দূর_দ্বীপবাসিনী,৩০,৩১

0
712

#দূর_দ্বীপবাসিনী,৩০,৩১
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৩০তম_পর্ব

“তোমার মাঝে আমি তোমার মার রুপ দেখি। সেই চাহনী, সেই পাগলামী”
“সে জন্যই তো তাকে নিজ হাতে হ’ত্যা করেছিলেন আপনি, তাই না?”

শ্রাবণ শীতল কন্ঠে কথাটি বললো। কথাটি ধাতস্থ হতে সময় নিলো মোস্তফা সাহেবের স্নায়ু। মূহুর্তেই গম্ভীর মুখখানা হয়ে উঠলো আঁধারে আচ্ছন্ন। ক্রোধ জমলো নয়নজোড়ায়। সোনালী বর্ডারের ফ্রেমের পেছনে আঁড়াল হলো না সেই ক্রোধাগ্নি। প্রবল ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন,
“শ্রাবণ, মুখ সামলে কথা বলো। ভুলে যাচ্ছো তুমি তোমার বাবাত সাথে কথা বলছো।”
“হ্যা, বাবাই তো বটে। সেই বাবা যে কিনা নিজ পুত্রের ছেলেবেলাকে কেড়ে নিয়ে দিয়েছে কেবল এক রাশ দুঃস্বপ্ন। যে বাবা তার পুত্রের নিরাপদ স্থানকে নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে। একটা সাত বছরের বাচ্চা সাক্ষী ছিলো তার মায়ের মৃ’ত্যুর। কত রাত মায়ের শাড়ি আকড়ে শুয়ে থাকতাম! আপনি তখন অন্যের বিচার করতে ব্যস্ত। ভুলে যাবেন না বাবা, আমি নিজ চোখে দেখেছিলাম সেদিনের ঘটনা। আমার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেলেও সেই দৃশ্য আজ ও জীবন্ত। কই আপনাকে কেউ ধরতে আসে নি, আপনার তো বিচার হয় নি। তাহলে আমার কেনো? আমি যা করেছি আমার চারুলতাকে আগলে রাখতে করেছি। আমার জীবনের একমাত্র আলোর উৎসকে আমি শেষ হতে দেই কি করে! ওরা আমার চারুলতাকে কলুষিত করতে চায়। আমি সব জেনেও নির্বোধের মতো বসে থাকতে পারবো না। ওই গণি আমার সাথে শোধ তুলতে চারুলতাকে টার্গেট করেছিলো। ওই আরিফ তো…..বেশ করেছি। আমি ওর ক্ষতি কখনোই মেনে নিতে পারবো না”

শ্রাবণ বিরতিহীন ভাবে বলে গেলো কথাগুলো। মোস্তফা কামাল শুধু শুনলেন। তার সরু দৃষ্টি দেখে যাচ্ছে শ্রাবণকে। শ্রাবণের কন্ঠ কাঁপছে, তার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নিজেকে সংযত রাখার অদম্য চেষ্টা। কিন্তু কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না স্বয়ংকে। মোস্তফা কামাল হতাশ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। শীতল কন্ঠে বললো,
“সেদিন আমি যা করেছি তোমার জন্য করেছি। ইশরা বেঁচে থাকলে তুমি কোনোকালেই বেঁচে থাকতে না”
“অযথা অজুহাত আমার ভালো লাগে না। খু’নী আপনি, আর খু’নীদের এতো বড় কথা মানায় না”
“তুমি কি তাহলে? আমি যে দোষে দোষী তুমি ও সেই দোষেই দোষী”

শ্রাবণ হাসলো। বাঁকা দূর্বোধ্য হাসি, সেই হাসিতে চকচক করে উঠলো ব্যাথিত আঁখিজোড়া। তারপর শক্ত জোড়ালো স্বরে বললো,
“আমি আর আপনি কখনোই এক নই, যে আপনাকে চোখ বুজে ভরসা করেছিলো আপনি তার বিশ্বাসের পাহাড়টি ভেঙ্গে ফেলেছেন এক নিমিষেই। আর আমি আমার প্রিয়তমার বিশ্বাস অর্জন করেছি। তাকে আগলে রাখছি। আমরা কখনোই এক নই। হতেই পারি না”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো শ্রাবণ। মোস্তফা কামাল শরীরটা এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। এক সূক্ষ্ণ বেদনা ভেসে উঠলো চোখে। নোনাজলের ছায়া দেখা গেলো চোখে। ব্যাথিত নয়নে তাকালে নিজে হাত জোড়ায়। থমথমে কন্ঠে বললেন,
“তুমি আমায় কোনোদিন বুঝলে না শ্রাবণ। সেদিন যে আমি অসহায় ছিলাম। ইশরা নয়তো তোমাকেই মে’রে ফেলতো। ও তো এটাও ভুলে গিয়েছিলো তুমি ওর আপন ছেলে”

