তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (৬)

0
1019

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (৬)
#রোকসানা_রাহমান

শাহিনা শাইখা কেঁপে উঠলেন। সাদা রঙের টেবিল ক্লথটা সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইশাদ তখনো রেগে আগুন। মানুষটা বাবা নাহলে হাতটা বুঝি কেটেই ফেলতো। মায়ের রাত জাগা পরিশ্রমের এই মূল্য? কিন্তু তার বাবাকে তো এমন রাগতে দেখেনি কখনো। হ্যাঁ মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে এটা জানে। তবে কখনো চেঁচিয়ে কথা বলে না। ঠান্ডা কন্ঠের তিক্ত কথা শোনায়। যার সাক্ষী সে নিজে। তাহলে আজ কী হলো? সামান্য সাদা রঙের টেবিল ক্লথ দেখে এমন কঠিন হুংকার? নাকি অন্যকিছু? ইশাদ মনে প্রশ্ন ফেলতেই পেছনের কেউ বাতাস বেগে পালিয়ে গেল। রুবিনা আন্টি? পালালো কেন? ভয় পেয়েছেন কি?

শাহিনা শাইখা টেবিল ক্লথ সরাতে গিয়ে গ্লাসটা ফেলে দিলেন। কাঁচের গ্লাসের রংহীন পানি সাপের গতির মতো বহুস্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। পানি সামলাতে গিয়ে রুটির প্লেট উল্টে গেল! ভেজা রুটি তুলতে গিয়ে তার হাত কাঁপছে। কিছু মিনিটের মধ্যে সাজানো ডাইনিংটার একি হাল হলো? সব কি তারই দোষ? শাহিনা শাইখা চোরা চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। তিনি এক দৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি বেয়ে পড়ছে অগ্নিশিখা। এই রাগের কারণ কি শুধুই সে?

চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তপ্ত পরিবেশে! স্বামীর চোখের আড়াল হতে ডাইনিং ছাড়লেন। ব্যস্ততা শুরু করলেন ভাঙা কাঁচ তুলায়। থরথর কাঁপুনি হস্তটা টুকরো কাঁচে পড়তেই ইশাদ দৌড়ে এল। মায়ের হাত চেপে ধরে বলল,

“আমি করে দিচ্ছি,আম্মু!”

শাহিনা শাইখা ছেলের দিকে তাকালেন। তার চোখ থৈ থৈ করছে। বরষার ভারি বর্ষণটা শুরু হলো বলে! শুধু একটু মায়া দরকার,একটু আদর,একটু ভালোবাসা,একটু স্নেহ,একটু যত্ন আর একটু খেয়াল। যে কারো দ্বারা হতে পারে স্বামী অথবা পুত্র। তবে তিনি চান না তার পুত্রের কাছে স্বামীকে অসম্মান করতে। স্বামী! সে তো একান্তই তার। তাহলে তার সম্মান-অসম্মানটাও যে তারই।

সোবহান শাইখ চেয়ার ছেড়ে দাড়ালেন। কদম ফেলতে শাহিনা শাইখা অতিশয় ব্যাকুল হয়ে বললেন,

“খাবেন না? আমি নতুন করে খাবার নিয়ে আসছি।”

সোবহান শাইখ দাড়ালেন। স্ত্রীর দিকে তাকালেন তবে কিছু বললেন না। বিনা বাক্যে দোতলা সিড়ির দিকে হাঁটা ধরেছেন। তাঁর ভারিক্কি চালে শাহিনা শাইখা নিরব। ইশাদ মায়ের কাঁধে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে শাহিনা শাইখার চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বহু বছর ধরে লুকিয়ে রাখা জল!
___________________________

