আলতা_রাঙা_পা,০৭,০৮

0
639

#আলতা_রাঙা_পা,০৭,০৮
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৭)

ভারী সাজ পাল্টে হালকা হয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব হতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকাতে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। চিৎকার করে বললাম,
” কী করছেন? ”

অমিত উত্তর দেওয়ার বদলে বলল,
” আরে! পা টেনে নিলে কেন? বিছানায় লাগবে তো। ”
” কী লাগবে? ”
” আলতা। ”

আমি টেনে নেওয়া পা আরও টেনে আনলাম। অমিত ছুটে গিয়ে আলো জ্বালাল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” গায়ের চাদরেও লাগবে। শুকাতে দেও। ”

আলো পেয়ে আমি পায়ে তাকালাম। আলতায় রঞ্জিত পাদুটো বড্ড অচেনা ঠেকল। দৃষ্টি বিভ্রম হতে তিনি বললেন,
” একটু নেমে দাঁড়াও। আমি দেখি কোথাও লেগেছে নাকি। ততক্ষণে শুকিয়েও যাবে। ”

আমি কথা শুনলাম না। আপত্তি দেখিয়ে ঠাঁই বসে থাকলাম। পায়ে পা ঘষে বললাম,
” আপনি না কথা দিয়েছিলেন, আমাকে ছুঁবেন না? ”

অমিতের উতলাভাব কেটে গেল মুহূর্তে। একটুখানি চুপ থেকে বললেন,
” ছুঁতে দেখেছ? ”

আমি আঁট হয়ে বললাম,
” ঘুমের মধ্যে ছুঁলে দেখব কী করে? ”
” ঘুমের মধ্যে অনুভব করা যায়। করেছ? ”

আমি দমে গেলাম। ঘুমের মধ্যে সুড়সুড়ির মতো একটা কিছু টের পেয়ে ঘুম ভাঙলেও সেটা পুরুষ ছোঁয়া ছিল না। তাহলে কি অমিত না ছুঁয়েই আলতা পরিয়েছে? আমি কপট রাগে বললাম,
” এসব পাগলামির মানে কী? ”

অমিত সাথে সাথে বলল,
” ভালোবাসা। ”

তার লজ্জাহীন উত্তরে আমি কুণ্ঠিত হলাম। চাহনি নরম হয়ে আসলে তিনি আদুরে গলায় বললেন,
” তোমার পা’দুটোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। ”

আমি অদ্ভুত কিছু শুনছি এমন ভঙ্গিতে তাকালে তিনি আবার বললেন,
” আমি ভালোবাসাকে সাজাতে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ”

আমার অদ্ভূত দৃষ্টি আরও গাঢ় হলো। নিশ্বাসের গতি থামিয়ে নিশ্চুপ হলাম। অমিত দাঁড়ানো অবস্থায় আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। প্রগাঢ় চাহনি রেখে বললেন,
” এই ভালোবাসায় কোনো অনুমতির দরখাস্ত করব না। একমাত্র এই জায়গায় তোমার বাঁধা মানব না। ইচ্ছের গুরুত্ব দেব না। আমার ইচ্ছের অগ্রাধিকার থাকবে সবসময়। ইচ্ছে হলেই আমি আলতা পরাব। আলতা রাঙা-পা’য়ের সৌন্দর্য উপভোগ করব। ”

আমি খানিকটা পেছনে হেলে বললাম,
” যদি বাঁধা দেই? ”

অমিত সোজা হলো। বিছানার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলল,
” বলেছি তো মানব না। ”
” জোর করবেন? ”
” দরকার পড়লে তাই করব। ”

আমার চোখে-মুখে ভয়ের আভা ফুটে উঠতে তিনি বললেন,
” জোরাজুরি করতে গিয়ে কিন্তু আপনাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারি। সুতরাং সাবধান! ”

তিনি সাবধান বার্তা দিয়ে গোসলখানায় ঢুকে গেলেন। মিনিট দুই পর বেরিয়ে এসে জায়নামাজ আর কোরআন শরীফ রাখলেন আমার সামনে। জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আযান শুনতে পারছ? ”

ঠিক তখনই আমার কানে আযানের সমধুর সুর পৌঁছাল। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন জানালার ধারে। পাল্লা সরিয়ে দিলেন। ভোরের শুভ্র আলো ও মৃদু বাতাস ভরে গেল পুরো রুমে। সেখানে দাঁড়িয়েই বললেন,
” অবশ্য একটু-আধটু ছোঁয়াতে তোমার সমস্যা হওয়ার কথা না। তুমি তো আর কিশোরী বয়সের প্রেমিকা নও যে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লজ্জা লুকিয়ে থাকবে। আর আমিও প্রেমিক নই যে একটু হাত ছুঁয়ে দিলেই লজ্জায় কেঁপে উঠবে। পা ছুঁয়ে দিলেই গাল লাল হয়ে যাবে, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে চোখে চোখ মেলাতে গিয়ে কেঁদে ফেলবে। ”

তার এমন কথায় আমার মুখ হা হয়ে গেল। চোখদুটো ছানাবড় হলে তিনি হেসে ফেললেন। নিজের জায়নামাজ কাঁধে ফেলে হাঁটা ধরেন। দরজার কাছে এগুলে আমি পিছু ডাকলাম। তিনি থামলেন। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমি বিছানা থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়ালাম। সন্দেহি গলায় বললাম,
” প্রেম নিয়ে তো আপনার দারুন অভিজ্ঞতা! গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা কত? ”

অমিত বাঁকা হাসলেন। জায়নামাজ এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে নিয়ে বললেন,
” এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রেম করতে হয় না। গোটা কয়েক বন্ধু থাকলেই হয়। ”
” আপনার বন্ধুরা বুঝি এসবও বলে? ”
” সবাই না, কেউ কেউ বলে। ”
” ছি! ”

আমি মুখ ঝামটি মেরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালে তিনি বললেন,
” আমি সেই কেউ কেউ এর দলে নেই। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। ”
” একদিন করবে। আর সেই দিনটিও তোমার জীবনে আসবে শীঘ্রই। ”

____________
নামাজ পড়ে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে ছোট আপুকে স্বপ্ন দেখলাম। দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অপরাধে একপায়ে দাঁড়িয়ে রুটি বেলছে। তার শাশুড়ি হাতে নাড়ুনি নিয়ে নজর রাখছে আপুর পায়ে। পা মাটিতে স্পর্শ করলেই পিঠে পড়বে। আপু রুটি বেলছে আর কাঁদছে। পায়ের ব্যথায় কাঁদছে নাকি শাশুড়ির হাতে মার খেয়ে কাঁদছে বুঝা গেল না।

ছোট আপু একপা উঁচু করে রুটি বেলতে বেলতে ক্লান্ত হয়ে পা মাটিতে ফেলে দিল। তখনই তার শাশুড়ি নাড়ুনি দিয়ে পিঠে সজোরে আঘাত করল। আপু চিৎকার করতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি অমিত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাঁটু ভর করা মেঝেতে। আমি উঠে বসলাম। ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কী করছিলেন? ”
” তোমাকে দেখছিলাম। ”
” আমি কি অনুমতি দিয়েছি? ”
” অনুমতি নেই এমনও বলোনি। ”
” মানে কী? ”

অমিত বসা থেকে দাঁড়াল। বলল,
” কাল রাতে বলেছিলাম, আমি তাকালে যদি রাগ করো তাহলে আলো নিভিয়ে দেও। দিয়েছিলে? ”
” পর্দা টেনে দিয়েছিলাম। ”
” তার মানে দাঁড়াল, আমি তোমাকে দেখতে পারব কিন্তু তুমি দেয়াল টানলেই দেখা বন্ধ। এই যে এভাবে। ”

বলতে বলতে তিনি আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিলেন। আমি ঘোমটাসহ বোকা চোখে তাকালাম। তিনি সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললেন,
” দুঃস্বপ্ন দেখছিলে নাকি? ঘেমে গেছ। ”

আমি তাৎক্ষণিক দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। প্রায় দশটা বাজে। মাথায় যেন ভারী আঘাত পড়ল! আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চেহারায়। অমিত ধরতে পেরে বলল,
” কী হয়েছে, তায়্যিবাহ? ”

আমি উত্তর দিলাম না। রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম দ্রুতপদে। বসার রুম পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালাম। শাশুড়িমা চুলায় কিছু একটা করছেন। আমি ভেতরে ঢুকে বিনয়ের সাথে ডাকলাম,
” আম্মা? ”

তিনি পিছু ফিরলেন। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হলাম। এককদম সামনে এগিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সাথে সাথে স্বপ্নে দেখা ছোট আপু আর তার শাশুড়ির সেই করুণ দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। আমি ভীত ঢোক গিলে বললাম,
” উঠতে দেরি হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। ”

তার দিক থেকে কোনো উত্তর আসল না। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মনে পড়ল বধূবরণের মুহূর্তগুলো। তিনি আমায় খুশিমনে বরণ করেছিলেন। আদর করে খায়িয়েছিলেন, ভালোবেসে চুমু দিয়েছিলেন। সেই মমতাটুকু আমি আজও আশা করছিলাম। কিন্তু তেমনটা কি হয়? অসম্ভব! শাশুড়িরা মায়েদের মতো সবসময় মমতাময়ী হয় না। সময়ের সাথে সাথে রূপ বদলায়। ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। পুত্রকে নিজ মুঠিতে রাখতে চায়। ব্যবহারে, কার্যকলাপে বার বার প্রমাণ করে দেয় মেয়েটি অন্য ঘরের। এ ঘরে তার কোনো অধিকার নেই, কোনো প্রাপ্তি নেই, কোনো যত্ন নেই।

আমার সঙ্কিত চিন্তা-ভাবনার মধ্যে তিনি ডেকে উঠলেন,
” অমিত? এই অমিত। ”

আমার ভয় এবার কাঁপা-কাঁপি পর্যায়ে চলে এলো। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, অমিতকে ডাকছে কেন? বিচার দেবে? ছেলেকে দিয়ে শাস্তি দেওয়াবে? কী শাস্তি দেবে? মারধোর করবে ছোট দুলাভাইয়ের মতো?

আমি চোখ মেললাম। শাশুড়ির নিকট এগিয়ে এসে অনুরোধের সুরে বললাম,
” আর এমন হবে না। মাফ করে দিন। কী করতে হবে, বলুন। আমি করে দিচ্ছি। ”

তিনি কিছু বললেন না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। ততক্ষণে অমিত চলে এলো। মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
” ডাকছিলে, মা? ”

শাশুড়িমা আমার কাছ থেকে সরে ছেলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করতেই বুঝি বললেন,
” তোর বউকে বাপেরবাড়ি রেখে আয়, এখনই। ”

চলবে

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৮)

” তোর বউকে বাপেরবাড়ি রেখে আয়, এখনই। ”

মায়ের আদেশে অমিত কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। নীরব চেয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখে চোখ পড়তে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। শাশুড়িমা নিজ থেকেই কারণ উল্লেখ করলেন,
” বাড়িতে বউ থাকতেও যদি আমাকে চুলা জ্বালাতে হয়, নাস্তা তৈরি করতে হয়। তাহলে বউ রেখে কী লাভ? ”

অমিত এবারও চুপ থাকলেন। আমার শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আসল। সেসময় টের পেলাম অমিত আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার আলোয় উপস্থিত হলো ছোট আপু। নরম শরীরের আঘাতের দাগগুলো হলো সূর্যের মতো তেজোময়। আমি শিউরে উঠলাম! প্রলয় ঘটল চিন্তাগম্যের! অশ্রুপাত শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে বললেন,
” মাকে খুশি করার সূত্র বলে দেওয়ার পরও অংকে ভুল করলে? ”

আমি টলমল চোখে তার দিকে তাকালাম। তিনি হেসে ফেললেন। যেন আমার নির্বোধতায় দারুন মজা পেয়েছেন! ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললেন,
” আমার মা ভালোবাসতে ভালোবাসে। ”

আমার তাকানোর ভঙ্গি বদলানো দেখে অমিত বললেন,
” এখনও বুঝতে পারছ না? তোমাকে ভয় পেতে দেখে মা মজা করছে। ”

আমি পলক ফেললাম। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলাম শাশুড়িমার দিকে। তিনি মিটিমিটি হাসছেন। হাসিটি আমার পছন্দ হলো না। চোখে জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেল নিমিষেই। ঠিক সেসময় চিনতে পারলাম আমার বদলে যাওয়া রূপ। খেয়াল হলো আমি কতটা দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলেছি। অথচ এমনটা আমি কখনই চাইনি। তবুও কেন এমন হলো? এ বাড়িতে থেকে যাওয়ার মতো ইচ্ছে, রুচি, বাসনা কোনোটাই নেই আমার। বের করে দিলে কী হবে? কিছুই না। আর অমিত? তাকে কেন এত ভয় পেলাম? হাত তুললেই কি আমি মেনে নিতাম? চুপচাপ মার খেয়ে যেতাম? একদমই না। আমি এত নরম মেয়ে নই। অত্যাচার সহ্য করা গৃহবধূও না। এই বিয়েটাই তো মন থেকে মেনে নিইনি! তাহলে এমন আচরণ আমার দ্বারা সম্ভব হলো কী করে?

” এখনও স্বপ্নে আছ নাকি? ”

অমিতের প্রশ্নে আমার ভাবনাচ্ছেদ ঘটল। আমার প্রশ্নের উত্তরও মিলল। স্বপ্নে না থাকলেও তার প্রভাব ঠিকই পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্য নিজের মধ্যে ছোট আপুকে অনুভব করেছিলাম। সেজন্যই হয়তো এমন আচরণ করেছি।

আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম অমিতের দিকে। বললাম,
” ছিলাম, এখন আর নেই। ”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে শাশুড়িমা এগিয়ে আসলেন। কাঁধে আলতো হাত রেখে আদুরে গলায় বললেন,
” পাগলি মেয়েটা! এইটুকুর জন্য এত ভয় পেলে চলে? আমিও তো এ সময়টা পাড়ি দিয়ে এসেছি, তাই না? আর কেউ না বুঝলেও আমি জানি এসময় কতটা ক্লান্ত থাকে শরীর, মন। একটু বিশ্রাম না নিলে হয়? পরিবারের জন্য তো মন কাঁদে সারাক্ষণ। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতেও অনেকটা সময় লাগে। তোকে এত অস্থির হতে হবে না। মাফ চাইতে হবে না। নিজের মতো করে ধীরেসুস্থে মানিয়ে নিতে থাক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ”

আমার উদ্যত পাদুটো আবারও আটকে গেল এই মমতাময়ীর মায়ায়।

” শুধু খেয়াল রাখিস, তোদের ভেতরের ব্যাপারগুলো যেন বাইরে না আসে। কেউ কানাকানি করতে না পারে। ”

আমি বুঝতে পারিনি এমনভাবে তাকালে তিনি ফিসফিসে বললেন,
” গোসল করিসনি কেন? ”

অমিত শুনতে পেল নাকি কে জানে! তিনি আমাদের একা ছেড়ে চলে গেলেন। শাশুড়িমাও সুযোগ বুঝে মনে করিয়ে দিলেন আত্মীয়রা এখনও বাড়িতে ঘুরঘুর করছে। এ অবস্থায় তাদের সামনে পড়া মানে লজ্জা!
” নাস্তার জন্য সবাইকে ডাক পাঠানো হয়েছে। জলদি গোসল করে আয়। অমিতের জামা-কাপড়ের পাশে সুতি শাড়ি ভাঁজ করা আছে। নতুন বউ শাড়ি পরলে ভালো লাগবে। ”

আমি আর সময় ব্যয় করলাম না। রুমের দিকে ফিরে এলাম। ভিন্ন ভিন্ন রঙের অনেকগুলো শাড়ি রাখা। কোন রঙটা পরব ভাবনায় পড়তে অমিতের গলা পেলাম,
” লালটা পরো। সোনালি পাড়ের সাথে আলতা রঙটা খুব মানায়। ”

আমি খানিকটা চমকালেও তার দিকে ফিরলাম না। লাল রঙ ফেলে অন্য রঙের একটি শাড়ি নিয়ে বললাম,
” আমার পেছন পেছন ঘুরা বন্ধ করুন। এটা আমার অপছন্দ। ”

___________
” অমিত তাহলে আলতা পরানোর মতো স্থায়ী দুটো পা পেল! ”

অপরিচিত নারী কণ্ঠে আমি ঘাবড়ালাম। চোখ তুলে তাকালাম নারী মুখটার দিকে। তার চোখদুটো তখনও আমার পায়ের দিকে স্থির।
” গোসল করার পরও রঙ রয়ে গেছে মানে অমিত তোমাকে অনেক ভালোবাসে, ঠিক বলেছি তো?

প্রশ্ন করেই তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি গোসলখানা থেকে পুরোপুরি বের হলাম। এককদম এগিয়ে এসে বললাম,
” আপনি? ”

তিনি উত্তর না দিয়ে হাসলেন। নিজের পাদুটো বিছানায় তুলে আরাম করে বসলেন। আমাকে ইশারায় বসতে বললেন। আমি বসলে হাতদুটো টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
” হিন্দুরা তো সিঁদুর নিয়ে মজা করে, আমি আলতা নিয়ে করলাম। ”

বলতে বলতে আরেকদফা হেসে ফেললেন। সে হাসি দীর্ঘ হলো। হাসির মধ্যেই বললেন,
” তখন আমি খুব ছোট। ক্লাস থ্রি কী ফোরে পড়ি। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাম লিখিয়েছি। রবীন্দ্রসংগীতে দল নাচ হবে। সে নাচের জন্য আবার শাড়িও পরতে হবে। সবাই খুব সুন্দর করে শাড়ি পরল। আমিও পরলাম। নাচ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে দেখলাম সকলে আলতা পরেছে। কিন্তু আমি পরিনি। এখন কী হবে? আলতা ছাড়া তো ওদের মতো লাগবে না। আমি দলনেতার কাছ থেকে আলতার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু হাতভর্তি চুড়ি নিয়ে পরি কী করে? বসলে তো শাড়িও নষ্ট হয়ে যাবে! এদিকে মাও কাছে নেই। স্টেজের সামনে বসে আছে আমার নাচ দেখবে বলে। আমি আলতা হাতে এক কোণ থেকে ডাকলাম। মা শুনল না। অমিত শুনল। ইশারায় বললাম মাকে ডেকে দিতে। সে বুঝল না। ছুটে আসল আমার কাছে। আমি মাকে ডেকে দেওয়ার জন্য বলতে যাব তখনই আমাদের ডাক পড়ল নৃত্য পরিবেশনের জন্য। আমি দৌড় দিতে গিয়েও থমকে গেলাম। অমিতের হাতে আলতা দিয়ে বললাম, ‘ ভাই, পায়ে পরিয়ে দে তো। ‘ অমিত আলতার মুখ খুলতে গিয়ে আলতা ফেলে দিল আমার গায়ে। সারা শরীরে মেখে সে কী কেলেংকারি অবস্থা! নাচ থেকে বাদ পড়ে গেলাম। এই দুঃখে আমি কেঁদেকেটে বুক ভাসালাম। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। অমিতের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। আমার এই শোক পালন অমিত মানতে পারল না। সে অভিমান ভাঙানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাবাকে বলে আলতা আনাল। মায়ের কাছ থেকে আলতা পরানো শিখে আমার পিছ পিছ ঘুরতে শুরু করল। আমি অভিমান ভাঙলেও আলতা পরলাম না। অমিত ধরে নিল শাড়ি পরলে আলতা পরতে হয়। তারপর থেকে আমি শাড়ি পরলেই সে আলতা নিয়ে হাজির হয়ে যেত। একসময় এ ব্যাপারটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। আমি বড় হলাম ও বড় হলো কিন্তু আলতা পরানোর অভ্যাসটা ছাড়ল না। তন্মধ্যেই আমার বিয়ে হলো। স্বামীর সাথে ইতালি চলে যেতে হলো। অমিত দুঃখ পেল। আমিও। ভাবলাম, এবার বোধ হয় আলতা পরানোর অভ্যাসটা কাটবে। কিন্তু কাটেনি। কয়েক মাস পর মা ফোন দিয়ে নালিশ করতে শুরু করল, অমিত নাকি মায়ের পায়ে আলতা পরিয়েছে। কাজটা করেছে ঘুমের মধ্যে। মা তো রেগেমেগে ফায়ার! পাশের বাসার কাকিমা দেখে নাকি খুব হেসেছে। বুড়ো বয়সে এসবে মানায়? আমিও অমিতকে….”
” আপনি অমিতের আপু? ”

