#মেহেরজান
#পর্ব-১৯,২০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-১৯
আম্রপালি আর অনুরাধা একসাথে রান্না করছেন। পাশেই মোহিনী মনমরা হয়ে একটা মোড়ায় চুপ করে বসে আছেন। রান্না কতদূর এগোলো, একটু পর পর উঁকি দিয়ে দেখছেন। যেন খাবার হওয়ারই অপেক্ষায় আছেন।
“আপনাদের রান্না আর কতদূর বড়মা?”
“কেন? খিদে পেয়েছে?”
“পেয়েছে তো।”
“সকালে খাসনি তুই? না খাইয়েই তারানা ছাড়লো তোকে?”
“খাইয়েছে তো। জোর করে। কিন্তু পেট ভরেনি।”
“পেট না ভরলে জোর করে খাওয়ালো কেন?”
“কে রান্না করেছে জানেন? রজনীদি। তার রান্নায় আমি একবিন্দুও স্বাদ পাই না। তাই খেতে চাইওনি। কিন্তু তারামার কথায় খেয়েছি। এই অল্প একটু। পেটও ভরেনি। আপনার হাতের রান্না না খেলে পেট ভরে নাকি আমার?”
“রাঁধছি তো নিরামিষ। তোর অপেক্ষা দেখে মনে হচ্ছে সামনে বিরিয়ানি।”
“আপনার হাতের নিরামিষের মধ্যেও আমি মাংসের স্বাদ পাই। বিরিয়ানি না হোক কিন্তু আপনার সব রান্নাই খেতে অমৃত বড়মা।”
“তোর মতো তোষামোদকারী আমি আর একটাও দেখিনি। চুপ করে বস। রান্না হলে খেতে পাবি।”
অনুরাধা বলে উঠলেন,
“শকুন্তলার ঘুম কি এখনো ভাঙেনি? এতোবেলা করে কেউ ঘুম থেকে ওঠে? সকালে উঠে আমাদের একটু সাহায্যও তো করতে পারে। নাকি শুধু হুকুম চালাতেই জানে? নিজেকে কি রাজরানী ভাবে ও?”
আম্রপালি হেসে উত্তর দিলেন,
“রাজরানী না হলো। কিন্তু জমিদার বাড়ির বউ তো। একটু শৌখিন তো হবেই।”
“সে তো তুমিও জমিদার বাড়ির বউ। আমিও এই বাড়ির মেয়ে। আর এই জমিদারি না তোমার শ্বশুরের আমলেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এতো বিলাসিতা মানায় না আমাদের।”
“বাদ দাও দিদি। শকুন্তলা তো এমনই। চেনোই তো ওকে।”
“বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান যে। বেশি আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে। তোমার শ্বাশুড়ি যে কী দেখে পছন্দ করেছিলেন কে জানে।”
আম্রপালি নিজের হাসি চেপে রাখলেন। মোহিনী বললেন,
“পিসিমা, আপনাদের সবারও তো একটাই সন্তান। অর্ণব, চিত্রা, শমিতদা। আপনারাও কি তাহলে তাদেরকে আদরে আদরে ছোটমার মতো বাঁদর বানাচ্ছেন?”
আম্রপালি আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। অনুরাধা বললেন,
“তুই চুপ কর। সবচেয়ে বড় বাঁদর তো তুই হয়েছিস। বড়দের মাঝে কথা বলিস। বসে না থেকে আমাদের কাজে সাহায্যও তো করতে পারিস। আর অর্ণব কী হ্যাঁ? অর্ণবদা বলতে পারিস না?”
মোহিনীর চোখ দোতলায় পড়তেই দেখলেন অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন। তাদেরকেই দেখছেন। মোহিনীকে ইশারা করে ওপরে আসতে বললে তিনি ইশারাতেই মানা করে দিলেন। উল্টো অনুরাধার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“না, পারি না। বাঁদর বলবো বাঁদর। আমার খাবারটা পদ্মার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েন বড়মা। আমি গেলাম।”
কথাটা বলেই মোহিনী দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
“দেখলে আম্রপালি, দেখলে? কত বড় সাহস এই মেয়ের! এই তুমিই ওকে এতো ছাড় দিয়েছো।”
“আমি ওকে শাসন করার সুযোগ পাই-ই বা কোথায়?”
