ভুলবশত_প্রেম,৪৬,৪৭

0
1133

#ভুলবশত_প্রেম,৪৬,৪৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪৬

রিসেপশনের পর অন্যান্য মেয়েরা যেখানে বাবার বাড়ি যায়, সেখানে রিসেশনের পর আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে এলাম৷ এমনটাই অবশ্য হওয়ার ছিলো। কারন অন্যান্যদের মতো বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি না এসে বাবার বাড়ি থেকেছি আমি।

আদ্রিশদের বাড়িতে আসার পর আপু ও জেবা ভাবী আমাকে আদ্রিশের রুমে দিয়ে গিয়েছে। আপুর অবস্থা এখন তুলনামূলক বেশ ভালো। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আপু এমনকি আমরা কেউই এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর আলোচনা করিনি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই চাইছি আপু ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাক। আপু নিজেও এ চেষ্টায় আছে।

আমাকে রুমে দিয়ে আপু ও জেবা ভাবী চলে গেলেন। ফুলে সাজানো রুমের বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছি আমি। অপেক্ষা আদ্রিশের। কিন্তু দশ পনেরো মিনিট পার হওয়ার পরও যখন আদ্রিশ এলেন না তখন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আজকের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারী লেহেঙ্গা ও গহনাদির জন্য ভীষণ গরম লাগছে আমার। এতোক্ষণ অব্দি অপেক্ষা করার পরও আদ্রিশের নামনিশানা না পাওয়ায় আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। বিছানা থেকে নেমেই আমি হাতের চুড়িগুলো খোলা শুরু করলাম। কিন্তু তন্মধ্যে আচমকা রুমের দরজা খুলে আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। আমায় আয়নার সামনে হাত থেকে চুড়ি খুলতে দেখে আদ্রিশ দ্রুত রুমের দরজা লাগিয়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ঈষৎ আঁতকে উঠার প্রয়াস করে বললেন,
” এসব কি মিশমিশ! চুড়ি খুলছো কেনো?”

আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য স্থির দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে তাকালাম। অতঃপর ঠোঁট বাকিয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” তো কি করবো শুনি? সারারাত পরে থাকবো না কি?”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না। বরং আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। আমার গাল দুটো আলতো করে টেনে বললেন,
” ভেঙচি কাটলে একদম বাচ্চাদের মতো মনে হয় তোমাকে। ”
এই বলে উনি ড্রেসিং টেবিলের উপর হতে কিছু সংখ্যক চুড়ি নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” সাজটা যেহেতু আমার জন্য সেহেতু আমি প্রাণভরে যদি তোমায় না-ই দেখলাম তাহলে কি সাজের কোনো মূল্য রইলো?”

আমি নিশ্চুপ রয়ে আড়চোখে আদ্রিশের পানে চাইলাম। আদ্রিশ চুড়ি পরানো শেষে বললেন,
” আমি মানুষটা একান্তই তোমার। এতো লুকোচুরি করে দেখার কিছু নেই। সরাসরি দেখলেই পারো।”

আদ্রিশের ফোঁড়ন কাটায় আমি লজ্জায় চুপসে গেলাম। ফলস্বরূপ নত মস্তকে উনার স্পর্শ হতে নিজেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে নিলাম। উনি আমার এ কাজে ঈষৎ হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” আজ মন ভরে তোমায় দেখবো মিশমিশ। তোমার স্নিগ্ধ রূপের পরশে আজ পুনরায় তোমার ভালোবাসায় মত্ত হবো আমি। আজ আমাকে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। স্বয়ং তুমিও না।”
এই বলে আদ্রিশ আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে পিছানোর সুযোগ না দিয়ে অকস্মাৎ আমার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন উনি৷ ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি কিঞ্চিৎ চমকে উঠলাম। ফলস্বরূপ উনার সাথে ক্ষীণ সময়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো। পুনরায় দৃষ্টি নত করার সুযোগকে প্রশমিত করে উনি অপর হাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে বললেন,
” আমার চোখে চোখ রেখে রাখতে পারবে না?”

আমি লজ্জামিশ্রিত চাহনিতে অবিন্যস্তভাবে এদিক ওদিক চাইলাম৷ পেলব গলায় বললাম,
” উঁহু। এ দুঃসাধ্য সাধনের সাহস আমার নেই। ”

আদ্রিশ আমার থুতনি ছেড়ে আমার হাত ধরলেন। প্রতিটি আঙুলের ভাঁজে আঙুল পুরে ধীরলয়ে বললেন,
” জানো মিশমিশ? কারোর সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো ওয়াদা করা ভীষণ কঠিন৷ আর এ ভীষণ কঠিন কাজটা সেসময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে যখন মন থেকে ভালোবাসার অনুভূতিটা আসে না৷
আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে কাটাতে চাই মিশমিশ। আমি চাই আমার সকল অনুভূতি তোমায় ঘিরেই থাকুক। বুড়ো বয়সেও যেনো আমরা লাঠি ভর দিয়ে একে অপরের হাত ধরে হাঁটতে পারি। এটাই চাওয়া। বিনিময়ে আমি চাই, তোমার অব্যক্ত ভালোবাসায় সবসময় আমায় সিক্ত করে রাখবে। পারবে তো?”

আদ্রিশের এ আকুল আবেদনে আমি অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলাম। মন চাইছে উনার মতোই আপন সুরে আমার জবাবটা জানিয়ে দেই উনাকে। কিন্তু এতো সাহস কুলায় না আমায়। ফলে কম্পনমান কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ”

আমার জবাবে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হাসলেন। অতঃপর আমায় ধীরেধীরে ছেড়ে দিয়ে তিনি বললেন,
” যাও, চেঞ্জ করে আসো। তুমি চেঞ্জ করে আসার পর আমি যাবো৷ এতক্ষণ একটু এসিতে জিড়িয়ে নেই। ”

এই বলে উনি এসির রিমোট নিয়ে এসি চালিয়ে দিলেন। পরনের কোট খুলে প্যান্ট, শার্ট পরিহিত অবস্থায় উনি গিয়ে বসলেন বিছানার উপর। হাতের উপর ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাতে লাগলেন। আমি আর দেরি না করে পরনের গহনাদি খোলা শুরু করলাম।
এ রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে বিছানার অর্ধেকাংশ দেখা সম্ভব। আমি ধীরেধীরে পরনের গহনাদি খুলছি আর আয়নার মাধ্যমে আদ্রিশকে দেখছি৷ উনাকে সরাসরি দেখার সুযোগটা নেই। কারণ উনি সর্বদা আমায় লজ্জা দিতে প্রস্তুত থাকেন। সুতরাং এমন মানুষকে আড়ালে দেখাই শ্রেয়। তবে আর যাই হোক না কেনো, এ মানুষটা তো শুধুই আমার। উনার উপর সকল প্রকার হক অধিকার আরোপ করার ব্যক্তিগত অধিকার রয়েছে আমার৷ মাঝে মাঝে মন চায় আমার মনের সকল অনুভূতি উনার সামনে খোলা বইয়ের ন্যায় মেলে ধরি৷ কিন্তু এ অনুভূতির কিতাব উনার সামনে খোলা মাত্রই তা অগোছালো শব্দগুচ্ছের ন্যায় জমাট বেঁধে যাবে৷ গাঢ় হয়ে জড় হবে কণ্ঠনালীতে। ফলস্বরূপ হৃদয়ের বুলিগুলো প্রকাশ করতে ব্যর্থ হবো আমি।
আয়না দিয়ে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি আদ্রিশকে। সাদা শার্টে দারুন মানিয়েছে উনাকে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঘন ভ্রুজুগল, খাড়া নাক সব যেনো একদম পরিমিত অনুপাতে সঠিক জায়গায় আছে। তার উপর এ মুহূর্তে ব্যাপৃত চোখজোড়ায় দেখা মিলছে রাজ্যের ব্যস্ততা। উনায় দেখে মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু দেখছেন, ভাবছেন। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবুক মুখশ্রীতে ক্ষুদ্র দার্শনিকের ছাপ এঁকে রাখছেন। এ যেনো মুহূর্তেই শশব্যস্ত হয়ে পড়া অদ্ভুত এক মানুষের আত্মা!

