প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড) #Part_ 10 [শেষাংশ]

0
971

#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_ 10 [শেষাংশ]
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— কেমন আছিস চাঁদ?

কথাটা কর্ণপাত হতেই দ্যুতি স্থির দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের পানে। বার কয়েক পলক ফেলে মৃদুস্বরে বলে,

— ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?

অরণ্য শ্লেষের হাসি হেসে বলে,

— এইতো আছি কোনমতে বেঁচে।

দ্যুতি এই কথার বিপরীতে কোন প্রত্যুত্তর করলো না। নীরব থেকে দেখতে লাগলো অরণ্যকে। হৃদস্পন্দনের গতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বুকের বা-পাশটায় চাপা কষ্টের তীব্রতা অনুভব হচ্ছে তার। দ্যুতিকে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরণ্য বলে উঠে,

— পড়ালেখা কেমন চলছে তোর?

— ভালোই৷

— কোন সমস্যা হচ্ছে না তো সেখানে? খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত করছিস তো নাকি?

দ্যুতি কথাটা শুনে মৃদু হাসে। আজও অরণ্য বদলায় নি, একটুও না। সেই আগের মতই দ্যুতির চিন্তাতে বিভোর সে। ক্ষণেই কিছু পুরনো দিনের স্মৃতি এসে ভিড় জমালো দ্যুতির মনের আঙ্গিনায়। দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানের পিছে এক গাছি চুল গুঁজে নিল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দু’টি ভিজিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

— কোন সমস্যা নেই ভাইয়া, আমি ভালো আছি। আর খাওয়া নিয়ে কোন অনিয়ম করছি না, আমি যাদের সাথে থাকছি তারা আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখছে।

— অহ আচ্ছা।

দ্যুতি ছোট করে বললো,

— হু!

অরণ্য আর প্রত্যুত্তর করলো না, নীরবে দেখতে থাকলো দ্যুতিকে। কিছু প্রহর এইভাবেই অতিবাহিত হতেই হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠে,

— বাবা, তুমি কার সাথে কথা বলছো?

‘বাবা’ সম্মোধনটা শুনে দ্যুতির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে, মন হয়ে উঠে উদ্বিগ্ন। সে নিষ্প্রভ দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে অরণ্যের পানে। অরণ্য ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়, দরজার সামনে দাঁড়ানো আদ্রকে দেখে অরণ্য কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— তোমার এক ফুপুর সাথে৷

আদ্র কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— ফুপু?

— হু! কথা বলবে?

আদ্র পুনরায় মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। অরণ্য হাত দিয়ে ইশারা করতেই আদ্র দৌড়ে চলে আসে। অরণ্য মেঝেতে এক পা ভাঁজ করে বসে আদ্র-এর সামনে ক্যামেরাটা ধরে। ক্ষণেই দ্যুতির ফোনের পর্দায় ভেসে উঠে ছিমছাম গড়নের হাস্যজ্জ্বল একটি চেহেরা। দ্যুতির দৃষ্টি একটু দৃঢ় হয়। আদ্র দ্যুতিকে দেখতে পেয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে উৎফুল্ল স্বরে বলে,

— আচ্ছালামুয়ালাইকুম!

এতক্ষণ দ্যুতি আনমনেই খুঁটিয়ে দেখছিল আদ্রকে। মিলানোর চেষ্টা করছিল অরণ্যের সাথে। ক্ষণেই সালামের উচ্চারণটা শুনে দ্যুতি একটু হেসে উঠে। স্থির দৃষ্টিতে তাকায় আদ্র-এর দিকে। মৃদুস্বরে বলে,

— ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছো?

— আমি সবসময় ভালো থাকি। তুমি কেমন আছো?

— আমিও ভালো আছি।

আদ্র ছোট একটা হাসি উপহার দিতেই দ্যুতি পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

— কি নাম তোমার?

— আদ্র!

নামটা শুনে দ্যুতি এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চোখ দু’টি কিঞ্চিৎ বড় করে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য তা দেখে কিছু না বলে কিঞ্চিৎ হাসে৷ দ্যুতি এইবার আবার আদ্র-এর দিকের তাকায়, দৃষ্টি তার নরম হয়ে এসেছে। একবার মজার ছলে দ্যুতি অরণ্যকে বলেছিল, তার ছেলে হলে তারর নাম রাখবে আদ্র আর মেয়ে হলে অদ্রি। দ্যুতি সরল মনে কথাটা বললেও, অরণ্য কথাটার মিনিং অন্যভাবে দ্যুতির সামনে উপস্থাপনা করেছিল। যার দরুন দ্যুতি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল।সেদিনের পর দ্যুতি লজ্জায় আর অরণ্যের সামনে বাচ্চাদের কথা উঠায়নি। কিন্তু অরণ্যের যে সেই নাম নিজের সন্তানের রেখে দিবে তা সম্পূর্ণই অপ্রত্যাশিত ছিল। দ্যুতি আদৌ ভাবেও নি নাম দু’টি তার মনেও আছে। দ্যুতি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আদ্র-এর দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমার নামটা অনেক সুন্দর, ঠিক তোমার মত।

