#সর্বনাশিনী,০৫,০৬
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৫
একটা বছর… ১২ টি মাস, ৩৬৫ টি দিনের মাঝে ছটি মাস-ও সুন্দর করে সংসার করা হয়নি স্নেহার। বিয়ের দ্বিতীয় দিন শরীরের তীব্র ব্যথা নিয়ে জাগ্রত হয়। মরীর পরিত্যক্ত রক্তের শুকিয়ে যাওয়া গন্ধ আর ঘরটির ভিতরের বাতাবরণ ভেপসা গরমের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্নেহা বিছানা থেকে ধীরে পায়ে গায়ে চাদর টেনে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার চাদরের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভয়ে আত্মকে উঠলো স্নেহা। হু হু করে কেঁদে উঠলো। পা দুটি সমানে কেঁপে যাচ্ছে তার। তল পেটের তীব্র ব্যথা আর শরীরের জখমের জালাতন স্নেহা সামলাতে পারছে না কোনো রকম বিছানার চাদরটা টেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গরম পানির নিচে স্নেহার ধবধবে সাদা উদম শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। গরম পানির প্রতিটি ফোঁটা মনে করিয়ে দিচ্ছে গত রাতে মর্মান্তিক মুহূর্ত গুলোকে। যাকে অন্য মানুষরা বলে,
” ভালোবাসার রাত!”
কিন্তু স্নেহার কাছে, ভীতিকর, ভয়ানক, এক কাল রাত্রী কেঁটে গেছে যেন। স্নেহা চোখ বুঝলো। সাধারণত রাতটুকু সময় মত তার রূপ পরিবর্তন করে আলোকিত করে চারিদিক। কিন্তু কালকের রাতটি স্নেহার মনে হচ্ছিলো, আর শেষ হবার নয়। টিপ টিপ করে পড়া পানি স্নেহার শরীরে লাল কালসিটে দাগগুলোকে ছুঁয়ে যেতেই স্নেহা শিউরে উঠছে। কঁপালটা তার এতোই পোড়া? না বাবা-মা পেলো, না পেলো সমাজে মর্জাদা আর না পেলো ভালোবাসা। পৃথিবী নাম এই অদ্ভুত পৃথিবীতে কষ্ট ছাড়া আর কোনো অনুভূতির মিষ্টি স্বাদ পায়নি স্নেহা। এসব ভেবেই ভিজে চোখ জোড়া মুছে নিলো। নব বধূর সাজে সজ্জিত হয়ে নিচে নেমে এলো। বড় ডাইনিং হলে দিলশাদের মা বিন্দু কাজের মেয়ে শেফালিকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। সিঁড়ির কোঠায় স্নেহাকে দেখে বিন্দুর ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠলো। বরাবরই স্নেহাকে তার পছন্দ ছিল। সেহেরের অহংকারী ভাব বিন্দুর দু চোখে সইতো না। তবুও ছেলের পছন্দ বলে চুপ ছিলো। কিন্তু এখন যে ছেলের বুদ্ধি হলো। পরম যত্নে নিজের কাছে এসে বসালেন তিনি। খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে একে একে বেরে দিলেন রুটি সবজি ডিম ভাজা আরো কত কি। স্নেহার এই টুকুতেই জীবনের সব আনন্দ মায়ের ভালোবাসার এক চিলতে ছোঁয়া হৃদয় স্পর্শ করে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেবে নিলো, এই মধ্যে বয়সী নারীটি তার মায়ের জায়গায় থাকবে সব সময়। স্নেহার বড় বড় চোখে জলের ফোয়ারা। বিন্দু বিঝতে পেরে স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব তাই না? দিল যে কি সকাল সকাল মিটিং আছে বলে বেড়িয়ে গেলো। কাঁদিস না ওই এলে তোকে একবার ঘুরিয়ে আনতে বলবো!”
