#দূর_দ্বীপবাসিনী,২৬,২৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
#২৬তম_পর্ব
চারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে খানিকটা দমে গেলো শ্রাবণ। নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“থাক, মনের বিরুদ্ধে কিছু করবার প্রয়োজন নেই। ভেবেছিলাম তোমাকে ভালোবাসার কথাগুলো বলে চমকে দিবো। হয়তো সেই উছিলায় তোমার মনেও কিছুটা হলেও স্থান পাবো। কিন্তু ভুল ছিলাম। তুমি চিন্তা করো না চারুলতা, আমি অপেক্ষা করবো”
বলেই যাবার জন্য পা বাড়ায় শ্রাবণ। ঠিক তখনই পেছন থেকে তার শার্টখানা টেনে ধরে চারু। চারুর এরুপ কাজে ঈষৎ কৌতুহল উঁকি দেয় শ্রাবণের মনে। অবাক নজরে দেখতে থাকে তার চারুলতাকে। চারু তখন লাজুক কন্ঠে বলে,
“সব কথা কি মুখে বলা যায়? কিছু কথা যে বুঝে নিতে হয়”
“কিছু কথা যে না বললেই নয় চারুলতা? আমি যে বহুদিনের প্রতীক্ষায় রয়েছি। শুধু তোমার হৃদয়ে জমা কথাগুলো শুনতে। আমি যে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছি। শুধু একটিবার তোমার মুখে এই প্রতীক্ষিত শব্দটি শুনবো বলে। যা শুনে আমার অতৃপ্ত হৃদয় তৃষিত হবে। আজ আর মৌনতা যে আমার বেহায়া হৃদয় মানবে না। যদি হৃদয়ে স্থান দিয়েই থাকো, তবে বাঁধা কোথায়? লজ্জার প্রাচীরটি যে আজ তোমায় ই ভাঙ্গতে হবে চারুলতা”
“তবে শুনে রাখুন, এই প্রথম এবং শেষ বার বলবো। ভালোবাসি, কারণ অকারণে ভালোবাসি, ভালো মন্দ সব কিছুতে ভালোবাসি। আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি ভালোবাসি”
চারুর মুখে যে শব্দটি শোনার জন্য এতো অপেক্ষা, সেই শব্দটি যে এতো মনোমুগ্ধকর হতে পারে কে জানতো! “ভালোবাসি” শব্দটিতে এতো প্রশান্তি থাকবে কে জানতো! মূহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো শ্রাবণ। চাহনী স্থির, বড় বড় নেত্রপল্লবে কেবল মাদকতা। মাদকতা মাত্রা ছাড়ালো, বেসামাল হয়ে উঠলো কিছু ইচ্ছে। ঝাপটে ধরলো চারুর কোমড়। অবিন্যস্ত স্পর্শে ভরিয়ে তুললো প্রেয়সীকে। আগুনের সংস্পর্শে যেমন মোম গলতে শুরু করে, চারুও ধীরে ধীরে গলতে লাগলো শ্রাবণের স্পর্শে। উত্তপ্ত স্পর্শে ব্যাকুল হয়ে উঠলো চারু। বাহিরের শীতল আবহাওয়া, বৃষ্টির বেগ বাড়লো, থাই গ্লাসে জমছে বিন্দু বিন্দু জল। এদিকে ঘরের ভেতর জমে উঠেছে মাদকতা। অবিন্যস্ত বিছানায় আদিমখেলায় মত্ত হয়েছে দুজন মানব মানবী। ঘনিষ্ট মূহুর্তগুলো আর্তনাদে পরিপূর্ণ। নগ্ন পিঠে নখের প্রবল আঁচড়, সুখ কুড়াতে ব্যাস্ত তারা। এতদিনের লজ্জার প্রাচীর ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে যেনো। এলোপাথাড়ি স্পর্শে মাতাল দুটো হৃদয়। রাত ঘন হতে লাগলো, আনন্দের জোয়ার বাড়তে লাগলো। অনুভূতি হলো প্রবল, এই সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না_______