আদ্র একটু ভাব নিয়ে বলে,

— সবাই বলে।

দ্যুতি কিছু না বলে হালকা হাসে আর দেখতে থাকে আদ্রকে। চেহেরায় তেমন মিল না হলেও স্বভাবে পুরাই অরণ্যের কার্বনকপি। আদ্র এইবার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলে,

— বাবা, সবাই চলে যাচ্ছে তো। তুমি যাবা না? আমি কিন্তু তোমার সাথে যাব।

অরণ্য মৃদু হেসে বলে,

— আমি একটু পরে যাব, আমার কিছু কাজ আছে। তুমি দিহান চাচ্চুর সাথে চেয়ে চলে যাও, কেমন?

আদ্র দুই দিকে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর দ্যুতিকে বায় বলে সে রুমের বাহিরে চলে যায়। দ্যুতি এতক্ষণে খেয়াল হলো, আদ্রকে তার বয়স অনুযায়ী বেশ বড় লাগছে৷ অরণ্যের বাচ্চা হলেও তো বড়জোড় দুই বা আড়াই বছর হওয়ার কথা কিন্তু আদ্রকে তার আরও বড় মনে হচ্ছে। নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেতে সে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করে,

— আদ্রর বয়স কত ভাইয়া?

অরণ্য কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে দ্যুতির দিকে তাকায়। স্বগতোক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— কেন?

— এইভাবেই। বলো না!

অরণ্য কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে,

— চার বছর চলছে৷

কথাটা দ্যুতির কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই দ্যুতি থমকে যায়৷ অবাক দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। কিভাবে কি? যেখানে তাদের বিয়েরই চার বছর পূর্ণ হয়নি, সেখানে আদ্রের বয়স সম্পূর্ণ চার কিভাবে হয়? দ্যুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষয়টা ভাবে, অতঃপর অস্ফুটস্বরে বলে,

— তার মানে..

অরণ্য নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

— যা ভাবছিস তাই, ওকে পালক নেয়া হয়েছে।

দ্যুতি চুপ হয়ে থাকলো। অতঃপর স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— নুরি আপু তাহলে কোথায়?

— কোথায় আর থাকবে, এইখানেই আছে।

দ্যুতি পুনরায় বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

— কেন করলে এমন? নুরিপুর দোষ কি ছিল, এমনটা কেন করলে তার সাথে?

অরণ্য শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— কি করেছি আমি?

দ্যুতি তেতে উঠে বলে,

— একদম না জানার ভাণ করবেন না। আপনি ভালো করেই জানেন আমি কি বলছি।

কথাটা বলে দ্যুতি কিছু প্রহর নীরব থেকে পুনরায় বলে,

— খুব কি দোষ হতো সবটা মেনে নিলে? কি হতো নুরিপুকে তার প্রাপ্য অধিকারগুলোর বুঝিয়ে দিলে?

অরণ্য উঠে দাঁড়ায়, অতঃপর এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। বিছানায় বসে সে বলতে শুরু করে,

— সব তো মেনেই নিয়েছি, সকল অধিকারও বুঝিয়ে দিয়েছি নুরিকে। স্ত্রী হিসাবে পরিচয়ও দিয়েছি, শুধু পারি নি একটা অধিকারই দিতে। আর সেটা দেওয়া আমার পক্ষে কোনদিন সম্ভব ও না।

— যে অধিকারটা দেননি সেটাই কিন্তু সকল অধিকারের উর্ধ্বে৷ স্বামীর কাছে একটা স্ত্রীর সর্বপ্রথম অধিকার সেটাই। আপনি কিন্তু ঠকাচ্ছেন নুরিপুকে, সেই সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ঠিকই আমাকে টেনে নিয়ে আসছেন আপনাদের মাঝে৷

— কিছুই করছি না আমি। কারণ নুরি সবটাই জানে আর ও নিজ থেকেই সবটা মেনে নিয়েছে। এমনকি আদ্রকেও ওর জন্য আনা হয়েছে।

দ্যুতি উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— মানে?

