ভুলবশত_প্রেম,১২,১৩

0
1178

#ভুলবশত_প্রেম,১২,১৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১২

সময়ের ঘূর্ণিপাকে কেটে গিয়েছে দুটো দিন৷ গত দুটো দিন আমার কেটেছে শুধু শুয়ে বসে। কারণ ডক্টর আমাকে বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন এবং সাথে কিছু ওষুধও লিখে দিয়েছেন। আপাতত এই ওষুধ এবং বেডরেস্টে আমার পা বেশ ভালো হয়েছে। তবে একেবারে আগের মতো যে চলাফেরা করতে পারি তা নয়। বরং আমাকে শ্লথের গতিতে চলতে হয়৷ কারণ পায়ে জোরে হাঁটার মতো প্রেশার দিলে ব্যাথা আরম্ভ হয়ে যায়। গতকাল রাত হতে পায়ের ব্যাথা কমায় আমি ধীর গতিতে হাঁটতে শুরু করেছি।

আজ আপুর রিসেপশন। গত দুদিন আমার অসুস্থতার জন্য ইমাদ ভাইয়ার কথায় রিসেপশন রাখা হয়নি।
সকাল হতেই ইমাদ ভাইয়ার ভুড়িভোজের জন্য আম্মু, খালামনি, চাচিরা ব্যস্ত সময় পার করছে। এদিকে আমি জানালার পাশে বসে অলস সময় পার করছি৷ আপুর রিসেপশন পার্টি উপলক্ষে বিয়ের দিন পর্যন্তও আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম। কিন্তু আজকে শরীরে জোর না থাকায় মনেও জোর নেই৷ ফলে সাজাগোজার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি বের হবার আগে মুখে হালকা কিছু দিয়েই বের হবো। এখন আপাতত দুটো ঘণ্টা একটু অলস সময় কাটাবো।

.

সকাল এগারোটার দিকে আম্মু,খালামনি,চাচিরা বাদে সকলেই আপুর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলাম। আমাদের বাসা হতে বড়জোড় আধ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন তাদের বাড়ি যেতে। অর্থাৎ সাড়ে এগারোটার পূর্বেই আমরা আপুর শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে গেলাম।
ইমাদ ভাইয়াদের আলিশান বাড়িতেই রিসেপশনের আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে স্টেজ সাজানো হয়েছে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে। আমাদের কাজিনদের সেখানে পৌঁছানো মাত্রই বিস্ময়ে মুখখানা হা হয়ে এলো। কারণ এমন বিরাট এলাহি কারবারি অনুষ্ঠান এর পূ্র্বে সিনেমায় দেখে থাকলেও এই প্রথম সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হলো। চারপাশে এতো জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ দেখে সে মুহূর্তে প্রকৃতপক্ষেই মনে হলো, ইমাদ ভাইয়াদের ক্লাসের কথা সকলের মুখে মুখে যা শুনেছি তা সত্যই।

লামিয়া আর তাসনিম পূর্বেই আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আভাও এতোক্ষণ আমার পাশাপাশি ধীর গতিতে হাঁটছিলো। কিন্তু ওর চোখেমুখে আপুর সাথে দেখা করার ব্যাকুলতা দেখে আমি ওকে পাঠিয়ে দেই। ব্যস, এখন এতো মানুষের ভীড়ে আমি ধীরেসুস্থে একাই হেঁটে চলছি।

আচমকা পিছন হতে কারোর ধাক্কায় আমি মুখ থুবড়ে পড়তে নিলেই এক জোড়া হাত আমাকে আগলে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ক্ষণিকের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। অতঃপর নিজের মস্তিষ্ককে শান্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমি মাথা তুলে চাই ব্যক্তিটিকে দেখার জন্য৷ সম্মুখে আদ্রিশের হাসিমাখা মুখখানা দেখে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। উনি আমার দিকে চেয়ে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” ঠিক আছো তো তুমি? ”

আমি স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দিলাম,
” জি ঠিক আছি। থ্যাংক ইউ আমাকে হেল্প করার জন্য। ”

আদ্রিশ প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না৷ বরং আমাকে সামনে এগুনোর ইশারা করে নিজেও সামনে এগুলেন। উনার ইশারা মোতাবেক আমি ধীরেসুস্থে সামনের দিকে এগিয়ে চলছি। আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলেন,
” পা কি পুরোপুরি ঠিক?”

