#মেহেরজান
#পর্ব-৩৮,৩৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-৩৮
জরুরী একটা কাজে যেতে হবে অর্ণবকে। কিন্তু মোহিনীকে কিছুতেই যাওয়ার কথা বলতে পারছেন না তিনি। বললে যে মোহিনী রেগে যাবেন তা নিশ্চিত। কিন্তু কাজটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। না গিয়ে উপায় নেই। একটু পর পরই হাতঘড়িতে সময় দেখছেন তিনি। বিরক্ত হয়ে মোহিনীই জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার সমস্যা কী বলুনতো? একটু পর পর সময় দেখছেন কেন?”
“আমার একটা ছোট্ট কাজ ছিল। যেতে হবে আমাকে।”
“কিসের কাজ?”
“সেটা বলা যাবে না এখন। একটু গোপনীয়। পরে জানতে পারবেন।”
অর্ণবের কথায় যেন মোহিনীর রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“মিথ্যে বলছেন আপনি। আপনার কোনো কাজ নেই।”
“আশ্চর্য তো! আমার কোনো কাজ থাকতে পারে না?”
“কোনো চাকরি-বাকরি তো আর করেন না আপনি। বাড়িতেই থাকেন সবসময়। কিসের কাজ তাহলে আপনার? নাকি অন্য কিছু?”
মোহিনীর কথায় খোঁটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন অর্ণব। তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
“অন্য কিছু মানে? কী বলতে চান আপনি?”
“বউয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তাই না? পদ্মার কাছে যাবেন নিশ্চয়ই?”
“অনেক হয়েছে মেহের। আপনি এখন সীমা অতিক্রম করে ফেলছেন।”
মোহিনী ঝ্যাংটা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“সীমা আমি না আপনি অতিক্রম করছেন। আপনার মধ্যে পরিবর্তন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি।”
“চুপ করুন মেহের। অযথা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবেন না দয়া করে।”
“মিথ্যে বলছি না আমি। যা দেখতে পাচ্ছি সেটাই বলছি। আজকাল আপনার মন একটু বেশিই বাড়িতে পড়ে থাকে। কেন বলুন তো? নাকি পদ্মার প্রতি আপনার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে?”
অর্ণব ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“ব্যস মেহের। অনেক বেশি বলে ফেলেছেন। আর একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না আপনি।”
মোহিনী ভয়ে একবার কেঁপে উঠলেন। কিছু বলতে গেলে অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অনুশোচনায় নিজের দু’গালে দুটো চড় মে/রে বসে পড়লেন মোহিনী। প্রচুর রাগ হতে লাগলো নিজের ওপর। অর্ণবকে সবসময় একটা অপরাধবোধে রেখে তার থেকে আরও বেশি ভালোবাসা পেতে চান মোহিনী। কিন্তু আজ মনে হয় একটু বেশিই বলে ফেলেছেন তিনি। প্রচন্ড রেগে গেছেন অর্ণব। আগে কখনো এভাবে রাগতে দেখেননি তাকে। এমনকি উচ্চস্বরে তার সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি কখনো। রাগে টেনে টেনে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে মোহিনীর।
.
.
.
