মেহেরজান #পর্ব-৪০,৪১

0
635

#মেহেরজান
#পর্ব-৪০,৪১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-৪০

“রোজ রোজ এই এতো মানুষের জন্য আমি রান্না চড়াতে পারবো না বলে দিলাম। যার খিদে পাবে সে নিজে রেঁধে খাক। এই আমি শুধু নিজের জন্য উনুনে ভাত চাপিয়ে দিলাম।”

রান্নাঘর থেকে কথাগুলো বেশ জোরে জোরে বললেন অনুরাধা। যেন বাড়ির সকলেই শুনতে পায়। তার কথায় শকুন্তলা বা আম্রপালি কেউ-ই কান দিলেন না। যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত। পদ্মাবতী আর শেফালী একসাথেই বসেছিলেন। পদ্মাবতী ফিসফিসিয়ে বললেন,

“এই, কী হয়েছে বলতো? বাড়ির পরিবেশ এতো গম্ভীর কেন? আবার পিসিমা এসব বলছেন যে?”

“আরে দুপুরে ছোট মামির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওনার। তাই সবাই চুপচাপ।”

“কখন হলো? আমি তো দেখলাম না।”

“তুই ছাদে ছিলিস। মা আর ছোট মামি রান্নাঘরে ছিলেন। আমি আর বড় মামি এখানেই ছিলাম। হঠাৎ মা চেঁচিয়ে ওঠেন। দু’জনে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। তারপর ছোট মামি কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। এরপর আর দু’জনে একটা কথাও বলেননি। তবে তখন কী নিয়ে কথা হয়েছিল বলতে পারলাম না।”

“সে কী! একমুহূর্তে এতোকিছু! আর তুই আমাকে এখন জানাচ্ছিস?”

“কী আর বলতাম। এসব একটু-আধটু তো হয়েই থাকে সব পরিবারে। এ আর এমন কী?”

“এটাও ভুল বলিসনি।”

“তবে দোষটা নিশ্চিত আমার শ্বাশুড়িরই। কী যে বলেছেন ওই মহিলা।”

“শেফালী! কীভাবে কথা বলছিস তুই ওনার ব্যাপারে?”

“কী? ভুল কিছু তো বলিনি। আমাকে জ্বালিয়ে মারেন ওই মহিলা। শুধু শ্বাশুড়ি বলে কিছু বলি না। এই আমি বলেই ওনার ছেলের সংসার করছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে না এমন ষড়যন্ত্রী শ্বাশুড়ির কাছে একদিনও টিকতে পারতো না। কীভাবে আমাকে শমিতের সামনে খারাপ বানানো যায় সেই মতলব আঁটেন সবসময়।”

কিছুক্ষণের জন্য রেগে গেলেও শেফালীর বলা শেষ কথাগুলো শুনে না হেসে পারলেন না পদ্মাবতী। সব ভুলে ফিক করে হেসে ফেললেন।

“হাসিস না, হাসিস না। এমন শ্বাশুড়ি তো আর তোর কপালে জোটেনি। মায়ের মতো শ্বাশুড়ি পেয়েছিস। তুই কী বুঝবি আমার জ্বালা?”

“হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না।”

শকুন্তলাকে নিজের ঘরের দিকে যেতে দেখে শেফালী বললেন,

“ছোট মামি তো রাতে না খেয়েই ঘরে চলে গেলেন।”

পদ্মাবতী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন।

“যাক। আমি বরং তার ঘরে খাবার দিয়ে আসবো। এমনিতেও মনে হয় না আজ পিসিমার সাথে এক টেবিলে বসে খাবেন।”

“রান্নাও বসানো হয়নি এখনো। মা তো শুধু নিজের জন্য করছেন বলেই দিলেন।”

“তুই যা রান্নাঘরে। আমি আসছি।”

শেফালী উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। অনুরাধা নেই এখানে। উনুনে ভাতের হাড়ি। রান্না করার সবকিছু গোছাতে গোছাতে একটা দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিল তার মনে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা ভালো করে দেখলেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে উনুনের আঁচ ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দিলেন।
.
.
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই শকুন্তলা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কে?”

