#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৩০,৩১
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৩০
রাহির চিৎকার শুনে সৈয়দ নওশাদ ও আফিয়া আহমেদ দুইজনেই উপরের দিকে তাকায়। উপরের তাকাতেই দুজনে বেশ অবাক হয়ে যায়। কেননা সেখানে রাহি অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে আফিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে। সৈয়দ নওশাদ ও আফিয়া আহমেদের কপালে ভাজ পরে যায়। রাহি কি সব শুনে নিয়েছে তাহলে! কি হবে এখন। ভাবছে সৈয়দ নওশাদ। আফিয়া আহমেদের চোখ কিছুটা সংকোচিত হয়ে যায়। সে ভীতু চোখে রাহির দিকে তাকায়। ধীর পায়ে রাহি নীচে নেমে আসে। পায়ের সাথে পা লেগে নিচে পরে যেতে নেয় রাহি। সৈয়দ নওশাদ তাকে ধরতে গেলে সে হাত উঠিয়ে তাকে আটকে দেয়। আর বলে,
– আমি নিজেকে সামলাতে জানি সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। রাহির শক্ত কণ্ঠস্বর।
রাহির মুখে এমন কথাশুনে অবাক হয়ে নিঃপলক ওর দিকে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদ। এর আগে কোন দিনও রাহি তার নাম ধরে ডাকে। সৈয়দ নওশাদ রাহিকে কিছু বলবে তার আগেই সে তাকে পাশ কাটিয়ে আফিয়া আহমেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আফিয়া আহমেদ করুন চোখে তাকিয়ে আছে রাহির মুখ পানে। অতঃপর রাহি বলে উঠে,
– এটা তুমি কেন করলে মা। আমি- কি তোমাকে একবারও বলেছি রাহনাফ কে আমার চাই। রাহনাফকে এনে দাও। তাহলে এমনটা কেন করলে তুমি মা। আজ যদি আপুর কিছু হয়ে যেত তাহলে! তাহলে কি হতো তার মা আর বোনের সেটা একবারও ভেবে দেখেছো। মাহবুবা আন্টির কথা ভেবেছো ুএকবার। আপু ছাড়া তার আর কে আছে! মা, তুমি কাজটা ঠিক করোনি। তার থেকে তুমি আমায় মেরে ফেলতে। কারন ওদের দুজনের মাঝে আমি এসেছি। তোমাকে মা বলে ডাকতে ঘৃনা হচ্ছে আমার। কান্নামিশ্রত কন্ঠ রাহির।
– রাহি,,, ধমকের সুরে বলে আফিয়া আহমেদ। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছো তুমি। মুখ সামলে কথা বলো। ভুলে যেওনা আমি তোমার মা।
– আমি ভুলি নি তুমি আমার মা, তাইতো এখনো ভালো ভাবে কথা বলছি। আর যদি ভুলতে পারতাম তাহলে সবচেয়ে বেশী খুশি হতাম আমি। একটা খুনি কখনো আমার মা হতে পারে না।
রাহির মুখে খুনি শব্দটা শুনে কেপে উঠে আফিয়া আহমেদ। প্রতিধ্বনির ন্যায় বারবার শব্দটা তার কানের কাছে বাজতে থাকে। ধপ করে সুফায় বসে পরে সে। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে। কানের কাছে তখন শুধু একটা কথাই বাজতে থাকে “একটা খুনি কখনো আমার বোন হতে পারে না ” বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। নাহ, বিকট শব্দ করে চিৎকার করে উঠে আফিয়া আহমেদ। উঠে দাঁঠিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আমি খুনি নই। আমি এমনটা করতে চাইনি। খুনি নই আমি। তারপর দৌড়ে সে উপরে চলে যায়। রাহির তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখ-মুখে ঘৃনা উপচে পড়ছে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। অতঃপর বলে,
– ঘৃনা করি তোমাদের। তোমাদের সবাইকে ঘৃনা করি আমি। জানো মা আমার এখন খুব আফসোস হয় কেন মাহবুবা আন্টি আমায় পেটে ধরে নি। তাহলে তো তোমার মতো খুনিকে মা বলে ডাকতে হতো না।
রাহির বলা কথাগুলো শুনছিলো সৈয়দ নওশাদ। সে রাহির কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদ। মাহবুবাকে মা হিসাবে চায় রাহি এটাও তার শুনতে হচ্ছে। রাহি চলে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে এক পা বাড়াতেই পিছন থেকে সৈয়দ নওশাদ তাকে ডেকে উঠে,
– রাহি,,
থমকে দাঁড়ায় রাহি। পিছনের দিকে ঘুরে সৈয়দ নওশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে,
– কিছু বলবেন আপনি?
– এভাবে কথা বলছিস কেন মা?
রাহি তার ডান হাতটা উচু করে বলে,,
– চুপ করুন আপনি। আপনি কারো বাবা হতে পারেন না। যে নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে পারে না। তাকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে পারে না। সে আবার বাবা হয় কি করে। কি ভুল ছিলো মেহের আপুর। কান্নামিশ্রত কন্ঠে প্রশ্ন করে রাহি। সৈয়দ নওশাদ অবলার মতো তাকিয়ে থাকে রাহির দিকে। রাহি তো কিছু ভুল বলছে না। সত্যিই তো মেহেরের তো কোন ভুল ছিলো না। তবুও তাকে কেন আমি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হলো। সৈয়দ নওশাদের ভাবনার মাঝেই রাহি বলে উঠে,
– আজ আপুর সাথে সেটা হয়েছে সেটার জন্যে আপনি দায়ী। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভাবে আপনিই দায়ী।সুন্দরী বউয়ের মোহে পরে অন্ধ হয়ে গেছেন আপনি সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। আপনি জানেন আপনার বউ আমার আপুকে মেরে ফেলতে চেয়েছে তবুও আপনি তাকে বিরুদ্ধে কোন একশন নেন নি। একজন বাবা হয়ে এমনটা কি করে করতে পারেন আপনি। আসলে আপনি কারো বাবা হতে পারেন না। কারো বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই আপনার সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। না ভালো বাবা হতে পরেছেন আর না হতে পরেছেন ভালো সন্তান। বউয়ের কথা শুনে নিজের মা-কে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন। এমনটা করবেন না। এখনো সময় আছে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিন। কথাগুলো বলা শেষে রাহির চোখের কোটর গড়িয়ে অশ্রু বের হয়। তবুও সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদের দিকে। একদিন এই মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতো। আর আজ তাকে শুধু ঘৃনা করতে ইচ্ছে করছে। বাবা হিসাবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে রাহির।
সৈয়দ নওশাদ নির্বিকায় রাহির মুখ পানে তাকিয়ে আছেন। রাহির বলা প্রতিটা কথাই ঠিক। সে ভালো বাবা হতে পারেনি। বাবা না থাকার কারনে আজও মেহেরকে নানা কথা শুনতে হয়। মেহেরের কোন দায়িত্বই সে নেয়নি। মেহের যে তার সন্তান সেটা সমাজ সমাজের মানুষ তারা কেউও জানেনা বললেই চলে। কিন্তু সে তো মেহেরকে জন্ম দিয়েছে। তাহলে সে কোথায় বাবা হতে পেরেছে। রাহুর দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।
৪০,
মেহের ঘুমাচ্ছে আর ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে ঝিমুচ্ছে রাহনাফ। মেহের কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে তখন রাহনাফ ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথায় জাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারপর সে ঘুমন্ত মেহেরের মুখপানে কিছুক্ষণ অবলোকন করে কপালে নিয়ে ওষ্ঠদ্বয়ের শীতল স্পর্শ দিয়ে দেয়। রাহনাফ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠে,
-যত দেখি তোমায় তত লাগে ভালো,কি এমন মায়া তোমার মাঝে বল? আমিতো চাইনি প্রেমের জালে জড়াবো কভু,তোমার ভালোবাসায় মজনু হলাম তবু।মন আমার নিজের ঠিকই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আর আমার হাতে নেই,তোমার সৌন্দর্যের সম্মোহনী শক্তির বলে,
আষ্টেপৃষ্টে আমায় জড়ালে!দু চোখ শুধু তোমায় খুঁজে, মন চায় তোমায় পেতে, শুধু এ জীবনে নয়, মরণের পরেও চাই তোমায়।
ঝিমুতে ঝিমুতে পরে যেতে নেয় রাহনাফ তখনি সে চমকে উঠে। আশপাশ একপলক তাকিয়ে আবারও সামনে তাকায় সে। মেহের এখনো গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। রাহনাফের এক হাত জড়িয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। নাকটা হালকা ফুলিয়ে কি সুন্দর করে শ্বাস নিচ্ছে মেহের। ঘুমন্ত মেহেরকে আজ একটু বেশীই আকর্ষণীয় লাগছে। ইচ্ছে করছে মেহেরের অধোরের নিচে থাকা ওই বাদামি তিলটাতে অধোর ছুঁইয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তো সে সম্ভব নয়। সে নিজের চোখটা নামিয়ে নিচের দিকে নিক্ষেপ করলো।
সেদিনের পর আজ প্রায় সপ্তাহ খনেক কেটে গেছে। রাহি নিজেকে তার ঘরে বন্ধি করে রেখেছে। বাসা থেকে বের হচ্ছে না সে। এমনকি মেহেরকে দেখতেও পর্যন্ত আসেনি। দুদিন আগে মেহেরকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। রাহনাফ রোজ বিকালে মেহেরকে দেখতে আসে। সৈয়দা মাহবুবার রাহনাফকে খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি মনে মনে এমন একটা ছেলেকেই তো চেয়েছেন মেহেরের জন্যে।যে মেহেরকে ভালোবাসবে যত্ন নিবে ভরসা হয়ে ওর পাশে থাকবে। রাহনাফকে দেখে তার মনে হয়ে এটাই যেন মেহেরের জন্যে যোগ্য পাত্র। তিনি মনেমনে ঠিক করে ফেলেছেন মেহেরের বিয়েটা রাহনাফের সাথেই দিবেন।
রাহির মেহেরদের বাড়িতে আসছে না দেখে বেশ অবাক হচ্ছে মেহের সহ পরিবারের বাকি সবাই। সৈয়দা মাহবুবা তো আজ সকালে বলেই ফেলছেন, রাহি কেন আসছে না তার খোজ নিতে। মেয়েটার শরীর ঠিক আছে। মায়ের কথা শুনে মৃদু হাসে মেহের। মনে মনে বলে,
– তুমিও না মা পারোও বটে। রাহিকি আর রোজ আমাদের এখানে আসবে। অট্টোলিকার মানুষ ও। বিলাসিতায় বড় হয়েছে। ওর মন যখন যা বলে তাই করে।ও কি আর আমাদের সাথে এই চিলেকোঠায় মিশতে পারে। আবেগের বসে দুদিন এসেছে এটাই অনেক।
রাহিকে কয়েকবার কল করে আলিহান। প্রতিবারই ওর মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে তাই বাধ্যে হয়ে নিজের জেদ ভেঙে ওদের বাড়িতে পা রাখে সে। নিজের জন্যে না হলেও রাহির জন্যে আবার সৈয়দ আহমেদ বাড়ির দরজায় পা রাখে আলিহান।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩১]
দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার উপর বসে আছে রাহি। ওর পাশেই বসে আলিহান অধোর কামড়াচ্ছে আর চোখ মিটমিট করছে। ওর ভাবতেই অবাক লাগছে আফিয়া আহমেদ এমন একটা কাজ করেছে। আর সৈয়দ নওশাদ সবটা জেনেও তাকে এ বাড়িতে তাকতে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে লিগালি কোন একশন নিচ্ছে না। আফিয়া আহমেদ যা করেছে তার জন্যে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ। অথচ সৈয়দ নওশাদ সব জেনেও চুপ করে আছে। এই তার পিতৃত্ব। আলিহান কি করে মেহেরের সামনে সত্যিটা তুলে ধরবে। মেহের যদি সবটা জানতে পারে তাহলে কষ্ট পাবে অনেক। তার থেকেও বেশী কষ্ট পাবে তার ছোটমনি। যে অতীত কে ছেড়ে চলে এসেছে সেই অতীত যদি আবার বর্তমান হয়ে আসে তাহলে যেন অতীতের সেই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে উঠে। সৈয়দা মাহবুবা অনেক কষ্ট করে এতদূর এসেছে। একা পরিশ্রম করে মেহেরকে বড় করে তুলেছে। অনেক কষ্টে সে তার অতীত ভূলে বর্তমানে একটা সুন্দর জিবন পেয়েছে। মেহের আর মৌ-এর মতো দুটো মেয়ে আছে। তাদের একসাথে দেখলে মনে হয় এটা যেন স্বর্গের দ্বীপ। সেখানে আছে সুখ আনন্দ হাসি। আলিহান চায়না সৈয়দা মাহবুবার এই সুখের স্বর্গে নওশাদের মতো হৃদকালো মানুষের নজর না পরে। মেহের ও তার ছোটমনির উপর যেন সৈয়দ নওশাদের কোন ছায়াও না পরে। তাই সে পারবে না, না আলিহান পরবে না তার ছোটমনিকে আবার কষ্ট দিতে। কাপাকাপা হাতে রাহির মাথায় হাত রাখে আলিহান। রাহি মাথা তুলে সামনের দিকে তাকায়। রাহির চোখ দেখে আতকে উঠে আলিহান। কেমন ভিতী চোখ তার। এই চোখে আছে শুধু অনুতাপের ছোয়া। আলিহান রাহিকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। রাহি আলিহানের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
– আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল ভাইয়া। আমি এই অমানুষগুলোর সাথে আর থাকতে চাই না।
আলিহান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর উপরের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। রাহি আবারও বলে উঠে,
– আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল ভাইয়া।
আলিহানের হাত থেমে যায় এই ভেবে যে আজ প্রথমবার রাহি তার কাছে কিছু চাইছে আর সেটা আলিহান তাকে দিতে পারবে না। আলিহান যতই দূরেই থাকুক, যতই যে তার চাচার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করুক না কেন? এতে তো আর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না। রাহি যে ওর বোন। আর বোনের আবদার পূরণ করতে না পারার কষ্ট শুধু একজন ব্যার্থ ভাই-ই জানে। আলিহান রাহিকে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে ওর এক হাত নিজের হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। তারপর সে রাহির মুখের দিকে তাকায়। রাহির তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আলিহান রাহির হাতটা আরো শক্তকরে চেপে ধরে বলে,
– আমার দিকে তাকা। আমার চোখের দিকে তাকা রাহি।
রাহি মাথা তুলে আলিহানের চোখের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অতঃপর আলিহান বলে উঠে,
– এ বাড়ি ছেড়ে তুই কোথায় যাবি পাগলী। এ বাড়ি তোর। তুই এই বাড়ির রাজকন্যা। তুই চলে গেলে যে এই বাড়ির প্রাণটাও চলে যাবে রে রাহি।
– কিন্তু আমি ওই মানুষগুলোর সাথে এ বাড়িতে থাকতে পারবো না ভাইয়া। ওরা কেউই মানুষ নয়। ওরা দেখতে মানুষের মতো ঠিক-ই কিন্তু ওরা আসলে জন্তু জানোয়ার। না-হলে মেহের আপুর মতো এমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারতো না। কান্নামিশ্রত কন্ঠ রাহির।
– আমি তোর কষ্টটা ফিল করতে পারছি রাহি। কারন আমিও একদিন এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। সেদিন আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি কিন্তু তুই যাবি না। দেখ ছোট চাচা তোকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। তোর সব কথাই সে শুনে। একমাত্র তুই-ই পারিস ওদের সঠিক পথে আনতে। ওদের সব ভুল শুধরে দিতে পারিস। দেখ তুই ওদের সন্তান। তোকে ছোট থেকে বড় করেছে তারা। তোর কথা নিশ্চয় শুনবে। একটা সন্তান হিসাবে এটা তোর দায়িত্বের মধ্যে পরে। ইসলাম যেমন পিতামাতার সব কথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে তেমনি পিতামাতা যদি কোন পাপ কাজ করতে বলে সেটা অমান্য করার ও নির্দেশ দিয়েছে। তবে সেটা তাদের কষ্ট দিয়ে নয়। বরং তাদের সাথে সদ্যব্যবহার করে। এটাও আল্লার নির্দেশ,
-বাবা এবং মা কাফের-অবিশ্বাসী, গুনাহগার বা পাপাচার যা-ই হোক না কেন কখনো সুসম্পর্ক নষ্ট বা ছিন্ন করা যাবে না। সন্তানের জন্য বাবা-মার সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট করা বা ছিন্ন করা বৈধ নয়। তবে তাদের কথায় বা নির্দেশে ইসলামি শরিয়তের বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। কোনো কাজে আমল করা যাবে না। তাদের গুনাহের কাজের অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে না।
ইসলামি শরিয়তের বিপরীতে তাদের অনুসরণ এবং অনুকরণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তাদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের সঙ্গে ভালো ও উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। বাবা-মা অন্যায় কাজে জড়িত থাকলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে নরম ও কোমল আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। দুটি বিষয়ই খুব সতর্কতার সঙ্গে ম্যানেজ করতে হবে। এবার তুই কি করবি সেটা একান্তই তোর ইচ্ছে তাদের বুঝিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করবি নাকি তুই ও তাদের মতো অন্যায় করবি।