রাত নিগূঢ়, নিস্তব্ধ পরিবেশ। ক্লান্ত শ্রাবণ ঘুমাচ্ছে। চারু অপলক নজরে তাকিয়ে আছে ভালোবাসার মানুষটির দিকে। শান্ত মুখশ্রী, খাঁড়া নাক, শুষ্ক ঠোঁট জোড়া। চারুর মনে আজ অন্য প্রশান্তি, ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না এই সুখের বর্ণনা। অজান্তেই শ্রাবণের মুখে ঠেকালো তার হাত। মনে মনে আওড়ালো,
“তোমার নীলাম্বরীর শুভ্র তুলো হতে চাই,
তোমার ব্যাস্ত হৃদয়ের এক নিবৃত্ত প্রশ্বাস হতে চাই,
হতে চাই তোমার কুঞ্চিত ললাটের সূক্ষ্ম চিন্তা;
তোমার বলিষ্ট বুকে শ্যাম মুখখানা লুকিয়ে মহাযাত্রায় যেতে চাই”
কি লজ্জা, কি লজ্জা! কবে থেকে এতোটা বেহায়া হয়ে উঠেছে মনটা? জানা নেই, তবে এই মানুষটার জন্য বেহায়া হতেও ক্ষতি নেই________
????
সায়েদাবাদ, গাবতলী, কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ড উপরন্তু প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনে পাগলের মতো রেট দেওয়া হয়েছে। তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে প্রতিটি জায়গা্, আরিফের টিকিটুকু পায় নি পুলিশ। সামিন ধৈর্য্যহারা হয়ে উঠেছে। একটা মানুষ ভাপের ন্যায় উঁড়ে যেতে পারেনা। সিলেট যাবার প্রতিটি গাড়ি চেক পয়েন্টে থামছে। পুলিশ পাগলের মতো তল্লাশি নিচ্ছে। মিডিয়া একের পর ফাউল নিউজ বের করে যাচ্ছে কিন্তু তাতে সামিনের মাথা ব্যাথা নেই, তার একটাই টার্গেট। আরিফকে হাতে পাওয়া। সামিনের ইচ্ছে হচ্ছে ওই লোকটিকে নিজ হাতে গু’লি করতে। পি’স্ত’লে’র ছয়টা গু’লি তার বুকে নামিয়ে দেওয়া। রাত এগারোটা বাজে, অথচ সারা দিকে একটা খাবারের কনাও পেটে যায় নি তার। দূর্বল শরীর, মস্তিষ্ক ভর্তি চিন্তা। তবুও ক্রোধ বেসামাল। এর মাঝেই আজাদ ছুটে আসে। তার মুখ উজ্জ্বল, উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে,
“স্যার, ক্লু পাইছি”
“কি ক্লু?”
“আরিফের একাউন্টে মোট বিশ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। আর অবাক হবে প্রেরকের নাম শুনলে”
“কে?”
“আশরাফ গনি”
নিভে যাওয়া আলোটা ধপ করে জ্বলে উঠলো সামিনের। ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যে আর আছে ছাব্বিশ ঘন্টা আছে। এর মধ্যেই মৃ’ত বা জীবিত ধরতে হবে আরিফকে। প্রজ্বলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ফ্যান্টাস্টিক”
আজাদ আবার বলা শুরু করলো,
“এ তো কিছুই না স্যার। আরিফের ঘর সার্চ করে আমরা যা পাইছি আপনার খারাপ হয়ে যাবে”
বলেই একটা প্যাকেট সামনে রাখলো আজাদ। প্যাকেট ভর্তি হাজার চিরকুট এবং চারুর অজস্র ছবি। আজাদ বলতে লাগলো,
“চারু ম্যাডামকে এই আরিফ বহু দিন ধরে ফলো করছে স্যার। এখানে চারু ম্যাডাম যখন কি’ড’ন্যাপ হয়েছিলো সেই সময়ের ছবিও আছে”
“স্টকার বলতে চাচ্ছো?”