স্নেহা মাথা নাড়লো। বিন্দু স্নেহার দিকে জুস এগিয়ে দিলো। মেয়েটি দেখে তার মনে সব সময় মায়া সৃষ্টি হয়। অদৃশ্য টান অনুভব হয়। বিন্দু হা করে শ্বাস ফেললো। স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আমি জানি তোদের মাঝে সম্পর্কের আনাবোনা আছে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আর একবার তোদের বাচ্চা এসে গেলে তো কথাই নেই!”
স্নেহার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
” বাচ্চা? ”
সেদিন দুপুরে দিলশাদ বাড়ি ফিরলো। বিন্দু ততখন রেডি হয়ে হল ঘরটিতে বসা। বিন্দুকে তৈরি দেখেই দিলশাদ ভ্রু কুচকে বলল,
” আম্মু চলে যাচ্ছো যে? কেউ কিছু বলেছে?”
বিন্দু হেসে বলল,
” ধুর পাগল ছেলে, আমায় কে কি বলবে, আমায় তো যেতেই হতো, তোর আব্বু বাসায় একা। ”
দিলশাদ হ্যা বোধক মাথা নাড়লো। বিন্দুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো দিলশাদ আর স্নেহা। যেতে যেতে বলে গেলো,
” খুব জলদি কিন্তু নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই!”
স্নেহা মাথা নইয়ে মুচকি হাসলো। বিন্দু চলে যেতেই পুরো বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলো। ভুতুরে বাড়ির মতো। স্নেহা খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে শেফালিকে বলল,
” দিলশাদকে খেতে আসতে বলুন!”
শেফালি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বলল,
” না মেডাম আপনি জান, আমার ভয় করে!”
স্নেহা চুপ রইলো। ওরো তো ভয় করে, গত রাতের পরে আরো বেশি ভয় করে। দিলশাদের ওই গভীর চোখ জোড়ায় ভয়ংকর কিছু আছে, যা স্নেহাকে নয় শুধু যেকোনো ব্যক্তির রূহ কাপিয়ে তুলতে সক্ষম। স্নেহা কি করবে ভাবছিলো, ঠিক তখনি নিচে নেলে এলো দিলশাদ। বিন্দু যাওয়ার আগে দিলশাদের মন পছন্দ মতো সব খাবার বানিয়ে রেখে গেছে। দিলশাদ টেবিলে এসে বসে পড়লো। স্নেহা কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার এগিয়ে দিলো। সকালে বিন্দুর কথায় পেয়েস করেছিলো নিজ হাত। সেটিও এগিয়ে দিলো সে। দিলশাদ খেতে লাগলো। খাবার শেষে গরম গরম পায়েস যখন মুখে দিলো, মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে গেলো দিলশাদের। হুংকার ছেড়ে ডাকলো শেফালিকে। শেফালি দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। দিলশাদ বলল,
” পায়েস কে বানিয়েছে?”
শেফালির বুকের ভিতর দুরুদুরু শুরু করে দিয়েছে। সে চুপ রইলো। স্নেহারওনেদিকে হাত পা জমে গিয়ে ঠান্ডা বরফ। সে আমতাআমতা করে বলল,
” আমি আমি বানিয়েছি।”
এতটুকু শুনেই না ডানে দেখলো না বামে দিলশাদ গরম পায়েসে বাটি ছুঁড়ে মারলো স্নেহার দিকে।গরম পায়েস গায়ে পড়তেই ফোসকা পড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। স্নেহার কাতরানো উপেক্ষা করে দিলশাদ বলল,
” আর কখনো আমার জন্য কিছু করবে না তুমি। তোমার হাতের খাবার থেকে বিষ পান করা ভালো। ”
বলেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো সে।
তরুনের পার্টিতে খাবারে আইটেমে পায়েস আর একই স্বাদের টেষ্ট পেয়ে পুরোনো স্মৃতির কথা মনে পড়লো দিলশাদের। বিয়ের দ্বিতীয় দিনটিতেই মেয়েটির হাত আর গা পুড়িয়ে দিয়েছিলো দিলশাদ। ভেবেই ভিতর থেকে আহ্ বের হয় এলো। কিন্তু পরিচিত পায়েসের স্বাদ পেয়ে মনে হলো মানুষটি তার খুব কাছে কিছুটা কৌতুহল হয়েই জিজ্ঞেস করলো দিলশাদ,
” পায়েস কে বানিয়েছে?”
