দূর_দ্বীপবাসিনী,১২,১৩

0
822

#দূর_দ্বীপবাসিনী,১২,১৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১২তম_পর্ব

সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে অশ্রু ছেড়ে দিলো সে। মানুষটিও পরম যত্নে খুলে দিলো সব বাঁধন, মোহনীয় কন্ঠে বললো,
“আমি এসে গেছি চারুলতা, ভয় নেই”

শ্রাবণের মোলায়েম কন্ঠ চারুর ব্যাকুল চিত্তে মূহুর্তেই স্বস্তির প্রলেপ ছুয়ে দেয়৷ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা চারুর মুখমন্ডলে আলতো হাতের পরশ ছোঁয়ায় শ্রাবণ। চারু মাথা ঠেকালো শ্রাবণের বুকে। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। এতোসময়ের জমায়িত ভয়গুলো অশ্রু রুপে গড়িয়ে পড়ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশেরা পুরো জায়গাটা তন্নতন্ন করে খুঁজছে। একটা পুরানো মিলের পেছনের অংশে আটকে রাখা হয়েছিলো চারুকে। জায়গাটা কাওরানবাজারের দক্ষিণ দিকে। মিলটা বিগত দশ বছর ধরে বন্ধ। ফলে অনৈতিক কাজ করাটা খুব সহজ। মোস্তফা কামাল যখন নিজের বন্ধু জাহিদুল কবিরের সাথে চারুর নিখোঁজ নিয়ে আলোচনা করে, তখন জাহিদ আশেপাশের সকল থানায় খবর দিয়ে দেন। ক্রমাগত চারুর মোবাইল ট্রাক করা হয়। বিভিন্ন ট্রাফিককে ইনফর্ম করে দেওয়া হয় যেনো তারা সন্দেহ জনক যেকোনো গাড়িকে আটকায়। সময় পার হতে থাকে কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া যায় না। একটা সময় শ্রাবণ অধৈর্য্য হয়ে পড়ে তার চারুলতার জন্য। ছেলের অধৈর্য মোস্তফা কামালের পক্ষে সামাল দেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে। ভাগ্যবশত ই ক্ষীন সময়ের জন্য চারুর মোবাইলটা অন হয়। তখন ই সেই লোকেশনটা ট্রাক করে পুলিশ। ফলে একদল পুলিশ নিয়ে শ্রাবণ আসে এই মিলে। পুরো মিলের তল্লাশি করে অবশেষে এক বন্ধ মেশিন রুমে চারুকে আটক অবস্থায় পায় শ্রাবণ। শ্রাবণ নিবিড়ভাবে আকড়ে ধরে আছে চারুকে। চারুর শরীর ঈষৎ কাঁপছে। এখনো মন থেকে বিশ্রী স্মৃতিগুলো সম্পূর্ণ সরে নি। সাব ইন্সপেক্টর শাহাদাত ছুটে আসে। অস্থির গলায় বলে,
“হা/রা/ম/জা/দা গুলো পালিয়েছে স্যার, ওখানে শুধু একটা ময়লা গামছা আর সিগারেটের দশ বারোটা ফিল্টার ছিলো। মনে হয় অন্তত চার থেকে পাঁচ জন ছিলেন”

শাহাদাতের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হয় কাওরানবাজার থানার ইন্সপেক্টর সামিন উল্লাহ এর। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে,
“একটাকে ধরতে পারলেই সম্পূর্ণ অ/প/হ/র/নের খোঁজ পেয়ে যেতাম। কেউ হয়তো আগ থেকেই ওদের জানিয়ে নিয়েছে। এজন্য চারু ম্যাডামকে রেখেই তারা পালিয়েছে। ধ্যাত”

এরপর একটু থেমে বললো,
“মিস্টার জায়ান, আমাদের ম্যাডামের বক্তব্য শুনতে হবে। নয়তো কিছুতেই এই লোকগুলোকে ধরতে পারবো না।”
“অফিসার, চারুর অবস্থা আপনার দেখছেন। এই অবস্থায় ওকে কোনো রকম ডিস্টার্ব করাটা ঠিক হবে না। ওকে স্বাভাবিক হতে দিন। ওর বয়ান সঠিক সময়েই পাবেন”

