দূর_দ্বীপবাসিনী,৩৮,৩৯

0
734

#দূর_দ্বীপবাসিনী,৩৮,৩৯
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৩৮তম_পর্ব

শ্রাবণ প্রত্যুত্তরে বিচিত্র হাসি হাসলো। খানিকটা এগিয়ে আসলো সে। চারুর চোখে চোখ রেখে বললো,
“তোমাকে কষ্ট দেবার কথা স্বপ্নেও ভাবি না আমি। তবে তুমি তো একা নও চারুলতা। তোমাকে ঘিরে যে অনেকে। এখন ভেবে দেখো। আমার কাছে থাকবে কি না?”

শ্রাবণের শীতল বাক্যখানা বুঝতে বেশ সময় নিলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো। থমকে গেলো চারু, বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো সে। অবিশ্বাস তার চাহনিতে। এই কি সেই শ্রাবণ! যার কাছে চারুর গুরুত্ব সর্বাধিক। বিষাদের মেঘ আবারো বিস্তৃত হলো হৃদয়ের আকাশে। সাথে হলো বর্ষণ, চিনচিনে ব্যাথা বক্ষস্থলকে জ্বালিয়ে তুলছে। বুকচুরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো। ম্লান কন্ঠে বললো,
“এভাবে জোরপূর্বক আটকে রেখে কি লাভ?”
“প্রাপ্তির প্রশান্তি, তুমি বুঝবে না দূর দ্বীপবাসিনী। সাড়ে তিনটে বছর অক্লান্ত ভালোবাসাকে এক মূহুর্তেই নিজ থেকে আলাদা কি করে করি। বিশ্বাস করো, আমি কারোর কোনো ক্ষতি করবো না। শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না”
“জোর কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?”
“আমার ভালোবাসা দুজনের জন্য যথেষ্ট। আমরা সুখী হবো বিশ্বাস করো। আর তুমি যতই অস্বীকার করো না কেনো তোমার হৃদয়ে আমার বিস্তার। আমাকে ঘিরেই তার প্রত্যাবর্তন। এতো সহজ এই স্নিগ্ধ ভালোবাসাকে অস্বীকার করা?”

চারু একরাশ বিতৃষ্ণার সাথে তাকালো শ্রাবণের দিকে৷ বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“আমার জীবনের সবথেকে বড় অভিশাপটিকেই আশীর্বাদ মনে করেছি আমি। কতটা ভুল বুঝেছি!”
“তুমি সর্বদাই আমাকে ভুল বুঝেছো, চারুলতা। আমার ভালোবাসাটাকে কখনোই বুঝার চেষ্টা করো নি। আচ্ছা, একটাবার মনের কাছে জিজ্ঞেস করো তো! আমি কি সত্যি এতোটা খারাপ! আমার ভালোবাসাটা এতোটাই জঘন্য!”

চারু মুখ ফিরিয়ে নিলো। শ্রাবণ কাতর নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। তারপর চারু ব্যাগটা উঠিয়ে রাখলো। তারপর চারুর মাথায় গভীর চুমু দিয়ে বললো,
“ঘুমিয়ে পড়ো, রাত অনেক হয়েছে”

চারুর কাছে এই স্পর্শটা কেমন এ’সি’ডের ঝলসানো চামড়ার কাতর জ্বলনের ন্যায় মনে হলো। ঘৃণা, ক্রোধে মুখ বিকৃত হয়ে গেলো। শ্রাবণের প্রতি এখন আর ভয় কাজ করছে না, করছে চরম ঘৃণা। মনে মনে একটা আফসোস হলো, তার ভালোবাসার অট্টালিকায় ফাটল ধরেছে। এই ফাটল হয়তো কখনোই জোড়া লাগবে না। এতো ঘৃণার মাঝেও বুকের এক কোনায় শ্রাবণের প্রতি জন্মানো ভালোবাসাটা হাহাকার করতে লাগবো বেঁচে থাকার আকুল অভিলাষে____________