“আমি ছোট মা। দরজা খুলুন।”

পদ্মাবতীর আওয়াজ পেতেই শকুন্তলা দরজা খুলে দিলেন। পদ্মাবতীকে খাবারের থালা হাতে দেখে তার মনে শান্তি লাগলো। ক্ষুধার জ্বালায় পেটের মধ্যে যেন ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছিল এতোক্ষণ।

“ভেতরে আয়।”

পদ্মাবতী ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন শকুন্তলা ইতোমধ্যেই শোয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। খাবারের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন,

“না খেয়েই শুয়ে পড়ছিলেন?”

“যাক। এ-বাড়িতে কেউ তো আছে যার আমার জন্য চিন্তা হয়। আমার খোঁজ নিয়েছে। নাহলে আমি রাতে খাই আর না খাই, তাতে কার কী আসে যায়।”

“আসে যায়, আসে যায়। অনেককিছু আসে যায়। এজন্যই তো খাবার নিয়ে এসেছি।”

“এনেছিস ভালো কথা। কিন্তু আমি খাবো না। ওটা তুই ফেরত নিয়ে যা।”

“খাবো না বললেই হবে নাকি? খেতেই হবে। এখন নিজে খাবেন নাকি আমাকে খাইয়ে দিত হবে?”

“ঢং দেখো মেয়ের! আমাকে এসেছে খাইয়ে দিতে। না জানি কত বড় হয়ে গেছে। দু’দিন আগেও যে নাকি কেউ খাইয়ে না দিলে খাবার মুখে তুলতো না, সে এসেছে আমাকে খাইয়ে দিতে।”

পদ্মাবতী ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,

“আপনার ওই দু’দিন দশ বছর আগেই চলে গেছে ছোট মা।”

“সে যাক। তাতে কী হয়েছে? তুই তো আর বদলাসনি। আগে যেমন ছিলি, এখনও তেমনই আছিস। অল্পতেই কেঁদে ফেলিস।”

শকুন্তলার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে পদ্মাবতী বললেন,

“একদম না। কই কাঁদি আমি? পারলে দেখান।”

“আরেকবার কাঁদতে দেখি। তখন বলবো।”

“পিসিমার সাথে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ছোট মা?”

শকুন্তলা চুপ মেরে গেলেন। পদ্মাবতী উৎসুক দৃষ্টিতে উত্তরের অপেক্ষা করছেন। শকুন্তলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“শমিত এখন আর বেকার বসে নেই। কাজ করে। নিজের মা আর স্ত্রীকে দেখার মতো সামর্থ্য আছে ওর। তাই দিদিকে বলেছিলাম কতদিন আর ভাইয়ের সংসারে থাকবে। এখন আলাদা হলেও তো পারে। তাতেই উনি এমন উত্তেজিত হয়ে গেলেন।”

পদ্মাবতী বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না। চুপচাপ শকুন্তলার কথাগুলো শুনলেন।

“তুই-ই বল। আমি কি ভুল কিছু বলেছি? যা বলেছি ভালোই তো বলেছি।”

পদ্মাবতী মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, “হ্যাঁ, আপনি ভুল বলেছেন। এটা পিসিমারও বাড়ি। উনি নিজের ইচ্ছে মতো এখানে থাকতে পারেন।” আর যাই হোক, এভাবে মুখের ওপর বলাটা হবে চরম বেয়াদবি। মোহিনীর কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে ফেললেন তিনি। মোহিনী হলে নিশ্চয়ই ছোট মার মুখের ওপর এসব বলে দিত। এতে তার কেমন লাগলো না লাগলো সেটা দেখার ওর প্রয়োজন নেই। শকুন্তলার খাওয়া শেষ হলে চুপচাপ চলে এলেন পদ্মাবতী।
.
.
.
মোহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াতেও লজ্জা করছে অর্ণবের। মনের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। তার প্রতি মেয়েটার বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। রাগে দুঃখে নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে এখন তার। মোহিনী অনেক্ষণ ধরেই তার উদ্দেশ্যে কিছু বলে চলেছেন কিন্তু অর্ণবের সেদিকে মন নেই। শুধু হুম, হ্যাঁ তে জবাব দিচ্ছেন। মোহিনীর সাথে পরীও এসেছে আজ। সে অর্ণবকে চেনে। তাদের বাড়িতে দেখেছে। কৌতূহলী হয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখতো অর্ণবকে। কিন্তু কথা বলেনি কখনো নিজে থেকে। অর্ণব ডাকলে দৌঁড়ে পালিয়ে যেত। অর্ণবকে শুধু হুম, হ্যাঁ করতে দেখে পরী মোহিনীর কানের কাছে এসে বললো,

“ও তোমার কথা শুনছে না মোহিনী দিদি।”

মোহিনী ভ্রুকুটি করে অর্ণবের দিকে তাকালেন। বললেন,

“আমি কী বলছি শুনছেন আপনি?”

