দূর_দ্বীপবাসিনী,৮,৯

0
972

#দূর_দ্বীপবাসিনী,৮,৯
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৮ম_পর্ব

মোস্তফা কামাল বই থেকে মুখ তুলেন, তার চাহনী শীতল। চোয়াল শক্ত। রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“এতো বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময় আমার অনুমতির প্রয়োজন হয় নি তোমার, অথচ ঘরে প্রবেশ করতে আদিক্ষেতা দেখাচ্ছো! আমি তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি”

বাবার তীব্র হুংকারেও শ্রাবণ নির্বিকার। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে সে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“ফুপু বলছিলো, আপনি আমাকে খুঁজছেন। যদি জরুরি কোনো কাজ না থাকে আমি কি যেতে পারি?”

শ্রাবণের নির্লিপ্ততা মেজাজ আরোও অধিক খারাপ করে দিলো মোস্তফা কামালের। রাগ চরম শীর্ষে পৌছে গেলো। হাতের কাছের গোলাকৃতি পেপার ওয়েটটি ছুড়ে পারলেন তিনি পুত্রের দিকে। বাবার বদমেজাজী স্বভাবটি অপরিচিত নয় তার। ফলে বা দিকে সরে যায় সে। দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় কাচের নির্জীব পেপার ওয়েট টি। হুংকার ছাড়েন মোস্তফা কামাল,
“অপদার্থ কোথাকার, ভাব নিচ্ছো তুমি? একে অপরাধ করেছো অথচ অনুশোচনার ছিটাফোটাও নেই। তোমার মা তো চলে গেছে, একটা অপদার্থ রেখে গেছে আমার জন্য। অসভ্য, বেয়াদব”

মায়ের কথা টানতেই নির্বিকার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। শান্ত চোখজোড়া জ্বলে উঠে রাগে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাক করে শ্রাবণ নিজের বাবার দিকে। কিন্তু মোস্তফা কামালের তাতে কিছুই যায় আসে না। তিনি তিনি দমলেন না, পুনরায় হুংকার ছাড়লেন,
“কি ভেবে একটা চালের ব্যাপারীর মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবছো তুমি। তুমি জানো না ওরা কারা? উপরন্তু ঐ মেয়ের তো আশরাফ গনির ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। যে আশরাফ গনি তোমাকে মারার চেষ্টা করতেও দুবার ভাবে নি, সব জেনেও…………”
“হ্যা, সব জেনেই আমি এগিয়েছি। সব জেনেই আমি চারুলতাকে বিয়ে করতে চাই”
“কিন্তু কেনো? মেয়ের কি আকাল ছিলো?”

শ্রাবণ নির্বিকার চিত্তে মাথা চুলকালো, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“আমার ইচ্ছা”
“তোমার ইচ্ছে তে সব চলে শ্রাবণ?”
“অন্তত আমার জীবনে তাই চলে বাবা, আপনার আপত্তি থাকলে আমার কিছুই করার নেই। আর একটা কথা, আমার আর চারুলতার মাঝে কোনো ঝামেলা চাচ্ছি না। আপনার ব্যাক্তিগত জীবনে আমি কখনো নাক গলাই নি, আশাকরি আপনিও আমার ব্যাক্তিগত জীবনে নাক গলাবেন না”

মোস্তফা কামাল ছেলের উগ্রতায় গজগজ করতে লাগলেন। কিন্তু মুখ থেকে কিছু বের হলো না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি চেয়ারে বসলেন। রাগে প্রেসার বেড়ে যায় তার। শ্রাবণের সাথে ঝগড়া করা আর উলো বনে মুক্তো ছড়ানো একই কথা। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন মোস্তফা কামাল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“শুনলাম আশরাফ গনির ছেলে মারা গেছে। তুমি জানো কিছু এ ব্যাপারে?”
“জানি, কেউ তার গাড়ির ব্রেক কেঁটে দিয়েছে”
“হু, তা এতে তোমার হাত নেই তো?”
“আমি কাঁচা কাজ করি না। যদি আর কিছু প্রশ্ন না থাকে আমি যেতে চাই। প্রচন্ড ক্লান্ত আমি”

