#মেহেরজান
#পর্ব-২৭,২৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-২৭
আম্রপালি আর শকুন্তলা সেই সকাল থেকে একটা কাজেই ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের আচার, মোয়া, নাড়ু বৈয়ামে ভরছেন। সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পিঠে আর মিষ্টির হাড়ি। রসগোল্লা, সরপুরিয়া, সীতাভোগ, বরফি, ছাড়াবড়া, পান্তুয়াসহ বাহারি সব মিষ্টি। তাদের সাথে পদ্মাবতীও বসেছেন। খালি বৈয়ামগুলো ভালো করে মুছে দিয়ে তাদের হাতে হাতে সাহায্য করছেন। তিনি এখন আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। কোনোকিছু নিয়ে এখন আর খারাপ লাগে না। সবসময় ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগে থাকে। এই যেমন এখন লেগে আছে। শমিত আশেপাশেই ঘুরঘুর করছেন। নিজের উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, এসে একটা করে মিষ্টি পেটে চালান করে চলে যাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় তিনি আবার এসে উপস্থিত হলেন। রসগোল্লার হাড়ির দিকে হাত বাড়াতেই আম্রপালি টান দিয়ে হাড়িটা সরিয়ে ফেললেন।
“উফ মামি, মোহিনী ছাড়া যেন আর কেউ-ই এসব খেতে পছন্দ করে না। আমাকে কি চোখে পড়ে না আপনাদের?”
“রান্নাঘরে আছে। ওখান থেকে খা। এগুলো খেতে হবে কেন? তোদের জন্য একটা হাড়ি রেখে দিয়েছি।”
“আগে বলবেন তো। আমি শুধু শুধু মোহিনীর ভাগেরটা খাচ্ছিলাম। ও জানলে তো আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।”
পদ্মাবতী ফিক করে হেসে ফেললেন। শমিত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই অর্ণব এসে উপস্থিত হলেন।
“বাহ! নববর্ষ উপলক্ষে এতো আয়োজন?”
শকুন্তলা বললেন,
“এগুলো নববর্ষের জন্য না তো।”
“তাহলে? এগুলো কার জন্য?”
“মোহিনীর জন্য।”
“মোহিনীর জন্য?!”
অর্ণব কিছুটা অবাক হলেন।
“কেন?”
“আজ জন্মদিন ওর।”
“শুধু ওর একার না। আমাদের পদ্মারও। দুটো তো একসাথেই হয়েছিল এই পহেলা বৈশাখের দিনে।”
মিষ্টি খেতে খেতে কথাটা বললেন শমিত। ইতোমধ্যেই রান্নাঘর থেকে একটা রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এইনে, হা কর। মিষ্টি খা।”
কিছুটা জোরপূর্বকই অর্ণবের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। অর্ণব একটা মোড়া টেনে ওখানে বসে পড়লেন। এরপর পদ্মাবতীকেও একই কথা বললেন শমিত। কিন্তু পদ্মাবতী খাওয়ার জন্য হা করতেই শমিত মুখের কাছে মিষ্টি নিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে নিজে খেয়ে ফেললেন।
“ধুর।”
“তুই খাবি কেন? তোরই তো জন্মদিন।”
“তাই বলে কি আমার খাওয়া বারণ নাকি? কই? মোহিনীর জন্য তো এতো কিছু ঠিকই যাচ্ছে।”
“সে তো মোহিনী এসব খেতে পছন্দ করে বলে বড় মামি ওর জন্য প্রতিবছরই পাঠান। তুই কি আর এতো খেতে পারবি?”
পদ্মাবতী শমিতের উদ্দেশ্যে ভেংচি কাটলেন।
“দেখেছো কত বড় বেয়াদব হয়েছে! বড় দাদাকে ভেংচি কাটে!”
আম্রপালি বললেন,
“তো তুই ওকে খোঁচাচ্ছিস কেন?”
