নাইওরি,পর্ব ৮,৯
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৮
সালিশের বিচারকারী সকলেই জেসমিনের কথা শুনে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হতে লাগলো রঞ্জুর। সে জানতো জেসমিন সাহসী। তাই বলে যে একগ্রাম লোকের সামনে, নিজের বাবা ভাইদের সামনে, ভালোবাসার কথা বলার মত সাহস রাখে সেটা সে কল্পনাও করেনি। জয়নাল মির্জা রক্তবর্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু জেসমিন তার দিকে তাকাচ্ছে না। সে শুধু একবার রঞ্জুর দিকে তাকিয়েছিল। তারপর থেকেই মাথা নিচু করে আছে। মানুষটার ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অসহায় মুখটা দেখে নিজেকে অপরাধী লাগছে।
হেডমাস্টার নাসেরউদ্দীন বললেন,
“রঞ্জু তোমার কি বক্তব্য?”
রঞ্জু বলল,
“আমি জেসমিনকে ভালোবাসি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা সেটা তার নিজের মুখেই আপনারা শুনেছেন। আমি শুধু ওকে ভালোই বাসিনা, সম্মানও করি। তাই আমি চাইনা তার সম্মান নষ্ট হোক। আমি ঢাকা শহরে জম্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা গ্রামে স্থায়ী হলেও আমার সেভাবে গ্রামে থাকা হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতেই থাকি। তাই গ্রামের নিয়মকানুন সেভাবে জানিনা। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তাহলে আমাকে শাস্তি দেবেন। তবে আমার অনুরোধ জেসমিনকে যেন অসম্মানিত করা না হয়।”
রঞ্জুর কথা শেষ হতেই হারুন ব্যাপারী বললেন,
“আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে চাই।”
সবার আগে জয়নাল মির্জা বললেন,
“বলেন জনাব, আপনার ছেলে অপরাধ করছে আপনার তো বলতেই হবে।”
হারুন ব্যাপারী অপমান গায়ে মাখলেন না। হেসে বললেন,
“প্রেম ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমার পুত্র যেমন অপরাধ করেছে, চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাও অপরাধ করেছে। তবে তাদের বয়স কম, আবেগ বেশি। তারপরেও যখন এত মানুষের সামনে তারা উভয়েই ভয়, লজ্জা, সম্মানের তোয়াক্কা না করে তাদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে তখন আপনারা বুঝতেই পারছেন তারা একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। এবং তারচেয়েও বেশি আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি। নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান সাহেবও তার কন্যাকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন। তাই আমি মনে করি এর একটা সুন্দর সমাপ্তি হতে পারে। চেয়ারম্যান সাহেব এবং উপস্থিত সকলের কাছে আমি রঞ্জুর ও জেসমিন বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনারা সকলে রাজী থাকলে শুভ দিন দেখে আমরা দুজনের বিবাহ সম্পন্ন করতে পারি। এতে ওরা দুজন সুখী হবে এবং সকলের সম্মান বজায় থাকবে।”
প্রস্তাব শুনে জয়নাল মির্জার ভীমড়ি খাবার জোগাড়। প্রনব সাহা বললেন,
“অতি উত্তম প্রস্তাব। ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিলে এরপর তো আর কথাই থাকে না। মিয়ারা কী বলেন?”
একে একে দেখা গেল সকলেই হারুন ব্যাপারীর প্রস্তাবে একমত। শুধু জয়নাল মির্জা চুপ করে রইলো। বেশকিছুক্ষণ পর সে বলল,
“আমার একটু ভাবতে হইবো। জেসমিন আমার একমাত্র মাইয়া। তার ব্যাপারে এত জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল।”
নাসেরউদ্দীন বললেন, “চেয়ারম্যান সাব, সালিশের সিদ্ধান্ত সালিশেই নেওয়া ভালো। নাইলে পরে লোকে নানান কথা কইব। বিগত দিনে এই ধরনের মামলায় তো দেখছেন ব্যাপারগুলা পরে কেমন হয়।”
কাশেম মোল্লা বললেন,
“হ নুরুর মাইয়ার বেলাতেও তো এমন হইছিল। বিয়ার তারিখ কয়দিন পরে দেওয়াতেই ত লোকে বিয়ার আগ পর্যন্ত নানানরকম কথা হুনাইছে।”
প্রনব সাহা বললেন,
“আমার মতে, বিয়ে হলে আজকে হয়ে যাওয়াই ভালো।”
তারপর হারুন ব্যাপারীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আজকে বিবাহ পড়াইলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
হারুন ব্যাপারী বললেন,
“আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি আমার ছেলের জন্য যেকোনো মুহূর্তেই প্রস্তুত। আপনারা বললে আমি আজকেই বিবাহের ব্যবস্থা করব।”
জয়নাল মির্জা বললেন,
“বিয়ার ব্যবস্থা পোলার বাপ করে না মিয়া। করে মাইয়ার বাপ। জালাল হুজুররে খবর দাও। আইজকাই ওগো বিয়া পড়ানো হইব।”
জালাল কাছে এসে বলল,
“আব্বা আপনের মাথা কি ঠিক আছে?”
