দূর_দ্বীপবাসিনী #অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)

1
3880

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)

স্বপ্নটা দেখতেই লাফিয়ে উঠলো চারু। মনটা কু ডাকছে। কপাল জুড়ে ঘামের কনা, গলা শুকিয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে পানি নিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করলো সে। রিসিভ করতেই একটা পুরুষালী কন্ঠ শুনতে পেলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“হ্যালো, আপনি কি মিস্টার জায়ান শাহরিয়ারের স্ত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা বলছেন”
“জ্বী বলুন”
“জায়ান শাহরিয়ার শ্রাবণ আ’ত্ম’হ’ত্যা করার চেষ্টা করেছেন, আমরা তাকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি”

লোকটার কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঢুকতে সময় নিলো। কিছুক্ষণ মোবাইলটা ধরে মূর্তির মতো বসে রইলো সে। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এপাশ থেকে সারা না পেয়ে অপাশের ব্যাস্ত লোকটি আবারো বলে উঠলো,
“হ্যালো, ম্যাডাম শুনতে পাচ্ছেন?”
“হ্যা”

হুশ ফিরলো চারুর। স্বম্বিত ফিরতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“আ/ত্ন/হ/ত্যা মানে! কি হয়েছিলো?”
“আসলে আজকে উনার কেসের শুনানী। উনার শরীরটাও ভালো ছিলো না। কন্সটেবল পলাশ তাই তাকে সেল থেকে বাহিরে আনেন, আমরা কোর্টের দিকে রওনা দিতাম। শ্রাবণ সাহেব সকলকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। উনার হাতে হাতকড়া লাগানো স্বত্তেও উনি ছাঁদের দিকে ছোটেন। তার পেছন পেছন পুলিশ কন্সটেবল এবং অফিসার ও ছুটেন। যখন তারা ছাঁদে পৌছায়, দেখতে পায় ছাঁদের রেলিং এ দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ সাহেব৷ অফিসাররা কাছে যেতেই সেখান থেকে লাফ দেন তিনি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। জানা নেই বাঁচবেন কি না!”

লোকটির শেষ কথাটা কর্ণপাত হতেই বুকটা ধক করে উঠলো চারু। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো সে। মনে হলো কেউ যেনো কানে গরম লোহা ঢেলে দিয়েছে৷ অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে বক্ষস্থলে। চোখ ভিজে এলো অজান্তেই। কষ্টগুলো বেসামাল হয়ে উঠেছে। দুঃস্বপ্নটা কি সত্যি হয়ে যাবে। তার পা’গ’ল প্রেমিকটা কি হারিয়ে যাবে। আজ সত্যি অনুভূত হচ্ছে লোকটার প্রতি কতটা তার অনুভূতির বিস্তার। পুরো পৃথিবীটা মূহুর্তেই অন্ধকার লাগছে। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার অর্থ নেই। লোকটি আবারোও সাড়া না পেয়ে ওপাশ থেকে বলতে লাগলো,
“ম্যাডাম কি আছেন? ম্যাডাম”
“আসছি”

কাঁপা স্বরে কথাটা বললো চারু। তার ভেতর উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছে। বিশ্রী ভয় মনকে কাবু করছে। এই প্রথম ভয় পাচ্ছে শ্রাবণকে হারাবার!

*****

হাসপাতালের করিডোরে বসে রয়েছেন মোস্তফা কামাল। সব তার প্লান মাফিক ই হচ্ছিলো। আজ ছাড়া পেয়ে যেতো তার ছেলেটা। কিন্তু ছেলেটাও মায়ের মতো ভুল করে বসলো। সে তো বলেছিলো,
“আমি সব ঠিক করে দিবো। তুমি চিন্তা করো না”

