মেহেরজান #পর্ব-২৯,৩০

0
669

#মেহেরজান
#পর্ব-২৯,৩০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-২৯

“মরা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি যে আমি। জানি আমার মৃত্যুতে সবাই অনেক কষ্ট পাবে। মা কাঁদবে অনেক। কিন্তু বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই আফসোস করতেন এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য। দাদা আমাকে সাবধান করেছিল। কিন্তু আমি তার কথায় কান না দিয়ে নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছি। একবার যদি শুনতাম দাদার কথাগুলো তাহলে আজ আমাকে এভাবে বিষ খেয়ে মরতে হতো না। তবুও একটা আশা ছিল। হয়তো বেঁচে থাকতাম। কিন্তু আজ পিসি যখন শেফালী আর ওর পরিবারকে অপমান করে বের করে দিল, সে আশাটাও সেখানেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। শ্যামল শুধু একটা অজুহাত খুঁজছিল আমাকে ছাড়ার। আর সেটা পেয়েও গেল। আমি যে ভুল করেছি তা যেন আর কেউ না করে।”

চিঠিটা পড়ে পাশে রাখলেন শমিত। অনেকদিন পর ছাদে দুই ভাই মদ আর সিগার নিয়ে বসেছেন। অর্ণবের দিকে হাত বাড়াতেই অর্ণব মদের বোতলটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বোতলে যতটুকু বাকি ছিল শমিত পুরোটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। আজ প্রথমবারে মতো মদে হাত লাগিয়েছেন শমিত। পাঞ্জাবির হাতায় দু-চোখ মুছে নিয়ে বললেন,

“কাল রাতে শেফালীর বাবাও মারা গেছেন। ফাঁসি দিয়ে। আর আমাদের বোনটা…।”

কথা সম্পূর্ণ করলেন না শমিত। অর্ণবও কোনো জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শমিত আবার বললেন,

“কিছু সময়ের ব্যবধানে দুটো পরিবারের দু’জন মারা গেল। এর জন্য আমিই দায়ী। তাই না রে অর্ণব?”

অর্ণব এবারও চুপ রইলেন।

“দোষ করলাম আমি আর শাস্তি পাচ্ছে অন্যরা। মা ভুল ছিলেন। তবুও আমি চুপ রইলাম। আমি এভাবে চুপ করে না থাকলে আজ হয়তো তারা দু’জনেই বেঁচে থাকতো।”

চিত্রার চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে অর্ণব বললেন,

“তুই নিজের ভুল বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস। এখন আর কিছুই করার নেই।”

আবারও কিছু সময় দু’জনেই চুপ রইলেন। এরপর শমিত বললেন,

“শেফালীর বাবা আর চিত্রাকে তো ফেরাতে পারবো না কিন্তু…।”

“কিন্তু?”

“আমি নিজের ভুলটা শোধরাতে চাই অর্ণব। তুই আমার সাথে থাকবি তো?”

“কাল সকালে দেখা যাবে। আজ বাড়ির কারও মন ভালো নেই। তুই ঘুমাতে যা।”

“উঁহু। যা করার আজই করবো।”

অর্ণব কিছুসময় শমিতের দিকে চেয়ে রইলেন। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা বাড়ির উঠোনে উপস্থিত হলেন। তিনদিকে তিনটা বড় বড় টিনের ঘর। আর অন্যদিকে ছোট্ট একটা রান্নাঘর। মাঝখানে বেশ বড় একটা উঠোন। বাড়ির ভেতর থেকে শেফালীর মা আর তার পেছন পেছন শেফালীও বের হয়ে এলেন। শমিত হাত জোর করে তাদের সামনে দাঁড়ালেন।
.
.
.
শমিতের হাত আঁকড়ে ধরে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন শেফালী। অনুরাধা রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসব হচ্ছেটা কী অর্ণব?”

