#হৃদমাঝারে,চতুর্থ_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া
কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। দার্জিলিং থেকে ফিরে সবাই যে যার নিজের কাজে খুব মন দিয়েছে। জিয়ার অফিসের এখন খুব চাপ। একটুও ছুটি নেওয়ার মতো ফুরসত পায়না ও। তাই এখন কলকাতায় ফেরার কোনো সুযোগই নেই ওর। এর মধ্যেই ওদের অফিসে কোথাও থেকে একটা কল এসেছে সেখানে কম্পিউটারের সফটওয়্যারের কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেটা দেখতে যাওয়ার জন্য। তাই জিয়ার অফিসের বস জিয়া আর অংশুমানকে সেখানকার ঠিকানাটা দিয়ে দিয়ে সেখানে যেতে বললেন। জিয়া শিলিগুড়ির এই সফটওয়্যার কোম্পানিটাতে বেশ কয়েক বছর ধরেই চাকরি করছে। অফিস যাওয়ার জন্য আগে অফিস থেকেই ওকে একটা স্কুটি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এক বছর কাজ করার পর জিয়া নিজেই একটা স্কুটি কিনে নিয়েছে। তাই এখন ও নিজের স্কুটিতেই অফিস যাতায়াত করে। আর অফিস থেকে বাইরে কোথাও কাজে যেতে হলে ও ওর নিজের স্কুটিতে করেই যায়। সেইমতো অংশু নিজের বাইকে আর জিয়া ওর স্কুটিতে উঠে ওই ঠিকানার খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। গুগল ম্যাপের দেখানো পথনির্দেশ মতো ওরা গিয়ে পৌঁছলো ওই ঠিকানায়। গিয়ে দেখলো ওই ঠিকানাটা একটা কলেজের। কলেজের সামনে গিয়ে বসের দেওয়া নাম্বারটায় ফোন করলো অংশু। ফোন করতেই একজন লোক এসে অংশু আর জিয়াকে কলেজের ভিতরে কম্পিউটার রুমে নিয়ে এলেন। বেশ কিছুক্ষণ চেক করার পর আসল সমস্যা বুঝতে পেরে তার সমাধানও করে ফেলতে পারলো জিয়া আর অংশু। তারপর ওরা অফিসে ফিরে যাওয়ার জন্য কম্পিউটার রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। পার্কিং জোন থেকে অংশু বাইক আর জিয়া স্কুটিটা নিয়ে কলেজের গেট থেকে বেরোনোর সময় ঠিক গেটের মুখেই হঠাৎ করে জিয়ার স্কুটির সামনে একজন এসে পড়ায় জোরে ব্রেক কষে দিলো জিয়া। লোকটার মুখের দিকে না তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠলো জিয়া,
-আরে আপনি কী চোখে দেখতে পাননা নাকি?! দেখতেই তো পাচ্ছেন আমি গেট থেকে বেরোচ্ছিলাম। এতোটা ফাঁকা রাস্তা পড়ে থাকতেও আপনি আমার স্কুটির সামনেই এসে পড়লেন কেন? আর একটু হলেই তো লেগে যাচ্ছিলো! তখন তো আমাকেই গালিগালাজ করতেন!
জিয়াকে ওভাবে মাথা গরম করতে দেখে অংশু নিজের গাড়িটা দাঁড় করিয়ে জিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আরে জিয়া তুমি এতো মাথা গরম কোরো না! ওনার আসলে কোনো দোষ নেই। উনি আমার বাইক থেকে পাশ কাটাতে গিয়েই বোধহয় তোমার স্কুটির সামনে এসে পড়েছিলেন। তুমি প্লিজ আর কিছু বোলো না ওনাকে। সরি দাদা, আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না! চলো জিয়া…
ততোক্ষণে আয়ান আর জিয়া একে অপরকে দেখে চিনতে পেরেছে। হঠাৎ করে ওদের এভাবে দেখা হওয়াটা ওরা কেউই আশা করেনি। এদিকে জিয়ার এতো মুখ ঝামটা শুনেও পাশের লোকটা কোনো তর্কবিতর্ক না করে, জিয়াকে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো অংশু। তখনই জিয়া আয়ানকে বলে উঠলো,
-আরে প্রফেসর বাবু যে! কিন্তু আপনি এখানে? ওহ আচ্ছা, এবার বুঝেছি! এটাই তাহলে আপনার কলেজ? আপনি এই কলেজেরই প্রফেসর তাইতো?
