#দূর_দ্বীপবাসিনী,২৮,২৯
মুশফিকা রহমান মৈথি
#২৮তম_পর্ব
নিস্তদ্ধ রাত, নিগুঢ় আঁধার। আমাবস্যা আজ। তার আকাশ কালচে। ক্ষীণ বাতাস বইসে। গভীর ঘুমে চারু। বাহিরের লাইটের সরু আলো পড়ছে তার শান্ত মুখশ্রীতে। আর সেই মুখশ্রীর দিকে অপলক নজরে চেয়ে আছে শ্রাবণ। তার ঠোঁটের কোনে হাসি। এক দূর্বোধ্য, রহস্যময়ী হাসি। বা হাতে বিলি কেটে দিলো চারুর অবিন্যস্ত, এলোমেলো চুল। মিহি কন্ঠে আওড়ালো,
“দূর দ্বীপবাসিনী, ভয় নেই। কোনো বিপদ তোমায় ছুবে না। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে তাই না, চারুলতা! কি করবো বলো! পাগল প্রেমিকের ভয় যে কাটাতে হতো তোমার মন থেকে। আমাকে ভালোবাসবে আবার আমাকেই ভয় পাবে কিভাবে সইবো বলো! তাই তো এই নাটকটা করতে হলো। ‘বিষে বিষে বিষক্ষয় আর ভয়ে ভয়ে ভয়ক্ষয়’
শ্রাবন আবারো নিঃশব্দে হাসলো। তারপর মোহময় নজরে দেখতে লাগলো চারুকে। ভয়ে তার মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। শ্যাম মুখশ্রী কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও শ্রাবণের চোখে মোহ। চারুর মুখে পরম আদরে হাত বুলাতে বুলাতে সে আনমনে বলতে লাগলো,
“আমার এতো সুন্দর প্লানের মাঝে ওই জা/নো/য়া/র আরিফটা সব গবলেট করে দিবে কে জানতো! বিশ্বাস করো আমি জানতাম না ও তোমার উপর হামলা করবে। ওর বিশ্রী নজর তোমার উপরে ছিলো বহুদিন, কিন্তু সেই লালসানজর যে এতোটা প্রবল হবে কল্পনা করতে পারি নি। তুমি চিন্তা করো না, ওর শাস্তি ও ঠিক পাবে। তুমি শুধু আমায় ভুল বুঝো না, কথা দিচ্ছি এমনটা আর হবে না। এবারের জন্য ক্ষমা করে দাও, দূর দ্বীপবাসিনী। বলেছিলাম না, তুমি আমার হবে, একান্ত আমার”
শ্রাবণের ঠোঁটে লেপ্টে আছে সন্তুষ্টির হাসি। শত প্রতীক্ষার ফল প্রাপ্তির সন্তষ্টি৷ এর মাঝেই তার মোবাইলটা বেজে উঠে, মোবাইলের কর্কশ শব্দে তেঁতো হয়ে উঠলো মন। বিরক্তি ছেয়ে গেলো তার চোখে মুখে। মোবাইলের স্ক্রীনে রাকিবের নামটি জ্বলজ্বল করছে। বিরক্তি অক্ষত রেখে ফোনটা ধরলো শ্রাবণ। অপর পাশ থেকে ভেসে উঠলো,
“স্যার, কাজ হয়ে গেছে”
“আরিফের হুশ ফিরেছে?”
