#হৃদমাঝারে,পঞ্চদশ_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া
সেদিন পিসির বাড়িতে এসে জিয়া শিয়াকে সবটা খুলে বলেছে। কেন ওর মা-বাবা ছোটোবেলায় ওকে পিসির বাড়িতে রেখে গিয়েছিলো, সেই সমস্ত কথা জিয়া বুঝিয়ে বলেছে শিয়াকে। শিয়া সেদিন এক মনে কথা গুলো শুনছিলো শুধু, কোনো উত্তর দেয়নি ও। জিয়ার কথা গুলোর সত্যতা বা মিথ্যাত্ব কোনোটাই যাচাই করতে চায়নি শিয়া। শুধু শুনেই গেছে একমনে। আর নিঃশব্দে চোখ থেকে জল ফেলেছে।
আজ শিয়া আর আয়ানের আশীর্বাদ। বাসন্তীদেবী, আয়ান আর রিমলি আজ গায়েত্রীদেবীদের বাড়িতে আসবেন শিয়াকে আশীর্বাদ করতে। তাই সকাল থেকেই গায়েত্রীদেবীদের বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ওনাদের বাড়িতে আজ বেশ কয়েকজন অন্যান্য আত্মীয়স্বজনও নিমন্ত্রিত। শিয়ার মনেও বেশ আনন্দ হচ্ছে। এই দুদিনের মধ্যে জিয়া বিভিন্নভাবে শিয়ার কাছে ওদের বাবা-মায়ের কথা তুলে ধরেছে। বিভিন্ন রকম কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই বোঝাতে চেয়েছে, যে শিয়াকে ছোটোবেলায় ওর পিমণির কাছে রেখে যাওয়াতে আসলে অনসূয়াদেবী আর সুখময়বাবুর তেমন কোনো দোষই ছিলো না। যার জন্য শিয়া নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে মানসিকভাবেও এতোটা দূরে চলে এসেছে। শিয়াও সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে ধীরে ধীরে এটাই অনুভব করতে শুরু করেছে যে সত্যিই হয়তো ওনাদের এতে কোনো দোষ ছিলো না। আজকের মতো এতো বড়ো একটা আনন্দের দিনে শিয়া ওর মণি আর পাপানের সাথে সাথে নিজের বাবা-মায়ের আশীর্বাদও নিতে চায়। ও মনে মনে এটাই ভাবছিলো যে আজ কী ওর বাবা-মা এই বাড়িতে আসবে? ও কী ওর মা-বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে পারবে? এক মনে জানলার দিকে তাকিয়ে সেসব কথাই ভাবছিলো শিয়া। হঠাৎই জিয়া ঘরে ঢুকে শিয়াকে পিছন থেকে একটু ঠেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
-এই দিদিয়া! কার কথা ভাবছিলিস রে?! জিজুর কথা নিশ্চয়ই?
হঠাৎ করে ওভাবে পিছন থেকে ধাক্কা দেওয়ায় চমকে উঠলো শিয়া। ও বললো,
-জিয়া! এভাবে কেউ না বলে হুট করে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়? কী জোর ভয় পেয়ে গেছিলাম!
-ওই দিদিয়া! বলনা রে কার কথা ভাবছিলি? জিজুর?
-সবসময় তোর এই ইয়ার্কি গুলো কিন্তু আমার একদম ভালো লাগে না জিয়া! চুপ কর তুই! এখনও তো ওনার সাথে আমার বিয়েটা হয়নি। তাই এই জিজু বলে ডাকাটা প্লিজ বন্ধ কর তুই!
-আরে বাবা, এখনও হয়নি তো কী হয়েছে? আর দু-এক দিনের মধ্যেই তো তোদের বিয়েটা হয়েই যাবে! জিজুর যা তাড়া, এক্ষুণি পারলে এক্ষুণি তোকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে পারলে হয়! শিলিগুড়ি ফিরে যাওয়াটা তো শুধু অজুহাত মাত্র!
-উফ্ জিয়া! আবার শুরু করেছিস তুই? তুই সত্যিই কোনো দিন বড়ো হবি না!
-কে বললো দিদিয়া, যে আমি বড়ো হইনি? আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি! আর তাছাড়া আমি তো তোর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের ছোটো! আমাদের দুজনের বয়স তো একই! আমি যদি বড়ো না হই, তাহলে তুই কী করে বড়ো হবি?
-আমাদের বয়স এক তো কী হয়েছে? তুই এখনও পরিণত নয় বোন..