-জিয়া তুমি ওনাকে চেনো নাকি?
-আরে হ্যাঁ গো অংশুদা, আমি চিনি তো ওনাকে! আসলে ওনার সাথে আমার দার্জিলিং-এ পরিচয় হয়েছিলো।
এই সরি সরি মিস্টার প্রফেসর! আপনার কোথাও লাগেনি তো?! ঠিক আছেন তো আপনি?
-হ্যাঁ ঠিক আছি, আপনাকে আর সরি বলতে হবে না!
-আপনার কোথাও লেগেছে নাকি?
-না না, আমার কোথাও লাগেনি। আমি ঠিক আছি। কিন্তু আপনি এখানে?
-আরে আপনাদের কলেজেরই তো দুটো কম্পিউটারে সফটওয়্যারের কিছু মেজর প্রবলেম ক্রিয়েট হচ্ছিলো। আর সেই জন্যই তো সেই প্রবলেম গুলো সলভ করার জন্য এখান থেকে কল করে আমাদের ডাকা হয়েছিলো।
-আপনি কম্পিউটার জানেন নাকি?
-আরে আমি তো সফটওয়্যার কোম্পানিতেই জব করি। জানবো না কেন?
-ও সরি, আসলে আমি জানতাম না তাই..
-এবার জেনে গেছেন তো? এবার আমার সামনে থেকে সরে যান প্লিজ! আমাদের এমনিতেই অফিসে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমরা যাই, চলো অংশুদা!
এর মধ্যেই অংশুর ফোনে একটা ফোন এসে যাওয়ায় একটু সাইডে গিয়ে কথা বলে আবার ওদের দিকে এগিয়ে এলো অংশু। অংশুর সামনেই আয়ান জিয়াকে বললো,
-সেকী? চলেই যাবেন? আবার যখন আমাদের দেখাই হয়ে গেলো, তখন অ্যাটলিস্ট আপনার পছন্দের এক কাপ দুধ চা তো খেয়ে যান?
-এই না না! মাথা খারাপ নাকি আপনার? এখন আমি আপনার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে চা খাবো? এমনিতেই এই কয়েকদিন আগে আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং ঘুরে এসেছি। আর এখন যদি আবার কাজে ফাঁকি দিই, তাহলে নির্ঘাত বসের গালাগাল শুনতে হবে! সাথে রেজিগনেশন লেটার ফ্রি! কী বলো অংশুদা?
-হ্যাঁ সেতো তুমি ঠিকই বলেছো জিয়া। কিন্তু, উনি যখন তোমাকে চায়ের অফার করছেন, তখন তুমি তো খেতেই পারো এক কাপ চা। আমি নাহয় বেরিয়ে যাচ্ছি এখনই, গিয়ে বসকে বলে দিচ্ছি তুমি কোনো জরুরী কাজে আটকে পড়েছো। এমনিতেই তো এখন তোমার অফিস আওয়ার শেষের দিকেই। আর তাছাড়া বস কিছু বলবেন না তোমাকে!
-আরে না না, আমি কী ওনাকে একাকে চা খেতে বলছি নাকি? আপনাকেও তো বলছি। আপনিও এক কাপ চা খেয়ে যান প্লিজ!
-আপনি তো শুনলেনই, সত্যিই এরপর আর দেরী করলে আমার চাকরিটা আর থাকবে না। তার ওপর আবার আমি ছেলে। বস তবু মেয়েদের একটু স্নেহের চোখে দেখেন। তাই মার্সি করে দেন। ছেলেরা কোনো ভুল করলে তো মুখ ঝামটা দিয়ে পেট থেকে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠিয়ে নিয়ে আসেন!
-না না, তাহলে আর আপনাকে আটকাবো না অংশু বাবু। কিন্তু জিয়া, আপনি প্লিজ এক কাপ চা খেয়ে যান। এই সামনেই একটা ক্যাফে আছে। বেশিক্ষণ সময় লাগবে না!