******
সময় বহমান। চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। তপ্ত ধরণী, নীলাম্বরীর কোনে ধূসর মেঘের আনাগোনা। মাঝে মাঝে উত্তাল ঝড়ের কবলে পড়ে শহর। ধুলো উড়িয়ে ক্ষান্ত করে দেয় ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ততা। তবুও যেনো সূর্যের তেজ কমবার নাম নেই। কালো পিচের রাস্তা থেকেও যেনো ভাপ উড়ছে। জানালার ধারে জ্বলন্ত নিকোটিনের দলা আঙ্গুলে চেপে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব। তার চোখ উদাস নয়নে তাকিয়ে আসে গলির মোড়ে। সোনালী বিকেলে একমুঠো শান্তি নেই। মন টা ভিজতে চাইছে, সাথে ধরণীর। এক অকৃত্রিম খরা চলছে। বক্ষস্থলে যেনো হাহাকার৷ কিসের হাহাকার জানা নেই। এই হাহাকার কি তবে চিত্রার! জানা নেই ধ্রুবের। বিগত সপ্তাহ খানিক চিত্রার দর্শন হয় না। মেয়েটা যেনো এই বাড়িতেই নেই। সকালে যাবার সময় ও তাকে পায় না ধ্রুব। আসার পর ও ক্লান্ত চোখ স্যাটেলাইটের মতো ঘুরে সারা ঘর৷ চিত্রাকে পায় না। একই খাটে মেয়েটি ঘুমাতো। অথচ সেদিনের পর থেকে মেয়েটিকে পায় না সে। চিত্রার প্রতি তার অনুভূতি গুলো মোটেই প্রগাঢ় নয়৷ বরং স্বাভাবিকের চেয়েও শীতল। সেই কারণেই চিত্রার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না সে। তাই মেজাজটাও খিটখিটে হচ্ছে। অকারণে কারোর প্রতি আকর্ষিত হবার স্বভাব ধ্রুবের মাঝে নেই। এর মাঝেই মারুফার আগমন ঘটলো। কিঞ্চিত চিন্তত কন্ঠে বললো,
“ধ্রুব, তুই কি ব্যাস্ত”

হাতের সিগারেটটা চেলে ফেলে উত্তর দিলো,
“না মামী, কেনো? কিছু লাগবে?”
“বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে, চিত্রাটা কলেজ থেকে ফিরে নি। চিন্তা হচ্ছে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখবি মেয়েটা কোথায়?”

চিত্রা বাসায় নেই, অথচ স্বামী হিসেবে ধ্রুবের সেটা অজানা। নিজেকে দায়িত্বহীন পুরুষের কাতারে মনে হচ্ছে। ধ্রুব খানিকটা বিচলিত ও হলো। চিত্রা সর্বদা এরুপ আচারণ করে। খামখেয়ালী মেয়েটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। টেবিলের উপর থেকে চাবিটা মুঠোবন্ধি করে বললো,
“চিন্তা করবেন না মামী, আমি দেখছি”

