#ভুলবশত_প্রেম,১০,১১
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১০
আদ্রিশের মুখে ‘মিশমিশ’ নামটি শুনে আমি ক্ষণিকের জন্য নির্বাক বসে রইলাম। উনার এহেন নামকরণে আমি শুধু বিস্মিত নয়, বরং রাগান্বিতও হলাম। ক্রোধিত স্বরে বললাম,
” এতো অদ্ভুত এবং নতুন নতুন নামের আমদানি করেন কোথা থেকে?”
আমার কথা শুনে আদ্রিশ বিচলিত হলেন না। বরং গর্বের সহিত হেসে বললেন,
” মন এবং মস্তিষ্ক। এ দুটো হতে এ নামের আমদানি এবং আমি অলরেডি তোমার কাছে এ নামের রপ্তানিও করে ফেলেছি। ”
এই বলে আদ্রিশ মিটিমিটি হাসলেন। উনার এ হাসি এবং কথায় আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। ফলস্বরূপ আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু আচমকা পায়ের তালুতে ভার পড়ায় পায়ের নতুন সুপ্ত ব্যাথা যেনো জাগ্রত হয়ে উঠলো। কাজেই হঠাৎ ব্যাথার টনক নড়ায় মৃদু যন্ত্রণায় ‘আহ’ শব্দ করে ধপ করে বসে পড়লাম আমি। সঙ্গে সঙ্গেই আদ্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার সামনে এসে দু হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। উনার চেহারায় মৃদু উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। তবে কণ্ঠে উনি স্বাভাবিকতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
” এর আগে কি পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলে?”
এই বলে উনি আমার পা ছুঁতে চাইলেন। তৎক্ষনাৎ আমি উনাকে বাঁধা দিয়ে বললাম,
” আমার পা ঠিক হয়ে গিয়েছে। তখন হঠাৎ প্রেশার পড়ায় ওমন ব্যাথা লেগেছিলো। এখন ঠিক আছি আমি।”
আদ্রিশ আমার কথা মানতে চাইলেন না। বরং নাছোড়বান্দার ন্যায় আমার পা দেখতে চাইলেন। আমি আর উপায় না পেয়ে উনার হাত আলতো করে চেপে ধরে বললাম,
” আরে! বললাম তো আমি ঠিক আছি। আপনি ডক্টর না কি যে আমার ব্যাথার উপরিভাগ দেখেই আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারবেন। ”
আদ্রিশ আমার দিকে এবার অসন্তোষজনক চাহনিতে চাইলেন। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” ডক্টর নয়, ফার্মাসিস্ট। তাই বলে এই নয় যে, এই ব্যাথার প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু আমি করতে পারবো না। ”
এই বলে ভ্রু এবং চোখজোড়া কুঞ্চিত করে চেয়ারে বসে পড়লেন উনি। অনেকটা ধমকের সুরেই আমাকে বললেন,
” আজকে একটা ফাংশনের দিন৷ কোন আক্কেলে ঐ হিল পড়ে চলতে গিয়েছো যে হিল তোমার পায়ের এই অবস্থা করে দেয়?”