“হতে পারে স্যার। কিন্তু আরিফ এতো টাকা নিয়ে কি করবে এটাই বুঝতে পারছি না। আর আশরাফের সাথে এর সম্পর্ক কি?”
“আচ্ছা আজাদ, চারু এবং শ্রাবণ সাহেব কোথায় আছে জানো?”
“জ্বী, স্যার। নাজিমগড় রিসোর্টে”
সামিন চুপ করে রইলো কিছু সময়। বা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো আরিফের লেখা চিরকুট গুলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। থমথমে কন্ঠে বললো,
“আমাদের তাড়াতাড়ি সিলেট যেতে হবে আজাদ, তুমি তিনটি প্লেনের টিকিট কাটো। আরিফ যে করে হোক সিলেট যাবে। বিশহাজার টাকা কিন্তু কম না, আর নাজিমগড় এর রিসোর্ট এর এক রাতের ভাড়া বারো হাজার। আমার ক্যালকুলেশন বলছে ও অলরেডি অন দ্যা ওয়ে। কুইক আজাদ। শ্রাবণ এবং চারুর বিশাল বিপদ। আর এখানে এদের বলো আশরাফ গণিকে গ্রেফতার করতে। চারু কি’ড’ন্যা’প কেস ও এন্ড করার সময় এসেছে”
আজাদ “ইয়েস স্যার” বলেই বেড়িয়ে পড়লো। সামিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। ফোন করলো একটা নাম্বারে। কিন্তু সেই নাম্বারটা এখন বন্ধ। প্রবল চিন্তায় সামিনের মস্তিষ্ক কাজ করছে না। আরিফ কি করার প্লানে আসে? মা’ডা’র নাকি অন্য কিছু?
????
সকাল এগারোটা, নাকে মুখে খাচ্ছে ধ্রুব। আজ ঘুমাতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। গত দুরাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। রাত রাত ধরে অনেক হিসেব কষতে হয়েছে তাকে। মনীরুল সাহেবের কাজ শুধু মজ মেরে এর বদনাম ওর বদনাম করা, আর অপর দিকে আহসান সাহেবের শরীরটা ভালো নেই। হুট করেই শরীর খারাপ করলো প্রেসার বেড়ে। তাই দোকানের সব দায়িত্ব পড়লো এই ধ্রুব এর উপর। গুদামের সকল হিসেব নামিয়ে গত রাতে ঘুমিয়েছে। কখন দশটা বেজে গেছে খেয়াল ই নেই। কোনো মতে খেয়ে বের হতে যাবে তখন ই মারুফা বললো,
“এই ধ্রুব, শোন”
“বলো মামী”
“চিত্রাটাকে একটু কলেজ দিয়ে আয় না, দিনকাল তো ভালো না”
চিত্রাকে কলেজ দেবার কথা শুনেই বিরক্তিতে চোখ মুখ খিচে এলো ধ্রুব এর। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“তোমার মেয়ে অনেক লেট করে মামী, আমার সময় নেই। বড় মামা তো একা দোকানে। লেট হলেই দু কথা শুনাবে। আমার তার ঠেস মারা কথা কিন্তু ভালো লাগে না”
“একটু যা না বাবা, মেয়েটা বড় হয়েছে। সেদিন নাকি একটা ছেলে ওর ওড়না টেনে ধরেছে। তোর মামাকে বললে আর কলেজ যেতে দিবে না। তুই একটু যা না ওকে নিয়ে”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো ধ্রুব। চিত্রা যে মিথ্যে কথা বলেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ধ্রুবের। এই মেয়ে এতো ত্যাদর কেনো হিসেব মিলাতে পারে না ধ্রুব। চারু যত শান্ত এই মেয়েটা তত ত্যাদর। ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমি কিন্তু তিন মিনিট অপেক্ষা করবো। তোমার মেয়ে না নামলে আমি ছুটবো”
মারুফা জোড়ে হাক দিলেন চিত্রা বলে। ধ্রুব অপেক্ষা না করে বাহিরে চলে গেলো। বাইকের উপর বসে সেটাকে স্ট্যান্ড থেকে নামালো। ঘড়ির দিকে নজর তাক। তিন মিনিট হবার অপেক্ষা। তিন মিনিট হলেই ছুটবে সে। ঘড়ির কাটা যখন তিনমিনিট হবার জন্য শেষ সেকন্ডে, তখন ই ছুটে এলো চিত্রা। চুল অবিন্যস্ত, মুখে একটা পরোটা। ব্যাগটা হাতে ঝুলছে। জুতোটা কোনোমতে পায়ে গুজা। হাপাচ্ছে চিত্রা। ধ্রুব মিটিমিটি হেসে বললো,
“বয়”
“অস’ভ্য খাচ্চ’র”
কথাটা মিনিয়ে বললেও কানে ঠিক গেলো ধ্রুব এর। পাত্তা না দিয়েই সে স্টার্ট দিলো বাইক। বাকা হাসি তার ঠোঁটে, চিত্রা বুনো ওল হলে সে বাগা তেতুল। তার বাইকে করে কলেজ যাবার শখ ছুটিয়ে ছাড়বে_______
???
বিকেলের সূর্য অস্ত যাবার তালে আসে। ক্লান্ত দিনের অবসান ঘটবে আর কিছু সময় পর। বিছানা কান্দি্র পিচ্ছিল পাথরের পা ভিজিয়ে এসেছে চারু। আজ তারা গিয়েছিলো বিছানাকান্দি এবং পান্থুমাই জলপ্রপাত দেখতে। নীল আকাশে সাদা মেঘের আস্তরণ আর নিচে কালো পাথরের উপর স্বচ্ছ পানি। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য দু চোখ ভরে দেখেছে চারু। শ্রাবণ তার ছবিও তুলেছে বহু। একটা ছবি তার প্রোফাইল পিকচার ও দিয়েছে, “নীলাম্বরী তলে আমার নীলাঞ্জনা”
প্রকৃতিতে মত্ত হতে যেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এসেছে তারা। পা ফুলে গেছে চারুর। সৌন্দর্য্য যে ভয়ংকর ও হয়। পিচ্ছিল পাথরে একবার পা পিছলে পড়তে গিয়েছিলো সে। ভাগ্যিস তার শ্রাবণ ছিলো। শক্ত হাতটি ধরে ফেলেছিলো। রিসোর্টে ফিরেই রুমের চাবি নিলো তারা। শ্রাবন তার মোবাইলের সাইলেন্ট অপশন অফ করলো সাথে সাথেই ফোনটি বেজে উঠলো। বাধ্য হয়ে চারুকে বললো সে,
“তুমি উপরে যাও, আমি আসছি”
চারু স্মিত হেসে রুমের পানে পা বাড়ালো। আধার নেমেছে পাহাড়ের কোলে। রিসোর্টের লাইট গুলো জ্বালানো হচ্ছে। রুমের দরজায় চাবি দিতেই দেখলো রুমটি খোলা। বেশ অবাক হলো চারু। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। অন্ধকারে নিজের হাত ও দেখা যাচ্ছে না। বা হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করলো চারু। মূহুর্তেই আলোকিত হলো রুম। না রুমে কেউ নেই। নিশ্চিন্তে চারু ওয়াশরুমে যাবার জন্য পা বাড়ালো। শাড়ির নিচ টুকু পুরো ভেজা। তখন ই অনুভব করলো, সে একা নয়………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#২৭তম_পর্ব
রুমের দরজায় চাবি দিতেই দেখলো রুমটি খোলা। বেশ অবাক হলো চারু। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। অন্ধকারে নিজের হাত ও দেখা যাচ্ছে না। বা হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করলো চারু। মূহুর্তেই আলোকিত হলো রুম। না রুমে কেউ নেই। নিশ্চিন্তে চারু ওয়াশরুমে যাবার জন্য পা বাড়ালো। শাড়ির নিচ টুকু পুরো ভেজা। তখন ই অনুভব করলো, সে একা নয়। পর্দার আড়ালে কেউ একজন সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে অবলোকন করছে। চারুর বুকটা কেঁপে উঠলো। হৃদস্পন্দন মাত্রা ছাড়ালো। আতঙ্কে তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে আসছে, পেছনে ঘোরার সাহস হচ্ছে না। চারু ঘাড় হালকা কাঁত করে দরজার পানে চাইলো। বোকার মতো কেনো যে দরজাটা আটকে দিয়েছে। শ্রাবণ নিচে, এখন চিৎকার করলে সে কি শুনতে পাবে! তবুও চেষ্টা করতে হবে। চারু গুটি পায়ে যেই আগাতে নিলো দরজা পানে অমনি পর্দার আঁড়াল থেকে হিংস্র পশুর নেয় বেড়িয়ে এলো সেই মানুষ। খপ করে ধরে নিলো চারুর হাত। চারু ভয়ার্ত নজরে দেখলো সেই অনাকাঙ্খিত মানুষটিকে। এই যে সেই যুবক যে কি না তার শ্রাবণকে ছু’রি মেরেছিলো। উশখো খুশখো চুল, অপ্রকৃতস্থ রক্তিম চাহনী, ঠোঁটের কোনে কালচে জমাট রক্ত, ময়লা মুখ। চাপা কন্ঠে বললো,
“দূর-দ্বীপবাসিনী, ভয় কিসের?”
চারু ভড়কে গেলো। পা অসার হয়ে গেলো, ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। যাকে এতোকাল ভয় পেয়ে এসেছে, যার থেকে পালিয়ে এসেছে সেই কি না তার সম্মুখে। চারুর গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। চোখে জল জমছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আরিফ নামক যুবকের মুখে রহস্যময়ী হাসি, তার হাসিতে গা গুলিয়ে আসছে চারুর। চারুর ভয়ার্ত নজর দেখে পৈশাচিক হাসি হাসলো সে। শীতল কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না, শুধু ওই মানুষটাকে আজ খ’ত’ম করবো। তুমি শুধু শান্ত হয়ে বসে থাকো”
“আ……মা…কে ছা…ছাড়ু……ন”
“ভয় নেই তো, আমি কিছু করবো না তোমায়”
বলেই চারুর চুলে হাত বুলালো, চারু শিউরে উঠলো। আতংক, ভয়, ত্রাশ তার মনকে গ্রাস করছে। তার পালাতে হবে, কিন্তু এই দা’ন’বের ন্যায় মানুষের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়ালো। এই শক্ত মুঠো থেকে যেনো মুক্তি নেই চারুর। এতো পাতলা মানুষের এতো শক্তি। এদিকে শ্রাবণের আসার নাম নেই, সে কোথায়! আসছে না কেনো?
শ্রাবণ রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি, ফোনে ওপারের মানুষটি আর কেউ নয় ইন্সপেক্টর সামিন। একটু একাকীত্ব সময় কাটাবে চারুলতার সাথে, এরা তার মাঝেও ব্যাগড়া দিচ্ছে। একপর্যায়ে শ্রাবণ বলেই উঠলো,
“আপনাদের অপারগতার শাস্তি আমি আর চারুলতা কেনো পাবো?”
“আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন, আমরা আরিফকে হাতে নাতে ধরতে চাচ্ছি। আমাদের ধারণা সে আপনাদের রিসোর্টে আছে। আপনাকে সেই সকাল থেকে কল করছি, কিন্তু আপনি একটি বার ও ফোন ধরেন নি। আমি জাস্ট সাবধানে থাকতে বলছি। আমরা আপনার রিসোর্টের ই সামনে। জাস্ট রিসোর্ট চেক করেই চলে যাবো”
“আরিফ এই রিসোর্ট কেনো থাকবে অফিসার?”
“কারণ সে আপনার ওয়াইফ এর স্টকার”
কথাটা শুনতেই থমকে গেলো শ্রাবণ। তার রাগ উবে গেলো। কপালে পড়লো চিন্তার ভাঁজ, নজর চলে গেলো নিজ রুমের দিকে। শ্রাবণ কিছু একটা ভাবলো, কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকলে সামিন বলে,
“শুনতে পারছেন?”
“আমার ওয়াইফের একজন স্টকার আছে আপনি জানলেন কি করে?”
“আরিফের বাসা থেকে সব ক্লু পেয়েছি”
“বেশ, তবে আসুন”
শ্রাবণের কন্ঠ শীতল। সে ফোন রেখে এগিয়ে গেলো রুমের দিকে। বুক কেনো যেনো কাঁপছে। সত্যি কি আরিফ রিসোর্টে এসেছে?
বিছানার কর্ণারে চারু ঘাপটি মেরে বসে আসে। চারুর দু হাত ওড়না দিয়ে বাধা্, সেই বাঁধন আরিফের হাতে। সে চিৎকার করতে চাইছিলো বিধায় মুখে ওড়না বেঁধে দিয়েছে। চারু ছাড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না, আরিফের আরেক হাতে একটা ধারালো ছু’রি। আরিফের চাহনী বিকৃত মস্তিষ্কের প্রমাণ দিচ্ছে। চারুর ছটফটানিতে সে বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্তি মাত্রা ছাড়ালে ধমক দিয়ে উঠে আরিফ,
“এই, চুপ। লাফালাফি করলে একদম গ’লা না’মি’য়ে দিবো”
চারু ভয় পেলো কিন্ত থামলো না। ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে লাগলো। তখন তার মুখ চেপে ধরলো আরিফ। শীতল কন্ঠে বলল,
“চুপ করে থাকতে বললাম না, আমি তো বলেছি তোরে কিছু করবো না। এতো লাফাস কেনো? নাগরের কাছে যাবি? আসতেছে তোর নাগর। মন ভরে দেখিশ”
কথাটা শুনে স্থির হলো চারু। চারুর থেমে যাওয়া দেখেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আরিফ। ভয়ংকর সেই হাসি। তারপর বলল,
“ওই কু’ত্তার মাঝে কি আছে যা আমার মধ্যে নেই। ও তো একটা জা/নো/য়া/র। আর সেই জা/নো/য়া/রের প্রাণপাখি তুই। তোরে বাঁচাতে ও এমনেই জা/ন দিয়ে দিবো। তারপর তোরে নিয়ে আমি উড়াল দিবো। তোর এই ভীত নজর, এই পাতলা ঠোঁট, এই কাজলকালো চোখ। এইগুলো যে আমার সেই লাগছিলো রে। সুখে রাখবো, কি জানি দূর দ্বীপবাসিনী”
আরিফ কথাগুলো বলছে এবং চারুকে বিশ্রী ভাবে স্পর্শ করছে। চারুর শরীর কাঁপছে সেই স্পর্শে, এতো জঘন্য স্পর্শ। এতো জঘন্য মুখের ভাষা। আরিফ যখন আরোও একটু কাছে আসবে চারুর তখন ই দরজায় কড়া নাড়লো শ্রাবণ। খানিকটা থমথমে কন্ঠে বলল,
“চারুলতা, আমি দরজা খোলো”
শ্রাবণের কন্ঠ খড়া জমিতে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় লাগলো। গোঙ্গাতে লাগলো চারু। আরিফ চোখ গরম করলো। কিন্তু থামলো না চারু। শ্রাবণ ক্রমাগড় কড়াঘাত করতে লাগলো।
