সেই মেয়েটি আমি নই _ ৪র্থ পর্ব
পুলিশ দেখে তুলি আর ইশতিয়াক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। ইশতিয়াক এগিয়ে গেল বাইকের কাছে।
– ‘আমাদের ডাকছেন স্যার?’
– ‘হ্যাঁ, আপনাদের ডাকলাম। এখানে কি? বাড়ি কোথায়?’
– ‘এখানে কি মানে? এখানে বেড়াতে এসেছি।’
– ‘বাসা?’
ইশতিয়াক বাসার ঠিকানা বলার পর পুলিশ পুনরায় বললো,
– ‘আপনারা সম্পর্কে কি হন?’
– ‘স্বামী-স্ত্রী।’
এই উত্তর শুনে পুলিশ যেন আশাহত হলো। তবুও হাল না ছেড়ে বললো,
– ‘স্বামী-স্ত্রী বললেই তো হবে না। ঐ গাছের নিচে চলুন। ছায়া আছে, এই যে ম্যাডাম আপনিও চলুন।’
এতদূর হেঁটে যেতে হবে দেখেই তুলির বিরক্তি এসে গেল। ইশতিয়াক কোমড়ে দুই হাত রেখে একদলা ‘থুথু’ ফেলে বললো,
– ‘বুঝলাম না স্যার, এই রোদের মাঝে গাছের নিচে যেতে হবে কেন? হয়রানি করার কারণ কি বলুন?’
– ‘আরে মিয়া হয়রানি মানে? আপনারা ঝোপঝাড়ে শুয়ে থাকবেন। পুলিশ খোঁজখবর নেবে না? আগে গাছের নিচে চলুন। সেখানে গিয়ে আলাপ হবে। এখানে মাঝ রাস্তায় কি?’
দু’জন বিরক্তি নিয়ে বাইকের পিছু পিছু গেল। রোদে পিচঢালা রাস্তা ধরে হেঁটে একটি গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা। সেই গাছ থেকে একটি ছেলে নেমে এলো। আরেকজন দূরে হাঁটাহাঁটি করছে। পুলিশ এবার বাইক থামিয়ে বললো,
– ‘আপনারা কি হন?’
– ‘স্বামী-স্ত্রী।’
– ‘প্রমাণ কি?’
ইশতিয়াক আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না।
– ‘ধরুন আমরা স্বামী স্ত্রী না। আমরা প্রেমিক প্রেমিকা, এখন সমস্যা কি হয়েছে? এই দেশে কি প্রেমিক-প্রেমিকা কোথাও বেড়াতে যেতে পারবে না?’
– ‘বেড়াতে যেতে পারবে, তাই বলে ঝোপঝাড়ে কি?’
– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা হলে ঝোপঝাড়ে যেতেই পারে। পাব্লিক প্লেসে কি চুমাচুমি করবে?’
– ‘এসব জায়গায় অনৈতিক কাজ হয়, ধর্ষণও হয়।’
– ‘আপনার কাছে আমরা দু’জনের কেউ অভিযোগ করেছি? এখানে জোরাজুরির কিছুই হয়নি, ধর্ষণের প্রশ্ন আসছে কেন।’
– ‘এতো কথা নেই, আপনারা বিবাহিত হলে কাগজ দেখান। পরকীয়াও করতে পারেন।’
ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখে পাশের ছেলেটা তুলিকে দূরে নিয়ে নানান প্রশ্ন শুরু করেছে। তুলির মোবাইলও দিতে বলছে তাকে। সে বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘আপনি আইনের লোক, কিন্তু এই ছেলে কে? সে ওকে বিরক্ত করছে কেন? মোবাইল চাচ্ছে কেন?’
পুলিশ বাইকে ভালোভাবে হেলান দিয়ে বসে বললো,
– ‘সমস্যা নেই, ও আমাদের লোক। আপনি কাগজ পত্র দেখান।’
– ‘মানুষ কি কাগজপত্র সাথে নিয়ে ঘুরে? সবচেয়ে বড়ো কথা আমরা স্বামী স্ত্রী না হলেই বা সমস্যা কি? দু’টা ছেলে মেয়ে কি বেড়াতে আসতে পারে না?’
– ‘বুঝেছি আপনারা বিবাহিত না। প্রেমিক-প্রেমিকা মনে হচ্ছে।’
ইশতিয়াক রেগে গিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ প্রেমিক-প্রেমিকা, তাতে হয়েছেটা কি?’
– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা হলে এখানে যে এসেছেন দু’জনের পরিবার কি জানে?’
দূরের সেই তৃতীয় ব্যক্তিও তাদের কাছে এলো।
ইশতিয়াক আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মূছে বললো,
– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা কি মা-বাবাকে জানিয়ে সব জায়গায় যায়?’