তরুন হালকা হেসে বলল,
” আমার বোন। ”
দিলশাদের বুকে ধক করে উঠলো। আচ্ছা কে এই মেয়েটি? যার সাথে সব মিলে গিয়েও অমিল? খাবারের পর হাত ধুতে গেল দিলশাদ। সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলো আকৃতা শেখ। দিলশাদকে দেখে সে বেড়িয়ে যেতে নিলো। দিলশাদ হাত ধরে আটকালো। গভীর চোখ জোড়া দিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। বলল,
” কে তুমি?”
আকুতা তার মিষ্টি কর্কষ কন্ঠে বলল,
” আকৃতা শেখ!”
” আমাদের কি এর আগে কখনো দেখা হয়েছে?”
” দিলশাদ আমরিন দ্যা বিজনেস ওফ টাইকুন। যার এর আগে একবার গোপনে বিয়ে হয়েছে। নিজের বউয়ের বড় বোনের সাথে এখন আপনার ডেটিং চলছে। তালুকদার বাড়ির মেয়েদের উপর ইন্টারেস্ট চলে গেছে নাকি আপনার? এখন পথের মেয়েদের পরিচিত মনে হয়?”
দিলশাদ মোটেও এমন উত্তরের আশা করে নি। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রোবটের মতো। মেয়েটির তিক্ত কথায় খারাপ লাগলো তার৷ কিন্তু কেন? মেয়েটি কি তাকে ঘৃণা করে?
আকৃতা শেখ স্থান ত্যাগ করলো। তার একটুপর ন্যাকা কান্না করে উপস্থিত হলো সেহের। দিলশাদ আমরিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাত ধুতে লাগলো। তা দেখে ক্ষেপে গিয়ে বলল সেহের,
” দিলশাদ তুমি আমার একদম কেয়ার করো না, ভুলেই গেছো একে বারে!”
দিলশাদ ঠোঁট বাঁকা হাসলো। সেই হাসি কতটা ভয়ংকর তা সেহের বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেলো। দিলশাদ আমরিন তার দাম্ভিক চকচকে মুখটি নিয়ে তীর্যক চোখে তাকালো সেহেরের দিকে। বলল,
” হো আর ইউ?”
” দিলশাদ?”
বড্ড অবাক হলো সেহের।
” কি বলছো? তুমি আমাকে চিন্তে পারছো না?”
” না তো? ”
” দিলশাদ? আমি তোমার সেহের? যাকে তুমি ভালোবাসতে…!”
দিলশাদ পকেটে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বলল,
” তাই না কি?”
সেহের তালুকদার ঘাবড়ে গেলো। ততলাতে ততলাতে বলল,
” আমি… আমি..!”
দিলশাদ থামিয়ে দিলো। বলল,
” ভুলে যে-ও না সেহের তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আমি হারিয়েছি। এখন যে দাঁড়িয়ে আছো না আমার সামনে? এক মাত্র আমার আম্মুর জন্য। আমার আম্মুকে না বাঁচালে তোমার মুখ টা-ও আমি দেখতাম না। সো স্টে অ্যায়ে!”