“না স্যার, এখনো ফিরে নি। ফিরার চান্স নেই, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে স্যার”
“কেসটা যেনো এখানেই ধামাচাপা পড়ে, কোনো সুতো দেওয়া যাবে না”
“কিন্তু স্যার, সামিনকে সাসপেন্ড করার চান্স আছে। সেটা আটকানো দরকার”
“আমি ঢাকা যেয়ে ব্যবস্থা করবো। তুমি সাবধানে থেকো, রাখছি”
বলেই ফোনটি রেখে দিল শ্রাবণ। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ঘুমন্ত চারুর কাছে। তাকে বক্ষস্থলের মধ্যখানে আগলে রাখলো। আজ অনেকদিন পর শান্তির ঘুম দিবে শ্রাবণ। তার চারুলতা কখনই আর ভয় পাবে না। সকল ভয়ের অন্ত হলো আজ______
সিলেট মানেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, চায়ের দেশের এই অন্যরকম আবাহাওয়া অনেকের কাছে ভালো লাগার বস্তু আবার পর্যটকের কাছে সেটা বিরক্তির কারণ। অভিমানী মেঘেরা দলে দলে নীলাম্বরীর কোনায় জমে থাকবে। আর ক্ষণে ক্ষণে বর্ষণ ঘটাবে ধরণীতে। রিসোর্টের ঘরের থাই গ্লাসে জমেছে এই বৃষ্টি কণা। পর্দা টানা শীতল ঘরে বেঘুরে ঘুমাচ্ছে চারু। গলা অবধি কম্বল টানা। ঘুমের ঔষধের মাত্রাটা একটু বেশিই ছিলো। ফলে এখনো ঘুম ভাঙ্গে নি তার। গোসল থেকে বের হলো শ্রাবণ। চুল মুছতে মুছতে নজর গেল ঘড়ির দিকে। আজ এগারোটার দিকে সামিনের আসার কথা, এখন বাজে সাড়ে নয়টা। তাই বাধ্য হয়েই পর্দাটা টেনে দিলো সে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে সূর্যের দেখা মিললো না। বিষন্ন আকাশের ম্যারম্যারে দশা। শ্রাবণ টাওয়াল রেখে দিয়ে ডাকলো চারুকে। দু-তিন বারা ডাকের পর ‘হুম’ করে শব্দ করলো সে। শ্রাবণ হাসলো। তারপর বললো,
“উঠো, চারুলতা। সকাল হয়ে গেছে”
বেশ ক’বার ডাকার পর চারুর ঘুম ভাঙ্গলো। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। চোখজোড়া ফুলে উঠেছে। বিষন্ন চাহনী তার। শ্রাবণের বুকে কেনো যেনো মোচড় দিলো। চারুর এমন বিবর্ণ মুখখানা তার ভালো লাগছে না। উজ্জ্বল শ্যাম মুখটাই যে তার সবথেকে প্রিয়। চারুর হাতজোড়া নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“কাল যা হয়েছে ভুল যাও চারুলতা, দুঃস্বপ্ন ছিলো। বাজে দুঃস্বপ্ন। ভুলে যাও”
“ওরা যদি ওই ছু/রিতে আমার আঙ্গুলের ছাপ পায়? আমাকে কি ধরে নিয়ে যাবে?”
নিঃস্পৃহ কন্ঠে শুধালো চারু। শ্রাবণের চাহনী স্থির। মূহুর্তকয়েক তার মুখে উত্তর নেই। চারুর উদাস চাহনী তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়লো। দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো,
“কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো”
শ্রাবণের কথায় ম্লান হাসলো চারু। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধলো। তারপর বিছানা ছাড়লো সে। মাটিতে পা রাখতে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো। কৌতুহল নজরে চাইলো নিজ পায়ে৷ বুড়ো আঙ্গুলে সাদা, ধবধবে ব্যাণ্ডেজ। গতকাল ধস্তাধস্তির সময় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে দিকে নজর যায় নি। অথচ ঠিক তার পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চারু শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ চোখের ইশারায় শুধালো,
“কি?”