“চারুলতা, চারুলতা। তুমি কি ওয়াশরুমে? চারুলতা সাড়া দাও”
কিন্তু হাত-মুখ বাধা বিধায় উত্তর দিতে পারছে না চারু। শ্রাবণের উৎকন্ঠা বাড়লো। সে শান্ত থাকতে পারছে না। আরিফের কপালে চিন্তার ভাজ, সে কিছু একটা ফন্দি আটলো। শ্রাবণকে আজকেই শেষ করতে হবে। সে চারুর বাঁধনসহ তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হিরহির করে টানতে টানতে দরজার কাছে দিয়ে যেতে লাগলো। ধীর গলায় বললো,
“আমি গেট খুলে দিবো, তুই ওরে ভেতরে নিবি। তারপর হবে খেলা”
চারুর বুঝতে বাকি রইলো না সে বুঝাচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণের কোনো ক্ষতি সে হতে দিবে না। তাই উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই আরিফের পায়ে সজোড়ে লাথি মারলো সে। আরিফ ব্যালেন্স হারিয়ে উলটো দিকে পড়ে গেলো। হাতের ছুরি গড়িয়ে পড়লো অন্য পাশে। আরিফের তটস্থ হবার পূর্বেই আরো দুবার পা দিয়ে প্রহার করলো চারু। হাতের বাধন আলগা হলো। রিমান্ডের মার খেয়ে আরিফের পায়ে বেশ চোট আসে। ফলে চারুর প্রহারে সে কাতরাতে লাগলো। চারু সেই সুজোগে সব বাধন খুললো। ছুটলো দরজা খুলতে। কিন্তু আরিফও কম না। সটান দাঁড়িয়ে চুল টেনে ধরলো সে চারুর। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো চারু। এদিকে ভেতরের আওয়াজ পাচ্ছে শ্রাবণ। ফলে সে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“আমি দরজা ভাঙ্গার ব্যাবস্থা করছি”
তত সময়ে রিসোর্টের লোকেরা জড়ো হয়েছে। কেউ শ্রাবণকে সাহায্য করছে তো কেউ রঙ্গ দেখতে এসেছে। সামিন ও পৌছে গেছে রিসোর্টে। সে সোজা উপরে চলে এলো লোকজন নিয়ে। দরজা ভাঙ্গার প্রস্তুতি হচ্ছে। সামিন নিশ্চিত আরিফ ভেতরে। আজাদ ম্যানেজারকে আরিফের ছবি দেখালে সে ঘামতে লাগলো। আজ নাকি দুপুরে একটা ক্লিনারের বদলে ছেলেটা এসেছে। বলেছে ক্লিনার আব্দুল পাঠিয়েছে তাকে। লোকের সংকট আর পর্যটকের ভিড়ে রিসোর্ট ম্যানেজার আপত্তি করে নি। অপর দিকে আরিফ ঘায়েল সিংহের ন্যায় ঝাপটে পড়লো চারুর উপর। পুরুষের শক্তির সাথে কি নারী পারে। আরিফের হিনহিনে কন্ঠ কানে আসলো,
“খুব তেজ তোর, অহমীকা অনেক। আজ সব কিছু শেষ করবো”
চারু বাঁচার চেষ্টা করলো। হাত পা ছুড়লো। একটা সময় হাতে বিধলো ধাঁরালো ছু’রি। নিজেকে বাঁচাতে প্রহার করে বসলো সে আরিফের উপর। কতবার করবো জানা নেই। এমন সময় দরজা খুললো। শ্রাবণ সহ সামিনরা প্রবেশ করলো রুমের ভেতর। সবার চোখ ছানাবড়া। একপাশে আরিফের র’ক্তা’ক্ত নিথর দেহ, অপর দিকে র’ক্ত রঞ্জিত চারু। শাড়িটি রক্তে মাখা। কাঁপা চাহনী তার। স্তব্ধ সেই দৃষ্টি। জড়ানো কন্ঠে বলল,
“আমি কিছু করি নি”