সামিন সাহেব কথা বাড়ালেন না। সামনে থাকা তেইশ বছরের নারীটির চোখ মুখের অবস্থা ভালো নেই। সে ক্রমেই কেঁপে উঠছে। চোখ বসে গিয়েছে, হয়তো দুপুরের পর কিছুই পেটে পড়ে নি। যতই হোক, তারাও মানুষ। একজন মানুষের করুন দশা দেখেও তাকে প্রশ্ন করাটা সমীচীন নয়। তাই সামিন কথা বাড়ালো না। চারুকে ধরে উঠালো শ্রাবণ। কিন্তু এতো সময় হাটু গেড়ে মাটিতে বসে থাকার কারণে পায় অবশের ন্যায় হয়ে গেছে। ফলে উপায়ন্তর না পেয়ে কোলে তুলে নেয় তাকে শ্রাবণ। চারুও শান্ত বিড়ালের ছানার ন্যায় বুকে লেপ্টে তাকে তার। শ্রাবণ তার প্রিয়তমাকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে হাটতে লাগলো। মিলের হলদে সোডিয়াম লাইটের আলো আছড়ে পড়ছে চারুর শ্যামমুখে। অশ্রুর রেখাগুলো সেই আলোতে চকচক করছে। কি মায়াবী লাগছে তার চারুলতাকে। রুদ্ধশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। এতোসময়ের উচাটনের অবশেষে সমাপ্তি হলো_____

???

মেঘকুঞ্জে থমথমে পরিবেশ। আহসান সাহেবের বুকের ব্যাথাটা বাড়ছে, সাথে দুশ্চিন্তাও। ধ্রুব এখনো বাড়ি ফিরে নি, হয়তো আশেপাশের পাড়ায় খোঁজ নিচ্ছে। মনীরুল সাহেবের হিনহিনে কন্ঠ কানে আসছে। এই লোকটার বয়স হয়েছে ঠিক কিন্তু কান্ডজ্ঞান এখনো শূন্য। এতো বয়স হবার পর ও সময় জ্ঞান নেই বললেই চলে। জাহানারা বেগম মেয়ের দুশ্চিন্তায় বারে বারে মূর্ছা যাচ্ছেন। খাবার খেতেও তার অনীহা, সেই দুপুর থেকে মেয়ের অপেক্ষায় আছেন তিনি। আতংক, ভয়, দুশ্চিন্তা তাকে ক্রমেই গ্রাস করছে। মারুফা তাকে সামলাচ্ছেন। এর মাঝেও মনীরুল সাহেবের হুমিড়ি তুমড়ি অব্যহত থাকলো। এক পর্যায়ে চিত্রা নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। বাবার মুখোমুখি হলো সে। ঠান্ডা গলায় বললো,
“বাবা, তুমি থামতে কি নিবে বলোতো? ঘরের অবস্থা কি একটিবারের জন্য ও বুঝবে না?”
“আমাকে বলছিস কেনো? কতবার বলেছিলাম মেয়েদের এতো পড়িয়ে কি হবে? শুনলো কোথায় আহসান। আরোও বের করুক মেয়েকে। না জানি কোথায় আছে। আমাদের সম্মান কি আর রেখেছে? একেই তার বিয়ে ভেঙ্গেছে এখন সে নিখোঁজ। তোর কি ধারণা ওর বিয়ে হবে? পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে তোমার বোনের। আজ যদি শ্রাবণের সাথে বিয়েটা হয়ে যেতো। আমাদের ঘাড়ে তো দোষ আসতো না।”
“শুনেছিলাম পৃথিবীতে নাকি ভালো পুরুষ না থাকলেও ভালো বাবা থাকে। আজ স্বচক্ষে তা ভুল হতে দেখছি। বুবুর জায়গায় তো আমিও থাকতে পারতাম। তখন ও কি একই কথা বলতে বাবা? সে তো তোমারো মেয়ে! ছোট চাচার অবস্থা দেখেছো? চাচী তো মূর্ছা যাচ্ছেন বারে বারে। মহিলা, জায়নামাজে মাথা ঠুকাচ্ছে মেয়ে যেনো ফিরে আসে। অথচ তুমি কোথায় বুবুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে তা নয়, আহাজারি শুরু করেছো। আমিও তো মেয়ে। আমার নিরাপত্তার জন্য কি তবে তুমি আমার পড়ালেখা ও বন্ধ করে দিবে?”