অরণ্য স্মিত হেসে বলে,

— আমি ওকে আমার সবটা আগেই জানিয়েছিলাম এমনকি এইটাও জানিয়েছিলাম আমার পক্ষে ওকে ভালোবাসা কোনদিনই সম্ভব নয়। আমি ওকে স্ত্রী মর্যাদা থেকে শুরু করে সকল চাহিদা পূরণ করবো ঠিকই কিন্তু তাও আমাদের মাঝে একটা অপূর্ণতা থেকেই যাবে। ও সবটাই মেনে নিয়েছিল। শুধু চেয়েছিল আমি যাতে ওকে না ছাড়ি, আজীবন ওর পাশে থাকি। বন্ধু হয়েই নাহয় আমরা থাকবো। হয়তো ভালোবেসে ফেলেছিল আমায় তাই আমাকে ছাড়তে পারেনি। আমিও আর অসম্মতি জনায়নি। সম্পর্কটা বন্ধুর মতই করে নিয়েছিলাম দুইজনে। এতে দুইজনই হ্যাপি ছিলাম। আর রইলো আদ্রর কথা? বছর খানিক আগে নুরি জানতে পারে সে কখনো মা হতে পারবে না, তাই নিজের জন্যই ও চেয়েছিল একটা সন্তান পালক নিতে৷ তাতে আমি দ্বিমত প্রকাশ করেনি, ওর জন্যই এনেছিলাম আদ্রকে। আর নিজের সন্তান হিসাবেই পরিচয় দিয়েছিলাম। সেই থেকেই আদ্র আমার আর নুরির ছেলে। নুরি কিন্তু ভালোই আছে চাঁদ।

সবটা শুনে দ্যুতি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর তার কি হলো কে জানে, সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে,

— আর আপনি?

দ্যুতির এহেন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে বলে,

— ভালো থাকতে শিখে গিয়েছি৷

দ্যুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। মিনমিনে কন্ঠে বলে,

— খুব কি ক্ষতি হতো নুরিকে একটু আগলে নিলে?

— আমি তো এখনো তারই মায়াকুঞ্জে বন্দী হয়ে আছি। অন্যের কুঞ্জে গিয়ে সমর্পন করার সাধ্য কি আমার আছে? বল তুই!

দ্যুতি কোন প্রত্যুত্তর করে না, নতজানু হয়ে বসে থাকে। ঘোলাটে হয়ে আসছে তার চোখে পরিহিত চশমাটি। নিজেকে আজ তার পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগী মানুষ মনে হচ্ছে। যে কি-না আসল ভালোবাসার স্বাদ পেয়েও পেল না, পারলো না আঁকড়ে ধরতে তাকে৷ প্রণয়ের সাগরে রচিত কাব্যগ্রন্থে তার প্রণয়ের ঢেউ ভাটা পড়েছে অতুল গভীরে। ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ হয়েছে সেই গল্পটা। দ্যুতি নিজেকে সংযত রাখতে এক হাতের মুঠোয় চেপে ধরে জামার একাংশ। অরণ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,

— আচ্ছা, আমি যাই। এইভাবেই দেরি হয়ে গিয়েছে। দেখা গেল, তোর সাথে আমিও বিয়ে মিস করে বসে আছি।

দ্যুতি নিজেকে সামলে বলে,

— হুম যান৷

— ভালো থাকিস চাঁদ।

— আপনিও।

অরণ্য কিছুটা সময় দ্যুতির দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা রেখে দেয়। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে,

— কি আজব এই পৃথিবী তাই না? ভালোবাসাহীন সম্পর্ক টিকে যায় বছরের পর বছর, অথচ ভালোবাসার সম্পর্কগুলাই হারিয়ে যায় আড়ালে-আবডালে।

অরণ্য দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পাঞ্জাবীর বা পকেটে দিহানের ফোনটা ঢুকিয়ে, উঠে দাঁড়ায়। রুমে একবার চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

____________

এইদিকে, দ্যুতি মিনিট দশেক বন্ধ হয়ে যাওয়া স্ক্রিনের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলো। ঝাপসা হয়ে আসা চশমাটা খুলে ভাঁজ করে রাখলো টেবিলের এক কোনে। চোখের কার্নিশের সিক্ততা খুব সপ্তপর্ণে মুছে নিল হাতের উল্টোপিঠে। মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,

— দায়ভার বুঝি আজ থেকে বেরে গেল আমার?

কথাটা বলে দ্যুতি হালকা হাসলো৷ ফোনটা চশমার পাশে রেখে হাত দু’টি ভাঁজ করে খুব সপ্তপর্ণে মাথাটা হেলিয়ে মুখ গুঁজে নিল। নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে শুয়ে থাকলো সেভাবেই৷ কিছু প্রহর, কিছু ঘন্টা।

_________________

— তুই কি বিয়ে করবি না? আজও একটা ভালো সম্মোধন না করে দিলি। এইভাবে আর কতদিন?

এনজিও থেকে বাসায় এসে ঢুকতে না ঢুকতেই শাহিদা বেগম কথাগুলো দ্যুতির উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন। দ্যুতি ডোরওয়েতে দাঁড়িয়ে জুতা খুলতে খুলতে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে,

— আবার শুরু হয়ে যেও না। তোমায় আমি আমার উত্তর আগেই জানিয়েছি। তাহলে প্রতিদিন এইভাবে ঘ্যানঘ্যান করার মানে কি?

শাহিদা বেগম তেতে উঠে বলে,

— বিয়ে করবি না বললেই হলো? এইটা কোন কথা?

— আমি এইসব নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। আর তোমার বা বাবার যদি আমাকে নিয়ে এতই সমস্যা হয় বলে দাও, আমি কালকের মধ্যেই শিফট হয়ে যাব।

তীক্ষ্ণ কন্ঠে কথাগুলো বলে দ্যুতি নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়৷ শাহিদা বেগম বিহ্বল দৃষ্টিতে দ্যুতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন৷ দ্যুতি নিজে রুমে গিয়ে দরজা দিতেই শাহিদা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে৷ নিজের রুমের দিকে গিয়ে, রুহুল সাহেবকে বলেন,

— তুমিই বুঝাও এখন তোমার মেয়েকে। সেই যে বিয়ে করবে না বলে ব্রত করে বসে আছে এখনো তা ভাঙার নামই নিচ্ছে না৷ এইভাবে কি দুনিয়া চলে?

রুহুল সাহেব নিউজপেপার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে একপলক শাহিদা বেগমের দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,

— আদৌ কাজ হবে বলে তোমার মনে হয়? এর আগে কম তো চেষ্টা করিনি।

— তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে তো থাকা যায় না। একমাত্র মেয়ে আমাদের। ওর বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কিছু স্বপ্ন আমাদের আছে তো নাকি? এইভাবেই মেয়ের বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। এখন শেষ চেষ্টা না করলে, সত্যি আশা ছাড়তে হবে।

— আচ্ছা, দেখা যাক। খাওয়ার সময় কথা বলে দেখবো নে।

রুহুল সাহেবের কথা শুনে শাহিদা বেগম কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।

_______________

ফ্রেশ হয়ে এসে দ্যুতি এককাপ কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। এক হাতের তর্জনী দিয়ে পড়নে চশমাটা নাকের দগায় ঠেলে দিয়ে কাজ করতে শুরু করলো। সে কফির কাপে টুকরো টুকরো চুমুক বসাচ্ছে আর আনমনে কিছু মেইল চেক করছে। মিনিট পাঁচেক পেরুতেই দ্যুতির মুঠোফোনটা বেজে করে উঠে। দ্যুতি পাশ ফিরে মুঠোফোনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ফোনের পর্দায় নিদ্রানের নামটি ভাসছে। দ্যুতি কফির কাপটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে ফোনটা নিয়ে নেয়। কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই নিদ্রান বলে উঠে,

— পাস্তা রেডি রাখো এডাল্ট বেবি। ইউর গেটস আর অন দ্যা ওয়ে।

দ্যুতি তেতে উঠে বলে,

— আগে জানালে কি তোমার পান থেকে চুন খসে পড়ে? আমাকে নাকে মুখে কাজ না করালে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না?

নিদ্রান হেসে বলে,

— একটুও না।

— বায়!

দ্যুতি কথা বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়৷ ফোনটা বিছানার উপর আলতো ভাবে ছুড়ে মেরে আধভেজা চুলগুলো খোপা করে নেয়। অতঃপর এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে৷ যতবারই নিদ্রান ওর বাসায় আসবে, ততবারই তার দ্যুতির হাতের পাস্তা চাই এই চাই। দ্যুতি নাকছ করলেও সে শুনবে না, যতক্ষণ না দ্যুতি পাস্তা বানিয়ে খাওয়াবে ততক্ষণ সে দ্যুতিকে জ্বালিয়ে মারবেই। তাই দ্যুতিও এখন আর কথা বাড়ায় না।

পাস্তা যখন প্রায় হয়ে এসেছে তখনই ডোরবেল বেজে উঠে। দ্যুতি পাস্তাটা চুলো থেকে নামিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। শাহিদা বেগমকে দরজা খুলতে দেখে দ্যুতি আর এগোয় না। দরজা থেকে ছয়-সাত হাত দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে এগিয়ে আসে দ্যুতির দিকে। ছোট ছোট হাত দু’টি দিয়ে দ্যুতির পা জড়িয়ে ধরে বলে,

— আই মিসড ইউ সো মাচ।

দ্যুতি কিঞ্চিৎ হেসে বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আলতো ভাবে একটি গাল টেনে আদর করে দেয়। মিষ্ট কন্ঠে বলে,

— কেমন আছে আমার মামপাখিটা?

নাদিরাহ মিষ্টি হেসে বলে,

— অনেক ভালো৷ তুমি কেমন আছো?

— আমিও অনেক ভালো।

হঠাৎ নাদিরাহ মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,

— তুমি কি আমার থেকে রাগ করেছ?

— কেন বলো তো?