মোস্তফা কামাল চোখ বুঝলেন। বা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু নোনা জল। সেই রেখাটা অলক্ষ্যে হারিয়ে গেলো________

শ্রাবণের গা ঘামছে। কদম বেসামাল হয়ে উঠেছে। শ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। শরীর ক্রমেই কাঁপছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠছে। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রুমের দিকে। পথ যেনো শেষ হতেই যাচ্ছে না। পাজোড়া কাপছে। দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ইঞ্জেকশনটা রুমে। তাড়াতাড়ি না নিলে আবারো খিঁচুনি উঠবে। শ্রাবণ প্রবল ইচ্ছাত অভিপ্রকাশ করলো। কিন্তু লাভ হলো না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ঘরের সামনে। সারা গা কাঁপুনি দিতে লাগলো, চোখ উলটে সাদা অংশটুকু পরিলক্ষিত হলো। চারুলতা ডাকার অভিলাষ ব্যক্ত হলো না। গোঙ্গাতে লাগলো সে। চারুলতা তখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলো। মেঝেতে শ্রাবণের কাতরানো দেহটিকে দেখে চিৎকার করে উঠলো সে। শরীর ঘেমে উঠলো উদ্বিগ্নতায়। সেই কিছুক্ষণ পূর্বেই না ঠিক ছিলো সে। দিব্যি তো বাবার রুমে গিয়েছিলো। পুনরায় কি হল! এমন কাটা মাছের মতো ছটফট কেনো করছে। চারু ডাকতে লাগলো,
“শ্রাবণ কি হয়েছে আপনার? শ্রাবণ?”

সাড়া দিলো না শ্রাবণ। তার চোখ উল্টে আছে। গোঙ্গানির শব্দ কানে আসছে। মুখ থেকে গ্যাজা বের হতে লাগলো। দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ খাচ্ছে শ্রাবণের শান্তা বেগম ছুটে আসলেন চারুর আর্তনাদে। মোস্তফা সাহেবের চিন্তায় বাধা পড়লো। চোখ মেললেন। শ্রাবণের নাম শুনতেই ছুটে গেলেন। শ্রাবণের কথা ঠিক ঠেকছিলো না তখন। তবে কি আবারো তার সিজার এট্যাক হলো! ছুটে গেলেন তিনি। গোলের স্থানে পৌছাতেই স্তব্দ হয়ে গেলেন মোস্তফা কামাল। শ্রাবণ মেঝেতে কাঁপছে। চারু উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে ডাকছে। হুলস্থুল এক অবস্থা______

শ্রাবণ ঘুমিয়ে আছে। তার মুখখানা শান্ত। দুখানা ইঞ্জেকশন তাকে দেওয়া হয়েছে। একটা খিঁচুনীর, একটা ঘুমের। তাই সে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। মোস্তফা কামাল ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাথিত নয়নে। এই এক দূর্বলতা তাকে সর্বহারা করেছে। কেনো যেনো ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগে না তার। একদিন ছেলেকে বলেছিলেন,
“দূর্বল হয়ো না, কোনো কিছুতে মায়া জাগিও না”

অথচ এই পুত্র তার সকল মায়ার উৎস। এই পুত্রের দূর্বলতাই তার হৃদয়কে বারংবার বিচলিত করে তোলে। এই পুত্রকে বাঁচাতেই নিজের প্রিয়তমাকে শেষ করে দিয়েছেন তিনি। বুক চিরে একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। চারু উদ্ভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণের এই অসুখের কথাটি তার অজানা ছিলো। আকস্মিক সত্যতা তাকে খানিকটা নাড়িয়ে দিয়েছে। মোস্তফা কামাল এগিয়ে এলেন চারুর দিকে। চারুকে মোলায়েম কন্ঠে ডাকলেন। ধীর স্বরে বললেন,
“আমার ছেলেটা তখন অনেক ছোট, মায়ের মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছে। সাত বছরের শিশু বিভৎস সেই স্মৃতি নিতে পারে নি। তখন থেকেই ওর এই রোগ ধরা পড়ে। খুব টেনশন নিজের মাঝে ধরতে পারে না। এই কয়দিন যাবৎ যা ঘটছে তা তো স্বাভাবিক না। হয়তো তাই এরকম হচ্ছে। খেয়াল রেখো ওর দিকে”