মোস্তফা কামাল ছোট করে বলেন “যাও”। শ্রাবণ আর দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে বেড়িয়ে যায় সে। শ্রাবণ চলে গেলে চশমা খুলে কপালের চামড়া দু আঙ্গুল দিয়ে চেঁপে ধরে মোস্তফা কামাল। যে ছেলে চেয়েও বিয়ের জন্য রাজী করাতে পারে নি সেই ছেলে কি নিজ থেকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ের কথা বলে এসেছে। নিজের বাবাকে অতিথির মতো দাওয়াত দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলের কাজে প্রশ্ন হয়, সে কি আদৌও তার ছেলে? আবার মেজাজ, কথাবার্তা, চালচলনে সেই প্রশ্নটি গুছে যায়। তবে এই চারু নামক মেয়েটাকে প্রচন্ড কৌতুহল হচ্ছে মোস্তফা কামালের। চট করেই ফোনটা কানে ধরলেন, আঙ্গুল দিয়ে ডায়াল করলেনে একটা নাম্বার, হিনহিনে স্বরে বললেন,
“একটা মেয়ের যাবতীয় ডিটেইলস লাগবে”

☘️☘️☘️☘️

গোধলীর সময়, নীলাম্বরীর পশ্চিম কোনায় রক্তিম সূর্য ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাখিরা নিজ নিজ ঘরে ফেরার চেষ্টায় রয়েছে। কোলাহলপূর্ণ দিনের অবশেষে ইতি ঘটবে। নামবে নিকষকৃ্ষ্ণ আঁধার। নীলাম্বরী আকাশে উঠবে রুপালী চাঁদ। সেই চাঁদের আলোর কতো কতো কাহিনী। কারোর লাল ভালোবাসার, কারোর নীল বেদনার, কারোর ধূসর অভিমানের তো কারোর বর্ণহীন জীবনের। চারু নীলাম্বরীর ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেই কাহিনী গুলোর কথাই ভাবছিলো। তার পা এখন অনেক ভালো, ব্যাথা নেই। হাটতে কারোর সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এতে মোটেই খুশি নেই চারু। বরং তার মনে হচ্ছে পা টা ভেঙ্গে গেলেই ভালো হতো। অন্তত বিয়েটা কেঁচে যেতো হয়তো। আজ সকালের কথা, তার বড় চাচা মনীরুল সাহেব ফরমান জারি করলেন,
“দেখো চারু মা, জীবন গতিময়। কিছুই থেমে থাকে না। নাহিয়ানের সাথে যা হইছে তাতে আমাদের দোষ নেই। বরং আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়েছে। ছেলেটা ভালো ছিলো না। তার বাপ একটা গু/ন্ডা। তোমার চাচী তো বুঝে নি। গু/ন্ডার ঘরের সম্বন্ধ আনছে। এখন ই না বুঝতেছি, কি ভালো হইছে। আশরাফ সাহেবের এতো শত্রু যে তার শত্রু একটাই তার পোলারে মে/রে দিছে। তুমি বাচ্চা মানুষ, এগুলো নিয়ে ভেবো না। শ্রাবণ ছেলেটা ভালো। তার বাবা একজন নামী বিচারক। এমন ঘরে বউ হবা এটা তো খারাপের কিছু না”
“বাবা ভালো হলেই যে ছেলে ভালো হবে তার কি গ্যারেন্টি? শুনেছি সেও কন্সট্রাকশন বিজনেসে আছে। আশরাফ গনির সাথে একটা রেষারেষিও চলে। সে যে ভালো তার খোঁজ কি নিয়েছেন বড় মামা?”

ফট করেই ফোঁড়ন কাটলো ধ্রুব। ধ্রুবের যুক্তি ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু তার যুক্তিতে বড় চাচার মুখ চুপসে গেলো। তিনি যে অপ্রসন্ন হলো সেটা ভালো করে মুখে প্রকাশ পেলো। কিন্তু দমলেন না তিনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“বিয়ে তো এখন হচ্ছে না, তুমি দেখো। ঘুরো, বুঝো। যদি মনে হয় গলদ আছে আমরা বিয়ে ভেঙ্গে দিবো। কিন্তু তুমি যদি তাকে চেনার চেষ্টাই না করো কিভাবে হবে?”