মনীরুল সাহেব মেয়ের কথা সহ্য করলেন না। শক্ত হাতের প্রবল চড় বসিয়ে দিলেন। হিনহিনে স্বরে বললেন,
“বেশি বুলি ফুটেছে তাই না? যতসব। একদম ঘরে বসে থাকবি। চারুর বিয়ের পর তোর বিয়ে আগে দিবো আমি। তারপর যা খুশি করে বেড়া গে যা”

মনীরুল সাহেবের কথা শুনে চুপ করে থাকে চিত্রা। গালে হাত দিয়ে নিরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। মাঝে মাঝে নিজের বাবাকে দেখে আফসোস হয় চিত্রার। কেনো! পরমকরুনাময় এই মানুষটার সন্তান হিসেবে পাঠিয়েছেন। মার কাছে শুনেছিলো মনীরুল সাহেবের ইচ্ছে ছিলো তার ছেলে সন্তান হয়। কিন্তু আল্লাহ দুজন পুত্র দিয়েও নিয়ে গেছেন। অবশেষে সন্তান হিসেবে চিত্রাই তার বংশধর হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। ছোটবেলা থেকেই চিত্রার প্রতি এক বাজে অবজ্ঞা মনীরুল সাহেবের মনে। যেনো এই মেয়েটাও মা/রা গেলে তিনি বেঁচে যেতেন। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আছে চিত্রার। ঠিক সেই সময়ে লোহার গেটের আওয়াজ পায় চিত্রা। ছুটে যায় গেটের দিকে সে। বাসার মেইন দরজা খুলতেই অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
“চাচা, বুবু ফিরেছে”

আহসান সাহেব ছুটে আসেন। শ্রাবণ আগলে ধরে আছে চারুকে। আহসান সাহেব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। বিবর্ণ মুখশ্রী, দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, ময়লা পোশাক, অবিন্যস্ত চুল। এক প্রহরেই মেয়েটা যেনো নির্জীব হয়ে গিয়েছে। আহসান সাহেব মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলে,
“মা রে! তুই ঠিক আছিস তো?”

চারু টলমল দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। হু হু করে কেঁদে উঠে যে। বাবার স্নেহে সকল ভয় যেনো কেটে গেছে তার। অস্পষ্ট স্বরে ছোট করে বলে,
“হু”

বিছানায় শোয়ানো হয় চারুকে। জাহানারা মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন। দু রাকাআত নফল নামাজ ও আদায় করেছেন সে। ধ্রুব চিত্রার ফোনে ছুটে আসে। চারুর মুখশ্রী দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। ধ্রুব এর ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটিকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পারে না, নিজের শিকল তাকে আকড়ে ধরে। সেই মূহুর্তে, মনীরুল সাহেব বলে উঠেন,
“শ্রাবণ বাবা, ওকে পেলে কোথায়?”
“কিছু খারাপ মানুষ ওকে অ/প/হ/র/ণ করেছিলো। ভাগ্যিস পুলিশ ফোর্সকে বাবা ইনফর্ম করেছিলো। নয়তো ওকে পাওয়া সহজ হতো না। কাওরানবাজারের একটা বন্ধ মিলে আটকে রেখেছিলো তারা। পুলিশের ধারণা ওরা মেয়ে পাঁচারকারী। এখন চারুর বক্তব্যে আগামী পদক্ষেপ নিবে তারা। ওর দিকে খেয়াল রাখবেন। ভয় পেয়েছে বড্ড। আমি আসছি”

শ্রাবণ যেতে নিলে মনীরুল সাহেব বলে উঠেন,
“তুমি বলেছিলে কাল তোমার বাবা ওকে দেখতে আসবে। সেই ব্যাপারটা!”
“আংকেল, সময় তো চলে যায় নি। চারু ঠিক হোক। সময় করে আসবো না হয়”

মনীরুল সাহেব চুপসে যান। কপালে ভাঁজ পড়ে। শ্রাবণ বেড়িয়ে যেতে নিলেই হিনহিনে কন্ঠে বলে,
“মেয়ে কি ঠিক আছে?”

শ্রাবণের পা আটকে যায়। আহসান সাহেব ভাইকে থামানোর জন্য বলেন,
“কি বলছেন ভাইজান?”
“না মানে, সময় তো কম না। চার-পাঁচঘন্টা, বন্ধ মিলে। সে/য়া/না মেয়ে! কিছু অঘটন কি ঘটেছে?”

