সর্দি_কন্যা,০৬,০৭

0
560

#সর্দি_কন্যা,০৬,০৭
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৬)

আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লাম। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে উষ্মাকে দূরে সরিয়ে বললাম,
” তুমি কি পাগল? কথার কোনো ঠিক নেই। একেক সময় একেকটা বলছ। মাথায় সমস্যা আছে নাকি? তোমার তো চিকিৎসার প্রয়োজন। ”

উষ্মা বোধ হয় খানিকটা ভয় পেল। জড়োসড়ো হয়ে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। টলমল চোখদুটোতে অসহায়ত্বের স্রোত! নাক টানছে থেমে থেমে। চোখের পানির চেয়ে নাকের পানি মুছায় বেশি কসরৎ করছে। আমার চোখে তখনও অগ্নির ছাপ। কণ্ঠস্বরে অগ্নিত্তাপ। একটু থেমে আবারও ধমকে উঠলাম,
” তুমি কী চাও, তা আগে নিজে বুঝতে শেখ। তারপর চাইতে আসবে। ”

উষ্মা কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট নাড়তে আমি সাবধান করলাম,
” তোমাকে বিয়ে করা অসম্ভব। আমার জ্ঞান থাকা অবস্থায় তো কল্পনাও করতে চাই না। খবরদার, আমাকে স্পর্শ করবে না। ”

উষ্মা ভেজা চোখ নামিয়ে ফেলল। জায়গায় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মাটি খুড়তে থাকল চুপচাপ। তার নিঃশব্দের ফুঁপানিতে আমার মনে একটুও দয়া হলো না। বরঞ্চ বিরক্তে বিষাক্ত হয়ে উঠল শ্বাস-প্রশ্বাস। আমি শাসানি চাহনি সরিয়ে বললাম,
” আসছি। ”

উষ্মা তখনও নীরব। আমি তাকে ফেলে উঠোন পেরিয়ে এলাম। ইটের রাস্তায় পা ফেলব সেসময় সে চিৎকার করে বলল,
” পালিয়ে গেলেই কি বেঁচে যাবেন? ”

আমি থমকে পেছনে ঘাড় ঘুরালাম। উষ্মা দূর থেকেই কণ্ঠ উঁচু করে বলল,
” আন্টি কিন্তু কথা দিয়েছেন, আমি আপনার বউ হব। মানে, আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আজ না হলেও কাল করতেই হবে। ”

আমি পুরো শরীরটা ঘুরিয়ে দাঁড়ালাম। সে দৌড়ে এলো। বলল,
” কিন্তু আমাকে তো আপনার অপছন্দ! ”

আমি কাঠ স্বরে বললাম,
” বলতে কী চাচ্ছ? ”
” আমি চাচ্ছি, কেউ কষ্ট না পাক। ”
” বুঝিয়ে বলো। ”

উষ্মা স্থির হলো। একটু সময় নিয়ে লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল,
” আমি আর আপনি চাই না বিয়েটা হোক, যার মানে দাঁড়ায় বিয়ে হলে আমরা কষ্ট পাব। আবার আমাদের দুই পরিবার চায় বিয়েটা হোক, যার মানে দাঁড়ায় বিয়েটা না হলে তারা কষ্ট পাবে। ”

আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। বললাম,
” তুমি আবারও আমাকে বিভ্রান্ত করছ। তোমার মাথায় সত্যিই সমস…”
” সমস্যা থাকলে আপনার কী? কিছু না তো? তাহলে আমার মাথা নিয়ে এত ভাবছেন কেন? তার থেকে ভালো, আমার বুদ্ধিটা শুনুন। লাভ হবে। ”
” বুদ্ধি? ”
” হ্যাঁ। আমার বুদ্ধিতে চললে, আমরা কেউ কষ্ট পাব না। ”

আমি অবহেলায় বললাম,
” তাই নাকি? তা শুনি তোমার সেই বুদ্ধি। ”

উষ্মার চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠল। কান্নার রেশ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
” একটু পরেই আন্টিরা উঠবে। আপনি গিয়ে বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। আজই এনগেজমেন্ট করতে চান।…”