এক মূহুর্ত দেরি না করে, বাইক ছোটালো ধ্রুব। এক অজানা অস্থিরতা বুক জ্বালাচ্ছে। সিগারেট টা খাওয়া কি বেশি হয়ে গেলো। মিনিট পনেরো বাদে যখন কলেজে পৌছালো তখন উদ্ভ্রান্ত নজর খুজতে লাগলো চিত্রাকে। একটা সময় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লো চোখ তখন ই নজরে পড়লো, সাদা সালোয়ার কামিজ পড়া নারী একজন অজানা পুরুষের সাথে খিলখিল করে হাসছে। বইয়ের ব্যাগটা কাঁধে তার। চুলগুলো দু পাশে বেনুনী করে রাখা। সাথের যুবকটিও উৎফুল্লভাবে কথা বলছে। যেনো পৃথিবীর চরম সমস্যার একটির সমাধান সে করে ফেলেছে। চরম ক্রোধে জ্বলে উঠলো ধ্রুবের চোখ। কারণ সাদা কামিজ পরিহিতা নারীটি তার একমাত্র স্ত্রী, তার জন্য ৬০ কিলোমিটার বেগে বাইক চালিয়ে সে কলেজে এসেছে। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা অতি কষ্টকর ঠেকলো। হনহন করে সে ছুটলো তাদের দিকে। শক্ত হাতে চিত্রার কোমল হাতটা নিজের হাতের ভেতরে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চিত্রা চমকালো, ভড়কালো। কিন্তু ধ্রুবের শক্ত মুখশ্রী দেখে কিছু বলার সাহস পেলো না। সাদা একটা টি-শার্ট গায়ে, কালো ট্রাউজার, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাকের উপর ঘাম জমা, চোখ জোড়া রক্তিম। এই ধ্রুবকে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবুও সাহস করে সহপাঠীকে বিদায় জানালো সে। তাকে ধ্রুব আরোও রেগে গেলো। হাতটা ধরে টানতে টানতে বাইকের কাছে নিয়ে এলো তাকে। তীব্র গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“বাইকে উঠ”

চিত্রা ধ্রুবের এমন আচারণে বেকুব বনে গেলো। লোকটি কি কারণে তার উপর চটে আছে। সে তো তার সামনেও আসে নি। নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে সে। ধ্রুব বাইক স্টার্ট দিয়েছে। সে অপেক্ষারত চিত্রার উঠার। একটা সময় অস্থিরভাবে বললো,
“তুই কি উঠবি?”
“চোটপাট দেখাচ্ছো কেনো? কি করেছি আমি?”
“বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে গিয়েছে। আর তুই একটা চ্যাঙ্গরা ছেলের সাথে হিহি হাহা করছিলি। আবার প্রশ্ন করিস, চোটপাট করছি কেনো?”

তীব্র কন্ঠে কথাটা বললো ধ্রুব। চিত্রা কিছুসময় অপলক নজরে চেয়ে রইলো। এর পর শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবতে লেগেছো?”

চিত্রার প্রশ্নটা কঠিন নয়। কিন্তু ধ্রুবকে মূহুর্তেই শান্ত করে দিলো। সত্যি ই তো সে কবে থেকে চিত্রাকে নিয়ে ভাবছে! নিজের অন্তরাত্মার কাছে থেকে উত্তর খুঁজতে যখন ব্যাস্ত, তখন চিত্রা উঠে বসলো বাইকে। ধীর কন্ঠে বললো,
“ভুল প্রশ্ন করেছি, তুমি আমাকে নিয়ে ভাবতে পারো না। তোমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে তো অন্য কেউ। নিশ্চয়ই মা তোমাকে পাঠিয়েছে”

চিত্রা কথাটা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিলো। ধ্রুব ও উত্তর দিতে পারলো না। কিন্তু সে সত্যি ই চিন্তিত ছিলো। ওই চ্যাঙরা যুবকের সাথে চিত্রাকে দেখে এক অকৃত্রিম রাগ হচ্ছিলো। ক্রোধে তার ভেতরটা জ্বলছিলো। কিন্তু কেনো! এই মেয়েটা তো কেউ না তার। হ্যা বউ, তা তো শুধু নামে। কিসের টান তাহলে! বাইক চলছে। টিপ টিপ জলধারার বর্ষণ হচ্ছে ধরণীর বুকে। তপ্ত পিচের রাস্তায় শীতলতা ছেয়ে গেলো। চিত্রা চোখ বুঝে বৃষ্টির ছোয়া নিচ্ছে দু হাত খুলে। ধ্রুবের তপ্ত হৃদয়টা এখনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। তার ও যে বর্ষণ চাই_________