— এই যে এতদিন আসি নি যে? দেখো আমার কোন দোষ নেই, সব দোষ পাপার। সেই আমাকে নিয়ে আসেনি।

দ্যুতি হালকা হেসে বলে,

— তাই নাকি তাহলে তো খবর লাগাতে হবে।

নাদিরাহ সম্মতি জানিয়ে বলে,

— হ্যাঁ একদম।

হঠাৎ পিছন থেকে নিদ্রান বলে উঠে,

— বাহ! এইখানে আসতে না আসতে সাইড চেঞ্জ? নট ডান ইয়ার।

কথাটা শুনে নাদিরাহ আর দ্যুতি হেসে উঠে৷ দ্যুতি এইবার নিদ্রানের দিকে তা কি বললে,

— দিশা কোথায়? আসেনি?

মুহূর্তেই দিশা পিছন থেকে বলে উঠে,

— আরেহ আছি, আছি। গাড়ি পার্ক করছিলাম তাই লেট হয়ে গেল।

— অহ আচ্ছা।

অতঃপর দ্যুতি হালকা হেসে ওদের বসতে বলে। নিজেও নাদিরাহকে নিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়ে। শাহিদা বেগম তো আগেই ছুটেছেন রান্নাঘরে দিকে সকলের জন্য নাস্তা বানাতে। তারা মিলে এইটা সেটা নিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে। মিনিট দশকের মাঝেই শাহিদা বেগম পাস্তার পাশাপাশি আরও কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করে ফেলেন এবং তা নিয়ে হাজির হন নিদ্রানদের সামনে। নাস্তার পর্ব চুকিয়ে নিতেই নিদ্রান দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমার সাথে আমার এনজিও নিয়ে কিছু কথা ছিল৷ সেই সাথে, কিছু মেইলও দেখানোর ছিল।

দ্যুতি নাদিরাহর সাথে খেলা করছিল, হঠাৎ নিদ্রানের কথা শুনে তার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলে,

— আচ্ছা, তাহলে আমার রুমে চল। সেখানে সব আলোচনা করে নেব।

কথাটা বলে দ্যুতি নাদিরাহ এর গালে টুকরো এক চুমু খেয়ে ওকে দিশার কাছে গিয়ে বসতে বলে। নাদিরাহও ভালো বাচ্চার মত দ্যুতির কোল থেকে নেমে পরে আর চলে যায় তার মায়ের কাছে। দ্যুতি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা দেয় নিজের রুমের দিকে। তারই পিছু পিছু নিদ্রানও হাঁটা দেয় সেদিকে।

প্রায় ছয় বছর ধরেই দ্যুতি আর নিদ্রান দুইজনেই একত্রে মিলে একটি বেসরকারি সংস্থা চালাচ্ছে। সংস্থাটির সূচনা নিদ্রান করলেও পরবর্তীতে তাতে দ্যুতি যোগদান করে। সেই থেকেই ইস্তাম্বুলের মাটিতেই নিজের জীবনটা গড়ে নেয় আর সেটেল হয়ে যায় সে৷ শাহিদা বেগম আর রুহুল সাহেব প্রথমে এতে নাখোশ হলেও পরবর্তীতে সবটা মেনে নেন৷ দ্যুতি তাদের বলেছিল, তাদের সকলকেই এইখানে একবারের জন্য চলে আসতে। কিন্তু দিহান তাতে রাজি হয়নি। নিজের ক্যারিয়ার আর জব ছেড়ে হুট করেই অন্য কোথাও সেটেল হওয়া যায় না, উপরন্তু সে নিজের জব থেকে খুশি ছিল৷ রুহুল সাহেব আর শাহিদা বেগমও প্রথমে ভিনদেশে রাজি হন নি কিন্তু মেয়ে ভিনদেশে একা থেকে যাবে বলে অগত্যা তারা দ্যুতির কাছেই চলে আসে। দ্যুতিও তাদের জন্য আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে নেয়। সেই থেকে তারা দ্যুতির সাথেই থাকে। বছরে মাসখানেক অবশ্য তারা দেশে গিয়ে ঘুরে আসেন ঠিকই কিন্তু দ্যুতি যায় না কোনবারই। ইস্তাম্বুলে পারি জমানোর পর শুধু একবার দেশে গিয়েছিল সে, দিহানের বিয়ের পর পর। দেখে এসেছি সেই মানুষটির সংসার। অরণ্য তাকে মিথ্যে বলে নি, আসলেই নুরি সুখী ছিল। মেয়েটা যে অল্পতেই খুশি থাকতে জানে সেটাই তার প্রমাণ। ছোট আদ্রও বেশ ছিল তাদের সাথে। অরণ্যও আদ্রকে ভালোভাবেই আগলে রেখেছিল, যেন সে তার নিজের সন্তানই। কিন্তু তবুও কোথাও যে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। দ্যুতি তখন সবটাই দেখে খুবই সপ্তপর্ণে ছেড়েছিল দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর আর ফিরে যায় না আপন দেশটাতে। পড়ালেখা শেষে নিদ্রানের সাথেই কাজ করা শুরু করে। প্রথম দিকে সংস্থাটা ক্ষুদ্র হলেও দ্যুতির কঠোর পরিশ্রমে সেটা বৃহত্তর আকার ধারণ করে। এখন প্রায় সকলেই এক নামে চিনে সেই সংস্থাটিকে।

