বালুকাবেলা-০৪ এবং ০৫ শেষ

0
1813

#বালুকাবেলা-০৪ এবং ০৫ শেষ
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
০৪

ভাবির শত ছলচাতুরী ডিঙিয়ে আমি বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিবো,সেটা আমার ভাবি কল্পনাও করেনি!
ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে অল্প সময় তাকিয়েই দ্রুত আমার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কি বললে তুমি আবার বলোতো?

আমি এবার আর আমার মাথা নিচু করলাম না, উনার চোখে চোখ রেখেই বললাম,
‘ বিয়ে করবো বলেছি, আমি উনাকে বিয়ে করতে চাই। পাত্র হিসেবে উনাকে তো আপনিই দেখিয়েছেন ভাবি, এখন আমার রাজী হওয়াটা কি দোষের?

আমার ভাবি জিহ্বা দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করছে এবং কিছু বলার জন্য আমতা আমতা করছে। প্রথমবার আমার কাছ থেকে এমন আচরণকে উনি গ্রহণই করতে পারছেনা৷ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলোনা, তামজিদের দিকে এগিয়ে গিয়েও কিছু বলতে পারলোনা, এরপর অন্যদিকে তাকিয়ে সোফায় নিজের হাতে নিজেই আঘাত করে বলে উঠলো,
‘ এতো সাহস এই মেয়ের! আমার মুখের উপরে কীভাবে বলে দিলো, তার রাজী হওয়া দোষের কিছু না! আগেই আঁচ করেছিলাম, দুধ কলা খাইয়ে কালসাপ পুষছি নাতো! হলো তো সত্যি। আমার দেখানো ছেলে তাকে একদিন দাম দেওয়ার পরেই সে আর মাটিতে পা ফেলছেনা, আর বাকিদিনে সে কি করবে?

এবার তামজিদ আমাকে ভাবির দিকে এগিয়ে আসলো। চেহেরায় কিছুক্ষণ রাগ থাকলেও ভাবির সামনে গিয়ে সেটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় বললো,
‘ আচ্ছা কি সমস্যা তোমার, আমাকে বলোতো? তুমিই তো চেয়েছিলে তাকে আমার হাতে তুলে তুমি দায়মুক্ত হবে!

আমার ভাবি রাগী চোখ করে ফিরে বললো,
‘ চেয়েছিলাম বলে কি আর সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ নেই? নিজেরা নিজেরাই সব করে ফেলবে? আমি আমার ননদকে তোমার হাতে তুলে দিবোনা, ব্যস। ওর প্রতি আমার যথেষ্ট অধিকার আছে।

তামজিদ কেমন করে হেসে যেন জবাব দিলো,
‘ যদি তোমার বোনঝি’কে বিয়ে করি?

আমার ভাবি ঢোক নিলো। তারপর ধীরে বললো,
‘ সেটা আলাদা বিষয়। আমিও চাই তুমি জাত কূল দেখেই বিয়ে করো। তোমার মতো এমন একটা ছেলে কেন তূর্ণাকে বিয়ে করতে যাবে? তোমার বাবার কাছেও তো তোমার একটা ইজ্জত আছে তাইনা?

তামজিদ ভ্রু বেঁকে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো, বুঝলাম সে আমাকে সবকিছু স্বাভাবিক নিতে ইশারা করছে। তারপর সে ভাবিকে বললো,
‘ না আছে, আমার বাবার কাছে আমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপাতত কিছু নেই। আর আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা তারা কীভাবে নিবে বুঝতেই পারছো! তোমার ভাগ্নিকে বিয়ে করতেই পারি, তবে এরপর তোমার খোঁজ খবর কিংবা তোমার সাথে কথা বলাটাও আমার হবেনা, কেননা তোমার ভাগ্নি তোমার পরশে কখনো ছিলই না। অন্যদিকে তূর্ণাকে এই পর্যন্ত নিতে তোমার অল্প হলেও অবদান আছে, যার পুরষ্কার হিসেবে আমি তোমাকে আমার সিটি কর্ণারের ইলেকট্রনিকসের দোকানটা লিখে দিয়ে দিবো৷ বোনাস আর অনেককিছুই থাকবে যা তোমার জামাই আগামী ১০ বছরেও চাইলে করতে পারবেনা। যতটুকু জানি তোমার বড়লোক বাবাও আর তোমাকে কিছু দিবেনা। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলে যা দিয়েছে সেটাই অনেক বেশি ছিলো। তোমার ফ্ল্যাটটাই কেবল আছে থাকার মতো। তুমি না চাইলে আমি তূর্ণাকে বিয়ে করবোনা। তবে ভেবে দেখো, ওকে বিয়ে করলে তোমার ক্ষতি নয় বরং শুধু লাভই হবে!