ছেলেটা স্মিত হেসে মাথা দুলিয়েছিলো। অথচ কি করে বসলো। অভিমানী, দাম্ভিক মোস্তফা কামাল সোনালী বর্ডারের চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন। ইশরা মা’রা যাবার পর ও এতোটা কষ্ট হয় নি। কারণ তখন বাঁচার একটা সম্বল ছিলো। আর ইশরাকে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই হতো। কিন্তু আজ নিজেকে সর্বাদিক অসহায় লাগছে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে, অপারেশন চলছে তার ছেলের। তৃতীয় তালা থেকে ঝাপ দিয়েছে। মাথার পেছনটা থেতলে গেছে। রক্তব্যাংক থেকে রক্ত আনা হচ্ছে। কতঘন্টা অপারেশন চলবে জানা নেই। নিদারুণ ব্যাথা হচ্ছে, বিশ্রী বিষাক্ত লাগছে সব কিছু। মোস্তফা কামালকে কখনো এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে নি শান্তা। নিজের শক্ত ভাইজানকে এভাবে দেখতে তার ও ভালো লাগছে না। ঠিক সেই সময় উপস্থিত হয় চারু। ধ্রুব এবং চিত্রাও এসেছে সাথে। অস্থির কন্ঠে চারু জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ কোথায়”
“অপারেশন চলছে”

নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয় মোস্তফা কামাল। তার নত মস্তক দেখে যাচ্ছে মেঝে। একটু পর ই কোর্টে যেতে হবে। যদিও কথা বলা হচ্ছে ডেট পেছানোর। দেখা যাক কি হয়! চারু অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে রইলো অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে। মূহুর্তেই চারমাসের লোকটির সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো ভাসতে লাগলো। আজ এই পরিস্থিতিটা তো তার জন্য ই। সব কিছুই তার জন্য। মূর্তির মতো বসে রইলো সে। তার বিশ্বাস মানুষটার কিচ্ছু হবে না, যেখানে তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে যাচ্ছে সেখানে কিভাবে লোকটা হারিয়ে যেতে পারে! চিত্রা এবং ধ্রুব এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুবের নিজেকেই অপরাধী লাগছে। সে তো চেয়েছিলো চারুকে একটা স্বাভাবিক জীবন দিতে। তাই তো এতোগুলো মাস শ্রাবণের পেছনে লেগে ছিলো। শ্রাবণের সব গোপন তথ্য বের করেছে। কিন্তু শ্রাবণের কৃতকর্মের কোনো প্রমাণ নেই। কারণ সব কাজ এতো নিখুঁত করে সে যে কোনো প্রমাণ রাখে নি। তাই তো তাকে ফাঁসাবার ছক কষে ধ্রুব। ইন্সপেক্টর ফররুখ এর সাথে হাত মেলায়। ফররুখের সর্বদাই মোস্তফা কামালের উপর একটা ক্ষোভ ছিলো। তাই এই কেসটা সাজাতে কষ্ট হয় নি। আর চারুর সাক্ষীর পর প্রমাণের অবকাশ ও ছিলো না। তবে আজ নিজেকে খুব ই হীন মানুষ মনে হচ্ছে। কি দরকার ছিলো এমন কিছু করার! অন্তত আজ চারুর বিষাদে আচ্ছন্ন মুখশ্রী তো দেখতে হতো না। ধ্রুবকে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রা তার বাহুতে আলতো করে স্পর্শ করলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“শ্রাবণ ভাই এর জন্য চিন্তা করছো? কিছু হবে না, দেখো!”
“নিজেকে অপরাধী লাগছে চিত্রা। এত্তোরাগ হচ্ছে। এই কান্ড টা না করলেও হতো!”
“এখন আফসোস করে কি লাভ বলো! আমাদের কাজের ফল তো ভোগ করতেই হয়! আমি জানি আমার বাবাকে কে বা কারা খু/ন করেছে। তবে কেনো যেনো মনে হচ্ছে শ্রাবণ ভাই নির্দোষ। যে মানুষটা মাথায় বুলিয়ে শান্তনা দিতে পারে, আর যাই হোক খু/ন সে করবে না”
“শ্রাবণের মতো মানুষ অনেক অভিনয় করতে পারে!”
“কিন্তু বুবুর প্রতি ভালোবাসাটা তো অভিনয় নয়! ধ্রুব ভাই, শ্রাবণ ভাইকে অপছন্দের কারণটা আমার জানা। কারণ তোমার ধারণ সে বুবুকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছে। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, বুবু কি সত্যি তোমার ছিলো? বুবুর বিয়ের উপর ও তুমি হাল ছাড়ো নি। লাভ কি হলো বলো! অজান্তেই কষ্ট দিচ্ছো চারুকে। এটাকে ভালোবাসা বলে না ধ্রুব ভাই।”