মোস্তফা কামালের মুখপানে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো চারু। এই প্রথম নিজ থেকে কথা বলেছেন তিনি। ব্যাপারটা তাকে বিস্মিত ই করলো। চারু মাথা নাড়ালো৷ সে খেয়াল রাখবে। মোস্তফা কামাল এবং বাকিরা চলে গেলো। শ্রাবণের মুখপানে তাকিয়ে থাকলো চারু। মূর্ছা গেছে মুখখানা। ঠোঁট জোড়া শুকনো। এক নীল বিষাদের ছাপ অবলোকন করলো। যে মানুষটিকে তাকে সামলেছে সেই মানুষটিকে অসহায়ের ন্যায় পড়ে থাকতে দেখে চিনচিন করে উঠলো বুকখানা। কি ব্যাথা, অসহ্য এই ব্যাথা!!! চারু তার হাতখানা নিজ হাতে নিলো। উষ্ণ ঠোঁট ছোয়ালো নিথর হাতে। কাতর স্বরে বললো,
“আমি সত্যি আপনাকে চিনি না শ্রাবণ। সব জানার মাঝেও এতো অজানা কেনো আপনি? কেনো আপনার চারপাশে এতো গোলকধাঁধা”

????

বৈশাখ মাস আসবে আসবে করছে। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুর, শরীর জ্বালিয়ে দিচ্ছে যেনো। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রাজপথে হাটছে ধ্রুব। সূক্ষ্ণ গরম বাতাস মুখে লাগলেও তা স্বস্তি খুব একটা দিচ্ছে না। বাইকটা নষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক করাতে সময় লাগবে। ফলে এখন রিক্সা, বাসে করেই যাতায়াত করে সে। শাহবাগের এখানে এসেছিলো একটা কাজে। কাজটি শেষ হয়েছে কিছুসময়। এখন গন্তব্য তার থেকে একটু দূরে। তাই হাটছে সে। অবশেষে পৌছালো সে গন্তব্যে। মাথা তুলে একবার দেখে দিলো বারডেম হাসপাতাল টি। রুম নাম্বার ৪০৫ তার গন্তব্য স্থল। সেই রুমেই রাখা হয়েছে আরিফকে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৩১তম_পর্ব

অবশেষে পৌছালো সে গন্তব্যে। মাথা তুলে একবার দেখে দিলো বারডেম হাসপাতাল টি। রুম নাম্বার ৪০৫ তার গন্তব্য স্থল। সেই রুমেই রাখা হয়েছে আরিফকে, আরিফের এখনো জ্ঞান ফিরে নি। অচেতন শরীরটা পড়ে রয়েছে রুম নম্বর ৪০৫ এ। কড়া পাহারাতে রয়েছে সে। জেল পলাতক আসামী বলে কথা, এ’ট্যাম্প টু মা’র্ডা’র এর চার্জ রয়েছে। যদি জ্ঞান ও ফিরে তবুও লাভ নেই। মোস্তফা কামাল তাকে জীবন্ত অবস্থায় মৃ’ত্যুর স্বাদ পাওয়ানোর ব্যাবস্থা করে রেখেছেন। আরিফ প্রতিমূহুর্তে মৃ’ত্যু কামনা করবে এমন ই ব্যাবস্থা করে রেখেছেন তিনি। তাই যতদিন তার জ্ঞান না ফিরে ততদিন ই শান্তি। প্রশান্তির ঘুমের মধ্যেই থাকুক সে। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আরিফের রুমের বাহিরে। রুমের বাহিরে দুজন হাবিলদার গল্পে মশগুল। একজন তো রীতিমতো পান চাবিয়ে গল্প করছে। অন্যজন ধ্রুবকে দেখে চোখ কুচকালো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“কে আপনি? এখানে কি চাই?”
“আসলে প্যাশেন্ট দেখতে এসেছিলাম”
“প্যাশেন্ট? কে?”

তাদের দুজনের মুখেই বিরক্তি, হুট করে অপরিচিত একজন তাদের গল্পে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। ব্যাপারটা মানতে ভালো লাগছে না তাদের। একেই প্রকৃতির উত্তাপ, উপরন্তু সটান দিন রাত পাহারা দেওয়া কি চারটে খানেক কথা, একটু তো কথা বলছিলো ডিউটির ফাঁকে। এই আগুন্তক এসে মেজাজ খারাপ করে দিলো তাদের। ধ্রুব স্মিত হাসলো, বিনয়ী কন্ঠে বললো,
“আসলে শুনেছি, এখানে একজন ক্রিমিনাল আসেন। আমি এসেছি তার ইন্টারভিউ নিতে। এই যে আমার কার্ড। আমি প্রমুখ পত্রিকার সাংবাদিক”

পুলিশ দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। ধ্রুবের গুছানো মিথ্যে হয়তো তারা ঠিক ধরতে পারে নি। খুব চিন্তায় পড়ে গেছে তারা, কি করা উচিত হবে বুঝে উঠতে পারছে না। একজন তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“স্যারের স্ট্রিক্ট ওর্ডার আছে, কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাইবে না। আপনি যেই সাংবাদিক হোক না কেন আপনারে ভেতরে যাইতে দিবো না”
“আচ্ছা, আপনার স্যার জানবে না”
“এটা কি হয় না কি?”
“একটু চা পানি দিলেও ব্যাবস্থা করা যায় না?”
“ওই মিয়া, ঘুষ দেবার চান আপনি? এতো সাহস?”
“আরে চেতে যাচ্ছেন কেনো, ইচ্ছে না হলে নিবেন না। আমি জোর করছি না”

হাবিলদার একজন বেশ চেতে গেলেন, ধ্রুব তাতে বিচলিত হলো না। অন্যজন একটু শান্ত, সে তার সহযোগীর হাত টেনে ফিসফিসিয়ে কিছু বললো। হয়তো চা পানির বুদ্ধিটা মনে ধরেছে। ধ্রুব বাঁকা হাসি হাসলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কাঙ্খিত উত্তরের। এবার রাগী হাবিলদার খানিকটা ক্ষান্ত হলেন। অপরজন মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“স্যার, ভেতরে যাইয়ে লাভ নেই। ওই আসামী কোমায় চলে গেছে। এখনো জ্ঞান আসে নি। মনে হয় না আসবে। তাই বলছি লাভ নেই স্যার”
“এক নজর দেখা যাবে, শুধু এক নজর”

অবশেষে রুমে ঢুকতে পারলো ধ্রুব। বিনিময়ে হাজার টাকাও খসলো। সাদা বিছানায় আরিফ শুইয়ে আছে, ফিনাইলের তীব্র গন্ধ নাকে আসলো ধ্রুব এর। রুমটি মাত্র ই মুছে গেছে ওয়ার্ডবয়। ধ্রুব টুল টেনে বসলো। আরিফকে দেখে মনে হলো সে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে পরম শান্তিতে। ধ্রুব মোবাইলে একটা ছবি তুলে নিলো আরিফের। ছেলেটাকে তার পরিচিত লাগছে, পাড়ায় হয়তো দেখেছে দু-তিন বার। চারুর কলেজেও দেখে থাকতে পারে। মনে আসছে না, চেষ্টাও করছে না সে মনে করার। সে শুধু গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে। তার দৃষ্টিতে সুপ্ত এক রাশ ক্রোধ, সামান্য সমবেদনা আর আকাশসম প্রসন্নতা। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালো। আরিফের কানের কাছে এসে স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“ভাবিস না আমি তোর শুভাকাঙ্খি, মোটেই নয়। যে মানুষটাকে আমি আগলে রাখতে চেয়েছিলাম তাকে কষ্ট দেবার প্রয়াস করেছিস। এটা তো সামান্য শাস্তি। তবুও আমি চাই তুই সুস্থ হয়ে উঠ। কারণ শ্রাবণ নামক দৈত্যকে বধ করতে তোকে যে প্রচন্ড প্রয়োজন। চারুকে ওই দৈত্যের হাত থেকে বাঁচাতে তোর প্রয়োজন। তুই যে একমাত্র সাক্ষী শ্রাবণের সব কার্যের”

আরিফের কোনো হেলদোল হলো না, সে তার প্রশান্তির ঘুমেই মগ্ন। তার স্যালাইন চলছে। ধ্রুব সোজা হলো, তারপর দ্রুত পায়ে বের হয়ে এলো। শ্রাবণকে তার সন্দেহ বহুদিনের। কিন্তু সন্দেহ গুলো ছন্নছাড়া, তবে এই ছন্নছাড়া সন্দেহ এর মাঝে এই আরিফ নামক গুটি টিকেই একমাত্র পেয়েছে যাকে কেন্দ্র করে সব হচ্ছে। পুলিশের মাধ্যমে জানতে পেরেছে এই আরিফ নাকি এতোকাল চারুকে ফলো করতো, সে শ্রাবণকে সেকারণে খু’ন করতে চেয়েছিলো। পুলিশের সন্দেহ সে গণি সাহেবের সাথে মিলে চারুর কিড’ন্যা’প ও করেছে, এবং পরে নিজের দলের মানুষ নাজমুল এবং করিম কে সে হ’ত্যা করেছে। কিন্তু ধ্রুবের এমন কিছু মনে হয় না। তার ধারণা একটা বিশাল ঘাপলা আছে। তার ধারণা এই সব কিছু সাজানো, বানোয়াট। এবং এর জন্য আরিফের জেগে ওঠা প্রয়োজন। অতি প্রয়োজন। ধ্রুব খোঁজ নিয়ে জেনেছে গণি সাহেব এবং জেলে। সে বারংবার বলছে আমি আরিফকে চিনি না, চিনি না। আমার একাউন্ট থেকে কিভাবে তার একাউন্টে টাকা গেছে আমি জানি না। কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। ধ্রুব কোনো পুলিশি লোক কিংবা গোয়েন্দা নয়। তাই এই রহস্য সমাধান তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তার মন প্রবলভাবে বলছে। এটা একটা সাজানো প্লান। শ্রাবণের চারুকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটা জিনিস অত্যন্ত সন্দেহ জনক। চারুর বিপদে পড়লে তার উপস্থিতি, এতো সিকিউরিটির মাঝে তাকে মা’রতে আসা। চারুর কি’ড’ন্যা’পারদের মৃ’ত্যু। সব কিছু কেমন যেনো একে অপরের সাথে লেপ্টে আসে। ধ্রুব সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু রহস্যটার মূলে যেতে পারছে না। হয়তো এই আরিফের অপেক্ষায় ই সে ছিলো। হয়তো আরিফ ই তাকে সাহায্য করবে শ্রাবণের এই ভালোমানুষী মুখোশ খুলে দিতে_________________

আলমারীর সকল কাপড় চোপড় গুলো অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। বিয়ে হয়ে এসেছে আজ একমাস হতে চললো, কিন্তু কাপড় এখনো সুটকেসেই রাখা। সকালে শ্রাবণ কড়াভাবে বলেছে তার বউ এর কাপড় যেনো সুটকেস এ না থাকে। এতো বড় আলমারী থাকতে সুটকেস কেনো? চারুর কেনো যেনো খুব ভালো লাগলো কথাটা, সত্যি অনেক বড় আলমারী। তিনটে পাল্লার আলমারীতে চারুর কাপড় ঠিক এটে যাবে। তাই সে সব কাপড় নামিয়েছে, গুছিয়ে গুছিয়ে রাখবে। তিনটে পাল্লার মধ্যে দুটো পাল্লা খোলা। একটা পাল্লা খোলা না, সেটা লক করা। চারু যখন বাকি পাল্লা খুললো তখন তার মাথায় প্রথম প্রশ্ন এলো এই পাল্লাটি বন্ধ কেনো! কিন্তু মূহুর্তেই সেটা ঝেড়ে কাজে মন দিলো। তবে সেটা স্থায়ী হলো না, যখন দুটো পাল্লায় শ্রাবনের কাপড়ের সাথে তার কাপড় আটলো না। চারু খুঁজতে লাগলো অন্য পাল্লার চাবিটি। বহু খোঁজাখুজির পর অবশেষে একটা চাবির গোছা পেয়েও গেলো। আলমারীর পাল্লাটি যেই খুলতে যাবে অমনি ছো মেরে চাবিটা নিয়ে নিলো শ্রাবণ। ঈষৎ বিচলিত কন্ঠে শুধালো,
“কি করছো?”
“আপনি চলে এসেছেন? আসলে শাড়ি গুলো রাখতাম। এই দুপাল্লায় হচ্ছে না”

শ্রাবণের কাজে কিঞ্চিত বিস্মিত হলেও প্রকাশ করলো না চারু। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতেই কথাটা বললো। শ্রাবণ ঠোঁটের উপর ঘাম মুছে নিলো। নজর সরিয়ে নিলো সে। অস্থিরতা তার মাঝে কাজ করছে। টাই খুলতে খুলতে বলল,
“আসলে এখানে অফিসের কিছু কাগজ আছে। এখানে শাড়ি রাখতে পারবে না। এর চেয়ে তুমি বরং আমার পাল্লায় ই ঠেসে রাখো। কালকে একটা ব্যাবস্থা করে দিবো”
“এমন কি আছে ওই পাল্লায়, যে আপনি আমাকে দেখতে দিচ্ছেন না?”
“বললাম তো অফিসের কাগজ”