“হুম।”

মোহিনী অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকালেন।

“কী হয়েছে আপনার? কথা বলছেন না কেন ঠিক করে?”

“কিছু হয়নি মেহের।”

“রেগে আছেন আমার ওপর?”

“না, রেগে থাকবো কেন?”

“সেদিন আপনার সাথে ঝগড়া করলাম। তারপর থেকে তো আর একদিনও এলেন না। আমি প্রতিদিন আসতাম। আপনাকে না পেয়ে ফিরে যেতাম।”

“গ্রামের বাইরে ছিলাম এতোদিন। আজই ফিরেছি।”

“কোথায় ছিলেন?”

“কলকাতায়।”

“সেজন্যই তো বলি হঠাৎ করে এমন উধাও হয়ে গেলেন কী করে। জানেন আমি কত কষ্ট পেয়েছি?”

“আমি দুঃখিত মেহের। ক্ষমা করবেন না আমাকে?”

মোহিনী অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখলেন। বললেন,

“ভালোবাসেন আমাকে?”

“হুম।”

“তাহলে আমিও ক্ষমা করে দিলাম। আপনার সব ভুল ক্ষমা করে দিলাম।”

পরী মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললো,

“ও কী ভুল করেছে মোহিনী দিদি?”

মোহিনীর জবাব দেওয়ার আগেই অর্ণব পরীকে হাতে ধরে তার সামনে এনে দাঁড় করালেন। বললেন,

“এইযে তোমার মোহিনী দিদিকে কষ্ট দিয়েছি।”

“কাউকে কষ্ট দিলে ক্ষমা চাইতে হয়?”

“অবশ্যই।”

“মোহিনী দিদিকে তো আরও অনেকে কষ্ট দিয়েছে। তাহলে তারা কেন ক্ষমা চায় না?”

“কে কষ্ট দিয়েছে? নাম বলো আমাকে তাদের। আমি নিজে ওদের শাস্তি দেব।”

“তোমার বাড়ির লোকেরা।”

অর্ণব কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। পরীর কথায় মোহিনী মনে মনে খুশিই হয়েছেন। তবুও ধমকের সুরে বললেন,

“পরী! তোকে এসব কে বলেছে?”

“ঊর্মিলা দিদি।”

“আজকাল তুই একটু বেশিই ঊর্মিলার সাথে থাকছিস। ওর সাথে এতো থাকা বন্ধ করতে হবে।”

অর্ণব বললেন,

“তারা এখনো নিজের ভুল বুঝতে পারেনি পরী। যখন বুঝবে তখন তারা নিজেরাই এসে তোমার মোহিনী দিদির কাছে ক্ষমা চাইবে। এখন এসব বাদ দাও। আমাকে বলো তো, তুমি আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাও কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবো তোমাকে?”

পরী দৌঁড়ে এসে মোহিনীর পেছনে দাঁড়ালেন। উঁকি দিয়ে বললেন,

“আমি ভয় পাই না তোমাকে। আমি চিনি তোমাকে।”

“আচ্ছা! আমাকে চেনো তুমি? কীভাবে চিনলে?”

“দেখেছি আমাদের বাড়িতে।”

“দেখলে কী হবে? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলোনি কোনোদিন।”

“বলেছি।”

“কবে বললে? আমার তো মনে পড়ছে না?”