সেহের বরফের মতো জমে গেলো। মরে যাওয়া স্নেহাকে ইচ্ছে মতো গালি দিতে লাগলো। তখনি পিছন থেকে একটি কন্ঠ স্বর ভেসে এলো,
” আজ কাল মানুষ ভুতকে ভয় পায় না.. ভয় পায় মানুষকে। আচ্ছা এমন যদি কখনো হয়? নিজের কর্মের ফল হিসেবে মানুষের রূহানী রূপ টা বেড়িয়ে আসে? তখন কি হবে? অবশ্যই তার করা পাপ কর্ম গুলো গুনে গুনে মনে করিয়ে দিবে।”
তরুনের বলা কথায় সেহের কেঁপে উঠলো। পুরোনা পাপ কথাটি ভাবতেই বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো কঁপালে। ঘাবড়ে যাওয়া মুখ নিয়ে ফিরলো পিছনে। কিন্তু তরুনকে ফোনে কথা বলতে দেখে রেহাই পেলো সেহের এক প্রকার পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। সেহেরকে পালাতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,
” পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।”
মধ্যরাত…
বাতাসের মৃদু দোল দোলানি শীতল ভাব। বাংলো বাড়ির বড় বাগানের বিদেশি ফুলের ঘ্রান। আর তীক্ষ্ণ চাঁদের আলোয় ফলকের রাশি রাশি বাহার। চাঁদের এক চিলতে হাসি পড়ছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহার উপর। হাতে ধোয়া উঠা চা আর রোমাঞ্চকর পরিবেশ।
“কি ভাবছিস?”
তরুন তার বোনকে জিজ্ঞেস করলো। স্নেহার সুন্দর ঢেউ খেলানো চুল গুলো এক পাশে করে নিয়ে গুরুগম্ভীরের মতো বলল,
” ভাবছি, পৃথিবীরটা একটা মায়াজাল, মায়াচক্র। ছোট বেলায় আমরা পুতুল নাচ দেখতাম না… ঠিক তেমন। উপর ওয়ালা আমাদের বানিয়ে ভেদাভেদ ছাড়া পৃথিবীর রঙ্গ মঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। আর আমরা… আমাদের ভাগ্য কিছু তুচ্ছ মানুষের হাতে তুলে দি… আর তারা আমাদের সেই ছোট বেলার দেখা পুতুল নাচের মতো… নাচিয়ে যায়।”
তরুন বোনের কাছে এসে দাঁড়ালো। খোলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
” পুতুল পারে না নিজের ভাগ্য পাল্টাতে। কারণ তাদের মধ্যে প্রাণ নেই, তারা তো মাটির তৈরি, কাঠের তৈরি বা মমের। কিন্তু মানুষ? রক্তে মাংসে গড়া। এরা চাইলেই পারে নিজের ভাগ্য পাল্টাতে। ”
স্নেহা চকিতে বলল,
” ভাই, আমি আমার ভাগ্য পাল্টাতে চাই!”
তরুন হেসে বলল,
” কি চাই!”
” একটা উপকার!”
” হুকুম কর!”
” আমরিন এম্পায়ারে জব! ”
” হুকুম শিরোধার্য ইউর হাইনেস। ”
তরুন বলতেই স্নেহা হেসে ফেললো। হাসলো তরুন ও। দু ভাই বোনকে হাসতে দেখে হাসলো যেন চাঁদনী পসর-ও…..