চারুর হাসি বিস্তৃত হলো। সে মাথা নাড়িয়ে “না” বললো। তারপর পাটা টেনে টেনে চললো ওয়াশরুমের দিকে। সকল আধারের সমাপ্তি ঘটাতে যেমন এক চিলতে রোদের কিরণ ই যথেষ্ট; তেমন সকল দুঃসময়ের মাঝে নিজেকে সামলানোত জন্য একটা শক্ত হাত ই যথেষ্ট। ভীত চারুর মনে কোথা থেকে অসীম সাহসের সঞ্চার হলো। কেনো যেনো মনে হলো, “তার কিছু হবে না”
সামিন এবং আজাদ লবিতে বসে আছে। তার ঠিক অপর পাশে বসে আছে শ্রাবণ এবং চারু। ফরেন্সিক রিপোর্ট এসেছে, যে ছু/রিতে শুধুমাত্র আরিফের ই আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তাই চারুকে অহেতুক আটকে রাখার মানেই নেই। সামিন চায়ের কাপটা রাখতে রাখতে বললো,
“আপনারা ঢাকা যেতে পারেন। আরিফের শরীরটা ডেভেলপ করলে ওকে আপরা ঢাকা নিয়ে যাবো। এটা স্পষ্ট যে সে চারু ম্যাডামকে এট্যাক করতে গিয়েছিলো। ধস্তাধস্তির কারণে ওর নিজ গায়ে আঘাত লাগে। তাই চারু ম্যাডামকে আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। তবে আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। ম্যাডাম কি উত্তর দিতে রেডি?”
চারু স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“জ্বী করুন”
“এই আরিফকে কি আপনি চিনতেন?”
“জ্বী না”
“আচ্ছা, আপনার কি কখনো মনে হতো কেউ আপনাকে ফলো করছে?”
এবার একটু সময় নিলো চারু। আড়চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ফলে সে ডান হাত দিয়ে চারুর হাত চেপে ধরলো। তারপর বললো,
“তুমি বলো, ভয় পেও না”
“জ্বী, আমাকে কেউ ফলো করতো। স্ট/কার বলতে পারেন, আমাকে চিঠি পাঠাতো। আমার চারপাশেই থাকতো। এই ধরের ক্যান্টিনের বিল দেওয়া, আমার জন্য রিক্সা পাঠানো, আমার যদি অসুবিধা হতো তা চাইতেই একটা সাহায্য পাওয়া। আমি ঠিক বুঝাতে পারবো না। ব্যাপারটা প্রথম দিকে ভালো লাগলেও ধীরে বিষাক্ত হয়ে উঠলো। একবার একটা ছেলেকে মেরে তাকে আইসিউ তে ভর্তি করে দিলো সেই লোকটি। আমি ভয় পেলাম, কথাগুলো গোপন করলাম। ব্যাপারটা ভয়ে পরিণত হলো। এমনটা তিন বছরের অধিক সময় ধরে চলছে।”
চারু থেমে গেলো। তার কন্ঠ ঈষৎ কাঁপছে। সামিন এতোক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর একটা চিরকুট চারুর সামনে রেখে বললো,
“দেখুন তো চিনেন কি না?”
চিরকুট টি দেখেই চারুর চোখ বিস্ফোরিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
“এটা তার হাতের লেখা আপনি পেলেন কোথায়?”
“এগুলো আরিফের ঘর থেকে পাই আমরা, আপনার অনেক ছবিও উদ্ধার করেছি। তারমানে আরিফ ই এতোকাল আপনাকে ফলো করতো। কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, তার আশরাফ গণির সাথে কি সম্পর্ক? কেনো আশরাফ গণি তাকে টাকা দিলো”
সামিনের প্রশ্নে চারুর ভ্রু কুঞ্চিত হয়। আশরাফ গণি নামক মানুষটির সাথে তার পরিচয় নাহিয়ানের সূত্রে। নাহিয়ানের মৃ/ত্যু না হলে আজ সে তার শ্বশুর হতো। সামিন একটু থেমে বললো,
“ইনফ্যাক্ট আশরাফ গণি তাকে বিশ হাজার টাকাও পাঠিয়েছে। আর চারু ম্যাডামের কি/ড/ন্যা/পিং এও গণি সাহেবের হাত ছিলো। আবার সেই স্থানে আরিফের উপস্থিতিও ছিলো। যদিও সে স্বীকার করে নি। ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে লাগছে”
“দেখুন শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। আশরাফ সাহেবের সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো না। ব্যাবসায়ের জন্য রেষারেষি আছে। হয়তো সেজন্য সে আরিফের সাথে হাত মিলিয়েছে”
“হতে পারে। আচ্ছা আরিফের পাঠানো চিরকুট গুলো কি আছে?”
“জ্বী আছে। সাথে ওর দেওয়া হুমকি পত্র ও আছে”
“বেশ ঢাকা যাবার সাথে সাথেই আজাদের হাতে সেগুলো পাটগিয়ে দিবেন। কেস স্ট্রং করার জন্য। আর টেনশন নিবেন না। এই আরিফ কেস ক্লোজ। এখন আর কেউ মিস চারুকে ডিস্টার্ব করবে না।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো সামিন। আজাদ ও উঠে দাঁড়ালো। এবার তাদের ফিরার পালা। তবে চারুর মুখে কোনো কথা নেই। শ্রাবণ তাদের বিদায় দিয়ে আসতেই চারু তাকে অকপটে প্রশ্ন করে বসলো,
“আশরাফ আংকেল আমাকে কি/ড/ন্যা/প করিয়ে ছিলো আপনি জানতেন? আমাকে কেনো জানান নি? আর এতো শত্রুতার মাঝেও আমাকে আপনি বিয়ে করেছেন। আচ্ছা নাহিয়ানের মৃত্যুতে আপনার হাত নেই তো…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#২৯তম_পর্ব
“আশরাফ আংকেল আমাকে কি/ড/ন্যা/প করিয়ে ছিলো আপনি জানতেন? আমাকে কেনো জানান নি? আর এতো শত্রুতার মাঝেও আমাকে আপনি বিয়ে করেছেন। আচ্ছা নাহিয়ানের মৃত্যুতে আপনার হাত নেই তো?”
চারুর দৃষ্টি স্থির অনঢ়। সে উত্তরের প্রতীক্ষায় শ্রাবণের পানে চেয়ে আছে। তার কন্ঠ বেশ শান্ত ঠেকলো। কিন্তু শ্রাবণ বিচলিত হলো না। তার ঠোঁটের কোনে দূর্বোধ্য হাসি। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন”
“এমনি, কৌতুহল বলতে পারেন। কারণ আরিফ যদি গণি আংকেলের সাথে হাত মিলিয়েই থাকে তবে তার পক্ষে নাহিয়ানের ক্ষতি করা সম্ভব নয়”
“কেনো নয়?”
“গণি আংকেল যদি জানতে পারেন উনি কি আরিফকে ছেড়ে দিবেন? আর টাকা দিয়ে সাহায্য করা তো দূরের কথা”
চারুর যুক্তির কাছে নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। নেশাতুর কন্ঠে বললো,
“তুমি সত্যি অনেক বুদ্ধিমান চারু, তাইতো তোমায় এতো বেশি ভালোলাগে। তোমার প্রতি প্রণয়টা আমার কখনই কমবে না, বরং দিন যত যাবে তা ঘন হবে। আর বিশ্বাস করো, নাহিয়ানের মৃ/ত্যুতে আমি দায়ী নয়। ওকে মে/রে ফেলা কখনই আমার ইচ্ছের মধ্যে পড়ে না। হ্যা ওর প্রতি সুপ্ত রাগ ছিলো। রাগটা খুবই সামান্য, তবে তার জন্য আমি ওকে কখনোই মে/রে ফেলবো না। ওর মৃ/ত্যু কেবলই একটা দূর্ঘটনা”
মানুষ যখন মিথ্যে বলে তখন সে দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তার কন্ঠ থাকে অস্থিরতায় ভরপুর। কিন্তু শ্রাবণের ক্ষেত্রে তা ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত৷ তার স্বর ছিলো শীতল, অবিচলিত। তার দৃষ্টি ছিলো চারুর চোখের পানে স্থির। সে নিজেকে আঁড়াল করে নি। চারু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শ্রাবণ নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে সন্দেহ করবে, কল্পনা করি নি। এখনো আমাকে বিশ্বাস করে উঠো নি তাই না চারুলতা?”
চারু চুপ করে থাকে। সে লজ্জিত, লজ্জিত শ্রাবণকে ভুল বোঝায়। চারুর নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে, ঘটনাগুলো এতো দ্রুত হচ্ছে চারুর মনে হচ্ছে সে একটা বিশাল গোলকধাঁধাতে আটকে গেছে। এমন গোলকধাঁধা থেকে বের হবার কোনো উপায় সে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে শুধু পথ খুচ্ছে। কিন্তু সেই পথ টুকু অজানা। চারু বিব্রত স্বরে বললো,
“আমি ঠিক সন্দেহ করছি না, আসলে ঘটনাগুলো আকস্মিকভাবে ঘটছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। নিজেকেও যেনো অজানা মনে হচ্ছে”
চারু মাথা নত করে বসে আছে, তার স্বর দলা পাকিয়ে আসছে। শ্রাবণ হাটু গেড়ে তার সম্মুখে বসলো। তার হাত জোড়া নিজ হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,
“চারুলতা, ভুলে যাও। মনে করো সব সুঃস্বপ্ন ছিলো। আঁধারটুকু কেটে গেছে, এখন ভোরের আলো ফুটেছে। আর কোনো বিপদ নেই। কুসুমপ্রভায় আলোকিত ধরনী তোমায় অপেক্ষায় আছে চারুলতা, আর কোনো ভয় নেই”
চারু ম্লান হাসলো। তারপর উঠে চলে গেলো নিজ রুমে। তার বিকালে ফ্লাইটে ঢাকা ফিরবে তারা। অনেক কিছু প্যাকিং করতে হবে। ঝরণার নিচ থেকে কিছু পাথর কুড়িয়েছিলো। না জানি কঠায় অবহেলায় পড়ে আছে। শ্রাবণ একখানা ঝিনুকে মালা কিনে দিয়েছিলো। গতরাতে না বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিড়ে যায় আরিফের আক্রমণে। সিলেট ভ্রমণ টা স্মরণীয় বটেই। কিছু সুখময় স্মৃতি তো কিছু প্রবল ভয়ংকর মূহুর্ত। এডভ্যাঞ্চারাস হানিমুন! শ্রাবণের দৃষ্টি চারুর যাবার পানে স্থির। তার চোয়াল শক্ত। মস্তিষ্ক হাজারো জাল বুনছে, জাল বুনছে নিজ প্রেয়সীকে নিজের বানানো রাজপ্রাসাদে আগলে রাখার। সেখানে শুধু তাকেই চিনবে চারু, তাকে আকড়ে বাঁচবে সে____
এক ডিলে দু পাখি মারা প্রবাদটিকে সে হাতে নাতে খাটিয়েছে। চারুর মন থেকে পাগল প্রেমিকের ভয়টিকে সরানোর সাথে সাথে নিজের দুজন প্রবল শত্রু আরিফ এবং গণিকে একই সাথে হটিয়েছে সে। আরিফের জ্ঞান আদৌও ফিরবে কি না, জানা নেই। ছেলেটা এতোকাল তার শিষ্য ছিলো। রাকিবের ন্যায় তার নিকট কাজ করতো। চারুর কলেজে হবার দরুন চারুর সকল খবরাখবর শ্রাবণের কাছে পৌছে দিতো। চারুকে নানা ভাবে বুঝিয়ে দিতো পাগল প্রেমিকটি তার আশেপাশেই আছে। কিন্তু গোলটা বাধলো তখন যখন আরিফের দৃষ্টিতে লালসা জাগলো, চারুর প্রতি সে আসক্ত হতে লাগলো। চারুর প্রতি লোভ তার গাঢ় হলো, একবার ঠিক করলো পাগল প্রেমিক হিসেবে নিজেকেই চারুর সামনে পরিচয় দিবে। শ্রাবণ তখন একটা কাজে চিটাগং, এর মাঝেই চারুর বিয়ে ঠিক হয় নাহিয়ানের সাথে৷ শ্রাবণের অগোচরে আরিফ তখন নাহিয়ানকে নানা ভাবে ভয় দেখানোর প্রয়াস করে। কিন্তু সফল হয় না। শ্রাবণ যখন ঢাকা ফিরে তখন চারুর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। রাকিব সকল ব্যাপার তাকে জানালে পাগলের ন্যায় হয়ে যায় শ্রাবণ। তখন সে আরিফকে ঠিক করে নাহিয়ানকে হু’মকি দেবার জন্য, একেই নাহিয়ান আশরাফ গণির ছেলে উপরন্তু তার প্রেয়সীর হবু বর। শ্রাবণ যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আরিফ সেটার সুযোগ নেয়, নাহিয়ানের গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে দেয় সে। সে ভেবেছিলো এতে সাপ ও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। কিন্তু নাহিয়ানের মৃ’ত্যুর পর শ্রাবণের বুঝতে বাকি থাকে না আরিফের মনোবাঞ্ছা। সে আরিফকে নানা ভাবে ট’র্চার ও করে, ফলে আরিফ স্বীকার করে। তার মনে চারু সনক্রান্ত ভাবনাগুলো সহ্য হয় না শ্রাবণের। সমস্ত ক্রোধ বের করে সে, আরিফকে এতোটা ট’র্চার করে যেনো চারুর সম্মুখে দাঁড়াতেও সে ভয় পায়। কিন্তু কোনো ভাবে শ্রাবণের আটক থেকে সে পালিয়ে যায়, এর পর থেকে আরিফ শ্রাবণকে নানা ভাবে ব্লাকমেইল করতে শুরু করে। শ্রাবণের বিয়ের দিন টিতেও আরিফ ই তাকে ফোন করে হুমকি দেয় ফলে সে প্যানিক এট্যাক করে। তারপর ই এই প্লান করে শ্রাবণ। আরিফ শ্রাবণের উপর ক্ষেপে ছিলো, সে যে দিন গুনছে তার উপর আক্রমণ করার সেটা শ্রাবণ জানতো। শ্রাবণ বিভিন্ন ভাবে আগুনে ঘি ঢেলেছে যেনো আরিফের এই ক্রোধ বাড়ে। আরিফ যেনো মরিয়া হয়ে উঠে তার প্রতিশোধের জন্য। যতই হোক কম ট’র্চার ত করে নি। আরিফ শ্রাবণের পাতানো ফাঁদে পাও দেয়। ফলে তাকে পুলিশ আটক করে। আরিফকে জেল থেকেও শ্রাবণ ই বের করে৷ গণির একাউন্ট থেকে টাকাও সেই পাঠায়। আরিফ এবং গণি ছিলো তার দুটো দাবার গুটি। এখন দুজনের একজন ও নেই। শ্রাবণের শীতল মস্তিষ্কের পরিকল্পনা আজ সফল। প্লেনে বসে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মুখে দূর্বোধ্য হাসি। কাধে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে প্রিয়তমা। আচ্ছা প্রিয়তমা কি কখনো জানবে এই পাগল প্রেমিক তাকে কত ভালোবাসে??
সন্ধ্যে ৭টা ২৫,
ধ্রুবের হাতে চায়ের কাপ। মুখে দিতেই মুখ বাঁকালো সে। চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু এতে চার দোষ নেই, সে তো জাহানারা আধ ঘন্টা আগেই ধ্রুবকে দিয়ে গেছে। কিন্তু ধ্রুবের মন ছিলো অন্যথায়৷ টিভিতে একটা নিউজ দেখে হতবাক হয়ে যায় সে। সেখানে বারংবার চারুর ছবি দেখাচ্ছিলো৷ এর পর থেকেই চা খাওয়ার কথা যেনো ভুলেই গেছে সে। টেবিলের উপর ল্যাপটপ বের করে তার সামনেই বসে আছে। তার চোখ স্থির। ভ্রু কুঞ্চিত।
“কি করো?”
চিত্রার কথা কানে আসতেই চমকে উঠলো ধ্রুব। সাথে সাথেই ল্যাপটপের ফোল্ডার বন্ধ করে দিলো। চিত্রা বিষয়টা খেয়াল করলো। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো,
“কি লুকালে? কি করছিলে তুমি?”
“তুই এখানে কি করছিস? তোর লি কাজ নেই নাকি? এখানে কি করছিস?লজ্জা করে না তোর?”