“আরও অনেকদিন আগে। যখন তুমি আর তোমার বন্ধু এসেছিলে মোহিনী দিদির নাচ দেখতে।”

অর্ণব বিব্রতবোধ করলেন। এই বাচ্চা মেয়েটার যে এতো পুরনো কথাও মনে থাকবে তা বুঝতে পারেননি তিনি। মোহিনী বললেন,

“লুকিয়ে লুকিয়ে তাহলে নাচও দেখতে আসতেন আপনি! হাহ, আর মুখেই যত কথা। আপনি আর নাচবেন না মেহের। এটা করবেন না। সেটা করবেন না। আরও কত কী।”

অর্ণব একটা শুকনো ঢোক গিললেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পদ্মাবতী চা দিয়ে গেলে অর্ণব খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চা খেতে লাগলেন। শান্তি দেবী নিজের ঘর থেকে বের হয়ে সবাইকে একবার দেখে এসে অর্ণবের পাশে বসলেন।

“কী ঠাম্মা? চা খাবে নাকি খবর পড়বে?”

“ওসব দেশ বিদেশের খবর জেনে আমার কী লাভ?”

“তাহলে চা খাবে?”

“না, ওটা তুই-ই খা। তারচেয়ে খবরের কাগজটা পড়ে আমাকে বরং দুটো খবরই শোনা।”

“এই যে বললে এতে তোমার লাভ নেই?”

“শুনলে ক্ষতিও তো নেই। তুই শুরু কর বলা। আমি শুনি।”

অর্ণব পড়তে যাবেন তার আগেই শকুন্তলা বললেন,

“খবরের কাগজ থেকে আর কী খবর শুনবেন মা? ওর থেকে বড় খবর তো পাড়ায় হয়ে গেছে।”

“কী হয়েছে?”

ছাদে থেকে নেমে এলেন আম্রপালি। শকুন্তলার বলার আগেই তিনি প্রশ্ন করলেন,

“বাইরে পুলিশ দেখলাম। কেন এসেছে?”

শকুন্তলা বললেন,

“সেটাই তো বলছিলাম। আরে ওই রাঘব মাস্টার দুমাস আগে আরেকটা বিয়ে করলো না? তো ওর আগের বউ নতুন বউকে কাল রাতে মে/রে ফেলেছে। মে/রে ফেলেছে তো ফেলেছেই আবার আজ পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বলছিল সতীনের সংসার করার চেয়ে ম/রে যাওয়া ভালো। নিজে তো ম/রতে পারবে না। ওতো সাহস নেই। তাই সতীনটাকেই মে/রে ফেলেছে।”

পদ্মাবতী নিজের কাজ ফেলে অবাক হয়ে শকুন্তলার কথা শুনছেন। শেফালীও নিজের কাজ থামিয়ে দিয়েছেন এ কথা শুনে। আম্রপালি বলে উঠলেন,

“কী সাংঘাতিক কান্ড!”

অর্ণব বলে উঠলেন,

“মানে কী? তাই বলে একেবারে খু/ন করে ফেলবে?”

শান্তি দেবী খিকখিক করে হেসে উঠলেন। তার হাসিতে সবাই ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইলেন। তিনি বললেন,

“বেশ হয়েছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে ওই রাঘব মাস্টারের। ঘরে বউ বাচ্চা থাকতে আরেকটা বিয়ে করতে গেল কেন? পুরুষ মানুষ বলে যা খুশি তাই করবে নাকি? এজন্যই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। নিজের সুখের সংসার নিজেই নষ্ট করেছে। এখন এ-কূলও গেল, ও-কূলও গেল। বিয়ে করার স্বাদ একদম ঘুচে গেছে ব্যাটার। এবার থাকুক বউ ছাড়া। দেখুক কেমন লাগে।”

শান্তি দেবী হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
.
.
.
বাইরে দুটো বিড়ালছানা খেলছে। একদম বাচ্চা। আশেপাশে তাদের মাকে দেখা যাচ্ছে না। মোহিনী জানালায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ওদের খেলা দেখছেন। আচ্ছা, ছানা দুটোকে কি তিনি বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসবেন? একদম না, এরপর দেখা যাবে তারানা তাকেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। বিড়ালছানা দুটোকে বাড়িতে আনার চিন্তা যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবেই চলে গেল মাথা থেকে। পেছন থেকে ঊর্মিলা বললেন,

“তোর গয়নাগুলো তো খুব সুন্দর মোহিনী। এভাবে অযত্নে ফেলে রেখেছিস কেন?”

মোহিনী বাইরে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“তোর পছন্দ হলে রাখতে পারিস। আমি আর ওগুলো পরিনা এখন।”

“নুপুরও?”