জিয়া নিজের ডান হাতটা একটু তুলে কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময়টা একবার দেখে নিয়ে বললো,
-হ্যাঁ অংশুদা, তুমি ঠিকই বলেছো। এখন অবশ্য আমার অফিস যেতে যেতেই ছুটির সময় হয়ে যাবে। সেই তো আবার আমাকে এই রাস্তা দিয়েই ফিরতে হবে। আমি তাহলে এখন আর অফিসে যাচ্ছি না। তুমি তো গিয়ে বসকে বলবেই, তাও আমি ওনাকে একটা কল করে নিচ্ছি।
-ওকে জিয়া। আমি তাহলে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমি এলাম মিস্টার.. কী যেন..
অংশু থেমে যেতে আয়ান নিজেই বলে দিলো,
-রায় চৌধুরী! হ্যাঁ আজ আপনাকে ছেড়ে দিলাম অংশু বাবু, কিন্তু নেক্সট টাইম দেখা হলে আপনাকেও চা খেয়ে যেতে হবে কিন্তু!
-হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই.. এখন আমি আসছি, জিয়া আমি তাহলে বেরিয়ে যাচ্ছি, টাটা! বাই মিস্টার রায় চৌধুরী!
অংশু বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই জিয়া ওর অফিসের বসকে একটা কল করে একটু কথা বলে নিয়েই স্কুটিতে উঠে বসে পড়ে আয়ানকে বললো,
-নিন উঠে পড়ুন তাড়াতাড়ি!
-আমি?
-এখানে আমি আর আপনি ছাড়া আর কে আছে শুনি? আরে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন? তাড়াতাড়ি উঠুন বলছি! লজ্জা পাচ্ছেন নাকি? ভাবছেন যদি কোনো স্টুডেন্ট দেখে ফেলে? তাহলে আপনাকে প্যাঁক দেবে নাকি?
-না না সেটা নয়.. আসলে..
-আসলে আবার কী? আরে মশাই বেশি না ভাবনা-চিন্তা করে উঠুন তো তাড়াতাড়ি! আপনার হাতে বুঝি অঢেল সময়? আমার কিন্তু খুব বেশি সময় নেই!
আয়ান দুজনের মাঝে অনেকটা দূরত্ব রেখে উঠে বসলো জিয়ার স্কুটিতে। জিয়া সাথে সাথে স্কুটিটায় স্টার্ট দিয়ে দিলো।
কলেজের একটা বিল্ডিং-এর তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ থেকেই সবটা লক্ষ্য করছিলো পৌলমী। যদিও অত দূর থেকেও কিছুই শুনতে পাচ্ছিলো না। ওদের দূরে দাঁড়িয়ে শুধু কথা বলতেই দেখছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই আয়ান জিয়ার স্কুটিতে উঠে বসে পড়তেই ভীষণ অবাক হয়ে গেলো পৌলমী। ও বিড়বিড় করে বললো, “কে ওই মেয়েটা? এআরসি ওই মেয়েটার স্কুটিতেই বা উঠলেন কেন? কোথায় যাচ্ছেন ওনারা?” তখন পৌলমীর পাশ দিয়ে ওরই ক্লাসমেট একটি ছেলে যাচ্ছিলো। পৌলমীকে এভাবে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আর মুখে কী সব বিড়বিড় করতে দেখে ছেলেটি বললো,
-কীরে পৌলমী? কী দেখছিস ওদিকে?
-তুই তো ওদিক দিয়েই এলি দেখলাম, স্যারের সাথে ওই মেয়েটা কে ছিলো রে? আর স্যার ওর স্কুটিতেই বা উঠলেন কেন? কোথায় গেলেন ওনারা?
-ও ওই মেয়েটা? আরে ওই মেয়েটা তো আমাদের কলেজের কম্পিউটার গুলো ঠিক করতে এসেছিলো। কিন্তু স্যার ওকে চেনেন কিনা সেটাই বা আমি কী করে জানবো? আর উনি কেন ওই মেয়েটার স্কুটিতে উঠলেন, বা ওনারা কোথায় গেলেন, সেটাই বা আমি কী করে বলবো বল? হয়তো উনি এআরসি স্যারের পরিচিতই কেউ হবেন। গার্লফ্রেন্ডও হতে পারেন! আর তাছাড়া তোরই বা এতো কিছু জানার কী আছে?
