#দূর_দ্বীপবাসিনী
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
বিয়ের দিন নিজের বরযাত্রীকে ফেরত যেতে দেখতে হয়তো কোনো রমনীর ভালো লাগে না। কিন্তু এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী চারু। লাল বেনারসিতে বউরুপে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। চোখ থেকে নোনা জলের ধারা বইছে তার। অশ্রুসিক্ত চোখ গুলো শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কান্নারত মুখ গুলোর দিকে। নাহিয়ানের বাবা আশরাফ গনি পুত্রশোকে পাথর হয়ে রয়েছে। যে পুত্রের আজ বিবাহ হবার কথা ছিলো সেই পুত্র শুয়ে আছে মর্গের বরফঘরে। উপস্থিত মেহমানের মাঝে কথার ঢল পড়লো। কেউ কেউ আফসোস করছে তো কোথাও কানাগোসা চলছে, “বিয়ের দিন বর মারা গেছে, মেয়ে কি অলুক্ষণে? মেয়ের দোষ টোষ আছে নাকি?” কথাগুলো যেনো বাতাসে ভাসতে লাগলো। মেয়ের পিতা আহসান সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে বসে আছেন। ঠিক কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। একদিকে মেয়ের হবু বরের মৃত্যু তো অন্যদিকে মেয়েকে নিয়ে আজেবাজে কথার ঢল। উভয়ই তাকে মানসিক রুপে দূর্বল করে দিচ্ছে। দূর্বল চিত্তে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসগুলো মেনে নেওয়া দূষ্কর হয়ে উঠেছে তার জন্য। চারুর মা জাহানারা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। মেয়ের জীবনের সুখের দিনে দুঃখের লহর নেমে আসবে কে জানতো। কিছুক্ষণ আগেও সব ঠিক ছিলো। নাহিয়ানের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো চারু। কিন্তু একটা ফোন সব কিছু ঝড়ের মতো লন্ডফন্ড করে দিলো। কিছুক্ষন পূর্বের কথা,
আহসান সাহেব অথিতিদের আপ্পায়নে ব্যস্ত। বরপক্ষ চলে এসেছে প্রায়। বরের গাড়ি এখনো এসে পারে নি। সেই গাড়িতে বর এবং তার বন্ধুরা রয়েছে। আশারাফ সাহেব এসেই আহসান সাহেবের সাথে কোলাকোলি করলেন। বেয়াইয়ের সাথে তার খাতির বেশ। এদিকে চারু বউসেজে নিজের ঘরে বসে রয়েছে। তার বান্ধবীরা তাকে ঘিরে রয়েছে। মজার ছলে তাদের কত কথা, কিন্তু চারুর হৃদয় অপেক্ষারত প্রিয় মানুষটির জন্য। বিয়েটা পারিবারিক হলেও নাহিয়ানকে প্রচন্ড মনে ধরেছিলো তার। শুধু তাই নয়, মন থেকে এতোদিনে জমা ভয়টা মুক্তি পাচ্ছিলো। অবশেষে বিয়েটা হচ্ছে। এতোদিনের বিষাক্ত ঝাল থেকে এবার সে মুক্ত হতে চলেছে। ভাবতেই ভেতরটা উল্লাসে ভরে উঠছিলো। কিন্তু সব স্বপ্ন, কল্পনা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো কাঁচের মতো। একটা ফোন আসলো আশরাফ গনির মোবাইলে। নাহিয়ানের ফোন ভেবে তিনি রিসিভ করেন, তখন ই অপাশ থেকে শুনতে পান,
“আসসালামু আলাইকুম, আমি ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল থেকে বলছি। কিছুক্ষণ পূর্বে একটা দূর্ঘটনা হয়ে গেছে। দুটো গাড়ির বেশ বাজে ভাবে সংঘর্ষ হয়েছে। মোট ছয়জন আহতকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। তিনজন মারাও গিয়েছেন অন স্পট। তাদের একজনের মোবাইল এটা। আপনি কি তাদের পরিবারের কেউ?”
লোকটির কথা শোনামাত্র আশরাফ গনি মুখের অবস্থা পাল্টে যায়। দূর্ঘটনার খবর কানে আসতেই সে ধপ করে বসে পড়ে। জড়ানো কন্ঠে বলে,
“এটা আমার ছেলের নম্বর। আপনি কে বলছেন?”
“দেখুন আমরা তাদের এম্বুলেন্সের সাথে এসেছি। পুলিশে খবর দিয়েছি, তারা এখনো আসে নি। আহতদের অবস্থা ভালো না। তাদের ইমার্জেন্সিতে রেখেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন”
“একটু বলতে পারবেন যে তিনজন মারা গেছে তারা কে?”