শ্রাবণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মনীরুল সাহেবের দিকে। সে বোঝার চেষ্টা করছে লোকটা কি বলতে চাচ্ছে। মনীরুল সাহেব বলতে শুরু করে,
“আজকাল তো দিন ভালো না। ওরা যদি খারাপ কিছু করতে চায়, মানে বুঝোই তো। আল্লাহ না করুক যদি এমন কিছু হয়। এই মেয়ের কি বিয়ে হবে! হয়তো চারুর ভাগ্য ই খারাপ, বিয়েটা তার নসিবে নেই। তাই তো বিয়ের আগেই যতসব অঘটন ঘটে। মোস্তফা সাহেব ও একবার ভাববেন না। অবশ্যই ভাববেন, তাই তো তিনি ও সময় নিচ্ছেন। আসলে কি বলতো আহসান, মেয়ে মানুষকের চরিত্রে দাগ পড়লে তাকে কেউ ই মেনে নেয় না।”

শ্রাবণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মনীরুল সাহেবের দিকে। আহসান সাহেব তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন,
“ভাইজান, এবার ক্ষান্ত দেন। অনেক হইছে আর না। আমার মেয়েটার কথা তো ভাবেন। ও যে বাড়ি আসছে এটা অনেক না? ওর মুখের দিকে একবার দেখছেন?”
“তুমি ওই মেয়ের দিকেই দেখো। বাড়ির চৌকাঠের বাহিরে কি কি কথা হয় জানো কিছু? কাল সকাল হইতে দাও। দেইখো কত কত কথা উঠে”
“বড় মামা, থামেন না। আপনি তো বাহিরের লোক থেকেও খারাপ। আপনি একবার ভেবেছেন চারুর মনোস্থিতি এখন কেমন?”

ধ্রুব থেমে থাকে না। তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রতিবাদ করে উঠে। একটা সময় কথার রেশ বাড়ে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শ্রাবণ। এতো কোলাহল তার অপছন্দ। এই ঘরের কোন্দল তার সবচেয়ে অপছন্দ। ফোনটা বের করে সে পকেট থেকে। এরপর একটা নাম্বারে ফোন করে, তারপর শীতল কন্ঠে বলে,
“হ্যালো রাকিব, কাজী অফিস খোলা থাকলে একটা কাজী ধরে নিয়ে আসো”
“কেনো স্যার?”
“আমি এখন বিয়ে করবো……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৩তম_পর্ব

একটা সময় কথার রেশ বাড়ে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শ্রাবণ। এতো কোলাহল তার অপছন্দ। এই ঘরের কোন্দল তার সবচেয়ে অপছন্দ। ফোনটা বের করে সে পকেট থেকে। এরপর একটা নাম্বারে ফোন করে, তারপর শীতল কন্ঠে বলে,
“হ্যালো রাকিব, কাজী অফিস খোলা থাকলে একটা কাজী ধরে নিয়ে আসো”
“কেনো স্যার?”
“আমি এখন বিয়ে করবো, অযথা সময় নষ্ট করো না। মেক ইট ফাস্ট, আই এম ওয়েটিং”

কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো শ্রাবণ। তার শীতল কন্ঠে রাকিব তাজ্জব বনে গেলো। স্যারের পাগলামী এর পূর্বেও বহুবার দেখেছে। তবে আজ মাত্রা ছাড়ালো মনে হলো, এই রাতে কাজী কোথায় পাবে সে। শ্রাবণের কথা মেঘকুঞ্জে এক অন্য লহর তুললো। বাড়িতে উপস্থিত সকলের মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। আহসান সাহেব তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“কাজী মানে? বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি? চারুর মনোস্থিতি এখন কি স্বাভাবিক আছে। বললেই হলো, এখন বিয়ে? ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার”

আহসান সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। শ্রাবণের মতো শান্ত এবং ধীর ছেলের এমন সিদ্ধান্ত যেনো হজম হচ্ছে না তার। শ্রাবণকে তার অপছন্দ নয়, বরং তিনি এবং জাহানারা চারুর জন্য ঠিক যেমন পাত্র চেয়েছিলেন শ্রাবণের মাঝে সেই সকল গুণাবলী রয়েছে। যে যেমন ধীর, স্থির, বিনয়ী ঠিক অনুরুপ ভাবে সে অত্যন্ত দায়িত্ববান চারুর প্রতি। যখন ই চার বিপদে পড়েছে সে চারুকে আগলে রেখেছে। কিন্তু এই সময়ে চারু ঘাবড়ে আছে। তার মনে ঝড় বইছে, অশান্ত চিত্তে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না, যা তার জীবনকে সাজানোর পরিবর্তে এলোমেলো করে ফেলে। সকলের নজর শ্রাবণের দিকে। ধ্রুব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলে রাখছে। পরিস্থিতি তাকে এমন মোড়ে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে চাইলেও সে ফিরতে পারছে না। চিত্রা ধ্রুব এর দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষের মুখমন্ডলে নীল বিষাদের ছাপ কারোর দৃষ্টিগোচর না হলেও তার নজর এড়ালো না। নিজে যে আগুণে প্রতিনিয়ত জ্বলছে সেই আগুনে ধ্রুবকে পুড়তে দেখে মোটেই শান্তি পাচ্ছে না সে। শ্রাবণ নির্বিকার। সে অপেক্ষায় আছে কাজীর। আহসান সাহেব পুনরায় বলে উঠলো,
“দেখো শ্রাবণ, আমার মেয়ের মানসিক অবস্থা এখন ঠিক নেই। তাই এসব পাগলামী থামাও”
“আপনার বাড়িতে চারুলতার মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন? প্রতিনিয়ত কিছু তিক্ত কথা রীতিমতো তাকে আরোও অসুস্থ করে ফেলবে। আর চিন্তা তো বিয়ে নিয়ে, আমি এখন ই সেটা করে ফেলছি। তাহলে ভবিষ্যতে আমার কথার নড়চড় ও হবে না। আপনার শ্রদ্ধেয় ভাই এর ও আপত্তি থাকবে না। বিয়েই তো, একটা কলমের খোঁচা আর কবুল বলা। আমি সেই ঝামেলা এখন ই মিটিয়ে ফেলছি। আর বাকি রইলো আনুষ্ঠানিকতার। আগামী শুক্রবার না হয়, ধুম ধাম করে বিয়ে হবে”

শ্রাবণের কন্ঠে রোষের আভাস পেলেন আহসান সাহেব। মনীরুল সাহেব শুকনো ঢোক গিললেন। শান্ত স্বভাবের শ্রাবণের মাঝে একটা পাগলেটে অস্থির মানুষ লুকিয়ে আছে ব্যাপারটা ধারণা করতে পারেন নি তিনি। এর মাঝে ধ্রুব মুখ খুললো, ধীর গলায় বললো,
“বিয়েটা শুধু কলমের খোঁচা আর কবুল বলা নয়। একটা বিয়ে দুটো মানুষের সারাজীবনের মতো একটা সম্পর্কে বেঁধে ফেলে। তোমার একার সিদ্ধান্তে তো কিছু হয় না। চারুর মতের ও কিছু গুরুত্ব আছে। একটি বার কি চারুকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? সে আদৌও রাজী কি না। এখানে সবাই নিজেদের ব্যাক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ব্যাস্ত৷ একটিবার কি চারুর মতামত নেবার প্রয়োজন নেই কারোর?”

ধ্রুবের কথাটা দৃষ্টি তার দিকে নেয় শ্রাবণ। সরু, শীতল দৃষ্টি। কিছুসময় চুপ করে তাকে সে। বুড়ো আঙ্গুলটা কপালে ঘষে সেকেন্ড কয়েক। তারপর বলে,
“বেশ, চারুলতার মতামত নেওয়া হোক। আমার আপত্তি নেই। আমি কখনোই তাকে কোনোকিছুতে জোর করি নি। আজ ও করবো না। যদি সে রাজী না থাকে; আমি এখন ই চলে যাবো। তবে যদি সে রাজী থাকে; বিয়েটা এখন ই হবে”

শ্রাবনের শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ধ্রুবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো। ঈষৎ ভয় তার হৃদয়কে কাবু করছে। অজানা কারণে মনে হচ্ছে চারু আপত্তি করবে না। কিন্তু কারণটা জানা নেই ধ্রুবের। সে আরোও একবার মনোযোগ দিয়ে দেখলো শ্রাবণের মুখমন্ডল। এক অজানা রহস্য যেনো নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে সে। তার চোখে মুখে আত্নবিশ্বাসের ঝলকানি, যেনো যুদ্ধ হবার পূর্বেই তার ফলাফল জানা_______

????

গোডাউনের পেছনে বেতের চেয়ারে বসে আসেন আশরাফ গণি। হাতে বেনসনের অর্ধখাওয়া সিগারেট। তার চোখে কালো আকাশের বিষন্নতায় হাতরাচ্ছে নিজের হারানো পুত্রের স্মৃতি। বুকে জ্বলন্ত প্রতিশোধের অগ্নিশিখা৷ প্রতিনিয়ত পুত্রের নিথর দেহটা চোখে ভাসে তার। কতোটুকু বয়স, অথচ ছেলেটাকে সেই মাটিতে শুইয়ে দিতে হলো তার।
“বস, কাম শেষ”

শ্লেষ্মাজনিত কন্ঠ কানে আসতেই দৃষ্টি ফেরায় সে। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,
“মেয়ে কি উদ্ধার হইছে?”
“হ, বস। পুলিশের বাহিনী লইয়া আইছিলো”
“মোস্তফা কামালের ছেলের হবু বউ বলে কথা, কোনো প্রমাণ রাখিস নি তো?”
“না বস, একেবারে নিট এন্ড ক্লিন কাজ। ঠিক যখন আপনি কইছেন, তখন ই ফোন অন করছিলাম। তার আধা ঘন্টায় ওই শ্রাবণ পুলিশ নিয়ে হাজির”
“বুঝলাম, এবার কিছুদিন গায়েব থাক তোরা। পাগলা কুত্তার মতো খুঁজবে তোদের। ধরা পড়া যাবে না। নয়তো সব পরিকল্পনায় পানি। বুঝলি নাজমুল! আর শোন, যাওয়ার সময় রহিমের থেকে টাকা নিয়ে যাস।”

নাজমুল ঘাড় কাত করে সায় দিলো। কিন্তু তার মনে একটা ব্যাপার বহু সময় যাবত খচখচ করছে। তাই যেতে যেয়েও থেমে গেলো সে। পেছনে ঘুরে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“একটা প্রশ্ন ছেলো বস”
“করে ফেল, নয়তো ভাত হজম হবে না তোর”

আশরাফ গণির কথায় বোকা হাসে সে। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করে,
“স্যার আপনে যদি প্রতিশোধের জন্যই মাইয়াডারে কি/ড/ন্যা/প করছিলেন, তাইলে ছাইড়ে দিলেন কেন?”

আশরাফ গণি আকাশ কাঁপিয়ে হাসে। এক অদ্ভুত অপ্রকৃতস্থ হাসি। যেনো এই প্রশ্নের থেকে হাস্যকর কিছুই হয় না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চিকচিক করে। নাজমুল কিছুটা পেছনে সরে যায়। আশরাফ গণি হাসি থামায়, তারপর হিনহিনে কন্ঠে বলে,
“ওরে পাগল, আমি তো মেয়েটার ক্ষতি করতে ওকে কিডন্যাপ করাই নি। করিয়েছি গভীরতা মাপতে। শ্রাবণ নামক দৈত্যের প্রাণপাখি যে একটা সামান্য মেয়ে হবে এটা কে জানতো?”
“স্যার, আরোও একটা কথা”
“বড্ড বেশি বকিস তুই। যা তো দূর হো। এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না”

আশরাফ গণির কন্ঠ ঝাঝালো শোনালো। তাই নাজমুল আর কথা বললো না। কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই সে ভুলে গেছে, তা হলো শ্রাবণের দূর্বলতা যে মেয়ে, সে আর কেউ না বরং নাহিয়ানের হবু স্ত্রী। প্রথমে না বুঝলেও, অ/প/হ/র/ণের পর নাজমুল সেটা বুঝতে পারে। নাজমুল টাকা নিয়ে রওনা দেয়। এর মাঝেই তার সাগরেট করিম তাকে জিজ্ঞেস করে,
“নাজমুল ভাই, এই মোবাইলটা কি করাম?”
“রাইখে দে, বড়লোকদের মেলা টাকা। ওরা নতুন একটা কিন্না লইবে”

নাজমুলের কথায় দাঁত বের করে হাসি দেয় করিম। তারপর মোবাইলটা পকেটে ঢোকায়। কিন্তু কে জানতো এই মোবাইল এর লোভটাই তাদের কাল হবে________

‌?????