-ছাড়! তোকে আর কিছু বলতে হবে না! তুই যা এখান থেকে…
কথাটা বলেই দৌড়ে ক্লাস রুমের ভিতরে চলে গেলো পৌলমী। আজ একটু পরেই পৌলমীদের ক্লাস নেওয়ার কথা ছিলো আয়ানের। তাই পৌলমী কয়েকটা ম্যাথও সলভ করে এনেছিলো আয়ানকে দিয়ে চেক করাবে বলে। আসলে সেই অজুহাতে আয়ানের সাথে অন্যদের থেকে একটু বেশি সময় ধরে কথাও বলতে পারতো ও। কিন্তু এখন আয়ান ওদের ক্লাসে না এসে বাইরে একটা মেয়ের স্কুটিতে উঠে চলে যাওয়ায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো পৌলমীর।
ক্যাফেতে ঢুকে বসে দু’কাপ চা অর্ডার করলো আয়ান। কিন্তু কী কথা বলবে বা কী দিয়ে জিয়ার সাথে কথা শুরু করবে সেটা ভেবে না পেয়ে ও বললো,
-বলুন, কেমন আছেন?
-এতোক্ষণ পর আমি কেমন আছি সেটা জিজ্ঞেস করার কথা আপনার মনে পড়লো?বাই দা ওয়ে, আমার ওই চলছে! আর আপনি?
-আমারও তাই। আপনাকে চা খাওয়ার জন্য আটকালাম বলে আপনার খুব লেট হয়ে গেলো না তো?
-যদি সেটাই মনে হয়, তাহলে আমাকে আটকালেন কেন?
-না আসলে..
-আরে বী কুল! আসলে আমাকে কেউ চায়ের অফার করলে আমি সেটাতে চট করে না বলতে পারি না! তাই আপনার সাথে চলেই এলাম এই ক্যাফেতে চা খাওয়ার জন্য। আমি এই ক্যাফেতে আগেও এসেছিলাম একবার। তবে তখন অবশ্য কফি খেয়েছিলাম। বেশ ভালোই বানিয়েছিলো।
-আমিও একবার এসেছিলাম, কয়েকটা স্টুডেন্টের সাথে। একটা স্টুডেন্টের বার্থডে ছিলো, তাই সব প্রফেসর আর ফ্রেন্ডদের ট্রীট দেওয়ার জন্য এখানে ইনভাইট করেছিলো।
-বাহ! আপনার স্টুডেন্টরা তো বেশ ভালো! প্রফেসরদেরও ট্রীট দেওয়ার জন্য ক্যাফেতে নিয়ে এসেছিলো!
-আর আপনি কার সাথে এসেছিলেন? ফ্যামিলি নাকি অফিস কলিগ?
-আরে না না! এখানে আমি আমার ফ্যামিলি কোথায় পাবো? আমি তো আমার জবের জন্য এখানে একাই থাকি। আমি একজন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম এখানে।
-ওহ আচ্ছা। আপনি এখানে কোথায় থাকেন জিয়া?
-এই এক মিনিট এক মিনিট! আপনি আমার নামটা জানলেন কী করে বলুন তো? অনেক্ষণ থেকেই তো শুনছি, আপনি আমার নাম ধরে ডাকছেন!
-ওই যে তখন আপনার কলিগ অংশুবাবু আর আপনি তো আপনাদের একে অপরকে নাম ধরেই ডাকছিলেন। তাই আমিও জেনে গেলাম আপনাদের নাম গুলো!
-হুম.. বুঝলাম!
-বললেন না তো, এখানে কোথায় থাকেন আপনি? ভয় নেই, আমি আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ চাইবো না!
-আপনি নিমন্ত্রণ চাইলেও কী আমি করতাম নাকি?! ওই কাউকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে-টাওয়াতে আমি পারবো না! ওসব আমার পোষায় না! আমি এখানে একটা পিজিতে থাকি। সাথে আমার একজন রুমমেটও আছে। আর আপনার বাড়ি কোথায়? শিলিগুড়িতেই?
-না! আমার বাড়িও কলকাতাতেই। এখানে এই কলেজে অধ্যাপনার জন্য আছি। আমি এখানে একটা দু’কামড়ার ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছি এই দু’বছর হলো। বেশ কয়েক বছর রেন্টে নিয়েই ছিলাম। কিন্তু এতোদিনে যা বুঝলাম, এখানে রেন্টে থাকার থেকে কষ্টশিষ্ট করে একটা ফ্ল্যাট কিনে নেওয়াই ভালো! তাতে অন্তত প্রতি মাসে গাদা গুচ্ছের ভাড়াটা তো বাঁচবে!