“না। নুপুর নয়। ওগুলো অর্ণব দিয়েছিলেন আমায়। ওগুলো বাদে সব।”

“আচ্ছা। তুই তো এখন আর নাচ করিস না। তোর ঘুঙুরজোড়া আমাকে দিবি? আমার খুব পছন্দ ওগুলো।”

চকিতে পেছনে ঘুরলেন মোহিনী। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“একদম না। ভুলেও ঘুঙুরের দিকে নজর দিবি না। ওগুলো শুধু আমার। এই তুই যা তো এখন ঘর থেকে। গোছাতে হবে না তোকে কিছু। আমার যা যা লাগবে না আমি পাঠিয়ে দেবো তোর ঘরে।”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”

মোহিনীর নিজেরও মনে হলো তিনি অযথাই রাগারাগি করলেন। যে কথাগুলো শান্তভাবেই বলা যায় সেগুলো শুধু শুধুই রাগ দেখিয়ে বললেন। মোহিনী বসে পড়লেন। ঊর্মিলার সাথে পরীও ছিল। একদম চুপ করে বসেছিল মেয়েটা। ও কখন ঘরে এসেছে বুঝতেই পারেননি মোহিনী। পরীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আমাকে একটু জল খাওয়া তো পরী। দেখিস, আবার জল ভরতে গিয়ে মেঝেতে ফেলিস না যেন।”

পরী জল এনে মোহিনীকে দিয়ে তার কোলে চড়ে বসলেন। মোহিনী জল খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুই কখন এলি?”

“তুমি ধমক দেওয়ার একটু আগে।”

মোহিনী হেসে বললেন,

“আমি কাকে ধমক দিলাম?”

“ঊর্মিলা দিদিকে।”

“তুই তো খুব দুষ্ট হয়েছিস পরী। কখন আসিস কখন যাস কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না।”

পরী ভ্রু কুঁচকে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার দৌঁড়াদৌঁড়িতে যখন ঘুমাতে পারতে না তখনও দুষ্ট বলতে আর এখনও বলছো। হায় ভগবান, কোথায় যাবো আমি?”

পরীর কথায় মোহিনী আর ঊর্মিলা দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মোহিনী বললেন,

“আপনাকে কোত্থাও যেতে হবে না মালকিন। আপনার বাড়িতেই আপনি থাকবেন।”

পরী লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,

“আমার বাড়ি এটা?”

“হুম।”

“রজনী দিদি যে বলে তার কথা না শুনলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।”

ঊর্মিলা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“ওর ওতো সাহস আছে নাকি? ওকেই তো সেদিন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। শুধু আম্মা দয়া করে আবার বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে বলে। শয়তান মেয়ে একটা। এরপর তোকে কিছু বললে তুই চুল টেনে ছিড়ে দিয়ে বলবি তোকে এ-বাড়ি থেকে বের করে দেব।”

“রজনী দিদি শয়তান মেয়ে?”

“হ্যাঁ, তোর মোহিনী দিদির সাথে খুব খারাপ করেছে ও।”

এমন সময় রজনী পরীকে ডাকতে ডাকতে খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পরীকে দেখেই বললেন,

“চল তাড়াতাড়ি। তোকে খাইয়ে দেই। এতো সময় নেই। অনেক কাজ আছে আমার।”

“যাবো না তোমার সাথে। তুমি শয়তান মেয়ে।”

“কী বললি?”

“হ্যাঁ, তোমার হাতে খাবোও না আর। তুমি কষ্ট দিয়েছো আমার মোহিনী দিদিকে।”

রজনী কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মোহিনী বললেন,

“খাবারের থালাটা রেখে যাও। পরীকে আমি খাইয়ে দেব।”

রজনী থালাটা রেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। মোহিনী উঠে হাত ধুয়ে আসলেন। পরীকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,

“খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকবি না বললাম। তাড়াতাড়ি খাবি।”

পরী ঘাড় কাত করলো। মোহিনীর পাশে বসে বললো,

“মোহিনী দিদি, আমাকে তোমার মতো নাচের পোশাক কবে বানিয়ে দেবে?”

“যখন তুই নাচ করবি।”

“আমি কবে নাচ করবো?”

“বড় হয়ে।”

“বড় তো হয়েছিই। আর কত বড় হবো?”