” বলা যায়। তবে জোরে হাঁটতে পারি না৷ এমনটা করলেই পায়ে প্রেশার পরে যাচ্ছে। ”

” তো? তোমাকে তো কেউ জোরে হাঁটতে বলেনি। তুমি যেভাবে হেঁটে সুবিধাবোধ করবে সেভাবেই হাঁটবে। ”

উনার কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ আমি কিছু বলতে চাইলাম। তবে এর পূর্বেই পিছন হতে কে যেনো উনাকে ডেকে নিয়ে চলে গেলেন। আদ্রিশ চলে যেতেই আমি পূর্বের ন্যায় হেঁটে আপুর কাছে এসে পৌঁছালাম। আপু আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো। ইমাদ ভাইয়া আমাদের দেখে নিজ স্থান হতে উঠে এসে বললেন,
” তোমাকে দেখে যেনো তোমার আপু হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছে। জানো না তুমি মিম, এ দুটো দিন তোমার টেনশনে তোমার আপু যেনো অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে৷ ”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আপু আমাকে ছেড়ে ইমাদ ভাইয়ার বাহুতে আলতো করে মেরে বললো,
” হয়েছে হয়েছে আর মিথ্যা বলতে হবে না৷ ”

ইমাদ ভাইয়া নিজের বাহুতে হাত ঘষতে ঘষতে নাকমুখ সিঁটকে বললেন,
” ইশ! মেয়ের হাতের পাওয়ার কি! হাত না কি হাতুড়ি!”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমরা সকলে একযোগে হেসে উঠলাম। সকলের হাসির প্রহর শেষ হওয়া মাত্রই ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” তোমরা গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে নাও। তারপর কথাবার্তা হবে। আব্বুরা পরে খাবে। উনারা হয়তো আমার আব্বুর সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত।”

এই বলে ইমাদ ভাইয়া সাদিককে ডাকলেন। দূর হতে লক্ষ্য করলাম, সাদিক একটা ওয়েটারকে কিছু বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। ইমাদ ভাইয়ার ডাক শুনে সাদিক স্টেজের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
” কোনো প্রয়োজন ইমাদ ভাই?”

ইমাদ ভাইয়া আপুকে বসতে বলে অনেকটা শাসানোর কণ্ঠে সাদিককে বললেন,
” হ্যাঁ। আমার শালিকাগণের দায়িত্ব তোর উপরে দিলাম। ওদের যেনো কোনোরকম অসুবিধা না হয়। যদি ওদের তরফ থেকে কোনো কমপ্লেইন আছে তাহলে তোর কি হবে তা চিন্তাও করতে পারবি না তুই।”

ইমাদ ভাইয়ার কথায় আমরা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলাম। সাদিকও হাসলেন। বললেন,
” যথা আজ্ঞা ইমাদ ভাইয়া। এবার বলুন, আপনার শালিকাগণের সেবাশুশ্রূষা স্বরূপ আমি কি করতে পারি?”

ইমাদ ভাইয়া সশব্দে হেসে সাদিকের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন,
” আপাতত ওদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কর। ”

” জি হুকুম জাঁহাপনা। ”
এই বলে উনি আমাদের উদ্দেশ্যে মজার ছলে বললেন,
” চলুন রাণীগন। আপনাদের সেবায় আমি নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। ”
উনার কথা শেষ হতে না হতেই আমাদের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলো।

সাদিক আমাদের নিয়ে খাবার ভেন্যুতে আসলেন। রিসিপশনে কর্মরত ওয়েটারদেরকে সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাদেরকে খেতে বলে উনি অত্যন্ত জরুরি একটা কাজে চলে গেলেন। উনি চলে যাবার কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা খাওয়াদাওয়া শুরু করলাম। আমাদের খাবার যখন শেষের দিকে তখন আপুর শ্বাশুড়ি এসে দাঁড়ালেন আমাদের টেবিলের পাশে। আমাকে দেখেই উনি মমতাময়ী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
” মিম মা! তুমি এসেছো! এখন পায়ের কি অবস্থা? ”

আপুর শ্বাশুড়ি অর্থাৎ নাসরিন আন্টীকে দেখে আমরা সকলে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর উনার উদ্দেশ্যে ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাসূচক হাসি বজায় রেখে বললাম,
” জি আন্টী, এখন পায়ের অবস্থা অনেকটাই ভালো। শুধু পায়ে বেশি প্রেশার দিয়ে হাঁটতে পারি না।”

নাসরিন আন্টী এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পূর্বের ন্যায় বললেন,
” ওটাও শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিও। এখান থেকে গিয়ে আবারো তিন চারদিনের বেড রেস্ট নিবে। তখন দেখবে সবকিছু আগের মতো একদম স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। ”

” জি আন্টী।”