-ঠিকই বলেছেন। আমার তবু একজন রুমমেট আছে বলে, ভাড়াটা শেয়ার হয়ে যায়। আমার একার পক্ষে হলে আমারও ভাড়া দিতে প্রবলেম হতো! আর তাছাড়া আমার বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে ভালো লাগে না! এখানে তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো আছি! দেখি আর কতোদিন এখানে থাকতে ভালো লাগে..
-মানে? এখান থেকে চলে যাবেন নাকি? কিন্তু কেন?
-এখছনও সেরকম কোনো ইচ্ছে হয়নি। আসলে আমার ভীষণ বোরিং লাগে এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে, এক মানুষের সাথে থাকতে বা একই জায়গায় থাকতে বা একই কথা বেশিক্ষণ ধরে বলতে! হয়তো আপনি আমাকে পাগল ভাবতে পারেন, তবুও আমি এরকমই! এই আপনি বিয়ে করেননি?
-না!
-সেকি! এখনও বিয়ে করেননি? দেখে তো আপনাকে খুব একটা বাচ্চা মনে হয় না! বয়স তো ভালোই হয়েছে বলে মনে হয়। তাহলে এখনও বিয়ে করেননি কেন আপনি? প্রেমিকা সময় চাইছে নাকি বিয়ের জন্য?
-প্রেমিকা মানে? না না, আমি ওসব প্রেম-ট্রেম করি না।
-সেকি, আপনার প্রেমিকা নেই? এটা তো মানা যাচ্ছে না! এতো বয়স হয়ে গেলো, তবুও বিয়ে করেননি, আবার প্রেমিকাও নেই বলছেন, তাহলে কী করেছেন টা কী জীবনে? প্রেমে ছ্যাঁকা-ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?
-না না। সেরকম কিছু না।
-সেটাও না? আমি তো ভাবলাম প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছেন বলে হয়তো দেবদাস হয়ে প্রেম করাই ছেড়ে দিয়েছেন বুঝি!
জিয়ার কথা শুনে হেসেই ফেললো আয়ান। তারপর বললো,
-না না! সেরকম কিছুও না। আসলে এই পড়াশোনা, চাকরির জন্য প্রিপারেশন নেওয়া, তারপর চাকরি পাওয়ার পর এখানে এসে থাকা, এসবের মাঝে আর কখনও ওই প্রেম-ট্রেম করে ওঠা হয়নি। আর তাছাড়া কখনও মনেও হয়নি প্রেম করার কথা।
-তাই? নাকি এগুলো সব অজুহাত? কেউ পাত্তা দেয়নি, কারোর কাছে পাত্তা পাননি! তাই কী বলবেন ভেবে না পেয়ে এরকম বলছেন!
আয়ান কী বলবে আর কিছু ভেবে পেলো না। এভাবে ওকে কেউ ওর মুখের সামনে এরকম কোনো অপমানজনক কথা বলেনি কখনও। অপমানজনক কথা তো দূরের কথা, কেউ সেভাবে কখনও ওর সাথে জোর গলাতে কথাও বলেনি। আয়ান এতোটাই গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে, ওর সামনে জোর গলায় বলার সাহসই পায়নি কেউ। কিন্তু এই মেয়েটা আয়ানকে কীভাবে যে ওর সামনেই এসব কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে কে জানে। কিন্তু আয়ান কিছুই বলতে পারছে না জিয়াকে। আর তাছাড়া ওর যেন কোনো অপমানিত বোধও হচ্ছে না সেভাবে। বেশ মজাই লাগছে ওর। কিন্তু পাত্তা না পাওয়ার কথাটা শুনে লজ্জায় শুধু মুখটা একটু নামিয়ে নিলো আয়ান। তখনই ওয়েটার চা নিয়ে চলে আসায় জিয়া বললো,
-এই তো চা এসে গেছে! নিন নিন চা খান প্রফেসর বাবু। কী হলো মিস্টার প্রফেসর? এই আপনি আমার কথায় কিছু মাইন্ড করলেন নাকি? আমি কিন্তু জাস্ট মজা করছিলাম একটু…
আয়ান মুখটা একটু তুলে বললো,
-না না, আমি কিছু মাইন্ড করিনি। নিন আপনিও চা নিন, আপনার পছন্দের দুধ চা… আপনি কী আর কিছু খাবেন? কিছু স্ন্যাক্স?
