সেদিন_ছিল_পূর্ণিমা #পর্ব:- দুই (০২)

0
2277

#সেদিন_ছিল_পূর্ণিমা
#পর্ব:- দুই (০২)

আমি বললাম,
” আপনারা কারা? আমাকে কেন নিয়ে যাবেন? ”

” সাদা রঙের প্যাকেটটা কোথায়? ”

” কিসের প্যাকেট? আমি তো কোনো প্যাকেট সম্পর্কে কিছু জানি না। ”

এমন সময় টগর ভাইয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর পিছন থেকে বললো,

” কি ব্যাপার এখানে এতো মানুষ কেন? ”

সবাই পিছনে ফিরে তাকালো। যে লোকটা আমার সঙ্গে কথা বলছিল সে বললো,

” টগর তুই? ”

” আপনারা এখানে কি করেন? ”

” এই মেয়েকে নিতে এসেছি। ”

” কেন? ”

” অনেক কাহিনি। পরে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। তুই এখানে কেন তাই বল। ”

” এই মেয়ে আমার পরিচিত, আমিই তাকে এখানে ভর্তি করেছি। সুতরাং তার বিষয় যা বলার সবটা আমার সঙ্গে বলেন। ”

” বলিস কি? তোর কিরকম পরিচিত? ”

” যেভাবেই হোক সেটা বড় কথা নয় , এখন বলেন ঘটনা কি? ”

লোকটা কিছু না বলে মোবাইল বের করলো। তারপর কাকে যেন কল দিল। তারপর বললো,

” ভাই এখানে টগর আছে, আর এই মেয়ে তো টগরের পরিচিত। ”

তারপর ওপাশ থেকে কিছু শুনলো। মোবাইল রেখে দিয়ে টগরকে বললো,

” হাসপাতালের মধ্যে কোনো ঝামেলা করলাম না টগর। রাতের মধ্যে ওই প্যাকেট সিরাজ ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিবি। নাহলে কিন্তু ভাই নিজে কিছু একটা করে ফেলবে। ”

টগরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তারা সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। টগর ভাই আমার কাছে চলে এলেন।

এতক্ষণে বুকের ভেতর জমানো ভয় খানিকটা কমেছে কিন্তু তারা কিসের প্যাকেটের কথা জিজ্ঞেস করছে সত্যিই জানি না।

আমি বললাম,
” আমি বাসায় যাবো। ”

টগর ভাই অবাক হয়ে বললেন,
” এই অসুস্থ শরীরে বাসায় কেন? ”

” আমি ঠিক আছি। আপনি যে অফিসে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেখানে কি আজ যাওয়া যাবে নাকি আগামীকাল? ”

” কালকে গেলে হবে। ”

” তাহলে বাসায় চলেন। ”

” ঠিক আছে ব্যবস্থা করি। ”

” একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? ”

” করেন। ”

” ওই খারাপ লোকগুলো আপনার পরিচিত ছিল তাই না? এদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি? ”

” কোনো সম্পর্ক নেই, এলাকার এক নেতার সঙ্গে চলাচল করে। কিন্তু আপনি বলেন তো ওরা কিসের প্যাকেটের খোঁজ করছে? ”

” আমি জানি না। ”

” মনে হয় কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। ঠিক আছে চিন্তা করবেন না, আমি রাতে সিরাজ ভাইর সঙ্গে দেখা করে সবকিছু বলবো। ”

” আপনার সঙ্গে এইসব মানুষের খুব খাতির তাই না টগর ভাই? ”

” আছে কিছুটা। ”

” আমার চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেলে আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখবো না। ”

” ঠিক আছে রাখতে হবে না। এমনিতেই কেউ যোগাযোগ রাখে না, এতে আমি কিছু মনে করি না। খুব স্বাভাবিক বিষয়। ”

” আপনার পরিবারে কে কে আছে? ”

” এক বোন আছে, আর কেউ নেই। ”

” সে কোথায়? ”

” রংপুর, ওর স্বামীর সাথে থাকে। ”

” সেও মনে হয় আপনার সঙ্গে কথা বলে না, তাই না? ”

টগর ভাই এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে গেল। আশ্চর্য এক মানুষ। তবে আমি এখনো ওই ভয়ঙ্কর লোকগুলোর কথা চিন্তা করে যাচ্ছি। কিসের প্যাকেট, কি ছিল সেখানে? যার কারণে এরা আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। মাদকদ্রব্য নাকি? হায় আল্লাহ!

★★★

ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। হলুদ রঙের শাড়ি পরে বসে আছে। মুখভর্তি পান, তার এক হাতে চুড়ি ভর্তি আর অন্যহাত খালি।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” রাত দশটার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। কারণ দশটার পরে আর কাউকে দারোয়ান ঢুকতে দেবে না বাসায়। ”

টগর ভাই বললেন,
” অফিসে চাকরি করবে। রাস্তায় মাঝে মাঝে তো জ্যাম থাকে। গেইট খোলা হবে না কেন? ভাড়া দিয়ে তো থাকব তাই না? ”

” আমার বিল্ডিংয়ের মধ্যে কেউ রাত দশটার পরে বের হতে পারে না। ”

” তবুও মাথায় রাখবেন বিষয়টা। তার চাকরি হবে বনানী, আর বনানী থেকে উত্তরা আসতে মাঝে মাঝে দেরি হতে পারে। দেখা গেল রাত আটটার দিকে ছুটি হয়েছে…. ”

” ঠিক আছে বুঝতে পারছি টগর, সমস্যা নেই যদি দু একদিন বিপদে পরে সেটা দেখা যাবে। ”

আমি সন্ধ্যার পরে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে মেসে চলে এলাম। একটা তিন রুমের ফ্ল্যাটের মধ্যে আমিসহ মোট সাতজন থাকবো। তিনজন পড়াশোনা করে, বাকি তিনজনই জব করে। আমি যার সঙ্গে এক রুমে থাকবো সেই মেয়েটার নাম তাযকিয়া তামান্না।

ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতে হবে। তামান্না নামের মেয়েটাও ফ্লোরে বিছানা করে বসে আছে। সে বললো,

” তুমি চাইলে খাট কিনে পেতে নিতে পারো। আমার দরকার হয় না তাই কেনা হয় না। ”

” না না সমস্যা নেই। ”

” তোমার নামটা যেন কি? ”

” অবন্তী ”

” আমার নাম তাযকিয়া তামান্না, নামের অর্থ হচ্ছে পবিত্র ইচ্ছে। ”

বয়স আনুমানিক আমার চেয়ে বেশি হবে। কাছেই একটা গার্মেন্টসে চাকরি করে, সুপারভাইজার।

” রেললাইনের ওপারে সেক্টরের মধ্যে তোমার বান্ধবীর বাসা তাই না? ”

” হ্যাঁ। ”

” খুব বড়লোক নাকি? ”

” জানি না, মোটামুটি! ”

” সেক্টরের মধ্যে তো বাসাভাড়া অনেক বেশি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ সেখানে থাকতে পারে না। ”

শরীর ক্লান্ত ছিল, এক্সিডেন্ট আমার পায়ের মধ্যে হালকা ছিলে গেছিল। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, তবে টগর ভাইয়ের হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।

রাত এগারোটার দিকে টগর ভাই আমাকে কল দিলেন। তার কাছে আমার নাম্বার নেই। নিশ্চয়ই রাবুর কাছ থেকে নিয়েছে। রাবুর ভালো নাম রাবেয়া, আমরা সবসময় তাকে রাবু বলে ডাকি।

” হ্যালো, আমি টগর বলছি। ”

” বলেন। ”

” আপনি সেদিন গ্রাম থেকে আসার সময় বাসের মধ্যে আপনার পাশের সিটে কি একজন মহিলা বসেছিল? ”

আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। তারপর নিজের কৌতূহল লুকিয়ে বললাম,

” হ্যাঁ। ”

” সেই মহিলা আপনার ব্যাগের ভেতর একটা সাদা প্যাকেট রেখেছিল। ওরা সেই প্যাকেট চাইছে, ওটা আপনি কোথায় রেখেছেন? ”

এবার আরো অবাক হলাম। আমি তো এসবের কিছু জানতাম না, তাছাড়া কিছুক্ষণ আগে সব বের করে গুছিয়ে রেখেছি। সেখানে কোনো সাদা প্যাকেট ছিল না।
বললাম,
” টগর ভাই আমি জানি না সেটা কোথায়। ”

” দয়া করে আমার কাছে সত্যিটা বলেন। নাহলে খুব বিপদ হতে পারে। ”

” আশ্চর্য, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না কেন টগর ভাই? আমি ওটা দিয়ে কি করবো? ”

” ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি দেখি কি করা যায়। আমি না বলা পর্যন্ত আপনি বাসা থেকে বের হবেন না। টাকাপয়সা লাগলে রাবেয়ার কাছে বলবেন, আপাতত বাসায় থাকেন। ”

” চাকরি? ”

” বিষয়টা একটু সমাধান করি তারপর আপনার চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত বাসায় বসে থাকেন, ঘুমান যা ইচ্ছে করেন। ”

কল কেটে গেল। আমি সেদিন গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার কথা ভাবতে লাগলাম। আমার পাশে এক মহিলা ছিল। আমি প্রায় সারাক্ষণ ঘুমিয়েই ছিলাম। আমার ব্যাগটা ছিল পায়ের কাছে। বেশি কাপড়চোপড় ছিল তাই মাথার উপরের বক্সে রাখতে পারিনি। মহিলা কখন বাস থেকে নেমেছে সেটাও জানি না আমি।

মোবাইলে মা কল দিয়েছে। এতো রাতে মা কল দিবে ভাবিনি। তাহলে বাবার শরীর আবার অসুস্থ হয়ে গেল নাকি?

” কেমন আছো মা? ”

” আমরা ভালো আছি, তুই কেমন আছিস মা? চাকরি হয়েছে? ”

” না চাকরির জন্য যেতে পারিনি। পথে সামান্য এক্সিডেন্ট করেছি তাই হাসপাতাল থেকে আবার বাসায় এসেছি। ”

” বলিস কি? সাবধানে থাকতে পারিস না? বেশি কিছু হয়নি তো? ”

” না মা। ”

” একটা কথা বলতে কল দিলাম। ”

” কি কথা? বলো! ”

” জামাই এসেছিল একটু আগে। ”

” মানে? কার জামাই? ”

” সোহাগ এসেছিল। ”

আমার হাসবেন্ডের নাম ছিল সোহাগ। কিন্তু সে আমাদের বাড়িতে এসেছে, আশ্চর্য।

” কেন এসেছে? ”

” সে নাকি ইচ্ছে করে ডিভোর্স দেয়নি, এসবের পিছনে অনেক ঝামেলা ছিল। বাধ্য হয়ে নাকি কাজটা করেছে। ”

” এসব কি ধরনের কথা? সে এসে তোমাকে বলে গেল আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে? ”

” সে ঢাকায় গিয়ে তোর সাথে দেখা করতে চায়। আমার কাছে ঠিকানা চায়। ”

” পাগল নাকি? তার সঙ্গে দেখা করবো কেন? ”

” জানি না, আমি তো নিজেই তোর ঠিকানা জানি না। দেবো কীভাবে? সে বলে গেল, যেভাবেই হোক তোর ঠিকানা নাকি যোগাড় করবে। ”

” কিছুই বুঝতে পারছি না মা। ”

” তুই সাবধানে থাকিস অবন্তী, তোর বাবা এসব কিছু জানে না। টেনশন করবে তাই কিছু বলিনি। ”

” ভালো করছো। ”

★★★

দুদিন পেরিয়ে গেল। সেই রাত থেকে টগর ভাইর নাম্বার বন্ধ। যে নাম্বার দিয়ে কল করেছিল সেই নাম্বার বন্ধ পাচ্ছি। রাবুর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, রাবুও কিছু জানাতে পারেনি।

তৃতীয় দিন একটা অপরিচিত নাম্বার দিয়ে কল এলো। আমি রিসিভ করে কথা বললাম,

” কে বলছেন? ”

” আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনার ব্যাগ থেকে একটা সাদা প্যাকেট আমি বাসের ভিতরে বসে নিয়েছিলাম। ওটা আমার কাছেই আছে। ”

[ গঠনমূলক মন্তব্য করলে লেখার প্রতি আগ্রহ আসে। আশা করি সবাই মতামত জানাবেন! ]

চলবে…

লেখা:-এম.ডি. সাইফুল ইসলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here