“তোর বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। আমার শ্বশুড়মশাই মানে তোর দাদা উনি নিজে এসে আমাকে পছন্দ করেছিলেন। তখন আমার বয়স পনেরো। যদিও সে আমলে পনেরো বছর মেয়েদের বিবাহযোগ্য গণ্য করা হতো কিন্তু আমার বাবা আপত্তি করেছিলেন খুব। বাবার আপত্তি আর তোর দাদার ইচ্ছে দুটোকে সম্মান করেই ঠিক হলো,এখন বিয়ের আকদ করে রাখবে। পরে সময় বুঝে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি তুলে নিবেন। আমার বাবা রাজি হলেন। দুজনের সম্মতিতে বিবাহকার্য শুরু হল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল আকদ হওয়ার পর। তোর দাদা আমাকে না নিয়ে যাবেন না। উগ্র আচরণ শুরু করে দিলেন। এমন অবস্থা যে আমি না গেলে উনি ফাঁস দিবেন। শেষে পরিস্থিতি সামলাতে বাবা বাধ্য হলেন আমাকে তুলে দিতে। তখনো তোর বাবার সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। শুধু চোখের দেখাটা পেয়েছিলাম। মানুষটার দিকে আমার চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল। সে কাউকে বুঝানোর মতো নয়। ফুলভর্তি বাগান হঠাৎ করে সব ফুল ঝরে গেলে বাগান যেমন শূন্য দেখায় ঠিক তেমন ছিল তোর বাবার মুখটি। বার বার ইচ্ছে হচ্ছিলো লাজ-লজ্জা ভুলে তোর বাবার হাতটা ধরি। জিজ্ঞেস করি,কী হয়েছে আপনার? কিন্তু সময়,সুযোগ,সাহস কোনোটাই কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। বাপের বাড়ির সব ঝামেলা মিটিয়ে যখন শ্বশুড় বাড়ি উঠলাম তখন তিনি কথা বললেন। রাশভারি গলা,’বাবা তুমি অন্যায় করেছো! খুব বড় অন্যায়।’ আমি শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাঁর দিকে চেয়েছিলাম। এতোটা সময় বাদে মানুষটি কথা বলল। এমন রুক্ষস্বরে? কেন? ছেলে হয়ে বাবাকেই বা এমন কথা বলে কিভাবে? তারপর তাঁর সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। দেখাও হয়নি। সে যে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি রেখে চৌকাঠ পেরুলো আর ফেরার নাম-গন্ধ নেই। এদিকে ছেলের দুশ্চিন্তায় আমার শ্বশুড় শয্যাশায়ী হলেন। তিনদিনের মাথায় পরকাল পাড়ি দিলেন। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে এলেন। তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত ছিল। কিন্তু একটাবারের জন্যও বাবা বলে ডাকলেন না। তাঁর এমন কঠোর রূপ আমাকে ভীত হতে বাধ্য করল। হলামও! না পারছিলাম তাঁর কাছে যেতে না পারছিলাম দূরে যেতে। এভাবেই কেটে গেল একমাস। এক সকালে উঠে দেখি উনি ব্যাগ গুছাচ্ছেন। বাইরে ভাড়া গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আমার রূহ কেঁপে উঠল। আমি হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে ছুটে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন? উনি আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তড়িঘড়িতে গাড়িতে বসে পড়লেন৷ গাড়ির ইঞ্চিনের শব্দে আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল। দরজার পাল্লায় মাথা ঠুকে মরে যেতে ইচ্ছে হল। দিশাহারা হয়ে মরণ চিৎকার তুলতে তোর বাবার হাত পড়ল আমার কাঁধে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন,’তোমার আমার বিয়েটা হয়েছে সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। আমার মন যে অন্য কোথাও পড়ে আছে। মন ছাড়া কি সংসার হয়? আমি চাইলেই তোমাকে ছুড়ে মারতে পারব না। আবার বেঁধে রাখতেও পারব না৷ তবে তোমাকে আমি মুক্ত করে দিয়ে গেলাম। তুমি যদি চাও তাহলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পার। আমি অনুমতি দিলাম। সাজিয়ে নিও তোমার নতুন সংসার।’