“শাসন করার সুযোগ না পেলে স্নেহ করার সুযোগটাও তৈরি করে দেওয়া উচিত হয়নি তোমার।”
আম্রপালির মুখ মলিন হয়ে উঠলো। অনুরাধার শেষ কথাগুলো খুব একটা পছন্দ হলো না তার। কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি।
.
.
.
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন পদ্মাবতী আর শিউলি। দুপাশে আবাদি জমি। শিউলিকে নিয়ে বিকেলবেলায় ঘুরতে বের হয়েছেন তিনি। হালকা বাতাসের মধ্যে হাঁটতে ভালোই লাগছে তার। সেদিন বিকেলে গ্রাম ঘুরে দেখতে চেয়েও পারেননি তিনি। পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে সেদিনই চলে গিয়েছিলেন শিউলি। শর্মিলা নিষেধ করেও আঁটকাতে পারেননি। তার সাথে তার শ্বশুরবাড়ির যোগাযোগ না থাকলেও ছেলেমেয়েদের সাথে ঠিকই আছে। আজ সকালেই ফিরেছেন শিউলি। ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও শর্মিলার আদেশে পদ্মাবতীকে নিয়ে বের হয়েছেন। এমন সময় পেটে ক্ষুধা অনুভব করলেন পদ্মাবতী। শিউলিকে বললেন,
“আর হাঁটতে পারছি না শিউলি। খিদেও পেয়েছে। চল কোথাও বসি।”
“সামনে একটা বড় মাঠ আছে। বিকেলবেলা অনেককিছু আসে। চলো ওখানে গিয়ে বসি।”
“অনেক লোকজন আছে ওখানে?”
“না। মাঠে কিছুই নেই। খাবারের দোকান সব রাস্তায় বসে। মাঠে মাঝেমধ্যে বাচ্চারা খেলে।”
“চল তাহলে।”
দুজনে দুটো ঘটিগরম নিয়ে মাঠে এলেন। এখানে কিছুটা রোদের তেজ থাকায় গাছের ছায়ার গিয়ে বসলেন তারা। একটু দূরেই বাচ্চারা খেলছে। খেতে খেতে পদ্মাবতী বললেন,
“প্রেম করিস শিউলি?”
পদ্মাবতীর কথা শুনে যেন শিউলি বিষম খেলেন।
“সাবধানে খা। পানি নেই আমার কাছে।”
নিজেকে সামলে শিউলি বললেন,
“কী বললে?”
“জিজ্ঞেস করেছি প্রেম করিস কীনা?”
“না।”
“ভালোবাসিস কাউকে?”
“একদম না। তুমি এসব কথা বলো না আমাকে। মা বকবে।”
“কিছু করিস না তো বকবে কেন?”
“তবুও বলো না। ভুল বুঝে আমাকে যদি এখনই বিয়ে দিয়ে দেয়।”
“আচ্ছা। বলবো না।”
“তুমি প্রেম করো?”
“না।”
“ভালোবাসো?”
“জানি না। আমার প্রশ্ন আমাকে করছিস?”
“জানো না কেন?”
“এমনিই।”
“তোমার সাথে যিনি এসেছিলেন তিনি দেখতে কিন্তু খুব সুদর্শন ছিলেন।”
পদ্মাবতীর কিছুটা হিংসা হলো।
“তোমার সাথে ভালোই মানাবে।”
শুরুতে হিংসা লাগলেও পরক্ষণেই শিউলির কথা তার ভালো লাগলো।
“আসলেই মানাবে?”
“তারমানে ওকেই ভালোবাসো।”
“একদম না। আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলছিস? তুই আমার চেয়ে ছোট হলে কী হবে। খুব পাকনা। পিসিকে বলবো সত্যিই যাতে তোর বিয়ে দিয়ে দেয়।”
খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী।
“কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
“বাড়ি চল। এখানে ভালো লাগছে না আমার।”
শিউলি চটপট উঠে পড়লেন। যেন পদ্মাবতীর মুখে এমন কিছু শোনার জন্যই আশা করে ছিলেন তিনি।
.
.
.
অন্যমনস্ক হয়ে সামনে থাকা খাবারের থালায় শুধু আঙুলই ঘোরাচ্ছেন মোহিনী। মুখে কিছু তুলছেন না। তারানা সেটা দেখে বললেন,
“মন কোথায় তোর? খাচ্ছিস না কেন?”
মোহিনী জবাব দিলেন না। তারানা এসে ধাক্কা দিতেই ধ্যান ভাঙলো তার।
“কী হয়েছে তারামা?”