চারু শুধু ঘাড় নাড়ায়, বড় চাচা মানুষটা সুবিধাবাদী। তিনি সময়ে সময়ে নিজের পক্ষ পালটায়। এই নাহিয়ান আর আশরাফ গনির প্রশংসায় এক কালে পঞ্চমুখ ছিলেন তিনি। কিন্তু আজ তাদের নামের যা তা বলছেন। এমন মানুষকে কি বলা যায়! স্বার্থপর, হয়তো তাই। ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করলো চারু। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওড়নাটা টেনে নিলো সে। হাতে থাকা ফোনটা বাজছে। আটাশি বারের মতো শ্রাবণ ফোন দিয়েছে। গত সাতাশি বারের মতো এবারো ফোনটা ধরবে না চারু। অহেতুক তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কি কথা বলবে! অগণিত এসএমএস নিয়েছে, একটার ও উত্তর দেয় নি চারু। ইচ্ছে হয় নি। মনটা বড্ড জট লাগিয়ে লেগেছে, নতুন জীবনের লোভ আর অতীতের ভয় মিলে ঘাবড়ে আছে সে। এই জট যে কবে খুলবে!
“নামায পড়বি না?”

চমকে পেছনে তাকায় চারু। পকেটে হাত গুছে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা শুকনো। ধ্রুবের এই সময়টা দোকানে থাকার কথা। মামাদের সাথে চালের আরোতে কাজ করে সে। ধ্রুব ভাই খুব উচ্চশিক্ষিত নয়, কিন্তু চালের আরোতে কাজ করার মতো ও নন। চাইলেই ভালো চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে, কেনো যায় না কে জানে? চারুর বাবা আহসান তাকে ভালোবাসলেও মনিরুল সাহেব পদে পদে অপমান করে। তবুও সব গিলে ফেলে সে। চারু মাথা নাড়িয়ে বলে,
“এই তো যাচ্ছি”
“আচ্ছা, এই বিয়েতে তুই রাজী?”

হুট করেই প্রশ্নটা ছুড়ে ধ্রুব। প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলিয়ে নেয় চারু। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“না রাজী হয়ে উপায় আছে?”
“যদি রাজী না থাকিস করতে হবে না বিয়ে, মামাদের আমি বুঝিয়ে দিবো”
“আমার জন্য কেনো অপমানিত হবে ধ্রুব ভাই?”

চারু স্মিত হেসে ফট করেই প্রশ্নটি করে। ধ্রুব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছু বলার আগে চারু বলে,
“তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক নিজেরটা বুঝে নিবো”
“শ্রাবণ ছেলেটাকে আমার ভালো ঠেকছে না চারু। সাবধান”

মিনমিনিয়ে কথাটা বলে ধ্রুব। তার কন্ঠ অন্যরকম ঠেকলো চারুর কাছে। বিষাদের উপস্থিতি টের পেলো সে। চারু উত্তর দিলো না। সে নেমে আসলো ছাঁদ থেকে। ধ্রুব দাঁড়িয়ে থাকলো সেস্থানেই। রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু অদৃশ্য। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে পায় না।

???

নিগূঢ় রাত, গভীর ঘুমে চারু। এমন সময় মাথার কাছের ফোনটা সজোরে বেজে উঠলো। রাতের নিস্তদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিলো বিশ্রী শব্দটা। ধরফরিয়ে উঠলো চারু। ঘুমঘুম চোখে হাতে নিলো ফোন। বাধ্য হয়েই ধরলো সে। হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে কানে এলো পরিচিত কন্ঠ,
“চারুলতা, একটু নিচে আসবে”

কন্ঠ কাঁপছে। কেমন বিচিত্র শোনালো যেনো। চারু কিছু বলার পূর্বেই ফোন কেটে দিলো। বুকটা কেঁপে উঠলো চারুর। শ্রাবণের কি কিছু হয়েছে। কৌতুহল এবং উদ্বিগ্নতায় আর বসে থাকতে পারলো না চারু। ফোনটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে লামলো সিড়ি দিয়ে। নিজের কেঁচি গেটটা খুললো খুব সাবধানে। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে গলির মাথায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। রাত কয়টা বাজে অনুমান করতে পারছে না চারু। শ্রাবণকে দেখতেই ঈষৎ রাগ হলো চারুর। এই রাতে পাগলামি করার কি মানে! চারু তার কাছে গেলো, বিরক্তি ভরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু তার পূর্বেই তার চোখ পড়লো…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৯ম_পর্ব