জরুরী আলাপ শেষে নিদ্রান আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় হাত দু’টো পিছন দিকে পিছিয়ে নিয়ে নিজের ভর ছেড়ে দেয়। ব্যঙ্গবিদ্রূপের সুরে দ্যুতিকে বলে উঠে,

— আমি তো বিয়ে-শাদি করে এক বাচ্চার বাপও হয়ে গেলাম। কিন্তু আপনার তো কোন খোঁজখবরই নেই৷ এখন কি আমার মেয়ের বিয়ের বয়সের সময় বিয়ে করবেন?

দ্যুতি একপলক নিদ্রানের দিকে তাকিয়ে আবার ই-মেইল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে,

— মুড যদি তখন চেঞ্জ হয় করতেও পারি। বলা তো যায় না।

নিদ্রান মুখ ঘুচে বলে,

— বিয়ে করবে না বললেই হয়৷ কথা এইভাবে জিলাপির মত ঘুরাও কেন?

— উত্তর তো জানোই তাহলে আবার প্রশ্ন করো কেন?

হঠাৎ নিদ্রান কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করে,

— আচ্ছা, এমন বিয়ে বিদ্বেষী হওয়ার কারণটা কি?কোথাও ছ্যাঁকা-ট্যাঁকা খেয়েছিলে নাকি? ওর সামথিং! সামথিং!

শেষের কথাটা রসিকতার সাথেই বললো নিদ্রান। দ্যুতি কড়া দৃষ্টিতে নিদ্রানের দিকে তাকিয়ে বলে,

— সাট আপ!

নিদ্রান এইবার গম্ভীর মুখে দ্যুতির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— সত্যিটা কি বলা যায় না? কেউ কি ছিল তোমার অতীতে? যাকে তুমি ভালোবাসতে?,

আজ প্রথম নয় যে নিদ্রান এই প্রশ্নটা করছে। আগেও অনেক বার করেছে কিন্তু সে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আজ কেন যেন দ্যুতি চেয়েও কথাটা এড়াতে পারলো না। অগত্যা সে স্বীকার করলো,

— হ্যাঁ ছিল একজন।

— সে কি তোমায় ধোঁকা দিয়েছিল নাকি ছেড়ে চলে গিয়েছিল?

দ্যুতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি কিন্তু তাও আমার বিশ্বাস ভেঙেছিল। সে আমার সাথে প্রতারণাও করেনি কিন্তু তাও প্রতারিত হয়েছিলাম আমি। ঠুনকো হয়েছিল দুইজনের প্রণয়। পূর্ণতা পেয়েও পায়নি আমাদের প্রণয়ের ঢেউ। অথচ দোষ ছিল না কারোই। না আমার, না তার। সবই ছিল ভাগ্যের করুণ লীলাখেলা।

নিদ্রান বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— মানে? কি বুঝাতে চাইছো?

— তেমন কিছুই না।

— তাহলে খুলে বল।

দ্যুতি কথা কাটিয়ে যেতে যেতে বলে,

— সে অনেক কথা। অন্য কোন একদিন বলবো নে।

নিদ্রান কিছু বলতে গিয়েও বললো না, অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকলো। দ্যুতিকে সে কম হলেও দশ বছর থেকে দেখছে। প্রথম দিকে তাদের সম্পর্ক এত সুবিধাজনক নাহলেও, সময়ের সাথে সাথে বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে উঠে তাদের মাঝে। সেই সাথে, এখন তো প্রায় ছয় বছর ধরে কাজও করছে। দ্যুতি অনেক শক্ত মনোবলের মেয়ে তা নিদ্রান জানে। সে কখনো নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না, মেয়েটা ভাঙবে কিন্তু মোচকাবে না। তাই সে যখন এখন বলতে চাইছে না সেহেতু নিদ্রানও হাল ছেড়ে দিল। কি দরকার অতীত খুঁড়ে কাউকে অবোধ যন্ত্রণা উপহার দেওয়ার?