চিত্রার কথার প্রত্যুত্তরে মৌন থাকলো ধ্রুব। সত্যি তো বলেছে সে। নিজের স্বার্থপরতার জন্য তার চারু কষ্ট পাচ্ছে। সে শুধু চারু দোষী নয়, বরং সে চিত্রাকেও কষ্ট দিচ্ছে। মেয়েটা মুখ বুজে সহ্য করেছে। শ্রাবণের মতো যদি সেও হারিয়ে যায় তখন! হুট করে বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। চিত্রার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি চারুকে ভালোবাসতাম ঠিক ই, কিন্তু আমি শুধু শুভাকাঙ্ক্ষী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভালো চাওয়াটাই যে ওর জীবনের বিষাদের কারণ হবে সেটা তো জানতাম না”
“বাসতে? এখন ভালোবাসো না?”
“উহু, একটা চঞ্চল মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে গেছি। মেয়েটির চঞ্চলতায় কঠিন মনটা কখন গলতে শুরু করলো জানা নেই। আজকাল সেই সারাক্ষণ তার কথাই ভাবি”
“ও”

চিত্রার বিষন্ন কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
“জিজ্ঞেস করলি না, মেয়েটা কে?”
“না, জানি আর যেই হোক সে আমি নই। অহেতুক শুনে কষ্ট পাবো। থাক না”

ধ্রুব আর কথা বললো না। কিন্তু চিত্রার হাত টাও ছাড়লো না। মেয়েটির অভিমান হয়েছে, বুঝতে বাকি রইলো না তার। রাগ ভাঙ্গানো সহজ, কিন্তু অভিমান ভাঙ্গানো বড্ড কঠিন। তবে এবার হাত ছাড়বে না ধ্রুব। চিত্রাকে হারাবে না সে। কারণ ভালোবাসার বর্ষণ সর্বদা হয় না, যখন হয় তখন ই সেই বৃষ্টিতে মন ভেজাতে হয়______

ঘন্টা ছয়েক বাদে অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হলেন। তার মুখের ভাব দেখে খুব একটা সুবিধার লাগলো না। থমথমে কন্ঠে বললো,
“রোগীর আত্নীয় কারা আছেন?”
“জ্বী আমরা!”

এগিয়ে আসলেন মোস্তফা কামাল। চারুর বিষন্ন মুখশ্রী ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রতীক্ষায় রয়েছে কোনো ভালো সংবাদের। কিন্তু ডাক্তারের কথাটা শুনে বিষন্ন হৃদয় বিষাক্ত হয়ে উঠলো। ডাক্তার থমথমে কন্ঠে বললো,
“আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। বাকি টুকু আল্লাহ তা’আলা জানেন। আমরা তো মানুষ, আমাদের ও একটা সীমা আছে। তবে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ব্রেইনে আঘাত পেয়েছে। ইন্টারনাল ড্যামেজ হয়েছে। বাকি টুকু জ্ঞান ফিরলে বলতে পারবো”

চারু দপ করে বসে পড়লো। তার পা জোড়া অসার হয়ে আসছে। এমন টা তো হবার ছিলো না। বুকের ভেতর যন্ত্রণা তীব্র হলো। মনে হচ্ছে এতো ভোতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। চিত্রা ছুটে এলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“বুবু, এই সময়ে তোর নিজের জন্য নয়। যে আসছে তার কথাটাও ভাবতে হবে৷ ভরসা রাখ। উপরে যিনি আছেন, তিনি তো পরম করুনাময়। ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে”

চারু উত্তর দিলো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সন্তপর্ণে। সে তো সাহসী কখনোই ছিলো না, ছিলো তো একটা ভীতু নারী। যাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রেখেছিলো শ্রাবণ। কি করে সইবে এতো কিছু, তবুও নিজের মাঝে বেড়ে উঠা নিস্পাপ মানুষটির কথা ভাবতেই কিছুটা নড়ে চড়ে উঠে সে। শ্রাবণ তো বেঁচে আছে! এইবার না হয় ভালোবাসার পরীক্ষাটা তার দূর দ্বীপবাসিনী ই দিলো_________