******
চৈত্রের প্রথম বর্ষণ। দু হাত বাঁড়িয়ে সেই বর্ষাকে আলিঙ্গন করছে চারু। তার হৃদয়টা ভঙ্গুর কাঁচের ন্যায় ছড়িয়ে আছে। সেদিনের পর থেকে একটা বদ্ধ খাঁচার পাখির ন্যায় এই বিশাল অট্টালিকায় রয়েছে সে। শ্রাবণ ওই ঘর প্লাস্টার করে দিয়েছে। চাইলেও ঘর থেকে বের হতে পারে না। সর্বদা শ্রাবণের নজরবন্দি থাকতে হয় তার৷ ছটপট করছে সে, কিন্তু চাইলেও এই জাল থেকে মুক্তি নেই। শ্রাবণ যে একজন অপ্রকৃস্থ মানুষ তা খুব ভালো করেই জানে সে। তাই পাগল চ্যাতানো উচিত নয়। শ্রাবণ তাকে অকৃত্রিম ভালোবাসে। সেদিন যখন চারু তার হাতে কামড় দিয়েছিলো, শ্রাবণের রক্তক্ষরণ ও হয়েছে তবুও সে নিশ্চুপ বসে ছিলো। চারু এখনও তার প্রতি রুঢ় আচারণ ই করছে। অথচ সে একটা শব্দও করছে না। হাসিমুখে ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে একটা প্রশ্ন মোটেই চারুর মাথায় আসছে না। যদি শ্রাবণ অপ্রকৃতস্থ ই হয় তবে মোস্তফা সাহেব সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে কিভাবে দেখছে! চারু একবার ভাবলো সে মোস্তফা সাহেবকে প্রশ্ন করবে। কিন্তু হুট করেই তো প্রশ্ন করা যায় না। তাই কিছু চিন্তা করলো সে। নীলাম্বরীর দিকে উদাস চাহনীতে চাইলো সে। মনে মনে বললো,
“এই জাল থেকে মুক্তি পেতে হলে, শ্রাবণের অতীত জানতে হবে। যে কোনো মূল্যেই হোক সেটা”

বলেই চোখ বুজে নিলো। তখনই কোলাহল কানে এলো চারুলতা। মোস্তফা সাহেবের রাশভারী কন্ঠ শোনা গেল, চারু দেরি না করেই ছুটলো নিচে। নিচে যেতেই দেখলো……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৩৯তম_পর্ব

নীলাম্বরীর দিকে উদাস চাহনীতে চাইলো চারু। মনে মনে বললো,
“এই জাল থেকে মুক্তি পেতে হলে, শ্রাবণের অতীত জানতে হবে। যে কোনো মূল্যেই হোক সেটা”

বলেই চোখ বুজে নিলো। তখনই কোলাহল কানে এলো চারুলতা। মোস্তফা সাহেবের রাশভারী কন্ঠ শোনা গেল, চারু দেরি না করেই ছুটলো নিচে। নিচে যেতেই দেখলো গোলটা মোস্তফা সাহেবের ঘরে বেধেছে। শ্রাবণ ব্যাতীত সকলেই সেখানে উপস্থিত। সদ্য আসা কাজের মেয়ে লতিকা অপরাধীর ন্যায় মেঝে থেকে কাঁচ পরিষ্কার করছে৷ এবং মোস্তফা সাহেব আহত বাঘের ন্যায় গরগর করছেন। শান্তা বেগম উপায়ন্তর না পেয়ে থাকে থামতে বলছেন,
“ভাইজান, নতুন তো ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিন”
“আমি হাজারবার বারণ করেছি। আমার ঘরে যেনো কেউ প্রবেশ না করে। দেখলি তো কি ঘটলো। ইশরার ছবিটা ভেঙ্গে ফেললো”
“একটা ছবিই তো ভাইজান”

শান্তা বেগমের কথাটা কর্ণগোচর হতেই কড়া তীর্যক চাহনীতে তাকালেন মোস্তফা সাহেব। তার কড়া অগ্নিদৃষ্টিতে শান্তা বেগম চুপসে গেলেন। দ্বিতীয় বার কোনো কথা বললেন না তিনি। মোস্তফা সাহেব থামলেন না। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“ভুতের মতো বসে আছো কেনো, যাও এখান থেকে। আমার তোদের একজনের চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না”