নাসরিন আন্টী মৃদু হাসলেন। অতঃপর আমাদের দিকে চেয়ে আচমকা অপরাধী কণ্ঠে বললেন,
” দেখেছো আমার কাজকর্ম! তোমাদের খাবার খাওয়ার মাঝেই এসে হাজির হয়েছি আমি। দূর থেকে দেখে ভেবেছি তোমাদের খাওয়া শেষ। আচ্ছা, যাই হোক। তোমরা খাওয়াদাওয়া করো। পরে কথা হবে।”

এই বলে নাসরিন আন্টী মিষ্টি একটা বিদায়ী হাসি দিয়ে চলে গেলেন। উনি যেতেই আমরা পুনরায় খাওয়াদাওয়ায় মনোযোগী হয়ে উঠলাম।

.

মানুষজনের ভীড়ে অতিষ্ঠ হয়ে মেইন ভেন্যু হতে একটু দূরে চেয়ার নিয়ে বসে আছি আমি৷ খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর আপুর কাছে যেতে চাইলেও আপুর শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের ভীড়ে আপুর ধারের কাছে যাওয়ায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো আমাদের জন্য। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় আমরা হাল ছেড়ে এসব ভিড়ভাট্টা হতে দূরে থাকবার জন্য চেয়ার নিয়ে বসে পড়ি৷ আভা, তাসনিম, লামিয়া এতোক্ষণ যাবত আমার সাথেই ছিলো। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য আপুর চারপাশে লোকসংখ্যা কমে এলেই এই তিনজনে স্টেজের দিকে ছুট লাগায়। প্রথমে আমিও ওদের পিছু পিছু যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পুনরায় লোকবল জড়ো হতে দেখে আমি সে সিদ্ধান্ত বাতিল করলাম।

চেয়ারে বসে অলস ভঙ্গিতে ফোন চালাচ্ছিলাম। আচমকা আমার সামনে চেয়ার নিয়ে কোথা থেকে যেনো উড়ে এসে জুড়ে বসলেন আদ্রিশ। নিমিষের জন্য আমি বেশ চমকে গিয়েছিলাম। আমার চেহারায় অঙ্কিত চমকের ছাপ দেখে আদ্রিশ মিটিমিটি হেসে বললেন,
” তুমি তো ভীষণ ভিতু মেয়ে!”

উনার কথায় বেশ অপমানিত বোধ করলাম আমি। ফোন রেখে গুটিগুটি চোখে ক্ষণিকের জন্য উনার দিকে চেয়ে রইলাম। বললাম,
” আপনার সামনেও কেউ যদি এভাবে এসে বসে পড়ে তাহলে আপনিও ভয় পেয়ে যাবেন। ”

আদ্রিশ আমার কথা মাটিতে পড়তে দিলেন না। বরং সশব্দে হেসে আমাকে টিপ্পনী কেটে বললেন,
” এর মানে মিশমিশ ভয় পেয়েছে।”
এই বলে উনি পুনরায় হাসিতে মগ্ন হলেন। উনার জবানে দুদিন পর ‘মিশমিশ’ সম্বোধন শুনে নিমিষের জন্য অজানা এক ভালোলাগা কাজ করলো আমার মাঝে। তবে এর কোনো ভিত্তি না থাকায় তা মুহূর্তেই উবে গেলো। ফলে আমি কিছুটা রাগান্বিত সুরে বললাম,
” আবারো এ নামে ডাকছেন আমাকে!”

আদ্রিশ হাসি থামিয়ে আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে এলেন। ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বললেন,
” কেনো? পছন্দ হয়নি? ”

অদ্ভুত হলেও সত্য। উনার এ প্রশ্নের কোনো জবাব বের হলো না আমার মুখ দিয়ে। অতঃপর আদ্রিশ আমার নিকট হতে কোনো জবাব না পেয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে বললেন,
” জবাব পেয়ে গিয়েছি আমি।”

আমি এ বিষয়টাকে ঘেঁটে ঘ করলাম না। বরং উনাকে বললাম,
” আপনি বেকার হয়ে এখানে বসে আছেন কেনো? কাজকাম নেই না কি?”

আদ্রিশ একটা হাই তুলে বললেন,
” এই বাড়িতে আমাদের কাজের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে যেটুকু ছিলো তা কমপ্লিট করেই এখানে এসেছি আমি। ”
আমি পুনরায় উত্তরহারা হয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ বাদে আদ্রিশ সোজা হয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মনোমুগ্ধকর এক হাসি দিয়ে বললেন,
” চলো,কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাই মিশমিশ!”