******

কোর্টে সবাই উপস্থিত হয়েছে। শুনানির তারিখ পেছানো হয়েছে এক সপ্তাহ। বেশ কয়েদি হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু কেস তো থেমে নেই। রাফিন দুজনের পক্ষে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ শুনানি, নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ না করলে আজকে শাস্তি ঘোষণা হবে। শ্রাবণের জ্ঞান এখনো ফিরে নি। সে কোমাতে আছে। ব্রেইনের ইন্টারনাল ড্যামেজ হয়েছে প্রচুর। তাই ডাক্তার কিছুই বলতে পারছেন না। চারু আজকাল হাসপাতালেই থাকছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকে আইসিউ এর বাহিরে। বড় হাসপাতালে আইসিউ তে কাউকে রাখে না। শুধু দুবার দেখা করার সুযোগ হয়। সে সেই সময়েই দেখা করে। ডাক্তার কেবিনে শিফট করতে পারছেন না, বলা তো যায় না কি হয়!

জজ আসলে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। আজ প্রতিপক্ষের উকিলকে সুযোগ দেয় নি শাহাদাত। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য রাখলো সবার প্রথমে,
“মাননীয় আদালতে একটা ভিডিও ফুটেজ চালানোর অনুমতি চাচ্ছি আমি। এটা একটা প্রমাণের অংশ রুপে চালাতে দেবার অনুরোধ রইলো”
“অনুমতি দেওয়া হলো”

ভিডিও চালানো হলো। ভিডিও টি চারুর পিতা আহসান সাহবের মৃ/ত্যু/র সময়ের ভিডিও। একটা জায়গায় এসে সেটি পজ করা হয়। শাহাদাত বলতে শুরু করে,
“মাননীয় আদালতে আমার আর্জি শুধু গাড়ির নাম্বারপ্লেটের দিকে একটু নজর দেওয়া হোক। ট্রাকের নাম্বার প্লেট এবং মনীরুল সাহবকে যে গাড়ি চাপা দেয় তার নাম্বার প্লেট হুবহু এক। কিন্তু এই ট্রাক রাকিব সাহেবের নয়। এই ট্রাকটিও রাকিব সাহবের গাড়ির মতো চুরি করা হয়। তারপর রাকিব সাহেবের গাড়ির নাম্বার প্লেট তাতে লাগানো হয়। এবার আমার ভাষ্য ক্লিয়ার করতে দুজনকে কাঠগড়ায় ডাকতে চাই ধর্মাবতার”
“অনুমতি দেওয়া হলো”

ইন্সপেক্টর সামিন দুটো মানুষকে হাতকড়া লাগানো অবস্থাতেই কাঠগড়ায় তুলে। একজনের মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, হলদে দাঁত, মুখে কাটা দাগ। অন্যজনের চুল এলোমেলো, রক্তিম চোখ, মুখভর্তি দাঁড়ি। শাহাদাত বলতে শুরু করে,
“ইউর অনার, এই দুজন ই সেদিন গাড়িটি চালাচ্ছিলো। শুধু ট্রাকটি নয়, মনীরুল সাহেবের গাড়িটি ও এই দুজন ই চালাচ্ছিলো। মনীরুল সাহেব পঞ্চাশ হজ টাকার বিনিময়ে এদের দুজন কে ঠিক করেন আহসান সাহেব কে মা/রা/র জন্য। ভাই মারা গেলে সকল সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়ার লোভে নিজের ভাইকে খু/ন করতেও পিচ পা হন নি তিনি। খু/ন টিকে দূর্ঘটনার রুপ দিতেই তিনি এই নাটক সাজান। খু/নে/র ঠিক পূর্বের এদের মোবাইলের বিকাশে দশহাজার টাকা পাঠানো হয়। এই যে সেই ডকুমেন্ট। এবং কথা থাকে খু/নে/র পরে চল্লিশ হাজার টাকা ক্যাশ দেওয়া হবে। এদের নাম আফজাল এবং রহমত। এদের কাছ থেকে পাওয়া ফোন নাম্বারের কল রেকর্ডিং থেকে এই ইনফোরমেশন পাওয়া যায়। আহসান সাহেব সেদিন ফুটপাত থেকেই চলছিলেন। অথচ এরা রুল ব্রেক করে জোরে গাড়ি চালায়। ফলে দূর্ঘটনায় জায়গায় মৃ/ত্যু হয় আহসান সাহেবের”