চারু বেশ অবাক হলো আজকের ঘটনায়। ইশরা বেগমের ছবি কেন্দ্রিক এতো বড় ঘটনা ঘটলো অথচ এই বাড়িতে ইশরা বেগমের কোনো কথাই হয় না। খেয়াল করে দেখলে সারা বাড়িতে কেবল তিনটে ছবি তার। দুটো শ্রাবণের ঘরে এবং একটি মোস্তফা সাহেবের ঘরে। এ ব্যতীত কোনো ছবি নেই। ঘরের কর্তী হিসেবে তার কথায় ঘর মুখোরিত হবার কথা। ঘর থেকে এক এক করে সকলে বের হতে লাগলো। চারু পেছনে ফিরে একবার মোস্তফা কামালের মুখপানে চাইলো। অদ্ভুত বিষাদের রেখা লক্ষ্য করলো সে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কোনো লক্ষণ তার ভেতরে এ বাড়িতে আসার পর থেকে পরিলক্ষিত হয় নি চারুর কাছে। অথচ আজ তার একটা ছবি ভাঙ্গায় এতোটা বড় কান্ড, ব্যাপারটা তাকে ভাবতে বাধ্য করছে।

********

পশ্চিমে রক্তিম আভা জড়ো হয়েছে, অস্তগামী তেজস্বী সূর্য। ব্যস্ত দিনের অন্ত হচ্ছে, রজনীর যাত্রা শুরু। মাগরীবের আজান কানে আসছে। পাড়ার মসজিদের মোয়াজ্জেন অক্লান্ত ভাবে একই সময়ে আজান দিয়ে নিজের কাজ অব্যাহত রাখছেন। এখনো দিনের শেষ আলোটি কাটে নি। আলো আঁধার মিলানো মায়াবী প্রকৃতি। চিত্রা মাথায় ওড়নাখানা টেনে রক্তিম নীলাম্বরীর দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল জীবনটা বেরঙ লাগছে। বড্ড এলোমেলো সবকিছু। এই এলোমেলো জীবনের অন্যতম কারণটি হলো ধ্রুব। ধ্রুবের আচারণ বড্ড অদ্ভুত। প্রথমত নিজেই চিত্রাকে নানা ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যেনো তার জীবনে হস্তক্ষেপ না করা হয়। যখন চিত্রা তার জীবন থেকে সম্পূর্ণ নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে তখন স্বয়ং তার জীবনে হস্তক্ষেপ করছে। তাও বিশ্রীভাবে। গতকালের ঘটনাটির পর ধ্রুব নিজ থেকে বলেছে যেনো তার ঘরেই চিত্রা থাকে। চিত্রা অবাক কন্ঠে যখন জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো? এক ঘরে থাকতে হবে কেনো?”

তখন কাঠ কাঠ গলায় ধ্রুব উত্তর দিলো,
“আমি চাই না মামীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে”

চিত্রা অবাক হলো। আরোও অবাক হলো যখন মানুষটা নিজ ইচ্ছাতে তাকে কলেজ নিয়ে যাচ্ছে আবার নিজের সময় মতো নিয়ে আসছে। এই পরিবর্তনের কারণ জানে না চিত্রা। তবুও মরীচিকার পেছনে ছুটতে চাইছে না সে। হৃদয়ে আশা বেধে সেই আশাভঙ্গের কষ্টটা সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার, সেই সাহসটুকুও নেই। এর মাঝেই মারুফার তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে আসে চিত্রা।
“চিত্রা, তাড়াতাড়ি নিচে আয়”