আমার ভাবি আড়চোখে তামজিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমাকে কি কোনো অফিসের ঘুষখোর অফিসার মনে হচ্ছে?

তামজিদ হাসতে হাসতে বললো,
‘ তা না, তবে তোমার একটা সিদ্ধান্তে বাকি জীবনের অনেক ইচ্ছে পূরণের সুযোগ থাকছে।

আমার ভাবি এবার নিরব!

আমি জানিনা তামজিদ আসলে কতটা সম্পদশালী, আর তার প্রতিপত্তির উৎস কি, তবে এটুকু পরিষ্কার আমি যদি কারো কাছে সর্বোচ্চ ভালো থাকি সেটা বোধহয় তামজিদের কাছেই হবে! আর তামজিদ যেকোনো মূল্যে আমাকে অর্জন করে নিবেই।

নিশ্চিন্ত আমি আমার বোন অর্ণার মাথায় হাত রেখে বললাম,
‘ কিরে তোর চুলের এই অবস্থা কেন? কেমন রুক্ষ আর খসখসে, আয় তোর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছি।

এদিকে তামজিদ পা বাসা থেকে বের হয়ে ভাবিকে উদ্দেশ্য করে জোরে বললো,
‘ এখনি এতো ভেবোনা, ভাবার জন্য অনেক সময় আছে। দরজাটা লাগিয়ে ঘুমাও, আর দুঃখিত সকাল সকাল এতো ডিস্টার্ব করার জন্য!

ভাবি দরজা লাগাতে গেলো আর আমি অর্ণাকে নিয়ে আমার রুমে এলাম। ওর চুলে তেল লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলাম,
‘ তোকে উনি কখন আনতে গিয়েছিলো?

‘ ৬ টার দিকে।

‘ খালা কিছু বলেনি?

‘ খালাকে ভাইয়া বলেছে, তূর্ণাকে আমি বিয়ে করতে চলেছি, অর্ণার দায়িত্বও আমার, তাকে আমার কাছে দিয়ে দিন। খালা বলছিলো আমাকে যেতে দিবেনা কারণ আমি বর্তমানে উনার সকল কাজের সহযোগী। তারপর ভাইয়া আমার শূন্যতায় বাসায় কাউকে টাকায় রাখতে বলেছে, যার এক বছরের খরচ ভাইয়া দিয়ে তখনি আসছে এবং পরে বাকি সব দিবে বলছে।

আমি কিছুক্ষণের জন্য নিজের চোখ বন্ধ করলাম। কথা দিয়ে একটা মানুষ কতো সুন্দর কথা রাখতে জানে!

অর্ণাকে গুছিয়ে দিয়ে আমি গেলাম সকালের খাবারের আয়োজন করতে৷ ভাইয়া ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে অফিসে চলে গেলো।

অর্ণা না থাকলে আজকের সারাদিনটা আমার গম্ভীর হয়ে কাটতো বোধহয়, তামজিদকে নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তায় নয়, বরং ভাবির কাজকর্মের জন্য! ভাবির লোভে জর্জরিত চোখ অদ্ভুত লাগছে আমার, না জানি সেটার সীমান্ত কোথায় ঠেকে!