কোর্টে থমথমে পরিবেশ। চিত্রা এবং ধ্রুবের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলো। এই ঘটনা অজানা ছিলো তাদের। কিন্তু চারু স্বাভাবিক, মোস্তফা কামাল গাড়ির মধ্যে এই ভিডিওটাই দেখিয়ে ছিলো। এর মাঝেই প্রতিপক্ষের উকিল চেঁচিয়ে বলে,
“অবজেকশন, এর সাথে মনীরুল সাহেবের খু/নে/র কি সম্পর্ক?”
“অবজেকশন অভাররুলড”
“আছে ইউর অনার, একটু ধৈর্য্য ধরলে আমি সম্পর্কটি বুঝিয়ে দিচ্ছি। খু/নে/র পর রহমত চিটাগাং হাইওয়ে তে ট্রাক ছেড়ে পালায়। ওরা নাম্বারপ্লেট খুলে নেয় যেনো কেউ না বুঝে। অপরদিকে, ক্রমাগত ফোন দেয় তারা মনীরুল সাহেবকে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেন না। যখন মনীরুল সাহেব ফোন ধরেন তখন তিনি নেশায় বুদ। এরা বাকি টাকা চাইলে ইচ্ছে মতো গালমন্দ করেন। এবং টাকা দিতে অস্বীকার করে। ওরা ব্লাক মেইন করলেও সেটায় কাজ হয় না। একেই পলাতক, পাওয়া টাকা না পেয়ে রহমত এবং আফজালের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তখন ই এই খু/নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাগের বসে গাড়ি চালিয়ে দেয় তারা মনীরুল সাহেবের উপর। আমি অডিও রেকর্ডিং পেশ করতে চাই। এবং কিছু ভিডিও দেখাতে চাই, এই ভিডিওটা রাকিব সাহেবের গ্যারেজের সামনের সিসিটিভির। যা ইন্সপেক্টর ফররুখকে দেখানোর পর ও তিনি বিশ্বাস করেন নি”

কোর্টে কিছু ভিডিও চালানো হয় যা থেকে প্রমাণিত আফজাল এবং রহমত ই রাতে রাকিবের গাড়ি চুরি করে। এবং কিছু কল রেকর্ডিং ও শোনানো হয়। যেখানে তাদের সাথে মনীরুল সাহেবের সম্পূর্ণ কথোপকথন ছিলো। শাহাদাত আবারো বলে,
“আমার মক্কেল জানতেন তার শ্বশুরকে কে খু/ন করেছে। সেকারণেই তিনি রাগের বশে সেই কথাটা বলেন। রাকিব সাহেবের খু/নের সময় উপস্থিতি সম্পূর্ণ কাকতালীয়। রাকিব সাহেব নিজের ফুপু আঞ্জুমান রোজীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আঞ্জুমান রোজীর বাসা খু/নের স্থল থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। তাই আমার মক্কেল সম্পূর্ণ নির্দোষ। ইন্সপেক্টর সামিন সাহেবের কাছে আহসান সাহেবের খুনটি ভীষণ কাকতালীয় লেগেছিলো। ফলে তিনি ইনভেস্টিগেশন করেন। ট্রাকের খোঁজটা তিনিই করেন। এবং ট্রাক চুরি থেকেই এই দুজনের খোঁজ পান। তাদের উত্তম মধ্যম করার পর সত্যি স্পষ্ট হয়। আফজাল এবং রহমত টাকার অভাবে আবারো যখন গাড়ি চুরি করতে যায় তখন তারা ধরা পড়ে। আমার মক্কেলেরা নিরপরাধ। তাদের ফাসানো হয়েছে ইউর অনার”