আমার হঠাৎ প্রশ্নে তিনি থমকে গেলেন। বলতে চাওয়া কথাগুলো ভেতরে চালান করে বললেন,
” ধরে ফেলেছ তাহলে? ”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই চুপ থাকলাম। তিনি বললেন,
” অমিত বলেছিল, তুমি খুব সাহসী, বুদ্ধিমতী। প্রথম দেখায় প্রমাণ দিয়ে ফেললে? ”
” বুঝিনি। ”
” বিয়ের পরদিনই স্বামীকে নাম ধরে ডাকছ। তাও আবার তার আপুর সামনে। এর জন্য কিন্তু সাহস লাগে। ”

আমি আবার চুপ হয়ে গেলাম। সেসময় অমিত রুমে ঢুকলেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতে বললেন,
” বিয়েতে ইরফান ভাইয়াও আসতে চেয়েছিলেন। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন দেখে বিয়েরদিন আসতে পারেনি। আপু মাত্রই আসল। ”

আমি ধরে নিলাম ইরফান ভাইয়া আপুর স্বামী। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
” ভাইয়া এ রুমে আসলেন না যে? ”

আপুর হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ”
” আপনি একাই এসেছেন? ”

আপু উত্তর দিল না। মলিনভাব কাটিয়ে বললেন,
” শুনেছি, বিয়ের সবকিছু নাকি ভাই নিজে গিয়ে কিনেছে। বউকে কী কী দিল? দেখাও তো দেখি। বিয়ের উপহারগুলোও কিন্তু দেখব। ”

আমি বসা থেকে দাঁড়ালাম। বিয়ের শাড়ি, গয়না বের করতে গিয়ে থমকে গেলাম। মনে হলো অমিত যে সবার থেকে আলাদা নয় এটা প্রমাণ করার এই সুযোগ। অযথায় চটে গিয়ে বললাম,
” কেন দেখাব? আমার জিনিস দেখে আপনার কী কাজ? দেখেই তো বলবেন, এটা খুব সুন্দর। ওটা খুব সুন্দর। বলতে বলতে সব হাতিয়ে নেবেন, তাই না? এসব আমার জানা। কিছু দেখাব না আমি। ”

আমি খেয়াল করলাম আপুর মুখের রঙ পালটে গেছে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। আমি আরও বললাম,
” আপনি অনুমতি ছাড়া আমার রুমে ঢুকেছেন কেন? ভাইয়ের রুম হলেই যখন-তখন ঢুকে পড়তে হবে? ভাই ছাড়াও যে এ রুমে অন্য কেউ থাকতে পারে এইটুকু আপনার জানা নেই? সে কী ভাববে এইটুকু বুঝ আপনার নেই? ”

আমি একটু দম নিয়ে আবার বললাম,
” আমি এখন সাজব। আপনি বের হোন। আপনি থাকলে আমার অসুবিধা হবে। ”

আপু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অমিতের দিকে চাইতে আমি অন্যদিকে মুখ করে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়ালাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here