“আরও বড়। এখন শুধু নাচটা ভালো করে শেখ।”
.
.
.
মধ্যরাত…। অর্ণব ছাদে উঠে সবেমাত্র একটা সিগার জ্বালিয়েছেন। তবে তা শেষ করা হয়তো তার কপালে ছিল না। কিছুটা দূরেরই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেছে। যা বোঝার বুঝে গেছেন। আর দাঁড়াতে পারলেন না তিনি। সিগারটা ফেলেই চলে গেলেন সাথে সাথে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একই দৃশ্য দেখছেন আম্রপালি। ভয়ে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। গলা শুকিয়ে গেছে তার। নিচে তাকাতেই অর্ণবকে দ্রুত গতিতে দৌঁড়ে যেতে দেখলেন।

বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। পরী ভয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরে তার সাথে একদম মিশে আছে। তারানা সদরদরজা ভালো করে লাগিয়ে তার সামনে ভারী আসবাবপত্র এনে রেখেছেন। সেখানে আবার দু’জন মেয়েকেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যেন কোনোমতেই কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে না ঢুকতে পারে। রজনী বলে উঠলেন,

“ওরা মোহিনীকে মা/রতে এসেছে আম্মা। মোহিনীকে না পেলে আমাদের সবাইকে মে/রে ফেলবে। তুমি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছো না কেন? ওর জন্য কি আমরা ম/রবো?”

“সেদিনের মা/রের কথা ভুলে গেছিস না? আবার মা/র খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর?”

“কেন? আমি ভুল তো কিছু বলিনি। আমি আগেই বলেছিলাম, এই মোহিনীর জন্য আমাদের সবাইকে একদিন বিপদে পড়তে হবে। এখন হলো তো। আরও পাঠাও ওকে অন্যের স্বামীর সাথে লীলাখেলা করতে। সবার চোখের সামনে ও অর্ণবের সাথে ঢলাঢলি করছে। কেউ দেখছে না মনে করছো? গায়ের লোক ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছো?”

রজনীর কথা শুনে আশেপাশের কিছু মেয়েও একই কথা বলা শুরু করেছে। তারানা ধমক দিতেই আবার সব শান্ত। রজনীর দু’গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

“তোর মুখে খুব বুলি ফুটেছে যে আজ? একদিনেরই অপেক্ষায় ছিলি বুঝি? তুই করাচ্ছিস না তো এসব? শুনে রাখ রজনী, এসবে যদি তোর হাত থাকে তো গলা কে/টে এ-বাড়িতেই পুতে রাখবো তোকে।”

তারানার কথায় রজনী একদম চুপসে গেছেন। তারানা সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কাউকে যদি আমি কোনোরকম বাড়াবাড়ি করতে দেখি তো সবার আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করবো। ওদের হাতে না ম/রলেও আমার হাতে নিশ্চিত ম/রবি।”

মোহিনী চোখ বন্ধ করে পরীকে জড়িয়ে ধরে আছেন। সকলের কথাই কানে যাচ্ছে তার। কিন্তু জবাব দেওয়ার ইচ্ছে করছে না। এসবের জন্য নিজেকেই দ্বায়ী মনে হচ্ছে তার। একমাত্র তার কারণেই সবার জীবন এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। তারানা এসে জানালা সামান্য ফাঁকা করে বাইরে তাকালেন। লোকগুলোর হাতে মশাল। কয়েকজন বাড়ির চারদিকে কেরোসিন ঢালছে। তারানার মনে হলো অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখছেন তিনি। একটা শুকনো ঢোক গিললেন তিনি। মুখ থেকে আপনা-আপনিই বেরিয়ে এলো,

“হে ঈশ্বর, রক্ষা করো আমাদের।”

মোহিনী চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“এসবের পেছনে জানো কে আছেন তারামা? তোমার মালকিন।”

“কী সব বলছিস মেহের? মাথা ঠিক আছে তোর?”

“আমি ঠিকই বলছি। তিনি যদি এসব না করান তো কার এতো সাহস যে আমাদের মা/রতে চাইবে?”

তারানা প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। মোহিনী আবার বলে উঠলেন,

“তিনি এসব না করিয়ে থাকলেও, তিনি এটাই চান যে আমি ম/রে যাই। নয়তো কোথায় আজ তিনি? একবারও এলেন না আমাদের বাঁচাতে?”

