আলতা_রাঙা_পা,১১,১২

0
741

#আলতা_রাঙা_পা,১১,১২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১১)

নাস্তার টেবিলে অমিতের আপু ফিসফিস করে বললেন,
” খাওয়া শেষ করে আমার রুমে এসো তো। ”

আমি খানিকটা ঝিলকে উঠে তটস্থ হলাম। মাথা একপাশে নেড়ে নিভু স্বরে বললাম,
” আচ্ছা। ”

খাওয়া শেষ করে টেবিল ছাড়লাম না। হাতে হাতে শাশুড়িমাকে গুছাতে সাহায্য করলাম। তিনি মানা করলেও শুনলাম না। এতে যেন খুশিই হলেন। মৃদু হেসে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কোন জায়গায় রাখতে হবে। গুছানো প্রায় হয়ে এলে আপুর রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। তিনি ফোনে কথা বলছিলেন। কথা বলার এক ফাঁকে দরজার দিকে তাকালেন। আমাকে দেখেই ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। আমি বিছানার এক কোণা দখল করে বসলাম। তিনি আরও কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকলেন। সে সুযোগে আমি তার রুমটা পর্যবেক্ষণ করছি। অকস্মাৎ বললেন,
” তুমি যে এত ভীতু দেখে বুঝা যায় না। ”

আমি ছিটকে উঠে তার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। সামান্য ঘাবড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে বলল? ”

তিনি বসলেন আমার পাশে। ফোনটা বিছানায় রেখে বললেন,
” কেউ বলেনি। আমি নিজে দেখেছি। ঘুমের মধ্যে কেমন কাঁপছিলে! ”

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
” ঘুমের মধ্যে কাঁপছিলাম? ”
” হ্যাঁ। অমিতের হাতটা এমনভাবে খামচে ধরেছিলে যে নখের দাগ পড়ে গেছে। দেখনি? ”

আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। মুখে কিছু না বলে মাথা দু’পাশে নাড়লাম। তিনি মুখ এগিয়ে আনলেন আমার দিকে। আমার একহাত চেপে ধরে বললেন,
” এই যে, এভাবে ধরেছিলে। চোখ-মুখ খিঁচে পুরো শরীরটা জমিয়ে নিচ্ছিলে যেন কোনো গভীর খাদ থেকে উঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলে। ”

আমি সবিস্ময়ে চেয়ে থাকলে তিনি কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” রোজই নাকি এমন করো? ”
” কে বলল? ”
” কে আবার? অমিত। ইচ্ছে করে বলেনি অবশ্য। কাল রাতে আমার চাপে পড়ে বলেছে। কতটা অসহায় দেখাচ্ছিল ও কে জানো? যেন তোমার এই অবস্থার জন্য ও-ই দায়ী। ”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তিনি একটু চুপ করতে প্রশ্ন করলাম,
” রাতে আমার রুমে গিয়েছিলেন? ”

তিনি সরলমনেই উত্তর দিলেন,
” হ্যাঁ, না গিয়ে উপায় ছিল? ”
” কেন? খারাপ কিছু হয়েছিল নাকি? ”
” খারাপ না আবার ভালোও না। ”
” বুঝিনি। ”

আপু একটু সময় নিয়ে বললেন,
” তোমাদের তো কাল আসার কথা ছিল না, তবুও হুট করে চলে এলে। তাও আবার মাঝরাতে। আমরা তখন গভীর ঘুমে। সেসময় তোমার বর আমার ফোনে কল দিয়ে বলল, ‘ আপু, দরজা খোল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ‘ আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি অমিত একা দাঁড়িয়ে আছে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে জানাল, তুমি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ। আমি ডাকতে বললাম, মানা করে দিল। ”

কাল রাতে কী হয়েছিল আমার মনে নেই। আপুর কাছ থেকে শোনার সৌভাগ্য হতে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। মাঝেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” তারপর কী হলো? ”
” তারপর আর কী, অমিত কোলে করে তোমাকে রুমে নিয়ে গেল। ”
” আপনার সামনে? ”

আপু ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন,
” তোমাদের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল। ও যদি খুলতে না পারে? তাই পেছন পেছন আমিও গেলাম। ভেতরে ঢুকে বালিশ ঠিক করে দেওয়ার পর তোমাকে শুয়িয়ে দেয়। তারপর আমি চলে আসছিলাম তখনই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। ”
” কোন ব্যাপার? ”
” তুমি যে ঘুমের মধ্যে ভয় পাও সেটা। ”

আমার উত্তেজনা কমে আসল। আপু অল্পক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” আমার ভাইকে কেমন লাগে? ”

আপুর এমন প্রশ্নে আমি চমকে তাকালাম। দৃষ্টি স্থির হতে তিনি বললেন,
” পুরুষদের সম্পর্কে তোমার যে ধারণা তা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাও, তোমার সেই কিশোরী বয়সটাকে কল্পনা করো। সেই নবজাত, কোমল মনটা কী বলে? অমিত ছেলেটা কেমন? প্রেমে পড়ার মতো কি? ”

আমি উত্তর দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলাম। দৃষ্টি ছুটে বেরিয়ে গেল আপুর রুমের দরজার ওপারে। এখানে বসেও বসার রুম দেখা যাচ্ছে অনায়াসে। দূর থেকেই অমিতের মুখটার দর্শন পেলাম। তার মায়ের সাথে কথা বলছেন দুষ্টুমি ভঙ্গিতে। শাশুড়িমাও হালকা হাসছেন আর কান টেনে দিচ্ছেন বার বার। মা-ছেলের এমন মধুর মুহূর্তটুকু আমার মনকে পুলকিত করল। অজান্তেই প্রার্থনা করে বসলাম, এমন মুহূর্ত বার বার চোখে পড়ুক আর হৃদয় জুড়িয়ে দিক।

” মন উত্তর দিচ্ছে না? ”

আপুর কণ্ঠস্বরে আমার প্রার্থনায় টান পড়ল। দ্রুত চোখ সরিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ ”

আপুর ভাবভঙ্গি খুব একটা পাল্টাল না। মনে হয় জানতেন আমি এমন উত্তরই দেব। বললেন,
” তাহলে পড়ছ না কেন? ”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। তিনি শঙ্কিত গলায় বললেন,
” যদি অন্য কেউ পড়ে যায়? ”

তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাটুকু আমার মধ্যে স্থানান্তর হলো। চোখদুটো ঘুরে গেল অমিতের দিকে।

আপু আবার বললেন,
” তুমি বিশাল দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছ, বুঝলে? ”

আমি বুদ্ধিশূন্য চাহনি রাখলে তিনি বললেন,
” ভাগ্য দোষে খুব খারাপ একটা পরিবেশে বড় হয়েছ তুমি। যার অভিজ্ঞতা বড়ই নিষ্ঠুর! চারপাশের কতগুলো নারী জীবনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। এমনভাবে মিশে গিয়েছ যে, তোমার মন ধরেই নিয়েছে, তাদের মতোই একটা জীবন তোমার প্রাপ্য। অথচ বাস্তবে ঘটল অন্য। তাদের থেকে আলাদা এক মানুষ পেলে, আলাদা জীবন, আলাদা সংসার। এইদিকে তোমার এই পাওয়াটুকু মানিয়ে নিতে পারছে না তোমার সেই বেড়ে উঠা বোকা মন। সে খুব করে চাইছে অমিত অন্যসব পুরুষদের মতো হোক। যাদের পৈশাচিক রূপ তুমি দেখে এসেছ। কিন্তু হচ্ছে না। আর এই না হওয়াটাকেই ব্যর্থতা হিসেব করছে তোমার ভুগে আসা বোকা মন। আমরা মানুষরা সবসময় ভালো আশা রাখি এমন না। মাঝে মাঝে খারাপও রাখি। এই যেমন ধরো, হঠাৎ শুনলে কেউ একজন হার্ট অ্যাটাক করল। তুমি চিন্তিত হলে। আর চিন্তায় পড়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘ উনি এখন কেমন আছে? ‘ কেউ একজন জানাল ভালো আছে। একটুর জন্য বেঁচে গেছে। এই খবর যেমন তোমাকে চিন্তামুক্ত করবে তেমন গোপনে নিরাশও করবে। কারণ, গোপনে কোথাও না কোথাও আশা করেছিলে মানুষটা মারা যাবে। যায়নি। এই যে মারা না গিয়ে বেঁচে গেল এটাই তোমার সেই গোপন আশাকে ভেঙে আশাহত করল। যেটা তুমি খেয়ালও করলে না। কারণ, সেই গোপন আশা সবসময় গোপনই থাকে। প্রকাশন পায় না। আর খারাপ আশা প্রকাশ পেতে নেই। তাই আশাভঙ্গটুকুও প্রকাশ পায় না। ”