শ্রাবণকে দেখতেই ঈষৎ রাগ হলো চারুর। এই রাতে পাগলামি করার কি মানে! চারু তার কাছে গেলো, বিরক্তি ভরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু তার পূর্বেই তার চোখ পড়লো শ্রাবণের কপাল এবং হাতের দিকে। তার পরণের শার্টটা ময়লা হয়ে আছে, সাথে রক্তের দাগ। কালচে লাল দাগে রঞ্জিত তার শার্টটি। কপাল এবং হাতে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ব্যান্ডেজটার অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। চারুর রাগ কোথায় যেনো উবে গেলো। বরং মস্তিষ্ক ছেয়ে গেলো উদ্বিগ্নতায়। বা হাতটা নিজ হাতে নিয়ে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে আপনার?”

শ্রাবণ কিছুটা হতচকিত হলো৷ তারপর নিজেকে সামলে নিলো নিপুন ভাবে। স্মিত হেসে বললো,
“তেমন কিছু না, সামান্য চোট”
“সামান্য চোট? সামান্য চোট লাগছে এটা আপনার কাছে৷ রক্ত পড়ছে, ব্যান্ডেজ ভিজে গেছে। আর আপনি কি না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন। কিভাবে হলো এগুলো?”

চারুর কন্ঠে ক্রোধের আভাস পেলো শ্রাবণ, সাথে চিন্তার হাতছানি। শ্রাবণ প্রতিউত্তরে অদ্ভুত বাঁকা হাসি হাসলো। সেই হাসির মানে চারুর জানা নেই। তারপর হাসি অক্ষুন্ন রেখে বললো,
“তুমি ফোনটা ধরলে তো এমনটা হতো না, চারুলতা?”
“মানে?”
“আমি ঢাকার বাহিরে ছিলাম, তোমার সাথে একটুখানি কথা বলার জন্য মনটা আনচান করছিলো। কিন্তু তুমি তো তুমি। এতোবার ফোন দেবার পর ও একটাবার ফোন ধরলে না। তাই তাড়াহুড়ো করে আসার পথেই এই কান্ড ঘটলো। গাড়িটা উলটে গেলো আর মাথা আর হাতে চোট পেলাম। রাকিব আমাকে জোর পূর্বক হাতপাতালে নিলো ঠিক, কিন্তু ওখানে থাকতে ইচ্ছে করলো না আমার। তাই চলে আসলাম তোমাকে দেখতে”

শ্রাবণ নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো। এতে চারুর বিস্ময়ের সাথে সাথে ক্রোধও বাড়লো। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসলো তার। কপালে পড়লো ভাঁজ। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আপনি কি পাগল? নিজেকে একবার দেখেছেন? আপনার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। বা হাত নাড়াতে পারছে না। তবুও আপনি এখানে এসেছেন? আর বলছেন হাসপাতালে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। আপনি নিজে বুঝতে পারছেন কি বলছেন?”

চারুর ক্রোধের সামনে মাথা নত করতে হলো শ্রাবণের। সে উত্তর দিলো না। এক দৃষ্টিতে মাটির দিয়ে চেয়ে রইলো। চারু কিয়ৎকাল বাদে নিজের রাগ কমালো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
“কেনো বুঝেন না আপনি! আমার চিন্তা হয়”
“আমার জন্য তোমার চিন্তা হয়? কেনো?”

মিয়ে যাওয়া মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠে শ্রাবণের। তার চোখজোড়া চেয়ে রইলো উত্তরের প্রতীক্ষায়। এক অদ্ভুত চাহনী। যেনো বহুসময় ধরে এক উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। চারু নিজেও থমকে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। তবে শ্রাবণের দশা দেখে হুট করেই বুক কেঁপে উঠেছিলো এক অদ্ভুত হাহাকার সৃষ্টি হয়েছিলো। ভেবেছিলো আবারো কাউকে হারাতে চলেছে। চারু উত্তর দিলো না। বরং দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শ্রাবণ ম্লান হাসলো। তারপর বললো,
“আমার হাসপাতাল ভালো লাগে না চারুলতা। ভয় হয় খুব। তাই জোর করেই চলে আসলাম”
“আপনার পরিবার আপনাকে আটকায় নি”
“আমার এক্সিডেন্টের কথা কেউ জানে না”