অর্ণব চেয়ারে আয়েসি ভংগিমায় বসে বললেন,

“দেখতেই তো পারছেন পিসি। বিয়ে করেছে ওরা।”

“বিয়ে করেছে বললেই হলো? আমি মানি না এই বিয়ে।”

“এখন আর আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসে না। এর চেয়ে ভালো আপনি বরং ওদের মেনেই নিন।”

সাবিত্রী সেখানে দাঁড়িয়েই সব শুনছেন। চিত্রার মৃত্যুর খবর পেয়ে কাল যতদ্রুত সম্ভব ছুটে এসেছেন এখানে। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কাল তোমার বোনটা মারা গেল। আর আজই তুমি এমন একটা কাজ করলে? তোমাকে দিয়ে এটা আশা করিনি।”

“ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার এই বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো।”

সাবিত্রী চুপ হয়ে গেলেন। আম্রপালি বলে উঠলেন,

“অর্ণব, কীভাবে কথা বলছিস তুই?”

“আমি দুঃখিত মা। তবে আপনিও দয়া করে এব্যাপারে জড়াবেন না। আমি পিসির সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। শুধু শমিত আর শেফালী থাকবে এখানে।”

অর্ণবের কথা শুনে আম্রপালি আর সাবিত্রী বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কিন্তু কোণায় পদ্মাবতী আগের মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার উদ্দেশ্যে অর্ণব বললেন,

“তোমাকে কি আলাদা করে বলতে হবে?”

পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন।

“তাহলে?”

অর্ণব প্রশ্ন করা মাত্রই পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ালেন অর্ণব। বললেন,

“জানেন পিসি, এ বাড়ি থেকে চিত্রার লাশ ওঠার আগে শেফালীদের বাড়ির একজনের লাশ উঠেছিল। কে জানেন? শেফালীর বাবা। যাকে আপনি যা-তা বলে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অথচ দোষটা কিন্তু আপনার ছেলেরই ছিল। আর যে দু’জন মারা গেল, তাদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী জানেন? আপনি।”

“আমি কীভাবে? চিত্রা কেন মরেছে সেটা আমি কীভাবে জানবো?”

“সেটা আমি এখন আপনাকে বোঝাতে পারবো। আসলে জানাতেই চাই না। কিন্তু শেফালীর বাবার মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী এটা কি মানেন?”

অনুরাধা জবাব দিলেন না। অর্ণব আবার বললেন,

“না মানলেও কিছু করার নেই। এতে সত্য বদলাবে না। এবার বলুন, দু’জনের মৃত্যুর বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবেন শান্তিতে?”

পাশে থেকে শমিত তাকে ডেকে উঠলে হাতের ইশারায় শমিতকে থামিয়ে দিলেন তিনি। অনুরাধার উদ্দেশ্যে আবার বললেন,

“পারবেন না পিসি। তাই ওদের বিয়েটা নিয়ে আর অশান্তি বাড়াবেন না। আর মেয়েটাকেও এবাড়িতে শান্তিতে বাঁচতে দিন।”

অনুরাধা শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কিরে? কিছু বলবি না তুই? ও আমাকে এসব মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে আর তুই চুপ করে আছিস?”

“অর্ণব কিছু ভুল বলছে না মা। আর আমিও কোনো ভুল করিনি। তাই আমাদের বিয়েটা আপনার মেনে নেওয়াই ঠিক হবে।”

অনুরাধা হতভম্ব হয়ে শমিতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পেছনে শেফালীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো কেমন যেন চকচক করে উঠেছে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এরপর অর্ণবের দিকে তাকালেন। তার শান্ত চেহারার ঠোঁটে হাসির স্মিত রেখা ফুটে উঠছে। অনুধারার চোখ জলে ভরে গেল। আবার শমিতের দিকে ঘুরে বললেন,

“এইদিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম আমি? আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই?”

শমিত কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনুরাধা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শমিত তাকে আঁটকাতে যাবেন তখনই অর্ণব থামিয়ে দিলেন তাকে।

“দাঁড়া।”

“কিন্তু মা?”

“পিসি নিজেই শান্ত হয়ে যাবেন। তুই চিন্তা করিস না।”
.
.
.
“অর্ণব এটা কেমন কাজ করলো আম্রপালি? চিত্রাটা মারা গেল দু’দিনও হলো না আর ও শমিতকে নিয়ে এমন একটা কাজ করলো। তুমি আগে থেকেই জানতে এসব। তাই না?”