.

রাত গভীর হওয়ায় শীতল অনুভূতিটা আরো জেঁকে বসলো। চুলে হেয়ার স্প্রে থাকায় এই গভীর রাতেও বাধ্য হয়ে চুলে শ্যাম্পু করতে হয়েছে আমার। ফলস্বরূপ অসময়ের এ কাজে শরীর হিম করে দেওয়া শীত লাগতে শুরু করলো। ভেজা, ঠাণ্ডা চুলগুলো ছেড়ে শীতে অল্প-বিস্তর কাঁপতে লাগলাম আমি। তন্মধ্যে আদ্রিশ ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলেন। আমায় এভাবে কাঁপতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” শীত লাগছে?”

আমি ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে মাথা দুলিয়ে বললাম,
” হুম। ”

আদ্রিশের চেহারা এ পর্যায়ে আরো একটু উদ্বিগ্নতায় ছেয়ে গেলো। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে তৎক্ষনাৎ আমার ভেজা চুলগুলো পেঁচিয়ে বললেন,
” তোমার শরীরে শীত যেহেতু এতো বেশি সেহেতু এই রাতে চুল না ভেজানোই উচিত ছিলো। ”

” না ভিজিয়ে উপায় ছিলো না। চুলে হেয়ার স্প্রে ছিলো। আর এই স্প্রে নিয়ে আজ ঘুমানো মানে চুলের বারোটা বাজানো। ”

আদ্রিশ মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক আওয়াজ বের করে বললেন,
” ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসো।”

” কেনো?”

” আহহা, প্রশ্ন না করে বসো তো।”

আদ্রিশের কথা মান্য করে বাধ্য মেয়ের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম। আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার লাগেজে হেয়ার ড্রায়ার আছে না?”

” আছে তো। কিন্তু আমি ব্যবহার করবো না। ”

” কেনো? ”

” চুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। আর একবার এটার অভ্যেস হয়ে গেলে আমার মাথার সব চুল নাই হয়ে যাবে। ”

” বিপদে একদিন ব্যবহার করলে কিছু হয় না। ”
এই বলে আদ্রিশ আমার লাগেজ থেকে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে এসে আমার চুল শুকিয়ে দিতে লাগলেন।
চুল প্রায় শুকিয়ে এলে আমার শীত শীত ভাবটা কমে গেলো। আমি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আদ্রিশ বললেন,
” এই কাজটা আগেভাগে করলে এই শীতটা আর লাগতো না।”
এই বলে উনি আয়নার মাধ্যমেই আমার দিকে চাইলেন। খোলা চুলে আলতো হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ গলায় বললেন,
” খোলা চুলে তোমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায় মিশমিশ। খোলা চুলে তুমি যেনো অন্য এক রমনী হয়ে উঠো। ”
বলেই উনি মুহূর্তমধ্যেই ভ্রু কুঁচকে ভাবুক গলায় বললেন,
” তবে এ সুন্দরী রমনীর সৌন্দর্যতায় একটি কমতি রয়ে গেলো। ওয়েট, এখানেই বসো। আমি আসছি।”
এই বলে উনি আমায় রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালেন। সেই সুযোগে আমি হেয়ার ড্রায়ারটা আপাতত লাগেজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম।

আদ্রিশ ব্যালকনিতে গিয়ে মাধবীলতার এক গুচ্ছ এনে আমার সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর আলতো করে আমার বাম কানের পিছনে চুল সরিয়ে দিয়ে সেখানে মাধবীলতা গুঁজে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন,
” এই না হলে পরিপূর্ণ রমনী। আদ্রিশের মাধবীলতা। ”

উনার প্রশংসামূলক বাক্যে আমি ঈষৎ লাজুকমিশ্রিত হাসি হাসলাম। উনি বললেন,
” তুমি কি জানো, মাধবীলতা ফুলে তোমার সুপ্ত সৌন্দর্যটা মন উজার করে প্রকাশ পায়?”

প্রত্যুত্তরে আমার বলার মতো কিছু রইলো না বিধায় চুপচাপ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আদ্রিশও কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর
অকস্মাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্থর কণ্ঠে বললেন,
” একটা গোপন কথা কি জানো মিশমিশ?”

অকস্মাৎ উনার এহেন আগমন, উনার এ কণ্ঠস্বর আমায় স্থবির করে তুললো। আমি কোনো রকমে বললাম,
” কি গোপন কথা?”

আদ্রিশ আমার কানের আরো নিকটে ঠোঁট এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
” তোমায় ভালোবাসি। অপরিমেয় ভালোবাসি। ”

এ প্রথম উনার মুখ নিঃসৃত ‘ভালোবাসি’ শব্দটি শোনা মাত্র আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। অতিশয় অনুভূতিতে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। হাত পা যেনো অবশ হয়ে এলো। এমতাবস্থায়ও আমি কি মনে করে কম্পিত কণ্ঠে ধীরলয়ে বললাম,
” তা আমার অগোচরে নেই আদ্রিশ।”

আদ্রিশ আমার কথায় ক্ষীণ শব্দে হেসে উঠলেন। আমার কোমড় চেপে পূর্বোক্ত অবস্থায় থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিলেন। পুনরায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন,
” ভালোবাসি জানো। তবে এ ভালোবাসার সীমা তোমার অজানা মিশমিশ। একজনকে কতোটা ভালোবাসলে নিজের মধ্যকার সবকিছু হারিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে বসে তা তোমার জানা নেই মিসেস মিম আরসালান আহমেদ আদ্রিশ। এর পরিসীমা সম্পর্কে তুমি কখনও অবগত হতে পারবে না। কারণ তুমি কখনও আমার মতো ভালোবাসতে পারবে না। কখনও না। মাই লাভ হ্যাজ নো লিমিট মিশমিশ।”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৭

তিনদিনের ছুটি কাটাতে আমরা গন্তব্য হিসেবে ঠিক করলাম সিলেট শহরকে। এ সিদ্ধান্ত অবশ্য আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশ। আমাকে জানানো হয়েছে গতকাল রাতে। গতকাল ক্লান্ত থাকায় ব্যাগপত্র গোছানোর সময় পাইনি৷ এজন্য আজ সকাল থেকেই সব গোছগাছ শুরু করলাম।
সকালের নাস্তা শেষে আমি ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। এদিকে আদ্রিশ যে তিনদিন শহরে থাকবেন না সে কারণে ল্যাবের কিছু কাজ এক সহকর্মী জুনিয়রকে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে সেই এক ঘণ্টা যাবত অনবরত ফোনে লেগে আছেন উনি।

আমার জামাকাপড় ব্যাগে ভরে আদ্রিশের জামাকাপড় গুছাতে শুরু করলাম। আলমারি থেকে উনার টিশার্ট, প্যান্ট নিয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। আলমারি থেকে গুছানো একটি শার্ট উঠিয়ে নিতেই শার্টের নিচে উনার পিস্তল আবিষ্কার করলাম আমি। আচমকা পিস্তলটি দেখে খানিক চমকিত হলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম৷ কারণ আদ্রিশের কাছে পিস্তল থাকার ব্যাপারটি এখন স্বাভাবিক। তবে সেদিন উনার কাছে পিস্তলটি না দেখলে আজকে এটি স্বাভাবিক মনে হতো না আমার কাছে৷ সেদিন ঘটনাস্থলে আদ্রিশের কাছে পিস্তল দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্কে প্রশ্ন খেলে গিয়েছিলো, আদ্রিশের কাছে পিস্তল এলো কি করে? কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সেদিন প্রশ্নটা করা হয়ে উঠেনি এবং এ তিনদিনেও ছোট বড় ব্যস্ততার বেড়াজালে উনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে আজ যেহেতু সময় ও সুযোগ উভয়ই আছে সেহেতু উনাকে এ ব্যাপারে আজ জিজ্ঞেস করতেই হবে।
আমি মন্থর গতিতে পিস্তলটা হাতে নিলাম। জিনিসটা দেখতে ছোট হলেও ওজনে একটু ভারী। এতোদিনে সিনেমায় দেখে আসা পিস্তল আজ সচক্ষে নিজ হাতে ছু্ঁয়ে দেখলাম। জীবনে প্রথম আসল পিস্তল হাতে নিয়ে অকারণেই একটু ভয়জনক অনুভূতি হলো। কিয়ৎক্ষণ পিস্তলটি এদিকে ওদিক ঘুরিয়ে দেখলাম৷ অতঃপর সেটি নিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। আদ্রিশ পুরো ব্যালকনি পায়চারি করে কথা বলছেন। হঠাৎ পিস্তলসহ আমাকে ব্যালকনিতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন উনি। মুহূর্তেই উনায় চেহারায় ক্ষীণ আঁতকে উঠা ভাব বিরাজ করলো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলেই উনি ফোন কানে নিয়ে ইশারায় আমাকে বাধা দিলেন। আমিও আগ বাড়িয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
দু মিনিটের মাঝেই আদ্রিশ ফোন রেখে দ্রুত আমার হাত থেকে পিস্তল নিয়ে নিলেন। প্রায় ধমকের সুরে বললেন,
” এটা বের করেছো কেনো?”

আমি সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কাছে পিস্তল এলো কি করে?”

আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আদ্রিশ পিস্তলটি নিয়ে আলমারিতে রাখলেন। অতঃপর আমাকে রুমে এনে নরম গলায় বললেন,
” তুমি প্রথম যেদিন আমার রুমে এসেছিলে সেদিন দেয়ালে ঐ শ্যুটিং ফেডারেশনের ঐ সার্টিফিকেটটা দেখোনি?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে চাইলাম। দেয়ালের সার্টিফিকেট লাগানো ঐ অংশের নিচের দিকে তাকালাম। আমি সার্টিফিকেটটা খুঁজে পেয়েছি বুঝতে পেরে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে বললেন,
” সার্টিফিকেটটা হাওয়ায় উড়ে আসেনি মিশমিশ। সার্টিফিকেটটা পেয়েছি এই পিস্তল চালানোর উপর ভিত্তি করেই।”

আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এর মানে আপনি পিস্তল চালাতে পারেন!”

” অবশ্যই এবং আমি এতোটুকু কনফিডেন্ট যে আমার টার্গেট কখনো মিস হয় না। একদম সঠিক নিশানায় গিয়ে গুলি লাগে। ”

আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো৷ কিন্তু এর পূর্বেই আমার ফোনে আপুর নাম্বার দিয়ে কল এলো। আমি কল রিসিভ করতেই আপু স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” রেডি হয়েছিস মিম?”

” উঁহু। এখনো না। তোমরা?”

” রেডি হবো। ইমাদ বলছে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে। না হলে সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। তোদের ব্যাগ গুছানো শেষ? ”

” হ্যাঁ। আচ্ছা আমরা তাহলে রেডি হচ্ছি।”

” আচ্ছা। রেডি হয়ে কল দিস।”

আপু ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়ার পর আদ্রিশকে বললাম,
” আপু রেডি হতে বলেছে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বের হবে বলে। ”

আদ্রিশ আলমারি থেকে একটা টিশার্ট ও জিন্সের প্যান্ট বের করে বললেন,
” আচ্ছা। রেডি হয়ে নাও তুমি। আমিও রেডি হয়ে নেই। ”
এই বলে আদ্রিশ ওয়াশরুমে চলে গেলেন৷ আর আমি বাকি জামাকাপড় গুছাতে লাগলাম।

.

