হৃদমাঝারে,দ্বাদশ_পর্ব

0
531

#হৃদমাঝারে,দ্বাদশ_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া

কলকাতাতেও জিয়ার একটা স্কুটি আছে। জিয়া যখন কলকাতায় ছিলো, তখন ও ওটাতে করেই সব জায়গায় যাতায়াত করতো। কাল পিসির বাড়িতে ওই স্কুটিটা নিয়েই এসেছিলো জিয়া। কিন্তু এতো সকালে গ্যারেজের চাবি খুলতে গেলে সেই শব্দ পেয়ে সবাই জেগে যাবে, সেই ভেবে জিয়া স্কুটিটা আর বের করার চেষ্টা করলো না। পিসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও একটা ক্যাব বুক করে, তাতে চেপেই নিজের বাড়ি পৌঁছালো। জিয়ার মা-বাবা তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো অনসূয়াদেবীর। ঘুমটা ভেঙে যেতেই দরজা খুলতে যাওয়ার জন্য ধরফরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন জিয়ার মা অনসূয়াদেবী। দরজা খুলে জিয়াকে দেখেই উনি বললেন,

-কীরে জিয়া? তুই এতো সকালে? কিছু হয়নি তো? ওখানে সবাই ঠিক আছে তো জিয়া?
-সবাই ঠিক আছে মা। কিন্তু আমি ঠিক নেই!
-ঠিক নেই মানে? কী হয়েছে মা তোর? শরীর খারাপ করলো নাকি?
-আমাকে এক্ষুণি বাবার সাথে কথা বলতে হবে। তুমিও ঘরে এসো মা। তোমার সাথেও কথা আছে আমার!
-আমাদের সাথে আবার কী কথা আছে? পরে তোর সব কথা শুনবো। আগে তোর শরীর ঠিক আছে কিনা সেটা বল? দেখি কপালটা, জ্বর এসেছে নাকি?

অনসূয়াদেবী জিয়ার কপালে হাত দিয়ে উষ্ণতা মাপতে তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু জিয়া কিছুটা রাগান্বিত হয়ে ওনার হাতটা ধরে সরিয়ে দিলো। ওভাবে হাতটা সরিয়ে দিতেই অনসূয়াদেবী ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। ওনার হাতটা সরিয়ে দিয়েই জিয়া বাড়ির ভিতরে ঢুকে সোজা অনসূয়াদেবী আর সুখময়বাবুর ঘরের দিকে চলে গেলো। জিয়াকে ওভাবে ওনাদের ঘরের দিকে যেতে দেখে অনসূয়াদেবী বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে নিজেদের ঘরের দিকে ছুটলেন। জিয়ার পিছনে ছুটতে ছুটতে উনি বললেন,

-এই জিয়া? কী হয়েছে তোর? দাঁড়া.. শোন আমার কথাটা.. তোর বাবা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি রে..

কিন্তু জিয়া ওনার কোনো কথা গ্রাহ্য না করেই ঘরের ভিতরে ঢুকে এলো। তারপর চিৎকার করে সুখময় বাবুকে ডাকতে শুরু করলো,

-বাবা? বাবা ওঠো.. তোমার সাথে আমার খুব দরকারি একটা কথা আছে! বাবা…

জিয়ার গলার স্বরে সুখময় বাবুর ঘুমটা ভেঙে যেতেই উনি উঠে বসতে বসতে বললেন,

-কীরে জিয়া তুই? কখন এলি? অনেক বেলা হয়ে গেছে নাকি রে? কই তোর মা তো এখনও ডাকলো না আমায়! আয় আয় বস…
-না, আমি এখন বসবো না! তোমার থেকে আমার অনেক জরুরী একটা কথা জানার আছে বাবা..
-আমার থেকে তোর আবার কী জানার আছে রে মা? এখন যা যুগ পড়েছে আমাদেরকেই তো তোদের থেকে সব জেনে শুনে নিতে হয়!
-আমি এখন ইয়ার্কির মুডে নেই বাবা! আমার সত্যি সত্যিই তোমার সাথে কিছু ইম্পরটেন্ট কথা আছে। মা তুমিও বসো এখানে..