আদ্রিশের কথা আমার কানে বেশ অদ্ভুত শোনালো। উনার কথার অর্থ বের করতেও কিয়ৎক্ষণ সময়ের প্রয়োজন হলো আমার। অতঃপর অর্থোদ্ধার করতে না পেরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”

আদ্রিশ মুখ ফিরিয়ে হেসে দিলেন। বললেন,
” ইশ! সব কথা বুঝিয়ে বলতে হয় তোমাকে! বললাম যে, চলো একটু হাঁটতে যাই।”

উনার কথায় আমি বিস্মিত চাহনিতে উনার দিকে কিয়ৎকালের জন্য চেয়ে রইলাম। অতঃপর চেয়ারের সাথে আঁটসাঁট হয়ে বসে বললাম,
” মোটেও না। আমি আপনার সাথে হাঁটতে যাবো কেনো! আজব তো! আমি আপনাকে চিনি না কি!”

আমার কথায় কৌতুক শোনার পর লোকে যেমন হেসে উঠে, আদ্রিশ ঠিক তেমনভাবে হেসে উঠলেন। বললেন,
” আমাকে চিনো না জানো না, অথচ সেদিন আমার কোলে উঠেই কতক্ষণ থাকলে তুমি! ”

উনার কথায় লজ্জায় আমার কানজোড়া গরম হয়ে পড়লো। আমি পুনরায় বাকহারা হয়ে পড়লাম। উনার নজর হতে বাঁচবার জন্য নত মস্তকে বসে রইলাম। আদ্রিশ দ্রুতই হাসির বেগ থামিয়ে দিলেন। অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” চেনাজানা করতে সময়ের প্রয়োজন হয়। সে সময়টুকু তো দিতে হবে আমাকে।”

আমি মাথা তুলে উনার দিকে চাইলাম। তবে কোনোরূপ কথা বললাম না। উনি এবার আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” বিশ্বাস হয় না আমার উপর?”

আমি ফ্যালফ্যাল চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। এ প্রশ্নের হ্যাঁ বা না সূচক কোনো জবাবই দিতে ইচ্ছে করছে না আমার। কারণ হ্যাঁ সূচক জবাব দিতে কেনো যেনো বিবেকে বাঁধছে । আবার না সূচক জবাব দিতে মন বাঁধা দিচ্ছে। কারণ আমার মনের কোথা হতে জোড়ালোভাবে একটা উত্তর ভেসে আসছে,’ হ্যাঁ। আমি আপনার উপর বিশ্বাস করি।’ তবে এ জোরালো উত্তরটা যে অবিশ্বাস্য! কারণ একদিনের সাহায্যে, কিছু সময় কাটানোয় আমি কি করে একটি ছেলের উপর ভরসা করতে পারি! তবে অদ্ভুত হলেও সত্য। আমি দ্রুতই আদ্রিশের উপর ভরসা করে বসেছি।

আদ্রিশ আমার দিকে উত্তরের আশায় কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন। অতঃপর হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোমার বিশ্বাস কখনোই চূর্ণ হতে দিবো না আমি। এটা তোমাকে মানতেই হবে। যদি কখনো বিশ্বাস ভেঙে ফেলি তবে আমার চেহারা কোনোদিনও দেখাবো না তোমায়।”

আমি পূর্বের ন্যায় নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার কথাগুলো খুব ভালো লাগলো আমার।
উনি এবার আমায় বললেন,
” তো যাওয়া যাক?”

আমি কি মনে করে হঠাৎ বলে উঠলাম,
” কিন্তু আমার যে পায়ে ব্যাথা।”

আদ্রিশ প্রশস্ত হাসলেন। বললেন,
” আমরা দৌড় প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করতে যাচ্ছি না৷ আর ধীরে হাঁটায় যে তোমার সমস্যা নেই তা জানি। এবার উঠো।”

আদ্রিশের কথা অগত্যাই চেয়ার ছেড়ে উঠলাম আমি। অতঃপর উনার পিছু পিছু গেট হতে বের হয়ে পাশাপাশি হাঁটা ধরলাম আমরা। গেট হতে বের হতে না হতেই আদ্রিশের ফোনে কল এলো। উনি কল রিসিভ করে ওপাশের ব্যাক্তিটির কথা শুনে বললেন,
” আমি মিস্টার এণ্ড মিসেস ইকবালকে বলেছি, আমি উনাদের সাথে কোনো প্রকারের ডিল করবো না৷ উনাদের মুখের উপর ‘না’ বলা সত্ত্বেও উনারা কোন মুখ নিয়ে উঠে এসেছেন!”