চিত্রার ভাবনার জগতে ফাটল ধরলো। ছুটে গেলো নিচে। নিচে যেতেই প্রচন্ড অবাক হলো সে। কাওরান বাজার থাকার সাব ইন্সপেক্টর এসেছে তাদের বাসায়। পুলিশের বাসায় আসার ব্যাপারটা খটকা লাগলো তার। মিহি কন্ঠে সালাম দিলো সে। ভদ্রলোক বললো,
“মনীরুল ইসলামের বাসা তো এটাই তাই না? আপনি”
“আমি তার মেয়ে, চিত্রা”

লোকটির হাসি বিস্তৃতি পেলো। ধ্রুব ও বাড়ি নেই। এই সময়ে লোকটির আগমণে খানিকটা বিচলিত হলো সে। মারুফা এবং জাহানারা এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক বিনয়ী স্বরে বললো,
“আসলে মনীরুল সাহেবের খু/নে/র মামলার জন্য এসেছি”
“কিহ!”
“জ্বী, আপনার বাবাকে খু/ন করা হয়েছে। যদিও প্রথমে দূর্ঘটনা মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এখন তা স্পষ্ট সেটা খুন। আচ্ছা ধ্রুব সাহেব আছেন কি! মানে উনার ভাগ্নে, আসলে ধ্রুব সাহেব ই আমাদের এই মামলার তদন্তের কথা বলেন। তার ধারণাছিলো এই দূর্ঘটনা, দূর্ঘটনা নয়”
“আপনি কি একটু খুলে বলবেন, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না৷ সবকিছু এলোমেলো লাগছে”

সাব ইন্সপেক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর সে বলা শুরু করলো,
“দেড় মাস পূর্বে, রাত চারটার দিকে আপনার বাবার লাশ পাওয়া যায় মেইন রোডের কাছে। টহল পুলিশ সেই লাশ পায়, তারা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তাকে মৃ/ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ময়নাতদন্তে মনীর সাহেবের পেটে এলকোহল পাওয়া যায়। তাই আমরা নিশ্চিত হই এটা মাতলামির কারণে ঘটিত একটা দূর্ঘটনা। তবে ধ্রুব সাহেবের কঠিন বিশ্বাস ছিলো এটা দূর্ঘটনা নয়। এবং সেটাই সত্যি বের হলো। এটা দূর্ঘটনা নয়। ওখানে একটা দোকান ছিলো, দোকানের বাহিরে লাগানো সিসিটিভি টি প্রায় রাস্তাই কভার করে। আমরা সেই ফুটেজ পেয়েছি। আপনার বাবা রাস্তার ফুটপাত দিয়েই চলছিলো। হুট করেই একটা গাড়ি তাকে পিসে চলে যায়। একবার না দুবার। বোঝায় যাচ্ছে খু/নের মতলব ছিলো তাদের। গাড়িটির প্লেট থেকে গাড়ির হদিস পাওয়া গেছে। কিন্তু গাড়িটি চোরাই পথে বেঁচে দেওয়া হয়েছে। এই খবর টি দিতেই আসা। আমরা হোপফুল, খুব তাড়াতাড়ি চালক ধরা পড়বে”

চিত্রা স্তব্ধ, তার বাবা হয়তো পৃথিবীর জঘন্য মানুষের কাতারে পড়ে। কিন্তু লোকটিকে কেউ খু/ন করতে পারে কখনোই ভাবে নি সে। সে পাথরের মিতো বসে রইলো। মারুফা এবং জাহানারাও সব শুনলো। মারুফার চোখ ভিজে আসছে বারবার। আকস্মিক খবরটি তিনজনকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরের মনোবল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কে এই অজানা শত্রু_______

চা হাতে মোস্তফা কামালের ঘরে কড়া নাড়লো চারু। মোস্তফা কামাল তখন আইনের মোটা বই এ কিছু খুঁজতে ব্যাস্ত। কড়া নাড়ার শব্দে তিনি চশমার ফাঁকে চোখ তুলে তাকালেন। চারু জড়োসড়ো হয়ে বললো,
“বাবা আসবো?”
“একি তুমি? লতিকা কোথায়?”