জিয়াকে কোনো দিন এতো গম্ভীরভাবে কথা বলতে দেখেননি সুখময়বাবু আর অনসূয়াদেবী। জিয়া সবসময় হেসে, মজা করে, ইয়ার্কি করে মজার ছলে কথা বলে সবার সাথে। তাই সুখময়বাবুও কথাটা মজার ছলেই বলেছিলেন। কিন্তু আজ হঠাৎ জিয়াকে এরকম কঠিনভাবে কথা বলতে দেখে ওনাদের কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হলো। তাই কৌতূহলবশত সুখময়বাবু শান্ত গলায় বললেন,

-বল মা, তোর কী কথা জানার আছে আমাদের বল..
-দিদিয়াকে তোমরা পিমণির বাড়িতে রেখে এসেছিলে কেন বাবা? কেন আমাদের দুজনকে একসাথে রাখোনি? ছোটোবেলায় আলাদা করে দিয়েছিলে কেন আমাদের?

পাশ থেকে অনসূয়াদেবী বললেন,

-তুই হঠাৎ এসব কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন জিয়া? শিয়ার সাথে কী তোর কোনো কথা হয়েছে এইসব নিয়ে?
-না মা! কোনো কথা হয়নি দিদিয়ার সাথে। তোমাদের এই একটা সিদ্ধান্তের জন্য যে দিদিয়ার মনে কতোটা কষ্ট হতে পারে, কতোটা আঘাত লাগতে পারে, তার কোনো আন্দাজ আছে তোমাদের? কেন বাবা? কেন মা? কেন দিদিয়াকে আমাদের সাথে এক বাড়িতে একসঙ্গে রাখোনি তোমরা?

সুখময়বাবু আর অনসূয়াদেবী কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওনারা চুপ করে থাকায় চিৎকার করে উঠলো জিয়া। ও বললো,

-কী হলো বাবা! তোমরা চুপ করে আছো কেন হ্যাঁ? উত্তর দেওয়ার মতো সৎ সাহসও নেই নাকি তোমাদের?! কেন দিদিয়ার সাথে এতো বড়ো একটা অন্যায় করেছিলে তোমরা?

পাশ থেকে অনসূয়াদেবী জিয়াকে ধমক দিয়ে উঠে বললেন,

-জিয়া! ঠিক করে কথা বলো.. তুমি ভুলে যেও না যে তুমি নিজের মা-বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলছো! আমরা কী তোমাকে ছোটো থেকে এই শিক্ষা দিয়েছি?
-ওকে বলতে দাও অনু.. বলতে দাও ওকে.. জিয়া তো ঠিকই বলেছে। আমরা তো সত্যিই আমাদের আর এক মেয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছি। আজ তার জন্য আমাদেরকেই কষ্ট পেতে হচ্ছে। নিজের মেয়ের সাথে না চাইতেই অনেক দূরত্ব তৈরী হয়েছে আমাদের। হ্যাঁ রে মা তুই বল.. তুই কী জানতে চাস জিয়া? এটাই জানতে চাস তো যে, তোর দিদিয়াকে কেন পিমণির বাড়িতে রেখে এসেছিলাম? শোন তাহলে..

সুখময়বাবু বিছানার একপাশে বসলেন। জিয়া এসে সুখময়বাবুর পাশে বসলো। অনসূয়াদেবীও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বিছানার সামনে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন সুখময়বাবু,

-তোরা তখন ওই বছর পাঁচেকের হবি। তোর মা আর আমি মিলে খুব ভালোভাবেই তোদের মানুষ করছিলাম। তোদের দুজনকে একসঙ্গে স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছিলাম। খুব নাম করা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তোদের মা খুব যত্ন সহকারে তোদের দুজনকে পড়াতেও বসতো রোজ সকাল-বিকাল নিয়ম করে। তোরা হওয়ার কয়েকদিন আগেই তোর পিমণিরও একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছিলো। জন্মের কিছু দিন পর থেকেই গায়েত্রীর মেয়েটার জ্বর, সর্দি, কাশি লেগেই লাগতো। অনেক নামিদামী ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসাও করেছিলো ওরা। কিন্তু শরীরের আরও অবনতি ছাড়া কোনো উন্নতি হয়নি কখনও। তারপর হঠাৎ করেই মেয়েটা একেবারে বিছানা শয্যা হয়ে গেলো। শারীরিক গঠনেরও পরিবর্তন হতে শুরু করলো। সময়ের সাথে অঙ্গপ্রতঙ্গ বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে আরও শুকিয়ে যেতে লাগলো। দিনের পর দিন মেয়েটা যতো অসুস্থ হতে শুরু করলো, গায়েত্রীও ততোই ভেঙে পড়তে শুরু করেছিলো। এখানকার কোনো ডাক্তারই সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে পারছিলেন না, আর রোগও ধরতে পারছিলেন না। তারপর ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে ভেলোরে গেলো ভালো চিকিৎসা আর পরামর্শ পাওয়ার আশায়। ওখানে গিয়ে বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শ মতো নানারকম টেস্ট করার পর মেয়েটার ব্ল্যাড ক্যান্সার ধরা পড়লো। ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছিলেন আর বেশিদিন হয়তো বাঁচানো যাবে না ওকে। ডাক্তাররা এটাও বলেছিলেন যে ওনাদের হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবটাই তখন ওপরওয়ালার হাতে। উনি চাইলে বাচ্চাটা তখনও দশ বছরও বাঁচতে পারে, আবার না চাইলে হয়তো দশ দিনও বাঁচবে না। ডাক্তারের কথাই একদম ঠিক ছিলো রে মা!
-মানে? তারপর কী হলো বাবা? পিমণির বাচ্চাটাকে কী আর বাঁচানো যায়নি? বলোনা বাবা..?
-না রে মা! আসলে ওপর ওয়ালা হয়তো চাননি যে, গায়েত্রী ওর মেয়ের মুখ থেকে আর বেশিদিন মা ডাকটা শুনুতে পাক। ওরা যেদিন ভেলোর থেকে ফিরছিলো, সেদিন ফ্লাইটের মধ্যেই বাচ্চাটা..

আর বলতে পারলেন না সুখময়বাবু। ওনার গলা ধরে এসেছে। চোখ থেকে নোনতা জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরত। জিয়ার চোখও তখন জলে পরিপূর্ণ। ও এগিয়ে এসে সুখময় বাবুর কাঁধে হাত রেখে ওনাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু উনি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলেন না। তাই জিয়াও নিজের কান্না থামাতে না পেরে ওনার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। অনসূয়াদেবী চেয়ার থেকে উঠে এসে জিয়া আর সুখময়বাবুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন। তারপর জিয়ার উদ্দেশ্যে উনি বললেন,

-তোর পিমণির সাথে তোর বাবারও ভেলোরে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি একা তোদের দুই বোনকে সামলাতে পারবো না ভেবে তোর পিমণিই বলেছিলো তোর বাবাকে এখানে আমার পাশে থাকতে। আর গায়েত্রীর কথায় তোর বাবা আমার সাথে এখানেই থেকে গিয়েছিলো তোদের দেখাশোনা করার জন্য। সেদিন ওদের সাথে যেতে পারেনি বলে, তোর পিমণির এতো বড়ো একটা কষ্টের সময়ে পিমণি আর পিসানের পাশে থাকতে পারেনি বলে তোর বাবা নিজেও খুব ভেঙে পড়ছিলো। ওদিকে তোর পিমণি মেয়ের শোকে আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করছিলো। ডাক্তাররাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। সন্তান হারানোর যে কী কষ্ট সে একমাত্র যার সন্তান হারিয়ে যায়, সেই জানে। তোর বাবা নিজের বোনের শরীরের ওই অবস্থা দেখে এখানে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলো না। আর তোর পিমণিকে এখানে এনে রাখতে চাইলেও সে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। ওই বাড়ির আনাচে কানাচে ওর মেয়ের সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলে। অন্যদিকে তোর পিমণির বাচ্চাটা জন্মাবার সময়ই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন যে, তোর পিমণির পক্ষে দ্বিতীয়বার আর সন্তান ধারণ করা সম্ভব হবে না। তাই দ্বিতীয় ইসু নিয়ে যে কোনোক্রমে সাময়িকভাবে গায়েত্রীকে সামলানো যাবে, তারও কোনো উপায় ছিলো না। সেই সময় আমি তোর বাবার আর তোর পিমণির কষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম না রে জিয়া। এদিকে আমি আমার দুটো সন্তানকে নিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। সারাক্ষণ তাদের “মা” ডাক শুনতে শুনতে সুখের জোয়ারে ভাসছি। নিজে মাতৃত্বের সুখ উপভোগ করছি, আর ওইদিকে তোর পিমণি নিজের সন্তান হারানোর শোক সামলাতে না পেরে মানসিকভাবে আরও অবনতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বলেছিলেন সেই সময় একটা বাচ্চাই পারে তোর পিমণির মানসিক অস্থিরতা সামলাতে, ওকে মাতৃত্বের সুখ দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু গায়েত্রীর পক্ষে যেহেতু আর সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব ছিলো না, তাই সেই মুহূর্তে তোদের মধ্যে যেকোনো একজনকে গায়েত্রীর হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না জিয়া! আমি এটাই ভেবেছিলাম, যদি তোদের মধ্যে কাউকে একটা পেয়ে তোর পিমণির মানসিক অবস্থার কোনোভাবে একটু উন্নতি হয়, বা তোর পিমণি যদি ভালো হয়ে যায়। আর যখন শিয়াকে তোর পিমণির হাতে তুলে দিলাম এই বলে যে, “আমি দুজনকে একসাথে সামলাতে পারছি না, তুমি দয়া করে আমার একটা মেয়ের দায়িত্ব নাও গায়েত্রী!” তারপরই দেখেছিলাম, তোর পিমণি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করলো। শিয়াকেই নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবেসে মানুষ করতে শুরু করলো। আর আস্তে আস্তে ওর কাছে পুরোনো সন্তান হারানোর স্মৃতিটাও ক্রমশ ক্ষীণ হতে শুরু করলো। শিয়াও গায়েত্রীকে মায়ের মতো করেই ভালোবাসতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে শিয়া আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে যেতে লাগলো। আর সেই কারণেই আমাদের মধ্যে মানসিক দূরত্বেরও সৃষ্টি হলো। আর আমাদের মধ্যেকার মানসিক দূরত্বটাও ক্রমশই বৃদ্ধির পথে এগোতে লাগলো। কিন্তু বিশ্বাস কর জিয়া, আমি তোদেরকে একসঙ্গে সামলাতে পারতাম না এমনটা কিন্তু নয়! আমি নিজে একাই একশো ছিলাম তোদের সামলানোর জন্য। পাঁচটা বছর তো তোদেরকে একসাথে সামলেছিও। আমার কাছে সেদিনও যেমন দুই সন্তান একই ছিলো, আজও তাই-ই আছে। তোকে বেশি ভালোবাসি বলে নিজের কাছে রেখেছি, আর শিয়াকে কম ভালোবাসি বলে ওকে গায়েত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম এমনটা নয়! আসলে ছোটো থেকেই তুই খুব দুরন্ত স্বভাবের ছিলি। তুই যতোটা দুরন্ত আর ছটফটে ছিলি, শিয়া ঠিক ততোটাই চুপচাপ আর শান্ত প্রকৃতির ছিলো। আমি ভেবেছিলাম আমি যদি তোকে তোর পিমণির কাছে রেখে আসি, তাহলে তোর পিমণি তোকে সামলাতে পারবে না। কারণ তোর পিমণি তো তখন এমনিতেই অসুস্থ ছিলো। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো না করার ফলে শারীরিকভাবেও খুব দূর্বল হয়ে পড়েছিলো। তাই শিয়াকে রেখে এলে ও গায়েত্রীর সব কথা শুনে চলবে আর তোর পিমণিরও ওকে সামলাতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু বিশ্বাস কর জিয়া, এতে আমার কোনো পার্শিয়ালিটি ছিলো না। আমি সেদিন যেমন তোদের দুজনকে সমানভাবে ভালোবাসতাম, আজও ঠিক তেমনটাই ভালোবাসি… শিয়া যতোই আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে চাউকনা কেন, আমরা কিছুতেই ওকে দূরে সরে যেতে দিতে চাই না। আমরা যখন দেখলাম, শিয়া আমাদের ওপর অভিমান করে আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে যেতে চাইছে, তখন আমরা বহুবার ওকে আমাদের কাছে নিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমাদের কাছে আর আসতে চায়নি জিয়া! আমরা যখনই ওই বাড়িতে ওকে দেখার জন্য বা আমাদের সাথে নিয়ে আসার জন্য যেতাম, ও তখন শুধু তোর সাথেই কথা বলতো। ও আমাদের সাথে ঠিকমতো কথাই বলতে চাইতো না। আমরা ডাকলেও আমাদের কাছে আসতো না, পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকতো। তারপর ওর গ্র‍্যাজুয়েশনের পর যখন গায়েত্রী ওকে পড়াশোনাটা ছাড়িয়ে দিলো, তখন তোর বাবা বলেছিলো শিয়াকে আমাদের এখানে নিয়ে এসে ও যতো দূর পড়তে চায় পড়াবে। কিন্তু ও ওর অভিমানের কারণে আমাদের সাথে আসেনি। শিয়ার এই অভিমান গুলো জমতে জমতে, কষ্ট পেতে পেতে যে, ও এরকম পাথরের মতো হয়ে যাবে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি রে জিয়া… আমাদের কখনোই শিয়াকে তোর পিমণির বাড়িতে রেখে আসা উচিৎ হয়নি…
-তুমি কোনো চিন্তা কোরো না মা! আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের সাথে দিদিয়ার এই দূরত্বটা ঠিক একদিন মিটিয়ে দেবো.. তোমাদের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব থাকবে না দেখো… আমি দিদিয়ার সব রাগ, অভিমান, কষ্ট ভুলিয়ে দেবো! তুমি আর কেঁদো না মা… তুমিও আর কেঁদো না বাবা! আর আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও বাবা.. আমি না জেনে রাগের মাথায় তখন তোমাদের অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে ফেলেছি… প্লিজ তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না বাবা! তোমরা প্লিজ আমার ওপর আর রাগ করে থেকো না..

জিয়া দুই হাত জোর করে অনসূয়াদেবী আর সুখময়বাবুর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো। ওনারা দুজনেই জিয়ার হাত ধরে নিজেদের বুকে টেনে নিলেন ওকে। তারপর সুখময়বাবু বললেন,

-জানি রে মা.. আমরা সবটা বুঝতে পেরেছি… আমরা তোর ওপর একটুও রাগ করিনি সোনা.. এতে তো তোর কোনো দোষ নেই রে মা, তোর কোনো দোষ নেই… তুই যা মা! তোর দিদিয়ার কাছে যা.. গিয়ে দেখ আমাদের ওপর করা তোর দিদিয়ার রাগ, অভিমান ভাঙাতে পারিস কিনা।
-হ্যাঁ জিয়া, তুই যা! তোর দিদিয়াকে বুঝিয়ে সবটা বল মা.. আমরা যতোবারই তোর দিদিয়াকে সবটা বুঝিয়ে বলতে গেছি, ও একবারও আমাদের কথা শুনতে চায়নি। শিয়া তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে জিয়া। ও নিশ্চয়ই তোর কথা শুনবে আর সবটা বুঝবেও.. এই বয়সে এসে আর আমরা নিজের সন্তানের কষ্ট, আর সন্তানের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে পারছি না জিয়া…
-তুমি কোনো চিন্তা কোরো না! দিদিয়া আমার কথা ঠিক বুঝবে। ও ঠিক তোমাদের ওপর করা মিথ্যে রাগ, অভিমান গুলো বুঝতে পারবে। হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পারবে দিদিয়া। আমি আসছি মা…

জিয়া মা-বাবাকে প্রণাম করে ওনাদের আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