শ্রাবণের নিষ্প্রাণ কন্ঠের কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে উঠলো চারুর। এতো বড় দূর্ঘটনা ঘটলো, অথচ বাড়ির কেউ জানে না। যতদূর চারুর মনে আছে শ্রাবণের মা মারা গেছেন, তার ফুপু তাকে মানুষ করেছেন। চারুর চিন্তিত মুখখানা দেখে শ্রাবণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“চিন্তা করবেন না চারুলতা, আসলে চিন্তা করবে বিধায় আমি জানাই নি”
“আপনি এতো খামখেয়ালি কেনো করেন?”
“চারুলতা, গাড়িতে বসবে? আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে”

কথাটা শোনা মাত্র এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না চারু। ফট করে গাড়িতে উঠে বসলো। লোকটার কথায় কি যেনো আছে, খুব মোহনীয়। চারু চাইলেও তা ফিরিয়ে দিতে পারে না। গাড়িতে বসলে শ্রাবণ বলে,
“নিরিবিলি কোথাও যাবে? আজ পূর্ণ চন্দ্রিমা। জ্যোৎস্নাবিলাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে”
“আপনার কষ্ট হবে না?”
“আমার স্বস্তির উৎস আমার পাশে। কেনো কষ্ট হবে?”

লোকটার সাথে তর্কে গেলো না চারু। দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরে তাকালো। শ্রাবণ হাড়ি স্টার্ট দিলো। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাজপথ চিরর এগিয়ে গেলো গাড়ি। শো শো করে মৃদু বাতাস লাগছে চারুর কানে। উম্মাদ হয়ে উঠেছে তার কৃষ্ণ চুল। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে। এই প্রথম রাতে ঢাকা শহর দেখছে চারু। এর পূর্বে কখনো সুযোগ হয় নি, সাহস ও করে নি। আজ কেনো যেনো ভীতু চারু সাহসী হয়ে উঠলো৷ মাত্র দিন বিশেক পরিচিত মানুষটির সাথে বেড়িয়ে পড়লো সফরে। কেনো যেনো ভয় হচ্ছে না। কোনো দূর্ভাবনা নেই মনে। এক অজানা আত্মবিশ্বাস রয়েছে বুকে। যেনো পৃথিবী উলটে গেলেও এই লোকটা চারুর গায়ে এক চিলতে আঘাত হানতে দিবে না। এই বিশ্বাস কেনো তৈরি হছে চারু নিজেও জানে না। তবে লোকটির নীলাভ নেত্রে এক অদ্ভুত টান দেখতে পায় চারু। হাজারো বিষাদ যেনো সেই আঁখিতে চেপে রেখেছে এই যুবক। গাড়ি থামলো একটা ব্রীজের উপর। চারু জানে না ব্রীজের নাম। নিচে ক্ষণপ্রবাহিত নদীতে পূর্ন চন্দ্রিমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। নীলাম্বরীর রুপালি চাঁদের আলো আছড়ে পড়ছে চারুর শ্যাম মুখে। চোখ বুজে প্রকৃতির নিস্তদ্ধতা উপভোগ করছিলো সে। ঠিক তখনই কর্ণকুহরে শ্রাবণের আকুল কন্ঠ ভেসে উঠলো,
“আমার কাজ তোমার কাছে পাগলামি, কিন্তু আমার কাছে তা ভালো থাকার উপায়। যখন গাড়িটা উলটে গিয়েছিলো। রক্তে আমার মুখমন্ডল ছেয়ে এসেছিলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিলো, তখন বারংবার তোমার মায়াবী মুখখানা ভাসছিলো চোখের সামনে। মনে হচ্ছিলো আর বুঝি দেখা হবে না। তাই ছুটে এলাম, জানি তোনার হৃদয়ে আমার স্থান নেই। কিন্তু আমার সমস্ত চিত্তে সে তোমার ই বাস। অজান্তেই ভালোবাসি তোমায় চারুলতা”