মেঘলা আকাশ। যেকোনো সময়ই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। সাদা কালো মেঘের মাঝেই উড়ছে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। দূরে একদল বাচ্চারা ওড়াচ্ছে। পদ্মাবতীর হাতেও একটা রয়েছে। ঘুড়ির লাটাই হাতে নিয়ে ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তিনি ঘুড়ি ওড়াতে জানেন না। মোহিনী জানতেন। সবসময় তিনিই ওড়াতেন। পদ্মাবতী তার সাথে থাকতেন। তাদের ঘুড়িটা উড়তো সবচেয়ে উচুতে। সবার ঘুড়ি ছাড়িয়ে। মোহিনীর কথা মনে পড়লেই অর্ণবের দেওয়া সকল যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে যায় পদ্মাবতীর। প্রথমবার কেউ হাত তুলেছে তার গায়ে। তার ভালোবাসার মানুষটাই। যাকে কি-না সবথেকে বেশি ভালোবাসেন তিনি। যার জন্য মোহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দু’বার ভাবেননি তিনি। সেই মোহিনীর জন্যই অর্ণব তাকে চড় মা/রলেন। মনের মধ্যে একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন পদ্মাবতী। ভেতরে ভেতরে প্রলয় বয়ে গেলেও বাইরে থেকে সবসময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। অর্ণবকে বাড়িতে ফিরতে দেখলেন ওপর থেকে। কিছুক্ষণ বাদেই আবার দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখলেন। গায়ে জ্বলুনি উঠে গেল তার। ছাদের কিনারা থেকে ধাক্কা দিয়ে একটা ফুলের টব নিচে ফেললেন। বিকট শব্দে টবটা পড়ে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে তা থেকে সব মাটি ছড়িয়ে পড়লো। অর্ণব ফিরেও তাকালেন না। নিজের মতো চলে গেলেন। কিন্তু রামু আওয়াজ পেয়ে দৌঁড়ে এলেন। নিচে ভালো করে দেখে ওপরে তাকালেন। পদ্মাবতীকে দেখতেই ডাক দিলেন। কিন্তু পদ্মাবতী কোনো উত্তর না নেওয়ায় তিনি আবার চলে গেলেন। পদ্মাবতী অপলকভাবে সামনে তাকিয়ে রইলেন। রাগ, দুঃখ, অনুশোচনা একত্রে গ্রাস করছে তাকে। তবুও নিজের মনকে বুঝ দিতে লাগলেন তিনি। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত নই। উনি আমাকে ভালোবাসেন না তাতে কী? আমি তো বাসি। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই। মোহিনী ওনাকে যতটা ভালোবাসে, তার চেয়েও হাজার গুন বেশি আমি ভালোবেসেছি ওনাকে। তাকে পাওয়ার অধিকারও একমাত্র আমার। শুধু আমার।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে লাগলেন,
“তুই দেখিস মোহিনী, উনি ভুলে যাবেন তোকে। চিরকালের জন্য ভুলে যাবেন। আমি ভুলিয়ে দেব। তারপর উনি শুধু আমাকে ভালোবাসবেন।”
অসতর্কতাবশত ঘুড়ির সুতোয় আঙুল কেটে গেল পদ্মাবতীর। অজান্তেই “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠলেন। আঙুল থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সাথে সাথে আঙুল মুখে নিয়ে চেপে ধরলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে নিচে বসে পড়লেন কাঁদতে কাঁদতে। মেঘ গর্জে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। কিন্তু বর্ষার এই বারিধারা তার দেহের উত্তাপ কমাতে পারলেও অনুশোচনার অনলে পুড়তে থাকা তার হৃদয়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
.
.
.
একশো দুই ডিগ্রি জ্বর। আম্রপালি ওষুধ খাইয়ে দিলেন পদ্মাবতীকে। একবার কপালে আর গালে হাত রাখলেন। বললেন,
“ভিজেছিস কেন বৃষ্টিতে?”