সারারাত ধরে আয়ান জিয়াকে ফোনে ট্রাই করতে করতে ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আর ঠিক তখনই জিয়া ফোনটা শুধু সুইচ অন করেই পকেটে ভরে নিয়ে পিমণির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো। তখনই সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রান্তেই মেসেজ অ্যালার্ট এলো। জিয়ার ফোনে মিসড কল অ্যালার্ট, আর আয়ানের ফোনের মেসেজের শব্দ জানান দিলো যে জিয়ার ফোনটা অন করা হয়েছে। কিন্তু আয়ানের কানে কয়েক সেকেন্ডের মৃদু মেসেজ টোনের আওয়াজ পৌঁছালো না। আর জিয়া ওর দিদিয়াকে নিয়ে মানসিকভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত ছিলো যে, তখন শুধুমাত্র ফোনটা সুইচ অন করা আর ছাড়া ফোনে আর কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি ওর। এখন বাবা-মার সাথে কথা বলার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোনের লকটা খুলতেই দেখলো একটা মিসডকল অ্যালার্টের মেসেজ এসেছে। মেসেজটা খুলেই জিয়া দেখলো আয়নের নাম্বার থেকে একশো তেতাল্লিশটা মিসডকল রয়েছে। তার মানে আয়ান এতোবার জিয়াকে কল করে গেছে। এতোগুলো মিসডকলের মেসেজ দেখে চমকে উঠলো জিয়া। ও কাল থেকে শিয়াকে নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে আয়ানের সাথে কথা বলার কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলো। এতোগুলো মিসডকলের কারণটা এতোক্ষণে খুব ভালো করেই বুঝে গেছে জিয়া। কারণ শিয়ার মুখে ও শুনেছিলো যে আয়ান আর ওর মা আগে শিয়ার ছবি দেখেই ওকে পছন্দ করেছিলো। আর আয়ান শিয়াকে জিয়া মনে করেই কাল ওদের বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে এসেছিলো। এসব ভেবে জিয়া ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। সূর্য উঠতে শুরু করেছে সবে সবে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠছিলো ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়ায় জিয়ার অবিন্যস্ত, অবাধ্য চুল গুলো উড়ে এসে ওর মুখে পড়ে ওকে বিরক্ত করছিলো। এতো সকালে রাস্তায় খুব বেশি লোকজন বা গাড়ি যাতায়াত না করায় রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকাই ছিলো। চারিদিক থেকে ভেসে আসছিলো পাখির কলতান। জিয়া হাঁটতে শুরু করলো নিজের মনেই। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার মধ্যেই একটা বাস স্ট্যান্ডের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে জিয়া নিজের ফোনে ডায়াল করলো আয়ানের নাম্বারটা। ফোনের রিংটোনের তীব্র শব্দে আয়ানের আলগা ঘুমটা ভেঙে যেতেই ফোনটা হাতে নিয়ে জিয়ার নাম্বার দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে কলটা রিসিভ করেই ও বললো,

-জিয়া? জিয়া তুমি কাল থেকে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেন হ্যাঁ?! তুমি জানো কাল বিকেল থেকে আমি তোমাকে কতোবার ফোনে ট্রাই করেছি?? তোমার সাথে কথা বলাটা খুব ইম্পরটেন্ট ছিলো আমার.. একটা খুব বড়ো ব্লান্ডার হয়ে গেছে জিয়া!

এতো বড়ো একটা ভুল বোঝাবুঝির কথা বুঝতে পেরেও জিয়া নিজেকে একদম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,

-ব্লান্ডার? কী ব্লান্ডার? আচ্ছা আচ্ছা, সেসব কথা নাহয় পরে হবে। আগে তোমাকে কংগ্র‍্যাচুলেটটা তো করি! কংগ্র‍্যাচুলেশন্স প্রফেসর বাবু! এবার তো তুমি আমার জিজু হয়ে যাবে। আর কিছুদিন পরেই তো তোমার সাথে আমার দিদিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। এই তারপর তোমাকে আমি কী বলে ডাকবো গো জিজু নাকি অন্য কিছু?
-তুমি সবটা জানো জিয়া? সবটা জানার পরেও তুমি এতোটা স্বাভাবিক কী করে থাকতে পারছো?! আমি এক্ষুণি তোমার সাথে দেখা করে সব কথা বলতে চাই জিয়া! এক্ষুণি আর এই মুহূর্তে! প্লিজ আমার সাথে এক্ষুণি একবার দেখা করো..

ক্রমশ…

পড়লেন?
কাকে বেশি ভালো লাগছে জিয়াকে নাকি শিয়াকে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here