_________________

রাত তখন নয়টা ছুঁই ছুঁই। খাবারের টেবিলে বসে আছে রুহুল সাহেব, শাহিদা বেগম আর দ্যুতি। যে যার মত ডিনার করছে। নিদ্রানরা চলে গিয়েছে আরও ঘন্টাখানিক আগেই৷ দ্যুতি চুপচাপ খাবার খাচ্ছে আর মোবাইল স্ক্রোল করে কিছু একটা করছে। তা দেখে শাহিদা বেগম চোখের ইশারায় রুহুল সাহেবকে বললেন দ্যুতির সাথে কথা বলতে৷ শাহিদা বেগমের ইশারা বুঝতে পেরে রুহুল সাহেব গলা পরিষ্কার করতে কয়েক দফা কেশে উঠেন। ভিতরে ভিতরে কথাগুলো গুছিয়ে বলে,

— দ্যুতি মা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

দ্যুতি সচকিত দৃষ্টিতে রুহুল সাহেবের দিকে তাকায়৷ মোবাইলটা বন্ধ করে নিজের প্লেটের পাশে রেখে শীতল কন্ঠে বলে,

— হ্যাঁ, বাবা বল।

— বিয়ের ব্যাপারে কি তোমার মতামত কখনো বদলাবে না?

প্রশ্নটা শুনে ক্ষণেই দ্যুতির মুখে গম্ভীরতা ছেঁয়ে গেল। সে স্বগোতক্তি কন্ঠে বললো,

— না বাবা। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট৷

রুহুল সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,

— কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে কারণ কি? কেন তুমি বিয়ে করতে নাখোশ?

দ্যুতি স্থির কন্ঠে বলে,

— আমার ভালোবাসা-বিয়ে-সংসারের উপর কোন বিশ্বাস নেই তাই।

রুহুল সাহেব কিছু বলতে যাবেন তার আগেই শাহিদা বেগম বলে উঠেন,

— এ কেমন কথা? বিশ্বাস নেই বললো হলো? আর মানুষ কি বিয়ে করছে না? সংসার করছে না? তোর করলেই সমস্যা কোথায়?

রুহুল সাহেব শাহিদার বেগমের কথাতে সাঁই জানিয়ে বলেন,

— আসলেই সমস্যাটা কোথায় বলো? এমন ভাবনা পোষণ করার কারণটা কি?

দ্যুতি চামচ দিয়ে প্লেটের উপর আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,

— অনেক কারণই আছে কিন্তু সেসব তোমাদের আমি বলতে পারবো না। আপাতত শুধু এতটুকু জেনে নাও আমি বিয়ে করছি না।

শাহিদা বেগম পেতে উঠে বলেন,

— তুই বললেই হল? বলা সহজ হলেও এইভাবে একা জীবন পার করা যায় না। একটা অবিবাহিত মেয়েকে সমাজে কত কিছু সহ্য করতে হয় তুই জানিস? তার বাবা-মাকে কত কি কথা শুনতে হয়?

দ্যুতি এইবার চোখ তুলে শাহিদা বেগমের দিকে তাকায়। অতঃপর স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে,

— আমাকে নিয়ে যদি তোমাদের এতই সমস্যা হয় বলো, আমি অন্য কোথাও শিফট হয়ে যাব। তারপর শুনতে হবে না কোন কথা। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমি একবার এইখান থেকে গেলে আর ফিরে আসবো না। এমনকি কোথায় যাব তাও কিন্তু কাউকে জানতে দিব না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার কোন খবর পাবে না তোমরা৷ আর তোমরা ভালো করেই জানো, আমি যা বলি তাই করে দেখাই৷ তাই পরেরবার যদি আবার আমার উপর বিয়ে নিয়ে প্রেশার দাও তাহলে দেখো তোমরা।

কথাটা বলেই অর্ধেক খাবার রেখেই দ্যুতি উঠে দাঁড়ায়৷ নিজের মুঠোফোনটা হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে চলে যায় নিজের রুমের দিকে। দ্যুতির এহেন ব্যবহারে রুহুল সাহেব ও শাহিদা বেগম দুজনই অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি যে এত কঠোর হয়ে যাবে তারা কল্পনাও করেনি। ছোট থেকে দ্যুতি অবাধ্য আর প্রচন্ড জেদি তারা জানে। সে যা একবার বলে তাই করে ছাড়ে এই নিয়ে তাদের কোন সন্দেহ নেই। তাই দ্যুতি যেহেতু এই কথাটা বলেছে সেহেতু সে এইটা করেই ছাড়বে। সুতরাং, রুহুল সাহেব আর শাহিদা বেগমের জন্য আর কোন পথ খোলা রইলো না। হার মেনেই গেল তারা দ্যুতির সামনে। যত যাই হোক, নিজের মেয়েকে কিভাবে হারাতে দিবে তারা?