“এটা কিভাবে বলি। তবে এটুকু বলতে পারবো। মৃত তিনজনের একজন বরের মতো পোশাকে ছিলো”
আশরাফ সাহেবের বুঝলে বাকি রইলো না তার ছেলে তার নেই। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আহসান সাহেব এবং বাকিরা ছুটে আসলো। বিয়ের দিন বর মারা গিয়েছে আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো। সংবাদটি কানে আসতেই পাথরের মতো বসে রইলো চারু। কাজলটানা চোখ গুলো মূহুর্তেই ভিজে আসলো। দমবন্ধ করা যন্ত্রণা হচ্ছিলো তার। বান্ধবীরা বুঝে উঠলো না কিভাবে স্বান্তনা দেওয়া যায়।
নাহিয়ানের ফুফা এবং দুলাভাই তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিক্যালের পথে রওনা হলেন। তাদের ধারণা নাহিয়ান বেঁচে আছে। কিন্তু এই ধারণা মিথ্যে হয়ে গেলো যখন মর্গের নিথর শরীরটা দেখলো। অতিথিরা একে একে প্রস্থান করতে লাগলো। আশরাফ গনি সহ বর পক্ষরা দুভাগে ভাগ হলো, কেউ বাড়িতে খবর দিতে গেলো তো আরেকভাগ গেলো লাশ আনতে। চারু এখনো জানালার ধারেই দাঁড়িয়ে আছে। জাহানারা মেয়ের মনোস্থিতি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। চারুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“চারু মা, কাঁদিস না। সব কিছু উপরওয়ালার হাতে আমাদের কিছুই করার নাই রে মা। এমন আজিব ঘটনা এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলাম। এমনো হয়? নিজেকে সামলা মা”
চারু মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলে,
“এটা কোনো আজিব ঘটনা না মা, আমি জানি এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। নাহিয়ানের গাড়ির দূর্ঘটনা কারোর সাজানো ষড়যন্ত্র”
চারু একে একে নিজের সাজসজ্জা খুলে ফেললো। মাথার ওড়নাটা খুলে রাখলো খাটে। একে একে সকল গয়না খুলতে লাগলো সে। মুখের সাজ গামছায় মুছে ফেললো। জাহানারা নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। বিয়ের সকল তামঝাম খুলে ফেলা হলো। মূহুর্তেই উৎসবমূখর বাড়িটি পরিনত শোকের অগ্নিকুন্ডে। যেখানে চারুর সব সুখের ছাই ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। ক্লান্ত কন্ঠে চারু বললো,
“মা, আমি একটু ঘুমাতে চাই। তুমি যাবার সময় দরজাটা ভিজিয়ে দিবে?”
জাহানারা কিছু বলতে চেয়েও বলে না। মেয়ের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে ঘর থেকে চলে যায়।
সন্ধ্যার পর “মেঘকুঞ্জ” এর বসার ঘরে সমাবেশ বসে। সমাবেশের কেন্দ্র চারুর বিয়ে। উপস্থিত আত্নীয় পরিজনদের নানা কথা, এর মাঝে কপাল চেপে বসে রয়েছেন আহসান সাহেব। তার বড় ভাই মনিরুল সাহেব খানিকটা রয়েসয়ে বললেন,
“কিছু ভাবলে?”
“কি বিষয়ে ভাইজান?”
“বিয়াটা তো ভাইঙ্গে গেলো। এখন কি করবা?”
আহসান সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি সত্যি জানেন না কি করা উচিত। এতো বড় ঘটনা মেয়ের কোমল হৃদয়ে কেমন আঘাত হেনেছে তা কল্পনাতীত। এর মাঝেই পুনরায় বিয়ে নিয়ে দহরম মহোরম কি সমুচিত হবে? এর মাঝেই জাহানারা বলে উঠলেন,
“ভাইজান মেয়েটাকে সামলানোর সুযোগ তো দেন। মেয়েটা আমার কেমন পাথর হয়ে গিয়েছে”
“আমি অবুঝ না জাহানারা, কিন্তু এই মাইয়ার বিয়ে কেমনে দিবা সে্টা কি ভাবছো? পাড়ার মানুষ নানা কথা কচ্ছে। তার কি?”