“…….. ”

” মিস্টার ইকবালকে চলে যেতে বলো। আমার ফ্রেন্ডের রিসেপশনের পার্টিতে আছি আমি। আজকে কোনোভাবেই উনার সাথে দেখা করবো না। ”
এই বলেই উনি খট করে কল কেটে দিলেন। এদিকে উনার জবানে ‘মিসেস ইকবাল’ নামটি কিছুটা পরিচিত শোনালো আমার কানে। ক্ষণিকের বিচার বিবেচনায় মুহূর্তেই সেদিনকার কলের কথা মনে পড়লো আমার। দুদিনে মিসেস ইকবাল নামটি শোনায় একই সুতোয় এদের গাঁথতে সময় লাগলো না আমার।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৩

চারপাশে মৃদুমন্দ হীম হাওয়া বইছে। আকাশে সূর্যের দেখা মেলা ভার। পরিবেশটা কেমন যেনো গুমোট ভাব ধরে বসে আছে। এ যেনো বৃষ্টির দিনের মতো কোনো অবুঝ কিশোরীর মন খারাপের ফল। নিরুত্তাপ সূর্যের লুকোচুরির ফলে আশপাশ হতে যেনো হীম হাওয়া নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে জাপটে ধরছে আমাকে। ভীষণ শীতচোরা প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় শীতে দাঁতে দাঁত লেগে আসার উপক্রম হলো আমার।
আপুর শ্বশুরবাড়িতে আসার পূ্র্বেই আমি অনুষ্ঠান বাড়ির শীত সম্পর্কে ঠিক অনুমান নিয়েই একটা পাতলা শাল নিয়ে বের হয়েছিলাম। এখানে এসে আমার সে অনুমান সঠিক হয়েছিলো। অর্থাৎ আপুর শ্বশুরবাড়িতে আসবার পর শীত নামক কোনো অনুভূতিই পেলাম না আমি। অথচ প্রায় জনমানবহীন এ রাস্তায় চলতে গিয়ে আপাদমস্তক শীতে কাবু হয়ে পড়লাম আমি। এর একটাই কারণ৷ আপুর শ্বশুরবাড়ি মানুষে গিজগিজ করছিলো, কিন্তু এখানে মানুষের দেখা মেলা ভার। ফলে হীম হাওয়াও সুযোগ বুঝে আমার উপর জুড়ে বসেছে।

আমি এবং আদ্রিশ নিশ্চুপ হেঁটে চলছি। কারোর জবান দিয়ে কোনোরূপ কথা বের হচ্ছে না। আমি বরং তখন আদ্রিশের সেই কলের পর উনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসব বিষয় সম্পূর্ণ উনার ব্যক্তিগত বলে কৌতুহল থাকা সত্ত্বেও আমি এ বিষয়ে নাক গলায়নি। আপাতত সেই ফোনকলের পর হতে আদ্রিশ নিঃশব্দে কিছু সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন। আমিও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলিনি উনার সাথে।

আচমকা শরীরে কাঁটা দেবার ন্যায় এক হীম হাওয়া আমায় স্পর্শ করে গেলো। ফলে গায়ে লেগে থাকা পাতলা শালটা আরো শক্তভাবে শরীরের সাথে চেপে ধরলাম। হাঁটার গতিও ধীর হয়ে এলো আমার৷ আদ্রিশ আমার পাশাপাশি হাঁটছিলেন। হঠাৎ আমার হাঁটার গতি ধীর হতে দেখে তিনিও নিজের হাঁটার গতি ধীর করে নিলেন। আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
” শীত লাগছে না কি?”

পাতলা শালটি গায়ে শক্তভাবে লেপ্টে নিয়ে কোনোমতে বললাম,
” হ্যাঁ। খুব শীত করছে। বাহিরে যে এতো বাতাস জানতাম না। জানলে কখনোও বের হতাম না।”

আমার কথায় আদ্রিশ থমকে দাঁড়ালেন। উনাকে দেখে আমিও হাঁটা বন্ধ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” হঠাৎ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? ফিরে যাবেন?”