এতটুকু শুনেই আমি অধৈর্য হয়ে পড়লাম। চোখদুটো রক্তিম হয়ে উঠল। ক্রোধান্বিত ধ্বনি ছুঁড়ব তখনই সে বলল,
” আবার রেগে যাচ্ছেন! পুরোটা তো শুনুন। ”

আমি ঘন ঘন উত্তাপ নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনলাম। ধীরে বললাম,
” বলো। ”

উষ্মা সাথে সাথেই বলল,
” আন্টিকে বলবেন, আপনি এনগেজমেন্ট করতে চান কিন্তু একটা শর্ত আছে। ”
” শর্ত? ”
” হ্যাঁ, শর্ত। ”
” কী শর্ত? ”

উষ্মা কেমন করে যেন তাকাল। একটু চুপ থেকে আবার বলল,
” বলবেন, আমরা যেহেতু একে-অপরকে আগে দেখিনি, জানাশোনা নেই সেহেতু আমরা বিয়ের জন্য একটু সময় নিতে চাই। যে সময়টাতে আমরা হালকা মেলামেশা করব। একে-অপরের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানব। যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা নেই। সেই সময়টুকু শেষ হলে আমরা দুজনে বিয়ের তারিখ জানিয়ে দেব। ”

পুরোটা শোনার পর আমার মেজাজ ঠাণ্ডা হওয়ার বদলে বিগড়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,
” এখানে আমার ভালোটা কোথায় হলো? সেই তো বিয়ে করতেই হবে। ”
” না, করতে হবে না। ততদিনে তো আমি পররাষ্ট্র ক্যাডার হয়ে যাব। ”

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
” পররাষ্ট্র ক্যাডার? ”

উষ্মা আমার বিস্ময়টা ধরতে পারল না। ভাবল, আমি বুঝতে পারিনি। তাই বলল,
” বুঝতে পারেননি? আরে ঐ যে বিদেশে বিদেশে ঘুরে চাকরি করে যে! ইংলিশে কী যেন বলে? ”

উষ্মা মনে করার চেষ্টা করলে আমি বললাম,
” ফরেন ক্যাডার। ”

উষ্মা আমার সাথে একমত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, মনে পড়ছে। ফরেন ক্যাডার। আমি ফরেন ক্যাডারে চাকরি করব, নানান দেশে ঘুরব আর সমুদ্র দেখব, পাহাড় দেখব, তুষারপাত দেখব, ভারি বৃষ্টিপাতে প্রতিদিন গোসল করব। আমাকে বাঁধা দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না। আম্মুও বকতে পারবে না। তখন তো আমি অনেক বড় অফিসার হয়ে যাব। ভয় পাবে। ”

আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে সে নিজের মতো বলে চলল,
” ততদিনে আপনিও আপনার মনের মতো সঙ্গী খুঁজে ফেলবেন। আন্টিকে তো আমি ঠিকানাই দেব না। আমাকে খুঁজে না পেয়ে আপনার পছন্দের মেয়েকে বউমা করতে রাজি হয়ে যাবে। ”

এবার আমি মুখ খুললাম। প্রশ্ন করলাম,
” তোমার মা কিছু বলবে না? প্রতিবেশিরা কথা শুনাবে না? ”
” সুযোগই পাবে না। আমার সাথে তো মা-বাবাকেও নিয়ে যাব। ঐদিকে বিয়ে না করলে কেউ কিছু বলে না। তাছাড়া, অত বড় অফিসার হলে ছেলের অভাব পড়বে নাকি? আমার পছন্দমতো একজনকে বিয়ে করে নেব। আমি খুশি, আমার পরিবার খুশি, আপনি খুশি, আপনার পরিবারও খুশি। বুদ্ধিটা কেমন বলুন? ”

আমি তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারলাম না। হঠাৎ করেই জানতে ইচ্ছে হলো, উষ্মার পছন্দের ছেলেটি কেমন হবে।

” অরু? উঠে গেছিস, বাবা? ”

বাবার গলা পেয়ে আমি সামনে তাকালাম তটস্থ হয়ে। মাও এসে দাঁড়াল বাবার পাশে। মৃদু ধমক দিয়ে কিছু একটা বললেন হয়তো। তারপরেই হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন,
” অরুণ, কখন উঠলি? ফ্রেশ হয়েছিস? ”

আমার দিক থেকে উত্তরের প্রত্যাশা না রেখেই উষ্মার দিকে তাকালোন। উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
” তোর চোখে-মুখের এ অবস্থা কেন, মা? রাতে ঘুম হয়নি? ”

উত্তরে মৃদু হাসল উষ্মা। ঠোঁটে হাসি রেখেই আমার দিকে তাকাল। ইশারায় কিছু একটা বলছে, আমি বুঝতে পারছি না। খেয়াল করলাম মা মুচকি হাসছে। উষ্মার থেকে একটু সরে বললেন,
” আমি গিয়ে দেখি, নাজু উঠল নাকি। ”

মা রান্নাঘরের দিকে এগুতে উষ্মা এক লাফে আমার কাছে চলে আসে। চোখ পাকিয়ে বলল,
” বলদের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আন্টিকে এনগেজমেন্টের কথা বলুন। এখনই। ”

আমি সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলাম। কী করব না করব ভাবনায় পড়তে উষ্মা আমাকে পেছন থেকে সামনে ধাক্কা দিল। চিৎকার করে বলল,
” আন্টি, আপনার ছেলে কী যেন বলবে। ”

মা দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলে আমি এনগেজমেন্টের কথা বলে ফেললাম।

____________

মুখ ফসকে এনগেজমেন্টের কথা বলে ফেলতেই উষ্মাদের বাড়িতে পাড়া-প্রতিবেশির ভিড় জমে গেল। চোখের পলকে মেহমানের খানা-দানা ও থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। মায়ের মুখে শুনলাম আংটি নাকি আগে থেকেই গড়ানো। তিনি জানতেন, উষ্মাকে দেখলেই আমার পছন্দ হয়ে যাবে। বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি করব। পরে যখন শর্তের কথা শুনলেন তখন মুখ কালো হলেও পর মুহূর্তেই মেনে নিলেন। খুশি হয়ে বললেন, বিয়ের জন্য না হলেও এনগেজমেন্টের জন্য তো পিড়াপিড়ি করেছি? তাতেই প্রমাণ হলো, মা আমাকে বুঝেন। আমার সকল পছন্দ জানেন।

উষ্মাকে সাজিয়ে যখন আমার সামনে আনা হলো তখন ওর পড়ার টেবিলটা স্পষ্ট হয়ে চোখের পর্দায় ভেসে উঠল। মুহূর্তেই মস্তিষ্ক তীব্রবেগে কাজ করতে শুরু করল। আমি উষ্মার সাজগোজে মনোযোগ না দিয়ে ফিসফিসে বললাম,
” তুমি না অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট? তাহলে টেবিলে ইন্টারের বইয়ে ঠাসা কেন? ”

উষ্মাও মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আনল। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে উত্তর দিল,
” অনার্সের বই কেনা হয়নি। টেবিল ফাঁকা থাকলে ভালো দেখায় না তাই ইন্টারের বই রেখে দিছি। ”

আমি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলাম,
” ফার্স্ট ইয়ারের বইও কেনোনি? ”

উষ্মা মুখ সরিয়ে নিয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলতে হলো না। মাথা দুপাশে নেড়ে না বুঝাল। আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালে, আম্মু অন্যপাশ থেকে ফিসফিসে বললেন,
” বোকা ছেলে, এত মানুষের সামনে এভাবে কেউ তাকায়? সকলে লজ্জা দেবে তো। চোখ নামা। ”

আমি চট করে চোখ সরিয়ে নিলে মা আমার হাতে আংটি ধরিয়ে দিল। সেই আংটি উষ্মার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে আমি প্রশ্ন করলাম,
” তোমার এসএসসি রেজাল্ট কী? ”

আংটিসহ হাত সরিয়ে উষ্মা উত্তর দিল,
” ৪.০০ ”
” এইচএসএসি? ”
” ৩.৫০ ”

আমি আর কিছু বলতে চাইলাম। আমার বন্দী মন চিৎকার করে জানাল, ‘ তুই ফাঁদে পড়েছিস। ‘

__________
আংটিবদলের অনুষ্ঠান শেষ করে বিদায় নিতে নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। উষ্মার বাবা বাড়ির সামনে সিএনজি দাঁড় করে রেখেছে। মা আর বাবা উঠে পড়লে আমিও উঠার প্রস্তুতি নিয়েও থেমে যাই। মা ভেতরে বসে জিজ্ঞেস জরল,
” কী হলো, অরুণ? কিছু রেখে আসছিস? ”

আমি মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতরে তাকালাম। উষ্মার বাবা-মা আমাদের এগিয়ে দিতে আসলেও উষ্মা দুয়ারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
” একটু শুনে যাও তো। ”

উষ্মা স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আসল। নাজু আন্টি আর আংকেল আমাদের একা ছেড়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি সএনজি একহাতে চেপে ধরেই জিজ্ঞেস করলাম,
” বলো তো ফরেন ক্যাডার হতে চাইলে, কী করতে হবে? ”
” বিসিএস পরীক্ষা দিতে হবে। ”
” বিসিএসের ফুল ফর্ম বলো। ”

উষ্মা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। অনেক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
” মনে পড়ছে না। ”

আমি হতাশ হয়ে সিএনজিতে বসলাম। ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করতেই আমার মন অংক কষতে শুরু করল, উষ্মা সবে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। অনার্স শেষ করতে প্রায় তিন বছর। বিসিএসের সকল পরীক্ষা সম্পন্ন করে চাকরি পেতে কম করে হলেও দু’বছর। তাহলে মোট পাঁচ বছর৷ একে-অপরকে জানতে কি পাঁচ বছর লাগে? প্রেম করে বিয়ে করতেও তো এত বছর লাগে না!

চলবে

#সর্দি_কন্যা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৭)

ছুটির দিন। সারা সকাল ঘুমে কাটিয়ে বিছানা ছেড়েছি। আড়মোরা ভেঙে ব্রাশ হাতে নিলাম। পেস্ট বের করব তখনই মা পেছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ব্রাশ পানিতে ভিজিয়ে বললাম,
” কিছু বলবে, আম্মু? ”

মা উত্তর দিলেন না। দূর থেকেই সরু চোখে চেয়ে রইলেন। আমি তখন দাঁত ঘষতে ব্যস্ত। উপরনিচ ঘষে ক্ষান্ত হলাম। মুখে পানি ভরে মায়ের দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় আগের প্রশ্নটাই করতে তিনি একটু এগিয়ে আসলেন। সরাসরি বললেন,
” উষ্মার তো পরীক্ষা শেষ। এবার বিয়ের তারিখ ঠিক করি? ”

আমি থতমত খেলাম। মুখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল আমার অনিচ্ছায়। মা আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন,
” নাজুকে কল দিয়ে ডাকব নাকি আমরাই যাব? ”

আমি নিজেকে ধাতস্থ করলাম। পুনরায় মুখে পানি ভরার জন্য কলের নিচে হাত রাখলাম। বললাম,
” এত তাড়াহুড়ার কী আছে, আম্মু? আমরা এখনও নিজেদের ভালো করে জানতে পারিনি। আরেকটু সময় দেও। আমি নিজেই তোমাকে বিয়ের কথা জানাব। ”

আমার মায়ের মুখের রঙ বদলে গেল। দাঁড়ানোর ভঙ্গি বদলে গেল। কণ্ঠ থেকে ক্রোধ ঝরে পড়ল,
” আর কত জানবি? চার মাস ধরে তো এই এক কথায় বলে যাচ্ছিস! ”

আমি মুখ ধোয়া থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এর মধ্যে চার মাস চলে গেছে! সময় এত দ্রুত যাচ্ছে কবে থেকে?

মা এবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আমার দিকে কড়া নজর দিয়ে বলল,
” চার মাসে কী কী জানলি, বল দেখি আমাকে। ”

আমি মায়ের দিকে চোরা চোখে তাকালাম। জবাবে কী বলব ভাবছি। কী কী জানা তো দূর সামান্য খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি। শরিয়তপুর ছেড়ে আসার পর উষ্মা ভারি বিরক্ত হয়ে সেঁটে গিয়েছিল মস্তিষ্কে। চিন্তা-ভাবনা থেকে তাড়ানোর জন্য কত কিছুই না করলাম! এত সহজে ও দ্রুত ভুলে যাব বুঝতেই পারিনি। মা জিজ্ঞেস না করলে হয়তো কোনো দিন মনেও পড়ত না।

মা আমার নীরবতা সহ্য করতে পারলেন না। ভীষণ চটে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন,
” চুপ করে আছিস কেন? বল কী কী জানলি। ”

আমিও নীরবতা ভেঙে রয়ে-সয়ে বললাম,
” তেমন কিছু নয়, আম্মু। সেজন্যই তো বলছি আরও সময় দেও। ”

আমি হাতে তোয়ালে নিয়ে বিছানার উপর বসলাম। মাও আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখের চাহনি আগের মতোই। বললেন,
” তোরা দেখা করছিস কোথায়? ”

আমি ভারি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোন জায়গার নাম বলব? মেয়েটা তো কাছেপিঠে কোথাও থাকে না যে চাইলেই একটা স্থানের নাম বলে দেব! মিথ্যা বলতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি? তাই বললাম,
” আমরা দেখা করছি না। ”
” তাহলে জানাশোনা কিভাবে হচ্ছে? ”

আমি সাথে সাথে জানালাম,
” ফোনে। ”

মা শান্ত হওয়ার বদলে আরও বেশি অশান্ত হয়ে পড়লেন। ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন,
” চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব। আমাকে মিথ্যা বলা? ”

আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘাবড়ে তাকালাম মায়ের দিকে। তবে কি মা সব জেনে গেছে? কিন্তু কিভাবে? আমি তো কিছু বলিনি। তাহলে কি উষ্মা বলেছে? মুহূর্তে আমার রক্ত গরম হয়ে গেল। মায়ের না দেওয়া চড়টা উষ্মাকে দিতে ইচ্ছে হলো।

মায়ের ক্রোধান্বিত ধ্বনি বাজল আবার,
” এতদিন তাহলে মিথ্যে বলেই আমাকে ভুলিয়েছিস? ”

আমি মাকে শান্ত করতে চাইলাম। কাঁধ চেপে ধরতে তিনি সরে গেলেন। কটমট চোখে চেয়ে বললেন,
” উষ্মা তো ফোনই ব্যবহার করে না। অন্য ফোন দিয়েও কারো সাথে কথা বলে না। ”

আমি একটু থামলাম। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রশ্ন করলাম,
” কেন? ”
” ওর সমস্যা হয়। ”
” কী সমস্যা? ”
” জানি না৷ ”

আমি আরও গভীরে না গিয়ে সুযোগটাকে কাজে লাগাতে বললাম,
” অন্য কারও সাথে বললে সমস্যা হয়, আম্মু। আমি অন্য কেউ না। ”

মা কিছু একটা বলতে চাইলে আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
” উষ্মার সাথে আমার রোজ ফোনে কথা হয়। অন্য ফোন থেকে নয়, নিজের ফোন থেকে। আমি গিফট করেছি। ”

মায়ের চোখ ছানাবড়! অল্পক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেন বুঝি। বেশ কিছুক্ষণ পর সুধালেন,
” সত্যি? ”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
” হ্যাঁ। ”

আনন্দে মায়ের চোখ-মুখ ঝলমলিয়ে উঠল। গলায় স্নেহের সুর এলো,
” এত বেলা করে কেউ ঘুম থেকে উঠে? এখন নাস্তা খাবি নাকি দুপুরের খাবার? ”

আমি হালকা হেসে বললাম,
” তোমার যেটা ইচ্ছে হয় দেও। ”

____________
আমার খাওয়া অর্ধেক হতে মা পাশের চেয়ারটায় বসলেন। বললেন,
” তোকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ করে ফেলছি। ”

আমি নিরুদ্বেগে জানতে চাইলাম,
” কী কাজ? ”
” উষ্মাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। ”

আমার খাবার গলায় আটকে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকালে তিনি অপরাধীর মতো বললেন,
” আমি ভেবেছিলাম, তোরা আমাকে মিথ্যা বলছিস। তোদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই, তাই নাজুকে কল করে বলেছি উষ্মাকে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দিতে। দেখা-সাক্ষাৎ নাহলে চেনাজানা হবে কীভাবে? ”

আমি আটকে যাওয়া খাবারটুকু গিললাম অতিকষ্টে। মা পানি এগিয়ে ধরে বললেন,
” মানছি, আমি ভুল ভেবেছিলাম কিন্তু পুরোপুরি নয়। শুধু ফোনে কথা বলে কি সব হয়? মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎও তো করা উচিত। ”

আমি পানি খাওয়া শেষ করলে মা আবার বললেন,
” তুই তো ফ্রি আছিস। একটু এগিয়ে নিয়ে আয় না, বাবা। ”

আমি চেয়ার ছেড়ে সটাং দাঁড়িয়ে পড়লাম। চিৎকার করে ‘ না ‘ বলতে চেয়েও বললাম,
” ঠিক আছে, আম্মু। কতদূর আছে, তুমি জেনে আমাকে জানিয়ে দিও। ”
” তুই জেনে নে। ”
” আমি কিভাবে জানব? ”

মা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
” ফোন করে। তুই তো বললি, ওর কাছে নাকি ফোন আছে। ”

আমি আবারও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললাম,
” ও হয়তো ফোন ফেলে আসছে। সকাল থেকেই বন্ধ পাচ্ছি। ”

মা চিন্তিত বদনে বললেন,
” বলিস কী! এখন মেয়েটা একা একা কিভাবে আসবে? রাস্তাঘাট তো একদমই চেনে না। হারিয়ে যায় যদি? ”

আমি থমথমে চোখে চাইলাম মায়ের দিকে। নীরবে বললাম, ‘ ও সব চিনে। ‘

________

উষ্মাকে খুঁজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা হলো না। হাঁচির শব্দ শুনেই তার উপস্থিতি টের পেলাম। রাস্তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে সিএনজি ঠিক করছিল। আমি হেঁটে গেলাম। দরাদরি বন্ধ করতে বললাম,
” উঠে বসো। ”

আমার হঠাৎ আগমনে উষ্মা একটুও ঘাবড়াল না। স্বাভাবিকভঙ্গিতেই আমার পাশে বসল। সিএনজি ছুটে চললে সে বলল,
” আপনি অনেক মিথ্যা বলেন? ”

আমি অপ্রস্তুত হলাম। রাগ নিয়ে বললাম,
” মিথ্যা বলব কেন? ”

উষ্মা জোর দিয়ে বলল,
” বলেছেন। অনেকগুলো মিথ্যা বলেছেন। নাহলে চার মাস আন্টিকে সামলেছেন কী করে? ”

আমি অন্য প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম,
” তুমি নাকি ফোনে কথা বলো না? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”

উষ্মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। আমি খেয়াল করলাম তার গালে লজ্জা রঙ! ভ্রূ উঁচিয়ে বললাম,
” উত্তর দেবে কি? ”

উষ্মা লাজুক কণ্ঠে বলল,
” সুড়সুড়ি লাগে। ”
” সুড়সুড়ি! হঠাৎ সুড়সুড়ি আসল কোথা থেকে? আমি জানতে চেয়েছি ফোনে কথা বলতে কী সমস্যা? ”
” ওটাই তো বললাম। ”

আমি তখনও উষ্মার কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। বোকা চোখে চেয়ে থাকলে সে বুঝিয়ে দিল,
” ফোনে কথা বলতে গেলে আমার সুড়সুড়ি লাগে। মনে হয় কেউ আমার কানে কানে কথা বলছে। আমার তো কানে সুড়সুড়ি! ”

আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। নিষ্পলকে চেয়ে থাকলাম উষ্মার লাজুক মুখটায়। মনে মনে ভাবছি, কানেও সুড়সুড়ি হয়? সেই সুড়সুড়িও আবার ফোনে কথা বলার সময় পায়! জগতের সকল আশ্চর্যজনক ব্যাপারগুলো নিয়েই কি এই মেয়ে জন্মেছে?

আমার ভাবনার সুতো কাটল উষ্মার হাঁচির শব্দে। আমি ভয়ে ও ঘেন্নায় একটু দূরে চেপে গেলে সে বলল,
” এটা সর্দির হাঁচি না, এলার্জির। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here