তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২১)

0
3110

#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২১)
#রোকসানা-রাহমান

আজ মিহি ক্লাসে কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। মাথা তার পুরো হট। কাল ইশাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে শুনেছে ইরফাদের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। খুব শিঘ্রই বিয়ে। খবরটা শোনার পর থেকে মিহির মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক পাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষ বিয়ে করবে,অন্য কাউকে। সারারাত সে ঘুমুতে পারেনি। থেকে থেকে কান্না এসেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখেছে,ইরফাদ বউ নিয়ে খাটের উপর বসে আছে। মিহি এটা কিছুতেই হতে দিবেনা। ঐ বুড়োটাকে তার চায়,অন্য কেন নিবে??? মিহির জল্পনা কল্পনা ভেঙেই ফোনের টোন বেজে উঠেছে। চুপিচুপি ফোন চেক করে দেখে ইরফাদের মেসেজ। মেসেজটা ওপেন করে সেও রিপলাই করলো৷,,,

**amar o apnar sathe kotha ache,apnar thekeo digun joruri..**

~~

ইরফাদ আর মিহি একটি অত্যাধুনিক,সবুজ আলোয় রঞ্জিত, কোলাহলপুর্ন কেফেতে বসে আছে। মিহির কলেজের পাশেই এটির অবস্থান। খুব একটা পুরোনো নয়,কয়েকমাস হবে উদ্বোধন করা হয়েছে। তাই তেমন একটা ভিড় নেই। ইরফাদ কিছু অর্ডার করতে চাইলে মিহি পরিষ্কারভাবে জানায় সে কিছু খাবেনা। কিন্তু এভাবে খালি মুখে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা অর্ডার করায় শ্রেয় মনে হলো ইরফাদের। দুজনের জন্য দুটো কোল্ড কফির অর্ডার করে মিহির দিকে তাকিয়ে আছে ইরফাদ।

সাদা এপ্রোনের সাথে সাদা স্কার্ফে মাথা ঢেকে বেধে রাখায় মেয়েটাকে যেন আরো বেশিই বাচ্চা বাচ্চা লাগে। ও পারবেতো এত বড় একটা দায়িত্ব সামলিয়ে নিতে?? বয়সের হিসেব করতে গেলে ইশাদের থেকে অনেকটাই ছোট,প্রায় ৮ বছরের ছোট হবে। খুব বেশিই কি ছোট হয়ে যাবে??

খয়েরি থাইয়ের,গোলাকৃতি টেবিলটার উপর দুটো সাদা কাচের গ্লাস। তাতে সুন্দর করে টিস্যু সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। টিস্যুর এক কোনে ‘উইশ হ্যাপি ফিউচার’ লেখাটি উকি দিচ্ছে। মিহি কিছু মিনিটের জন্য ইরফাদের কথা ভুলে গিয়ে নামটা নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলো। এতো সুন্দর নাম সে আগে কখনো দেখেনি। মিহির ভাবনাতে পানি ঢেলে দিলো ওর ডান হাতটার উপর ইরফাদের হাতের ছোয়া । টিস্যুর থেকে নজর সরিয়ে ইরফাদের দিকে তাকাতেই ইরফাদ বললো,,

“” মিহি,তোমার কাছে একটা অন্যায় আবদার করতে চলেছি,শুধু আবদার বললে ভুল হবে,মনে করো অনুরোধ,খুব প্রয়োজনীয় অনুরোধ,যেটা তোমাকে রাখতেই হবে। সেটা হোক আমার দিকে চেয়ে নাহয় ইশাদের দিকে চেয়ে।””

মিহি ইরফাদের কথা বুঝতে পারছেনা। প্রশ্ন করার জন্য ঠোঁটদুটো খুলতেই ইরফাদ চটপট বললো,,

“” ইশাদকে পছন্দ করো তো?””
“” হুম!””
“” তুমি চাওনা ও একটা স্বাভাবিক লাইফে ফিরে আসুক। একটা নতুন সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নতুনভাবে বাঁচতে শিখুক?””

ইরফাদের কথায় মিহির গ্লাসে সাজিয়ে রাখা টিস্যুর দিকে নজর চলে গেলো। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই ইরফাদ আবার বললো,,

“” তাহলে ওকে বিয়ে করে নাও!””