-আচ্ছা ঠিক আছে! সেসব কথা এখন থাক দিদিয়া! আজ আর তোকে আমাকে শাসন করতে হবে না! শোন দিদিয়া, আজ কিন্তু আমি তোকে নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো.. আর আমি তোর আশীর্বাদের প্রতিটা মুহূর্ত আমার এই ক্যামেরার মধ্যে বন্দী করে রাখবো দিদিয়া… আর আমার ইচ্ছেটার কথা তো জানিসই, বাইরের কোনো ফটোগ্রাফার নয়, তোর বিয়ের ফটোগ্রাফার আমি হবো দিদিয়া! এই রে আমার ফোনটা মনে হয় বাজছে, যাই গিয়ে দেখি কে কল করেছে! কথাটা বলে নিয়েই তোকে সাজাতে আসছি দিদিয়া। ততোক্ষণ তুই জিজুর চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাক!
কথাটা বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো জিয়া। জিয়ার কথা শুনে শিয়া একটু হেসে ফেলে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো। আসলে জিয়া সারাক্ষণ চেষ্টা করে চলে কীভাবে শিয়ার মনটাকে একটু ভালো রাখা যায়। কীভাবে ওকে আনন্দে আর হাসিখুশিতে পরিপূর্ণ করে রাখা যায়। আর জিয়ার সেই চেষ্টাটা আগের থেকে অনেকটাই সফল হতে শুরু করেছে। শিয়া আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। জিয়া ঘরের বাইরে এসে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সুলেখা কল করছে। কলটা রিসিভ করে ও বললো,
-হ্যাঁ সুলেখাদি বলো! কেমন আছো তুমি? আর বাকিরা সবাই কেমন আছে গো?
-আমরা সবাই ভালো আছি জিয়া। কিন্তু তোমাকে আমরা খুব মিস করছি জানো! বস্ও তোমাকে খুব মিস করছেন। অন্য কেউ যদি এতোদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বসে থাকতো, তাহলে তো তার জবটা একদিনেই চলে যেতো! বাট বসের তোমার প্রতি এতোটাই সফ্ট কর্ণার রয়েছে, যে উনি তোমার জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোমেরও ব্যবস্থা করে দিলেন!
-হা হা হা! তুমি যে কী বলোনা সুলেখাদি! ওয়ার্ক ফ্রম হোমের এই ব্যাপারটা তো এখন প্রায় সবার জন্যই অ্যাপ্লিকেবল। আর যদি উনি ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ব্যবস্থা করে না দিতেন, তাহলে কিন্তু আমি এই জবটাই ছেড়ে দিতাম। এমনিতেই তো বেশ কয়েক বছর হলো আমি এই কোম্পানিতে জব করছি। এবার একটু কোম্পানি চেঞ্জ করতে মন চাইছে গো!
-এই না না জিয়া! প্লিজ তুমি আমাদের কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোথাও যেও না.. তাহলে যে বসের চাপে আমরা মারা পরবো! তবু তুমি আছো বলে বসের হাত থেকে কী একটু ছাড় পাওয়া যায়।
-না না সুলেখাদি, তুমি একদম চিন্তা কোরো না। কোম্পানি চেঞ্জ করলেও আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগটা ঠিকই অবিচ্ছিন্ন রাখবো। এই সুলেখাদি, অংশুদা কোথায় গো? তিথি, দিশা আর বুবুনদা ওরাই বা কোথায়? ওদের সবাইকে একটু ফোনটা দাওনা? ওদের সাথেও তো অনেকদিন কথা হয়নি আমার! একটু কথা বলি..
জিয়া একে একে অফিসের সব কলিগদের সাথে কথা বলে নিয়েই শিয়াকে সাজানোর জন্য ওর কাছে গেলো। তারপর খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো শিয়াকে। শিয়াকে একটা সুন্দর শাড়ি আর তার সাথে ম্যাচিং করে গয়না পরিয়েছে জিয়া। ওকে দেখতে একদম লক্ষী প্রতিমার মতো লাগছে আজ। জিয়া নিজে কিছুই সাজেনি। প্রতিদিনকার মতো একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর একটা ঢলঢলে টপ পরেই আছে। আর চুলটা গুটিয়ে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছে। মুখের সামনে এক গুচ্ছ চুল পড়ে আছে। ওকে এরকম অগোছালো অবস্থায় দেখে গায়েত্রীদেবী বললেন,
-একী রে জিয়া, তুই তোর দিদিয়াকে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে দিলি। আর নিজেই এখনও তৈরী হোসনি? এখনও সেই বাড়ির জামাকাপড়ই পরে আছিস? তাড়াতাড়ি ভালো কিছু পরে রেডি হয়ে নে!