“আমি আবার কই খোঁচালাম?”
“সেই ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে না কাঁদানো পর্যন্ত থামতি না। আর বলিস কই খোঁচালাম?”
“আর ও কেঁদে কেঁদে আপনাদের কাছে গিয়ে বিচার দিত। যার মিথ্যা সাক্ষী দিত মোহিনী। অথচ ঘটনাস্থলের আশেপাশেও ও থাকতো না। পদ্মা কেঁদে কেঁদে নাক টেনে বলতো মোহিনীকে আর সেও রাজি হয়ে যেত। তারপর…”
“তারপর আর কী? অনুরাধা ঝাড়ু নিয়ে সারা গ্রাম তোর পেছন পেছন দৌঁড়াতো।”
অনুরাধাও চলে এলেন। মুহূর্তেই যেন কয়েকজনের গল্পের আসর বসে গেল। অনুরাধা এসেই বললেন,
“আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল?”
শকুন্তলা বললেন,
“তোমাকে নিয়ে না। পদ্মাবতীর কথা হচ্ছিল। সেই পুচকে মেয়েটা আজ কত্তো বড় হয়ে গেছে। আমার তো এখনো মনে পরে ওর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনের কথা। অর্ণব কী কান্ডটাই না করেছিল।”
অর্ণবের চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠলো।
“কী করেছিল ও?”
“পদ্মাকে এবাড়িতে নিয়ে আসায় যা রেগে গিয়েছিল। ওকে তো থাকতেই দেবে না কিছুতে এখানে। এরপর দিদি বোঝানোর পরে রাজি হয়েছে। আবার তোমাদের বাড়ি থেকে যখন ছুটি কাটিয়ে এসে মোহিনীকে দেখলো তখন আবার সব উল্টো। তখন তো কেঁদেই ফেলেছিল এই বলে যে এখন ওরা সবাই আমার জিনিসে ভাগ বসাবে। মায়ের ঘরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে আমার আর দিদির নামে সে কি নালিশ! তখন আবার মা বোঝানোর পরে সে শান্ত হলো।”
অর্ণব কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে এসব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বললেন,
“আমি এমন করিনি।”
“বললেই হলো নাকি। আমাদের স্পষ্ট মনে আছে।”
অর্ণব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে আম্রপালির উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা, খিদে পেয়েছে।”
“একটু রান্নাঘরে গিয়ে নিয়ে নে না। ওখানে বেড়ে রাখাই আছে তোর জন্য। দেখছিস তো আমি কাজ করছি।”
অর্ণব আর কথা না বাড়িয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। খাবারের থালা বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“মা, এখানে তো পান্তা-ইলিশ আর কী কী ভর্তা যেন রয়েছে।”
“ওগুলোই তো।”
“মানে?”
“কী মানে?”
“পান্তা কেন?”
“বিলেতে থেকে কি সব ভুলে গেছিস? আজ পান্তা খাবি না তো কী খাবি? চুপচাপ খেয়ে নে।”
অর্ণব অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। বাড়িতে আর কিছু রান্না হয়নি আজ। ইশারা করে শমিতকে ডাকলেন সেখানে।
“কী হয়েছে বল।”
“মেহের কই জানিস?”
“মেহের?”
“মোহিনী।”
“ওহ। দু’ঘন্টা বাদে কবরস্থানে গিয়ে দেখিস। পেয়ে যাবি।”
“কবরস্থানে! কেন?”
“গেলেই বুঝতে পারবি।”
“ঠিকাছে। তুই যা এখন।”
শমিত চলে গেলে অর্ণব একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিলেন।
.
.
.
কবরস্থানের বাইরে থেকেই মোহিনীকে একটা কবরের পাশে বসে থাকতে দেখলেন অর্ণব। কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললেন,
“এখানে কী করছেন মেহের?”
