#আলতা_রাঙা_পা,পর্ব (২)
#রোকসানা_রাহমান
” আপনার পা-দুটো তো খুব সুন্দর। আলতা পরলে বেশ মানাবে। ”
আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। বিস্মিত নয়নজোড়া তার দিকেই স্থির হলো। এমন করে পায়ের প্রশংসা পাইনি কখনও। তাই হয়তো আমাকে থামিয়ে দিল। অথবা সুকণ্ঠে আমাকে আকৃষ্ট করল।
” নিয়ম করে আলতা পরেন, তাই না? আজ পরেননি যে? ভুলে গেছেন? ”
তার বিরতিহীন প্রশ্নে আমার ঘোর কেটে গেল। বিস্ময়ের জায়গায় বিরক্ত জায়গা করে নিল। কঠিন হয়ে বললাম,
” উঠুন। ”
বিপরীতে সে নরম চাহনি দিল। জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়ল না। যেন কিছু হয়নি এমনভাবে আবার বলল,
” আলতা নেই? ফুরিয়ে গেছে? আমি এনে দেব? ”
তার কৌতূহলপনায় আমার ভারি রা’গ হলো। বার বার পায়ে তাকানোর ফলে অস্বস্থি চেপে ধরল লজ্জায় ঢাকা কায়ায়! আমি আলগোছে পাজানার নিম্নাংশ দিয়ে পা ঢেকে রাখার চেষ্টায় মেতে উঠলাম। সে বসা থেকে দাঁড়াল। আমার দিকে একপা এগিয়ে বলল,
” কোথায় পাওয়া যাবে বলেন, আমি এনে দিচ্ছি। ”
আমি ক্রু’দ্ধ নয়নে ফিরে তাকালাম। বললাম,
” বেরিয়ে যান। ”
সে বোকা চোখে তাকিয়ে থাকলে আমি জোর দিয়ে বললাম,
” আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান। এখনি। ”
সে বের হলো না। কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিরুদ্বেগে বলল,
” আমি তো থাকতে আসিনি। দেখতে এসেছি। ভালো করে দেখি, তারপর চলে যাব। ”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে আমার রুমের সবকিছু খুঁটে খুঁটে দেখছে। আমি রা’গে-ক্ষো’ভে তার দিকে ধে’য়ে গেলে সে চটজলদি বলল,
” তিন্নি চা আনতে গিয়েছে। আসুক। চা খাই….”
” আপনি বের হবেন না? ”
” আমি তেমনটা…”
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আমি বললাম,
” ঠিক আছে৷ আপনি থাকুন, আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি। ”
কথাটা বলতে বলতে আমি নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ধপধপ পা ফেলে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে তিন্নির সামনে পড়লাম। সে ট্রে হাতে পথ আটকে বলল,
” তোদের কথা শেষ? ”
আমি রা’গে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
” তোকে বলেছিলাম আমাকে সাহায্য করতে, আর তুই এটা কী করছিস? ”
” তোকেই তো সাহায্য করছি। ”
” এভাবে? ছেলেকে আমার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে? তুই তো আমার বাবা-মায়ের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। আমি যতদূর জানি তারা এই কাজটা করতে হাজারবার ভাবত! ”
তিন্নি আমাকে মানাতে নরম হয়ে বলল,
” তুই ভুল বুঝছিস, তায়্যু। ”
আমি উ’ত্তে’জিত হয়ে পড়লাম। খানিকটা চ’ড়াগলায় বললাম,
” আমি ঠিকই বলছি। ”
তিন্নি মাথা নেড়ে আরেকটু নরম হয়ে কিছু একটা বলতে চাইলে আমি থামিয়ে দিলাম। বললাম,
” তুইও আমাকে বুঝলি না? কেন তিন্নি? সেই ছোট্টকাল থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আমার কোন ব্যাপারটা তুই জানিস না? কোন ঘটনাটা অজানা? বাবা-মা যা জানে না তুই সেটাও জানিস। তবুও এমন করলি? ”
তিন্নি অসহায়ের মুখ বানিয়ে বলল,
” আমার কথাটা তো শোন, তায়্যু! ”
” কিছু শোনার নেই। তুই খুব ভালো করেই জানিস, এসব বিয়ে-টিয়েতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কেন নেই সেটাও জানিস। ”
” জানি বলেই তো ভাইয়াকে নিয়ে এসেছি। ”
আমি একটু চমকে বললাম,
” ভাইয়া! ”
তিন্নি একটু স্বাভাবিক হলো। সা’হ’স কুড়িয়ে বলল,