জজ যখন আফজাল এবং রহমতকে জিজ্ঞেস করে,
“তোমরাই কি খু/ন করেছো”
“জে স্যার, রাগে মাথা ঠিক ছিলো না। বজ্জাত লোক, কয় কি না চল্লিশ হাজার টাকা দেবে না। যা খুশি কর। তাই ভাবলাম, এক খু/নে যা সাজা, দুই খু/নে একই সাজা। মা/ই/রে দিলাম তাই”

আফজাল এবং রহমতের বক্তব্যের পর কোর্টে আর প্রশ্নোত্তরের পর্যায় থাকে না। জজ তার সিদ্ধান্ত শোনায়। রাকিব এবং শ্রাবণকে সসম্মানে এই কেস থেকে মুক্তি দেয়_________

******

গোধুলীর প্রহর, শ্রাবণের হাত ধরে বসে আছে চারু। শ্রাবণের মাথা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া, পাও একই অবস্থা। মেশিন চলছে। কিন্তু মানুষটির জ্ঞান ফিরে নি। ডাক্তার এম.আর.আই করিয়েছে। ব্রেইনে মারাত্নক আঘাত পাবার কারণে তার পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। সে সব শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু উত্তর দিতে পারছে না। রেসপন্স করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এই কোমা থেকে কবে ফিরবে জানা নেই। তবুও প্রতিদিন আসে চারু, অনেক কথা বলে। আজ ও এসেছে, হাত ধরে আছে দীর্ঘসময়। মৃদু স্বরে বললো,
“জানেন, আজ সকালে না বমি হয়েছিলো। শরীরটা এতো খারাপ লাগছিলো। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। কোনো মতে একটা রুটি খেয়েছি। চিত্রাটা এতো জিদ্দি হয়েছে। জোর করে দুধ খাওয়ায়। ফলিক এসিড পাবে নাকি বাচ্চা। আপনি তো জানেন দুধের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। তবুও খাই, আপাদের বাবুর জন্য। আচ্ছা আপনার ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে না। বাবুর সাথে কথা বলতে, তার সাথে কথা বলতে! জানেন গতদিন যখন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, ডাক্তার আল্ট্রাসোনো করিয়েছিলেন। এখন বাবুর নয় সপ্তাহ চলে। অথচ আমি টের ও পাই নি। আসলে আপনাকে ঘৃণা করতে এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে আপনার ভালোবাসার কথাটাই ভুলতে বসেছি। শ্রাবণ আমি না আর পারছি না। আপনি ব্যাতীত জীবন কতটা শূন্য আপনার ধারণা নেই। জানেন, আপনার মুখে চারুলতা শুনার জন্য হৃদয় অস্থির হয়ে থাকে। রাতে যখন ঘুমাই মনে কতদিন আপনার বুকে মাথা রাখা হয় না। শ্রাবণ আমি সত্যি পারছি না। যে পাগলামিকে ভয় পেতাম, আজ আমি সেই পাগলামিতে আসক্ত হয়ে গেছি। অজান্তেই নেশার মতো মিশে গেছে আপনার সেই দমবন্ধ করা ভালোবাসা। প্লিজ শ্রাবণ, ফিরে আসুন। আমার জন্য নয়, আমাদের ভালোবাসার জন্য”

তখন ই মেশিন শব্দ করতে থাকলো, ক্রমান্বয়ে হার্টবিট কমতে লাগলো শ্রাবণের। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ও কমতে লাগলো। অস্থির চারু নার্সকে ডাকলো। নার্স ছুটে এলো, ডাক্তার ছুটে এলো। তারা তাদের চেষ্টা করতে লাগলো। ইলেক্ট্রিক শক দিলো শ্রাবণকে। একটা সময় যন্ত্রটা বন্ধ হয়ে গেলো। হার্টবিটের রেখাটা সমান হয়ে গেলো। চারু অশ্রুশিক্ত চোখে দেখতে লাগলো, মনে মনে বলল,
“আমাকে ছেড়ে যাবেন না শ্রাবণ। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না”
_____________________