আজকে ভাইকে দেখলাম সন্ধ্যা সন্ধ্যায়ই বাসায় ফিরে এসেছে। আসার কিছুক্ষণ পরে চা নাস্তা দিতে গিয়ে যা বুঝলাম তারা কোনো কারণে খুব বিভ্রান্তিতে আছে। ভাবি একপাশে গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আর একপাশে ভাই একটা বই নিয়ে নিজের মতো আছে৷

রাতের সব কাজ শেষ করে খেয়েদেয়ে শুয়ে অর্ণার সাথে গল্প করছিলাম। করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো, দুবোনের অনেক জমানো কথা একে অপরকে বলছি। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত আড়াইটা বাজে। যতটা জানি ভাই ভাবি অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে। আর আমার ভাবি কিংবা ভাই কখনো রাতে কোনো কাজে আমার রুমে আসেনা৷ ভয় পাইনি, তবে এতো রাতে এখানে দরকার পড়াটা বিষ্ময়কর লাগছে, ভাবি কেন আসলো এখন?

ভাবতে ভাবতে আমি দরজা খুলে দেখি ভাবি নয় ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি আশেপাশেও ভাবি নেই, ভাই যে ভাবিকে রেখে লুকিয়ে এখানে এসেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। জরুরী কথা হবে অবশ্যই, তাই আমিও খানিকটা অবাক স্বরেই বললাম,
‘ কিছু বলবেন ভাই?

উনি পরিশ্রান্ত চেহারায় বিছানায় বসলেন, নিজের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘ তূর্ণা দেখ আমি জীবনে তোদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি, কিন্তু জীবনে প্রথমবার আমার মনে হচ্ছে এটা হতে দেওয়া যাবেনা।

আমি আরো অবাক হয়ে বললাম,
‘ কোনটা?

‘ এই যে তামজিদ নামক ছেলেটার সাথে তোর বিয়ে!

‘ কেন কোনো সমস্যা?

‘ সমস্যা না তো কি? যা জেনেছি ওই ছেলে ভালো নয়, তারপর টাকার গরমে তোকে যেন কিনেই ফেলতে চাচ্ছে৷ দেখ জীবনটা টাকা দিয়ে পার হবেনা। আমি সেটা না বুঝে করলেও, বোঝার পরে আমার বোনের সাথে কি করে হতে দেই?

আমি বিশালকার একটা ঢোক নিলাম।

চলবে….

#বালুকাবেলা (০৫)

ভাইয়া বিষন্ন মুখে বসে আছে। আমি অনেক্ষণ ধরে বলার জন্য শব্দ খুঁজছি। কিন্তু বলতে পারছিনা। তারপর হঠাৎ আমি বলে উঠলাম।

‘ বাবা মৃত্যুর আগে একটা কথা বলেছিলো আপনার মনে আছে?

ভাইয়া আমার দিকে ফিরে বললো,

‘ কি কথা বলেছিলো?

আমি এবার আমার ব্যাগ থেকে তামজিদের চিঠিটা বের করে ভাইয়ার পাশে বসে বললাম,
‘ এটা পড়ুন।

ভাই কাগজের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের দিকে ইশারা করে বললেন,
‘ চশমা আনিনি।