এদিকে যেমন হাসাহাসির কলকলানি। অন্যদিকে আধার ঘরের এক ফোঁটা চাঁদনী পসর পরছে খোলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দিলশাদের উপর। ক্লিন সেভ মুখ আর শক্ত চোয়াল ঘন কালো চুল গুলো এলো মেলো। রাতের আকাশের মতো গভীর গাড় নীলাভ চোখ মেলে চেয়ে আছে দূরের অম্বরে। হাতের কোনে থাকা একটি তাবিজের লকেটে জ্বলজ্বল করছে দিলশাদ লিখা নামটি। দিলশাদ তাবিজটি উপরে তুললো। স্নেহার ছোট বেলার চেহারাটি মনে করতে চাইলো। ছোট একটি মুখ। বড় বড় চোখ। টমেটোর মতো লাল গাল। খিলখিল করে হাসছে। ভেসে আসচ্ছে তার মৃদু ছন্দ তোলার মতো কন্ঠ,
” দিলশাদ আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন না।”
দিলশাদ নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে চাইলো চোখে কোনে চিক চিক করে উঠলো জল। একটি ভুল স্নেহা আর তার জীবনের পরিনীতি এভাবেই হবার ছিলো কি? দিলশাদ পুরোনো স্মৃতিতে ঢুব দিলো……
চলবে,
#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৬।
দিনটি ছিল শীতকালের শুরু। ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠার স্বাদ আর বাহারি পাখির কিচিরমিচিরে সন্ধ্যার নরম আলোয় এক উৎসব। কুয়াশা ঢাকা শহরটিতে শীতকালীন ফুলের সুবাস ভেসে বেড়ায়। হার কাঁপানো ঠান্ডায় গরম কাপড় গায়েও গরম ভুট্টার স্বাদে ছুটে চলে
কপোত কপোতীরা। এমনি একটি দিনে বাংলার সাজে সজ্জিত হয়ে ছুটে চলছে এক রমণী। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডায় সাদা শাড়িতে জিড়য়ে নিয়েছে নিজেকে। খুব অল্প সাজেই এক ছোট পরি মতো মনে হচ্ছে। গোলাপি ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি। থাবেই বা কেনো? আজ স্নেহার মনের মানুষ দেশে ফিরছে। চোখে মুখে আনন্দের ফুলঝুরি। স্নেহা বাতাসের গতিতে এসে দাঁড়ালো বাসার সামনে। ভার্সিটি এক প্রকার দৌড়ে এসেছে, উদ্দেশ্য বাবা-মা বোনের সাথে যাবে এয়ারপোর্টে। স্নেহা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ালো। তালুকদার বাড়ির গাড়িটি ছাড়লো বলেই। স্নেহা কাছে এসে সায়রাকে বলল,
” মা আমাকে নিবে তোমাদের সাথে?”
সায়রা হেসে বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই কেন নিবো না। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা একেবারে আমরিন ভিলায় যাবো। পার্টি আছে। ”
স্নেহা হাসলো। দুরুদুরু বুকে গাড়িতে উঠলো। সেহের তখন নাক ছিটকে বলল,
” ছিঃ তুই এসব পড়ে যাবি নাকি পার্টিতে? মান- সম্মান থাকবেতো মা?”
সায়রা ধমকে বললেন,
” বেশি কথা নয়”
সেহের মুখ ভেংচে নিজের ফোনে মন দিলো। এদিকে স্নেহা তার বুকের বাপাশটা চেপে ধরে আছে। দিলশাদকে এক পলক দেখবে ভেবেই হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে ছুটছে। স্নেহা ভয় পাচ্ছে বুকের এই ধুকপুকানির ওয়াজটা যদি গাড়ির ভিতরে সবাই শুনে ফেলে? আচ্ছা দিলশাদকি তাকে চিনবে? সায়রা যখন স্নেহাকে সেহেরের পুরাতন ফোনটা দিয়েছিলো প্রথমবার ইউস করতে? তখনি সে ফেবু একাউন্ট খুলেছিলো এক বন্ধুর মাধ্যমে। তারপর থেকেই সে সব সময় ঘুরাঘুরি করতো দিলশাদ লিখা আমরিন নামের আইডিটিতে। এক বার দু বার নয় দিনে রাতে অসংখ্যবার। প্রতিটি ছবিতে লাভ রিয়েক্ট ছিলো মাস্ট। তবে দিলশাদ তাকে ফেন্ড লিস্টে কখনো এড করেনি। কিন্তু কেন করেনি? স্নেহার অনেক ইচ্ছে হতো একটি বার “হাই” ” হ্যালো” করতে। ভয় পেতো স্নেহা….! কিন্তু সেহের তালুকদার ঠিকি তার আইডির ফেন্ড লিস্টে জায়গা পেয়েছে। কথা-ও হয়েছে তাদের….! এসব ভেবেই বুকের ভিতরটা ভাড় অনুভব মনে হলো স্নেহার। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখে ফুঁটিয়ে আনলো। এত দিন পরে পোড়া মনে একটু ঔষধ লাগবে বোধহয়?