“বিশ্বাস করুন মাসিমা। আমি এসবের কিচ্ছু জানতাম না। অর্ণবের মধ্যে আজ যে পরিবর্তনটা দেখলাম তা আগে কখনো দেখিনি।”

“কাল সারারাত ছেলে দু’টো বাড়িতে ছিল না। মন মেজাজ ভালো নেই বলে সেদিকে তেমন একটা খেয়াল ছিল না কারও। কিন্তু ওরা যে এমন একটা কাজ করে বসবে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি।”

কথা বলতে বলতে দু’জনে শকুন্তলার ঘরে ঢুকলেন। খাটের ওপর উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে রয়েছেন শকুন্তলা। একদম ভেঙে পড়েছেন তিনি। একদিনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। শকুন্তলাকে উঠিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। সাবিত্রী তার পাশে বসে আম্রপালি আর পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“তোমরা কাল থেকে ওর সাথেই আছো। এখন নিজেদের ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। তাছাড়াও তোমাদের অন্যান্য কাজও আছে। আমি আছি শকুন্তলার সাথে। তোমরা যাও।”

“কিছু লাগলে আমাদের জানাবেন মাসিমা।”

“ঠিকাছে।”

আম্রপালি আর পদ্মাবতী চলে গেলে শকুন্তলা বললেন,

“বাড়িতে তখন কিসের চেঁচামেচি হলো মা?”

“শমিত বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।”

শকুন্তলা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন,

“এদিকে আমার মেয়ে মরলো আর ওদিকে ওরা বিয়ে করছে।”

“আরে ওই অর্ণব করিয়েছে ওদের বিয়ে।”

“অর্ণব?!”

“হ্যাঁ।

“অভ্র আসেনি মা?”

“এখনো তো না।”

“আসবেও না দেখে নিও তুমি। ও কখনো চিত্রাকে নিজের মেয়ে ভেবেছে নাকি? জন্মের সময়ও আসেনি আর এখন মরেছে তবুও আসবে না।”

“আহ। এমন কথা বলছিস কেন? যতই হোক চিত্রা ওর মেয়ে। তখন না হয় সেই বিলেতে ছিল বলে আর আসতে পারেনি। তাই বলে কি এখনো আসবে না?”

“কী করবে ও এসে? চিত্রা কি এখনো আছে নাকি? সারাজীবন যে নিজের মেয়েকে একবার ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয়নি, এখন সে মেয়ে মরার পর কী দেখতে আসবে? তুমি খুঁজে খুঁজে আমাকে এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিলে যার কাছে নিজের স্ত্রী আর মেয়ের কোনো মূল্যই নেই।”

“এসবে তোর তো কোনো দোষ নেইরে মা। অভ্র ছেলে চেয়েছিল। হয়েছিলোও তো। কিন্তু মরা বাচ্চা হলে সেখানে তোর কী দোষ? দেখিস, ও ঠিক একদিন তোর কষ্টটাও বুঝবে।”

“ওর আর ওর সহানুভূতির কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার যা ছিল সব চিত্রাই ছিল। আর সেও নেই এখন। সব শেষ হয়ে গেল। দোষ তো আমার মেয়েটারও ছিল না মা। ও কেন মরলো?”

সাবিত্রীর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন শকুন্তলা। নিজের ভেজা চোখ দুটো মুছে তার মাথায় হাত রাখলেন সাবিত্রী। কী একটা বলতে গিয়েও কেন যেন বললেন না। হঠাৎ-ই বাইরে থেকে অভ্র বাবুর কণ্ঠ ভেসে এলো।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

নদীর পাড়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছেন অর্ণব। হঠাৎ মাথায় কারও কোমল হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করলেন। অপার দিগন্তে আবদ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। মুচকি হেসে মোহিনী হাত ধরে ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে এলেন। চোখ খুলে মোহিনীকে একনজর দেখে টান দিয়ে নিজের পাশে বসালেন।

“হঠাৎ এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছেন কেন মেহের?”