অর্ণবের প্রশ্নে বিচলিত হলেন না তিনি। পেছনে না ঘুরেই জবাব দিলেন। যেন আগে থেকেই জানতেন অর্ণব আসবেন।
“এটা আমার মায়ের কবর। মুসলিম হওয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে এখানে। প্রতিবছর এই দিনটায় আসি তার সাথে দেখা করতে।”
“আমি দুঃখিত। আমি আপনার কষ্টটা বুঝি।”
“উঁহু। দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আর আমি যেমন আপনার বাবা হারানোর কষ্ট বুঝি না তেমন আপনিও আমার মা হারানোর কষ্ট বুঝবেন না। যদি কেউ বোঝে তাহলে সে শুধু পদ্মা।”
“হয়তো ঠিক বলেছেন আপনি।”
“পদ্মা আর আমার মাঝে আকাশপাতাল তফাৎ থাকলেও এই জিনিসটায় আমাদের খুব মিল। দু’জনে একই দিনে জন্মেছি আর একই দিনে মা হারিয়েছি।”
“হুম।”
“কিন্তু জানেন, আমার না একটুও কষ্ট লাগে না মায়ের জন্য।”
“কেন?”
“আপনার বাবা যখন মারা গেলেন তখন আপনি সব বুঝতেন। তার আদর স্নেহও পেয়েছিলেন। আর পদ্মা, সে বড়মার কাছে ওর মায়ের সব গল্প শুনেছে। কিন্তু আমি? আমি তো আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু জানিই না। কে ছিলেন? নাম কী? কিছুই জানি না। জন্মের পর তার স্পর্শ পর্যন্ত পাইনি। শুধু তারামার কাছে জেনেছিলাম, তিনি নাকি পাকিস্তানি ছিলেন। উর্দু বলছিলেন। এখন আপনিই বলুন। একজন অপরিচিত মানুষের জন্য আমার কেন কষ্ট হবে? যাকে কখনো দেখিনি। চিনি না। তার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
“মায়ের সাথে তার সন্তানের সম্পর্ক জন্মের ন’মাস আগেই তৈরি হয়। আপনার যদি খারাপ না লাগতো, মায়ের প্রতি টান অনুভব না করতেন তাহলে কেন বারবার তার কবরের কাছে ছুটে আসতেন?”
এবার মোহিনী পেছনে ঘুরলেন। এতোক্ষণ শক্ত গলায় কথা বললেও অর্ণব দেখতে পেলেন মোহিনীর চোখ দিয়ে অনর্গল জল ঝরছে। আজ প্রথমবারের মতো তাকে কাঁদতে দেখলেন অর্ণব। মোহিনীর অশ্রুসিক্ত চোখের সাথে কিছুতেই নিজের চোখ মেলাতে পারছেন না অর্ণব। তার পাশে বসে জল মুছে দিয়ে বললেন,
“আমার বাঘিনীটা হঠাৎ এমন ভিজে বেড়াল হয়ে গেল কী করে?”
মোহিনী না চাইতেও তার কথায় হেসে ফেললেন।
“বাড়ি যান অর্ণব। আমি একটু পর আসছি।”
“আপনাকে একা রেখে যাচ্ছি না।”
“একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি আগে যান।”
অর্ণব জোরে একটা শ্বাস ছাড়লেন।
“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসবেন।”
.
.
.
হাতঘড়িতে বারবার সময় দেখছেন অর্ণব। অর্ণবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও মোহিনীর কোনো হদিস নেই। তিনি আর আসেননি। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার দেখছেন কেউ এলো কিনা। এমন সময় মোহিনীকে ঢুকতে দেখলেন গেইট দিয়ে। মেরুন রঙের আনারকলি পরা। অর্ণব তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলেন। নিচে আসতেই দেখলেন পদ্মাবতী, শমিত সবাই তৈরি হয়ে সেখানে বসে আছেন।
“তোরা কোথাও যাচ্ছিস?”
“মেলায়।”
“মেলায় মানে?”