সামিনের বুঝতে পারি রইলো না কি ঘটেছে। শ্রাবণ তড়িৎ গতিতে বেস্টনীতে নিলো চারুকে। চারু এবার জল ছেড়ে দিলো। ভীত সন্ত্রস্ত চারু বললো,
“আমি করি নি কিছু”
চারু কাঁপছে এখনো। শ্রাবণ তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে। মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“আমি আছি তো চারুলতা, ভয় নেই। কিছু হবে না তোমার”
তার চোখে অশ্রু। প্রেয়সীকে বুকের মধ্যখানে ঢুকিয়ে রাখলে হয়তো শান্তি হতো। সামিন চেক করলো আরিফকে, পালস আছে। চিৎকার করে বলল,
“ওকে হাসপাতালে নাও”
আরিফকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আজাদ সকলের জবানবন্দি নিলো। সামিন একান্ত ভাবে চারুর সাথে কথা বললো। ছুরি পাঠানো হলো ল্যাবে, চারুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট না পাওয়া গেলে চারু বেঁচে যাবে। শ্রাবণ অপর পক্ষে বাবা এবং রাকিবের সাথে কথা বলে নিলো। চারুকে এরেস্ট করা হলো না। কারণ বন্ধ ঘরে কি হয়েছে কেউ জানে না। আর আরিফ যে চারুর ক্ষতি করতে এসেছে তা সকলের জানা। চারুর জবানবন্দিতেও তাই স্পষ্ট। ধস্তাধস্তিতে নিজের ছু/রিতে আঘাত পেয়ে এমনটা হতেই পারে। আর আরিফ এখনো বেঁচে আছে। তাই সামিন সিদ্ধান্ত নিলো সে ছুরির তদন্তের পর ই চারুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। চারু ভয়ে এমনেই নাজেহাল অবস্থায় আছে। তাই তাকে স্বাভাবিক করতে চাইছে সে। যাবার বেলায় শ্রাবণকে বললো,
“আপনার স্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখবেন। বেশ ধকল গেছে তার”
শ্রাবণ মাথা নাড়ালো। ছুরির রিপোর্ট আসার আগ অবধি তারা সিলেট ছাড়তে পারবে না। পুলিশ বেড়িয়ে গেলো। শ্রাবণদের রুম পরিবর্তিত হলো। চারু ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। নিজ হাতে কাউকে রক্তাক্ত করেছে সে। যদি সে মা/রা যায় তবে চারুকে সবাই খু/নী বলবে। শ্রাবণ প্রেয়সীকে আগলে নিলো বুকে। মোলায়েম স্বরে বললো,
“তোমাকে কেউ কিচ্ছু বলবে না। আমি আছি তো চারুলতা”
চারু শান্ত হয় ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু আবার পাগলামী করে। একপর্যায়ে ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় তাকে শ্রাবণ। মিনিট বিশেকের মাঝেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় চারু_______
নিস্তদ্ধ রাত, নিগুঢ় আঁধার। আমাবস্যা আজ। তার আকাশ কালচে। ক্ষীণ বাতাস বইসে। গভীর রুমে চারু। বাহিরের লাইটের সরু আলো পড়ছে তার শান্ত মুখশ্রীতে। আর সেই মুখশ্রীর দিকে অপলক নজরে চেয়ে আছে শ্রাবণ। তার ঠোঁটের কোনে হাসি। এক দূর্বোধ্য, রহস্যময়ী হাসি। বা হাতে বিলি কেটে দিলো চারুর অবিন্যস্ত, এলোমেলো চুল। মিহি কন্ঠে আওড়ালো,
“দূর দ্বীপবাসিনী, ভয় নেই। কোনো বিপদ তোমায় ছুবে না…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি