হিজিবিজি(৮ম পর্ব)

0
951

গল্পঃ #হিজিবিজি(৮ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

তাহলে জাবের আজকেই কেন আমাদের মধ্যে আহানকে আনতে গেলো। এটা জাবেরের কেমন পরিকল্পনা?

কেমন যেন একটা অন্য রকম ভয় আমাকে তাড়া করছে। কপালে মিহি ঘাম নিঃসৃত হচ্ছে!
ঠিক সেই মূহুর্তেই জাবের বলতেছে
___ কিরে সে কোথায়?

আমি আরো অবাক হলাম। সে আবার কে?

আহান পেছনে তাকিয়ে বললো..
___ওয়াশরুমে গেলো, এখনি আসবে। চল আমরা বসি।

জাবের আমার পাশে, আর আহান আমার বরাবর। অস্বস্তি লাগছে,সামনে তাকাতে পারছিনা। নিচে নিজের পায়ের দিকে নজর করে কাচুমাচু হচ্ছি।
হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে লাফিয়ে উঠলাম। কারণ এই কণ্ঠটা আমি কাল শুনেছি৷
হ্যাঁ এটাই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে আমার এতো প্রশ্ন! জাবেরের বন্ধু শ্রেয়া যাকে আমি তার প্রেমিকা বলেই জানি।

মেয়েটা এসেই আহানের সাথে বসেছে। আর হাত দিয়ে আহানের চুলের উপর হাত দিয়ে বলতেছে।
___এলোমেলো হয়ে আছে চুলগুলো, ওখান থেকে ঠিক করে আসতে পারতে।

আহান মাথা পেতে দিয়ে হেসে বলতেছে..
___ঠিক করে দেওয়ার জন্য তুমি আছোনা?

আমি চোখ বড় বড় করে জাবেরের দিকে তাকালাম। জাবের আমার দিকে তাকিয়ে এক গালে হাসলো। অদ্ভুত কান্ডকারখানা চলছে আজব!
মেয়ের বিহেভিয়ারে মনে হচ্ছে এই ছেলে তার জামাই।
মনে মনে ভাবছিলাম আর মেয়েকে বকছিলাম, কিন্তু তখনই জাবের বললো..
___ এই যে এতো ভাবতে হবেনা ওরা স্বামী স্ত্রী,
কালকেই বিয়ে করেছে।

আমি এটা ভাবছি জাবের কিভাবে জানলো। তার অনুমান এতো কড়া বাবাহ!
কিন্তু এখন আমি আরো ঘোরপ্যাঁচে পড়ে গেলাম। আম্মু তো বললো কালকে আমাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে,আমাদের বাড়িতে অন্য কারো বিয়ে হয়নি।
আর সকালে জাবের ফোনে কথা বলছিল আহানের সাথে, সেখানে বলছিল..
___ ওরেএ আহাইন্না এতো চিন্তা করতে হবে না। তোর ভালোবাসা তোর কাছেই ফিরিয়ে দিবো। ওর চেহেরাটা দেখতে হচ্ছে বলেই আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কুল ম্যান, তোর ভালোবাসার মানুষকে তুই তারাতাড়িই পেয়ে যাবি, আর আমি আপন করে নিবো আমার ভালোবাসাকে!

অথচ আহান কাল বিয়ে করে ফেলেছিল। তাহলে জাবের এসব বলছিলো কেন?সেসময় আমার চিন্তার বাঁধ ভেঙে আহান বলে উঠলো..

___রিতা তোমাকে কিছু বলা হয়নি৷ আমরা দুজন দুজনকে বহু আগ থেকেই ভালোবাসি৷ কাল আমার আর জাবেরের সিদ্ধান্তেই এসব হয়েছে। তবে আমরা কাজী অফিসে বিয়ে করেছি৷ তুমি জানোই আমি বাবার এক ছেলে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে তার এক নিকটাত্মীয়ের সাথে। এদিকে আমি আমার ভালোবাসাকে হারাতে চলেছিলাম, তখন জাবের বললো শ্রেয়ার মা, মানে জাবেরের খালাকে জাবের মেনেজ করতে পারবে। আমি যেন আপাতত বিয়েটা করে ফেলি। আর আমার বাবা বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলে আর কিছু বলতে পারবেনা৷ আর শ্রেয়ার পরিবারে তার বড় বোন আমাদের ব্যপারে জানে৷ আর কেউ কিছু আঁচ করতে পারবেনা কারণ শ্রেয়া চাকরির জন্য এখানেই একা বাসা নিয়ে থাকে। আমি কালকে আমার মাকেও জানিয়েছি। মা বলেছে কয়েকদিন দুজন এখানেই থাকতে। বাবার রাগ কমলে তারপর শ্রেয়াকে আমাদের বাড়িতে বরণ করে নিবে৷

এতটুকু বলে আহান শ্রেয়ার দিকে তাকালো। দুজনের মুখে মিষ্টি একটা হাসি। বাহ দুজনকে সত্যি কি সুন্দর মানিয়েছে!
মাথা থেকে পাথর সরলো। যাক এই বিষয়টা ক্লেয়ার হলাম। কিন্তু আহান যদি শ্রেয়াকে অনেকদিন ধরে ভালোবেসে থাকে সেই অনেকদিন তো কম হলেও বছরখানেক হবে! কিন্তু তার সাথে আমার কথা বন্ধ হয়েছে মাস পাঁচেক আগে। আমার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সে শ্রেয়াকে ভালোবাসতো?
কিভাবে এতো নিখুঁত এক্টিং করে আহান,আর জাবের?

আমি জাবেরের হাস্যজ্বল মুখটার দিকে তাকালাম, বহুদিন হয়ে গেছে তাকে এভাবে দেখা হয়নি আমার!
জাবের এই মূহুর্তে প্রচুর হাসতেছে, এতো হাসছে কেন? আহান জাবেরকে লক্ষ্য করে বললো..
___ কিরে এবার তুই তো কিছু বল?

___ আমি কি বলবো তুইই বলতে থাক আমি একটু আসছি। তোরা খাওয়া শুরু কর।

বলেই জাবের বেরিয়ে গেলো।

আহান খুব বিনয়ী সুরে বলে উঠলো.
___রিতা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। তবে তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো নি। তুমি আমাকে কখনোই ফোন দিতেনা,কিন্তু যেদিন জাবের শ্রেয়াকে নিয়ে ছবি পাঠাতো সেদিন তুমি আমাকে ফোন দিয়ে ঘুরতে যেতে বলতে, আমার শত কাজ থাকলেও তুমি মানতে না। এরপর জাবের এসব বন্ধ করে দিলো আর তুমিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে।
প্রথমদিকে আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আর শ্রেয়া তো জাবেরের ছোট বেলার সঙ্গী তাই সে জাবেরের সবকিছুই জানে। তোমার সাথে প্রথম কয়েকমাস রিলেশনে আমি বুঝতে পেরেছি আসলে কোনো একটা রহস্য আছে,নাহলে তুমি এমনিতে কোনো কেয়ার করো না,অথচ একেকদিন খুব পাগল পাগল হয়ে যাও আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে৷ এরপর সেখানে গিয়ে কথা নেই,একটু হাসিখুশি অনূভুতি নেই,যতক্ষণ থাকো ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকো। এরপর চলে যাও।
এটা নিয়ে আমি ডিপ্রেশনে ছিলাম,তখন শ্রেয়ার সাথে আমার যোগাযোগ হয়, বন্ধুত্ব হয়। তারপর তোমার ব্যাপারে সব আমাকে জানায়৷ শ্রেয়াকে জাবের বলেছিল আমাকে তার ব্যপারে জানাতে৷ এদিকে এটাও বলেছে তুমি যেন কিছু বুঝতে না পারো। শ্রেয়ার সাথে সবসময় এসব ব্যপার নিয়ে কথা হতে হতে কোনো এক সময় আমরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে যাই। সবকিছুই ঠিক ছিল শুধু জাবের আর তুমি ছিটকে ছিলে! আর বাস্তবতা ছিল অভিনয়, জাবের শ্রেয়াকে নিয়ে অভিনয় করতো আর আমি তোমাকে নিয়ে। আমরা তিনজন বিষয়টা জানলে একমাত্র তুমিই জানতেনা।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাকিয়ে বললাম..
___ জাবের আমাকে ছেড়ে গেলো কেন? আমি তো বিচ্ছেদের কথা বলিনি। সেই প্রথম আমার কাছে নতুন সম্পর্কের জন্য দু’আ চেয়েছে। এসব কি তাহলে? কেন এমন করলো, যদি ভালোবেসে থাকে? কেন ইচ্ছে করে দূরে সরে গেলো?

এতক্ষন আহান কথা বলছিল এখন শ্রেয়া আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো .
___ শুনো বোন, ভুল বুঝোনা। ভুল বুঝাবুঝির পালা অনেকদূর এগিয়েছে। জাবেরের এটাই ভুল ছিল।
সে কেন এমন করলো! আসলে তোমার সাথে তার তখন প্রায়ই ঝগড়া হতো, তার একটা কারণ সে তোমাকে সময় দেয়না। কারণ সে তখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতো,কিভাবে নিজেকে সফল করবে। আর তোমার বাবার কাছে নিজকে যোগ্য দাবী করতে পারবে। চাকরির পড়া,ইন্টারভিউ আরো নানা সমস্যার ভেতরে থাকতো। কিন্তু তুমি পাগলাটে ছিলে সাধারণ বিষয় নিয়ে তাকে সন্দেহ করতে রাগারাগি করতে। এক পর্যায়ে সে ভেবেছিল তোমার সাথে বছরখানেক যোগাযোগ বন্ধ করে নিজেকে গড়বে। যার জন্য সেই মিথ্যা অভিনয় আমাকে নিয়ে শুরু করেছিল। জাবের ভাবেনি তুমি দ্বিতীয়বার আবার সম্পর্কে জড়াবে, সেটা জানার পরে সে একদম ভেঙে পড়ে। তারপর আমাকে দিয়ে আহানের সাথে কথা বলায় এরপর যখন জানতে পারে তুমি আহানের প্রতি উদাসীন তখন সে নিশ্চিন্ত হয়।
কারণ তুমি জাবেরকে ঘৃণা করলেও নতুন করে সত্যিকার অর্থে আর কাউকে ভালোবাসোনি।
দেখো তোমার জন্য সে আজ ভালো একটা চাকরি করছে। যার কারণে তোমার বাবা সাচ্ছন্দ্যে তোমাদের বিয়ে দিতে রাজী হয়েছে। দেখলেনা আংটি পরানোর কথা ছিল কিন্তু জাবের জেদ ধরেছে সেদিনই বিয়ে করবে আর সেদিনই তোমার বাবা রাজী হলো। কারণটা ছিল তার যোগ্যতা বুঝলে?
আর জাবেরের ভয় ছিল তুমি যদি পরবর্তীতে বিয়েটা না করো কিংবা কোনো ঝামেলায় সে তোমাকে হারিয়ে ফেলে! তাই বিয়েটা করেই ছাড়লো।

এসব শুনতে শুনতে অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। এই মানুষটাকে আমি কিভাবে এতোদিন ঘৃণা করে এসেছি! যে কিনা আমাকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করলো। অভিমানী সুর নিয়ে বললাম…
___ এতো ভালোবাসলে আমার সাথে এতো নাটক করলো কেন? কি দরকার ছিল এসবের? সরাসরি বললে হতোনা?

এইটুকুই বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলাম।
শ্রেয়া চেয়ার থেকে উঠে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো…
___ সে খুব খারাপ, নাহলে বিয়ের রাতে কেউ বউকে বাইরে রাখে? কিন্তু মজার কথা হলো সেও তোমার সাথে বাইরেই ছিল। তুমি নাকি ঘুমিয়ে ছিলে!

___ মানে? জাবের সত্যি বাইরে ছিল?

___ হ্যাঁ সত্যি। আসলে দুই বছর এতো বেশি বেশি অভিনয় করেছে যার জন্য হঠাৎ এতো কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কি করবে সে ভেবে অস্থির ছিল। আমরা দুজন খুব করে বলেছি ক্ষমা চেয়ে নিতে৷ কিন্তু সে এতটাই লজ্জিত তার দ্বারা এটা হবেনা। এরপর আমরা বলেছিলাম আমরাই তোমাকে সব জানাবো। একটা দিন অপেক্ষা করতে। অতঃপর আজ সব বলতে পেরে ভালো লাগছে।

আমি মাথা তুলে শ্রেয়ার দিকে তাকালাম। শ্রেয়া আমাকে আস্বস্ত করে খেতে বলল..
আমি তখন আহান আর শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
___ সবকিছুর সমাধান হওয়ার আগে জাবেরকে একটা ধাক্কা খাওয়ানো দরকার। আমার সাথে এত কিছু করেছে আমি তো এমনি এমনি মাফ করে দিতে পারিনা।

শ্রেয়া হেসে বলল..
___এবার আমরা দুজন তোমার দলে। তাকে নাকানিচুবানি দিবো একটা!

এইটুকু বলার সাথে সাথেই জাবেরের প্রবেশ। জাবের শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে.
___এখনো খাওয়া শুরু করলিনা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো। আর কি জানি বললি কাকে নাকানিচুবানি দিবি তুই?

___ আরে এসব আমাদের কথা, তোর শুনতে হবেনা।
বস শুরু কর ।

আমি প্রচন্ড অভিমান নিয়ে আছি এখন । এতদিন ঘৃণা থেকে রাগ ছিল। আর এখন ভালোবাসা থেকে অভিমান। জাবেরের দিকে না তাকিয়েই খেতে শুরু করলাম।
শ্রেয়া আহানকে খাইয়ে দিচ্ছে।
জাবের দু-তিনবার আমার দিকে তাকিয়েছে কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি।
শেষ পর্যন্ত জাবের বলেই ফেললো..
___ আহান তুই কি লাকি রে! আমার ভালোবাসার মানুষটা এখানে থাকলে আমাকেও নিজে নিজে খেতে হতোনা।

আমি জাবেরের দিকে তাকিয়ে আহান আর শ্রেয়ার দিকে তাকালাম। ওরা হেসে ফেললো। জাবের এখনো কেন এসব বলছে আল্লাহ জানে। মনে হয় বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে। আর ছাড়াতে পারবেনা। এখনো সে স্বীকার করতে চাচ্ছে তার আরেকটা গার্লফ্রেন্ড আছে। সে থাকলে তাকে এখন খাইয়ে দিতো।

আমি হাসছি,তক্ষনি পায়ের উপর পায়ের উপর একটা আলতো স্পর্শে এতটাই ভয় পেয়ে গেলাম আমার হাত থেকে চামচটা পড়ে গেলো। নিচে তাকিয়ে দেখি শ্রেয়া আহান জায়গামতো আছে। তাহলে এই কাজ কে যে করেছে আমি বুঝতে পারছি। সেটা ভুলবশত নয়,ইচ্ছে করেই করেছে। আমি খাইয়ে দেই কিনা এই আশায়।

কিন্তু নাহ আমি তো নাছোড়বান্দা, তোমাকে আগে শিক্ষা দিবো এরপর সব। খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায় জানিয়ে আমরা বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। আসার সময় বাবার গাড়ী করে এসেছি,যদিও বেশি দূরে না৷ কিন্তু সেটা দিয়ে মা এবং বাকিরা চলে গেছে। এখন আমাদের রিকশা করে যেতে হবে।

সন্ধ্যা নেমে গেছে,চারপাশ আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে গেছে। চারদিকে বিদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেছে। কি ঝলমলে পরিবেশ সাথে আমার মনটাও!
আমার পাশে আমার জাবের,বারবার ঘেঁষে বসতে চাচ্ছে কিন্তু আমি দূরে সরে যাচ্ছি। তার হাত আমার হাত একসাথে কিন্তু দুজনই দুজনকে ছুঁয়ে দেওয়া বারণ! দুটো মনে দুই রকমের সংকোচন!
সে সাহস পাচ্ছেনা আর আমি চাচ্ছিনা।
কিন্তু ইচ্ছেটা যেন বাঁধ মানছেনা! আচ্ছা একটু ছুঁয়ে দিলে কি আমার ভেতরের লালিত অভিমানটা হালকা হয়ে যাবে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here