কানাডার টরেন্টো শহর। একটা দোতলা বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে। একটা চার বছরের মেয়ে খেলছে। ঠিক তার পাশেই একজন বাঙ্গালী রমনী দাঁড়িয়ে আছে। বাঙ্গালী রমনীটি কালো রঙ্গের শাড়ির পরিহিত। চুলগুলো সাপের ন্যায় মাজা অবধি ছড়িয়ে দেওয়া। ব্যাক ইয়ার্ডের ম্যাপল ট্রিতে একটা পাতাও নেই। শীত কালে এখানের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক খারাপ থাকে। এখন শীতের শুরু, তাই পাতা ঝড়তে শুরু হয়েছে। কিছুদিন পর মাইনাসে যাবে তাপমাত্রা। নারীটি কেবল গোসল করে এসেছে। মৃদু স্বরে বললো,
“শ্রাবণী, এভাবে ছুটে না মা। ব্যাথা পাবা”

কিন্তু বাচ্চাটি শুনলো না। বাড়ির পোষা কুকুর সিম্বার সাথে খেলছে আর খিলখিল করে হাসছে। নারীটি দু চোখ ভরে মেয়েকে দেখলো। মেয়েটিও বাবার মতো নীলাভ চোখ পেয়েছে। বাবার মতো মায়াবী সেই চোখ। বাচ্চাটি ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে আসতেই হোচট খেলো। রমনী ছুটে গেলো। আগলে ধরলো মেয়েকে। বিষাদ, উদ্বিগ্নতার ছাপ রমনীর মাঝে। তীব্র কন্ঠে বললো,
“বলেছিলাম, বলেছিলাম ব্যাথা পাবে৷ হলো? ব্যাথা পেলে! আচ্ছা আমার কথা শুনলে কি হয়?”

বাচ্চাটি মায়ের কোলে চুপ করে বসে থাকে। রমনী তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। ব্যান্ডেজ করে দেয় ক্ষতস্থানে। তখন ই কলিংবেল বাজে। বাচ্চা মেয়েটি ছুটে যায় দরজার কাছে। দরজা খুলতেই একজন পুরুষ কোলে তুলে নিলো তাকে পরম আদরে। আদুরে গলায় বললো,
“আম্মু, মাকে এভাবে কষ্ট দেও কেনো? দেখো মা তো রেগে গেছে”

বাবার কন্ঠ শুনে খিলখিলিয়ে হাসে বাচ্চাটি। তারপর পুরুষটি এগিয়ে আসে রমনীর কাছে। কোমড় শক্ত বাহুর বেষ্টনীতে আটকে ধরে। অভিমানী মুখশ্রীতে উষ্ণ স্পর্শ গেঁথে কোমল স্বরে বলে,
“রাগ করে আছো চারুলতা?”

মেকি রাগ গলে যায়। বলিষ্ঠ বুকে মাথা রেখে বলে,
“মেয়েটা একেবারে ত্যাদর হয়েছে। আপনার মতোই আমাকে জ্বালায়”

শ্রাবণ স্মিত হাসে। হ্যা! সেদিন শ্রাবণ ফিরে এসেছিলো চারুলতার কাছে। নিজের প্রেয়সীর আকুল অনুনয় ফিরাতে পারে নি। তবে মাথার পেছনে আঘাত পাবার জন্য স্মৃতিগুলো আবছা হয়ে গিয়েছিলো। যখন চারু তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি চারু”

তারপর প্রথম কথা ছিলো,
“নষ্টনীড়ের চারু”

সে চিনতে না পারলেও প্রবল অনুভূতিটাকে অস্বীকার করতে পারে নি। মোস্তফা কামাল ছেলে ছেলের বউ কে সব থেকে আলাদা কানাডার টরেন্টোতে পাঠিয়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন এখানেই ছেলের চিকিৎসা হবে। তারপর থেকে টরেন্টোতেই তাদের বসবাস। অন্যদিকে, তিনি এখন অবসর নিয়েছেন। সামনের মাসে নাতনীকে দেখতে আসবেন। ধ্রুব এবং চিত্রাও একটা ছোট পরিবার গড়েছে। মারুফা মারা গেছে গত বছর, এখন জাহানারা, ধ্রুব, চিত্রা এবং তাদের ছোট ছেলে প্রণ ই থাকে সেখানে। ধ্রুব অবশেষে চিত্রার অভিমান ভাঙ্গতে পেরেছিলো। ভালোবাসার বর্ষণ তাদের জীবনেও ঘটেছে। স্নিগ্ধ, নিবিড় বর্ষণ।