“আরে এখানে খুব বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। যাবি তুই আমাদের সাথে?”
“বাচ্চা পেয়েছিস নাকি আমাকে? মেলায় যাবো কী করতে?”
“মেলায় কী শুধু বাচ্চারা যায় নাকি?”
“তা নয়তো কী?”
“ধুর। যেতে হবে না তোকে।”
মোহিনী ভেতরে ঢুকেই বললেন,
“বের হবে তোমরা এখন?”
অর্ণব শমিতকে টান দিয়ে পাশে এনে নিচু স্বরে বললেন,
“মোহিনীও যাবে নাকি তোদের সাথে?”
“যাবে না আবার! ওকে ছাড়া চলবে নাকি?”
“আগে বলিসনি কেন? আমিও যাবো তোদের সাথে।”
“কেন? তুই কেন যাবি? ওখানে তো বাচ্চারা যায়। তাই না?”
অর্ণব জোরে চিমটি কাটতেই শমিত চিৎকার করে উঠলেন। উপস্থিত সবাই তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শমিত গলা নিচু করে বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা। অভিনয় শুরু কর।”
“ঠিকাছে।”
শমিত এবার বাকিদের শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন,
“অর্ণব, বলছিলাম কী। তুই তো আমাদের সাথে কোনোদিন মেলায় যাসনি। আজ চল তাহলে। দেখে আয় একটু।”
“না না। তোরাই যা। আমার এসব ভাল্লাগে না।”
শমিত আবার গলা নিচু করে বললেন,
“বেশি ভাব নিস না। নয়তো না নিয়েই চলে যাবো। চুপচাপ রাজি হয়ে যা।”
“আচ্ছা।”
শমিত আবার জোরে জোরে বললেন,
“আরে চল না। একদিন গেলে কিছুই হবে না। দেখবি ভালোই লাগবে।”
“ঠিকাছে। চল তাহলে। একটা দিনই তো।”
পদ্মাবতী বলে উঠলেন,
“তোমরা বারবার কানে কানে কী কথা বলছিলে শমিতদা?”
“কানে কানে কথা বলছিলাম? কই না তো। তুই ভুল দেখেছিস।”
“না, আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“আচ্ছা দেখেছিস ভালো করেছিস। বাদ দে তো। চল এবার।”
“চিত্রাও সাথে থাকলে ভালো হতো।”
“ও কী করে থাকবে? ও তো গেছে ওর মামার বাড়ি।”
মোহিনী বললেন,
“গিয়ে এসেও পড়েছে। ওই দেখো।”
হাত দিয়ে বাইরে ইশারা করলেন। ব্যাগবোঁচকা নিয়ে চিত্রা আসছেন। শকুন্তলা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিত্রাকে আসতে দেখে বললেন,
“কি রে, তুই না একসপ্তাহর জন্য গেলি? দু’দিন বাদেই চলে এলি যে?”
“একটুও ভালো লাগছিল না। বিশেষ করে আপনার মায়ের জন্য। কী পরিমাণ যে কথা বলতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। বাপরে বাপ! কানটা ঝালাপালা হয়ে যায়। বুড়ি হয়ে গেছে অথচ এখনো চাপার জোর কমেনি।”
মোহিনী হেসে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,
“তুই কি আমাদের সাথে যাবি?”
“কোথায়?”
“মেলায়।”
“না, তোরা যা। আমি অনেক ক্লান্ত এখন। একটু ঘুমাবো।”
শমিত বললেন,
“তাহলে আর কী করার। আমরা এখন বের হই চল।”
অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“দাঁড়া। আমি পোশাক পাল্টে আসছি।”
“এখন আবার পোশাক পাল্টাতে যাবি?”
“সমস্যা কই?”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“পোশাক পাল্টাবে আর কতই বা সময় লাগবে?”
“তবুও।”
“তোর এতো তাড়া কেন বলতো।”
“কই? আমার কোনো তাড়া নেই। তুই যা। পোশাক পাল্টে আয়। আমরা অপেক্ষা করছি।”
শমিত কথা শেষ করার আগেই অর্ণব দোতলায় চলে গেলেন। নববর্ষে পরার মতো একটা পাঞ্জাবি পরে কিছুক্ষণের মাঝেই ফেরত এলেন। তারা বের হয়ে কিছুদূর যেতেই সামনে শেফালীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। অর্ণব গাড়ি চালাচ্ছিলেন। শমিত তাড়াতাড়ি থামাতে বললেন। অর্ণব গাড়ি থামালে শেফালীও এসে যোগ দিলেন তাদের সাথে। এরপর একদম মেলার গেইটের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়িটা রেখে এলেন। সবাই ইতোমধ্যেই ভেতরে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগলো না অর্ণবের। শমিত বললেন,
“অর্ণব, ও শেফালী।”
“দেখেছি তোর সাথে আগেও। এটাও জানি কে ও।”
“দেখলেও পরিচয় তো ছিল না। তাই পরিচয়টা করিয়ে দিলাম।”
পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভালো করে শোন পদ্মা। এবারও যদি হারিয়ে যাস তো ঝালমুড়ির দোকানে বসে কাঁদবি না। একদম গেইটের সামনে চলে যাবি। আমরা খুঁজে নেবো তোকে।”
“উঁহু, আমি এবার হারাবোই না। সাথে সাথে থাকবো তোমাদের।”
“ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”
“থাকবে।”
শেফালী বলে উঠলেন,
“এই, হাতির পিঠে চড়বে?”
“হাতি কোথায় পেলে?”
“আরে ওইযে, সামনে দেখছো না। চলো না, আমার অনেকদিনের শখ।”
“উঠবে? চলো তাহলে। আমরা সবাই যাই।”
“তার আগে কুলফি কিনে দাও।”
শমিত পাঁচটা কুলফি নিয়ে আসলো। শেফালীর হাতে একটা দিয়ে পদ্মাবতী আর মোহিনীর দিকে বাড়ালে তারা বললেন,
“আমি খাবো না।”
“আমিও না।”
“খাবি না কেন?”
“নারকেল আছে এতে। মোহিনী আর আমি দুজনেই এটা পছন্দ করি না।”
“নারকেল ছাড়া তো নেই।”
“তাহলে থাক।”
“অর্ণব, তুই নে।”
“না, আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে।”
“যাব্বাবা, তাহলে কিনলাম কেন?”
শেফালী বলে উঠলেন,
“রাখো তো, আমিই খেয়ে ফেলতে পারবো সব। চলো এবার।”
শেফালী আগে আগে হাতির পিঠের ওপরে করা আসনে উঠে বসলেন। মোহিনী এগিয়ে গেলে অর্ণব সবার অগোচরে তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলেন। এক হাতির উপর চারজন উঠতে পারবে দেখে বুদ্ধি করে আগেভাগেই মোহিনীকে সরিয়ে নিলেন। পদ্মাবতী আর শমিতও উঠে পড়লে অর্ণব মোহিনীকে নিয়ে আরেকটায় উঠলেন। হাতি উঠে দাঁড়ানোর সময় একটু হেলতেই মোহিনী অর্ণবের হাত একদম খামচে ধরলেন। খুব খুশি দেখাচ্ছে তাদেরকে। দূর থেকে দু’জনকে একসাথে এতো খুশি দেখে অজান্তেই পদ্মাবতীর ঠোঁটে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠলো।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“এটা কী জিনিস?”
হাতের জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখে অর্ণবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন মোহিনী।
“মুঠোফোন। কলকাতায় নতুন এসেছে। তাই আনিয়েছি আপনার জন্য।”
“মুঠোফোন! সেটা আবার কী জিনিস?”
“দূরাভাষ যন্ত্র।”
“মানে?”
“এটা দিয়ে আপনি যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবেন। আপনি যত দূরেই থাকুন না কেন, চাইলেই এটার সাহায্যে কথা বলতে পারবেন আমার সাথে।”
“আপনাদের বাড়িতে যে আছে টেলিফোন। ওটার মতো?”
“কিছুটা।”
“যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবো?”
“হ্যাঁ। তবে অপরজনের কাছেও এটা থাকতে হবে।”
“যাহ। তা কী করে সম্ভব? এটায় তো তারই নেই।”
“এটায় তারের প্রয়োজন পড়ে না। বেতার।”
“কীভাবে? এ আবার হয় নাকি?”
অর্ণব নিজের কাছে থাকা আরেকটা মুঠোফোন দিয়ে মোহিনীর হাতে থাকাটায় কল করতেই সেটা বেজে উঠলো। অর্ণব ইশারা করে মোহিনীকে কলটা ধরতে বললেন। সবুজ বোতামটা চেপে কানে ধরতেই অর্ণব বললেন,
“কী? এবার বিশ্বাস হলো তো?”
মোহিনী অর্ণবের দিকে তাকিয়ে দু’বার ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন।
.
.
.
বাড়ি ফিরতেই একটা শোরগোল কানে এলো অর্ণবের। বাড়ির সবাই উপস্থিত সেখানে। কেউ বাদ নেই। অতিরিক্ত আরও তিন-চারজনকে দেখলেন। তাদের মধ্যে একজন শেফালী। বউয়ের সাজে এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটা। অর্ণব সেখানে দাঁড়িয়েই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন যে কী হয়েছে। একজন ভদ্রলোক হাত জোর করে অনুরাধার কাছে আকুতি করছেন। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে উনি শেফালীর বাবা।
“দয়া করুন। গ্রামে আমাদেরও একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”
অনুরাধা চড়া গলায় বললেন,
“মান সম্মান? কিসের মান সম্মানের কথা বলছেন? আপনার ছোট মেয়ে কেন মরেছে তা বুঝি কেউ জানে না ভেবেছেন? এরপরও মান সম্মানের কথা বলছেন?”
“আমার মেয়ে যে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যাবে। পরে কে বিয়ে করবে ওকে?”
“সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আপনার উচিত ছিল নিজের মেয়েকে ধরে রাখা। আপনি পারেননি সেটা আপনার ব্যর্থতা।”
পাশে থেকে আরেকজন লোক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
“দেখুন, আপনার ছেলের জন্য আমার ভাইঝির বিয়ে ভেঙেছে। ও রাস্তায় বরের গাড়ি থামিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। তা নাহলে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে কেন ভাঙতে যাবে? আপনি যদি শমিতের সাথে শেফালীর বিয়ে না দেন তবে কিন্তু আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হব। পুরো গ্রাম জানে আপনার ছেলে আমাদের মেয়ের পেছনে ঘোরে।”
“হুমকি দিচ্ছেন আমাকে আপনি? হুমকি দিচ্ছেন? যা পারেন করেন। আমি আমার ছেলেকে এমন পরিবারের এমন একটা মেয়ের সাথে কখনোই বিয়ে দেব না। আমার ছেলেকে আমি নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করাবো। আপনারা বের হন বাড়ি থেকে। নাহলে দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করাবো।”
শেফালী অনর্গল কেঁদেই চলেছেন। অনুরাধা তার সামনে গিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে, লজ্জা বলতে কিছু নেই তোমার? আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ওর ঘাড়ে চেপে বসতে চাইছো? লজ্জা করে না? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে কোথাকার।”
শেফালী আরও জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শেফালীর বাবা তার হাত ধরে বললেন,
“চল এখান থেকে।”
“বাবা।”
স্ব জোরে শেফালীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। এরপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেয়েটা করুণ চোখে একদৃষ্টিতে শুধু শমিতের দিকেই চেয়ে রইলো। অর্ণব শমিতকে দেখে বেশ অবাক হলেন। এতোকিছু হয়ে গেল, তার মা তার প্রেমিকা আর প্রেমিকার পরিবারকে এতোকিছু বললেন, অপমান করলেন অথচ তিনি একবারও এর প্রতিবাদ করলেন না। অনুরাধার রাগ দেখে আজ কেউ আর তাকে থামায়নি। চাইলেও পারতো না। অর্ণব নিজেও তো শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই গেলেন। আচ্ছা, এমনটা যদি মোহিনীর সাথে হতো তাহলে তিনি কি পারতেন চুপ থাকতে? একদমই না। অবশ্যই এসবের প্রতিবাদ করতেন। সবাই চলে গেলে অর্ণব শমিতকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই সত্যিই শেফালীর বিয়ে ভেঙেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“ভালোবাসি ওকে। কী করে বিয়ে হয়ে যেতে দিতাম?”
“সত্যিই ভালোবাসিস? তাহলে নিচে কিছু বললি না কেন? পিসির কথার প্রতিবাদ করলি না কেন?”
“বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উল্টে গেলেও মায়ের মুখের ওপর কথা বলার, তার অবাধ্য হওয়ার, বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আমার নেই।”
“কেন?”
“তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর ভয়।”
“নিজের মাকে ভালোবাসিস আর ওই মেয়েটার সাথে শুধু ভালোবাসার নাটক করে গেছিস এতোদিন?”
“এমনটা নয় অর্ণব। তুই আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর। আমার জায়গায় যদি তুই থাকতিস, মা আর শেফালীর জায়গায় যদি বড় মামি আর মোহিনী থাকতো তাহলে তুই পারতিস বড়মার বিরুদ্ধে যেতে?”
অর্ণব কিছু সময় চুপ রইলেন। এরপর বললেন,
“অবশ্যই পারতাম। মা যদি ভুল করতেন তাহলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতাম।”
“বলা সহজ অর্ণব। করা নয়। মায়ের আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারবো না।”
“তাহলে তুই এখন কী করবি?”
“জানি না। যাই করি, তার অবাধ্য হয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তুই আমাকে এ নিয়ে এখন আর কিছু বলিস না। আমার মাথা ঠিক নেই। পরে কথা বলবো।”
শমিত চলে গেলেন। পুরো বাড়িটায় একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অস্থির হয়ে উঠেছেন চিত্রা। প্রচন্ড ঘামছেন তিনি। একটা ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। হাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে বসে পড়লেন তিনি।
.
.
.
“তুমি কথা দিয়েছিলে শ্যামল। তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। যে করেই হোক মা-বাবাকে বোঝাবে। তাহলে এখনো আসছো না কেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?”
“তোর কী মনে হয়? আমি এখনো তোকে বিয়ে করবো? তোর ভাইয়ের জন্য আমার বোনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও ভাবলি কী করে যে আমি তোকে বিয়ে করবো?”
“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে?”
“তো কীভাবে কথা বলবো? তোকে আমি বিয়ে করবো না। বুঝেছিস?”