আপু একটু দম নিয়ে আবার বললেন,
” এই মুহূর্তে তোমার মনের গোপন আশাটা হলো একটা খারাপ জীবন পাওয়া। যেটা পাচ্ছ না বলে হতাশ হচ্ছ। ফলে চিতা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অমিতকে নিয়ে ভালো আশা করতে পারছ না। মন খুলে বরণ করতে পারছ না। আপন করতে পারছ না। একমনে চাইছে তাকে ভালোবাসো আরেকমন চাইছে ঘৃণা করো। আর এই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে তোমার দাম্পত্য জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আঁধারে ডুবে যাচ্ছে। তায়্যিবাহ, জোর করে যে নরক জীবনটা আদায় করতে চাচ্ছ তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হবে চিন্তা করেছ কখনও? ”

আমার ভেতরটা শিউরে উঠল। এক অদ্ভুত ভয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিল। আপু আমার কাঁধে আলতো হাত রাখলেন। আশ্বস্ত করে বললেন,
” এতগুলো মানুষ কখনই তোমাকে ভুল বুঝাবে না। আমাদের বিশ্বাস করো। ঠকবে না। একটা খারাপ জীবন পাওয়ার আগে নাহয় একটা ভালো জীবন পাওয়ার আশা করো। ”

আমার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি কোমল কণ্ঠে বললেন,
” আমার ভাইটাকে একটু ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করো। দেখবে, হাজারগুণ বেশি ফেরত পাবে। ”

আমি চোখ নামিয়ে নিশ্চুপে বসে থাকলাম। আপুও চুপ থাকলেন কতক্ষণ। আমাকে একটু সময় দিয়ে বললেন,
” ভাই তোমাকে খুঁজছে। রুমে যাও। ”

আমি রুমে এসে দেখি সত্যি অমিত আমাকে খুঁজছেন। বারান্দায় না পেয়ে পেছন ঘুরে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
” আমি অফিসে যাচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে কল করো। ”

আমি কিছু বললাম না। নীরবে বিছানায় আসলাম। মস্তিষ্ক জুড়ে আপুর বলা কথাগুলো ঝড় বয়ছে। অমিত একটু অপেক্ষা করে রুম থেকে বের হতে চাইলেন। আমি পেছন ডাকলাম,
” শুনুন। ”

অমিত থামলেন। আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু বলবে? ”

আমি এবারও চুপ থাকলাম। বিছানায় বসে থাকলাম না। তার দিকে হেঁটে গেলাম ধীরপায়ে। চোখে চোখ রাখতে মনে পড়ল অমিতের শেষ বার্তাটি। আসলেই কি জড়িয়ে ধরলে ভালোবাসা হয়ে যাবে?

আমি আবার দ্বিধায় জড়িয়ে পড়লে তিনি বললেন,
” তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। অনুমতি দেও, আমিই জড়িয়ে ধরি। শিখে যাবে আবার সাহসও পাবে। ”

আমি লজ্জা পেলাম। একটু সরে এসে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। তিনি নিজ জায়গায় স্থির থেকে বললেন,
” মন পড়ে নেওয়ার কথা দেওয়াটা ভুল ছিল। সে কথা রাখতে গিয়ে তোমাকে লজ্জায় ফেলে দিলাম। দূরত্ব বাড়িয়ে ফেললাম। ভালোবাসাটা হতে গিয়েও হতে পারল না! ”

অমিতের কণ্ঠে আফসোস! আমি না চাইতেও হেসে ফেললাম। তিনি দৌড়ে আসলেন। পাশ থেকে মাথা এগিয়ে আনলেন আমার সামনে। আকাশ মাপের বিস্ময় নিয়ে সুধালেন,
” তুমি হাসছ? ”

আমি হাসি লুকাতে চাইলাম। পারলাম না। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল গালে, চোখে, চোয়ালে। তিনি ঘোরলাগা কণ্ঠে বললেন,
” হাসলে তোমায় আমার বউয়ের মতো লাগে। ”

আমার হাসি উবে গেল। কপট রাগ নিয়ে বললাম,
” বউয়ের মতো মানে? আপনার বউ কয়টা? ”

অমিত থতমত খেলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন,
” আমি তো বউয়ের সংখ্যা বুঝাইনি। ”
” তাহলে? ”
” হাসলে আমার বউয়ের মতো লাগে, না হাসলে তায়্যিবাহর মতো। ”

আমি বুঝতে পেরেও চোখ-মুখ শক্ত করে রাখলাম। তিনি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লেন। আনন্দিত গলায় বললেন,
” আমার বউ হেসেছে মানে আমার সংসারে আনন্দ ফিরে এসেছে। এ খুশি উদযাপন করা উচিত। কী করা যায় বলো তো? ”

তিনি সপ্রশ্নে আমার দিকে তাকালেন। আমি কোনো বুদ্ধি দিলাম না। তার দিক থেকে কিছু আশা করে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
” তোমার ভার্সিটি থেকে ঘুরে আসি চলো। বিয়ের পর প্রথম যাওয়াটা স্বামীর সাথেই হোক। ”
” আপনার অফিস? ”
” তুমি তৈরি হও, আমি দেখি বসকে ম্যানেজ করা যায় কিভাবে। ”

চলবে

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১২)

অফিসের গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে বের হলো অমিত। যেতে যেতে চোখ পড়ল অমিতের ডানহাতের উপর পৃষ্ঠে৷ নখের দাগগুলো স্পষ্ট, দগদগে। অন্তরে সহানুভূতি জেগে উঠল আমার। ভীষণ মায়ায় ক্ষত স্থান ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো।

” চুপচাপ যে? এতদিন বাদে ক্যাম্পাসে যাচ্ছ আনন্দ হচ্ছে না? ”

অমিতের কণ্ঠে আমার মায়াভরা চোখদুটো কেঁপে উঠল। সংযত হলো মন। অনুভূতিরা গেল লুকিয়ে। আমি সামনের দিকে উদাস তাকিয়ে বললাম,
” আমি এমনই। চুপচাপ, শান্ত। ”
” আমার তেমন মনে হয় না। ”

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলাম অমিতের দিকে। স্থিরনেত্রে চেয়ে আছেন আমার মুখটায়। তার ভাবভঙ্গি বলছে আমার ব্যাপারে তার জানাশোনা সুনিশ্চিত। আমি সে চাহনি অগ্রাহ্য করে নিরুত্তর রইলাম। তিনিও দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন কিছুক্ষণ বাদে। আমাকে অনুকরণ করেই বোধ হয় চুপ থাকলেন। আরও কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর আমি কথা বললাম,
” মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা বলতে ভুলে গেছেন। ”
” ভুলে যাইনি। আপু বলে দিয়েছে তাই আর আমি বলিনি। ”

আমি বিস্মিত নয়নে তাকালাম তার দিকে। পলকহীন চোখদুটিতে চোখ রেখে তিনি বললেন,
” অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার ব্যবহারেই বুঝতে পেরেছি। এতটা পরিবর্তন এমনিতে হয় না। ”

আমি নিজেকে সামলে বললাম,
” আপনি কথার খেলাফ করেছেন। ”
” একদমই না। ”
” আবার অস্বীকার করা হচ্ছে। ”
” কিছু করলে তো স্বীকার করব। ”

আমি চোখ-মুখ শক্ত করে ফেললে তিনি নরম হয়ে বললেন,
” এই রাগটা যাতে না আসে সেজন্যই আপুকে সামনে রেখেছিলাম। ওটা জরুরি ছোঁয়া ছাড়া আর কিছুই না। ”
” জরুরি না বলুন সুযোগ। আপনি সুযোগ পেয়েই আমাকে কোলে….”
” তায়্যিবাহ? ”

কথার মাঝে আমার নাম ধরে ডাকায় আমি থেমে গেলাম। সে সুযোগে তিনি বললেন,
” অন্তত আমার সামনে অভিনয় করো না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোমার মধ্যে একফোঁটাও রাগ নেই। কারণ, তুমিও জানো ওটা জরুরি ছোঁয়াই ছিল। ”

আমি বিব্রত হলাম। কুণ্ঠিত বদনে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। তিনি বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন বোধ হয়। আমি বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বললেন? ”

অমিতও অন্যদিকে ফিরে ছিল। সেদিকে মুখ রেখেই বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” কী? ”
” বলা যাবে না। ”
” কেন? ”
” তুমি লজ্জা পাবে। ”

আমার ভ্রূজোড়া কুঁচকে এলো। বিরক্ত হতে গিয়েও কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। ইচ্ছে হলো লজ্জা পেতে। কিন্তু জোর করতে পারলাম না।

_________

আমাকে ক্লাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন অমিত। পুরো দিনের ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। কাজটা নাকি খুব জরুরি। তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। তাই অর্ধেক বেলার ছুটি নিয়েছেন জোর করে। যা আমাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেতে যেতেই শেষ হয়ে যাবে।

আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন তখনই তিন্নি দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত বাঁধনে। আনন্দে গলে পড়ে বলল,
” তোকে খুব মিস করছিলাম রে, তায়্যু। ”
” আমিও। ”

ভালোবাসা দেওয়া-নেওয়া শেষ হতে আমাকে ছেড়ে দাঁড়াল তিন্নি। সেসময় অমিত বললেন,
” তোর চোখ-মুখ এত শুকনো লাগছে কেন? ”

তিন্নির হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। অমিতের দিকে এক পলক চেয়েই মাথা নত করে ফেলল। সে অবস্থায় বলল,
” সামনে পরীক্ষা তো তাই পড়ার চাপ পড়েছে। ”

অমিত আর কিছু বললেন না। এক মুহূর্ত স্থির চেয়ে হেঁটে চলে গেলেন। তিন্নিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এমনভাবে নিশ্বাস ছাড়ল। আগের হাসি ফিরে এলো। আমাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল গল্পের ঝুড়ি খুলতে খুলতে। টানা চারটা ক্লাস করেও সেই ঝুড়ি খালি হলো না। ছুটির ঘণ্টা পেয়ে বই-পত্র গুছিয়ে বের হলাম তিন্নির বকবকানি শুনতে শুনতে। ভবন ছেড়ে মাঠ পেরিয়ে গেটের দিকে এগুলাম দুজন অন্যমনস্কতায়। রিকশা ধরতে যাব তখনই কেউ একজন আমার নাম ধরে ডেকে উঠল। সেই ডাক অনুসরণ করে তাকাতে দুজন চমকে গেলাম। দ্রুতপদে সামনে এগিয়ে বললাম,
” আপনি যাননি? ”

অমিত হালকা হেসে বললেন,
” না। ”
” বস কিছু বলবে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” আমার বদলে অন্য একজনকে পাঠিয়েছি। বসকে অবশ্য এখনও বলিনি। যদি কাজটা করতে পারে তারপরই বলব। আশা করছি পারবে। ”
” আর যদি না পারে? ”

অমিত উত্তরে হাসলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
” খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? ”

আমরা কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই তিনি রাস্তার ওপারে ইশারা করে বললেন,
” ঐপাশে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখলাম। চলো তোমাদের হালকা-পাতলা কিছু খায়িয়ে আনি। ”

অমিত হাঁটা ধরলে আমরা পিছু নিলাম। রাস্তা পার হতেই হঠাৎ বললেন,
” আন্টির নাকি ওষুধ শেষ? তোর নিয়ে যাওয়ার কথা? ”

তিন্নি দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও। অমিত হাতের ঘড়ি দেখে বললেন,
” দুপুরের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তোর তো ফেরা উচিত। ”

অমিত উদ্বিগ্ন বদনে রাস্তার এপার থেকে ওপারে তাকালেন দ্রুত। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আশেপাশে তো খালি রিকশা দেখছি না। তুমি ভেতরে গিয়ে বসো। আমি সামনে এগিয়ে দেখি রিকশা পাই নাকি। তিন্নিকে তুলে দিয়ে আসছি। ”

আমি হ্যাঁ- না কিছু বলার সময় পেলাম না। তিনি সামনে হাঁটা ধরলেন। তিন্নিও চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে চলল।

____________

রাতে খাওয়ার পর বিছানা গুছাচ্ছিলাম আমি। তন্মধ্যেই অমিত ভেতরে এলেন। সোজা হেঁটে চলে গেলেন বারান্দায়। আমি ঝাড়ু ফেলে বারান্দার দিকে চেয়ে থাকলাম নিষ্পলক। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতে মন ভার হয়ে পড়ল। মনখারাপকে পাত্তা না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ঘুম আসার বদলে রেস্টুরেন্টে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পড়ল। নিমিষেই বুকজুড়ে অস্থিরতার ঝড় শুরু হলো। চোখ বন্ধ করে থাকা যাচ্ছে না। বার বার চোখ পড়ছে অন্ধকার বারান্দায়। জানালায়। পর্দায়। আমি সেই অস্থিরতা সহ্য করতে পারলাম না। ফোন হাতে নিয়ে অমিতকে বার্তা পাঠালাম,
” আপনি চাইলে ভেতরে এসে ঘুমাতে পারেন। ”

সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি বার্তা আসল,
” বদ্ধ রুমের মেঝের চেয়ে খোলা হাওয়ার বারান্দার মেঝেই ভালো। ইচ্ছে হলেই আকাশ দেখা যায়, চাঁদ দেখা যায়। তারা গুণা যায়। ”
” আমি কি মেঝেতে ঘুমাতে বলেছি? ”

বার্তার উত্তর এলো না। তিনি পর্দা সরিয়ে উঁচুস্বরে বললেন,
” আলো জ্বালো তো, তোমাকে না দেখে মন পড়তে পারছি না। ”

আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। পরমুহূর্তে সামলে উঠে বললাম,
” মন পড়ার কী দরকার? যা বলার সরাসরিই তো বলেছি। ”

অমিত পর্দা ছেড়ে দিলেন। জানালার থেকে সরে গিয়ে রুমে আসলেন। বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
” ভেবে বলছ তো? ”

আমি মুখে কিছু বললাম না। নিজ জায়গায় থেকে একটু সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলাম। তিনি বোধ হয় বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। পাহাড়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমি উল্টো ঘুরে বললাম,
” শুধু ঘুমানোর অনুমতি দিয়েছি আর কিছু নয়। ”

অমিত বিছানায় উঠলেন সাবধানে। বালিশে মাথা রেখে বললেন,
” আমি অল্পতেই অধিক খুশি হই। ”

তার এই সামান্য খুশিটুকুও আমার হৃদয়ে ভারী আঘাত আনল। পূর্বের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ। তার সাথে গল্প করার জন্য ব্যাকুল হলো মন। নিশ্চুপ থাকতে পারছিলাম না কিছুতেই। কোনো এক ছুঁতোই তার দিকে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু সেই ছুঁতো বানাতেই পারছিলাম না। আমার এই ছটফটানি টের পেল অমিত। সহসা বললেন,
” ঘুম আসছে না? ”

আমি উত্তর দেওয়ার বাহানায় তার দিকে ঘুরলাম। এক হাত দূরত্বে থাকা মানুষটার মুখোমুখি হতেই বাকহারা হয়ে পড়লাম। জমে গেলাম বরফের মতো। আবছা অন্ধকারেও তিনি আরও একবার আমার মন পড়ে ফেললেন। শোয়া থেকে উঠে বসলেন সটাং। জিজ্ঞেস করলেন,
” চা না কফি? ”

আমি সপ্রশ্নে তাকালে তিনি বললেন,
” রাত জেগে গল্প করবে আর হাতে পানীয় থাকবে না? নিরামিষ লাগবে। ”

আমি উঠে বসতে বাধ্য হলাম। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
” চা না কফি? ”
” কফি। ”

অমিত বিছানা ছাড়লে আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি বানাবেন? ”
” হ্যাঁ, মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

আমি আবদার করার মতো বললাম,
” আমি বানাই? ”
” তুমি বানাতে পার? ”

অমিতের কণ্ঠে সন্দেহ। আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। সলজ্জায় বললাম,
” না। আমার তো বিয়ে, সংসার নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তাই নিজ থেকে কিছু শিখিনি। মা শেখাতে চাইলেও আগ্রহ দেখাইনি। ”

অমিত এক মুহূর্ত চুপ থেকে সুধালেন,
” তোমার বানাতে ইচ্ছে করছে? ”

আমি ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ। ”
” ঠিক আছে, তুমিই বানাবে। ”

আমি খুশি হয়েও মনখারাপ করে ফেললাম। বললাম,
” আমি তো পারি না। ”
” পার না, শিখবে। ”
” কে শেখাবে? ”
” তোমার স্বামী। ”

আমি বিস্ময় চোখে তাকালে তিনি বললেন,
” মেয়েরা রান্না শেখে মায়ের কাছে, বউমারা শাশুড়ির কাছে আর তুমি শিখবে স্বামীর কাছে। ”

অমিত আমাকে নিয়ে রান্নাঘরে এলেন। আমাকে শেখাতে গিয়ে সবটাই নিজে করলেন। আমি শুধু কফি মগে কফি ঢাললাম। তার হাতে দিতে তিনি গন্ধ নিয়ে বললেন,
” ভালো বানিয়েছ। খেতে বেশ লাগবে। ”

কফি হাতে বিছানায় বসতে গেলে তিনি বাঁধা দিলেন আমাকে। বললেন,
” বারান্দায় চলো। গল্পের ফাঁকে আকাশ দেখবে, চাঁদ দেখবে, তারা গুণবে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেই হাওয়া এসে সতেজ করে দিবে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here