তীব্র স্বরে কথাটা বললো সে, ফলে খানিকটা কেঁপে উঠলো চারু। এই প্রথম শ্রাবণের শীতল চোখে অগ্নির উপস্থিতি পেলো। তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। কপালের শিরাটা ফুলে উঠেছে। স্বরে ঝাঁঝ এর উপস্থিতি টের পেলো চারু। শ্রাবণের হুট করে রেগে উঠার কারণ টের পেলো না সে। হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। শ্রাবণ পরিস্থিতিতে তটস্থ হতেই নিজেকে সংবরণ করে নিলো। চারুর মুখে আলতো পরশ ঠেকালো, ধীর স্বরে বললো,
“পাল্লাটা আমি খুলি না, অনেক অফিসের ধুলো আবর্জনা আছে ওখানে। যখন সেগুলো ফেলাবার সময় হবে, আমি ফেলে দিবো। তুমি আপাতত এডজাস্ট করে নাও”
“ঠিক আছে”

চারু শান্তভাবে কথাটা বললো। শ্রাবণের কাছ থেকে এরুপ আচারণ সে আসা করে নি। সে তো যেচে আলমারীতে হক জমাতে যায় নি। নেহাৎ শ্রাবণ বলেছিলো তাই। চারু তার বাড়তি কাপড় গুছিয়ে সুটকেসে রেখে দিলো। চারুর থমথমে মুখখানা নজর এড়ালো না শ্রাবণের। নিজের কাজে নিজের ই খারাপ লাগছে। আসলে চারুকে পাল্লাটি খুলতে দেখে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো সে। সেই পাল্লাটি যে মোটেই খুলতে দেওয়া যাবে না চারুলতাকে। তাহলে এতোদিনের তিল তিল করে সাজানো তাশের ঘর এক ঝটকায় ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে। কিন্তু চারুলতার মেঘমেদুর মুখশ্রীও তো মানতে কষ্ট হচ্ছে। তাই সময় নষ্ট করলো না সে। চট করে জড়িয়ে ধরলো সে চারুকে। তার কাঁধে ঠেকালো কপাল। মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
“ক্ষমা করে দাও চারুলতা। আর ভুল হবে না। তোমাকে কষ্ট দেবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আসলে কি বলো তো, আজকে অফিসে খুব ধকল গেছে। তার উপর পাল্লাটা খুললে সব কিছু ধপ করে সব কিছু বেড়িয়ে ঘর নষ্ট হবে। আমি বোধহয় বছর হলো পাল্লা খুলি না। তাই বারণ করেছি”
“আমি তো অধিকার চাই নি, অধিকারটা আপনি দিয়েছেন। সেটাকে এভাবে কেড়ে নিলে কারোর ই ভালো লাগবে না”
“এখানে সব তোমার চারুলতা, পুরোদস্তর আমিটা তোমার এই পাল্লা তো কোন ছাড়। তুমি তো জানো আমার আবর্জনা পছন্দ না। তাই বলেছি। এবার ক্ষমা করে দাও”

লোকটা এতো মায়া নিয়ে কি করে কথা বলে জানা নেই চারুর। তবে মূহুর্তের রাগটা জল হতে সময় নিলো না। মুচকি হেসে বললো,
“আজ ক্ষমা করে দিলাম, আর যেনো না হয়”
“হবে না, এবার কি এককাপ চা পাওয়া যাবে?”
“যাবে। দাঁড়ান”

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো চারু। শ্রাবণ এক অপলক পাল্লাটির দিকে তাকালো। তারপর চাবির গোছা থেকে পাল্লার চাবিটি বের করে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। যেনো তার চারুলতা কখনো জানতে না পারে পাল্লার পেছনে কি আছে। মিনিট পনেরো বাদে চারু ফিরলো চা নিয়ে। চা টা শ্রাবণের হাতে ধরাতেই তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেলো তার। চোখ টলমল করতে লাগলো। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। শ্রাবণ চায়ের কাপ রেখে তাড়াতাড়ি আগলে ধরলো চারুকে। অস্থির কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে চারুলতা?”
“বাবা আর নেই………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here