“এমনি ইচ্ছে করলো একটু ভিজতে।”
“ঠিকই জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিস। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে একদম। ওষুধটাও খাসনি। ভাগ্যিস আমি এখনো জেগে ছিলাম। এদিকে না আসলে তো জানতেও পারতাম না।”
“আমি কি জানতাম নাকি যে এই অল্পতেই জ্বর আসবে? আর ভিজবো না বৃষ্টিতে।”
“জ্বর বাঁধিয়ে বলছিস আর ভিজবো না। এজন্যই বলে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।”
পদ্মাবতী বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আম্রপালি তার গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে বললেন,
“ঘুমিয়ে পড়। আমারও ঘুম পাচ্ছে প্রচুর।”
পদ্মাবতী হালকা ঘাড় কাত করলেন। আম্রপালি দরজা ভেজিয়ে চলে গেলেন। চোখ বুজে রইলেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঘুম আসলো না তার। সময় গড়াচ্ছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। জ্বর ছাড়ছে। গরম লাগছে এখন। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুই ছুই। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। ঠান্ডা বাতাস আসছে। সাথে হালকা বৃষ্টির ছিটা এসেও মুখে লাগছে তার। ভালো লাগছে এখন।
গভীর রাত। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ক’টা বাজে খেয়াল নেই অর্ণবের। মদের নেশায় চূড় হয়ে এলোমেলো পা ফেলছেন তিনি। এরই মাঝে দু’বার পিছলে পড়েছেন কাদায়। এবার তৃতীয়বারের মতো পড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
“ধুর সালা। কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই। না বাইরে, না বাড়িতে। বাইরে প্রেমিকা অবিশ্বাস করে আর বাড়িতে বউয়ের যন্ত্রণা। বউ! ওই একটা জিনিসই তো সব নষ্টের গোড়া। ওই একটা মেয়েই আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। আর আমি অর্ণব, কিচ্ছু করলে পারলাম না। আমার জীবনের ওপর আমারই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যেমন পারছে চালাচ্ছে। আর আমি কাঠেরপুতুলের মতো তাদের ইশারায় চলছি।”
বলতে বলতে নিজেই হেসে উঠলেন অর্ণব। বাড়িতে চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু চারিদিক অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে এই এক যা সমস্যা। একটু হাওয়া বইলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই ঘুমিয়েও পড়েছে। ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসলেন তিনি। বহুদিনের অভ্যেস। সহজে বদলায় না। তাই নেশার ঘোরে ভুল করে নিজের ঘরেই চলে আসলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন পদ্মাবতী গুটিসুটি মে/রে উল্টোদিকে ঘুরে বিছানায় শুয়ে আছেন। কোমরে একটা গভীর ভাজ পড়েছে তার। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে কোনোরকম গায়ে জড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় একটু পরপর কেঁপে উঠছেন তিনি। অর্ণব আরেকটু ভালো করে দেখতেই বুঝলেন কাঁপছেন না তিনি। কাঁদছেন! নিঃশব্দে কাঁদছেন। আর একটু পরপর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। অর্ণবের হাতের ধাক্কায় কিছু একটা পড়ে যেতেই তার শব্দে চমকে উঠে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী। সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্ণবের। ভেজা সাদা পাঞ্জাবী ভেদ করে বুকের কালো তিলটা দৃশ্যমান তার। পদ্মাবতী না চাইতেও সেদিকে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে আবার নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন তিনি। চোখের দিকে তাকালেন তার। অর্ণব মাতাল চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। পদ্মাবতীর পদ্মপাপড়ির মতো, দীর্ঘপল্লববিশিষ্ট চোখ দুটো জলে টলমল করছে। ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। যেন কিছু বলতে চাইছে। মনে হচ্ছে বারবার সামনে মোহিনীকে দেখছেন অর্ণব। ভুল দেখছেন না সঠিক দেখছেন তা পরখ করার মতো অবস্থায় নেই তিনি। কী ভেবে কে জানে, পদ্মাবতীকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন তিনি। নিজের অধরদ্বয় মিশিয়ে দিলেন তার অধরে।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৩৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
শেফালী টেবিলের ওপর দু’কাপ চা রাখলেন। পদ্মাবতীর কপালে হাত রেখে বললেন,
“বড় মামি বললেন তোর নাকি জ্বর এসেছিল রাতে। এখন কেমন আছিস?”
পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ভালো আছি এখন।”
শেফালী চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন,
“এখনো ঘর থেকে বের হলি না তাই ভাবলাম জ্বর-টর আবার বাড়লোই নাকি। তাই এসে পড়লাম দেখতে।”
“চা এনে ভালোই করেছিস। মাথাটা ধরেছিল একটু। এখন ভালো লাগছে।”
“অর্ণবদা কোথায় জানিস?”
“না, জানি না। আমি কী করে জানবো? উনি আমাকে বলে যান নাকি? কোথায় গেছেন?”
“কলকাতা। সকালে খাওয়া-দাওয়া করেই বেরিয়ে গেছেন।”
“হঠাৎ ওখানে কেন?”