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু প্রথম দফায় কেউ কল রিসিভ করলো না৷ আমি চোখ মেলে সামনে তাকালাম। আদ্রিশ ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে আর ইমাদ ভাইয়া ফ্রন্ট সিটে বসে আছে৷ আমি আর আপু পিছনে বসে আছি। আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি ইমাদ ভাইয়াদের গাড়িতে করে। লম্বা দূরত্বের রাস্তা হওয়ায় আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া পালাক্রমে ড্রাইভ করবেন বলেই সামনে বসেছেন। আমি আর আপু বসেছি পিছনে।
এ মুহূর্তে আপু হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। আমার ঘুম একবার ভেঙে যাওয়ায় আবারো আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুনরায় ফোন বেজে উঠলো। রিংটোনের শব্দ শুনে বুঝলাম, আদ্রিশের ফোনে কল এসেছে আদ্রিশ ড্রাইভ করতে করতেই বললেন,
” ইমাদ, কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দে তো। কে কল করেছে দেখি। ”

ইমাদ কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলেন৷ সাথে সাথে ওপর পাশ হতে একটি অর্ধপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” মিস্টার আদ্রিশ বলছেন?”

আদ্রিশ বললেন,
” জি। আপনি শাহেদ সাহেব না?”

” জি জি৷ তাহলে চিনতে পেরেছেন। ”

” জি অবশ্যই। হঠাৎ আমায় ফোন করলেন যে অফিসার?”

” আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো। একচুয়েলি আপনাকে সাবধান করতেই আমি কল করেছি। ”

আদ্রিশ সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার কথা বুঝলাম না অফিসার। কি নিয়ে সাবধান করবেন?”

ওপাশে শাহেদ সাহেবের ক্ষীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বিত কণ্ঠ,
” রোহানের বেইল হয়ে গিয়েছে মিস্টার আদ্রিশ। ”

শাহেদ সাহেবের কাছ থেকে এ খবর শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রোহান ভাইয়ার বেইল পাওয়ার কথা শুনে দু চোখ থেকে আধো আধো ঘুমের রেশটুকু কেটে গেলো৷
আদ্রিশ আকাশসম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কবে কখন হলো! ও বেইল পেলো কি করে?”

” ওকে অ্যারেস্ট করার পরেরদিনই বেইল পেয়ে গিয়েছিলো ও। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মিস্টার রোহানের বাবা একজন বড় রাজনীতিবিদ। উনার সামনে এসব কিছুই না মিস্টার আদ্রিশ। ”

” তো আপনি আমাকে আগে বলেননি কেনো অফিসার!”

” ইমাদকে বলেছিলাম আমি। কিন্তু ও বললো, সামনে আপনাদের রিসেপশন। এ কারণে যেনো আপনাকে এসব জানিয়ে শুধু শুধু টেনশন না দেই। যাই হোক, আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন। কারণ রোহানের হাবভাব আমার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট হিংস্রতা দেখেছি আমি। এজন্য বলবো, সাবধানতা অবলম্বন করুন। ”
এই বলে উনি নিমিষের জন্য থামলেন। পুনরায় বললেন,
” আমি পরে কথা বলছি মিস্টার আদ্রিশ। থানায় একজন আসামীকে আনা হয়েছে। তারা খাতির ব্যবস্থা করতে হবে। ”

আদ্রিশ ক্ষীণ শব্দে বললেন,
” আচ্ছা অফিসার।”

এরপর হয়তো শাহেদ সাহেব কল কেটে দিলেন। তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ গাড়িতে ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন। অকপট রাগ দেখিয়ে ইমাদ ভাইয়াকে বললেন,
” তুই আমাকে এ ব্যাপারে আগে বলিসনি কেনো ইমাদ! ”

ইমাদ ভাইয়া মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
” তোদের রিসেপশন ছিলো বিধায় বলতে চাইনি৷ আর আমি চাই না নাফিসা বা মিম এ ব্যাপারে জানুক। নাফিসার কাছে রোহান এখন একটা আতঙ্কের নাম।”

” তো তুই কি ভেবেছিস, আমি নাফিসা ভাবীকে এ ব্যাপারে বলতাম?”

” বলতি না। কিন্তু আমি তোদের কাউকেই এ ব্যাপারে জানাতে চাইনি৷ শাহেদকেও বলেছিলাম না জানাতে। কিন্তু ও কি মনে করে তোকে বললো বুঝলাম না। ”

” আশ্চর্য! আমাদের জানাতে চাসনি কেনো? এখন রোহান কিছু করে বসলে?”

ইমাদ ভাইয়া এবার খানিক রেগে গেলেন। বললেন,
” তো! রোহানের ভয়ে আমরা কতদিন গুটিয়ে থাকবো? কতদিন বাসায় বসে থাকবো?”

আদ্রিশ আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো ইমাদ ভাইয়ার যুক্তির সাথে উনিও সহমত প্রকাশ করেছেন।
খানিক সময় পর উনি বললেন,
” ওদের দুজনকে এ ব্যাপারে কিছুই জানতে দেওয়া যাবে না। ওরা ঘুমাচ্ছে না এখন?”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি যে রোহান ভাইয়ার ব্যাপারে জেনে গিয়েছি তা উনাকে জানতে দেওয়া যাবে না। এতক্ষণ চলমান ঘুমের অভিনয় এখনও চালিয়ে গেলাম আমি৷
ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” এখন বাসায় ব্যাক করবি না কি?”

” তা কি করে সম্ভব। আমরা তো সিলেট শহরে ঢুকে পড়েছি। ”

ইমাদ ভাইয়া আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে চাপা ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এলো। বন্ধ চোখের সামনে বারবার রোহান ভাইয়ার চেহারা ভেসে এলো৷ সেদিন শেষ মুহূর্তে উনার চেহারায় যে হিংস্রতা লক্ষ্য করেছি তা সে মুহূর্তে আমাকে ভীত করে না তুললেও এখন ঠিকই আমাকে ভয়ের অতল সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। জানি না সামনে কি হবে। তবে মনেপ্রাণে চাইছি, খারাপ কিছু যেনো না হয়৷ চোখ বন্ধ রেখেই আল্লাহর নাম নিচ্ছি।

.

সিলেট পৌঁছে আমরা হোটেলে উঠেছি কিছুক্ষণ পূর্বেই। পাশাপাশি দুটো রুম খালি না পাওয়ায় ইমাদ ভাইয়া ও আপু উঠেছে চতুর্থ তলার একটি রুমে। আর আমি ও আদ্রিশ উঠেছি তৃতীয় তলার একটি রুমে।

রুমে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আদ্রিশ কিছু কাজে বেরিয়ে পড়লেন। আমায় বললেন, জরুরি কিছু কাজ আছে এবং এ জরুরি কাজটা কি তা আমি ঢের আন্দাজ করতে পেরেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই আদ্রিশ রোহান ভাইয়া সম্পর্কিত কোনো কাজেই বেরিয়েছেন।
আদ্রিশ রুম থেকে বেরুনোর পূর্বে আমায় সতর্কতার সহিত বলে গেলেন উনি বাদে অন্য কেউ আসলে যেনো আমি দরজা না খুলি। রোহান ভাইয়ার বেইল হওয়ার খবরটা আমার জানা থাকায় এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর প্রশ্ন করিনি উনাকে। আদ্রিশ বেরিয়ে যেতেই আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দীর্ঘ জার্নির কারণে ক্লান্তি শরীর নিয়ে বেশি সময় ওয়াশরুমে রইলাম না আমি৷ দশ মিনিটের মাঝেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই হঠাৎ সোফায় কাউকে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলাম আমি। আমার চমকানোর মাত্রা আরো বেড়ে গেলো যখন সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটিকে রোহান ভাইয়া হিসেবে চিনলাম আমি। অস্ফুটস্বরে উনার নাম নিতেই উনি মুহূর্তমধ্যে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন৷ আতঙ্কে চিৎকার করার পূর্বেই রোহান ভাইয়া আমার সামনে কি যেনো স্প্রে করলেন৷ ক্ষণেই কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here