আমি মাথা নেড়ে বললাম ওকে আমি শোনাচ্ছি।

তূর্ণা,

তুমি আমাকে আলাদাভাবে চিনোনা, তা আমি জানি। তবে হয়তো বিশদ বর্ণনার পরে চিনতে পারবে!
আমার জীবনে অভাব নামক কোনো শব্দ আমাকে ছুঁতে পারেনি। যা ছুঁয়েছিলো তা বিষাদ। ৬ বছর বয়সে আমার মায়ের মৃত্যু আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো। এদিকে আমার বাবা নিজের ব্যবসা,বাণিজ্য, আর কাজের মধ্যে আমাকে সময় নামক জিনিসটা কখনোই ভালোভাবে দিতে পারেনি। বেপরোয়া হতে থাকলাম তখন থেকেই। প্রচন্ড জেদ আর একগুঁয়েমিতে বড় হয়েছি, যখন যা ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। যাই হোক একটুকু বুঝতাম আমার বাবা আমার জন্যই এসব করছেন, এমনকি দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথাও ভাবেননি। কিন্তু আমি বাবাকে বুঝতাম না, হুট করে বুঝলাম একদিন, যখন আমার বাবা এক্সিডেন্ট করে মৃত্যু অভিমুখী। ৫ বছর আগের ঘটনা এটা,
আমি ইমারজেন্সি বি নেগেটিভ রক্তের জন্য হাসপাতালের এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা ছুটছিলাম, কোথাও রক্ত পাচ্ছিলাম না৷ সময় ছিলো হাতে গোনা কিছুক্ষণ। জীবনে প্রথমবার মনে হয়েছিলো আমাদের সব সম্পত্তির বিনিময়ে কেউ যদি এখনি একব্যাগ রক্ত দিতো! পরে নাহয় খুঁজে বাকিটা ম্যনেজ করতে পারতাম, কিন্তু এখন তো ডক্টর রক্ত ছাড়া রোগীকে ছুঁবেইনা! তাদের স্টকেও মাত্র একব্যাগ ছিলো।কিন্তু অপারেশন করতে দুইব্যাগ লাগবে। ছুটাছুটির এক পর্যায়ে আমার ধাক্কা লাগে এক ভদ্র লোকের সাথে, উনার হাতের সবগুলো ঔষধ নিচে পড়ে যাওয়ার পরেও তিনি না রেগে আমাকে মার্জিত গলায় প্রশ্ন করলেন, বাবা তুমি এতো পেরেশান কেন?
আমি যখন বললাম আমার এই মূহুর্তে বি নেগেটিভ রক্ত লাগবে, লোকটা আর কোনো প্রশ্ন না করে বলে চলো আমার সাথে, আমি দিবো, আমার বি নেগেটিভ।
সেই রোগা লোকটা আমার বাবার জন্য দিয়ে দিলো একব্যাগ রক্ত। হ্যাঁ সেই যাত্রায় আমি আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি। তবে সেই মানুষটার ঋণ শোধ করতে এখনো লেগে আছি। সেই হাসপাতাল থেকে তার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন থেকে শুরু করে তাদের পরবর্তী জীবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিতে চেয়েছিলাম, তিনি চিকিৎসার খরচ গ্রহণ করলেও আর কিছু নিতে নারাজ ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন উনারা যদি দুনিয়ায় না থাকেন, তবে যেন তার ছোট দুইটা মেয়ের কেমন আছে একটু খেয়াল করি! উনাদের ছেলে বড় বাড়িতে বিয়ে করে বউয়ের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, বেশিনা শুধু মেয়েগুলোর বিয়ের সময় একটু সদয় হই যেন!

তুমি জানো, সেই লোকটা আর কেউ নয়, তোমার বাবা ছিল। তোমার মার মৃত্যুর এক বছর পর উনি গত হয়েছেন, সেটারও দু বছর হয়ে গেছে। আমি জানতাম তোমার ভাই কাকে বিয়ে করেছিলো, কাকতালীয়ভাবে সে আমার পরিচিত। সেই সূত্রে আমি ধরে নিয়েছিলাম তোমাদের খোঁজ নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব নয়। এর মধ্যে আমি বদভ্যাস, বদ স্বভাব ছেড়ে কাজের মধ্যে ডুবে এতটাই অন্য রকম হলাম যে সবকিছু ভুলেই গিয়েছিলাম। কয়েকমাস আগে আমার কেন জানি মনে হলো তোমরা কতো বড় হয়েছো আমার দেখা উচিত, আমি ভেবেছিলাম তোমার ভাই তোমাদের ঠিকঠাক খেয়াল রাখছে। তার উপর আবার খোঁজ নিয়ে জানলাম তুমি ঢাকায় পড়ছো! কিন্তু আমার মাথা থেকে দায়িত্বের ভারটা আমি নামাতে পারছিলাম না৷ তাই একদিন সন্ধান করে তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম, দেখলাম এতটাও বড় হওনি, যতটা বড় হলে তোমার বাবার দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে পারবো!
এদিকে বাবা আমাকে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে, বুঝতে পারছিনা আসলে কি করবো? তোমার ভাবির সাথে যখন কথা হয়েছিল শুনতে পেলাম উনি তোমাদের উপর ভীষণ বিরক্ত। তার জন্য তোমার বোন অর্ণাকে খালার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তখনি আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আলাদা করে কি কারো দায়িত্ব নেওয়া যায় বলো? আমি বলছিনা আমি খুব ভালো ছেলে৷ তবে তোমার বাবা সেদিন আমাকে যেভাবে মার্জিত গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাবা তোমাকে এতো পেরেশান লাগছে কেন? আমি ধরে নিয়েছিলাম উনি আমার একটা অংশ। এবং আমিও চেষ্টা করবো তোমাকে সারাজীবন সেই মায়া জড়ানো স্বরে প্রশ্ন করতে! প্রতিটা খারাপ সময়ে, ভালো সময়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে। তবে তূর্ণা বিয়ে ব্যপারটা সম্পূর্ণ তোমার উপর, তুমি চাইলে আমি বিয়ে করেই দায়িত্ব নিবো, নয়তো দূর থেকেই। আমি তোমার মুখে সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায়….