পুলিশ এবার যেন দূর্বলতা খুঁজে পেল। মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আমরা সেক্ষেত্রে দুজনের পরিবারের কাছে কল দিয়ে জানাই, নাম্বার দিন অভিভাবকদের।’
– ‘আপনি এটা কেন করবেন? একটা পরিবারের কাছে পুলিশ কল দিলে তো এমনিতেই ওরা বাজে কিছু ভেবে ভয় পাবে। সাধারণ বিষয় আপনি বড়ো করবেন কেন?’
– ‘সাধারণ কিভাবে? আপনি মা-বাবাকে না জানিয়ে ঝোপঝাড়ে যাবেন এটা কি অন্যায় নয়?’
– ‘আমরা কি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে? সবকিছু মা-বাবাকে জানিয়ে আমাদের করতে হবে কেন? তাছাড়া মা-বাবাকে লুকিয়ে বাচ্চারাও তো অনেক কিছুই তো করে। খেলায় যায়, ঠান্ডায় আইসক্রিম খায়। অনেকে সিগারেট খায়। স্কুল পালায়। অন্যায় হলেও এসবের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কি?’
তৃতীয় লোকটা এবার ইশতিয়াকের হাত ধরে টেনে দূরে নিয়ে বললো,
– ‘আরে ভাই, আপনি বোকা না-কি? এসব ঝামেলায় যাচ্ছেন কেন? থানায় নেবে, পরিবারের মানুষ ডাকবে। এর চাইতে দশ-বারো হাজার টাকা দিয়ে কেটে পড়ুন।’
ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘জানতাম তোমাদের এসব ধান্ধা।’
সে আবার পুলিশের কাছে এসে বললো,
– ‘এই পোশাক পরে ব্ল্যাকমেইলের কাজ করেন। যাইহোক কোনো টাকা-পয়সা পাবেন না। আপনি যা ইচ্ছা করেন। থানায় নিতে হলে নেন। আর গাছের উপর থেকে ভিডিও করিয়েছেন তো। পারলে সাংবাদিক ডাকেন, রিপোর্টার এনে চ্যানেলে লাইভ দেখান। আমারও দরকার লোকজন জানানো। আর আমরা বিবাহিত কি-না তার কাগজ দেখাতে পারবো না। আমরা বিবাহিত না, এবার কি করবেন করুন।’
পুলিশ খানিকটা থমথমে খেয়ে গেল। তাকে রক্ষা করলো তুলির সঙ্গে কথা বলা ছেলেটি। ফিসফিস করে এসে কি যেন বললো। পুলিশের চেহারায় হাসির ঝলক।
পুলিশ ছাড়াও অন্য দুই ছেলে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলো। ওরা কিছু একটা তুলির কাছে পেয়েছে। তিনজনকেই খুশি খুশি দেখা যাচ্ছে।
ইশতিয়াকের কানেও এলো ওদের কিঞ্চিৎ কথাবার্তা।
হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি, যে তুলির সঙ্গে কথা বলেছে, সে বললো,
– ‘মেয়েটির সঙ্গে টাকাইই নাই। ওকে ব্ল্যাকমেইল করে তেমন লাভই হবে না।’
– ‘পরে তো পাবো? মেয়েটির ফোন থেকে সবকিছু আমাদের মোবাইলে নিয়ে রাখি।’
– ‘ওর জামাইকে দেখাই, তাকে ব্ল্যাকমেইল করলে টাকা মিলবে।’
– ‘আরে না, তাতে জামাই বউয়ের মাঝে ঝামেলা হবে। আমরা টাকা পাব কিভাবে?’
– ‘তাও ঠিক।
– ‘আচ্ছা বউকে আরও প্রেশার দিয়ে দেখি। আর জামাইয়ের নাম্বার রাখি।’
তৃতীয় ব্যক্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ইশতিয়াক পুরোপুরি কোনোকিছু বুঝতে পারছে না। তুলির দিকে তাকায়। খুবই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে ওকে।
হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি এগিয়ে এসে তাকে বললো,
– ‘আপনার নাম্বারটা দিন। কিছু জরুরি কথা আছে। পরে যোগাযোগ করবো। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।’
ইশতিয়াক আমতা-আমতা করে নাম্বার দিয়ে দিল।
তুলির ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। এসব কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটি কে? তাকে একটা নাম্বার থেকে ক’দিন আগে কল দিয়ে ছলনাময়ী, আমার জীবন নষ্ট করেছিস, এমন অনেক এলোমেলো কথা বলে অভিযোগ করেছিল। এমনভাবে কথা বলেছে তুলি নিজেই ভয় পেয়ে যায়। যেন সবকিছুই সত্য বলছে। কেউ শুনলে ভাববে আসলেই সে ছেলেটির সঙ্গে এমন কিছু করেছে। আজ সকাল থেকে কল রিসিভ করেনি। নাম্বারও ব্লক দিয়েছে। যখন হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটির হাতে মোবাইল দিয়েছিল। ঠিক তখনই দেখে অন্য নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। মোবাইল সাইলেন্ড থাকায় সে বুঝতে পারেনি। কলের সঙ্গে একটা মেসেজও এসেছে। হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি তুলির হাত থেকে ফোন নিয়ে মেসেজে ক্লিক করে
“কল রিসিভ করছো না কেন? আমাকে না চেনার অভিনয় করা বন্ধ করো। তোমার হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছি দেখো। এসব কি ভুলে গেছো?”
