#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৬
#শারমিন আঁচল নিপা
আমার কলিজা কাঁপতে লাগল পুনরায়। আমি স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথাটা এমনভাবে ঘুরছে যে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। কাগজগুলো টেবিলের উপর যথাস্থানে রেখে নীলের বিছানাতেই হেলে পড়লাম। নীল ছাদ থেকে রুমে আসলো ঠিক তখন৷ আমাকে এভাবে দেখে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল
“কখন আসলেন? নিরা ঠিক আছে তো?”
নীলের কথাটা শুনে আমি কিছুটা উপহাসের সুরে জবাব দিলাম
“নিরার জন্য আপনার এত চিন্তা কেন? আমি কী এমনিতে আসতে পারি না? আপনার কাছে আসতে কী আমার কারণ লাগবে?”
নীল কিছুটা ইতস্তত কণ্ঠে জবাব দিল
“তা বলিনি। নিরা অসুস্থ তো ভাবলাম ওর কিছু হয়েছ কিনা। এত সকাল সকাল আসলেন তো তাই। নাস্তা করেছেন?”
“সময় পাইনি। আপনি নাস্তা করেছেন?”
“এখন করব। আচ্ছা চলুন একসাথে নাস্তা করি।”
“আমার এখন নাস্তা করার মতো মুড নেই।”
নীল এবার আমার পাশে এসে বসে বলল
“মন খারাপ? দেখেন নিরা এমন পাগলামি হয়তো মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে করেছে। সময় মতো ট্রিটমেন্ট আর সবার ভালোবাসায় ঠিক হয়ে যাবে। আপনি নিরাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করছেন। শুধু শুধু নিরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে হবে? আমাকে নিয়েও একটু ভাবেন। আমি তো আপনাকে নিয়ে এত স্বপ্ন বুনে রেখেছি সেগুলো নিয়েও একটু কল্পনা করুন। কিছুদিন পর আমাদের প্রণয় সেটা নিয়েও ভাবুন। মন হালকা লাগবে। আর নিরার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন আমি বুঝে নিব।”
নীলের মুখে আবারও নিরার কথা শুনে আমার রাগ চড়ে গেল। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। বুকের ভেতর ধেয়ে আসা ঝড়টাকে এবার বাইরে বের করলাম। আচমকা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম
“আপনি বারবার নিরা নিরা কেন করছেন? নিরার দায়িত্ব তো আপনাকে দেওয়া হয়নি। আর আমাদের বিয়ে হচ্ছে না। আপনার মতো দুশ্চরিত্র মানুষ কখনও আমার স্বামী হতে পারে না।”
নীল আমার আচমকা প্রতিক্রিয়ায় আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি উনার হাবভাব দেখে আরও কিছুটা রেগে বললাম
“এমন একটা ভাব ধরছেন যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না। আপনার মতো মানুষ আমি দুনিয়ায় আর দুটো দেখিনি। নিজেকে তো একদম সাধু পুরুষ বানিয়ে রেখেছেন। ভেবেছেন কখনও আমি সত্যটা জানতে পারব না। আপনার কী ধারণা আপনি যা’তা করে যাবেন আমি জানতে পারব না কিছু? ”
আমার কথা শুনে নীল কিছুটা বিস্ময় কন্ঠে বলে উঠল
“আপনি মাথা ঠান্ডা করে কথা বলুন। এভাবে চিল্লাবেন না। চিল্লাচিল্লি জিনিসটা ভালো না। আপনি আমাকে সরাসরি বলুন কী হয়েছে। আমি কী এমন করেছি আপনি আমাকে এতগুলো কথা শুনাচ্ছেন? আমাকে আগে জানতে দিন আমার অপরাধটা কোথায়।”
“ওহ আচ্ছা এখন তো আপনি কিছুই জানেন না। নিরার সাথে নোংরামি করার সময় লজ্জা করেনি। আমার বোনটাকে নিয়ে খেলছেন। আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি দুনিয়ায় একটাও দেখেনি। আমার বোনের সাথে নষ্টামি করে আমাকে বিয়ের কথা বলছেন?”
আমার কথা শুনে নীল এবার ভীত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ রইল। আমি পুনরায় বলে উঠলাম
“কী ব্যাপার চুপ কেন? ধরা পরে এখন চুপ কেন? নোংরা কোথাকার।”
নীল আমার কথায় এবার রেগে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল
“আপনি কী থামবেন?”
নীল আর আমার চেঁচানোতে নীলের বাবা আর মা চলে আসলো রুমে। নীলের মা আমাদের দিকে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমার ভেতরে থাকা কষ্টের লাভা যেন সাপের মতো ফুসফুস করে বের হচ্ছে। তিনি আমার অবস্থা দেখো জিজ্ঞেস করলেন
“আঁচল কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কেন?”
আমি সজোরে বলে উঠলাম
“আপনার ছেলে আমার বোনের সাথে নোংরামি করেছে। নিরার পেটে বাচ্চাও এসেছিল সেটাও নষ্ট করেছে। আপনার ছেলে আমারেই ছোট বোনের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে সেটা চাপা দিতে চেয়েছিল। আর আপনার ছেলের জন্যই নিরা গলায় দঁড়ি দিয়েছিল। ”
আমার কথা শুনে নীল পাশ থেকে বলে উঠল
“মা এমন কিছুই না। আর আপনি যা বলছেন না জেনে না বুঝে বলছেন। কেন আপনি সবার সামনে আমাকে শুধু শুধু অপমান করছেন। নির্দোষ একটা মানুষকে দোষ দেওয়া উচিত না।”
আমি এবার আরও রেগে গেলাম। টেবিলের উপর থেকে কাগজগুলো নিয়ে নীলের মুখের দিকে ছুড়ে মেরে বললাম
“আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে এগুলো কী? এখানে সব প্রমাণ আছে। আমার কথায় কোনো মিথ্যা নেই। আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন সাথে আমার বোনকেও।”
নীলের বাবা আর মা কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। নীলের মা নীলকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন
“এক সময় গর্ব হত তোকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে আজকে নিজের চোখে সবটা দেখার পর ঘৃণা হচ্ছে।”
নীলের বাবাও বলে উঠল
“আমি আমার বন্ধুর কাছে কী জবাব দিব। আমার মাথাটা এভাবে নত না করলেই তো হত। এ দিন দেখার আগে মরে গেলেও ভালো হত।”
উনারা অনেকটা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। নীল চুপ হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ নীলের চোখে মুখে কোনোরকম অনুতাপের ভাজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে ছক কষছে মনে মনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল
“আমাকে তো তোমরা আর বিশ্বাস করবে না বাবা, মা। তোমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আমি একটা বাজে ছেলে। ঠিক আছে তোমরা আমাকে এত বড়ো করেও যখন চিনতে পারলে না তখন আমি স্বীকার করে নিচ্ছি নিরার সাথে আমিই নোংরামি করেছি। নিরার বাবা, আমার বাবার বন্ধু। আমি চাই না আমার বাবার মাথা নত হোক। যেহেতু ঝামেলা হয়েছে আর এত কাহিনির তৈরী হয়েছে সেহেতু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আঁচলকে না নিরাকে বিয়ে করব। এতে বাবার মান সম্মানও ঠিক থাকবে আর নিরাকেও ঠকানো হবে না। সেও তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবে। আর নিরার বাবা যেহেতু তার প্রথম মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে সুতরাং এখন প্রথম মেয়ের পরিবর্তনে দ্বিতীয় মেয়েকে বিয়ে দিতে অমত করবে না। আশাকরি সমস্যার সমাধান হয়েছে। নিরার যদি মত থাকে আমি নিরাকে বিয়ে করব। এতে কারও আপত্তি থাকার কথা না।”
নীল গড়গড় করে কথাগুলো যতটা সহজে বলেছে ঠিক তার চেয়ে বেশি দু্র্লভভাবে কথাগুলো আমার বুকে এসে বিঁধল। আমি দম আটকে দাঁড়িয়ে আছি। নীলের বাবা, মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্ঠা করছি তারা কী চাচ্ছেন। পিনপনা নীরবতা চারদিকে। নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে নীলের বাবা বলে উঠলেন
“আঁচলের বাবার সাথে কথা বলে নীল যা বলেছে তাই করতে হবে। এছাড়া তো উপায় নেই।”
কথাটা উনি বলে বের হয়ে গেলেন। নীলও রুম থেকে বের হয়ে গেল। নীলের মা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে ধরে বললেন
“নীলকে ক্ষমা করে দিস।”
নীলের মা ও রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি এক রাশ স্তব্ধতা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। অবাধে পড়তে দিচ্ছি এ পানি। নিজেকে সামলানোর কোনো চেষ্টা করলাম না। নিজেকে স্বান্তনা দিলাম এ ভেবে নিরার তো কোনো গতি হলো। ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছি। কিছুক্ষণ পর দুই পরিবার একসাথে বসেছে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য। বাবাও আর অমত করেনি। নিরার অবস্থা বিবেচনা করে বাবাও মত দিয়ে দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালাম। নিজের প্রিয় মানুষটা অন্য কারও হওয়ার জন্য প্রহর গুণতে লাগলাম। যে শুক্রবারে আমার আর নীলের একসাথে হওয়ার কথা ছিল সে শুক্রবারেই নীল আর নিরা একসাথে হবে।
চলবে?