শিয়ার মাথার খোঁপার জুঁই ফুলের মালাটা ঠিক করে দিতে দিতে জিয়া বললো,
-আমি আবার কী রেডি হবো পিমণি? তুমি তো জানোই, আমার অতো সাজগোজ করতে ভালো লাগে না! আর তাছাড়া আজ দিদিয়ার আশীর্বাদ। শুধু দিদিয়া সাজবে না তো কে সাজবে তুমি, আমি আর বাকি লোকেরা?
-তাই বলে তুই এরকম অগোছালো হয়ে থাকবি?!
-আমি তো অগোছালোই পিমণি! আর আমার এরকম অগোছালো থাকতেই বেশি ভালো লাগে গো! তাছাড়া বেশি সাজলে আমাকে ঠিক মানায়ও না!
-তাই বলে তুই আজকেও এভাবে থাকবি জিয়া?
জিয়ার কথা শুনে শিয়া গায়েত্রীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-তুমি একদম ভেবো না মণি! আমি তো ভেবেই রেখেছি, আমার সাজটা কমপ্লিট হয়ে গেলেই আমি ওকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেবো। কিন্তু জিয়ার তো আমাকে রেডি করা শেষই হচ্ছে না! একের পর এক গয়না পরিয়েই যাচ্ছে। আর তোকে কে বলেছে জিয়া, যে তোকে নাকি সাজলে মানায় না? সাজলে তোকে আমার থেকেও বেশি সুন্দর লাগে! আমি তোকে সাজিয়ে দেওয়ার পর নিজেকে একবার আয়নায় দেখবি কতো সুন্দর লাগবে…
-এই দিদিয়া না, প্লিজ না! তুইও তো জানিস আমার বেশি সাজতে একদম ভালো লাগে না! গা চুলকায় ওইসব গয়নাগাটি পরলে! আমি সাজবো না!
-তুই যদি না সাজতে চাস, তাহলে কিন্তু আমি আমার সাজটাও নষ্ট করে ফেলবো জিয়া! আমিও কিন্তু তাহলে তোর মতো অগোছালো হয়েই থাকবো বলে দিলাম!
-ওই দিদিয়া, না প্লিজ, তুই এমনটা করিস না! আচ্ছা ঠিক আছে আমি সাজবো। এবার হয়েছে তো?
-হ্যাঁ! এই তো আমার মিষ্টি বোন..
শিয়া পিছন ঘুরে জিয়ার গাল টিপে আদর করে দিলো একটু। ওদের দুই বোনের এমন খুনসুটি প্রত্যক্ষ করে গায়েত্রীদেবীও বেশ আনন্দিত হলেন। উনি বললেন,
-আচ্ছা আচ্ছা, আর বেশি কথা না বলে তোরা তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে এবার। সব লোকজন কিন্তু আসতে শুরু করেছে প্রায়। দাদা-বৌদিও এই এলো বলে! ওরা যে এতো দেরী করছে কেন কী জানি! আগে তো ওদেরকেই আশীর্বাদ করতে হবে। আমি যাই গিয়ে একটা ফোন করি বৌদিকে…
গায়েত্রীদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর শিয়াও সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো জিয়াকে। শিয়া অনেক করে জোরাজুরি করার পর জিয়া আজ শাড়ি পরতে রাজী হয়েছে। শাড়ির সাথে মানানসই করে জিয়ার বারণ সত্ত্বেও খুব হালকা ধরনের কিছু গয়না পরিয়ে দিলো শিয়া। জিয়া আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। সেই কোন কালে ছোটোবেলায় একবার শাড়ি পরে দুই বোন মিলে ছবি তুলেছিলো ওরা। তখন অবশ্য জিয়া নিজের ইচ্ছেতেই শাড়িটা পরেছিলো। তারপর হয়তো দুয়েকবার শাড়ি পরেছিলো সরস্বতী পুজো বা অষ্টমীতে। আজ আবার শিয়ার ইচ্ছে আর জোরাজুরিতে শাড়ি পরতে বাধ্য হলো জিয়া। এর মধ্যেই অনসূয়াদেবী আর সুখময়বাবু এসে উপস্থিত হয়েছেন। দুই মেয়েকেই একসাথে শাড়ি পরে দেখে ওনাদের বেজায় আনন্দ হলো। দুইজনকে একইরকম দেখতে হওয়ায়, বাইরের লোকের কাছে কোনটা জিয়া আর কোনটা শিয়া বোঝা প্রায় মুশকিলের ব্যাপার। কিন্তু ওনারা মা-বাবা। তাই ওনাদের কখনোই ওদের দুজনকে চিনে নিতে ভুল হয়না। অনসূয়াদেবী ঘরের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-বাহ্! কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোদের দুজনকে! জিয়া তুইও শাড়ি পরেছিস? যাক, তোর একটু সুবুদ্ধি হয়েছে তাহলে!
-আমার কথা বাদ দাও! আগে দিদিয়াকে কেমন লাগছে তুমি সেটা বলো মা?
-বললাম তো জিয়া, তোদের দুজনকেই ভীষণ ভীষণ সুন্দরী লাগছে। তবে তোর দিদিয়াকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে আজকে!
-তবে? দিদিয়াকে কে সাজিয়েছে সেটা দেখতে হবে তো! এই আমি সাজিয়েছি বলে কথা!
-তাই নাকি জিয়া? তুই আবার কবে থেকে এতো সুন্দর সাজাতে শিখলি? তোর তো আবার এসব মেকআপ-টেকআপ ভালো লাগে না!
জিয়ার উদ্দেশ্যে কথাটা বলে উনি এগিয়ে এলেন শিয়ার দিকে। তারপর শিয়ার গালে হাত রেখে বললেন,
-তুই কতো বড়ো হয়ে গেলি রে মা। আর দুদিন পরেই তোর বিয়েও হয়ে যাবে! বিয়ে হয়ে পরের বাড়ি চলে যেতে হবে তোকে। কতো দূরে চলে যাবি আমাদের থেকে। তোর জন্য আমাদের খুব কষ্ট হবে রে শিয়া। তুই কী আমাদের এখনও ভুল বুঝেই থাকবি মা? একটুও বুঝবি না আমাদের?
শিয়া মনে মনে ভেবে রেখেছিলো আজ ওর মা-বাবা এলে ওনাদের সাথে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করবে ও। তাই প্রথম থেকেই মুখে একটা আলগা হাসি টেনে রেখেছিলো শিয়া। কিন্তু ওনাদের সামনে থেকে দেখে যেন ওনাদের প্রতি হয়ে থাকা এতোদিনের অভিমানটা গলতে শুরু হওয়ার বদলে ওর মনের মধ্যে আরও বেশি জমাট বেঁধে গেলো! শিয়া অনসূয়াদেবীর কথার কোনো উত্তর না দিতে পেরে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ওকে ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিতে দেখে অনসূয়াদেবী কষ্টে মাথা নামিয়ে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন। সুখময়বাবু শিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে শিয়া ওনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি জিয়া। মণি মনে হয় আমাকে ডাকছে!
কথাটা বলেই শিয়া সুখময়বাবুর দিকে তাকিয়ে আবারও একটু স্মিত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ও চলে যাওয়ার পর জিয়া সুখময়বাবুর দিকে এগিয়ে এসে ওনার বুকে মাথা দিয়ে বললো,
-তুমি কষ্ট পেও না বাবা। আমি তো তোমাকে আগেই কথা দিয়েছি, আমি ঠিক দিদিয়াকে বোঝাবো। আবার বোঝাবো আমি.. আর আমার দিদিয়া যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে। তাই ও ঠিক বুঝতে পারবে তোমাদের কথা… একদম কষ্ট পাবেনা তোমরা!
জিয়ার মাথায় হাত রেখে সুখময়বাবু বললেন,
-জানি রে মা, আমি জানি আমার মেয়েটা ঠিক বুঝবে। আসলে বহু বছরের জমানো অভিমান গুলো সব ওর মনে অভিযোগে পরিণত হয়েছে। তবে সেই অভিযোগ গুলো যদি শিয়া আমাদের কাছে উপড়ে করে দিতে পারতো, তাহলে ওর কষ্ট গুলো অনেক গুণে কমে যেতো। কিন্তু কী আর করবো বল? এটা তো বাবা-মা হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা! আমরাই হয়তো ওকে সেই জায়গাটা করে দিতে পারিনি, যার জন্য ও আমাদের কাছে নিজের অভিযোগ গুলো উপড়ে দেবে! তবে আমার বিশ্বাস, এতো গুলো বছর কেটে গেলেও, ওর মনের দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান আর অভিযোগ গুলো কঠিন হয়ে জমাট বেঁধে গেলেও সেগুলো ঠিক নরম হবে। শিয়া আমাদের কষ্টটা বুঝতে পারবে!
জিয়া সুখময়বাবুর বুক থেকে মাথাটা তুলতে গিয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়ে যেতেই ওর মনে হলো দরজার সামনে থেকে কেউ সরে গেলো। আর সেটা যে শিয়া, তা বুঝতে ভুল হলো না জিয়ার। কারণ আজ এই বাড়িতে মাথায় জুঁই ফুলের মালা ঝুলিয়েছে একমাত্র শিয়া-ই। আর জিয়ার লক্ষ্য এড়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে দরজার সামনে থেকে সরতে গিয়ে দরজার খোঁচে লেগে কয়েকটা জুঁই ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়লো মেঝেতে। জিয়া নিজের মনেই হেসে ফেললো একটু। ওকে এভাবে নিজের মনে হাসতে দেখে সুখময়বাবু জিজ্ঞেস করলেন,
-কী হলো জিয়া? তুই হাসছিস কেন?
-ও কিছু না! আমি বাইরে গিয়ে দেখি সব আয়োজন কতো দূর এগোলো। তুমিও আমার সাথে এসো বাবা!
কিছুক্ষণ পরে কলিং বেলের শব্দ পেয়ে গায়েত্রীদেবী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। আয়ান, রিমলি আর বাসন্তীদেবীকে দেখে ওনাদের বাড়ির ভিতরে আহ্বান জানিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলেন উনি। তারপর বললেন,
-চলুন, আপনারা ভিতরের ঘরে চলুন দিদি। এসো বাবা! তুমিও এসো মা.. বাসন্তীদেবী, এই বুঝি আপনার মেয়ে রিমলি?
-হ্যাঁ আন্টি, আমিই আপনার মেয়ের রায় বাঘিনী ননদিনী হবো! হবু বৌদিকে ভালো করে দেখে বুঝে নিতে এলাম, তবেই তো ওদের বিয়ের পর ঠিকমতো ঝগড়াঝাটি করতে পারবো!
বলেই হাহা করে হেসে ফেললো রিমলি। ওর কথা শুনে গায়েত্রীদেবীও হেসে ফেললেন। এদিকে বাসন্তীদেবী রিমলির দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে বললেন,
-এসেই শুরু করেছিস? দাঁড়া একবার বাড়িটা ফের তুই, তারপর তোর মজা দেখাচ্ছি আমি! আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না দিদি। আসলে আমার মেয়েটা এরকমই। কোথায় কী বলতে হয় এখনও শেখেনি। নামেই বড়ো হয়েছে ও!
-না না আমি কিছু মনে করবো কেন? বাচ্চারা তো এরকম একটু হাসি-ঠাট্টা, মজা আড্ডা করবেই! তাতে এতো রাগ করলে চলবে? আপনারা ভিতরে আসুন তো দিদি…
আয়ানের আসার খবরটা পেয়ে শিয়া মনে মনে খুব খুশী হলো। এদিকে জিয়া নানান অজুহাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কারণ, ও এখন আয়ানের সামনে যেতে চায় না। যদি আয়ান জিয়াকে দেখে কোনোভাবে কষ্ট পায় বা শিয়ার সাথে আংটি বদল করতে রাজী না হয়, সেই কারণেই জিয়া নিজেকে ওখান থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছিলো। কিন্তু শিয়া ওর কোনো অজুহাতই শুনতে চায়নি। ও কিছুতেই জিয়াকে বাইরে বেরোতে দেয়নি। কারণ, আজ শিয়ার জীবনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর সেই দিনে ও কিছুতেই জিয়াকে কাছ ছাড়া করতে চায় না। এমনিতেই পাকা কথার দিন জিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো হুট করে। তখন ও জিয়াকে কাছে পায়নি। তাই আজ আর ওকে চোখের আড়াল করেনি শিয়া। এসে থেকে আয়ান একটাও কথা বলেনি। চুপচাপ সোফার এক কোণে বসে রয়েছে ও। রিমলি ওর হবু বৌদির সাথে একটু কথা বলার জন্য বাসন্তীদেবীর অনুমতি নিয়ে শিয়ার ঘরে গেলো। গায়েত্রীদেবী তখন বাসন্তীদেবীকে শিয়ার বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যদিও বাসন্তীদেবীকে উনি ফোনে সবটাই বলেছিলেন, কিন্তু ওনাদের সাথে সামনাসামনি পরিচয়টা আগে হয়ে ওঠেনি। তাই আজ সবাই মিলে গল্প করতে শুরু করেছেন। এদিকে রিমলি শিয়ার ঘরের দরজার সামনে এসে দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো,
-ভিতরে আসবো?