আমি অসহায় চাহনিতে আমার সম্মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হিল দুটোর দিকে চেয়ে বললাম,
” আজই নতুন পড়েছি আমি৷ এর আগে শুধু ট্রায়ালেই পড়েছিলাম। তখন কি জানতাম যে, এই হিল পড়ে আমার এমন করুন দশা হবে! অবশ্য এই হিল কেনা হয়েছে গাউনটার জন্যই। আজ যেমন এই গাউনটা জ্বালাচ্ছে তেমনি এই হিলটাও জ্বালিয়ে খাচ্ছে। ”
এই বলে চট করে আমার মাথায় এলো, আমি শুধু শুধু উনাকে এসব কাজের সাফাই দিতে যাচ্ছি কেনো? এই ভেবে আমি আর কিছু বললাম না৷ চুপচাপ বিরক্তিভরা চাহনিতে উনার দিকে কিয়ৎক্ষণের জন্য চেয়ে রইলাম৷ উনিও নিশ্চুপ বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। উনার নিষ্পলক এ চাহনিতে আমি খানিক বিব্রত বোধ করলাম। ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” আশ্চর্য তো! আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
আদ্রিশ আমার ধমককে পাত্তাই দিলেন না৷ বরং বললেন,
” তুমিও তো আমার দিকে তাকিয়ে আছো। শুধু আমি তাকিয়ে থাকলেই দোষ! ”
আমি এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,
” আপনার সমস্যা কি বলুন তো? এভাবে আমার পিছে পড়ে আছেন কেনো? আমি একটু একা রিল্যাক্সে থাকতে চাইছি। কিন্তু আপনি তো আমার পিছুই ছাড়ছেন না। অদ্ভুত! ”
আদ্রিশ আমার কথাগুলোর গুরুত্ব দিলেন না। কৃত্রিম হাই তুলে বললেন,
” আমি তোমার পিছে কোথায় মিশমিশ? আমি তো তোমার সামনে৷ এই দেখো, আমি তোমার সামনে বসে আছি। ”
উনার কথায় আমি এবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে রইলাম৷ উনি আমার দিকে এখনও চেয়ে আছেন৷ উনার এ চাহনির সামনে টিকে থাকা ভীষণ মুশকিল হয়ে পড়লো আমার জন্য৷ ফলে নিরুপায় হয়ে আমি চেয়ারটা ঘুরিয়ে উনার দিকে পিঠ দিয়ে বসে পড়লাম। কিয়ৎক্ষনের মাঝেই আমার ফোনে আম্মুর কল এলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশে আম্মুর উদ্বিগ্নতায় ভরপুর ব্যস্ত কণ্ঠ শুনতে পেলাম,
” তুই কোথায় রে মিম? তোকে কখন থেকে খুঁজছি আমি! নাফিসার ঐ শাড়ীটা কোথায় যেটা ইমাদ দিয়েছিলো ওকে?”
” ঐ শাড়ী দিয়ে কি করবে এখন? আর তুমি কোথায় আম্মু? ”
” আমি বাসায় আসছি। হঠাৎ এ শাড়ীর কথা মনে পড়ায় আমি বাসায় চলে আসি ওটা নেওয়ার জন্য৷ এবার বল শাড়ীটা কোথায়? নাফিসার লাগেজে ঢুকাতে হবে তো। ”
” আমার রুমের আলমারি অথবা আপুর রুমের আলমারিতে হবে। তা না হলে তোমার রুমের আলমারিতে।”
” আচ্ছা। তুই কোথায় আছিস? তাড়াতাড়ি বাসায় আয় তো। টুকটাক কিছু কাজ বাকি আছে।”
” আচ্ছা।”
এই বলে আমি ফোন কেটে দিলাম। পায়ের ব্যাথায় এ মুহূর্তে কোথাও যেতে মন না চাইলেও উঠে দাঁড়ালাম আমি। কারণ এ মুহূর্তে আম্মুর আদেশ অমান্য করার অর্থ হলো, বাসায় যাবার পরপরই ছোটখাটো একটা ঝড় তোলার সুযোগ করে দেওয়া।
পায়ের তালুর ব্যাথা নিয়ে আমি ধীরলয়ে হেঁটে হিল জোড়া পড়তে সম্মুখের দিকে এগুলাম। দুটো হিল দুদিকে পড়ে আছে। আমি ডান পায়ের হিল নিয়ে পড়তে পড়তে হুট করে আদ্রিশ আমার সামনে বাম পায়ের হিল দিয়ে বললেন,
” এই বলে পায়ে ব্যাথা৷ তো এই ব্যাথা নিয়ে যাচ্ছো কোথায়?”