“করবে না মানে? তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক করলে কেন? তোমার বাচ্চা আছে আমার পেটে। বিয়ে না করলে সবাইকে বলে দেব।”
এতোক্ষণ কেঁদে কেঁদে করুণ স্বরে কথা বললেও এবার চিত্রা শাসিয়ে উঠলেন। তার কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন শ্যামল।
“বাচ্চা মানে? কার বাচ্চা? আমি কিছু জানি না। এর দায় আমি নিতে পারবো না।”
চিত্রা দু’হাতে শ্যামলের পোশাকের কলার টেনে ধরলেন।
“কুত্তারবাচ্চা। নিবি না মানে? আমার জীবন নষ্ট করে তুই বেঁচে যাবি ভেবেছিস? ভুলে গেছিস আমি কোন বাড়ির মেয়ে? আমি মুখ খুললে সবাই একদম পিষে ফেলবে তোকে।”
নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন শ্যামল।
“যাকে যা খুশি বল। প্রমাণ করবি কী করে এটা আমার বাচ্চা? আর করলেও লোকে তোকে দোষ দেবে। তুই হবি সবার চোখে দুশ্চরিত্রা।”
নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়লেন চিত্রা।
“ভুল তো আমি করেছি। তোর মতো একটা কাপুরষকে ভালোবেসেছিলাম। দাদার কথা শুনে যদি তোর থেকে দূরে থাকতাম তো আজ আমার এই সর্বনাশ হতো না। হায় ভগবান! এ কী করলাম আমি? সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন চিত্রা। অবস্থা বেগতিক দেখে শ্যামল দৌঁড় লাগালেন। পেছন থেকে চিত্রা চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। দেওয়াল টপকাতে যাবেন ঠিক এমন সময় কেউ শ্যামলের পা টেনে ধরলেন। চিত্রা দূর থেকে দেখলেন রামু শ্যামলকে ধরে ফেলেছেন। চৌকিদারও দৌঁড়ে আসছে। তাকে কেউ দেখে ফেলার আগেই অন্ধকারে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেলে। সবার হাতেই লাঠি। যে যেমন পারছে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে শ্যামলকে। ঘরে ফিরে ভালো করে দরজা বন্ধ করে দিলেন চিত্রা। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। টেবিলের ওপর থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার হাত কাঁপছে বিধায় ঠিকমতো লিখতেও পারছেন না। ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দে লেখা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
.
.
প্রতিদিনের মতো একটা নতুন সূর্যের উদয় হলো। একটা নতুন দিন। কিন্তু এই দিনটাই পুরো বাড়িতে কালো মেঘের ছায়ার মতো ঘনিয়ে এলো। কারও চিৎকার কানে আসছে অর্ণবের। চোখ খুললেন তিনি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে এসে ঘর থেকে বের হতেই চিৎকারটা আরও স্পষ্ট শুনতে পেলেন। শকুন্তলা ডাকছেন চিত্রাকে। চিত্রার ঘরের দরজার সামনে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেছে। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আম্রপালি আর নিচ থেকে অনুরাধাও চলে এলেন। অর্ণব এগিয়ে গেলেন সেখানে।
“কী সমস্যা এখানে?”
“পদ্মাকে পাঠিয়েছিলাম চিত্রাকে ডাকতে। দরজা খোলেনি। এখন আমি এসে সেই কখন থেকে ডাকছি তাও দরজা খুলছে না।”
শকুন্তলা আরও কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলেন। অর্ণব বললেন,
“আপনি একটু সরুন। আমি দেখছি।”
শকুন্তলা সরে গেলে অর্ণব দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিত্রাকে ডাকলেন কয়েকবার। কিন্তু কাজ না হওয়ায় দরজা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। দরজায় জোরে একটা লাথি দিলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। আবারও দিলেন। এবারও ভাঙলো না। এবার আরেকটু জোরে লাথি দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মেঝেতে চিত্রার নিথর দেহটা পড়ে আছে। মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মতো কী যেন পড়ে দাগ হয়ে আছে। হাতের কিছুটা দূরেই বিষের শিশিটা। শকুন্তলা ভেতরে ঢুকেই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ধপ করে নিচে বসে পড়লেন। এক মুহূর্তেই চারদিক একদম নীরব হয়ে গেল। পদ্মাবতী দৌঁড়ে চিত্রার কাছে গিয়ে ওকে ডাকতে লাগলেন। সবার আগে ওর কান্নার শব্দটাই কানে ভেসে এলো সকলের। চিত্রার বা’হাতে একটা ভাজ করা কাগজ দেখতে পেলেন অর্ণব। তার হাত থেকে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলেন। এমন সময় শকুন্তলা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
চলবে…