‘ তামজিদ ‘

আমি পড়েই থামলাম। আর আমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি উনার চোখ ছলছল করছে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসলাম। ভাই আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ আমি তামজিদকে বুঝতে পারিনি তূর্ণা! এটা আমার বাবা সারাজীবনের সৎ কাজ আর তোদের প্রতি উনার অশেষ দোয়ার কার্যকারিতা হয়তো! তুই ভাগ্যবতী বোন। আর আমি? না সেদিন মায়ের পাশে থাকতে পেরেছিলাম, আর না বাবা মার দোয়া পেয়েছি! আমার তো এমনই থাকা উচিত, সকাল বিকাল ঝাড়ুপেটা হবো। আমি তারই যোগ্য। আমিও শুনেছিলাম বাবা বলছিলো, একজন আছে যে কিনা আমি না থাকলেও তোদের ছায়া হবে। বিশ্বাস করিনি, আজ করলাম। হ্যাঁ তুই ভালো থাকবি বোন, আমি চাইবোও তোরা ভালো থাক। অন্তত আমার মতো এমন হাত পা বাঁধা মানুষটার থেকে দূরে গিয়ে ভালো থাক। আমি দূর থেকেই এতে স্বস্তি পাবো।

বলেই ভাই উঠে গেলো! আমি অর্ণার দিকে তাকিয়ে আছি, আর অর্ণা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনেই বেশ খানিক্ষন নিরব।
সারারাত দুই বোন বসেই কাটিয়ে দিলাম। তারপর একদম ফজর নামাজ পড়ে ঘুমালাম।

পরেরদিন আমার ঘুম ভাঙলো ভাবির ডাকাডাকিতে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজতে চলেছে। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম। ভাবি হাসিমুখে ট্রেতে দুই কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে হুহু করে হেসে বললো,
‘ নাও নাও চা খাও, আর হলুদের জন্য প্রস্তুতি নাও।

আমি রিপিট করলাম,
‘ হলুদের জন্য প্রস্তুতি!

ভাবি হাসতে হাসতে বললো,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ঘুমিয়েই থাকবা এখন, এদিকে আমরা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি।

আমি ভাবির কথা ঠিক বুঝিনি, কিন্তু কিছু সময় যেতেই বাড়ি সাজাতে কোথা থেকে যেন লোকজন গমগম করছে, ফুলের গন্ধে চারপাশ কেমন মুখরিত। ভাবির আত্মীয় স্বজনদেরও দেখা যাচ্ছে।
তাদের ভীড়ে আমি ভাবিকেও খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি বুঝতে পারছি না আসলেই কি আজকে আমার হলুদ?

আশেপাশে দেখতেছি আর ভাবতেছি কীভাবে কি হয়ে গেলো? আমার ভাবি কি তবে নিজের ভাবনাকে এখানেই স্থিরতা টানিয়ে দিয়েছেন? তামজিদকেই আমার জন্য বেছে নিয়েছেন,নিজের স্বার্থে? আমার ভাবনার মধ্যে অর্ণা দৌঁড়ে এসে আমার ফোনটা আমার কানে ঠেকিয়ে বললো,
‘ আপু কথা বলো।

আমি নাম্বার দেখার আগেই ওপাশের আওয়াজ শুনলাম একজন বলছে,
‘ তোমার পছন্দের রং কি তূর্ণা?

আমি চুপ করে থেকে জবাব দিলাম,
‘ আপনার পছন্দের সাথে আমার পছন্দকে মিলিয়ে একাকার করবোনা, নিঃসন্দেহে সেদিনের পরে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি আপনার পছন্দ আমার জন্য সর্বোত্তম। আর আমার এটাও মনে হয় আপনার মতো করে সাজলেই আমাকে বেশি সুন্দর দেখাবে।

ওপাশ থেকে একটা অট্টহাসি ভেসে এলো। হাসতে হাসতে উত্তর এলো,
‘ হ্যাঁ আমিও আমার বউকে আমার পছন্দে সাজাতে চাই, আর চাইবোও। আজকেও প্রশ্ন কর‍তাম না, কিন্তু কখনো যদি বলো আমি তোমার ব্যপারেও আমার ইচ্ছেকে আমি প্রাধান্য দেই, তখন তো আমার একটু খারাপ লাগবে।

আমি হাসলাম। তামজিদের কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলো। তারপর আস্তে আস্তে বললো,
‘ তূর্ণা তুমি খুশি তো?

আমি এবার চুপ হয়ে গেলাম! কি উত্তর হবে এর? কিন্তু কিছু তো বলা উচিত। বলবো নাকি বলবোনা? এর মধ্যে ভাবি এসে তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘ এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে এমন হাসছে কেন? এমা চোখে আবার পানিও!

আমি ফোনটা কান থেকে সরাতে যাবো, তখনি শুনলাম তামজিদ বলছে,
‘ আমি উত্তর পেয়েছি।

আমি কেটে দিলাম। তারপর ভাবির সাথে বেড়িয়ে গেলাম। উনার গন্তব্য এখন পার্লার। এমন একটা জাঁকজমক বিয়ে আমার কাছে স্বপ্ন ছিলো, আমার সবগুলো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে একটা মানুষ, যে মানুষ ঝড়েরবেগে পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্রের মতো এসেছে!

বিয়ে সম্পন্ন! আমার ভাবি আমার গলা জড়িয়ে ধরে শেষ বললো,
‘ তূর্ণা আমাকে ক্ষমা করো বোন, আমি তোমাদের সাথে অনেক খারাপ করেছি, ভাবিকে কখনো ভুলে যেওনা। আমি সত্যিই তোমাদেরকে মন থেকে ভালোবাসি।

আমি হেসে জবাব দিলাম,
‘ তা আমি জানি ভাবি!

তারপর সবার থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে বসলাম। তামজিদ আমি আর অর্ণা একসাথে। গাড়ীতে উঠেই তামজিদ অর্ণার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমি জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। কি প্রশস্ত আকাশটা। মেঘের ছিঁটেফোঁটাও নেই। ভাইয়ের একটা কথা ইতোমধ্যে মনে পড়ছে, বলেছিলেন আমাকে তিনি কূলহীন সমুদ্রে ছেড়ে দিয়েছেন! এর তীর খুঁজতে আমাদেরকে অনেক হাবুডুবু খেতে হবে। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, ভুল করে তিনি গোড়ালি অব্দি পানিকে গভীর সমুদ্র ভেবে ফেলেছিলেন। তার জন্যই মনে হয় রোদের একটু আঁচেই সে জল শুকিয়ে বালুতে পরিণত হয়েছে, আমরা আমাদের জন্য বিশালকার বাসভূমি পেয়েছি, আর পেয়েছি তকতকে আলোকিত বেলা!
তামজিদ অর্ণার সাথে কথা বলার ফাঁকে একটা হাত বাড়িয়ে আমার মাথা ছুঁয়ে বললো,
‘ তূর্ণা খারাপ লাগছে?

আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘ একদমই না।

তারপর বিরবির করে উচ্চারণ করলাম, খারাপ কেন লাগবে? জীবন নামক বিশাল সমুদ্রে যদি আপনার মতো বালুকাবেলার সন্ধান আল্লাহ এভাবে মিলিয়ে দেয়!

(সমাপ্ত)

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here