আমি আদ্রিশের হাত হতে হিল নিয়ে পরলাম। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে উনার উদ্দেশ্যে তেজস্বরে বললাম,
” তা দিয়ে আপনার কি কাজ? আমি যেখানেই যাই না কেনো আপনাকে বলার প্রয়োজন নেই তো আমার৷ আপনার কি কোনো কাজ নেই? ছ্যাচড়ার মতো সেই কখন থেকে আমার পিছে পড়ে আছেন আপনি! ”
এই বলে আমি দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম। পিছে আদ্রিশ কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না৷ হয়তো আমার কথায় উনি কষ্ট পেয়েছেন। তো কষ্ট পাক। উনার কষ্ট দিয়ে আমার কোনো যায় আসে না। এ মুহূর্তে আমার পায়ে ব্যাথা করছে ঠিকই। তবে আদ্রিশের উপর ক্ষুব্ধ থাকায় এ ব্যাথা আমার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না৷
পায়ে ব্যাথা সত্ত্বেও আমি ধপাধপ পা ফেলে প্রথম স্তরের সিঁড়ি পেরুলাম। পিছে লক্ষ্য করলাম আদ্রিশও আসছেন। যতটুকু ধারণা করলাম তাতে মনে হলো, উনি এখন একদম চুপচাপ গোমড়া মুখো হয়ে আসছেন। ব্যস, এই তো চাইছিলাম আমি৷ সেই কখন থেকে উনার এই সেই প্যাঁচাল শুনতে শুনতে কান দুটো জ্বলছিলো৷ এখন যেনো তারা শান্তি পেলো।
নিচে নামবার দ্বিতীয় স্তরের তিন নাম্বার সিঁড়িতে পা রাখতেই অসাবধানতাবশত আচমকা আমার বাম পা মচকে গেলো। পা’টা এমনভাবে মচকালো যে, প্রচণ্ড ব্যাথায় আমি সাথে সাথে সিঁড়িতে বসে পা ধরে মৃদু আর্তনাদ তুলি। আমার এ অবস্থা দেখে আদ্রিশ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার নিচের সিঁড়িতে এসে বসলেন। আমি তখন ব্যাথায় কাতর এবং এমনই ব্যাথা পেয়েছি যে, চোখ দিয়ে টপাটপ দু ফোঁটা জলও পড়ে গেলো। আদ্রিশ দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্নতার সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
” পড়লে কি করে তুমি!”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। এ মুহূর্তে আমার জবাব দিতে মন চাইছে না। মন চাইছে, পা ধরে গগনবিদারী এক চিৎকার দেই। বাম পা’টা এবার এমনভাবে মচকে গিয়েছে, মন বলছে পায়ের কোনো রগ হয়তো গিয়েছে একেবারে। কয়েক মাসের বেড রেস্ট ছাড়া হয়তো এ মচকানো ঠিক হবে না।
আমি বাম পা ধরে তখনও নিরবে কেঁদে চলছি। আদ্রিশ আমার পরিস্থিতি দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন,
” খুব ব্যাথা করছে কি?”
আমি কাঁদোকাঁদো চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। উনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” দাঁড়াতে পারবে?”
উনার প্রশ্ন শুনে আমি দাঁড়াতে উদ্যত হলাম৷ কিন্তু বাম পা’টা একটু নাড়াতেই প্রচণ্ড ব্যাথায় আমার পা যেনো অবশ হয়ে পড়লো। ফলস্বরূপ আমি ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়লাম। আদ্রিশের চেহারা এবার পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। উনি চিন্তিত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন,
” সিরিয়াস ইনজুরি মনে হচ্ছে। কয়েক মাসের বেড রেস্ট ছাড়া এ ব্যাথা ঠিক হবে না মনে হচ্ছে। ”
আদ্রিশের কথা শুনতেই আমার দু চোখ উপচে পড়ে জলের ধারা বইতে লাগলো। হ্যাঁ, আমিও এমনটা আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে আদ্রিশও আমাকে এমন ভয় দেখালেন! এ যদি সত্যি হয় তাহলে আমি কি করবো!
আমি এবার কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
” সত্যিই কি এমনটা হবে?”
আদ্রিশ আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ৷ এমনটাই হবে। ”
আমি এবার অনুনয়ের সুরে উনাকে বললাম,
” প্লিজ সত্যি করে বলুন না। কালকে আপুর রিসিপশন আছে। আমার ক্লাস আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আপুকে এখনো বিদায় দেওয়া হয়নি। এটা কোনো কথা হলো!”
আদ্রিশ আমার কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসলেন। অতঃপর সিঁড়ি হতে উঠে আমার পিছনের সিঁড়িটায় এসে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” একদমই উঠে দাঁড়াতে পারছো না?”
আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” না। ”
আদ্রিশ আমার কথায় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর পাঞ্জাবির হাঁতা গোটাতে গোটাতে বললেন,
” তাহলে এখন আমি যা করবো তাতে তুমি কোনো বাঁধা দিতে পারবে না এণ্ড অবভিয়েসলি এটা তোমার ভালোর জন্যই করবো। ”
উনি ঠিক কি করতে চাইছেন সে মুহূর্তে আমার ভাবনায় এলো না। তবে নিমিষের মাঝেই উনি যা করলেন তা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।
আদ্রিশ কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আচমকা আমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিয়ৎক্ষণের জন্য আমি উনার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। অতঃপর যখন উনি এক সিঁড়ি নামলেন তখন আমি ধরাধামে অবতীর্ণ হলাম৷ ফলে আমাকে উঠানোর সময় পা নাড়াচাড়া করায় যে ব্যাথা লেগেছিলো তা মাত্রই অনুভব করলাম। ফলস্বরূপ ব্যাথা কঁকিয়ে উঠলাম। আদ্রিশ সাথে সাথে ঐ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” ব্যাথা পেয়েছো?”