ঘন্টা খানেক পর….
সারি সারি লোকজন বের হচ্ছে। বড় বড় সাইনবোর্ড, ব্যানার টানিয়ে এনেছে আপনজনেরা তাদের দেশ ফিরত আপনজনদের জন্য। তালুকদার পরিবার আর আমরিন পরিবার নিজেরাও সেখানে দাঁড়িয়ে… অধির আগ্রহে বড় বড় চোখ করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে উৎকন্ঠা স্নেহা। ওর ভয় লাগছে। ভয়টি-ও মিষ্টি মনে হচ্ছে। হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে। ঘন বড় বেনি করা চুল গুলো ঘুছিয়ে নিচ্ছে। এয়ারপোর্টের বাহিরে থাকা একটি আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো স্নেহা। শাড়িটি ঠিক আছে তো? কঁপালের টিপ টা? আর হাতের চুরি? রিনিঝিনি নূপুর? নাহ্ সব ঠিক। যেমনটি দিলশাদ একবার পোষ্ট করেছিলো তার বাঙ্গালি নারী খুব পছন্দ। লিখে ছিলো,
” সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মাথার ঘাম টুকু মুছে দেয়ার জন্য একজন রমণীর শাড়ির আঁচলটা প্রয়োজন”
এই পোষ্টের নিচে তখন হাজারো কমেন্টের ভীড়। দিলশাদ ইউএস থাকাকালীন প্রায় পাঁচ বছর মডেলিং হিসেবে কাজ করেছে তার সাথে খুব সুন্দর গিটারিস্ট সে। গিটারের সুরের সাথে নিজ কয়েকটা গান-ও কমোজ করেছে সে। যার জন্য ফ্যান ফোলোয়িং কমনেই তার। দিলশাদের পোষ্টের নিজে তখন একজন কমেন্ট করেছে,
” আমাদের স্বপ্নের রাজকুমারের বুঝি বাঙ্গালী মেয়ে পছন্দ?”
তার নিচে আরেকজন লিখেছে,
” আমাকে বিয়ে করবে দিল? আমি তোমাকে এত এত ভালোবাসি! ”
তার নিচে বিন্দু লিখেছে,
” বুঝেছি, ছেলের বিয়ের বয়স হয়েগেছে? এবার দেশে আসলেই মিঙ্গেল করে দিবো!”
বিন্দুর কমেন্টের একজন মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তখন রিপ্লাই করলো,
” আন্টি আমি কি আপনার ছেলের বউ হতে পারি?”
বিন্দু রিপ্লাই করলো,
“ওয়েল, তোমাদের দিলশাদ তো ওল রেডি নিজের মানুষ খুঁজে রেখেছে!”
এমন রিপ্লাইতে আরো আরো কমেন্ট মুহুর্তেই ভরে গেলো। সব কমেন্ট গুলো পরে স্নেহা লাল-নীল হতো।দিলশাদ তো তাকেই বলে গেছিলো, অপেক্ষা করতে? তাহলে বুঝি সে সত্যি তার কাছে ফিরছে?
স্নেহার ভাবনার মাঝেই একটি ঝংকার তোলা পুরুষালীর স্পষ্ট কন্ঠ ভেসে এলো। কন্ঠের স্বর শোনেই কেঁপে উঠলো স্নেহা। মাটির থেকে নজর উপরে উঠতেই হাজার টা টুকরো হয়ে গেলো স্নেহার স্বপ্নে। চোখের কোনের জলে ফুরোঙ্গী টুপ করে ঝড়ে গেলো। স্নেহা একদম পিছিয়ে গেলো। সে কি ভুল দেখছে?
দিলশাদ, তার দিলশাত, তার প্রাণ প্রিয় দিলশাদ। সেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। স্নেহার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভুল কিছু ভাবছে না তো স্নেহা?