জয়নাল মির্জা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“আমার চেয়ে বেশি বুঝার চেষ্টা করবা আমি মরনের পরে। যা বলা হইছে তাই করো গিয়া।”
বাদ মাগরিব রঞ্জু ও জেসমিনের বিবাহ সম্পন্ন হলো। যাকে সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকেই এখন জামাই আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। রঞ্জু অবশ্য খেতে পারছেনা। বমি এসে পড়ছে তার। মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনোমতে হাত নাড়াচাড়া করছে। সময়টা পেরিয়ে গেলে সে বাঁচে। গায়ে একফোঁটা শক্তি নেই। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থির থাকার। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে।
জেসমিনকে এখনই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবেনা, রঞ্জুকেও এবাড়িতে রাখা হবেনা। আগে আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হবে এরপর দুজনের বাসর হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের তারিখ দেয়া হলো সপ্তাহখানেক বাদে। তখনই জেসমিনকে উঠিয়ে নেয়া হবে। তাই রঞ্জু চলে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে তাদের দুজনকে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে দেয়া হলো। এর পেছনে অবশ্য জেসমিনের বড় ভাবি আসমার অবদান সবচেয়ে বেশি। সেই প্রথম বলেছে, নববিবাহিত দম্পতিকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও কথা বলতে দেয়া উচিত। তার উপর যে ঝড় আজ সারাদিন দুজনের উপর দিয়ে গেছে তাতে এটা না হলেই না।
রঞ্জু ঘরে ঢুকতেই জেসমিন মাথা নিচু করে অপরাধীর গলায় বললো,
“আমারে মাফ কইরা দেও।”
রঞ্জু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,
“কেন? তুমি কী করেছ?”
“আমার পাগলামির কারণেই কাইল ধরা খাইছি। তুমি চইল্যা যাইতে চাইছিলা, আমি বারবার তোমারে আটকাইছি।”
রঞ্জু মৃদু হেসে জেসমিনের হাত দুটি নিজের দুহাতে ধরে বলল,
“ভাগ্যিস আটকেছিলে। নাহলে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে পেতাম কীভাবে?”
জেসমিন মুখ তুলে তাকালো। তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
“কিন্তু তোমারে রাইতভর বাইন্ধা রাখলো। বড়ভাইজান তোমার গায়েও হাত তুলল। কতবড় অপমান!”
“মাঝরাতে দেখা করতে এসে প্রেমিকার বাপ ভাইয়ের কাছে ধরা পড়লে এরচেয়ে ভয়ংকর কিছুও হতে পারতো। যা হয়েছে তা অপমান হিসেবে না দেখে শাস্তি হিসেবে দেখো।”
জেসমিনের চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। রঞ্জু তা যত্ন করে মুছে দিয়ে বলল,
“কাল থেকে অনেক কেঁদেছো। এই সুন্দর চোখে আর যেন জল না দেখি। তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে জেসমিন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। দাঁড়াও আসমা ভাবিকে ডাকি।”
রঞ্জু দরজার দিকে যাচ্ছিল। জেসমিন একটা হাত ধরে তাকে থামালো।
“না খাঁড়াও ভাবিরে ডাক দিও না।”
“কেন? ভাবিকে না ডাকলে পানি পাব কোথায়?”
জেসমিন রঞ্জুর হাতখানা ধরে নিজের কপালে রেখে বলল,
“তোমার ঠান্ডা হাতখান আমার কপালে রাহো, এমনেই জ্বর সাইরা যাইব। এতদিন বাপ ভাইয়েগো ডরে কত কষ্ট কইরা পলাইয়া তোমার কাছে গেছি। আর এহন তারাই তোমারে আমার কাছে পাডাইছে। আইজ আর কোনো ডর নাই। ভাবিরে ডাইকা এই সময়টারে এমনে নষ্ট করতে চাও?”