“আপনাকে দেখাবো না তো আর কাকে? এখানে এভাবে একা একা বসে আছেন কেন?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অর্ণব। বললেন,

“চিত্রার মৃত্যুটা আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না মেহেরজান। তার ওপর বাড়িতেও কিছু ঠিক নেই। পিসি এখনও রেগে আছেন।”

“চিন্তা করবেন না অর্ণব। আপনি কোনো ভুল করেননি। যা করেছেন ঠিক করেছেন। দেখবেন খুব তাড়াতাড়িই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

“তাই যেন হয়।”

“এটা আমার খুব পছন্দের। কিন্তু ছিড়ে গেছে। আপনি ঠিক করে এনে দেবেন?”

অর্ণবের সামনে একটা ঘুঙুর উঁচু করে ধরলেন। অর্ণব ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে সামান্য হেসে বললেন,

“দেবো। তবে একটা শর্তে।”

“কী শর্ত?”

“এটা আর কোনোদিন আপনি পায়ে পরবেন না।”

“মানে?”

“নাচ ছেড়ে দিন।”

মোহিনী নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

“কী হলো? পারবেন না?”

“কিন্তু হঠাৎ করে…।

“আমি বাড়তি কোনো শব্দ শুনতে চাই না। আমি আমার শর্ত রেখেছি। এবার আপনি এক শব্দে জবাব দিন। পারবেন কিনা?”

মোহিনী আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“পারবো। আপনার জন্য সব করতে পারবো। আপনি যা বলেছেন তাই হবে। আর নাচবো না আমি।”

“বাড়িতে গিয়ে কী বলবেন?”

“যেটা সত্যি সেটাই। আর তারামা আমার কথা ঠিকই রাখবেন। তার মুখের ওপরে কিছু বলার কারও সাহস হবে না। আপনি এটা নিয়ে ভাববেন না।”

মোহিনী গালে একহাতে আলতোভাবে স্পর্শ করলেন অর্ণব।
.
.
.
রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন শেফালী। গায়ে ঝলমলে রঙ্গিন শাড়ি। গা ভরা গয়না। চেহারায় হালকা প্রসাধনীর ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন বউ। তাকে দেখেই অনুরাধা রান্নাঘরের কাজ ফেলে উঠে যাচ্ছিলেন। শেফালী তার পথ আঁটকে বললেন,

“আপনার আমাকে নিয়ে এখনো এতো কিসের সমস্যা মা? আমি আপনারই ছেলের বউ।”

“এই মেয়ে, খবরদার। একদম মা ডাকবে না আমাকে।”

“শাশুড়ীকে মা ডাকবো না তো কী ডাকবো? শাশুড়ী, ও শাশুড়ী?”

“তুমি আসলেই নির্লজ্জ একটা মেয়ে।”

অনুরাধা চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শেফালী তার বাহুতে ধরে ঝাঁকিয়ে আবার নিজের সামনে দাঁড় করালেন।

“এই মেয়ে, হচ্ছেটা কী? ছাড়ো আমাকে।”

“কোথায় যাচ্ছেন? দাঁড়ান এখানে। চুপচাপ দাঁড়ান বলছি। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”

অনুরাধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। শেফালী তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,

“আপনার কী মনে হয়? আপনার ছেলের প্রেমে পাগল হয়ে আমি এবাড়িতে এসেছি?”

“নাহ। একদম না। তুমি তো এসেছো লোভে পড়ে। এতো বড় বাড়ির বউ হওয়ার লোভ সামলাতে পারোনি। তাই আমার ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে উঠে এসেছো এবাড়িতে। তোমাকে আমি চিনি না ভেবেছো?”