ধমকের স্বরে কথাটা বললো ধ্রুব। তার মেজাজ এখন তিরিক্ষি। কিন্তু চিত্রা পাত্তা দিলো না। সে তার বইগুলো খাটে চেলে দিয়ে বললো,
“কাজেই এসেছি। ভেবো না তোমাকে জ্বালাচ্ছি। প্রেম ভালোবাসার নিবেদন করতে এসেছি। আমি সেই চিন্তা ঝেড়ে দিয়েছি। আমি এসেছি পড়তে। তুমি আমাকে হিসেববিজ্ঞান পড়াবে। আমি চাই না ফেল করি, বাবা আমার মাথা চিবিয়ে খাবে। নাও নাও, পড়াও। আমি এই ডেবিট ক্রেডিটের হিসেব মিলাতে পারি না”
ধ্রুবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বিরক্তি ভরা চাহনী প্রয়োগ করলো চিত্রার দিকে, কিন্তু লাভ হলো না। সে পায়ের উপর পা তুলে আসন গেড়ে বসে আছে। ভাবটা এমন যেনো এক রাতে বিদ্যাধরী হয়ে যাবে। চোখ বুঝে একটা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ধ্রুব। খেকিয়ে বললো,
“বই দে”
“এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছো কেনো? একটু পড়তে এসেছি কি ভাব? নেহাত তুমি ভালো বলে এসেছি নয়তো ও বাড়ির নিরব ভাই ও হিসেব এ ভালো। বলো তো ওখানে যাই”
“এই একটা মারবো। এতো কথা বলিস কেনো রে। চুপ করে বয়। বলছি তো পড়াবো”
“পারবে? আমার কিন্তু ফেল করা চলবে না”
ধ্রুব বই দিয়ে সজোরে মাথায় মা’রলো চিত্রার। ধমকিয়ে বললো,
“যে না আমার ছাত্রী, চুপ করে থাকবি। আমি বুঝাবো বুঝবি। যদি প্যা পু করিস একেবারে নিরবের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো”
চিত্রা চুপ করলো। ধ্রুব পড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু চিত্রার নজর ক্ষণে ক্ষণে ওই ল্যাপটপের দিকেই যাচ্ছে। ওখানে শ্রাবণের নামে কিছু তো লেখা ছিলো_______
মোস্তফা কামালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। সিলেটের ঘটনা কিছুই অজানা নয় তার। আরিফ শ্রাবণের ক্ষতি কেনো করতে চেয়েছিলো সেটা তো অজানা নয়। সেই ব্যাপারেই কথা বলতে চাচ্ছিলেন তিনি। উপরন্তু আরিফের আহত হওয়া তাকে খুব ভাবাচ্ছে। সামিনের সাসপেনশন থামিয়ে দিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। তিনি চান না, ব্যাপারটা বাড়ুক। মোস্তফা কামাল শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই আরিফটিকে তুমি চিনতে তাই না?”
“না চিনতাম না”
“দেখো শ্রাবণ, এই শহরে কিছুই আমার অজানা নয়। তাই আমার থেকে লুকিও না। আমি কিন্তু জানি তুমি কি করতে চাচ্ছিলে”
“তো?”
শ্রাবণের দায়সারা ভাব যেনো মোটেই সহ্য হলো না মোস্তফা সাহেবের। ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন মূহুর্তেই। হিনহিনে স্বরে বললেন,
“যার জন্য এগুলো করছো, সে তোমার সত্যি জানলে তোমাকে মেনে নিবে তো?”
“আমি আপনার ছেলে বাবা, আপনি এতোকাল যেভাবে নিজের কাজ গুলো ধামাচাপা দিয়েছেন, আমি তো আপনার থেকেই শিখেছি। আর একটা কথা বলি, স্বভাবে আমি আপনার থেকেও বড় দা’ন’ব”
“তোমার মাঝে আমি তোমার মার রুপ দেখি। সেই চাহনী, সেই পাগলামী”
“সে জন্যই তো তাকে নিজ হাতে হ’ত্যা করেছিলেন আপনি, তাই না?………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি