#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২৫)
#রোকসানা-রাহমান
সকাল থেকেই মরিয়ম বেগমের শরীরটা একটু বেশিই খারাপ,স্বামী জমিল সাহেব,ছেলে ইরফাদ,ইশাদ,ছেলের বউ তাকে ঘিরে রেখেছে।সকলের মনেই যেন কিছু হারানোর বড় পাথর চেপে রয়েছে।
মরিয়ম বেগম,অস্পষ্ট স্বরে বললেন,,
“” সবাই একটু বাইরে যাও। ইশাদের সাথে আমার কথা আছে!””
ইশাদ মায়ের দিকে হামলে পড়ে বললো,,
“” আম্মু,এখন কোনো কথা নয়,পরে শুনবো!””
“” এখন না বললে হয়তো আর কখনোই বলা হবেনারে,বাপ। সবাই চলে গেলে দরজাটা আটকিয়ে আমার কাছে আয়!””
ইশাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজার দিকে পা বাড়ায়। সিটকানি লাগানোর প্রয়োজনবোধ করলোনা। কোনোমতে ভিড়িয়ে নিয়ে আবার মায়ের সম্মুখীন হয়ে বসেছে।
“” ওখানে বসলি কেন? বিছানায় উঠে আয়। আমার কোলে মাথাটা একটু রাখ। আমি হাত বুলিয়ে দেই।””
“” থাকনা,আম্মু। তুমি আগে সুস্থ হও,তারপর দেখ প্রতিরাতেই আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো।””
“” শুধু সুস্থ মায়ের ভালোবাসা নিলেই হবে? অসুস্থ মায়ের ভালোবাসা চায়না? “”
ইশাদ আর কিছু বলতে পারছেনা। মায়ের ভালোবাসা তো সন্তান সব অবস্থায় পেতে চায়। হোক সেটা সুস্থ ভালোবাসা নাহয় অসুস্থ ভালোবাসা। ইশাদ মরিয়ম বেগমের কোলে মাথা রাখতেই উনি কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলের চুলে হাত দিলেন। চোখটা বন্ধ করে বললেন,,
“” এখন আমি যা বলবো তা তুই শুনবি,চুপ করে শুনবি। আমার কথার মাঝখানে কথা বলবিনা। ঠিক আছে বাবা?””
“” হুম!””
মরিয়ম বেগম বুকের কাছে আটকে থাকা দীর্ঘস্বাস ফেলে শুরু করলেন,,
“” আমি ছোটবেলা থেকেই একরোখা টাইপের ছিলাম। সহজে কারোর সঙ্গে মত্ত হতাম না। হাতে গুনা একটা/দুটা বান্ধুবী ছিলো। তবে এই দু একজন বান্ধুবীকেই আমি এতো বেশি ভালোবাসতাম যে ওরা আমাকে রেখে অন্য কারো সাথে মিশলে আমার খুব কষ্ট হতো,খুব কাঁদতাম। আমার শুধু মনে হতো ওরা আমার বান্ধুবী, অন্য কারো সাথে কেন মিশবে? অন্য কাউকে কেন ভালোবাসবে?? আমি এগুলো সয়তে পারতাম না। তাই সেই দুএকজন বান্ধবী কে ও ছেড়ে দিলাম। একা একা পথ চলা শুরু করলাম। একটু বুঝদার হতেই তোর বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়। একটা অপরিচিত মানুষ হলেও আম্মু আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। উনাকে নিয়েই আমার জীবনের প্রতিটা পথ চলতে হবে। আমি চাইলেও উনাকে রেখে চলে আসতে পারবোনা,তাড়িয়ে দিতে পারবোনা। আম্মুর কথা যতটা বুঝতে পারছিলাম তোর আব্বুকে আমি ততোটাই নিজের দিকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে এমন হলো যে তোর দাদা,দাদি যদি তোর আব্বুর সাথে কথা বলে,সময় কাটায় আমার ভালো লাগতোনা। রাগ হতো,অভিমান হতো,কষ্ট হতো,কান্না পেতো। ধীরে ধীরে এই অনুভূতি প্রকট হয়ে পড়ে,উনাদের সাথে,তোর আব্বুর সাথে আমার ঝগড়া হতে শুরু হলো। আমার একটাই কথা তোর আব্বুকে আমি একা ভালোবাসবো আর কেউ বাসতে পারবেনা।
তোর আব্বু আমার জেদের সাথে পেরে উঠতে পারছিলোনা। মানুষটা ও আমাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলো,তাই এই ঝামেলা এড়াতে ভিটে ছাড়া হলো। আমাকে নিয়ে পাড়ি দিলো শহরে। আমি তো ভীষন খুশি,আমার খুশি দেখে তোর আব্বুও খুশি। আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসার ভালোই চলছিলো। এর মধ্যেই তোর ভাই ইরফাদ এলো পৃথিবীতে। সংসারটা যেন আসতে আসতে পুর্ণতা পাচ্ছিলো। সুখ,আনন্দের ছড়াছড়ি। আর পুরোপুরিভাবে পরিপূর্ণ করতেই হয়তো তুই এলি। কিন্তু ঝামেলা পেকে গেলো এখানেই। তুই আমার থেকেও বেশি তোর আব্বুকে কাছে পেতে চাইতিস। উনার কোলে গেলেই তুই চুপ,খিলখিলিয়ে হাসিস,বুকে নিলেই ঘুমিয়ে পড়িস। অথচ আমার কাছে যতক্ষন থাকিস তখনও শুধু আব্বু আব্বু বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলিস। এটা নিয়ে তোর আব্বুও মাঝে মাঝে আমার সাথে ঠাট্টা করতো। প্রথম প্রথম ঠাট্টাটা মজার হলেও এক সময় আমার বুকে তীর হয়ে বিধছিলো। মনের ভেতর আবার সেই একরোখা ভাবটা জাগতে থাকে। একসময় তোর আব্বুকে তোর সামনে সহ্য করতে পারলাম না। শুরু হলো ঝগড়া। ঝগড়ার কারন তাকে বিদেশে যেতে হবে। কিন্তু উনি তোদের আর আমাকে এভাবে একা ছেড়ে কিছুতেই যাবেননা। কিন্তু আমার জেদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে দেশ ছাড়লেন। এক বছর,দু বছর,তিন বছর করে করে প্রায় ছয় বছর পার হলো। আমি তোদের নিয়ে দিব্বি আছি। এখন আমার ছেলেরা শুধু আমাকেই ভালেবাসে। তোর আব্বু দেশে আসতে চাইলেও আমি মানা করে দেই। আমার ভয় হতো উনি আসলেই যদি তোরা আবার উনাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসিস সেই ভয়। এমন করে করে ৮ বছর পর উনি দেশে ফিরলেন। তাও আমাকে না বলে। দিন গড়িয়ে বছর পার হচ্ছিলো এভাবেই। তোরা আমার আদরের চাদরে বড় হচ্ছিলি। তোর আব্বু ততদিনে বুঝতেও পেরে গিয়েছিলো,আমি স্বাচ্ছন্দে থাকার জন্য নয়,তোদেরকে তার থেকে দুরে রাখার জন্য এমনটা করেছি। মানুষটা বুঝতে পেরেও আমাকে কিছু বলেনি,নিয়তির দান মনে করে চুপ করে থাকলো। যেখানে উনি বছরে দুবার দেশে আসার পারমিশন পেতো সেখানে উনি আমার জন্য চার বছর পরপর দেশে আসতেন।
এরমধ্যেই ইরফাদের সাথে ঘটে সানজিদার বিয়ের ঘটনা। ও বাড়িতে আসাতে আমার খারাপ লাগলেও মেনে নিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিলো ইরফাদ আমার থেকে দুরে চলে যাচ্ছিলো। আগের মতো আমার খোজ নিতোনা,আমার রুমে এসে আমার কাছে বায়না করতোনা। বাসায় যতটা সময় থাকতো সে সানজিদাকে নিয়েই। আমার কষ্ট হতো,হিংসে হতো। কিন্তু তবুও চোখ বন্ধ করে সহ্য করতে চাইতাম। তোকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাইতাম। বারবার বলতাম,তুই কখনোই ইরফাদের মতো হবিনা। কখনোইনা।
হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় সানজিদা মারা গেলো। ইরফাদের মতো আমার ও কষ্ট হচ্ছিলো। যতই হোক পরিবারের একজন ছিলোতো। কিন্তু ছেলে আমার বউয়ের শোকে দেশ ছাড়লো। তাতে আমার কষ্ট দ্বিগুন বেড়ে গেলো। কেন ওর দেশ ছাড়তে হবে? ছোটবেলায় যেমন আমার সাথে হেঁসে খেলে দিন কাটিয়েছে এখন কেন পারবেনা?? খুব রাগ হলো। আমার ভালোবাসার দুটো মানুষের থেকে একটা হারিয়ে ফেললাম। তোকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এর মধ্যে তোর জীবনে এলো তিহি!””
তিহির কথা শুনতেই ইশাদ নড়ে উঠেছে। কিছু বলার আগেই মরিয়ম বেগম জোর গলায় বললেন,,
“” বলেছি কথার মাঝখানে কথা বলবিনা। চুপ করে শোন।””
ইশাদ আগের ন্যায় চুপ হয়ে গেলে মরিয়ম বেগম আবার বলতে শুরু করলেন,,,
“” তোর মুখে তিহির কথা শোনে আমি ভীষন খুশি হয়েছিলাম। কারন এই মেয়েটার জন্য তোর মাঝেও বেশ পরিবর্তন এসেছিলো। আগে তুই পড়াশোনার চাপে হোস্টেলেই সময় কাটাতি। কিন্তু তিহি আসার পর থেকে বাড়িতে থাকা শুরু করলি। ঘনঘন বাড়িতে আগমন আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছিলো। তুই যেমন তিহিকে পেয়ে খুশি আমিও তিহির জন্য তোকে পেয়ে খুশি। এর মধ্যে তুই আমাকে জানালি তুই তিহিকে বিয়ে করবি। তখন আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিলো। কেন জানিস? কারন তিহির জন্য তোর পরিবর্তনগুলো প্রথম প্রথম আমার ভালো লাগলেও পরবর্তীতে লাগেনি। আসতে আসতে তুই তিহির মাঝে এতোটাই হারিয়ে যাচ্ছিলি যে আমাকে ভুলে যাচ্ছিলি। যে ছেলে মাকে না বলে বাড়ি থেকে যেতোনা,সে ছেলে বাড়িতে কখন আসে কখন চলে যায় আমি টেরও পায়না। তুই ঘুমোনোর আগে সবসময় আমার রুমে আসতি। কিন্তু তিহির সাথে ফোনালাপে এতোটাই ব্যস্ত থাকতি যে,আমি রাত জেগে তোর অপেক্ষা করতাম সেটা তোর চোখেও পড়তোনা। তোর খাবারে অনীহা চলে এসেছিলো,সময়ের কোনো ঠিকঠিকানা নাই। তাই তোর সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেলো। তোর প্রত্যেকটা জন্মদিনে আমার দেওয়া জামাটা পড়ে কেক কাটা হতো। কিন্তু সেবার তুই আমার দেওয়া জামাটা ছুয়েও দেখলিনা। তিহির দেওয়া পান্জাবীটা পড়ে দিব্বি কেক কেটেছিলি। সেদিনই আমি বুঝে গেলাম,আমার ছেলের জন্য মায়ের ভালোবাসার ঝুড়ি ভরে এসেছে,এখন সে অন্য কারো ভালোবাসার সন্ধানে খালি ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কষ্ট হচ্ছিলো আমার,কিন্তু তোকে বলতে পারছিলাম না। কিভাবে পারবো? এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। চোখ বন্ধ করে সবটা মেনে নিয়ে যখন তোর আর তিহির বিয়ের তারিখ ঠিক করছিলাম ঠিক তখনি তাজের আগমন। আমাকে নানা হুমকি দিতে থাকলো। সে ইনাকে নিয়ে যাবে যেভাবেই হোক। দরকার হলে গুন্ডা দিয়ে কিডন্যাপ করবে,আদালতে মামলায় লড়বে। তখন তো তোর জীবনে ইনার গুরুত্ব কতটা তাও আমি জানতাম। কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে ব্যাপারটা বলবো কিন্তু তাজ যখন ইনার বদলে তিহিকেও অপশনে রাখলো তখন আমি চুপ করে সবটা শুনলাম। আমি জানতাম তুই ইনা আর তিহি কাউকেই তাজের হাতে তুলে দিবিনা। তুই কেমন ধরনের ছেলে সেটাতো আমি জানতাম। তোর শরীরের বলের উপর,মাথার বুদ্ধীর উপরও আমার প্রচন্ড ভরসা ছিলো। কিন্তু ঐযে স্বার্থপরতা জেগে উঠলো। হিংসে আমার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। তাজের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধী চাপলো। ছুড়ে দিলাম তোর সামনে ভালোবাসার পরীক্ষা। জিতেও গেলাম আমি। তিহির বিয়ে ঠিক করলাম অন্য জায়গায়। ছেলে ভালো ঘরের,ইন্জিনিয়ার। তোকে ছবি দেখাতে চাইলাম। কিন্তু তুই দেখলিওনা। তোর এই ব্যাপারটাই এতোটা উদাসীন দেখে,মনের ভেতরে খারাপ চিন্তা এসে জায়গা করে নিলো। মনে হলো আপদ যখন বিদেয় করছি তাহলে পুরোপুরি করি। এক ঢিলে দু পাখি। তোর অজান্তেই পাশা পাল্টে গেলো। বর বদলে গিয়ে তাজের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলাম।””
মরিয়ম বেগম চোখ টিপে চোখের পানি ফেলে ছেলের চুলে আঙুল ঢুকালেন। ধরা গলায় বললেন,,,
“” আমি জানি এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে খারাপ,নিকৃষ্ট মা,,যে নিজের স্বার্থে ছেলের জীবন থেকে সবটা সুখ কেড়ে নিয়েছে। হিংসের আগুন নিভাতে গিয়ে তোদের দুটো মানুষকে আমি জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছি। আর এই জন্যই হয়তো আমি ইহকালেই শাস্তি পেয়েছি। না পেলাম শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির ভালোবাসা,না পেলাম স্বামীর ভালোবাসা আর না পেলাম সন্তানের। আমি জানি তোরা সবাই আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসিস। কিন্তু তবুও তোরা সবাই আমার থেকে অনেকটা দুরে। যেখানে ভালোবাসা থাকা সত্বেও আমাকে ছুতে পারেনা। আমি সারাটা জীবন অন্যায় করে এসেছি তাই সৃষ্টিকর্তা আমাকে শাস্তিও দিচ্ছেন। আমার অন্যায়ের জন্য আমি কখনো ক্ষমা চায়নি। কিন্তু এবার চাইবো তোর কাছে আর তিহির কাছে। ক্ষমা করবি তো আমায়?””
ছেলের দিকে চায়তেই মরিয়ম বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ইশাদের চোখ ভিজে এসেছে। চুপ করে রয়েছে সে। কি বলা উচিত তার???
মরিয়ম বেগম একটা খাতার পেজ ইশাদের হাতে দিয়ে বললেন,,
“” এটা তিহিকে দিস। তেমন কিছু লিখা নাই। ক্ষমা চেয়ে দু-চার লাইন লিখা আছে। আমি চায় তুই নিজে ওকে আমার ব্যাপারে সবটা বলবি। তারপর চিঠিটা ওর হাতে তুলে দিবি। যাতে ওর বুঝতে সুবিধা হয়।””
“” না আম্মু,আমি আর ওর মুখোমুখি হতে পারবোনা। যে সত্যটা তোমার আর আমার মধ্যেই বন্দী আছে তা বন্দীই থাক। অন্য কাউকে বলার দরকার নেই। আমি তো সবটা মেনে নিয়েছি আর তিহিও…””
“” ধরে নে,এটা আমার শেষ চাওয়া।””
ইশাদ শোয়া থেকে উঠে বসে দ্রুততার সাথে বললো,,
“” তুমি সুস্থ হয়ে যাবে আম্মু। আমার তো তোমাকে ভালোবাসাই হয়নি।””
“” আমি যদি কোনো শরীরিরোগে আক্রান্ত হতাম তাহলে সুস্থ হতাম। আমি মনোরোগে ভুগছি,নিজের অন্যায়ের অনুতপ্তে ভুগছি,যে রোগের ঔধুধ এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই। আর আল্লাহও হয়তো চাচ্ছেন আমার হিংসে আর স্বার্থপরতা থেকে তোরা এবার মুক্তি পা।””
“” আম্মু এভাবে বলোনা প্লিজ,আমার তোমার উপর কোনো রাগ নেই।””
“” তুই এখন যা। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। আল্লাহর দরবারে হাত তুলতে ইচ্ছে করছে।””
ইশাদ মায়ের আদেশ অমান্য করতে পারলোনা। নিশ্চুপ হয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলেই মরিয়ম বেগম আবার বললেন,,
“” আমার শেষ ইচ্ছেটা পুরন করিস,বাবা। নাহলে আমাকে পরকালেও যে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তিহির সাথে করা অন্যায়ের জন্য ওর ক্ষমাটা জরুরী। বান্দা ক্ষমা না করলে যে আল্লাহও ক্ষমা করবেননা।””
~~
পরীক্ষা হলে বসে আছে মিহি। টেস্ট চলছে। আর চার মাস বাধেই এইচ.এস.সি এক্সাম। ইংলিশ পরীক্ষা হওয়ার সুবাদে ইরফাদ ওদের ক্লাসেই গার্ড টিচার হিসেবে আছে। এতে যেন মিহি আরো বেশি অসস্থিতে পড়ে গেলো। ঠিক মতো লিখতে পারছেনা। আবার চুপ করে বসে থাকতেও পারছেনা। না লিখলে যে তার জন্য কত কঠিন শাস্তি রয়েছে তার আন্দাজও নেই। চুপচাপ প্রশ্ন পড়ায় মন দিতেই পাশ থেকে তৃনা বললো,,
“” কি ব্যাপার মিহি,আজ তোর ক্রাশের দিকে একবার ও তাকালিনা যে। অন্য সময় তো হা করে তাকিয়ে থাকতি। “”
মিহি তৃনার কথা অবজ্ঞা করেই সাদা খাতায় কলমের দাগ বসাচ্ছে। তৃনা আরেকটু চেপে এসেছে মিহির দিকে। ফিসফিস করে বললো,,
“” তোর ক্রাশ কিন্তু দেখতে হেব্বি। বয়সটা একটু বেশি হলেও তেমন বোঝা যায়না। আজকে কালো শার্টটাতে যা লাগছেনা। তোর কি হয়েছে বলতো। অন্য কারোর উপর ক্রাশ খেয়েছিস নাকি? স্যারের দিকে তাকাচ্ছিস না যে? কালো শার্টটাতে কিন্তু দারুন হ্যান্ডসাম লাগছে।””
মিহি লিখা বন্ধ করে মুচকি হেঁসে বললো,,
“” লাগবেইতো শার্টটাতো আমার পছন্দের। আলমারি থেকে আমিতো বের করে দিয়েছি উনাকে।””
মিহির কথায় তৃনা যে বেশ চমকিত তা ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
“” তুই এসব কি বলছিস মিহি? তুই কি করে স্যারের শার্ট চুজ করে দিলি? তোদের কি প্রেম শুরু হয়েছে? এটা কি করে সম্ভব? স্যার তো তোকে পাত্তায় দেয়না।””
“” প্রেম নয় সংসার শুরু হয়েছে।””
“” কিহ!””
“” হুম। উনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।””
তৃনা যেন আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়লো। কিছুটা উচ্চ আর ব্যঙ্গ স্বরে বললো,,
“” এই বুড়োটা তোর স্বামী?””
মিহি খাতা কলম ফেলে চিৎকার করে বললো,,
“” কি বললি তুই? আমার স্বামী বুড়ো? তোর এতো বড় সাহস,আমার স্বামীকে বুড়ো বলিস?””
তৃনা ভয়ে পেছনে সরে গেলেও মিহির হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। মিহি অলরেডি তৃনার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
~~
ইশাদ বাসায় এসে ইরফাদ আর মিহির মুখোমুখি বসে আছে। ইরফাদকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে,বেশ রেগে আছে। আর মিহি চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে। ইশাদ দম ছেড়ে ইরফাদের উদ্দেশ্যে বললো,,
“” ভাইয়া এসব কি শুনছি? মিহির কলেজ থেকে কল এসেছিলো। প্রিন্সিপাল বললো,তুই নাকি মিহির টিসির জন্য বলেছিস?””
“” হুম।””
ইরফাদের ভাবনাহীন উত্তরে ইশাদ হতাশ হয়ে বললো,,
“” ভাইয়া,আর কিছুদিন পর মিহির পরীক্ষা,তুই কি বুঝতে পারছিসনা কি হতে পারে?””
ইরফাদ বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়ে বললো,,
“” আমার মনে হয়না আমি ভুল কিছু করেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সেম কাজটায় করতো আর সেটা আরো অনেক আগেই। নেহাৎ ওকে তুই বোনের মতো দেখিস বলে আমি এতোদিন সহ্য করে এসেছি।””
“” এভাবে বলছিস কেন? মিহি কি করেছে?””
“” সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর!””
ইশাদ মিহির দিকে তাকাতেই ও কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো,,
“” আমার কি দোষ? তৃনা উনাকে বুড়ো বললো কেন? আমার খারাপ লাগেনা বুঝি?””
মিহির কথা শুনে ইশাদ অট্টস্বরে হেঁসে উঠে তাতে যেন ইরফাদের রাগ আরো বেড়ে গেলো। গলা হাঁকিয়ে বললো,,
“” তোর হাঁসি পাচ্ছে? তুই জানিস ওর জন্য আমি একটা দিনও ঠিক মতো ক্লাস করাতে পারিনি। আর আজ তো এক্সামটাই বাদ হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছে করছিলো…””
“” ভাইয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো মিহির কি দোষ। ওর স্বামীকে কেউ বুড়ো বললে ওর তো খারাপ লাগবেই।””
“” বুড়োকে বিয়ে করলে বুড়া তো আর ছেড়া হয়ে যাবেনা। যদি সহ্যই করতে না পারবে তাহলে কে বলেছিলো বিয়ে করতে? অসহ্য একটা। সব তোর জন্য হয়েছে!””
ইরফাদ রাগ নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
~~
অন্যসব সকালের মতো আজ সকালেও তিহির বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। তবে খুব একটা বেশি না। ৯ টার দিকে। চোখ মেলেই তাজকে দেখতে পেলো। ফরমাল ড্রেসআপে নিজেকে পরিপাটি করছে। তিহি ব্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো।
তাজ নিজেকে আরেকবার পর্যবেক্ষন করে প্রাপ্তির কাছে এসে বললো,,
“” আম্মা,তোমার বাবা ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। তুমি আমাকে দোয়া করে দাও তো। একটা চুমু দাও।””
তাজ নিজের গালটা প্রাপ্তির ঠোটের কাছে ধরে রাখতেই ও হাতদুটো দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। চুমু দেওয়ার বদলে ঠোঁটদিয়ে চেটে দিচ্ছে।
তাজ বেশ খুশিখুশি মুড নিয়ে প্রাপ্তির কপালে পরপর চারপাশটা চুমু খেয়ে বললো,
“” তোর আম্মু কি আমাকে গুড লাক বলবেনা? তুই বললে ঠিক বলবে। আমার হয়ে সুপারিশ করবি?””
তাজের কথাতে প্রাপ্তি খিলখিলিয়ে হাঁসছে,এখন তো তার চারটা দাঁত উঠেছে। সাথে হাত পা নাড়িয়ে আব্বা আব্বা বলে ডাকছে।
তাজ তিহির দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। ওর কোনো রিয়েকশন না দেখে মন খারাপ নিয়ে বললো,,
“” আসছি আম্মু,আমার মা’টা তার মায়ের কাছে থাকো কেমন?””
তাজ শেষ বারের মতো তিহির দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো। শিরিন বেগমের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে সদর দরজা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে। কয়েক কদম যেতেই পেছন থেকে তিহি ডেকে উঠলো,,
“” শুনুন!””
তাজ থমকে গিয়ে পেছনে তাকাতেই তিহিকে দেখতে পেলো। দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে উৎসুক হয়ে বললো,,
“” হ্যা,বলো!””
“” বেস্ট অব লাক!!সাবধানে যাবেন।
তিহি নিজের কথা শেষে ঘুরে দাড়িয়ে পড়লো। ভেতরে ঢুকার জন্য পা ফেলতে চাইলেও পারেনি। পেছন থেকে তাজ ওর হাত ধরে ফেলেছে। ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,,
“” আমার প্রতিটা সকাল এমন মিস্টি চাই।””
“” আমার চাইনা। আমি যখন চেয়েছিলাম তখন আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমন কি যাকে ঘিরে এতোকিছু করছেন তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিতে চাননি। আপনার মতো এমন নিকৃষ্ট মানুষকে আমি কখনোই ক্ষমা করবোনা।””
“” তাহলে শাস্তি দিও। কিন্তু দুরে ঠেলে দিওনা।””
~~
ইশাদ বেশ কিছুসময় ধরে তিহির বাসার নিচে দাড়িয়ে রয়েছে। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তিহির রুমের জানালাটার দিকে। ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছেনা। বারবার অন্তরআত্মা বলছে তার উপস্থিতি তিহি ঠিক বুঝবে। আর সে ঠিক ইশাদের সামনে এসে দাড়াবে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নিলো। মেয়েটার ভালোবাসার আর কত পরীক্ষা নিবে সে? এবার একটু নিস্তার নিক। ইশাদ চটপট মেসেজ লিখলো,,
**niche dariye achi..kichu kotha chilo..asbe ki?**
ইশাদ সেন্ট অপশনে ক্লিক করার আগেই শুনতে পেলো,,
“” তুমি,তুমি এখানে?””