-না না! স্ন্যাক্স কিছু খাবো না। তবে..
-তবে কী?
-সিগারেট চলতে পারে!
-আপনি স্মোক করেন?
-হ্যাঁ করি তো, না করার কী আছে? আপনি করেন না নাকি?
-না!
-এই আপনি কী বলুনতো? চায়ের নেশা নেই, সিগারেটের নেশা নেই! তাহলে কীসের নেশা আছে আপনার?
-নেশা কিছুরই নেই, তবে রাত জেগে পড়াশোনার জন্য একটু কফি খাই মাঝেসাঝে। কফিটাই যা একটু ভালো লাগে আমার।
-বুঝলাম, তার মানে আপনি কফি ভালোবাসেন। বাট আপনি সিগারেট খান না?
-না। তবে আপনি চাইলে খেতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।
-আপনার আপত্তি থাকলে আমি খেতাম না নাকি? আমার ইচ্ছে হলে নিশ্চয়ই খেতাম, কারোর আপত্তির ধার ধারি না আমি! কিন্তু এখন আর সিগারেট খাবো না! চা তো শেষই হয়ে গেলো। এবার আমাকে উঠতে হবে। নাহলে আবার আমার রুমমেট রাগারাগী করবে। ওকে ডিনার বানাতে হেল্প করতে হয় তো তাই। এই আপনার চা এখনও শেষ হয়নি? তাড়াতাড়ি শেষ করুন প্লিজ!
-হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো হয়েই এসেছে শেষ। এক সেকেন্ড!
আয়ান নিজের কাপের শেষ টুকু চায়ে চুমুক দিয়ে চা-টা শেষ করে ওয়েটারকে ডেকে বিলটা পেমেন্ট করে দিলো। তারপর ওরা দুজনে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে।
-চলুন আমার স্কুটিতে উঠুন, আমি আপনাকে আপনার কলেজে ড্রপ করে দিচ্ছি।
-না না, তার কোনো দরকার নেই। এখান থেকে তো আমার কলেজটা বেশি দূরে নয়। আমি হেঁটে চলে যাবো।
-ওকে, আপনি যা বলবেন!
-তাহলে আবার কবে আমাদের দেখা হবে?
-মানে? আবার কবে দেখা হবে মানেটা কী হ্যাঁ? এই আপনি আমাকে লাইন মারছেন নাকি বলুনতো?
আবার লজ্জায় পড়ে গিয়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে আয়ান নিজের মাথাটা নীচু করে নিলো। জিয়া যে কেন এভাবে কথা বলে সেটা ও নিজেও জানে না। আর ওর এরকম কথাতে যে অপর প্রান্তের মানুষ গুলো ভীষণরকম লজ্জিত বা অপমানিত হতে পারে, সেদিকেও ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! তাই ওর কোনো অপরাধ বোধও নেই। আয়ান চুপ করে থাকায়, জিয়া নিজেই আবার বললো,
-কী হলো প্রফেসর বাবু আপনি চুপ করে আছেন যে? আবার কেন দেখা হবে আমাদের?
-না আসলে, আমি তো আপনার পছন্দের দুধ চা খেলাম এই দু-দিন ধরে। এবার আপনি আমার পছন্দের ব্ল্যাক কফি একবার টেস্ট করে দেখবেন না?
-হুম, সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার পছন্দের ব্ল্যাক কফি তো টেস্ট করে দেখতেই হয়!
-তাহলে কবে?
জিয়া নিজের ডান হাতের নখটা দাঁত দিয়ে একটু কামড়ে ধরে একটু ভেবে নিয়ে বললো,
-ওকে, তাহলে নেক্সট সানডে বিকেল পাঁচটায়! এই ক্যাফেতেই। ওকে? আপনার টাইম হবে তো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি ঠিক সময়ে চলে আসবো..
-ওকে, এখন বাই!
আয়ানকে একটা হাত নেড়ে বাই বলে স্কুটিতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো জিয়া। আয়ান কিছুক্ষণ ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ওখানেই। তারপর নিজের মনেই একটু হেসে ও কলেজের দিকে পা বাড়ালো..
ক্রমশ…