“জানিনা। বললেন কাজ আছে। মামা যেতে বলেছেন হয়তো।”
“ফিরবেন কবে জানিস?”
“তা বলেনি। তবে থাকবে কিছুদিন বোঝাই যাচ্ছিলো। সাথে কাপড়ের ব্যাগ ছিল।”
“ওহ।”
“তুই কি আমার সাথে একটু বের হতে পারবি? যদি যেতে পারিস তো?”
“পারবো। কোথায় যাবি?”
“আমাদের বাড়িতে। একা একা যেতে ভালো লাগছে না। সেদিন যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম আজ যাবো। রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
দু’জনের চা খাওয়া শেষ। শেফালী কাপ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
“ঠিকাছে। দুপুরের খাবার খেয়েই বের হবো। তৈরি থাকিস তুই।”
পদ্মাবতী ঘাড় কাত করলেন। শেফালী চলে যেতে যেতে বলে উঠলেন,
“ওহ। আরেকটা কথা।”
“কী?”
“সকালে অর্ণবদাকে এ-ঘর থেকে বের হতে দেখলাম। কাল রাতে তোরা একসাথে ছিলি?”
পদ্মাবতী মুচকি হাসলেন।
.
.
.
কলকাতার এক সনামধন্য রেস্তোরাঁয় বসে আছেন অর্ণব। তার সামনাসামনি বসেছেন মধ্যবয়সী এক বিদেশিনী। নাম ব্রেন্ডা স্মিথ। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে বাংলা বলেন তিনি। বিলেতে অভ্র বাবুর মাধ্যমে পরিচয় তার সাথে অর্ণবের। ছোটবেলায় এই মহিলার সাথে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। কিন্তু বড় হতে হতে তাতেও মরিচা পড়েছে। ব্রেন্ডাকে কী বলে সম্বোধন করবেন তা ঠিক করতে না পেরে তাকে নাম ধরে ডাকাতেই অভস্ত্য অর্ণব। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই তিনি বললেন,
“আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ব্রেন্ডা।”
“অসম্ভব অর্ণব। আমি এতোদূর থেকে এখানে এসেছিই শুধুমাত্র অভ্রর সাথে দেখা করতে। ওর সাথে দেখা না করে আমি কিছুতেই ফিরে যাবো না।”
“কাকুর সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। উনি আপনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখতে চান না।”
“এজন্যই তো আমি তোমার সাহায্য চাইছি অর্ণব। একমাত্র তুমিই বোঝাতে পারো অভ্রকে। বোঝাও ওকে। আমার সাথে দেখা করাও। কথা বলতে বলো।”
“কাকু আপনার সাথে যোগাযোগ রাখুক এটা আমিও চাই না ব্রেন্ডা।”
অর্ণবের কথায় এবার ব্রেন্ডা কিছুটা আশাহত হলেন। তার শেষ অবলম্বন ছিলেন অর্ণব। কিন্তু তিনিও এখন তাকে কোনো সাহায্য করবেন না বলে দিলেন। ব্রেন্ডা আকুতিভরা কণ্ঠে বললেন,
“দয়া করো অর্ণব। একটাবার আমাকে অভ্রর সাথে দেখা করাও।”
“দুঃখিত ব্রেন্ডা।”
এবার ব্রেন্ডা কিছুটা বিরক্ত হলেন। সাথে রাগান্বিতও। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কটমট করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমি কি জানতে পারি কেন? কেন তুমি চাইছো না আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দিতে?”
“আমার কাকু আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। অথচ আপনি ভালোবেসেছেন তার টাকাকে। লুটেপুটে খেয়েছেন তাকে। কাকু যখন একদম নিঃস্ব হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকার পরও আপনি তাকে ফেলে চলে গেলেন। যখন কি-না তার আপনার সাহায্য বেশি প্রয়োজন ছিল। এরপরও আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে সাহায্য করবো? তার সাথে দেখা করতে দেব?”