সামনে তাকিয়ে দেখলো তিহি অবাকভর্তি চোখ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। ইশাদ সাথে সাথে নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে ভনিতা ছাড়াই বললো,,
“” তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।””
“” আমার সাথে? সত্যি?””
তিহির চোখদুটো চকচক করছে। তার ইশ! তার সাথে নিজ থেকে দেখা করতে এসেছে।
মায়ের দেওয়া চিঠিটা তিহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“” কিছু কথা ছিলো। শুনতে পারবে? মানে সময় হবে?””
“” তোমার জন্য তো আমার সবটা সময় কবেই দিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। আজ এতো অনুরোধ করছো যে!””
ইশাদ তিহির দিকে তাকাতে পারছেনা। অস্থির চোখদুটোকে এদিকওদিক ঘুরিয়ে বললো,,
“” আম্মু আর আমাদের মাঝে নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।””
“” চলে গিয়েছে মানে?!””
ইশাদ মায়ের বলা সবটা কথা তিহিকে খুলে বলেছে। তিহি সবটা শোনার পর তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত বুঝতে পারছেনা। যার জন্য তার পবিত্র ভালোবাসা পুর্নতা পায়নি তার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করবে নাকি যে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে পরকালে চলে গেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে?
তিহি দোটোনায় মৃত্যুযাত্রীর দেওয়া শেষ চিঠিটার ভাজ খুলে বললো,,
“” ইশাদ!””
“” হুম!””
“” এটাতো সাদা কাগজ!””
ইশাদ চট করে তিহির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিলো। এপিঠ ওপিঠ চেক করেও যখন কোনো লেখা পেলোনা কাগজটা নিচে ফেলে দিলো। নিজের পকেট হন্ন হয়ে খুজছে। ভুল করে অন্য কাগজ নিয়ে আসেনিতো। কিন্তু কোথাও কিছু না পেয়ে ছোট্ট একটা চিন্তার সাগরে ডুব দিতেই অট্টস্বরে হেঁসে উঠে।
ইশাদের কর্মকান্ডে তিহির চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে,তবে পাতাগুলো এখনো কিছুটা ভিজে আছে। ভেজা পাতা নিয়েই বললো,,
“” হাঁসছো কেন?””
“” সন্তান যত চালাকই হোকনা কেন,মায়ের ভেতরে কি চলে তা সে কোনোদিনও বুঝে উঠতে পারবেনা””
“” মানে?””
“” কিছুনা।””
ইশাদ তখনো মুচকি মুচকি হেঁসে যাচ্ছে। তারমাঝে তিহি ছোট্ট করে বললো,,
“” ইশ!””
তিহির মুখে ছোট্ট শব্দটাই ইশাদের সব হাঁসি উবে দিলো। কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলো তার আর তিহির বাস্তবতা। আবার কেন মনে পড়লো?? এমনটা কি হতে পারেনা আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছি??
“” ইশ!””
“” হুম বলো।””
“” তোমার কি আজো কিছু বলার নেই?””
তিহির প্রশ্নে ইশাদ ওর দিকে শান্তদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
আমি কি বলতে চাচ্ছি তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো ইশ। তুমি শুধু একবার বলো,তিহিপাখি আমি তোমাকে নিতে এসেছি। দেখবে আমি সব ছেড়ে এখনি তোমার কাছে চলে যাবো। আমার যে তোমাকে চাই। আমার অপুর্ন স্বপ্নদেরও তোমাকে চায়। প্লিজ ইশাদ আজ একা ফিরে যেওনা। আজ যদি আমাকে ফেলে যাও,তাহলে এই তিহি আর কোনোদিনও তোমার জন্য চোখের পানি ফেলবেনা। নিজের সবটা সে বিসর্জন দিবে। আমার ভালোবাসার কসম!
চলবে