” তোকে যে দেখতে এসেছে সে আমার ভাইয়া হয়। চাচাত ভাই। নাম অমিত হাসান। খিলক্ষেতে পরিবার নিয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। বিয়ের জন্য চাচি মেয়ে খুঁজছেন”
” আর তখনই আমার কথা মনে হলো? ”
তিন্নি দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়লে আমি কাঠ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেন? ”
তিন্নি বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
” তোর ভুল ভাঙানোর জন্য। ”
” ভুল? ”
” হ্যাঁ, ভুল। ছোটবেলা থেকে তুই মনের মধ্যে যে ভুলের বাসা বেঁধেছিস তা ভেঙে দেওয়ার জন্য। অমিত ভাইয়াকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। তার আচার-ব্যবহার মুখস্থ। আর সেখান থেকেই আমার বিশ্বাস হয়েছে তোর ভুল যদি কেউ ভাঙাতে পারে সে অমিত ভাইয়া। সেজন্যই তোকে না জানিয়ে ভাইয়াকে তোর ছবি দেখিয়েছিলাম। এক দেখায় পছন্দ করে ফেললে আমি আন্টিকে জানাই। ”
” ওহ, তার মানে এই সবকিছু তোর পরিকল্পনা? ”
তিন্নি একটু থামল। বুঝতে পারল অমিতের ব্যাপারে আমি মোটেও কৌতূহলী নই। তাই বলল,
” একটু বোঝার চেষ্টা কর, তায়্যু। একটা মানুষের পক্ষে একা একা সারাজীবন থাকা সম্ভব নয়। একটা সময়ে গিয়ে মন চাইবে কেউ পাশে থাকুক। শ’রী’র চাইবে কেউ তাকে ছুঁয়ে থাকুক। ”
আমার ধৈর্য ধরা মনটা হঠাৎই ক্ষি’প্ত হয়ে গেল। চু’র’মা’র করে দিতে ইচ্ছে করল তিন্নির মাত্র বলা কথাটুকু। তীব্র প্র’তি’বাদ করে বললাম,
” পারে, অবশ্যই পারে। আর সেটা আমি প্রমাণ করে দেব। ”
তিন্নি আমার প্রতিবাদ আমলে নিল না। নিজের ইচ্ছেটাকে চাপিয়ে দিতে বলল,
” আমাকে ভালোবাসিস তো? তাহলে অমিত ভাইয়াকেও ভালোবাসতে পারবি, বিশ্বাস করতে পারবি। সে আমার আত্মীয়, আমার আপন চাচার ছেলে। ”
আমি শীতল কণ্ঠে বললাম,
” বিয়ে আত্মীয়তাও ন’ষ্ট করে দেয়, তিন্নি। যার প্রমাণ ফাতেমা। ”
তিন্নি এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। হয়তো ফাতেমার মুখটা মনে পড়েছে। গত বছরেই তার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে। ফুফুর কোলে খেলে-খেয়ে বড় হওয়া মেয়েটা বিয়ের পরই কেমন বড় হয়ে গেল! আদর করে ডাকা ফুপি নামটা বদলে আম্মা হয়ে গেল। কলেজ আসা বন্ধ হলো। মাসের পর মাস বাপেরবাড়িতে না গিয়েও চাল-ডাল চু’রি হওয়ার বদনাম দীর্ঘ করছে।
তিন্নির নীরবতাকে ফেলে আমি বসার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, মা-বাবা তাদের বয়সী কারও সাথে কথা বলছে। আপ্যায়ন চলছে পুরোদস্তুর! নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় হয়তো আমাকে খেয়াল করেনি। সে সুযোগে আমি বড় দরজা পার হয়ে রাস্তায় চলে আসলাম। পাহাড় মাপের মনখারাপ নিয়ে যখন উদাসভঙ্গিতে হাঁটছিলাম তখনই একটি মেয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। ময়লা ও ছেঁড়া কাপড়ের দুঃখী মুখটি আমার মনখারাপ ভুলিয়ে দিল। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপা, পোলাডার গায়ে মেলা জ্বর। কয়ডা ট্যাহা দিয়া সাহায্য করেন! ”
তার ডানকাখের বাচ্চাটিকে আমি খেয়ালই করিনি। সে মায়ের কাঁধে মাথা ফেলে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মুখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” তোমার ছেলে? ”
” হ, আপা। ”
আমি মেয়েটির মুখে আরেকবার চোখ বুলালাম। বয়স বিশোর্ধ হবে না। আমি ছেলেটির মাথায় আদুরে হাত রেখে চমকালাম। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে!
” ওর বাবা কোথায়? ”
মেয়েটি পেছন তাকিয়ে তী’ব্র ভ’র্ৎ’সনায় বলল,
” সারারাত জু’য়া খেইললা এহন ঘুমাইতাছে। ”
আমিও মেয়েটির পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দেয়ালের সাথে ঘেষে ধুলোর মধ্যে ম’রা লা’শের মতো কেউ শুয়ে আছে। মেয়েটিকে কিছু একটা বলার প্রস্তুত হতেই তিন্নি ছুটে এলো। আমার সাথে ধা’ক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” তুই এখানে? আর আমি সারা বাড়ি খুঁজছি। ”
আমি ভ’য়া’নক বিরক্ত নিয়ে তিন্নির দিকে তাকালাম। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই ওর হাত থেকে পার্স নিলাম। একটা একশ টাকার নোট বের করতে করতে বললাম,
” সব পুরুষ এক। আর কত প্রমাণ লাগবে? ”
তিন্নির দিক থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই মেয়েটির হাতে টাকা গুঁজে দিতে চাইলাম তখনই সে সুকণ্ঠ বেজে উঠল,
” সব পুরুষ এক নয়। ”
আমি ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অমিত দাঁড়িয়ে আছে। হালকা হেসে এদিকে এগিয়ে আসল। দুঃখী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনার দেখায় ভুল আছে। ”
আমি সপ্রশ্নে তাকালে সে আবার বলল,
” এই বাচ্চাটি এই মেয়ের নয়, শুয়ে থাকা ঐ লোকটিও তার স্বামী নয়। ”
আমার চাহনি পূর্বের মতো থাকলে সে মৃদু হেসে বলল,
” এই মেয়েটির বিয়েই হয়নি। সে আপনাকে বোকা বানাচ্ছে। ”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
” আমাকে বোকা বানাবে কেন? ”
” ব্যবসা করার জন্য। বিশ্বাস না হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন। ”
আমি দুঃখী মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে শব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কোলের ছেলেটিকে নিচে রেখে পায়ে পড়ে অনর্গল বলতে থাকল,
” আমারে মা’ফ কইরা দেন, আফা। আমি আর এমন করমু না। ”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম নামিয়ে রাখা ছেলেটি দৌড়ে কোথাও চলে গেল।
অমিত মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে ভ’য়ে জড়োসড়ো হয়ে পালাল। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লে অমিত এসে বলল,
” এবার বিশ্বাস হলো তো আপনার দেখায় ভুল হতে পারে? ”
আমি চুপ থাকলে সে আবারও বলল,
” দেখায় যদি ভুল থাকে, ভাবনায়ও ভুল থাকতে পারে। আর সেটাও আমি প্রমাণ করে দেব শীঘ্রই। আপনি মানতে বাধ্য হবেন, সব ছেলে এক নয়। ”
আমি নিজের ভাবনায় অটুট থেকে বললাম,
” সব ছেলে এক। আপনি বললেই ভিন্ন হয়ে যাবে না। ”
অমিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি হাঁটা ধরলাম। তিন্নি পিছু ধরলে গ’র’ম চোখে শা’সি’য়ে দিলাম,
” খবর’দার, আমার পিছু নিবি না। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। ”
তিন্নি ভ’য়ে থেমে গেলেও অমিত থামল না। সে আমার পিছু পিছু আসতে লাগল। আমি থমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। রা’গে ফুঁ’সে উঠে বললাম,
” আপনাকে বলেছি না চলে যেতে? ”
সে অবুঝ মানুষের মতো বলল,
” কী করে যাব? আমার জুতা তো আপনার পায়ে। ”
চলবে