বাহিরের কোলাহল চারুর কানে যে যায় নি তা নত, বড়কাকার সকল তিক্ত কথাগুলো বুকে বিষাক্ত তীরের ন্যায় লাগছিলো। কান বন্ধ করে এতো সময় বসে ছিলো সে। এই সময়টা মনে হচ্ছিলো সে কেনো এই বাড়িতেই ফিরলো। সে যদি আর না ফিরতো তবে এই বিষাক্ত কথাগুল শুনতে হতো না। পরমূহুর্তে মায়ের ক্রন্দনরত মুখখানা ভেসে উঠলো চোখে, তাই সকল বিশ্রি কথা গিলে ফেললো চারু। এর মাঝেই শ্রাবণের শান্ত গলার কথাগুলো কর্ণগোচর হলো তার। লোকটা এমন কেনো! যেখানে তার পরিবারের মানুষ তার উপর হাজারো প্রশ্ন ছুড়ছে সেখানে এই মানুষটা কিভাবে তাকে এতোটা ভরসা করছে! কেনো একটিবারও সমাজের কথা না চিন্তা করেই তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাচ্ছে! প্রশ্নগুলোর উত্তর চারুর জানা, শ্রাবণ তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসাগুলো কি এমন ই হয়! বেপরোয়া ঢেউ এর মতো উম্মাদ আবার স্নিগ্ধ পানির ন্যায় শীতল। চারুর অনুভূতিগুলো মিশ্র, হাজারো ভয়ের মাঝেও তার মনে এক অজানার প্রশান্তির প্রদীপ জ্বলজ্বল করছে। শ্রাবনের মায়ায় তাকে পড়তেই হলো। না চাইতেও এই মায়া তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে আষ্টেপৃষ্টে।

বাহিরে কাজী বসে আছে। রাকিব কোনোমতে একটা কাজী যোগাড় করে এনেছে। মোস্তফা সাহেবকে শ্রাবণের পাগলামির কথা জানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু শ্রাবণের ভয়ে সে সেই কাজ করলো না। শ্রাবণ নির্বিকার চিত্তে বসার ঘরে বসে রয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে সে ঘড়ি দেখছে। জাহানারা মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলো। চারু তখন বালিশে হেলান দিয়ে রয়েছে। মায়ের বিব্রত মুখটা দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না প্রশ্নটা কি! স্মিত হেসে বললো,
“মা, তোমাদের যা মত আমারো তাই। যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতেই রাজী”

মেয়ের কথায় বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে জাহানারার। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে আসে। মেয়ের বিয়েটা এভাবে দিবে কখনোই কল্পনা করে নি। আবার পরম করুনাময় যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন। এই ভেবে জাহানারা আহসান সাহেবকে বুঝান। দেখা যাবে কাল সকালে চারুর নিখোঁজ ই হবে পাড়ার চায়ের দোকানের মুখ্যম আলোচনা। এর থেকে শ্রাবণ যদি বিয়ে করতেই চাচ্ছে তাতে আপত্তি কি! সে তো বলেছেই আগামী শুক্রবার ধুমধাম করে মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। জাহানারার বোঝানোতে আহসান সাহেব কিঞ্চিত চিন্তায় পড়ে গেলেন। অবশেষে তিনি শ্রাবণকে একাকীত্বে ডাকলেন। তাদের মাঝে ঠিক কি কথা হলো কেউ জানে না। তবে কথাটা বলা পর পর বিয়েটা হলো। অবশেষে শ্রাবণের সাথে তার চারুলতার বিয়েটা হলোই। পাঁচলাখ টাকা দেনমোহরে বিয়েটা হলো। বিয়েতে দুটো মানুষ খুশি ছিলো না, প্রথমত মনীরুল সাহেব। কারণ শ্রাবণ তাকে নিজের ধারালো দৃষ্টিতে বহুবার আঘাত করেছে। দ্বিতীয়ত ধ্রুব, তার প্রেয়সী অবশেষে কিনা অন্য কারোর হয়ে গেলো। হৃদয়ে ছুরিঘাত হচ্ছে তার বারংবার। এমন টাতো হবার ই ছিলো। কিন্তু প্রেয়সীকে হারানো যে এতোটা বেদনাদায়ক জানা ছিলো না ধ্রুবের। ধ্রুব দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হনহন করে প্রস্থান করলো নিজ ঘরে। দম আটকানো যন্ত্রণা হচ্ছে তার।

দরজায় টোকা পড়লে চারুর নজর যায় সেখানে। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। অনুমতি পাবার অপেক্ষা। চারু স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আসুন”
“তুমি রেগে আছো আমার উপর, চারুলতা………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here