আমি ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলাম,
” হ্যাঁ। ”
তৎক্ষনাৎ উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমাকে এভাবে কোলে তুললেন কেনো?”
আদ্রিশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” তো? তুমি যেভাবে বললে যে, তুমি দাঁড়াতে পারছো না। সে হিসেবে এই অ্যাকশন নেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিলো না আমার কাছে।”
ঘটনার শিকার হয়ে আমি নির্বাক চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনি আমার এ চাহনি দেখে মৃদু হাসি দিলেন। অতঃপর ঠেস দেওয়া গলায় বললেন,
” শেষমেশ এই ছ্যাচড়ার কোলেই তো উঠলে তুমি। দেখলে! তোমার দুঃসময়ে এই ছ্যাচড়াই তোমার কাজে এলো মিস মিশমিশ। এই হলো ছ্যাচড়াদের পিছে পড়ার উপকারিতা। ”
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১১
আমি পরাস্ত চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ মুচকি হেসে আমাকে বললেন,
” এজন্য যা বলবে ভেবেচিন্তে বলবে।”
আমি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলাম না৷ নির্বাক রয়ে উনার পরনের পাঞ্জাবির ঘাড়ের দিকের অংশ চেপে ধরলাম। উনি অকস্মাৎ বলে উঠলেন,
” এই আস্তে ধরো আমাকে। তোমার নখগুলো খুবই ভয়ংকর।”
উনার এমন অকস্মাৎ কথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম৷ সাথে সাথে উনার পাঞ্জাবি ছেড়ে দিলাম আমি৷ অবুঝ বালিকার ন্যায় প্রশ্ন করলাম,
” এমন বললেন কেনো? কি করেছি আমি?”
আদ্রিশ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললেন,
” মনে নেই? নিচে পড়ে যাওয়ার সময় আমার পাঞ্জাবি খামচে ধরেছিলে? তখন তোমার নখ দিয়ে আমার পিঠে আঁচড় লেগেছিলো। এখন আঁচড়টা কতটুকু ডিপ তা জানি না। কিন্তু এখনও অব্দি আমার পিঠ জ্বলছে।”
আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপরাধীর ন্যায় দৃষ্টি নত করে সরি বললাম। উনি প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না।
আদ্রিশ আমায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় নিচের দিকে নেমে এসেছেন৷ ধীরেধীরে মানুষজনের কলরব শুনে আমার টনক নড়লো। তৎক্ষনাৎ আমি আদ্রিশের ঘাড় চেপে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম,
” দাঁড়ান দাঁড়ান৷ আমাকে এখানে নামিয়ে দিন। ”
আদ্রিশ শেষ তৃতীয় এসে থমকে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো তাড়াতাড়ি তোমার পা ঠিক হয়ে গেলো! ”
আমি দ্রুততার সহিত বললাম,
” না। আমার পা এখনও আগের মতো আছে। কিন্তু আমাকে আপনি নামান কোল থেকে।”
” কিন্তু কেনো? তোমায় তো এখন ক্লিনিকে যেতে হবে। ”
আদ্রিশের কথায় আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে এলো। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” পাগল না কি আপনি! এভাবে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবেন!”
আদ্রিশ স্বাভাবিক উত্তর দিলেন,
” এভাবে নিবো কেনো? প্রথমত এভাবে গাড়ির কাছে যাবো। তারপর গাড়িতে করে ক্লিনিকে যাব। তারপর আবার সেখান থেকে কোলে করে হসপিটাল বেডে নামাবো। ”
আদ্রিশের সোজাসাপটা কথায় আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। রাগত স্বরে বললাম,
” আমি এই ‘ এভাবে’র কথা বলিনি। আমি বলেছি আমাকে এভাবে কোলে করে সবার সামনে দিয়ে যাবেন না কি!”