স্নেহা সামনে গেলো না৷ দিলশাদ বলেছিলো,
” তোমাকে আমি ঠিক খুঁজে নিবো।”
তাহলে হয়তো, সত্যি খুঁজে নিবে সে…! স্নেহা আবার মাথা নুয়ে রাখলো। বিন্দু তখন স্নেহার কাছে টেনে নিয়ে দিলশাদকে বলল,
” দিলশাদ, ওকে চিনেছো? ও স্নেহা!”
স্নেহা আবারো আশা ভড়া চোখে দিলশাদের চোখে তাকালো। কাজল কালো চোখ জোড়া এক ফোঁটা আশার ঝলক। কিন্তু হায়…. দিলশাদ এক পলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে, সেহেরের হাত ধরে। স্নেহা নিস্তব্ধ হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। দিলশাদ আজ ক্যাজুয়াল ড্রেসে ছিলো, পড়নে হোয়াইট টিশার্টের উপর ব্ল্যাক জেকেট আর ব্ল্যাক পেন্টে এক যেন রাজপুত্র লাগছিলো। স্নেহা চেয়েছিলো, দিলশাদের চওড়া বুকে মুখ লুকিয়ে শান্তির শ্বাস নিবে। কিন্তু কি হলো? একে একে স্নেহাকে ফেলেই সবাই চলে গেলো। দিলশাদ তার স্পোর্টস কারে সেহেরকে সঙ্গী করে বেড়িয়ে গেলো। বেড়িয়ে গেলে একে আরো দুটি গাড়ি। শুধু পিছনে ফেলে গেলো পরগাছা এক অবয়বকে, একটা ছায়াকে। স্নেহার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। নিজেকে আজ তুচ্ছ মানুষ হিসেবে মনে হচ্ছে। একটা ইউসল্যাস পার্সন। যার কারো জীবনেই প্রয়োজন নেই। দিলশাদের জীবনেও না….উমহুম একদম না….!একটু-ও না….!
এয়ারপোর্টের চৌকাঠে হাজারো লোকের আনাগোনা সকলের-ই গন্তব্য কোথা-ও না কোথায়-ও। কিন্তু স্নেহার গন্তব্য কই?স্নেহা রাতের আঁধারে কনকনে ঠান্ডায় একাই বেড়িয়ে পড়লো। তার আর জায়গা নেই না তালুকদার বাড়িতে.. আর না আমরিন ভিলা। স্নেহা তুচ্ছো হাসলো। রাতের আঁধারে নিজের ছায়াকে সাথী করে রওনা করলো ভার্সিটির হলে। স্নেহা জানে, তাকে কেউ খুঁজবে না। কেউ না। তাকে কেউ ভালোবাসবে না, কেউ না। তবে সে নিজেকে নিজে ভালোবাসবে, খুব ভালোবাসবে। যদি দিলশাদ তার ভালোবাসার মানুষটিকে না চায়..তবুও সে খুশি হবে, খুব খুশি।
ঠান্ডার কাঁপতে কাঁপতে স্নেহা তার ভার্সিটির হলে উপস্থিত হলো। ঠান্ডায় হাত যেন জমে গেছে তার। তবু-ও কোনো অনুভূতি নেই। নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঠিক তখনি এক প্রকার চিৎকার করে স্নেহার বেস্ট ফ্রেন্ড বন্যা অন্য রুম থেকে দৌড়ে এলো। হাতের ফোনটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” দোস্ত.. তোর দিলশাদতো এঙ্গেজমেন্ট করতেছে!”