“সেটাই তো আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি। কী হয়েছে তোর?”
মোহিনী আবার ভাবতে শুরু করলেন।
“কী করে বলবো তোমাকে তারামা। অর্ণবকে হারানোর যে ভয় আমার মনে আবির্ভূত হয়েছে, তা যে আমাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।”
তারানা আবার মোহিনীকে ধাক্কা দিলেন। বললেন,
“এই মেয়ে, কী হয়েছে তোর? আমার কথা কানে যাচ্ছে না? কিছু বলছিস না কেন?”
“কী হবে তারামা? কিছুই তো হয়নি।”
“তোকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। আমার চোখ এড়ানো তোর দ্বারা সম্ভব নয়। সত্যি করে বল কী হয়েছে তোর?”
“সত্যিই কিচ্ছু হয়নি। আচ্ছা তারামা, তুমি আমাকে এখানকার সবার চেয়ে বেশি কেন ভালোবাসো?”
“একদম কথা ঘোরাবি না। আমার প্রশ্নের জবাব দে।”
“কথা ঘোরাচ্ছি না তারামা। বলো না, আমাকে সবার চেয়ে কেন বেশি ভালোবাসো?”
মোহিনীর মতো সেখানকার বাকি মেয়েরাও জানার জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তারানা বললেন,
“কারণ তোর মধ্যে আমি আম্রপালিকে দেখতে পাই।”
“সত্যিই? সেটা কীভাবে?”
“হ্যাঁ, তোর মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া চঞ্চল, দস্যি মেয়েটাকে দেখতে পাই। তোর বড়মা না আগে এমন শান্তশিষ্ট, কোমল আর নমনীয় ছিল না।”
“তারামা, বড়মা তো এই বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন। ও-বাড়িতে বিয়ে হলো কী করে?”
“হঠাৎ এসব প্রশ্ন করছিস কেন?”
“হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করলো তাই। ওনার তো প্রেমের বিয়ে ছিল। তাই না?”
“সে তো আদিত্য চৌধুরী প্রেমে পড়েছিল। আম্রপালি না।”
“তুমি গল্পটা শোনাও না।”
“এখন পারবো না।”
“একটু তো শোনাও।”
তারানা মানা করলেও মেয়েরা তাকে ছাড়লেন না। অবশেষে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন।
“শোন তাহলে, আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন একটা শিশু ছিলাম মাত্র। তৃতীয় লিঙ্গের ছিলাম বলে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন আমার বাবা-মা আমাকে। তাদের কোনো খোঁজ খবর আমি জানি না। কখনো জানার চেষ্টাও করিনি। আমাকে যিনি পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন এ-বাড়ির কর্তৃ। ওনার নাম ছিল রানী। সবাই রানীবাই বলে ডাকতো। এসব কথা আমি বড় হওয়ার পর জেনেছিলাম। যাই হোক, তিনিই নিয়ে এসেছিলেন আমাকে এখানে। আম্রপালির মা এখানকার মেয়ে ছিল না। আমার যখন বারো বছর তখন সে আসলো এখানে। বয়স হবে উনিশ কি কুড়ি। ওর নাম ছিল মাধবীলতা। সবাই মাধবী বলে ডাকতো। ও যখন এলো তখন গর্ভবতী ছিল। ওর অতীত সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু জানতো না। কাউকেই বলেনি ও। আমি ছোট হলেও আমার কাজ ছিল সব মেয়েকে দেখে রাখা। আমার সাথে খুব ভালো সখ্যতা হলো ওর। এরপর আম্রপালি এলো। মাধবী নাচ শিখলো। অন্যন্য মেয়েদের মতো নাচতে শুরু করলো। আম্রপালিকে ও বেশির ভাগ সময় আমার কাছেই রাখতো। তবে এসব কিছু থেকে মাধবী আম্রপালিকে দূরে রাখতো। কিন্তু মেয়েটা বেশিদিন বাঁচলো না। আম্রপালির যখন সাত বছর তখন হঠাৎ করেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ও বুঝে গিয়েছিল ওর শেষ সময় এসে গেছে। আমাকে বললো আম্রপালিকে যেন সব কুনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখি। এসব কিছু থেকে যেন দূরে রাখি। আমি তখন খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। তারপর হঠাৎ একদিন মাধবী চলে গেল। আর আম্রপালিকে রেখে গেল আমার ভরসায়।”
তারানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। একটা মেয়ে বললেন,
“উনি তো তাহলে তোমার অনেক ছোট, আম্মা। তাহলে ওনাকে আপনি করে কেন ডাকো?”
