দূর_দ্বীপবাসিনী,২৪,২৫

0
714

#দূর_দ্বীপবাসিনী,২৪,২৫
মুশফিকা রহমান মৈথি
#২৪তম_পর্ব

বড্ড অপ্রকৃতস্থ ঠেকলো সামিনের কাছে। আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। এদিকে মোস্তফা কামাল একেবারে কোমড় বেঁধে নেমেছে, সে মোটেই এই আরিফকে ছুটতে দিবে না। একটা স্বাভাবিক মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি এভাবে নিবে না নিশ্চয়ই। এর মাঝেই ঝড়ের মত ছুটে এসেছে আজাদ। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো সে,
“স্যার আরিফ পালিয়েছে”

কথাটা হজম করতে সময় লাগলো সামিনের। মস্তিষ্ক বর্তমানে কাজ করছে না। একজন কয়েদী থানার জেল থেকে পালিয়েছে, এতো কড়া ভাবে গার্ডের মাঝে কিভাবে পালাবো সে? আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। আরিফ যে সে ক্রিমিনাল নয়। সে একজনকে খু’ন করতে যেয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে। এমন একটা মানুষ সমাজে ঘুরে বেড়াবে আর পুলিশ কি না চুপচাপ বসে রইবে! সামিন মাথা চেপে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। আজাদ ভীত স্বরে বললো,
“স্যার কি করবো এখন?”
“কি আর করবে আজাদ, কন্ট্রোল রুমে ইনফর্ম করো। আরিফের ছবি সব থানায় পাঠিয়ে দাও। প্রতিটি ট্রাফিকে জানিয়ে দাও। যেভাবেই হোক আরিফকে ধরতে হবে। আর গণির বাড়িতে নজর দাও। কেনো যেনো মনে হচ্ছে ছেলেটার সাথে গণির সম্পর্ক আছে। আর একটা কথা, শ্রাবণ সাহেবের উপর ঐ ছেলেটা আবার হামলা করতে পারে। উনাকে সতর্ক করে দাও। কুইক আজাদ, সময় নষ্ট করার সময় নেই”

আজাদ “ইয়েস স্যার” বলেই বেড়িয়ে গেলো। সামিনের মাথায় ঢুকছে না ছেলেটা পালালো কি করে! থানা থেকে পালানো তো এতোটা সহজ নয়। নিশ্চয়ই এই থানার ই কেউ সাথে সহায়তা করেছে। ক্রোধে মাথা ফেটে আসছে সামিনের। রাগ নিয়ন্ত্রণে টেবিলে সজোরে আঘাত করলো সে। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে, একটা ক্রি’মি’না’লকে আটকাতে পারলো না সে___________

ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলার প্লেনটি মাত্র ল্যান্ড করলো। প্লেন থেকে নামলো শ্রাবণ এবং চারু। চারুর এই প্রথম প্লেনে চড়া। এর পূর্বে কখনোই প্লেনে চড়া হয় নি তার। এই অনুভূতিটি আজ ই প্রথম। পুরান ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে এই প্রথম সে অন্য কোথাও অন্য কোথাও এসেছে। যখন প্লেনটি উঁড়ান দিয়েছিলো মেঘের উপরে, অবাক নজরে চারু দেখছিলো এই তুলোর ন্যায় জমে থাকা মেঘগুলো। একরাশ আশ্চর্য্য নিয়ে দেখছিলো সেই দৃশ্যটি। মেঘগুলোকে ছুয়ে দেবার ইচ্ছে তাকে যেনো কাবু করে দিচ্ছিলো। মোস্তফা কামাল চেয়েছিলেন ছেলে বউ কে দেশের বাহিরে পাঠাতে, কিন্তু বাধ সাধলো শ্রাবণ। কারণ চারুর আক্ষেপ ছিলো সে বাংলাদেশ ই ঘুরে দেখে নি, উপরন্তু তার পাসপোর্ট নেই। পাঁচদিনে পাসপোর্ট করার ঝামেলা থেকে চায়ের নগরী সিলেট ঘুরে আসা ঢের ভালো। শ্রাবণের সেলাই শুকিয়ে এসেছে, চামড়ায় টান ধরেছে। এখন আর ব্যাথা নেই। শুধু ক্ষত দাগটা রয়ে গেছে স্মৃতি হিসেবে। মোস্তফা কামাল তাই ছেলে বউ কে শহর থেকে দূরে পাঠাবার ব্যাবস্থা করেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে তেতাল্লিশ কিলোমিটার দূরে নাজিমগড় রিসোর্টে তাদের রুম বুক করা হয়েছে। সেখানথেকে মেঘালয়া জলপ্রপাত খুব কাছে। সারি নদীর পাশ দিয়ে টিলার উপর তৈরি রিসোর্টটি যেনো সবুজের অনন্য প্রতিচ্ছবি। একাকীত্ব সময় কাটানোর সাথে সাথে এই ঝামেলা গুলো থেকেও কিছু সময় বিরত থাকতেই এই ব্যবস্থা। যদিও সাজেক, বান্দারবানের তাল তুলেছিলো আফিয়া। কিন্তু সিলেটে আসার পরিকল্পনাটিও শ্রাবণের। কারণ তার প্রেয়সী ঝর্ণা দেখার আবদার করেছিলো।

মোস্তফা কামালের ঠিক করা গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে চললো তাদের নাজিমগড় রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। ছোট ছোট ঢালাই পথ গুলো উঠে গেছে উপরের দিকে। পাহাড়ের টিলা ঘেরা নগরীতে ধীর গতিতে চলছে গাড়ি। গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করে প্রকৃতি দেখে যাচ্ছে চারু। এই কদিনের ঘটনাটি প্রাণোজ্জ্বল মেয়েটিকে যেনো মূর্ছিয়ে দিয়েছিলো। এই হাওয়া বদলটি প্রয়োজন ছিলো তাদের জন্য। গাড়িটি গেট পেড়িয়ে সোজা ঢুকলো রিসোর্টে। ব্যাগটি নামিয়ে রাখলো রিসিপশনে। লবির সামনেই সুইমিংপুল, তার দুধারে থাকার রুমগুলো। শ্রাবণ রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে নিলো। শ্রাবণের রুমটি দোতালার একেবারে কর্ণারের। ডাবল বেডের রুম। রুমে এসেই বারান্দায় ছুটলো চারু। বারান্দা থেকে সবুজে মোড়া পাহাড়ের দৃষ্টি দুচোখ ভরে দেখলো চারু। তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম এতো মনোরম কিছু দেখেছে সে। শ্রাবণ হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিলো। এখন বাজে দুপুর ২টা, পাঁচটা নাগাদ তারা বের হবে। এই রিসোর্টের নিজস্ব টিলা রয়েছে। যেখান থেকে এক পাশে সারি নদীর নীল পানি তো অন্যদিকে মেঘালয়ার সুউচ্চ পাহাড়ি দৃশ্য। আজকের সূর্যাস্তটা সেখানে দেখার ইচ্ছে তাদের। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে চায়ের নগরীতে। হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টিকে ছোয়ায় চেষ্টায় রয়েছে চারু। মুখে বৃষ্টিবিন্দু ছিটকে আসছে। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি উপভোগ করছে সে। তখন ই অনুভব হলো এক জোড়া শীতল হাত তার কোমড় আকড়ে ধরলো। এক মাতালগন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করলো চারুর। হয়তো শ্রাবণের পারফিউমের গন্ধ। শ্রাবণ কানে মুখ ঠেকিয়ে বললো,
“তুমি খুশি তো?”
“খুব, ধন্যবাদ”
“শুকনো কথায় যে চিড়ে ভিজে না, আমারো তো কিছু প্রাপ্য”
“কি?”

জিজ্ঞাসু নজরে তাকালো চারু। শ্রাবণ তখন ঠোঁট কামড়ে বাকা হাসি হাসলো। হাসির অর্থটি ঠিক বুঝলো চারু। লজ্জায় গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। শ্রাবণ একটু এগিয়ে আসতেই তার ফোনটি বেজে উঠলো। শ্রাবণের নজর সেদিকে যেতেই চারু নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর ছুটে ভেতরে চলে এলো। হাসতে হাসতে বললো,
“আপাতত ফোন দিয়েই চিড়ে ভেজান”
“তবে রে”

চারুকে আর পায় কে, সে ছুটে চলে গেলো ওয়াশরুমে। শ্রাবণ মিটিমিটি হাসলো। তারপর ফোনটি হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে রাকিবের নাম্বার দেখে খানিকটা চিন্তিত হলো সে। ফোন ধরতেই বললো,
“তোমাকে না বলেছি, আমাকে এই সপ্তাহ ফোন দিবে না। তাহলে কেনো ফোন দিয়েছো?”
“স্যার, শেয়াল পালিয়েছে খাঁচা থেকে”
“কিহ!”
“জ্বী স্যার, সামিন সাহেবের ফোন আসলো। তারা সারা শহর খুজে বেড়াচ্ছে মানুষটিকে। কিন্তু পাচ্ছে না”
“বুঝলাম”
“সাবধানে থাকবেন স্যার, কোনো সমস্যা হলেই সামিন সাহেবকে জানাবেন”
“ঠিক আছে, আমি রাখছি”

ফোন রাখতেই ভ্রু কুচকে আসলো শ্রাবণের। বিপদের কি অন্ত হবে না? একটু তো এসেছিলো এই ঝঞ্জাট মুক্তির জন্য। কিন্তু সেই আবার ঝামেলা। শ্রাবণের হাত কাঁপছে। যখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে তখন এমনটা হয় তার। একটা সিগারেট খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু চারুর নাক মুখ খিচে আসে বিধেয় সিগারেট খাওয়া যাবে না। ওয়াশরুম থেকে বের হলো চারু। চুল মুছতে মুছতে বলে উঠলো,
“কার ফোন ছিলো?”

চারুর প্রশ্নে ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। খানিকটা অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
“রাকিবের”
“কি বলল?”
“পৌছেছি কি না, শরীর কেমন, এসব হাবিজাবি”
“ওহ”

বলেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে গেলো চারু। শ্রাবণ এখনো বারান্দায়। চারুলতাকে আবারো চিন্তায় ফেলতে চায় না সে। আরিফ নামক ব্যাক্তিটিকে জেলে নেবার পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো মেয়েটি এখন আবার তাকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছে নেই শ্রাবনের। তাই আরিফ পালানোর ব্যাপারটা নিপুনভাবে গোপন করে নিলো, এখন অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার নেই__________

টিলার বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চারু। পরণে সাদা শাড়ি। খোপা করেছে বহুদিন পর। সেই খোঁপায় শ্রাবণ খুব আদরে গুজে দিয়েছে একটা গোলাপ। পশ্চিমের রক্তিম সূর্যটি দেখা যাচ্ছে সবুজের পাহাড়ের উপড়ে। রিসোর্টের পেছনের টিলায় ঘুরতে বেড়িয়েছে তারা। এই টিলাটি এতোটাই সুন্দর যে কবির ভাষায় বলতে হলে বলা যেতো, “মায়াবন”। পাখির কিচিরমিচির, নদীর ঢেউ এর স্নিগ্ধ কল্লোল সাথে ডুবন্ত সূর্য। আর কি চাই! চারুকে বেঞ্চে বসিয়ে একটা কাজে গিয়েছে শ্রাবন। তার আসার প্রতীক্ষায় রয়েছে চারু। একসাথে ডুবন্ত সূর্য দেখার অভিলাষা সে বহু আগে তার। অথচ লোকটা যেনো হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অধীর নজরে আশেপাশে খুজতে লাগলো সে শ্রাবণকে। সময় যখন পেরিয়ে যাচ্ছে তখন না পেরে ফোনটি হাতে নিলো চারু। তখনই শ্রাবনের নম্বরটি ভেসে উঠলো তার মোবাইলে, সময় নষ্ট না অরে ফোনটি ধরলো চারু। অধির কন্ঠে বলল,
“কোথায় আপনি, আমি অপেক্ষা করছি তো, সূর্য ঢুবতে গেলো”
“তাড়াতাড়ি রুমে আসো চারুলতা, সময় নষ্ট করো না……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#২৫তম_পর্ব

তখনই শ্রাবনের নম্বরটি ভেসে উঠলো তার মোবাইলে, সময় নষ্ট না অরে ফোনটি ধরলো চারু। অধির কন্ঠে বলল,
“কোথায় আপনি, আমি অপেক্ষা করছি তো, সূর্য ঢুবতে গেলো”
“তাড়াতাড়ি রুমে আসো চারুলতা, সময় নষ্ট করো না”