স্নেহার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে নিলো। নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখলো দিলশাদকে। ব্ল্যাক অফহোয়াইট কালার সুটে দাম্ভিক মুখখানায় খুশির ঝিলিক। তার পাশেই চমৎকার এক সুন্দরী মেচিং অফ হোয়াইট কালার গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে। খিল খিল করে আসচ্ছে। বড় বড় হেডলাইনে ভেসে ভেসে যাচ্ছে স্ক্রীণে,
” আমরিন এমপ্যায়ারের এক মাত্র অংশীদার দিলশাদ আমরিনের সাথে তালুকদার গ্রুপের ছোট বড় মেয়ে সেহের সাথে হতে চলছে একই বন্ধনে আবদ্ধ। এই বিষয়ে দিলশাদ আমরিনের বক্তব্য, ‘ ছোট বেলার ভালোবাসা এবার পূর্ণতা পেতে চলেছে’ ”
স্নেহার জোরে জোরে কান্না করে দিলো। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে চলছে। বন্যা সামলাতে চাইছে খুব করে কিন্তু পারছে না…। এদিকে স্নেহার বুক ফাঁটা আর্তনাদ কারো সাথে ভাগ করার নেই। স্নেহার কান্নায় বন্যার চোখেও জলের বন্যা। বান্ধবীকে বুকের সাথে চেপে আছে। যতটা শান্তনা দিয়া যায় আর কি! কিন্তু তাতে কি আর লাভ হবে? নাহ্ হবে না….! আর যাই হোক.. কেউ কারো কষ্টের ভার নিতে পারে না…! কিন্তু কষ্টের বোঝা বাড়িয়ে দিতে জানে। জানে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে….। স্নেহা কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মাথার উপর পুরোনা দিনের সিলিংটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” আপনি আপনার ভালোবাসা খুঁজে নিতে ব্যর্থ দিলশাদ, ব্যর্থ। ”
————-
” আপনি আপনার ভালোবাসা খুঁজে নিতে ব্যর্থ দিলশাদ, ব্যর্থ। ”
আমরিন এ্যামপায়ারের ১৪ তলা দিলশাদের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা উরফ আকৃতি। স্বচ্ছ কাচের এই কেবিনটিতে একটি সুদর্শন যুবক বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। প্রতিবারের মতো ফিট এন্ড ফাইন, অফিস সুটে একজন সুপুরুষ। ক্লিন সেভ মুখ-মন্ডলে সিরিয়াসন্যাস। এই যুবকটিকে দেখে এখনো স্নেহা বুক কাঁপে, তৃষ্ণা পায়। বড্ড ছুয়ে দিতে মন চায়… বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। পরম যত্নে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে…! স্নেহা শুকানো ঢুক গিললো। হাই হিল আর অফিস ড্রেস কোর্ডে, মুখের মাঝে কনফিডেন্স নিয়ে দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে ভেসে এলো ঝংকার তোলা কন্ঠ,
” কামিং!”
স্নেহা নিজের শত্রু পক্ষের কেবিনে পা রাখলো। বলল,
” হাই মিস্টার আমরিন আ’ম আকৃতা শেখ!”
দিলশাদের কলম থেমে গেলো। মাথা তুলে নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এক পলক তাকাতেই মনে হলো যেন, ” স্নেহা”
কিন্তু কোনো রিয়াকশন নেই। কিন্তু স্নেহা মনে সনে হাসলো,
” শত্রুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলাম!”
দিলশাদ এবার মুখ খুললো,
” তরুন আমাকে বলেছে আপনার কথা মিস আকৃতা…! আপনি এখানে আমার পি এ হিসেবে কাজ করবেন!”
স্নেহা মাথা নারলো। দিলশাদ বসতে ইশারা করলো। এবং কাউকে আসতে কল দিলো। কিছু মুহূর্তেই একটি ছেলে এসে হাজির।
” সাফাদ মিস আকৃতা শেখকে কাজ বুঝিয়ে দাও!”
সাফাদ মাথা নাড়িয়ে আকৃতাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।পিছনে আবারো আগের মতো ভাবলেশহীন ভাবে কাজে ডুবে পড়লো দিলশাদ আমরিন। স্নেহা একবার চাইলো তার দিকে। বলল,
” আপনার এই এ্যামপ্যারেকে খুব ভালোবাসেন না আপনি? আর এই এ্যামপ্যায়ার যদি না থাকে?”
বাঁকা হাসলো স্নেহা। প্রতিশোদের নেশায় সহজ সরল স্নেহা এখন সর্বনাশিনী……
চলবে,