পরী বলে উঠলো,

“মোহিনী দিদি, আমরা কি ম/রে যাবো?”

“কেউ ম/রবে না। অনেক হয়েছে। এবার যা করার আমিই করবো।”

পরীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কোনোমতে আসবাবপত্র সরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। কেউ আঁটকাতে চেয়েও পারলেন না। মোহিনীর চোখে যেন আগুন জ্বলছে। যার তেজ এই শত মশালের চেয়েও বেশি। এখানকার সকল অপরিচিত মুখের মাঝে তার পরিচিত একটা মুখ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে সবটা দেখতে লাগলেন। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। মোহিনী চিৎকার করে বললেন,

“আমাকে পোড়াতে এসেছো না তোমরা? তাহলে পোড়াও আমাকে। আমিও দেখি কার এতো সাহস। আসো, সামনে আসো।”

মোহিনীর এমন কান্ডে লোকগুলো কিছুটা হকচকিয়ে গেছে। একজন মশাল নিয়ে ছুটে আসতেই মোহিনী তার বুকে স্ব-জোরে লাথি মে/রে ফেলে দিলেন তাকে। বাকিরা ক্রুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতেই কেউ একজন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিলেন তাদের। তাকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মোহিনী।

“অর্ণব।”

“আপনি ভেতরে যান মেহের। এদিকটা আমি দেখছি।”

মোহিনী দৌঁড়ে বাড়ির ভেতরে চলে এলেন। অর্ণবকে দেখা মাত্রই গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি দ্রুত সে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন।

আম্রপালি এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ বাদেই লোকগুলোকে ফিরে যেতে দেখলেন। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। বুঝলেন এখন সব ঠিক আছে। ঘরের ভেতরে যাবেন ঠিক এমন সময় কাউকে খুব সাবধানে বাড়ির দিকে আসতে দেখলেন। চোখ ছোট ছোট করে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলেন। চিনতে পেরেই বুকটা ধক করে উঠলো তার। অস্ফুট স্বরে বললেন,

“পদ্মা!”

অর্ণবকে দেখলেও পদ্মাবতীকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেননি আম্রপালি। তার মানে তিনি অনেক আগেই গেছেন বাইরে। অর্ণবের পেছন পেছন যে যাননি সে ব্যাপারে নিশ্চিত আম্রপালি। হোক না হোক কিছুক্ষণ আগের ঘটনার সাথে পদ্মাবতীই জড়িত। চিন্তাটা মাথায় আসতেই মাথা ভনভন করতে শুরু করলো আম্রপালির। সবকিছু ওলট-পালট মনে হতে লাগলো। দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন তিনি। পদ্মাবতী নিজের ঘরে ঢুকতে যাবেন এমন সময় পেছন থেকে আম্রপালি বলে উঠলেন,

“দাঁড়া।”

চকিতে পেছনে ফিরলেন পদ্মাবতী। আম্রপালিকে দেখেই ঘামতে শুরু করলেন।

“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

“বাগানেই ছিলাম বড়মা। ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করে এলাম।”

আম্রপালি স্ব-জোরে পদ্মাবতীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। বললেন,

“মিথ্যে বলিস আমাকে? আমি দেখেছি সবটা। একটু আগে যা যা হলো সবটা তুই করিয়েছিস পদ্মা। কী করে পারলি এটা করতে? ছিঃ। লজ্জা হচ্ছে আমার তোকে দেখে। তোর দ্বারা এমন কাজও সম্ভব!”

পদ্মাবতী আম্রপালির পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমাকে ক্ষমা করুন বড়মা। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। কিন্তু আপনি তো বোঝেন আমাকে। আপনি তো জানেন আমি এসব কেন করেছি। শেষবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কোনোদিনও এমন করবো না।”

“আমাকে ছাড় পদ্মা।”

আম্রপালি নিজের পা ছাড়িয়ে নিলে পদ্মাবতী সেখানে বসেই কাঁদতে লাগলেন। আম্রপালি চলে যেতে যেতে বললেন,

“যা করেছিস, করেছিস। ভুলে যা সব। ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ জানতে না পারে। অর্ণব তো একদমই নয়। ও জানতে পারলে আমি আর তোকে বাঁচাতে পারবো না পদ্মা।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here