ভালো শ্রোতার মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে আলিহানের কথা শুনছিলো রাহি। সব শুনে সে নাক টেনে বলে,
– আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু তাতেও যদি তারা নিজেকে না শুধরে নেয় তাহলে আমি তাদের শাস্তি দিবো। কঠিন শাস্তুি।
– এই তো লক্ষি বোন আমার। বলেই রাহিকে জড়িয়ে ধরে আলিহান। আর তখনি রুমে প্রবেশ করে আফিয়া আহমেদ। ওদের দুজনকে এক সাথে হাসতে দেখে আফিয়ার মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। সে এখানে এসেছিল আলিহানকে ডাকতে। সৈয়দ নওশাদ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। এখানে এসে দুজনের মাধ্যে এত ভাব দেখবে সেটা ভাবতে পারেনি আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমেদকে দেখে আলিহান রাহিকে ছেয়ে একটু নড়েচড়ে বসে। আফিয়া আহমেদ আড় চোখে একবার রাহির দিকে তাকিয়ে থেকে আলিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– তুমি আবার কোন মন্ত্র দিলে আমার মেয়েটাকে। দেখ আলিহান আমার মেয়েকে আমার বিরুদ্ধে উসকানোর চেষ্টা করবে না। না হলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। বলে দিলাম।
আফিয়া আহমেদের কথা শুনে স্মিত হাসে আলিহান। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে নাক চুলকিয়ে বলে উঠে,
– একদম সিরিয়ালের মায়েদের মতো কথা বলছেন আপনি। বলছি যে সিরিয়াল একটু কমকম দেখবেন। আচ্ছা একটা বলুন, ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখে দেখেই শিখেছেন! কি করে সতিনের সন্তানকে মারতে হয় তাইতো।
আলিহানের কথাশুনে শুকনো ডুকগিলে আফিয়া আহমেদ।
– মানে কি- কি বলতে চাইছো কি তুমি?
– নাথিং। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে আলিহান। রাহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
– আমি আসছি বোন। নিজের খেয়াল রাখিস।
রাহির মৃদি হেসে আলিহানকে বিদায় জানায়। অতঃপর প্রস্থান করে আলিহান।
৪১,
বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে মেহের। ওর পাশেই বসে মৌ গুনগুনিয়ে গান গাইছে। ওর থেকে কিছুটা দূরে টেবিলের কাছে বসে আছে রাহনাফ। রাহনাফ বসে বসে কিছু আঁকছে আর একটু পরপর আড় চোখে মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। মেহের ব্যপারটা লক্ষ করলেও কিছু বলছে। এতে ওর অনেক ভালো লাগছে। মৌ মোবাইল নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিক কি হচ্চে না হচ্চে সেটা খেয়াল নেই তার। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ হাতে ইয়া বড় একটা ছবি নিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। ছবিটা দেখেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের। এত বড় একটা ছবি একেছে রাহনাফ তাও সেটা মেহেরের। খুশিতে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে মেহের। রাহনাফ এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে এটা জানতো না মেহের। নিচের ঠোঁটে ঝুলান্ত মৃদু হাসি দেওয়া আছে ছবিটায়। গভীর ভাবে না দেখলে কেউ এই হাসিটা দেখতে পারবে না। ছবির নিচে থাকা ক্যাপশন টা দেখে আরো অবাক হয় মেহের। হাতের লেখাগুলো দেখলে মনে হবে যেন কম্পিউটারে টাইপিং করছে। ইতালিয়ান অক্ষরে লেখা আছে,
– আমার দিনের উজ্জ্বলতা রোদের উপর নির্ভর করে না বরং তোমার হাসির উপর নির্ভর করে, লেখিকা সাহেবা।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।