আদ্রিশ অবুঝ বালকের ন্যায় বললেন,
” হ্যা, এভাবেই। ”
” আপনি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গিয়েছেন৷ কিন্তু আমি পাগল হয়নি। এভাবে আমি কিছুতেই সবার সামনে যাব না। মরে গেলেও যাব না৷ এর চেয়ে বরং আমাকে এখানেই নামিয়ে রাখুন। আমি কল করে আমার চাচুকে ডেকে নিবো। আর আমার এ অবস্থার ব্যাপারে কাউকে জানাতে চাচ্ছি না আমি৷ কারণ এ ব্যাপারে জানলে আপুর বিয়ের ফাংশনটাই মাটি হয়ে যাবে৷ সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ যা আমি চাই না। সুতরাং, আমাকে নামান আপনি।”
আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমার কথায় কোনো পাত্তাই দিলেন না তিনি। বরং আমায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। উনার এ কৃর্তিতে আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি পুনরায় রাগত স্বরে উনাকে বললাম,
” দেখুন! এগুলো ভালো হচ্ছে না কিন্তু। একে তো আমার পারমিশন ছাড়াই আপনি আমাকে এভাবে উঠিয়ে নিয়েছেন। তার উপর আপনাকে নামাতে বলছি। কিন্তু আপনি তা আমলেই নিচ্ছেন না! এভাবে সবার সামনে যাওয়াতে আপনার মানসম্মানের কিছু হবে না৷ যা হবে সব আমার উপর দিয়েই যাবে। লোকে আমাকে থু থু করবে। প্লিজ আপনি আমাকে কোল থেকে নামান৷ ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আমি কিন্তু এবার…….”
আমার কথার পরিসমাপ্তি না ঘটতেই আদ্রিশ আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। সাথে সাথে আমি বিস্মিত নয়নে চারপাশ দেখতে লাগলাম। এটা নিচের হল নয়৷ বরং একটা রুম৷ হয়তো রেস্টরুম!
আমি চারপাশ একবার পর্যবেক্ষণ শেষে আদ্রিশকে এই জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হলাম যে, উনি কোথায় এনেছেন আমাকে। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে টু শব্দটুকু বের হবার পূর্বেই উনি বললেন,
“চুপচাপ এখানে বসে থাকো। মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হলে তোমার এ অবস্থার কথা বাইরের সবাইকে বলতে এক সেকেন্ডও সময় নিবো না আমি। ”
আদ্রিশের কথায় আমি ব্যাথায় কোঁকানোর পরও যতদূর সম্ভব কথাবার্তা বিহীন বসে রইলাম। এ মুহূর্তে চুপচাপ বসে থাকাকে সবচেয়ে বড় সাজা বলে মনে হলো আমার কাছে। কিন্তু এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় রইলো না আমার পক্ষে।
আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” এটা রেস্টরুম। সিঁড়ির পাশ দিয়েই এসেছি। আই থিংক কেউ দেখেনি আমাদের। তুমি এখানেই বসে থাকো। দেখি,আমি কোথাও থেকে বরফ জোগাড় করতে পারি কি না। আপাতত এই স্প্রেইন এ বরফের সেক দেওয়ার দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বরফ পাবো কোথায়?”
আদ্রিশ এবার চিন্তায় মগ্ন হলেন এবং আমি চুপচাপ ব্যাথাযুক্ত পা নিয়ে বসে আছি। আদ্রিশ কিছুক্ষণ ভাবনার সাগরে ডুবে রইলেন। অতঃপর পকেট হতে ফোন বের করতে করতে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে যেতেই আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম এবং সাথে সাথে আমার ব্যাথা যেনো জাগ্রত হয়ে উঠলো। ব্যাথায় ‘আহ’ শব্দ করে আমি আলতো করে পা স্পর্শ করলাম।
প্রায় দশ মিনিট পর আদ্রিশ একটা বক্স নিয়ে ফিরে এলেন। উনার সাথে এলেন তামিম এবং সাদিক। তিনজনের চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ। আদ্রিশ দ্রুত এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমার পায়ের হিল খুলে নিজ পাঞ্জাবির পকেট হতে রুমাল বের করে তাতে বরফ নিয়ে আমার গোড়ালিতে চেপে ধরলেন উনি৷ উনার অকস্মাৎ স্পর্শে আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আদ্রিশ সাথে সাথে বরফ সরিয়ে নিলেন। উনার এ কাণ্ডে সাদিক অনেকটা ধমকের সুরেই বললেন,
” আরে বরফ সরালি কেনো! ওর পায়ে বরফ দে! ”
আদ্রিশ বাচ্চাদের মতো বলে উঠলেন,
” কিন্তু ও তো ব্যাথা পাচ্ছে।”
সাদিক এবার এগিয়ে এসে উনার হাত হতে বরফ নিয়ে বললেন,
” তুই সর তাহলে। আমিই ওকে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি। ”
সাদিকের কথা শেষ হতে দেরি হলো। কিন্তু উনার হাত হতে আদ্রিশের বরফ নিতে দেরি হলো না৷ আদ্রিশ বরফ হাতে নিয়ে আমার পায়ে আলতো করে চেপে ধরতে ধরতে বললেন,
” আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। সমস্যা নেই। তুই বরং বাইরে যা। এখনই তো সবাই বেরিয়ে যাবে। ”
আদ্রিশের কথায় সজোরে বলে উঠলাম,
” কি! আপুরা এখনই বের হয়ে যাবে!”