শ্রাবণী ঘুমোচ্ছে। চারু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শীতল সমীরে তার ঢেউ খেলানো চুল উড়ছে আপন তালে। শাড়ির আঁচলটা গড়াচ্ছে নিচে। শ্রাবণের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু স্মৃতিগুলো এখনো আবছা। অবশ্য এতে একটা ভালো হয়েছে। শ্রাবণ এখন আগের মতো পাগলামি করে না। এখানে ছোট একটা চাকরি করেই দিন যাচ্ছে তাদের। হঠাৎ পেটে শীতল স্পর্শ পেতেই খানিকটা কেঁপে উঠলো চারু। শ্রাবণ থুতনি কাঁফহে ঠেকিয়ে বলল,
“কি ভাবছো?”
“কিছু না। ঘুম আসছে না। তাই এখানে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছিলাম”
“মিথ্যে বলছো! আমি জানি তুমি কিছু ভাবছো!”
“আচ্ছা, আপনার এখনো কিছুই মনে পড়ে নি?”

শ্রাবণ চুপ করে গেলো। খানিকটা সময় নিয়ে বললো,
“আমার স্মৃতি আবছা হলেও আমি কিন্তু তোমাকে সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালোবাসি। স্মৃতি দিয়ে কি হবে! যে স্মৃতিতে খারাপ কিছু আছে, আমি চাই না তা মনে করতে। আর ভালো স্মৃতিগুলো না হয় আমি আবার গড়ে নিবো। বিশ্বাস করো তো?”
“হু, করি”

বলেই মাথা ঠেকালো শ্রাবণের বুকে। চোখ বুজে নিলো। শ্রাবণের স্পর্শ গাঢ় হলো, সে কোলে তুলে নিলো নিজের প্রেয়সীকে। তারপর পা বাড়ালো ঘরের ভেতরে। নিবিড় রাতের অন্ধকারে ভালোবাসাগুলো হয়ে উঠলো স্নিগ্ধ।

সকাল হলেই ব্যাস্ত হয়ে উঠলো চারু। রবিবার বিধায় শ্রাবণ মেয়ে সময় দিতে ব্যাস্ত। ব্যাক ইয়ার্ডে মেয়েকে দিয়ে বসে আছে সে। রাতে শিশির পড়েছিলো। ঘাসগুলো ভেজা এখনো। হঠাৎ মেয়ে বললো,
“বাবা, একটা গান শুনাবে। আমি বাংলা গাণ শিখবো। এখানে ব্যাবি শার্ক আর ভালো লাগে না”

মেয়ের শুদ্ধ বাংলা শুনে হাসে শ্রাবণ। ব্যাক ইয়ার্ড থেকে চারুলতাকে স্পশট দেখা যাচ্ছে। সে কোমড়ে আঁচল বেধে কাজ করছে। চুল গুলো খোঁপায় বাঁধা। কি অপরুপ দৃশ্য। যেনো কোনো আর্টিষ্টের শিল্পকলা। শ্রাবণ সুর তুললো,
“বাজাও কি বন সুর পাহাড়ি বাঁশিতে
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী হাঁসিতে।।
তব কবরী মূলে, নব এলাচেরও ফুল
দোলে কুসুম বিলাসিনী।
দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী, দূর দ্বীপবাসিনী ..”

মেয়ে হা করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। শ্রাবণ স্মিত হাসলো, দূর্বোধ্য সেই হাসি। দৃষ্টি এখনো আবদ্ধ চারুলতায়, তার দূর দ্বীপবাসিনীতে।

সমাপ্ত

মুশফিকা রহমান মৈথি

1 COMMENT

  1. I like this types of mysterious story. Frankly speaking, it’s really an amazing story. Thank you,moythi apu for this story. “Dur dipbasini” this song always remind me of this story. And I also like the main lead actor’s acting.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here