“ভালোবাসি” কথাটা বারংবার ঝংকার তুলতে লাগলো। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে চারু। শ্রাবণের দৃষ্টি তখন নভোস্থলের শেষ প্রান্তে। আধারে এক দৃষ্টিতে চেয়ে এওয়েছে সে। চারুলতা শুধালো,
“কেনো ভালোবাসেন আমায়?”
“এই উত্তরটা যে নেই আমার কাছে। শুধু একটা কথাই জানি বড্ড বেশি ভালোবাসি। তোমাকে যখন প্রথম দেখেছি যেদিন থেকে বুকের মধ্যিখানে তোমার জন্য মায়ামহল গড়ে উঠেছে। যেখানে শুধু তোমার রাজত্ব। প্রথমে ভেবেছি মোহ, তারপর সেই মোহ কবে ভালোবাসার রুপ নিলো টেরটি পেলাম না। যখন ফুপু বিয়ের জন্য জোর দিলো তখন তোমার মুখখানা ভেসে উঠলো মনে। পাগলের ন্যায় খুঁজলাম তোমায়। শেষমেষ পেয়েই গেলাম। তোমার চাচা সাথে দেখা হলো একটা কাজে। তিনি কথায় কথায় তোমার কথা বললেন। তোমার বিয়েতে দাওয়াত ছিলো আমাদের জানো? আমি গিয়েছিলাম ও। কিন্তু বিয়েটা হলো না৷ তোমার দুঃখের সময়টায় কষ্ট হচ্ছিলো, সাথে ক্ষীণ আশায়াও জন্মালো, তোমাকে নিজের কাছে সম্পূর্ণ আপন করে আনার। তাই পরদিন বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলাম৷ আমি জানি চারুলতা, তুমি নাহিয়ানকে মন দিয়ে বসেছো। তবুও কি আমার কোনো ঠাঁয় নেই তোমার হৃদয়ে?”

চারু চুপ করে রইলো, তার চোখ টলমল করছে। কেনো যেনো খুব কান্না পাচ্ছে তার। আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না আসছে। কিন্তু শ্রাবণের সামনে কাঁদবে না যে। মাথা নত করে রেখেছে নিজের অশ্রু লুকাতে। শ্রাবণ উত্তরের আশা ছেড়ে দিলো। চারু উত্তর দিবে না ভেবে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঠিক তখনই কাঁপা স্বরে চারু বললো,
“আমার ভয় করে, পুনরায় আশায় বুক বাঁধতে ভয় করে”
“কেনো? কিসের ভয়”
“একজন আছে, যে আমাকে কারোর হতে দিবে না। আমি জানি না মানুষটা কে, কিন্তু এটুকু জানি সে চায় না আমি অন্য কারোর হই”

চারু কাঁদছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোত ব্যার্থ চেষ্টাও করছে। শ্রাবণ কিছুটা এগিয়ে এলো। ডান হাতে আলতো করে চেপে ধরলো চারুর কাঁধ। মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“কেদো না চারুলতা, তোমার কান্না যে অসহনীয় লাগে আমার কাছে”

চারু শুনলো না। তার শক্ত বক্ষস্থলে মুখ লুকিয়ে নিলো। ডুকরে উঠলো বারে বারে। গাঢ় নিঃশ্বাস শ্রাবণের বুকে আছড়ে পড়ছে। নোনাজোলে ভিজে যাচ্ছে শার্ট। সে বাঁধা দিলো না। আজ প্রথমবার চারুলতা তার সাথে দুঃখবিলাস করছে। এই সুযোগকে কি হাতছাড়া করা যায়। একটা সময় চারু থামলো। দলা পাকানো স্বরে একে একে খুলে বললো সব। প্রথমে আজগুবি মনে হলেও ক্রমেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো ললাটে। অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি শিওর নাহিয়ানের সাথে যা হয়েছে তা ওই মানুষটি করেছে?”
“নাহ, শিওর না। তব সে করতে পারে না এমনটাও নয়”
“তুমি কি তাকে ভয় পাও”

চারু কিয়ৎকাল চুপ করে রইলো। হয়তো মনের ভেতরে উত্তর খুজলো। এর পর ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমি তাকে ভয় পাই না, ভয় পাই ওর ভালোবাসাকে। বিশ্রী, দমবন্ধ করা ভয়ংকর ভালোবাসা; যা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে আছে”

শ্রাবণ কিছু বললো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চারুর ম্লান মুখশ্রীর দিকে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডান হাতে আলতো করে ধরলো তার মুখশ্রী। উষ্ণ ঠোঁট ছুয়ে দিলো চারুর কপালে। আকস্মিক কাজে শিউরে উঠলো চারুর শরীর। ঈষৎ ঝাকুনি খেলো সে। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেলো উষ্ণ রক্তের প্রবাহ। চোখ মেলে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ তখন দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আর ভয় পাবে না চারু, আমি থাকতে ওই মানুষ তোমাকে ছুতেও পারবে না। তুমি যেহেতু তাকে ভয় পাও, আমি তোমার ছায়ার কাছেও তাকে ভিড়তে দিবো না। কথা দিলাম”