মিহি পুনরায় ইরফাদের দিকে চেয়ে আছে,তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। একটু আগে যে ভয়ংকর আবদারটা করেছে তাতে যেন মিহির উপর কোনো প্রভাবই পড়েনি। হয়তো ভুলে একটা মাছি সামনে চলে এসেছিলো এমন একটা ভাব। কোথা থেকে এসেছে সেদিকটায় খুজছে ইরফাদের মুখে।

ইরফাদ নিজের হাতটা দিয়ে মিহির হাতটা গাঢ় করে চেপে ধরে বললো,,

“” একমাত্র তুমিই সে মেয়ে যে ইশাদের বুকে আবার ঝড় তুলতে পারবে। যাকে ইশাদ ফিরিয়ে দিতে পারবেনা। আমি জানি তোমরা দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসো। হয়তো বিবাহ বন্দনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য সে ভালোবাসাটা নয়,তবুও যদি তাতে একটা মানুষ আবার হাঁসিখুশি জীবন ফিরে পায় তাহলে কি তা করা খুব অন্যায় হয়ে যাবে?? পারবেনা আমার ভাইটাকে সামলিয়ে নিতে?””

মিহি তৃতীয়বারের মতো টিস্যুটার দিকে তাকালো,সবুজ কালিতে লিখা ‘উইশ হ্যাপি ফিউচার’ নামটার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাঁসছে। মনে মনে ভাবলো,সার্থক হলো নামটার!

“” মিহি,চুপ করে থেকোনা। সাজবে তো আমার ভাইয়ের বউ?””

মিহি ঠোঁটে হাসি নিয়েই নিজের বা’হাতটা ইরফাদের হাতের উপর চেপে ধরলো। ভরসার চাহনি রেখে,খানিকটা দুর্বলসুরে বললো,,

“” পারবো,তবে উনার বউ সেজে নয়,আপনার বউ সেজে। আমি উনাকে ভাইয়ের চোখে দেখি আর উনিও আমাকে বোনের চোখে দেখে। অঢেল ভালোবাসা আমাদের মধ্যে,তবে তাতে বিয়ে নামক কালি দিয়ে কলঙ্কিত করতে চায়না। এতে শুধু আমি নয়,সুন্দর ভাইয়াও কলঙ্কিত হয়ে যাবে। যে কলঙ্কের দাগ উনার বর্তমান জীবনটাকেও নষ্ট করে দিতে পারে।””

মিহির কথায় স্তব্ধ ইরফাদ। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে মিহির দিকে। কোলাহলহীন কেফেটাকে কোনো এক নির্জন কবরস্থান মনে হচ্ছে। যেখানে বয়ে যাচ্ছে বাঁশের দোলের শনশন বাতাস। ইরফাদ মিহির দুহাতের মাঝে আটকে থাকা হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলে মিহি আরো জোরে চেপে ধরে বললো,,

“” আমি নাহয় ছোট,তাই আপনাকে অগোছালোভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি আমি আপনাকে কতটা চায়। কিন্তু আপনি কেন সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে বুঝার চেষ্টা করেননি। তাহলে হয়তো আজ এমন অন্যায় আবদারটা করতে পারতেননা। আর আমাকেও প্রত্যাখ্যান করতে হতোনা। এই প্রথম কিছু চাইলেন আমার কাছ থেকে, যা আমি বাস্তবে কেন স্বপ্নেও দিতে পারবোনা৷ অথচ প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে আমি নিজেকে আপনার জীবন দলিলে সপে দিয়ে যাচ্ছি!””

ইরফাদ গরমে ঘেমে যাচ্ছে,অথচ তারা ওপেন এয়ারকন্ডিশনে আছে। শীতল বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে মিহিকে। কিন্তু ইরফাদকে কেন ছুতে পারছেনা?? ইরফাদ চোখটা বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললো,তাহলে আমার যা সন্দেহ হয়েছিলো তাই ঠিক!

ইরফাদ বড়বড় কয়েক নিশ্বাস নিয়ে বললো,,

“” তাহলে আমার দলিলে থাকা সম্পদটা আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই। অন্যপাত্রে ঢেলে দেখতে চায়,সে কতটা নমনীয়!””

ইরফাদের কথায় মিহির অবাক হওয়ার কথা নাহয় রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুইটার কোনোটাই মিহির মুখে ফুটে উঠেনি। সে আগের মতোই শান্ত গলায় বললো,,

“” সম্পদের মালিকানা তো পাননি।””
“” মানে?””
“” ভালোবাসার বিপরীতে ভালোবাসা দিয়েছেন?””
“”…””

ইরফাদকে চুপ থাকতে দেখে মিহি উঠে দাড়ালো। কোল থেকে ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে নিয়ে বললো,,

“” আমি আপু নয় যে, ভালোবাসার দোহায় দিয়ে যা বলবেন তাই শুনবো। তবে ভেবে দেখতাম যদি আপনি আমায় ভালোবাসতেন। কিন্তু ভালো তো বাসেননি,তাহলে কোন অধিকারে আমার জীবনের আলো নিভিয়ে দিতে চাচ্ছেন, বলুনতো??””

ইরফাদ অবাক নয়নে চেয়ে আছে মিহির দিকে। ক্ষনিকের শীতল ছোয়াতে কি মিহি বড় হয়ে গেলো?? যতটা গুছিয়ে কথাগুলো বলবো ভেবেছিলাম তাতো ওর গুছানো আর কঠিন যুক্তিতে আরো বেশি অগোছালো হয়ে গিয়েছে।

মিহি টেবিলে সাজিয়ে রাখা টিস্যুগুলো থেকে একটা টিস্যু নিয়ে ইরফাদের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,,

“” এইভাবে আপনার ঘাম মুছে দেওয়ার জন্য হলেও আমি আপনার বউ সাজতে চাই।””

ইরফাদ রেগে মিহির হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,,

“” তুমি পাগল হয়ে গেছো। এটা কখনোই হতে পারেনা। কখনোই না।””
“” কেন হতে পারেনা?””

ইরফাদ মিহির কথার উত্তর না দিয়ে ওকে টেনে ধরে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

~~

প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ইশাদের চেম্বারে বসে আছে মিহি। এমন ব্যস্ত সময়ে আসাটা ঠিক হয়নি। দুপুরের দিকে আসলেই হতো।

ইশাদ রোগীর ভিড় কাটিয়ে চেম্বারে এসে দেখে মিহি টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝিমুচ্ছে। ইশাদ চুলে আলতো করে হাত রেখে বললো,,

“” কি ব্যাপার মিহিরানী,রাতে ঘুমোওনি?””

ইশাদের কন্ঠ পেয়ে মিহি মুখটা উচু করে তাকিয়ে রইলো। কি অমায়িক হাসি,কি সুন্দর আদুরী কন্ঠ। কে বলবে এই মানুষটার এত কষ্ট। প্রিয় মানুষটার বিরহ কতটা কষ্টের হতে পারে মিহিতো এক মাসেই বুঝতে পেরে গিয়েছে। প্রত্যেকটা রাত সে নির্ঘুমে কাটিয়েছে। চোখের কোনটা একটা সেকেন্ডের জন্যও কি শুকিয়ে ছিলো??

“” কেমন আছেন,সুন্দর ভাইয়া?””
“” আমি তো বেশ আছি। কিন্তু তুমি ঠিক নেই। কি হয়েছে বলোতো? আজ কলেজ যাওনি?””

মিহি চোখ ঢলে নিয়ে বললো,,

“” না,ভালো লাগছেনা। আপুকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমাকে নিয়ে যাবেন?””
“” ওহ! এই কথা? এর জন্য সারারাত ঘুমোওনি বুঝি?””
“” হুম!””
“” কিন্তু আমি তো আজ খুব বিজি। তুমি কি এখনি যাবে ভেবে এসেছো?””
“” হুম।””
“” ওকে। আমি আমার ড্রাইভারকে ডেকে নিচ্ছি। তুমি তার সঙ্গে যাও। কোনো ভয় নেই।ভরসা রাখতে পারো। খুবই বিশস্ত!””

মিহি ইশাদের মুখের দিকে চেয়ে তার ভেতরে কি চলছে বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইশাদ ব্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করতেই মিহি মাথা দুদিকে নাড়িয়ে কিছুনা বুঝালো। ইশাদ কাউকে ফোন করে কথা বলা শেষ করলো।

মিহিকে গাড়ীতে বসিয়ে দিয়ে বিদেয় দিয়ে চলে আসার জন্য ঘুরে দাড়াতেই মিহি, ইশাদের উদ্দেশ্যে বললো,,

“” আপনার ভালোবাসার পরীক্ষায় ভালোবাসার বিসর্জনের খেলাটা কি খুব বেশি কষ্টের? আমি যদি কখনো এই খেলায় অংশগ্রহন করি তাহলে কি আমি সহ্য করতে পারবো?””

ইশাদ থমকে গিয়ে মিহির দিকে তাকালো। ড্রাইভার ততক্ষনে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরেছে। ইশাদ মিহির কাছে এসে বললো,,

“” মিহিরানি,তোমার কি হয়েছে বলোতো!””
“” কিছুনা,সুন্দর ভাইয়া। জাস্ট কৌতুহল!””

গাড়ীর ইঞ্জিনের শব্দে মিহির চাপা কষ্ট চাপা পড়ে গেলো।

~~

বাবুটাকে যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে মিহি। এতো সুন্দর,কিউট বাবু সে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা। ছোট্ট ছোট্ট দুটো দাঁত বের করে যখন হেঁসে উঠে মিহির ইচ্ছে হয় কামড়ে খেয়ে নিতে। উফ! এতো ভালো দেখতে কেন?? মিহি মনে মনে মাশআল্লাহ! পড়ে নিয়ে কপালে নজর টিকাটা গাঢ় করে তিহির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললো,,

“” কেমন আছিস,আপু?””

তিহি কাপড় ভাজ করা বন্ধ করে বললো,,

“” এসেছিস দুঘন্টা পার হতে চললো,এখন জিজ্ঞেস করছিস কেমন আছি? মাথায় কি ব্যামো হয়েছে?””

মিহি বাবুকে রেখে তিহিকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

“” বলনা। ইশাদ ভাইয়ের চাওয়া পুরনে তোর কেমন সুখ হচ্ছে??””
“” শুন্য বুকটা ভরিয়ে নেওয়ার জন্য আজো পুকুরে আচল ভরে পানি তুলে যাচ্ছি। কিন্তু কি পোড়া কপাল দেখ,আমার আচলে পানি জমছেইনা। বুকের কাছটাতে পানি নিয়ে আসতে আসতে আচল খালি! নিঙরে নিঙরে সবটা পানি মাটি ভিজিয়ে ফেলছে।””
“” তাহলে কেন সেদিন মুখ বুঝে ইশাদ ভাইয়ার কথা শুনেছিলি? এতোটায় কি দায় পড়েছিলো?””
“” তা হয়তো পরেনি,কিন্তু মানুষটা যে আমায় ভিষন ভালোবাসতো!””
“” ভালোবাসতো বলেই করেছিস? যদি ভালো না বাসতো মানে তোর এক তরফা ভালোবাসা হতো তাহলে?””

মিহির কথায় তিহি আড়চোখে ওর দিকে তাকালো,,

“” এক তরফা হলে এমন আবদার ও করতোনা।””
“” যদি করতো তাহলে??””
“” থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতাম।””
“” সত্যি?””
“” হুম!””
“” আর তাজ ভাইয়াকে নিয়ে কি বলবি?””
“” তুই এতো প্রশ্ন করছিস কেন বলতো?””
“” আপু বলনা!””
“” পৃথিবীতে অনেকগুলো কঠিন কঠিন কাজের মতো একটি হলো অভিনয় করা। ক্ষনিকের জন্য,কিছু সময়ের জন্য অভিনয়টা আনন্দ দিলেও একটা সময় পর তা সব থেকে বিদঘুটে লাগে,আমি এখন এই পর্যায়েই আছি।””
“” কেন? আমার অমন সুন্দর বনমানুষ ভাইয়াটাকে তুই একটু ও ভালোবাসিস না?””

তিহি, মিহির পাশে বসলো,দৃঢ়গলায় বললো,,

“” প্রথম ভালোবাসা যেমন চট করে হয়ে যায়,দ্বিতীয়টা তেমন নয়। দ্বিতীয় ভালোবাসা জন্মানোর জন্য অনেক কাঠ,খড় পুড়াতে হয়,প্রতি নিয়ত মনের সাথে যুদ্ধ চালাতে হয়। আর সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন একটি ধারালো অস্ত্র। আমার তো সেই অস্ত্রটাই নাইরে বোন। তোর সুন্দর বনমানুষ ভাইয়াটা কখনোই আমার বুকে বিধে যাওয়ার পদক্ষেপ নেয়নি। হয়তো চায়নি। তার জীবনেও যে অন্য কেউ ছিলো। তাহলে আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় ভালোবাসার সূত্রপাত কি করে উদয় হবে?””

~~

অন্ধকার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে গভীর রাত। চারপাচটা নির্জনতায় ছেয়ে আছে। কিন্তু তিহির রুমটাকে সেই অন্ধকার ঢাকতে পারেনি। সাদা আলোতে পুরোরুম সাদাময়। আজকাল শুধু বাবুটা নয়,সাথে মা টা ও অন্ধকারকে ভয় পায়। জানালা বন্ধ করে ঘুমোলেও বারবার মনে হয়,এই বুঝি জানালা খুলে গিয়েছে। একটা মানুষের আসার অপেক্ষায় একটা বছর পার করে দিয়েছে,সে কি আসলেই আসবে??

তিহির সবেই চোখটা লেগে এসেছিলো তখনি ফোনটা বেজে উঠেছে। চোখ বন্ধ করেই কল রিসিভ করে কানে নিয়ে বললো,,

“” হ্যালো?””
“”….””

অপরপাশে নিরব। কোনো শব্দ নেয়। মাঝে মাঝে গভীর শ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিহি চোখ খুলে আননোন নাম্বারটা দেখতে পেয়ে নিজের মেয়ের আর তার মাঝখানে মোবাইলটা রেখে দিলো। কলটা কাটেনি।

তাজ চলে যাওয়ার ঠিক দুমাস পর রাত দেড়টার দিকে এই আননোন নাম্বারটা থেকে কল আসছে। কে করছে কেন করছে তিহি কিছুই জানেনা। অপরপাশ থেকে কখনোই কারো কন্ঠ পায়নি। প্রথম প্রথম তিহি বিরক্ত হলেও হঠাৎ করেই তার ভেতর এক অন্যরকম সন্দেহ জাগলো। মনে হতে লাগলো এটা তার পরিচিত। খুব কাছের কেউ,যে চায় সে তাদের শুনতে। তার আর তার মেয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে। তবে সেই কাছের মানুষটি কে? তাজ নাকি ইশাদ? সেটা এখনো ধরতে পারেনি তিহি।

তিহি মোবাইলটা নিজের কাছটাতে আনলো। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” রাজকুমারী,তুই কি তোর এই মায়ের ছায়াতে সারাটা জীবন থাকতে পারবিনা?? নাকি তোর ও বাবা চায়? আমি কিন্তু আমার মায়ের ছায়াতেই বড় হয়েছি। তোর কপালটাও আমার মতো পোড়া বুঝলি? নাহলে তোর বাবার হাতটা তোর মাথায় নেই কেন? আমার নাহয় মাথায় হাত রাখার মানুষটা ছিলোনা,কিন্তু তোর তো আছে! যার থাকতেও থাকেনা,সে হলো পুড়াকপালি!””

তিহি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো লাইনটা কেটে গিয়েছে। ওর মনে হলো ওর ফোন থেকে এক অদৃশ্য, শব্দহীন কন্ঠ ভেসে উঠেছে। বারবার বলছে,আমার মেয়েকে তুমি পোড়াকপালি বলবেনা!!

~~

মিহি নিজের ইংলিশ বইটার দিকে চেয়ে আছে। বাসার মধ্যে সে যতগুলো ট্যাবলেট পেয়েছে সবগুলো জড়ো করে বইটার উপরে রেখেছে। একেকটা একেক রকম,একেক নাম। কোনটা কোন রোগের ঔষধ মিহি জানেনা। কোনটা খেলে কি হতে পারে তাও সে জানেনা। কিন্তু তবুও সে খাবে। পানিভর্তি গ্লাসটার দিকে চেয়ে আছে। নিজের অন্তরআত্মার সাথে কথা বলছে,তোর সতেরো বয়সে কেন এতো কষ্ট পাবি? এতো কষ্ট বয়ে তুই কি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ডে নাম লিখবি?? কোনো দরকার নেই। এতে তো তোর বুড়ো মানুষটার একটুও কষ্ট হবেনা,একটুও খুশি হবেনা,সেতো তোকে একটুও ভালোবাসেনা,কিপটা একটা। মানুষ বুড়ো হলে কি কিপটা হয়ে যায়? একটু ভালোবাসলে কি হতো?? আবার উল্টো আমাকে মহৎ বানাতে চাই। কেন রে,আপনার দরকার হলে আপনি মহৎ হোন,আমি কেন হতে যাবো??

মিহি ফোনটা হাতে নিয়ে ইরফাদকে কল লাগালো,দ্বিতীয় রিংয়ে রিসিভ হলো,,

“” আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেননা?””
“” মিহি,কি ছেলেমানুষি কথা? বাচ্চাদের মতো করছো কেন? চোখ মেলে দেখো তুমি আর আমি..””
“”, আমি কি এখন আপনার ক্লাস করছি? এতো বড় লেকচার দিচ্ছেন কেন? ছোট্ট প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর দিন। হ্যা অথবা না!””

ইরফাদ কিছু সেকেন্ড চুপ করে থেকে ছোট্ট করে বললো,,

“” না।””

মিহি সাথে সাথে লাইনটা কেটে দিলো। সময়টা দেখলো ১ টা বেজে ৫২। ট্যাবলেটগুলো একটা একটা করে খুলে নিচ্ছে। আজকে আমি সব কষ্ট গিলে খাবো,পানি আর ট্যাবলেট দিয়ে। শুনেছি আঠারো বছর বয়সে দুঃসাহসী হয়ে উঠা যায়। আমিও হবো। এই আর কিছুক্ষন বাদেই আমারো আঠার বছর পুর্ন হবে!

ইরফাদ ফোনটা পাশে রেখে চোখ বন্ধ করতেই মেসেজ টোনটা বেজে উঠেছে। ওপেন করতেই দেখতে পেলো,,

** Sundor vaiyar moto, Amar ato shohon shokti nei j valobasar porikkhai valobasar bishorjon dibo,,abar apur moto ato gun o nei j ditiyo valobashar kuri futanor ashay,diner por din ovinoy kore jabo. Ami Isad noy,ami Tihi noy,ami Mihi jar dhoirjoshokti kom!

Sorry!!!**

ইরফাদ মেসেজের কোনো রিপলাই করলোনা। মেয়েটাকে এভাবে বুঝানো যাবেনা। আরো সংবেদনশীল হতে হবে। নাহলে অবুঝকালের কোনো অবুঝ ঘটনা তৈরী করতে গিয়ে ভয়ংকর কিছু হয়ে যেতে পারে।

~~

তিহি নিজের মেয়েটাকে কোলে নিয়েই হসপিটালে ঢুকেছে। হনহন করে ১১৮ নং কেবিনে ঢুকে পড়লো। আশেপাশে কি আছে,কে আছে কিছু দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি। সোজা মিহির সামনে গিয়ে দাড়ালো। আধশোয়া মেয়েটার নরম গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললো,,

“” তোর সাহস কি করে হলো,এমন বোকামী করতে? আমি তো ভেবেছিলাম এবার বুঝি আমার বোনটা বড় হয়েছে। আমার চিন্তা কমলো,মায়ের দেখাশোনা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিলি? আম্মুর কথা একবারও ভাবলিনা? আমি যে ভুল করেছিলাম,সেই একি ভুল তুইও করলি? আবার আমার থেকে দুকদম এগিয়ে?””

তিহি নিজের রাগ নিয়েই মিহিকে আবার চড় মারার জন্য হাত তুলেছে। তার আগেই পেছন থেকে ইশাদ বললো,,

“” আমার রাগ ওর উপর ঝারছো কেন,তিহিপাখি?””

তিহি থমকে গিয়ে পেছনে তাকালো। ইশাদ তিহির কোলের ফুটফুটে কন্দনরত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” মেয়েটাকে ঝগড়া শিখাচ্ছো? তোমার মতো ঝগড়ুটে বানাবে?””

তিহির রাগে চোখ বড় হয়ে আসছে। ইশাদ ওর কোলের বাবুটাকে নিজের আয়ত্তে নিতে নিতে ওর চোখে চোখ রেখেছে। চাপা কন্ঠে বললো,,

“” তোমার ঘামের গন্ধটাতো আরো বেশি মারাত্মক হয়ে গেছে!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here