কথাটা বলেই খট করে ফোন রেখেদিলো সে। চারু কিছুসময় থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো। শ্রাবণের কন্ঠে ভালো ঠেকলো না চারুর কাছে। উদ্বিগ্নতার সাথে কিঞ্চিত আতংকিত ও ছিলো। আবার কি কোনো বিপদ ঘটেছে? চারু দাঁড়িয়ে থাকলো না। ছুটলো রিসোর্টের দিকে। একটা সময় টিলার কাটা সিঁড়িতে অসর্তকতা বশত ব্যাথাও পেলো। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার হৃদস্পন্দনের গতি লাগামছাড়া ঘোড়ার ন্যায় বাড়ছে। এতোটুকু পথ যেনো তার কাছে ক্রোশের সমপর্যায়ে লাগছে। কোনো মতে রিসোর্টে পৌছালো চারু। সময় নষ্ট না করেই নিজ রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। রুমের দরজাটি ভেজানো। দরজাটি খুলতেই চোখ বিস্ফোরিত রুপ নিলো। এমন কিছু দেখবে কল্পনাও করে নি সে।

কন্ট্রোল রুমের সিসি টিভি ফুটেজ চেক করছে সামিন এবং আজাদ। যত সময় পার হচ্ছে তত অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে তারা। এখনো পর্যন্ত আরিফের কোনো খবর তারা পায় নি। সকল চেক পয়েন্ট, হাইওয়ে তে জানানো হয়েছে। সারা শহরে, মিডিয়াতে জানানো হয়েছে। পুলিশের এতো কড়া সিকিউরিটির পর ও একটা আ’সামী কি করে পালালো সেটার জবাবদিহিতাও করতে হচ্ছে হচ্ছে সামিনকে। চাকরি নিয়ে টানাটানির সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে তার। উপর মহলের আদেশ, ৩৬ ঘন্টার মাঝে আরিফকে খুজে বের করতে হবে। নয়তো থানার ইনচার্জ হিসেবে সামিনকে সাসপেন্ড করা হবে। তাই আরিফকে খুঁজে বের করা কতোটা জরুরি সেটা কেমন সামিন ই জানে। আরিফের সেলের সামনে সিসি টিভির ফুটেজ গুলো বারবার চেক করে যাচ্ছে সামিন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার। সিসি টিভিতে এখনো আরিফের বসে থাকার দৃশ্য ই দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটিতে আরিফ একবার সেলে বসে আছে, তারপর উঠে পানি খাচ্ছে, তারপর শুয়ে পড়ছে। ছয়মিনিট পর পর একই দৃশ্য। তার মানে কাল রাতে এই সিসি টিভি টা হ্যা’ক করা হয়েছে। তারপর এই ছয়মিনিটের দৃশ্যটি ই লুপে চলছে। সেলের কর্মরত হাবিলদার শাকিল রাত তিনটার শেষ বারের মতো আরিফকে দেখেছিলো। তারপর সে ডিউটিরত থাকা অবস্থায় ঘুমিয়ে যায়। সকাল আটটায় থানায় যখন আজাদ আসে। সে প্রশ্ন করার জন্য আরিফের সেলে প্রবেশ করে তখন দেখে শাকিল অচেতন অবস্থায় সেলের বাহিরে পড়ে আছে। তার পোশাক গায়েব। এবং আরিফের সেল ফাঁকা। তখন ই সবাই জানতে পারে আরিফ নেই। তারপূর্বে পুরো থানা যেনো ঘুমের মাঝে ছিলো। যা হয়েছে তা ঠান্ডা মস্তিষ্কের কাজ। রাতে থানায় হাবিলদার শাকিল সহ ৫জন ছিলো। হাবিলদার শাকিল এবং সোয়েবের দায়িত্ব ছিলো সেল। সোয়েব তখন বাহিরে যায় আর শাকিল পাহারায়। আরিফ খুব চতুরতার সাথে শাকিলকে অজ্ঞান করে তার কোমড়ের চাবি নিয়ে সেল থেকে পালায়। তারপর তার পোশাক পড়ে পালায়। কন্ট্রোল রুমের সিসি টিভিতেও কিছু ধরা পড়ে নি। তাই কেউ এলার্ট ও হয় নি। ফলে আরিফ নিপুন ভাবে পালিয়েছে। কিন্তু এটা যেমন তার বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে তেমন পুলিশদের অপারগতার প্রমাণ ও দিচ্ছে। সামিনের উপর প্রেসার দুদিকের, উপর মহল এবং মিডিয়া। আরিফকে না ধরতে পারলে তার বদনামী তো হবেই, চাকরিটাও থাকবে না। এর মাঝেই একটা ফোন আসে সামিনের মোবাইলে। সামিন ফোন ধরতেই শুনতে পায়,
“স্যার, আরিফকে শায়েদাবাদ ডাচবাংলার এটিএম বুথের এখানে দেখা গেছে। আমরা ওর পিছু নিয়েছি। ও আমাদের চোখে ফাকি দিয়ে পালিয়েছে।”
“বা’ল ছি’ড়ো নাকি, প্রশাসনের টাকা গিয়ে ভুড়ি বানাচ্ছো। আর একটা আ’সামী ধরতে পারো না। তোমরা ওরে ট্রাক করার ট্রাই করো। আমরা আসছি”

বলেই ফোন রেখে দিলো সামিন। আজাদকে বললো,
“চলো আজাদ, শায়েদাবাদ”
“কেনো স্যার?”
“আরিফ কে এটিএম বুথের সামনে দেখা গেছে”
“স্যার, আমার মনে হয় আরিফ শহর থেকে পালানোর তালে আছে। বুথে দেখা গেছে। তারমানে ও টাকা তুলেছে”

আজাদের কথাটা শুনতেই থমকে গেলো সামিন। তার কপালে স্পষ্ট হলো চিন্তার ছাপ। নিস্প্রভ স্বরে বললো,
“আচ্ছা, মিস্টার শ্রাবণ এবং তার ওয়াইফ কোথাইয় গিয়েছে?”
“রাকিব সাহেব বললেন, সিলেটে”
“শিট, আজাদ কুইক। আরিফ সিলেটে যাবার তালে আছে। শ্রাবণ এবং চারুর বিশাল বিপদ। কন্ট্রোল রুম থেকে জানিয়ে দাও। সায়েদাবাদে সিলেট যাবার বাসগুলোকে চেক করতে বলো। কুইক”

আজাদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। সামিনের সজোরে আঘাত বসালো টেবিলে। একটা সামান্য যুবক এতটা চালাক কি করে হতে পারে। সামিন ফোন লাগালো পুনরায় সেই নম্বরে। অপর পাশের মানুষটি ফোন ধরতে বললো,
“আরিফের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখো, আর একটা গ্রুপ ওর বাড়ি খোঁজ নাও। ওখানে তল্লাশি নিলে ওর মোটিভ বোঝা যাবে”

বলেই ফোনটি রেখে দিলো সামিন। আরিফ একা নয়, তার পেছনে খুব চালাক কারোর হাত আছে। যে আরিফকে পেয়াদা হিসেবে চাল চালছে। একবার আরিফকে নাগালে পেলে এই মাস্টারমাইন্ডকে ধরা যাবে। তার আগে কোনো বিপদ না হলেই ভালো। কিন্তু মন কু গাইছে, কেনো যেনো মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু ঘটতে চলেছে________

নিজ রুমে প্রবেশ করতেই চারুর চোখ ছানাবড়া। দরজা খুলতেই ফুলের পাপড়ির বর্ষণ হলো তার উপর। চারু অবাক নয়নে দেখছে চারিপাশ টা। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। নিকষকৃষ্ণ আঁধারকে চিরে সাদা মোমবাতি জ্বলছে। গোলাপের মিহি গন্ধে ডুবে যাছে ঘর। শীতল হাওয়া বইছে এসি থেকে। চারু খেয়াল করে দেখলো। সাদা এবং নীল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে রুমটি। রুমের এন্টারেন্স থেকেই গোলাপের পাপড়ি দিয়ে পথ বানানো হয়েছে। চারু ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে গেলো। টেবিলের উপর একটি বক্স এবং একটি কার্ড। মোমের মিহি আলোতে বক্সটি খুললো চারু৷ একটা নীল রঙ্গের শাড়ি। নীল রঙ্গ টি বরাবর ই পছন্দ চারুর। স্নিগ্ধ পরশ পায় এই রঙ্গে। তাই তো তার প্রিয় ফুল নীল গোলাপ। ঘটনাগুলোয় এখনো ধাতস্থ হতে পারে নি চারু। তখনের আতংক, ত্রাশ সম্পূর্ণ কাটে নি। শাড়ির বাক্সটির সাথে রাখা কার্ডটি হাতে নিলো সে। গোটা গোটা হাতের লেখা।
“চারুলতা, আমার দোটানা জীবনে দমকা হাওয়ার ন্যায় তোমার আগমণ। বছর তিনেক পূর্বে এই দিনেই তোমার সাথে প্রথম সাক্ষাত৷ সাক্ষাতড়ি ক্ষণসময়ের জন্য হলেও তার প্রভাব ছিলো বিস্তার। মনের বন্ধ দোয়ারে বিনা নোটিসে চলে এসেছিলে তুমি। ঘুমহীন কত রাত কাটিয়েছি তোমার ভাবনায়, তুমি কি জানো সেটা? তোমার এক ঝলক দেখতে অধীর আগ্রহে বসে রইতাম৷ তোমার একখানা ছবি পেয়েছিলাম বহু কষ্টে। ছবিটি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত। তুমি জানো না চারুলতা তোমার ভূমিকাটা আমার জীবনে কত! একাকীত্ব খরার জীবনে এক পশলা শীতলতা ছিলে তুমি। আমার প্রথম ভালোবাসা শুধু তুমি চারুলতা। আজ যখন তোমাকে নিজ জীবনে পেয়েছি আমি যেনো পূর্ণতা পেয়েছি। পূর্ণতায় যে এতো সুখ সেটা কি আগে জানতাম! হয়তো তোমার হৃদয়ে আমার নামটি এখনো অঙ্কিত হয় নি তবে আমার জীবনে চিরটাকাল তোমার ই নাম থাকবে। তুমি ই আমার পূর্ণতা, আমার বাঁচার খোড়াক, আমার চারুলতা____

না চাইতেও চোখে নোনাজল জমলো চারুর। এই জলের উৎস কোনো বিষাদ নয় বরং না চাইতে পাওয়া আকাশ সমান প্রশান্তি। চারুর চোখ খুঁজছে শ্রাবণকে। আজ মনের জমানো কথাগুলোর প্রকাশ করবে সে। লোকটিকে যে মনের সিংহাসনে বসিয়েছে বহুকাল পূর্বে। সূর্য অস্ত গেছে বহু সময়৷ শীতল হাওয়া বইছে বাহিরে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দর্শন পেতে উতলা হয়ে উঠেছে মন। তখনই দরজার শব্দ কানে আসলো। পেছনে ফিরতেই দেখলো দরজার কাছে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। মোমের মিহি আলোয় লোকটির পুরুষত্ব যেনো আরোও বেড়ে গেছে৷ ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালে। নীলাভ চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে চারু। নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তমকে। শ্রাবণ ও নিবিড়ভাবে নিজের প্রেয়সীর বুকের সাথে লেপ্টে রাখলো। উষ্ণ প্রশ্বাস ভেদ করছে সুঠাম বুকে। উত্তাপে যেনো পুড়ছে হৃদয়খানা। নিষিদ্ধ ভাবনা গুলো মাদকের ন্যায় মাথায় চড়ে বসলো। ঘোর লাগা নজরে দেখতে লাগলো চারুকে শ্রাবণ। অপেক্ষা চারুর সম্মতি। বাহিরের উম্মাদ আবহাওয়ায় ভেতরের মানুষের মাঝেও যেনো জ্বলে উঠলো কামনার আগুন। শ্রাবণ ধীর গলায় বললো,
“আজ কিন্তু তোমার পালা। লজ্জাকে বরণ করবে নাকি আমাকে, সিদ্ধান্ত তোমার”

শ্রাবণের কথাটায় লজ্জায় কুকড়ে গেলো চারু। চারুর লজ্জিত মুখশ্রী দেখেই সরে পড়লো শ্রাবণ। শ্রাবণের কাজে ক্ষণিকের জন্য অবাক হলো সে। কিন্তু লোকটি যে হাড়ে হাড়ে শয়তান, আজ চারুকেই যে লজ্জার জলাঞ্জলি দিতে হবে। চারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে খানিকটা দমে গেলো শ্রাবণ। নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“থাক, মনের বিরুদ্ধে কিছু করবার প্রয়োজন নেই। ভেবেছিলাম তোমাকে ভালোবাসার কথাগুলো বলে চমকে দিবো। হয়তো সেই উছিলায় তোমার মনেও কিছুটা হলেও স্থান পাবো। কিন্তু ভুল ছিলাম। তুমি চিন্তা করো না চারুলতা, আমি অপেক্ষা করবো”

বলেই যাবার জন্য পা বাড়ায় শ্রাবণ। ঠিক তখনই পেছন থেকে তার শার্টখানা টেনে ধরে চারু……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here