মেসেজ দেখে তুলি নিজেই আঁতকে উঠে। হোয়াটসঅ্যাপে আবার কি পাঠাবে? তাও এই জঘন্য লোকদের হাতে পড়বে। ততক্ষণে হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি ডাটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সব পেয়ে যায়। তুলির ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় তৃতীয় ব্যক্তি।
– ‘ম্যাডাম কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে এখানেই মিটমাট করে দিন। আপনার হাসবেন্ডকে কিছুই জানানো হবে না।’
ম্যাডাম হলুদ গেঞ্জি পরা যে ছেলেটিকে দেখছেন। সে কিন্তু খুবই খারাপ। আপনার হাসবেন্ডকে সব বলে দিতে পারে। কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে মিটমাট করে নিন। ছবি আর ভিডিয়োগুলো একেবারে ফকফকা। আপনার জামাই দেখলে যতই যা বলেন কাজ হবে না, সংসার কিন্তু শেষ।’
তুলি দুই হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাচ্ছে। যা করার দ্রুত করতে হবে। এই ছবি আর ভিডিয়োগুলো ইশতিয়াকের কাছে কোনোভাবে যেতে দেওয়া যাবে না। তার সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আর এরাও টাকা না পেলে ঝামেলা করবে। ইশতিয়াককে তো দেখাবেই, পারলে নেটে দিয়ে দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে ছাড়বে। সে এখন কি করবে? টাকাই দেবে, আগে এখান থেকে ঝামেলা চুকিয়ে যাওয়া যাক। বাকি সব পরে ভেবে দেখবে। তুলি ইশতিয়াকের দিক থেকে পাশ ফিরে লুকিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে সকল টাকা বের করে দিয়ে বললো,
– ‘ভাই আমার সঙ্গে যা ছিল দিয়ে দিয়েছি। এখানে কত টাকা তাও জানি না। দয়া করে এবার যেতে দিন।’
ছেলেটি টাকা মুঠোয় নিয়ে হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেল। দু’জন ফিসফিস করে কথা বলছে।
পুলিশ বাইকে বসে সিগারেট টানছে। ইশতিয়াককে ডেকে কাছে নিয়ে বললো,
– ‘আরে ভাই এই ছেলেরা এখানকার লোকাল। আমাকে কল দিল এখানে এনেছে অনৈতিক কাজ হচ্ছে বলে। ওরা বোধহয় ভিডিয়ো-টিডিয়ো করেছে।’
– ‘তো করলে সমস্যা কি? আমরা তেমন কিছুই করিনি।’
– ‘সেটা ঠিক আছে, তবুও ওদেরকে খুশি করে দিয়ে চলে যান। বলবেন ছবি-টবি ডিলিট করে দিতে।’
ইশতিয়াকের ইচ্ছা করছিল বলতে, ‘ছবি-টবি ডিলিট করাবেন আপনি। আর আমি অকারণ টাকা দেবো কেন?’
কিন্তু সে আর ঝামেলা করতে চাইছে না। অনেক হয়েছে। তুলিরও বিপর্যস্ত চেহারা। ক্লান্ত লাগছে। এরা সহজে যেতে দেবে না। সে পাঁচশো টাকা বাড়িয়ে দিল পুলিশের দিকে।
– ‘আরে ভাই আমার কাছে না, ওদেরকেই দেন। তবে আরও পাঁচশো দেন। দাঁড়ান আমি ডেকে আনছি।’
পুলিশ দু’জনকে ডেকে এনে বললো, ‘ভাই তোমাদেরকে এক হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছেন৷ চা-নাস্তা করে নিয়ো। আর ভিডিয়ো-টিডিয়ো করে থাকলে ডিলিট দিয়ে দিয়ো, ঠিক আছে?’
দু’জন সম্মতি জানায়। ইশতিয়াক পুলিশের নাটক সবই বুঝতে পারছে। তবুও টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে তুলির দিকে গেল।
–চলবে–
সেই মেয়েটি আমি নই
লেখা: জবরুল ইসলাম