চলবে…
নাইওরি
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৯
সপ্তাহখানেক বাদেই অনুষ্ঠান করে জেসমিনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন জয়নাল মির্জা। এরকম কোনো সুযোগ আসবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। হারুন ব্যাপারী বুদ্ধিমান লোক হলেও ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। নাহলে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়! সালিশে তার ছেলের কী বা শাস্তি হতো! এইটুকু তিনি মেনে নিতে পারলেন না! শত্রুর সাথে আত্মীয়তা বড় কঠিন জিনিস। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই কঠিন পথ বেছে নিলেন। অবশ্য একমাত্র ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকা অস্বাভাবিক না।
তবে এই আত্মীয়তা হলে হারুণ ব্যাপারী ছাড় দিতে বাধ্য। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি জয়নাল মির্জা। এক কথাতেই রাজী হলে সেটা অনেকের চোখে পড়তো তাই সে প্রথমে ভেবে দেখার কথা বলেছিল। একটু তো গাইগুই করতেই হয়।
জেসমিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই বউ দেখার ঢল নামলো রঞ্জুদের বাড়িতে। সূর্যমনি গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলারা বাদ রইলো না। গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে রঞ্জু। এবং সে-ই একমাত্র যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বউখানা কেমন হলো তা না দেখলে গ্রামবাসীর চলবে কীভাবে! জেসমিনের শাশুড়ি রহিমা বেগম তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুতুলের মত একটা বউ আসাতে সে ভীষণ আনন্দিত।
সন্ধ্যার পর থেকেই প্রচন্ড ঝোড়োহাওয়া বইতে লাগলো। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগলো মেঘমালা। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার দরজার কপাট বারবার বাড়ি খাচ্ছে। রঞ্জু বারান্দার দরজা আটকাতে গেলে জেসমিন বলে,
“আমারে কামিনী ফুলের গাছটা দেহাইলা না যে?”
“এত মানুষ ছিল এতক্ষণ কীভাবে দেখাব বলো? কাল দেখো।”
“আমি এহনই দেখমু।”
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল,
“বলে কী মেয়ে! ঝড় শুরু হয়েছে দেখো না? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।”
“তাতে আমার কী? আমি দেখমু।”
জেসমিন এগিয়ে গেল দরজার কাছে। রঞ্জু তার দুই বাহু ধরে আটকালো। বলল,
“পাগলামি করে না। কাল সকালে দেখো। এখন দরজা জানালা সব আটকে দেয়া উচিৎ। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।”
জেসমিন একটু অভিমান করে বলল,
“হুম আমারে দেহাবা ক্যা? কার লাইগা জানি গাছখান লাগাইছো, হেরেই দেহাইয়ো। আমি কেডা!”
ফিরে এসে বিছানার উপর বসলো সে। রঞ্জু দরজা লাগিয়ে এসে তার পাশে বসে মুখটা ধরে বলল,
“তুমি আমার একলা আকাশ
দখিন দ্বারের বাউলা বাতাস
কদম ফুলের ঘ্রাণ,
তুমি আমার জল জোছনা
অন্ধকারের গান।”
কবিতা শুনে জেসমিনের অভিমান নিমিষেই উধাও। সে বলল,
“এই কবিতাটা আমারে চিডিতে দেও নাই তো?”
“এটা তো এই মাত্রই বানালাম।”
জেসমিন মুগ্ধ চোখে জানতে চাইলো,
“তুমি কেমনে এমন কথায় কথায় কবিতা বানাও?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“তোমার চাঁদমুখটা দেখলেই আমার কবিতা পায়।”
জেসমিন লজ্জা পেয়ে হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু অন্ধকারের আবার গান কেমনে হয়?”
“অন্ধকারের গান অনেক রকম হয়। মন খারাপের হয়, খুশির হয়। আরও কত রকমের!”
“আমি তোমার কেমন অন্ধকারের গান?”
বিছানার পাশেই হারিকেন। রঞ্জু সেটা নিভিয়ে কাছে এসে নিচু গলায় বলল,
“চলো দেখাই তুমি আমার কেমন অন্ধকারের গান।”
চলবে…