আদ্রিশ মুচকি হাসলেন। আমার দিকে চেয়ে নিজের পরনের কোট খুলতে খুলতে বললেন,
” ফিরে যাওয়ার মতলব থাকলে এতোদূর আসতাম না। তোমাকে এই ঠাণ্ডা হতে বাঁচানোর একটা উপায় খুঁজে বের করলাম। যেনো আরো কিছুদূর আমরা একসাথে চলতে পারি।”

এই বলে আদ্রিশ পরনের কোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” নাও, এটা গায়ে জড়িয়ো নাও। আর শীত লাগবে না।”

উনার কথা শুনে আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
” ফিল্মের হিরো সাজার পায়তারা করছেন না কি? বাট ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এখানে কোনো ফিল্ম চলছে না। সো আপনার কোট আপনার কাছেই রাখুন। আমি আমার মতোই ঠিক আছি। ”

এই বলে আমি পুনরায় হাঁটতে শুরু করলাম। পিছে আদ্রিশ হয়তো দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ উনাকে আমার পাশে দেখতে পেলাম না।
কয়েক কদম এগিয়ে আসার আমি কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই আচমকা পিছন হতে কেউ আমার শরীরে কিছু জড়িয়ে দিলো। আমি চমকে উঠে নিজের দিকে তাকাতেই সেই কোটটি দেখতে পেলাম৷ এর দ্বারা এক সেকেন্ডও বুঝতে সময় লাগলো না যে কাজটি কে করেছে। অতঃপর আমি পিছনে ফিরে তাকাতেই আদ্রিশের মুখে জয়ী জয়ী একটা ভাব দেখতে পেলাম। আদ্রিশ ততক্ষণে আমার পাশাপাশি এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
” সব জায়গায় মুড দেখাতে নেই মিশমিশ।”

আমি কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” আশ্চর্য তো! আমি কখন মুড দেখালাম? যা সত্য তাই বলেছি আমি।”

এই বলে আমি উনার কোটটি খুলে নিতে গেলাম। কিন্তু উনি আমার কাঁধের উপর হাত রেখে আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে বললেন,
” তোমাকে কোটটা শীত কাটাবার জন্য দিয়েছি। হিরো সাজতে নয়।”

উনার পরোক্ষ স্পর্শে আমি তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঝাঁকিয়ে উনার হাত সরিয়ে নিলাম। উনার দিকে চেয়ে ক্রোধিত কণ্ঠে বললাম,
” ফিল্মের হিরোদের মতোই তো কাজ করছেন আপনি৷ ফিল্মের হিরোরা যেমন নায়িকাকে শীত থেকে বাঁচাতে নিজের কোট বা জ্যাকেট খুলে নায়িকাকে দিয়ে দেয় আর নিজে পাতলা শার্টে থাকে। তবুও শীত করে না। আপনার ক্ষেত্রেও তো তাই হয়েছে।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ সরু চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। অতঃপর ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” ওহহো মিশমিশ…..নিজেকে ফিল্মের হিরোইন মনে করছো তুমি! নট ব্যাড…….”

আদ্রিশের কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র আমি থ বনে গেলাম। উনি যে কথাটা এভাবে আমার দিকে ঘুরিয়ে দিবেন তা কল্পনাও করতে পারিনি আমি। অতঃপর হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতি হতে বেরিয়ে এসে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
” আমার কথাটাকে আপনি একশো আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিলেন! এটা মোটেও আশা করিনি আমি।”

আদ্রিশ জয়ী হাসি হাসলেন। উনার এ হাসি দেখে কি মনে করে মুহূর্তেই আমি জোশের মাথায় বলে ফেললাম,
” আমাকে কোটটা দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তো তাই না? ব্যস, এবার কোটটি আপনি ফেরত পাবেন না। ”

আদ্রিশ যেনো এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিলেন। আমার কথা শুনে উনি আয়েশি ভঙ্গিতে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আমিও তো এটাই চাই। তোমাকে তো আমি ফেরত দেবার কথা বলিনি। রাখো কোটটা তোমার কাছে। বরং এটা পরেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দাও। আমি খুশি হবো।”

” আপনার খুশি দেখে তো আমার কাজ নেই। ওটা আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম। আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আপনার কোট নিবো। যার সম্পত্তি তার কাছেই মানায়৷ ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ির গেটে ঢুকবার আগেই আপনি কোটটা নিয়ে নিবেন। ”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” এজ ইউর উইশ। ”

উনার কথা শুনে বেশ স্বস্তি পেলাম আমি।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে আদ্রিশ রাস্তা বদলিয়ে বললেন,
” চলো, আমাদের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসি তোমাকে। ”

আমি নিশ্চুপে পথ চলতে চলতে মাথা নাড়িয়ে উনার কথায় সায় দিলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই উনি ডুপ্লেক্স একটি বাড়ির সামনে এনে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন,
” এটাই আমাদের বাড়ি। ইমাদদের বাড়ি থেকে সোজা রাস্তায় মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে এখানে আসতে। আজ তোমাকে একটু ঘুরিয়ে এনেছি বলে সময় লাগলো। ”