ব্রেন্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
“আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আমি জানি আমি ভুল করেছি। তবুও আমি একটাবার অভ্রর সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে অন্তত তার কাছে ক্ষমাটা চাইতে দাও অর্ণব। একবার দেখা করাও।”
“আপনি এখন আসতে পারেন ব্রেন্ডা।”
কাজ হবে না বুঝতে পারলেন ব্রেন্ডা। তাই আর অযথা সময় নষ্ট করলেন না। একরাশ হতাশা নিয়ে উঠে চলে গেলেন। বড় একটা বোঝা যেন নেমে গেল অর্ণবের ঘাড় থেকে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন। গতকাল এই মহিলাই চলে এসেছিলেন কুঞ্জনগড়ে। তাকে থামাতেই অর্ণব ছুটে ছিলেন রেলওয়ে স্টেশনে। কোনোরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে পরের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস অভ্র বাবু অর্ণবকে আগেই টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন সবটা। তা নাহলে উনি বাড়ি পৌঁছে গেলে কত বড় ঝামেলাটাই না হতো। মোহিনী শুধু শুধু তাকে ভুল বুঝলেন। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অর্ণবের মনে পড়লো পদ্মাবতীর কথা। সেই সাথে কাল রাতের কথা। নিজের ওপর ঘেন্না হলো অর্ণবের। গা গুলিয়ে উঠলো। ব্রেন্ডা কোনোভাবে জানতে পেরে গিয়েছিলেন অভ্র বাবু কলকাতায় আছেন। তাই সরাসরি এখানে চলে এসেছেন। অভ্র বাবু এটা জানতে পেরে সকালে সাথে সাথে জানিয়েছিলেন অর্ণবকে। দ্রুত কলকাতাতে চলে আসতে বলেন তাকে। তখন বাড়ি থেকে এক প্রকার পালিয়েই এসেছিলেন অর্ণব। এখানে এসে যেন তিনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কাল রাতের মতো একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না হয় তার জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। কিন্তু সেজন্য বাড়ি ফেরা জরুরি। তবে এখন বেশ কিছুদিনের জন্য আর বাড়িমুখো হবেন না-ই ঠিক করেছেন অর্ণব।
.
.
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে বাড়ি ফিরছেন পদ্মাবতী আর শেফালী। তাদের সামনে রামু হাতে হ্যারিকেন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আম্রপালি পাঠিয়েছিলেন রামুকে তাদের দু’জনকে সাবধানে নিয়ে আসতে। শেফালীর মা আজ খুব আপ্যায়ন করেছেন তাদের। বাপ মরা মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে কেমন আছে না আছে এটা ভেবেই রাতে ঘুম হতো না তার। কিন্তু যখন শেফালীর বেশভূষা দেখে বুঝলেন মেয়েটা খুব যত্নে আছে তখন তার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগলো। বাইজীবাড়ির সামনে আসতেই পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়িটা সাজানো হয়েছে। জলসা হবে। নিশ্চয়ই অনেক জায়গা থেকে লোক এসেছে। পদ্মাবতী এই বাড়ির ভেতরে কোনোদিন যাননি। শকুন্তলার কড়া নিষেধ ছিল। বাইরে থেকেই কল্পনায় সাজাতে শুরু করলেন ভেতরের দৃশ্য। রামু আর শেফালী তার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। পদ্মাবতী সবার পেছনে থাকায় কেউ খেয়াল করেননি। শেফালী খেয়াল করা মাত্রই আবার ফিরে আসলেন। বললেন,
“কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি যে। কী ভাবছিস?”
“কিছু না। বাড়ি চল।”
পদ্মাবতী হাঁটতে শুরু করলেন। তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। মোহিনীকে নিয়ে যেন তার আর দুশ্চিন্তা রইলো না। ভালোবাসা নামক খেলায় নিজেকে জয়ী মনে হচ্ছে তার। অর্ণবকে ঠিক এভাবেই ফেরাবেন তিনি নিজের কাছে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে। তারপর অর্ণবের সবটা জুড়ে শুধু তিনি বিরাজ করবেন। মোহিনী নামে কারও অস্তিত্ব থাকবে না অর্ণবের জীবনে।
চলবে…