____________________

বারান্দার রেলিং-এর উপর দুই হাত রেখে নিজের শরীর ভড় ছেড়ে দিল দ্যুতি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নদীটির দিকে৷ এইখান থেকে বসফরাস নদীটি স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর কলধ্বনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশের মাধুর্য বাড়াতে। শীতল বায়ুর হালকা দোলে টুকরো টুকরো ঢেউ খেলা করছে নদীর বুকে। দ্যুতি নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো নদীটিকে। আনমনে ভাবতে থাকলো, প্রণয় জিনিসটাই এত অদ্ভুত কেন? তিন অক্ষরের এই শব্দ নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছে কতশত গল্প,আবেগ,অনুভূতি ও ব্যর্থতা। যা কখনো শেষ হবার নয়। এই প্রণয়ই কাউকে নতুন করে গড়তে পারে তো কাউকে ভেঙেচুরে নিঃস্ব করে দিতে পারে।

কথাটা ভেবেই দ্যুতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। কিছুটা সময় আপন ভাবনা থেকে বিরত থেকে পুনরায় ভাবতে শুরু করে,

— কতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছি আমি তাই না? নিজের কথার উপর আমল করতে স্বাচ্ছন্দ্যে বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে বসে আছি৷ কিন্তু আজ এইসব কথা না বললে কি তারা দমতো? হয়তো না। তারা আমার ভালোই চাইচ্ছে আমি জানি, কিন্তু আমার পক্ষে যে সম্ভব না অপর এক সত্ত্বাকে ভালোবাসা। যাকেই ভালোবাসতেই পারবো তার সাথে আদৌ কি সংসার করা সম্ভব? ভালোবাসাহীন সম্পর্ক টিকেই থাকে কম্প্রোমাইজ আর সেক্রিফাইসের উপর৷ আর দুইটাই যে আমাকেই করতে হবে, যেটা আমার দ্বারা সম্ভব না৷ ভালো তো আছি নিজের জীবনে, সুখে আছি, সুস্থসবল আছি। এর চেয়ে বেশি কি চাই? এইভাবেই নাহয় বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দিব।

ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে দ্যুতি৷ জীবনটাই বড় বৈচিত্র্য। তার চেয়েও বেশি বৈচিত্র্য এই প্রণয়। হঠাৎ সমুদ্রে স্নিগ্ধ ঢেউয়ের মত হানা দেয় জীবনে, রঙিন প্রজাপতির ছোঁয়া লেপ্টে দেয় মনের আনাচ-কানাচের। জোয়ারের মত আঁচড়ে পড়ে দাগ কেটে যায় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। কিন্তু কিছুক্ষণের মোহ দেখিয়ে চলে যায় ছলনা করে। ভাটা পড়ে যায় সকল স্মৃতির গহীনে। আবার এই প্রণয়েরই আছে একেক রুপ, একেক সংজ্ঞা। সকলের জন্য প্রণয়ের ঢেউ সুখকর না হলেও, কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য আর্শীবাদ। দিনশেষে, সে হয়ে উঠে কারো গল্পের পরিপূর্ণতা তো কারো গল্পের ব্যর্থতা।

~~~~সমাপ্ত~~~~

জানি এই প্লট হয়তো অনেকের অপছন্দের। কিন্তু এতে আমার কিছু করারই নেই৷ আমার প্লটই ছিল দুইজন বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া যুগলদের নিয়ে। যাদের ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না কিন্তু তাও তারা একে অপরের হয়নি। পূর্ণতা পায়নি। বলা বাহুল্য, এই গল্পের মেইন নায়ক নায়িকা অরণ্য আর দ্যুতিই। আর তাদের জীবনের শেষ পরিহাসটা নিয়েই পুরো উপন্যাসটা সাজানো।
সেই সাথে, কারো জন্য যে কারো জীবন থেমে থাকে না৷ জীবনে অনেক অনিচ্ছাকৃত জিনিস হয় তা আমাদের কখনোই কাম্য না কিন্তু তাও আমাদের মানিয়ে চলতে হয়। সেটাই এই উপন্যাসের মূল ছিল।
বাকি সেটা আপনারা নেগেটিভলি নেন আর পজেটিভলি সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু আমার মতে গল্প বাস্তবিক দিক দিয়ে হ্যাপি এন্ডিং৷

আর, প্রথম খন্ডে অরণ্য ও দ্যুতির ভালোবাসা দেখানোর মূখ্য কারণ ওদের বিচ্ছেদের কষ্টটা আপনাদের বুঝানো। বিচ্ছেদ শব্দটা যতটা না ছোট তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই তীব্র যন্ত্রণাটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম।
এখন হয়তো অনেকেই বলবেন, অরণ্য আর নুরীর সম্পর্কটা ভিত্তিহীন।ভালোবাসাহীন সম্পর্ক টিকে না। তাহলে বলবো আমাদের সমাজে এমন সম্পর্ক অহরহ আছে, শুধু তাদের দেখে বুঝা যায়না। আমি সেরকম একটা যুগলই এই উপন্যাসে তুলে ধরেছিলাম।

বাদ বাকি, আপনাদের ফিলিং যদি আমার জন্য হার্ট হয় তাহলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here