শিয়া তখন ঘরের শোকেশের কিছু কাজ করার জন্য পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আর জিয়া রিমলিকে দেখতে পেয়ে বললো,
-হ্যাঁ হ্যাঁ এসো না? এসে বসো এখানে..
-তুমি কেমন আছো বৌদি?
-এই আমি তোমার বৌদি নই! আমি তোমার বৌদির বোন.. ওই যে তোমার বৌদি ওখানে আজকের দিনেও কীসব কাজ করতেই ব্যস্ত!
-ওহ! সরি সরি! আসলে তোমাদের দুজনকে তো একদম একইরকম দেখতে, তাই আমি বুঝতে পারিনি তুমি আমার হবু বৌদি নয় বলে!
-হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি সেটা বুঝতে পেরেছি..
এই দিদিয়া তুই এদিকে আয়, তোকে আর কাজ করতে হবে না! আমি করে দিচ্ছি। তুই এদিকে এসে তোর হবু ননদের সাথে কথা বল…
জিয়া শিয়ার হাত থেকে বই গুলো কেড়ে নিয়ে গুছিয়ে রাখতে শুরু করলো। শিয়া এগিয়ে এসে রিমলির পাশে বসে একটু হাসলো। তারপর বললো,
-বলো.. কী নাম তোমার?
-আমার নাম রিমলি! তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে গো বৌদি..
রিমলির কথায় একটু হেসে ফেলে শিয়া বললো,
-থ্যাংকস! তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে। তোমাকে একটা কথা বলবো রিমলি? কিন্তু তুমি রাগ করবে না তো?
-এমা ছি ছি! রাগ করবো কেন? তুমি বলোনা কী কথা?
-আসলে তোমার দাদার সাথে আমার বিয়েটা তো এখনও হয়নি, তাই তার আগে পর্যন্ত যদি তুমি আমাকে বৌদি না বলে দিদি বা অন্য কিছু বলে ডাকো, তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে.. বিয়ের পরে তুমি আমাকে বৌদি বলে ডাকলে, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই!
-ওহ! এই কথা? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে তোমাকে আরুশি দি বলেই ডাকবো, কেমন?
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই.. তাই-ই বলবে। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।
-আচ্ছা! তোমার বোনের নাম কী গো আরুশি দি?
জিয়া ওদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আমার ভালো নাম আধিরা। তবে সবাই আমাকে জিয়া বলেই ডাকে। তুমিও আমাকে জিয়া দি বলেই ডাকতে পারো!
-আচ্ছা, তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে জিয়া দি!
-ওহ রিয়েলি? আসলে আমার এই শাড়ি-টাড়ি পরতে একদম ভালো লাগে না। তোমার হবু বৌদি আমাকে জোর করে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাজিয়ে দিয়েছে। আর আমি ওকে। তবে তোমাকেও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে রিমলি!
তখনই বাসন্তীদেবী রিমলিকে বাইরে থেকে হাঁক দিয়ে ডাকায়, ওনার ডাক শুনতে পেয়ে রিমলি বললো,
-হ্যাঁ মা আসছি! আরুশি দি? জিয়া দি? আমাকে মা ডাকছে, আমি যাচ্ছি কেমন!
ওরা ঘাড় নেড়ে যাওয়ার জন্য সম্মতি জানালো রিমলিকে। রিমলি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জিয়া বললো,
-তুই কী রে দিদি? বাচ্চা মেয়েটা নাহয় তোকে এখন থেকেই বৌদি বলে ডাকতে শুরু করেছিলো। তাতে হয়েছেটা কী শুনি? ওকে বৌদি বলতে বারণ করার কী ছিলো? আর কয়েক দিন পরে তো তুই ওর বৌদি হয়েই যাবি।
-আসলে জিয়া, এখনও তো আমরা একে অপরকে ঠিক মতো চিনলামই না। এর মধ্যেই আর প্রথম দেখাতেই ওর আমায় বৌদি ডাকাটা কেমন অড শুনতে লাগছিলো না? তাই দিদিই ডাকতে বললাম। বিয়ের পরে নাহয় আবার বৌদি বলেই ডাকবে।
-সত্যি দিদিয়া! তুইও না! এই তোকে মনে হয় বাইরে ডাকাডাকি করা হচ্ছে। আশীর্বাদ শুরু হবে মনে হয় এবার। যা দিদিয়া তুই বাইরে যা…
-তুইও চল জিয়া..
-আমি? আমি এখন গিয়ে কী করবো?! তুই যা আমি একটু পরে আসছি!
-সেটা তো হবে না জিয়া। তোকেও আমার সাথে যেতে হবে।
গায়েত্রীদেবী শিয়াকে ডাকতে এসে যখন শুনলেন জিয়া বাইরে আশীর্বাদের ওখানে যাবে না বলছে, তখন তা শুনে উনি বললেন,
-সেকী রে জিয়া? তুই তো কতোদিন আগে থেকে তোর দিদিয়ার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছিস। ওর আশীর্বাদ থেকে শুরু করে সমস্ত অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফি আর ভিডিওগ্রাফি করবি বলে। সেই জন্য তো অন্য কোনো ফটোগ্রাফারও ঠিক করা হয়নি। আর এখন তুই পরে যাবি বললে কী করে হবে শুনি? শুভ সময় কিন্তু পেরিয়ে যাবে বেশি দেরী করলে… তোরা আয় তাড়াতাড়ি!
-তুমি যাও মণি, আমি জিয়াকে নিয়ে এক্ষুণি আসছি!
আয়ান আর শিয়ার জন্য পাশাপাশি দুটো আসন পেতে রাখা হয়েছে। তার সামনে একটা থালায় আশীর্বাদের জন্য কিছু ধান আর দূর্বা রাখা হয়েছে। একটা বড়ো প্রদীপ স্ট্যান্ডে প্রদীপ জ্বলছে। শিয়া জিয়ার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর শিয়া আর আয়ানকে পাশাপাশি বসানো হলো। আয়ান একভাবে মাটির দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। একবারের জন্যেও জিয়ার দিকে বা অন্য কারোর দিকেই মুখ তুলে তাকায়নি। প্রথমে বাসন্তীদেবী শিয়াকে ধান আর দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তারপর ওর হাতে দুটো সোনার বালা পরিয়ে দিলেন। বাসন্তীদেবীর কথায় এই বালা জোড়া নাকি ওনাদের পরিবারের পরম্পরায় পুত্র বধূদেরই প্রাপ্য। উনি এগুলো ওনার শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। আর এখন সেটা উনি শিয়াকে আশীর্বাদ স্বরূপ দিলেন। গায়েত্রীদেবী অনসূয়াদেবীকেই প্রথমে আশীর্বাদ করার কথা বললেও, অনসূয়াদেবী গায়েত্রীদেবীকেই আগে আয়ানকে আশীর্বাদ করা শুরু করতে বললেন। কারণ গায়েত্রীদেবী শিয়ার নিজের মা না হলেও, এতো গুলো বছর ধরে ওকে নিজের মেয়ের মতো করেই মানুষ করেছেন উনি। তাই হবু জামাইকে প্রথম আশীর্বাদ করা ওনারই অধিকারের মধ্যে পড়ে। গায়েত্রীদেবী একটা সোনার ব্রেসলেট দিয়ে আশীর্বাদ করলেন আয়ানকে। তারপর এক এক করে অনসূয়াদেবী, সুখময়বাবু আর অমলেন্দুবাবু আশীর্বাদ পর্ব সাড়লেন। জিয়া প্রতিটা শুভ মুহূর্তকে নিজের হাতের ক্যামেরার মধ্যে বন্দী করছিলো। আজ কেন জানে না, জিয়ার মনের ভিতরটা খুব কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যখন বাসন্তীদেবী শিয়ার হাতে ওনাদের পারিবারিক আশীর্বাদী বালাটা পরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন যেন জিয়ার বুকের ভিতরটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে উঠছিলো। মনের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো ওর। কিন্তু সেই অস্বস্তির কারণটা ও কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না। জিয়া মনে মনে এটা ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো যে, হয়তো আর কিছু দিন পরেই ওর দিদিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। আর সেটা আজ থেকেই পাকাপাকিভাবে শুরু হতে চলেছে বলে হয়তো ওর মনটা দিদিয়ার জন্য কষ্টে হুহু করছে। ওই কষ্টটাকে আর ও নিজে কোনোভাবেই পাত্তা দিলো না। কারণ কষ্টকে যতো প্রশ্রয় দেওয়া হবে, ততোই মনের মধ্যে চেপে বসবে!
আশীর্বাদের পর্ব মিটে যাওয়ার পরই শিয়া আর আয়ানের আংটি বদলের পালা। টেবিলের মধ্যে একটা থালায় ফুলের মধ্যে দুটো আংটি রাখা আছে। সারা বাড়ির সাথে সাথে এই টেবিলটাও সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঠিক যেই মুহূর্তে আয়ান আংটিটা শিয়ার হাতে পরিয়ে দিতে যাবে তখনই ও একবার ঘুরে জিয়ার দিকে তাকালো। জিয়ার চোখ দুটো তখন ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে আবদ্ধ। আয়ান হঠাৎ করে শিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে জিয়ার দিকে তাকানো মাত্রই, ক্যামেরার লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো জিয়া। আয়ান এভাবে সবার সামনে ওর দিকে তাকানোয় সবকিছু জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠলো ওর। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য জিয়া ইচ্ছে করেই চিৎকার করে উঠে বললো,
-কী হলো জিজু? আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন আপনি? তুলছি তুলছি! আমি খুব ভালো করেই আপনাদের ছবি তুলছি। একদম চিন্তা করবেন না আপনি! আপনাদের সব ছবি গুলোই ভীষণ সুন্দর হচ্ছে। তবে যাই বলেন, আপনার থেকে কিন্তু আমার দিদিয়াকেই বেশি ভালো লাগছে!
জিয়ার কথা শুনে ওখানে উপস্থিত সবাই সশব্দে হেসে ফেললো। সবার নজর এড়িয়ে শিয়া আয়ানের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-ওর কথায় আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না আয়ান। আসলে আমার বোনটা এমনই। কখন যে কী বলে, তার ঠিক নেই। আপনি ওর কথা ধরবেন না! আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে… আমি পরে ছবি গুলো জিয়ার থেকে নিয়ে আপনাকে পাঠিয়ে দেবো!
সবার হাসি থামতে রিমলি বললো,
-এই দাদা! তাড়াতাড়ি আরুশি দি-কে আংটিটা পরিয়ে দে না.. কখন থেকে ভিডিও করার জন্য ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! হাতে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে তো নাকি! ও আরুশি দি? তুমি তোমাকে হাতটা বাড়াও দাদার দিকে..
রিমলির কথা শুনে শিয়া ওর বাম হাতটা এগিয়ে দিলো আয়ানের দিকে। আয়ানের মনে হচ্ছে ওর হাতটা যেন কেউ পিছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে। নিজের হাতের প্রতি যেন ওর কোনো নিয়ন্ত্রণই কাজ করছে না। হাতটা শিয়ার হাতের দিকে একটু এগোতে গেলেও যেন ওকে শরীরের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে তবেই এগোতে হচ্ছে। আয়ান বহু কষ্টে নিজের আবেগকে সামলে হাতটা শিয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কোনোরকমে শিয়ার অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিলো। আংটিটা পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই সবাই সশব্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। রিমলি আবার বললো,
-আরুশি দি? এবার তুমিও আমার দাদাকে আংটিটা পরিয়ে দাও! ভিডিও অন আছে… এই দাদা তোর হাতটা এগিয়ে দে আরুশি দি-র দিকে! নাহলে আরুশি দি তোকে আংটিটা পরাবে কী করে?
রিমলির কথা শুনে আয়ান অতি কষ্টে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েও হাতটা এগিয়ে দিলো শিয়ার দিকে। শিয়া লাজুক মুখে একরাশ হাসি নিয়ে ওর পছন্দের আংটিটা পরিয়ে দিলো আয়ানের ডান হাতের অনামিকাতে।
-এই দাদা? ও আরুশি দি? এবার তোমাদের দুজনের আংটি পরা হাতটা একসাথে সামনে নিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে ধরো। ও জিয়া দি? তুমি এভাবে কয়েকটা ছবি ক্লিক করো না গো? এই পোজে পিক গুলো দারুণ উঠবে! জিয়া দি…
এতোক্ষণ যেন জিয়া কোনো একটা ঘোরের মধ্যে বিরাজ করছিলো। রোবোটের মতো ক্লিক করে চলছিলো প্রতিটা ছবি। ওর ঘোর কাটলো রিমলির চেঁচানোতে,
-হ্যাঁ? হ্যাঁ.. এই তো তুলছি! দারুণ লাগছে.. সব ছবি তোলা কমপ্লিট!
ক্রমশ…