আমি একনজর উনাদের বাড়ির উপরিভাগ দেখে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
“ওহ।”
অতঃপর বাম হাতের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলাম। ঘড়িতে সময় বিকেল চারটা ছুঁইছুঁই। ঘড়ি হতে চোখ তুলে আমি আদ্রিশের দিকে চেয়ে বললাম,
” অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চলুন। সবাই হয়তো যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ ”

” আচ্ছা চলো। আজ আর আমাদের বাড়িতে যেতে বললাম না৷ এর কারণও আছে অবশ্য। যাই হোক, এখন যাওয়া যাক।”
এই বলে উনি হাঁটা শুরু করলেন। উনার পাশাপাশি আমিও হেঁটে চললাম। অতঃপর পাঁচ মিনিটের মাঝে সোজা রাস্তা ধরে আমরা ইমাদ ভাইয়াদের বাড়িতে চলে এলাম৷ ভেতরে ঢুকবার পূর্বে আমি কোটটি খুলে নিয়ে উনার হাতে দিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললাম,
” থ্যাংকইউ।”

আদ্রিশ মৃদু হেসে বললেন,
” ইটস মাই প্লেজার।”

আমি পুনরায় উনাকে বললাম,
” সেদিনের জন্যও থ্যাংকস। ”

আদ্রিশ এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। বরং নিজ হতেই বললেন,
” সবকিছুর জবাব ‘ওয়েলকাম’ দিতে ভালো লাগে না৷ এজন্য কিছু বললাম না। তুমি আবার মাইন্ড করো না যেনো। ”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি এক চিলতে হেসে দিলাম। অতঃপর বিনা বাক্য ব্যয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।

.

বাসায় আসবার পর হতেই ইমাদ ভাইয়ার যত্নআত্তিতে কোনে কমতি রইলো। নানা ধরণের নাস্তা পানি এবং রাতের খাবারের হিড়িক দেখে আমার মাথায় হাত পড়লো। বিরাট এ আয়োজন দেখে আম্মুকে বললাম,
” আম্মু আমি জামাই হবো। আমি কারোর বউ হবো না। জামাই হবো জামাই। আমার এতো এতো যত্নআত্তি আর খাবারদাবার লাগবে। বউ হলে তো আর এসব কপালে জুটবে না।”

আমার কথা শুনে উপস্থিত সকলে একত্রে হেসে উঠে। ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” যাও শালিকা, তোমার জন্য দোয়া করে দিলাম। এমন একটা জামাই পাবে তুমি যে তোমাকে এমন যত্নআত্তিতে রাখবে।”

ইমাদ ভাইয়ার আকাশকুসুম কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম,
” কি যে বলেন ইমাদ ভাইয়া। মেয়ে হয়ে জন্মালে ওসব কপালে জোটে না। ওসব তো আপনাদের ছেলেদের জন্য। ”

এই বলে আমি রান্নাঘরে গিয়ে আম্মু এবং চাচিদের সাথে টুকটাক একটু কাজ করে আপুর রুমে চলে আসি। ইমাদ ভাইয়াকে বাহিরে সবার সাথে আড্ডা দিতে দেখে এবং আপুকে একা রুমে পেয়েই আসি আমি। কারণ আপুর সাথে সেই আননোন নাম্বারের ছেলেটির ব্যাপারে কথা বলা প্রয়োজন।

রুমে ঢুকেই দেখলাম আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। আয়না হতে আমাকে দেখে আপু বিস্তৃত হেসে বললো,
” এতোক্ষণে তোকে পাওয়া গেলো। কোথায় ছিলি তুই?”

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে চুপচাপ আপুর পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু, তোকে একটা প্রশ্ন করবো। একদম ঠিকঠাক জবাব দিবি তো? মিথ্যা বলবি না তো?”

আপু কাজ থামিয়ে আমার দিকে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো,
” কি এমন জিজ্ঞেস করবি তুই?”

আমি সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” তোর কি আগে কারোর সাথে রিলেশন ছিলো?”

মুহূর্তেই আপুর চেহারা পাংশুটে বর্ন ধারণ করলো। নির্বাক চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো আপু। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করবার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। অতঃপর আমি আপুর সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। আপুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আকুতি পূর্ণ সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু, আমাকে বলতে পারিস সব৷ তোর সমস্যা আমার সাথে শেয়ার কর আপু। ঐ ছেলেটি কে? এখনও কি তোদের রিলেশন আছে? তুই কি ঐ ছেলেকে পছন্দ করিস? সব জানতে চাই আপু। সব। প্লিজ আমাকে সবটা বলবি। ”

আপু আমার দিকে কাঁদোকাঁদো চাহনিতে চাইলো। অতঃপর লম্বা একটি শ্বাস টেনে ছেড়ে দিয়ে বললো,
” ঐ ছেলেটাকে তুই চিনিস৷ তোর বান্ধবী রুনুর ভাই রোহান। ”

আপুর কথা কর্ণগোচর হতে আমি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। অতঃপর অবিশ্বাস্যমূলক এ কথা শুনে তাতে বিশ্বাস আনতে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড রুনু? ওর ভাইয়ের সাথে তোমার রিলেশন ছিলো?”

আপুর দু চোখ তখন জলে ভরে উঠেছে। আপু আমার হাতের মুঠো হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। দু হাত দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিয়ে বললো,
” হ্যাঁ। ঐ রুনুর ভাই রোহান। কিন্তু আমাদের কখনও রিলেশন ছিলো না। ”

” তাহলে রোহান ভাইয়া তোমাকে কল জরে ভালোবাসার কথা কেনো বলে? আপু একটু ডিটেইলস এ বলো। ”

” গত আট নয় মাস আগে রোহানের কাছে আমি একটু হেল্পের জন্য নক দিয়েছিলাম। শুনেছিলাম উনার এক ফ্রেন্ড আমাদের ভার্সিটি থেকেই সিএসই নিয়ে পড়েছে। মাঝে একটা প্র্যাক্টিকালে আমায় অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। এজন্যই রোহানের সেই বন্ধুর কনট্যাক্ট নাম্বার নিতে চেয়েছিলাম। টুকটাক কথাবার্তায় রোহানের সেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রবলেম সলভও করে ফেলি। কিন্তু তখনও জানতাম না যে রোহানের কাছে এই সামান্য সাহায্য চাওয়াই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। সে ঘটনার পর থেকে রোহান আমাকে প্রতিদিনই নক দিতো। সামান্য একটু হালচাল জিজ্ঞেস করেই আমাদের কথা শেষ হতো। মাঝেমধ্যে রাস্তায় কখনও দেখা হলে টুকটাক কথা হতো। ব্যস, এভাবেই একদিন রোহান আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমিও ঘুরেফিরে নানা কথা বলে উনাকে রিজেক্ট করে দেই। এরপর উনি চুপচাপ হয়ে যান। তবে কিছুদিন পর থেকে উনি আবারও আমাকে নক করে কথা বলতে শুরু করেন। পরে অতিষ্ঠ হয়ে উনাকে ব্লক করে দিলে উনি রাস্তায় আমার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি উনাকে বারবার উপেক্ষা করতে থাকি। কারণ আমার তরফ থেকে কখনও উনাকে আমি এমন কোনো সাইন দেইনি যাতে উনি মনে করেন আমি উনাকে পছন্দ করি। আমি সবসময় লিমিটে থেকে ফর্মাল কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু এরপরও উনি ভাবতে থাকেন, আমি উনাকে পছন্দ করি।
এভাবে রোজরোজ রাস্তায় উনার কথা বলার চেষ্টা দেখে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ফলে একদিন সবার সামনে উনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলি৷ ব্যস, তারপর থেকে উনি আমার পিছে এমনভাবে পড়ে যান যে আমাকে রাজি করিয়ে তবেই দম নিবেন। এরপর থেকে উনার কর্মকাণ্ডগুলো পুরো উন্মাদের মতো হতে থাকে। গত এক মাস যাবত উনার এ উৎপাত থেকে বাঁচবার জন্য অনেক রাস্তা অবলম্বন করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি৷ পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমার উনাকে সুইসাইড করার হুমকি দিলে উনি চুপ হয়ে পড়েন। কিন্তু তারপরও আমাকে মাঝেমধ্যে কল করে ডিস্টার্ব করে। তুই বিশ্বাস করবি না মিম, আমি উনার কতো নাম্বার যে ব্লক লিস্টে রেখেছি তা আমি নিজেই জানি না।প্রতিবার উনি নতুন নতুন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে কল করে জ্বালায়। আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি মিম। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রোহান কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই না। আমি কি করবো বল আমায়। কি করবো আমি?”

এই বলে আপু নিচে বসে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমিও নিরবে কাঁদতে কাঁদতে আপুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ দরজার উপর দৃষ্টি পড়ায় আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ছাড়তে ভুলে গেলাম যেনো। কারণ দরজায় দাঁড়িয়ে ইমাদ ভাইয়া অবিশ্বাস্য চাহনিতে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here