শেফালী সামান্য হেসে বললেন,

“আপনি আসলেই আমাকে চেনেন না মা। আমি এখানে প্রেমের টানেও আসিনি আর লোভে পড়েও আসিনি। এসেছি আপনাদের জীবন দূর্বিষহ করে তুলতে। আপনার আর আপনার ছেলের জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এখনো ভালোবাসা থাকবে ভেবেছেন? দেখুন না, আপনাদের মা, ছেলের জীবনটা কীভাবে বিষিয়ে দিই আমি। আর আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না।”

“তোমার চাওয়া কোনোদিনও পূরণ হবে না। আমি হতে দেব না। আজ রাতে অভ্র কলকাতায় ফিরছে। ওর সাথে জানো আর কে যাচ্ছে? শমিত। যাও, ঘরে গিয়ে নিজের স্বামীর ব্যাগ গোছাও। আর দেখেও এসো ভালো করে। আবার কবে দেখতে পারবে তার তো ঠিক নেই। হয়তো আর দেখতেই পারবে না। কারণ দেখার জন্য তুমি নাও থাকতে পারো।”

“এসব হুমকি অন্য কাউকে দেবেন। আমাকে না। আমাকে এসব বলে আঁটকানো যাবে না।”

কথাটা বলেই শেফালী চলে গেলেন। অনুরাধা বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ঘরে এসেই দেখলেন মোহিনী আগে থেকেই তার ঘরে এসে বসে আছেন।

“কিরে? তুই কখন এলি?”

“কিছুক্ষণ আগে। তুই ছিলি না। কোথায় গিয়েছিলি?”

শেফালী একটা ব্যাগ আর শমিতের জামাকাপড় বের করলেন। মোহিনীর সামনে বসে সেগুলো ভাজ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন,

“রান্নাঘরে। মায়ের সাথে কথা বললাম।”

“মা?”

“আমার শাশুড়ী।”

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই বিয়েটা করেছিস। যাদের জন্য নিজের বাবাকে হারালি, তাদেরই আপন করে নিলি।”

“বিশ্বাস না করে তো উপায় নেই। বিয়ে তো করেছিই। কিন্তু কেন করেছি? কী মনে হয় তোর?”

“সে তোর নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। এতোটুকু তো তোকে আমি চিনিই।”

“ঠিক বলেছিস। একটু আগে মাকেও সেই কথাই বললাম।”

“কী বললি?”

“বলেছি আপনাদের মা ছেলের জীবন বিষিয়ে দিতে এসেছি।”

মোহিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“তারপর?”

“তারপর আর কী? আমাকে এটা ওটা কথা শোনালেন। হুমকি-ধমকি দিলেন। আর সবথেকে বড় কথা কী জানিস?”

“কী?”

“শমিতকে মামার সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন আজ। এজন্যই তো ওর কাপড়চোপড় গোছাচ্ছি। উনি ভেবেছেন এতে আমার কিছু যায় আসে। কিন্তু জানিস, শমিতকে আমি যেমন ঘৃণা করি তেমন ভালোওবাসি। যতই হোক, পুরোনো স্মৃতি তো আর ভোলা যায় না। এজন্য অর্ণবদার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। তুই অনেক ভাগ্য করে অর্ণবদার মতো একজনকে পেয়েছিসরে। যে কাপুরুষের মতো তোকে কখনো ছেড়ে যাবে না। দুঃসময়ে শমিতের মতো পিছিয়ে যাবে না।”

মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছেন।

“কিরে? ওভাবে কী দেখছিস? ওহ, বুঝেছি। ভাবছিস আমি কী করে জানলাম?”

মোহিনী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লেন।

“শমিত আমার কাছে কিচ্ছু লুকোয় না। ও-ই বলেছিল।”

“কে জানে আর কে কে জেনে গেছে। আমি তো এখনো পদ্মাকেও কিছু বলিনি। কিন্তু দেখ, ওর আগে তুই ঠিকই জেনে গেছিস।”

“পদ্মা এতোটাও বোকা না যে না বললে বুঝবে না। আমার তো মনে হয় ও জানে। শুধু ও কেন? এপাড়ার সবাই জানে। প্রায়ই তো অনেকেই দেখেছে তোদের একসাথে। কানাঘুঁষাও শুনেছি আমি। এবাড়ির মানুষ জানতেও দেরি নেই বোধহয়।”

“জানলে জানবে। বেশিদিন লুকিয়ে রাখা তো সম্ভব নয়।”

“সাবধানে। এখানে তো সবাই মুখোশ পরে থাকে মনে হয়। বাইরে এক আর ভেতরে আরেক।”

“এমন বললি কেন?”

“তেমন কিছু না। সময় হলেই বুঝবি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here