চশমা খুলতে খুলতে মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। চারু স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“ও ভয় পেয়েছে, আসলে নতুন তো। তাই আমি ই চা নিয়ে এলাম”
“আচ্ছা, রেখে দাও”

চারু চায়ের কাপটা রেখে চলে যেতে নিলেও থেমে গেলো। কিছুটা জড়তা নিয়ে বললো,
“বাবা, একটা প্রশ্ন করবো?”
“কি?”
“এই বাড়িতে মায়ের কথা বলা নিষেধ কেনো? কাল যা ঘটেছে তাতে আমি নিশ্চিত আপনি মাকে খুব ভালোবাসেন। তাহলে কেউ কেনো মায়ের কথা বলতে চায় না?”

চারুর প্রশ্নে চমকে উঠেন মোস্তফা কামাল। অবাক চোখে থাকায় তার দিকে। চারুর চোখে মুখে হাজার প্রশ্নের আভাস পেলো সে। বইটা বন্ধ করতে করতে বললেন,
“অতীত নিয়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের নয় চারু, তাই এই বাড়িতে কেউ অতীট ঘাটায় না”

চারু আর কথা বাড়ালো না। ম্লান হেসে বেড়িয়ে গেল। মোস্তফা কামাল এবং শ্রাবণ উভয়ই ভয়ংকর রহস্যময় মানুষ। এদের রহস্য ধরতে পারা খুব জটিল। তবুও হার মানবে না চারু। বন্দী জীবন কারোরই সহনীয় নয়। চারুর কাছেও এই জীবনটা অসহনীয়। যেখানে প্রতিটি সময় একটা ভয়ের সম্মুখীন হতে হয় এমন জীবনে সে মোটেই থাকতে চায় না। চারু ঘরে যেতেই শ্রাবণের মুখোমুখি হলো সে। যে হৃদয়জোড়া একটা সময় উষ্ণ ছিলো আজ তা শীতল। চারু একপলক শ্রাবণের দিকে তাকালো। পরমূহুর্তেই তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই শ্রাবণ তার হাত টেনে ধরলো। চারু চমকালো শ্রাবণের কাজে। কিছু বলার আগেই শ্রাবণ অস্থির ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
“তুমি কি ভুলে যাচ্ছো, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি!”
“হাত ছাড়ুন”
“আমার স্পর্শেও ঘৃণা হচ্ছে তোমার?”
“হচ্ছে, একটা প্রতারকের স্পর্শে যেমন অনুভূতি হবার কথা সেটাই হচ্ছে”

শ্রাবণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। অসহায়ত্ব তার চোখে ভেসে উঠলো৷ চারুর এরুপ আচারণ যেনো সহ্য হচ্ছে না তার। শ্রাবণ ছেড়ে দিলো চারুকে। তারপর সজোরে লাথি দিলো চেয়ারটিতে। নির্জীব চেয়ারটি মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো মেঝেতে। চারু হাত দিয়ে নিজের চিৎকার আটকালো। শ্রাবণের শরীর কাঁপছে। সমস্ত রাগ যেনো চেয়ারটির উপর ই দেখালো সে। চারু মূর্তির মতো দেখলো সবকিছু। এই ঘটনার মাঝে তার খেয়াল ও নেই তার ফোন বাজছে। যখন ফোনের রিংটোন তীব্র হলো চারু খানিকটা নড়ে চড়ে উঠলো। ও বাড়ির ফোন। কন্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ফোনটি ধরলো চারু। তখন ই চিত্রার ক্রন্দনরত কন্ঠ কানে এলো,
“বুবু, বাবাকে খু/ন করা হয়েছে”

কথাটা বুঝতে সময় লাগলো চারুর। কিছুক্ষণ চুপ রইলো, তারপর তার চোখ চলে গেলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ তখন বিছানায় বসে নিজের রাগ নিবারণে ব্যাস্ত। চিত্রা বলতে লাগলো,
“বুবু কি শুনছিস?”

চারু উত্তর দিলো না…………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here