আদ্রিশ হ্যা সূচক জবাব দিলেন। মুহূর্তেই আমার দু চোখ উপচে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
” এই ব্যাথা এখনই পাওয়ার দরকার ছিলো! আপু চলে যাবে আর আমি দেখতে পাবো না! এটা হওয়া উচিত না। আমি আপুর কাছে যাবো।”
এই বলেই আমি উঠতে উদ্যত হলাম। সাথে সাথে আদ্রিশ আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
” পাগল না কি! এই ব্যাথা নিয়ে তুমি অতদূর কি করে যাবে? এই রুম থেকেই বের হবার সাধ্য নেই তোমার। আবার বাইরে যাবার প্ল্যানিং করছে!”
আমি আদ্রিশের কথা মানতে নারাজ। আমার চোখ বেয়ে এখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। তামিম আমাকে দেখে বললেন,
” মানো আর না মানো। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তোমার কাছে। একটা হুইলচেয়ার থাকলে গতি করা যেতো। কিন্তু এখানে তো আর হুইলচেয়ার পাওয়া সম্ভব না৷ বরং আমি বাইরে গিয়ে তোমার এ অবস্থার কথা বলি। তাহলে তোমার আপুই এখানে চলে আসবে।”
আদ্রিশ সায় দিলেন,
” হ্যাঁ। তাই কর বরং। এছাড়া তো আর উপায় দেখছি না৷ ”
আদ্রিশের সম্মতি পেয়ে তামিম এবং সাদিক বেরিয়ে গেলেন এবং দু মিনিটের মাঝেই আপু, আব্বু,আম্মু,আভাসহ আরো অনেকে এসে রেস্টরুম ভরিয়ে ফেললো। আমাকে দেখামাত্রই আপু আর আম্মু আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। আপুর চেহারা কাঁদোকাঁদো। হয়তো আপু কান্না শুরু করে দিয়েছিলো!
আপু আমাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এ অবস্থা হলো কি করে!”
আমি নত মস্তকে জবাব দিলাম,
” হিলের কারণে হয়েছে।”
আম্মু এবার ধমকের সুরে বলে উঠলো,
” হিল সামলাতে না পারলে পরিস কেনো? কতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিস দেখলি! এখন পায়ের ভেতরকার অবস্থা কি আল্লাহ ভালো জানেন।”
আম্মুর কথা শেষ হতে না হতেই আপু আমাকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলো। এদিকে আমি ও আভাও আপুর সাথে সমান তালে কেঁদে চলছি। আমাদের দেখাদেখি আম্মুও কান্না শুরু করে দিলো। ব্যস, পরিবেশটা তখন বিদায় পূর্ববর্তী মহলে পরিণত হয়ে গেলো।
এভাবে কান্নাকাটির পর আব্বু আর ইমাদ ভাইয়া মিলে আপুকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। আপু আমাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না৷ এজন্য একপ্রকার জোর করেই তাকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। আপু যাওয়ার পর আভা আর আম্মু আমার পাশে থাকতে চাইলেও আমি তাদের আপুর পিছে পাঠিয়ে দিলাম। একে একে সবাই আপুকে বিদায় দেওয়ার জন্য চলে গেলে আমি ফুঁপাতে ফুঁপাতে কাঁদতে লাগলাম। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই আমি আপুকে ভীষণভাবে মিস করতে লাগলাম। চোখের সামনে ভেসে এলো আপুর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত। যা এখন একটা স্মৃতি।
#চলবে