চারু খেয়াল করলো তার বুকের জমে থাকা কৃষ্ণ ভয়ের মেঘগুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এতোকালের ত্রাশ, আতংক সব কর্পুরের ন্যায় উড়ে গেলো। একবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো শ্রাবণের কথায়। কি যেনো আছে লোকটার মাঝে, যা চারুকে টানে। এক অবিচ্ছিন্ন আকর্ষণ।

চারুকে বাড়ির গেটে নামিয়ে দিলো শ্রাবণ। চারু শাসনের স্বরে বললো,
“এখন হাসপাতালে যাবেন, ব্যান্ডেজ বদলাবেন। রেস্ট করবেন ডাক্তারের কথা মতো।”
“তুমি ফোন ধরবে তো?”
“ভেবে দেখবো”

শ্রাবণের মুখটা মিয়ে গেলো। চারু মৃদু হাসলো। তারপর পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। একটু পর ই ফযরের আযান দিবে। বাড়ির লোকেরা উঠে গেলে তার মার মাটিতে পড়বে না। তাই সাবধানে প্রবেশ করলো সে। কিন্তু এতো সাবধানতার মাঝেও একজোড়া চোখ ঠিক তাকে দেখে ফেললো। আক্ষেপের নিঃশ্বাস বের হলো নিমিষেই______

☘️☘️☘️

দুপুর বেলা, সূর্য এখন মাথার উপর। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ। দূর কোথাও কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে। আজ সূয্যিমামা প্রচন্ড রেগেই আছে হয়তো। তাইতো প্রকোপটা অধিক। চারু চুলগুলো উচু করে খোপা করে নিলো। রোদটা ঘাড় পুড়িয়ে দিচ্ছে। তবুও হাটা থামালো না সে। দ্রুত পায়ে রাস্তার কোনা দিয়ে হেটে যাচ্ছে সে। চিত্রাটা খুব জিদ করলো, সে নাকি বট ভাজি খাবে। ধ্রুবকে বলেছিলো, সে নাকি হুংকার ছেড়েছে। তাই অবশেষে চারুর কাছে আকুতি মিনতি করলো। চারুও বোনের আকুল নিবেদন ফিরিয়ে দিতে পারলো না। তাই কলেজ থেকে আসার সময় নামলো হালিমের দোকানে। ভাগ্যিস আজ বটভাজি ফুরিয়ে যায় নি। বটভাজি কেনার পর বাধলো ঝামেলা৷ একটা রিক্সা নেই। রিক্সা যেটা পেয়েছিলো সেটা ছেড়ে দিয়েছে সে। ফলে এখন বাধ্য হয়েই হেটে যেতে হচ্ছে তাকে। হাটতে হাটতে গলিতে ঢুকলো চারু। আর দু গলি পড়ে তাদের গলি। কিন্তু শরীরটা আর হাটতে চাইছে না। এর মাঝেই ফোন বাজলো। একটু থেমে ফোনটা ধরলো সে। অপাশ থেকে শ্রাবণের কন্ঠ শোনা গেলো,
“কি করো চারুলতা?”
“এই তো বাড়ি যাচ্ছি, আপনি?”
“আমি বিছানায় শুয়ে আছি। বউ এর আদেশ তো অমান্য করা যায় না।”
“আমি আপনার বউ?”
“এখন নও, হতে কতক্ষণ। আর পাঁচ মাস, ভালো কথা। বাবা আসতে চাচ্ছিলেন তোমাকে দেখতে”

শ্রাবণের বাবার কথা শুনতেই কিঞ্চিত গলা শুকিয়ে আসলো চারুর। মিনিয়ে বললো,
“উনি কি খুব কড়া?”
“আমি আছি তো চারুলতা, তুমি হাপাচ্ছো কেনো?”
“আসলে, রিক্সা পাই নি তো হেটেই যেতে হচ্ছে। এই তো চলে এসেছি…

কথাটা পুরো করতে পারলো না চারু। তারপূর্বেই একজোড়া কালো হাত তার মুখ চেপে ধরলো…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here