তারানা মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিলেন,
“ছোট তো কী হয়েছে? এখন ও যেখানে গেছে না, সম্মান না দেখিয়ে উপায় নেই। এ-বাড়িটা দেখছিস না? এখানে আগে তোদের মতো ষোল সতেরোটা মেয়ে ছিল না। দু’শ দাসী থাকতো এখানে মনোরঞ্জনের জন্য। কতো জায়গার জমিদারদের আনাগোনা ছিল এখানে জানিস? যদিও এসব আমার শোনা কথা। ওই চৌধুরীদের বাগানবাড়ি ছিল এটা। ওরাই চালাতো সব। যদিও ওদের জমিদারি ওই প্রতাপ চৌধুরীর সময়ই উঠে গেছে।”
একজন বলে উঠলেন,
“প্রতাপ চৌধুরী কে আম্মা?”
“কে আবার? আম্রপালির শ্বশুর। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আর জমিদারি ধরে রাখতে পারেনি। সম্পদও কমতে শুরু করে। তখনও এখানে ওদের যাওয়া আসা ছিল।”
“তুমি এতোকিছু জানো কী করে?”
“বললাম না শুনেছি।”
মোহিনী বললেন,
“তুমি গল্পের বাকীটা বলো তারামা। তারপর কী হলো?”
“তারপর আর কী হলো। আমি আর কিছু আঁটকে রাখতে পারিনি। আম্রপালির যখন ষোল বছর তখন সে নাচা শুরু করে। একদিন আদিত্য চৌধুরী এলো এখানে। আম্রপালির প্রেমে পড়লো। আর একবছর পরই বিয়ে করে নিয়ে গেল।”
“মেনে নিলো সবাই তাকে?”
“ততদিনে প্রতাপ চৌধুরী মরে ভূত। শুধু শান্তি ছিল। সে প্রথমে না মানলেও পরে আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছিল। তারপরই তো ওরা ওই জমিদার বাড়ি বিক্রি করে এখন যে বাড়িতে আছে সেখানে উঠলো। এখন তো শান্তি খুব পছন্দ করে আম্রপালিকে।”
রজনী বললেন,
“রানীবাই এর কী হলো আম্মা?”
সবাই হেসে উঠলেন। তারানা বললেন,
“আমি তোদের এতো বড় একটা গল্প বললাম। আর তুই সেই রানীবাইকে নিয়েই পড়ে আছিস? সে আর বেঁচে আছে নাকি এখনো। গাড়ি দুর্ঘটনা করে সেই কবেই মরে গেছে। এখন আর একটা কথাও বলবি না কেউ। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার ঘরে যাবি। দেখ, তোদের আগে পরীর খাওয়াও হয়ে গেছে। সব কথা তোদের শুধু খাওয়ার সময়ই মনে পড়ে।”
“একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া আমরা এভাবে একসাথে হই-ই বা কখন। খাওয়ার সময়ই তো সবাই এমন আড্ডা দিতে পারি আম্মা। অন্য বাইজীবাড়ির খবর জানি না। তবে তুমি আমাদের এখানে একটা পরিবারের মতো রেখেছো। নাহলে এখন তো কোনো সাধারণ মানুষের ঘরেও পরিবারের সবাই এমন একসাথে বসে খায় না।”
“অনেক কথা বলেছিস। এখন চুপচাপ খা আর আমাকেও খেতে দে।”
সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। এরপর খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। শুধু মোহিনী বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তাকে যেতে দেখে তারানা বললেন,
“তুই এই সময় কোথায় যাচ্ছিস মেহের?”
“তাড়াতাড়ি এসে পড়বো তারামা। চিন্তা করো না তুমি।”
চেয়ার টেবিলে বসে কিছু একটা করছিলেন অর্ণব। ঘরের দরজা জানালা সব খোলা। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঘরে ঢুকছে। হঠাৎ দরজায় চোখ পড়তেই দেখলেন মোহিনী দাঁড়িয়ে আছেন। এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়লেন। মোহিনী ভেতরে এসে তার সামনে দাঁড়ালেন।
“আপনি এ সময় এখানে কী করছেন মেহের?”
“সকালে ডেকেছিলেন?”
“সেটা সকালের কথা ছিল। তবে হিসেবটা এখনো চুকেনি।”
চট করে মোহিনীর হাত ধরে ফেললেন অর্ণব। এবার আর মোহিনীর মাঝে আগের মতো ভয়ডর নেই। না আছে কোনোরকম ছটফটানি। অর্ণব বললেন,
“সকালে কী যেন বলছিলেন আমাকে?”
“কী?”
“বাঁদর বলেছিলেন। তাই না?”
“তো কী বলতাম? অর্ণবদা?”
“কী বললেন?”
“আর বলবো না।”
“শাস্তি তো পেতেই হবে আপনাকে।”
“কী শাস্তি দেবেন?”
মোহিনী খুব শান্ত গলায় কথা বলছেন। অন্যান্য সময়ের মতো তেজ নেই। অর্ণবের কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগছে। এমন মোহিনীর সাথে পরিচয় তার সচরাচর নেই। অর্ণব খেয়াল করলেন মোহিনী তার অনেকটাই কাছে চলে এসেছেন। আমতাআমতা করে বললেন,
“নারীরা সত্যিই মায়াবিনী হয়।”
“আমার শাস্তি দেবেন না?”
“কাল দেবো।”
“কেন?”
“আর কতো রুপ দেখাবেন আপনি?”
“আমি কী করলাম?”
“আপনার এভাবে এ সময় এখানে আসাটা ঠিক হয়নি মেহের। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”
এবার যেন মোহিনী নিজের আগের বৈশিষ্ট্যে ফিরে এলেন। ভ্রুকুঞ্চন করে বললেন,
“কী সমস্যা হবে?”
“আপনার এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত মেহেরজান।”
“আবার ডাকুন।”
“মেহেরজান।”
“কার কাছে শুনেছিলেন এ নাম?”
“আপনার আগমন আমার জীবনে শরৎকালে হয়েছিল। তাই ডেকেছিলাম মেহেরজান। পরবর্তীতে আপনিই জানিয়েছেন আপনার এ নাম।”
মোহিনী হেসে উঠলেন।
“আমি চিরকাল আপনার মেহেরজান হয়েই থাকতে চাই অর্ণব।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“তোমাকে আরেক টুকরো মাংস দেবো পদ্মাবতী?”
“না না। আর দেবেন না। আমি এতো খেতে পারবো না।”
“আচ্ছা। আমার মেয়েটার যে আজ কি করে এতো সুমতি হলো কে জানে। যাকে হাজারবার বলেও রান্নাঘরে ঢোকাতে পারতাম না। সে আজ নিজেই এতোকিছু রান্না করেছে।”
শিউলি বলে উঠলেন,
“তোমার মেয়ে আজও রান্নাঘরে ঢোকেনি মা।”
“তাহলে? এতোকিছু কে রান্না করলো?”
“যাকে এতো আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াচ্ছো সে-ই রেঁধেছে।”
“মানে? আমি সকালে বাড়িতে ছিলাম না বলে তুই মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করালি?”
“আমার কী দোষ? আমি তো করতে নিষেধই করেছিলাম। দিদিই তো শুনলো না আমার কথা।”
পদ্মাবতী বললেন,
“ওর দোষ নেই। আমিই জোর করেছিলাম। এমনিতেও এখানে আমার কোনো কাজ নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে কার এতো ভালো লাগে। তাই ভাবলাম দুপুরের রান্নাটা আমিই করি।”
“তবুও। এটা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি পদ্মাবতী। তুমি শুধু শুধু এতো কষ্ট করলে।”
“আমার কোনো কষ্ট হয়নি। এগুলো তো আমার বা হাতের খেল।”
“শিউলিকে সেদিন বলেছিলাম তোমাকে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে। কেমন লাগলো?”
“যতটা শুনেছিলাম তার চেয়েও বেশি সুন্দর।”
তাদের কথার মাঝে শিউলি বলে উঠলেন,
“তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। জানো দিদি, আমরা যে মাঠে গিয়ে বসেছিলাম না? সেখানে অনেক বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। তুমি এসো কিন্তু আবার নববর্ষে।”
“আসবো।”
“খাওয়া শেষ করে তুমি একবার আমার ঘরে এসো পদ্মাবতী। একটা কাজ আছে।”
“ঠিকাছে।”
পদ্মাবতী খাওয়া শেষ করে যথারীতি শর্মিলার সাথে তার ঘরে এলেন। শর্মিলা আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে পদ্মাবতীর হাতে দিলেন।
“এটা কী?”
“খুলে দেখো।”
পদ্মাবতী খুলে দেখলেন একজোড়া বালা।
“এগুলো?”
“এগুলো তোমার মায়ের। এতো বছর আমার কাছেই ছিল। তাকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তাই তোমাকেই দিলাম।”
“কিন্তু..”
নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না পদ্মাবতী। তাকে থামিয়ে দিয়ে শর্মিলা বললেন,
“কোনো কিন্তু নয়। এগুলো এখন তোমার। তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে।”
“ঠিকাছে। আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু যতদিন আমি এখানে আছি ততদিন আপনার কাছেই রাখুন। যাওয়ার সময় না হয় দিয়ে দেবেন।”
“আচ্ছা। তুমি যা বলবে।”
পদ্মাবতী শর্মিলার ঘর থেকে বের হয়ে শিউলির ঘরে ঢুকলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“মা কী বললো তোমাকে?”
“তেমন কিছু না।”
“আচ্ছা।”
শিউলি বিছানা ঠিক করতে লাগলেন। পদ্মাবতীর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিনি এখন ঘুমাবেন।
.
.
.
রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছেন মোহিনী। সামনেই নদী। দুপুরের কড়া রোদে কতোগুলো বাচ্চা নদীতে নেমে ঝাঁপাঝাপি করছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারও ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
“কিরে? এসময় এখানে বসে আছিস যে?”
চকিতে পেছনে তাকালেন মোহিনী।
“শমিতদা। তুমি। তেমন কিছু না। এমনিই বসে ছিলাম। তুমি এখানে কী করতে?”
“তোকেই খুঁজতে এসেছিলাম।”
উঠে দাঁড়ালেন মোহিনী। শমিতের সামনে এসে বললেন,
“আমাকে? কেন?”
“আজ বাড়িতে এলি না কেন?”
“এমনিই যাইনি।”
“এমনিই বাড়িতে যাসনি। এমনিই এখানে বসে আছিস। কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি। তুমি কী বলতে এসেছো বলো।”
“অর্ণব খুঁজছিল তোকে। তাই বলতে এলাম।”
“উনি আমাকে কেন খুঁজবেন?”
“এমন ভাব করছিস যেন তোদের প্রেমকাহিনী সম্পর্কে আমি কিছু জানিই না। তুই আজ যাসনি বলে খুঁজছিল।”
“তুমি কী বললে?”
“বলেছি তুই ওর ওপর রেগে আছিস।”
“আমি কেন ওনার ওপর রেগে থাকবো? আমি তো রেগে নেই। তাহলে তুমি এমন কেন বললে?”
“এমনিই। তোদের মাঝে একটু ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য।”
“তারপর উনি কী বলেছেন?”
“জিজ্ঞেস করলো কেন রেগে আছিস। বললাম জানি না। তারপর ও বললো তোর সাথে রাতে দেখা করবে।”
“কখন? কোথায়?”
“সন্ধ্যার পর পরই। বাড়ির পেছনে বাগানে অপেক্ষা করিস।”
“ঠিকাছে।”
“শোন। আমি এখন যাই। তুই ঠিকমতো আসিস কিন্তু। নয়তো অর্ণব আবার আমাকে দোষ দেবে যে আমি তোকে বলিনি।”
“আচ্ছা। আমি আসবো।”
.
.
.
আম গাছতলায় দাঁড়িয়ে অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করে করে চলেছেন মোহিনী। সূর্যাস্তের অনেক আগেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। অনেক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে চলেছেন। এখন সন্ধ্যার আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে। পেছন থেকে নিজের খোলা চুলে কারও স্পর্শ পেতেই তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরলেন তিনি।
“অর্ণব।”
“সোজা হয়ে দাঁড়ান।”
হাতে থাকা নাগচাঁপাটা মোহিনীর চুলে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“এবার বলুন।”
সামান্য হাসলেন মোহিনী।
“এটা আমার অনেক পছন্দের ফুল।”
“জানি। এজন্যই এনেছি। অনেক খুঁজে।”
“মিথ্যে বললেন। খোঁজার কী দরকার? বাগানেই তো আছে।”
“প্রেমে একটু-আধটু মিথ্যে বললে কোনো ক্ষতি নেই। উল্টো ভালোবাসা বাড়ে।আমার ওপর নাকি রেগে আছেন? কেন?”
“একদম না। শমিতদা মিথ্যে কথা বলেছে।”
“আগেই বুঝেছি। আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে।”
“কী কারণ?”
“কাল আমি চলে যাচ্ছি। এটা জানাতেই।”
“চলে যাচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন?”
“কলকাতায়। কাকু নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। কারও সাহায্যের প্রয়োজন। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এজন্যই যাচ্ছি ওনাকে সব গুছিয়ে দিতে।”
“আপনার যাওয়ার কী প্রয়োজন? শমিতদাকেই তো পাঠাতে পারেন।”
“বলেছিলাম। কিন্তু পিসিমা রাজি হননি।”
“ফিরবেন কবে?”
“দেরি হবে অনেক।”
“কতদিন?”
“কয়েক মাস।”
“স্বরসতী পূজোর আগে ফিরবেন তো?”
অর্ণব মোহিনীর মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে তার গালে স্পর্শ করলেন।
“বলতে পারছি না। আরও দেরি হতে পারে। ভালো থাকবেন মেহেরজান।”
একটু দূর থেকে কারও চাপা কন্ঠ ভেসে এলো,
“চলে আয় অর্ণব। রামু কাকু আসছেন এদিকে।”
মোহিনী কৌতূহলী চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। অর্ণব বললেন,
“শমিতকে সামনে রেখে এসেছি পাহারা দিতে।”
মোহিনী হেসে ফেললেন। অর্ণব শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,
“চলে যা তুই। আমি একটু পর আসছি।”
হাটু গেড়ে নিচে বসে পড়লেন অর্ণব। পকেট থেকে একজোড়া নুপুর বের করে মোহিনী পায়ে পরিয়ে দিলেন।
“আপনার পায়ে ঘুঙুর অপেক্ষা নুপুর বেশি শোভা পায় মেহের।”
কথাটা বলে মোহিনীকে নিয়ে পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। মোহিনী বললেন,
“এদিকে কোথায় যাবেন?”
“চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আমি একা যেতে পারবো।”
অর্ণব গলার স্বর দৃঢ় করে বললেন,
“আমি বলেছি আমি পৌঁছে দেবো।”
“ঠিকাছে।”
রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বাইজীবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলেন তারা। দোতলায় জানালা থেকে তাদের একসাথে আসতে দেখলেন তারানা। আবছা আলোয় তাদের চিনতে অসুবিধা হয়নি তার।
“এতোটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমি একাই যেতে পারবো। ভেতরে যাওয়াটা আপনার উচিত হবে না।”
“কেন?”
“এটা বাইজীবাড়ি। এখানে সচরাচর কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পৌঁছে দিতে আসে না। সবার আসার উদ্দেশ্য একটাই। তাই আপনার না আসাই উচিত। লোকে জানলে কুৎসা রটাবে।”
“আমার পূর্বপুরুষ আসতে পারলে আমি কেন পারবো না? পার্থক্য কোথায়?”
“সময়ের পার্থক্য।”
বাড়ির ধূলো জমা নাম ফলকটা রুমাল দিয়ে মুছে দিলেন অর্ণব। একটা নাম ভেসে উঠলো “রঙ মহল”। নামটা যে অনেক আগেই মুছে গেছে তা বলা বাহুল্য। অর্ণব মুচকি হেসে মোহিনীকে বিদায় জানালেন। অর্ণব চলে গেলে মোহিনীও বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে ঢুকতেই তারানার সামনে পড়লেন তিনি।
“কী করছিস মেহের?”
“তারামা।”
“প্রমিতার মতো সেই একই পথে হাঁটছিস? এসব প্রেম ভালোবাসা যে তোদের জন্য না। প্রমিতার পরিণতি কী হয়েছিল ভুলে গেছিস?”
“শান্ত হও তারামা। কিচ্ছু ভুলিনি আমি। প্রমিতাদির সাথে যা হয়েছিল তা আমার সাথে কখনোই হবে না। আমি এতো দুর্বল নই।”
“কী করতে পারবি তুই? গ্রামের লোকেরা পাথর ছুড়ে ছুড়ে মেরেছে ওকে। ভুলে গেছিস?”
“কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমাকে তারামা। কারোর এতো সাহস হবে না। তুমি অযথা চিন্তা করা বন্ধ করো।”
মোহিনী নিজের ঘরে ফিরে এলেন। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। রাতের খাবার খেতেও গেলেন না। রাত যত গভীর হলো, তার গায়ের তাপমাত্রাও তত বাড়তে থাকলো। বারবার কাঁপুনি দিয়ে উঠছেন তিনি। পাশে থেকে কাঁথা টেনে নিজের গায়ে দিলেন। জ্বরের সাথে তীব্র মাথাব্যথা। দুর্বলতা তার শরীরকে গ্রাস করে নিচ্ছে অথচ তীব্র মাথাব্যথায় ঘুমাতেও পারছেন না। উঠে ঔষধ খাওয়ার শক্তিটুকুও যেন নেই তার। লম্বা একটা নির্ঘুম রাত কাটানোর পর যখন সূর্য উঁকি দিল, একটা নতুন দিনের সূচনা হলো, তখন চোখে ঘুম নেমে এলো তার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন, জানেন না তিনি। যখন চোখ খুললেন ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপর। দরজায় কেউ বারবার কড়া নেড়ে যাচ্ছেন। সবকিছু বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো তার। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলেন তিনি। বাইরে রজনী দাঁড়িয়ে। মোহিনী দরজা খুলতেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। মোহিনী আবার আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলেন। শরীরের দুর্বলতা এখনো কাটেনি।
“কী হয়েছে তোর? এতো দুর্বল দেখাচ্ছে কেন?”
“রাতে জ্বর এসেছিল।”
“হঠাৎ জ্বর কেন এলো?”
“জানি না।”
“ওষুধ খেয়েছিস?”
“না। এখন জ্বর নেই। তুমি একটু আমাকে জল দাও না।”
রজনী মোহিনীকে জল এনে দিলেন। মুখে দিতেই তেঁতো স্বাদ অনুভূত হলো তার। চোখে মুখে জল দিয়ে রজনীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন ক’টা বাজে রজনীদি?”
“বাজে তো অনেক। সাড়ে এগারোটা হবে হয়তো।”
মূহুর্তেই তার অর্ণবের কথা মনে পড়লো। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পেছন থেকে রজনী আওয়াজ দিলেন।
“এই শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“আমি এখুনি এসে পড়বো রজনীদি। তারামাকে বলো না।”
দৌঁড়ে অর্ণবদের বাড়িতে এলেন তিনি। অর্ণবকে কোথাও পেলেন না। শমিতকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“অর্ণব কই শমিতদা?”
“তুই এতোক্ষণে এলি? অর্ণব তো সেই কোন সকালেই চলে গেছে। তোর জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষাও করেছে। কিন্তু তুই এলি না বলে শেষে চলেই গেল। তুই এলি না কেন?”
অনুরাধার ডাক শোনা গেল। শমিত আর মোহিনীর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। সেদিকে চলে গেলেন। মোহিনী জ্বরে পড়ার জন্য বারবার নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন। বাড়ির বাইরে এসে সিড়িতে বসতেই দেখলেন পদ্মাবতী আসছেন। কাছে এসে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
“কত্তোদিন পর দেখলাম তোকে। অনেক মনে পড়েছে তোর কথা। তোদের সবার কথা। কেমন আছিস তুই?”
মোহিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“ভালো। তুই?”
“আমিও।”
“চলে এলি যে?”
“ভালো লাগছিল না তাই। কালও ভাবিনি আজ চলে আসবো। আজ সকালেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
“একা আসতে পারলি?”
“দেখছিস না? আর যাওয়ার সময় তো রাস্তা দেখেইছিলাম। আর পিসিমা নদী পার করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন।”
“তোর ঠাকুমা কেমন আছেন?”
“ভালো না। কোনোরকম বেঁচে আছেন আরকি।”
“ওহ।”
পদ্মাবতী বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তার চোখ যেন অন্য কাউকে খুঁজছে। মোহিনীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাড়ির সবাই কেমন আছে? বড়মা, ছোটমা, পিসিমা, চিত্রা, শমিতদা আর অর্ণববাবু?”
“সবাই ভালো আছে। আর অর্ণব বাড়িতে নেই।”
“কোথায় গেছেন?”
“কলকাতায়।”
“ফিরবেন কবে?”
“জানি না। অনেক দেরি হবে শুনলাম।”
“ওহ।”
পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।
“তুই ভেতরে চল।”
“যাচ্ছি। তুই আমার ঘরে যা। আমি সবার সাথে দেখা করে আসছি। অনেক কথা জমে আছে তোকে বলার।”
চলবে…