মনিরুল সাহেবের কথাটা আহসান সাহেবের ভালো লাগে নি, কিন্তু বড় ভাইকে সম্মান করেন বলে কিছু বলতেও পারছেন না। এর মধ্যে চারুর ফুপাতো ভাই ধ্রুব খানিকটা কড়া কন্ঠেই বলে উঠলো,
“মামা, চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা সময় সব গা ভরে যায়। এটাও ভরে যাবে। আর চারুর বয়স ই বা কত? খুজলেই আরোও ভালো ছেলে পাওয়া যাবে”
ধ্রুবর দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো আহসান সাহেব চাইলেন। যাক কেউ তো এবাড়িতে তাদের মেয়ের কথা ভাবছে।
নাহিয়ানকে পরদিন যোহরবাদ মাটি দেওয়া হলো। চারু শেষ বারের মতো নাহিয়ানকে দেখতে এলো। কিন্তু নাহিয়ানের মা শান্তা তাকে বাড়িতেই ঢুকতে দিলো না। জাহানারা এমন কিছু আগ থেকেই অনুমান করেছিলেন কিন্তু চারু বাধা শুনে নি। প্রিয় মানুষটিকে শেষ একবার দেখার ইচ্ছে কার না হয়। তাই ধ্রুব এর সাথে এই বাড়ি এসেছিলো। নাহিয়ানের বাড়ি থেকে আসার সময় আশরাফ গনির সাথে দেখা হয় চারুর। গনি সাহেবকে দেখে চারু তাকে সালাম দেয় তারপর বলে,
“আংকেল আমি জানি নাহিয়ানের সাথে বা আপনাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটা অনুরোধ আপনারা দয়া করে ভালো করে তদন্ত করবেন। এই দূর্ঘটনাটি কি স্বাভাবিক নাকি কোনো ষড়যন্ত্র”
চারুর কথায় গনি সাহেব ধরা গলায় বলে,
“তুমি বাড়ি যাও মা, আর তোমার আন্টির কথা কিছু মনে করো না। পুরোনো চিন্তার মানুষ তো”
চারু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সে সত্যি জানে না তার অনুমান ঠিক কি না, তবে এটুকু জানে কেউ আসে যে প্রতিনিয়ত তার দিকে নজর রাখে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের খবর যেনো তার কাছে আছে। ঘর থেকে বের হলেই এই অনুভূতিটি হয় তার। কেউ তাকে দেখছে। যখন ই কেউ তার কাছে আসতে চায় তখন অদৃশ্য দেয়ালের মতো তাদের বাধা দেয়। চারুর ধারণা লোকটি ই নাহিয়ানকে মেরে ফেলেছে। সে চায় না চারু মুক্তি পাক। তার বিছানো জাল থেকে তার মুক্তি যেনো নেই। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না, কারণ কোনো প্রমাণ নেই।
নাহিয়ানের বাড়ি থেকে বের হতেই ধ্রুব চারুর হাত টেনে ধরলো। ধ্রুব এর এমন কাজে বেশ অবাক হয় চারু। অবাক কন্ঠে বলে,
“কিছু বলবে ধ্রুব ভাই?”
“তোর কেনো মনে হলো এটা কোনো স্বাভাবিক দূর্ঘটনা নয়? তোর ধারণা নাহিয়ানকে কেউ খুন করেছে?”
“জানি না, মনে হলো বললাম তাই। কিন্তু তুমি আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো?”
“এমনি”
ধ্রুব আমতা আমতা করে উত্তর দিলো। তারপর হনহনিয়ে চলে গেলো সিএনজি খুজতে। চারু বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবের দিকে। মাঝে মাঝে ধ্রুবকে বুঝে উঠতে পারে না। খুব অদ্ভুত লোকটা, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে তাকে। ফুপুর মৃত্যুর পর থেকেই ধ্রুব তাদের বাসায় থাকে। লোকটা বড্ড বিচিত্র, তার চাহনী, কথাগুলোও বড্ড বিচিত্র। চারু দীর্ঘশ্বাস ফেললো, বুকটা বড্ড ফাকা ফাকা লাগছে।
বাড়িতে পৌছাতেই চরমভাবে অবাক হলো চারু। বসার ঘরে অচেনা পাঁচজন মানুষ বসে আছে। দুজন মহিলা এবং তিনজন পুরুষ। তাদের ঠিক বিপরীতে মনিরুল সাহেব এবং আহসান সাহেব বসে রয়েছেন। আহসান সাহেবের মুখ থমথমে হলেও মনিরুল সাহেব বেশ প্রফুল্ল। চারু বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথেই তিনি বলে উঠলেন,
“ওই যে আমাদের মেয়ে চলে এসেছে”
জাহানারা চারুর ওড়নাটা মাথায় টেনে দিলো। চারু তার দিকে অবাক দৃষ্টি তাক করতেই তিনি বললেন,
“উনারা তোমাকে দেখতে এসেছেন”
জাহানারা বেগমের কথাটা বৈদ্যুতিক শকের মতো লাগলো চারুর কাছে। সমস্ত গা ঘাম ছাড়লো। দেখতে এসেছেন মানে কি? সে কি মানুষ নয়? কাল যা ঘটেছে তার পর পুনরায় বিয়ের তোড়জোড়ের কি মানে! তার মতামতের কি কোনোই দাম নেই? এর মাঝেই পাত্র রুপে আসা ছেলেটির দিকে নজর যায় চারুর। ছেলেটিকে সুদর্শন বললে খুব ভুল হবে না। বেশ সাউথ ইন্ডিয়ান হিরোদের মতো শ্যাম চেহারার গঠন। ছেলেটির সবথেকে সুন্দর তার নীলাভ চোখ, সাধারণত বাঙ্গালীদের এমন চোখ হয় না। তবে ছেলেটিকে কোথাও তো দেখেছিলো। ঠিক মনে পড়ছে না চারুর। হঠাৎ ছেলেটি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হেটে চারুর সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের দেখাটা হয়েই গেলো, চারুলতা……………
চলবে