সেদিন তাঁর কথার বিপরীতে আমি একটাও কথা বলিনি। নিঃশব্দে তাঁর চলে যাওয়া দেখেছিলাম। তাঁর কথা মতো আমি নিজের মতো সংসারও সাজাতে শুরু করেছিলাম। তবে দ্বিতীয় নয় প্রথমটাই। বউ নয়,একজন মেয়ের ভূমিকা পালন করতে শুরু করলাম। এভাবেই বছর পেরুলো। আমি আর তোর দাদি ধরেই নিয়েছিলাম তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। যার কাছে তার হৃদয় বাঁধা ছিল হয়তো তাকে কেন্দ্র করেই নতুন সংসার পেতেছেন। একটু একটু করে তোর বাবাকে ভুলতে চাইছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। মায়া আর আকাঙ্ক্ষা আমাকে ঝাপটে ধরছিল। বার বার মন প্রশ্ন করছিল,কেন পড়ে আছি আশাহীন সংসারে? এমনি এক রাতে উনি হাজির। চোখে,মুখে বিরক্ত নিয়ে আমাকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আমি একটিরও জবাব দিতে পারছিলাম না। মনে মনে তখন অন্য ঝড় চলছিল। হুট করে আর্জি করে বসলাম,’আমার সন্তান চাই। আপনার বদলে নাহয় তাকেই ভালোবাসব।’ তিনি বাকরুদ্ধ! হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন। এমন একটা ভাব যেন অবাস্তব জিনিস চেয়ে বসেছি। যার শাস্তি হিসেবে ফাঁসিটাও কম। তবে আমার অবাস্তব চাওয়াটা পূরণ হলো। হয়ত সৃষ্টিকর্তা আমার উপর সদয় হয়েছিলেন। তার ইচ্ছেতেই তো সব। তুই পেটে আসতেই তোর দাদি সারাক্ষণ আমার কানে এক বুলি তুলতেন। বলতেন,চাঁদ মুখখান পৃথিবীতে আসতে দেও বউমা। তখন আকাশটাও তোমার নামে দলিল হবে। তারপর তুই এলি। সাথে করে ক্ষীণ আশাটাও নিয়ে এলি। মনে হলো তোর বাবা এইবার আমার বাধনে পড়বে। যে মানুষটা বছরেও একবার আসত না সে মাসে মাসে আসতে শুরু করল। একরাত নয়,পুরো এক সপ্তাহ থাকতে শুরু করল। তবে তখনো তাঁর মন অন্য কোথাও বাঁধা ছিল। আমার বাধনে নয়,তোর বাধনে বাঁধা পড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী হলো কে জানে! মানুষটা আবার দূরে সরে গেল। তোর মায়াটাও দিন দিন কেটে যেতে থাকল।”

শাহিনা শাইখা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ইশাদ মায়ের সান্নিধ্য ত্যাগ করল। গ্লাসভর্তি করে পানি নিয়ে আসে। মায়ের দিকে বাড়িয়ে বলল,

“আমি তো কিছু শুনতে চাইনি আম্মু।কেন বলছো? শুধু শুধু নিজের কষ্টটা বাড়াচ্ছো!”

শাহিনা শাইখা পানি খেলেন। চোখের পানি মুছে ইশাদকে নিজের পাশে বসালেন। ওর হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরে ভেজা গলায় বললেন,

“মানুষটা বড্ড বেশি পাষাণ। নাহলে তোর মায়াও কেন বাঁধতে পারল না?”
“বাঁধার দরকারও নেই। এবার বিরতি দেও। বন্ধ করো আশা বাঁধা। যে এতো বছরেও ধরা দেয় নি সে আর কখনো দিবে না।”

শাহিনা শাইখা ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন। উদাস গলায় বললেন,

“আশা ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? আমিও বাঁচব না। মৃত্যুকালেও তার মনের দেখা পাওয়ার স্বাদ জাগাব!”

ইশাদ কি মায়ের শেষ কথাটা শুনল? হয়তো শুনেনি। নাহলে তার পুরো শরীরে বিদ্যুৎ বেয়ে যেত। সে পানির গ্লাস রাখছিল। সহসা বলল,

“তুমি এক দিকে কিন্তু এখনো জিতে আছো আম্মু। হয়তো বাবার জীবনে তুমি দ্বিতীয় নারী কিন্তু স্ত্রী হিসেবে একমাত্র তুমিই আছো। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি।”

শাহিনা শাইখা চমকালেন। চকিত কন্ঠে বললেন,

“কি করে বুঝলি?”

ইশাদ মৃদু হাসল। ধীর গলায় বলল,

“তাহলে মিহি আমার বউ নয়,বোন হত।”

ইশাদ আর এক দন্ডও মায়ের রুমে দাড়াল না। মায়ের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। সে হাত ঘড়ি দেখল। নয়টা বেজে গেছে। সাড়ে নয়টার মধ্যে ক্লিনিকে পৌঁছুতে হবে। এক বিশেষ ক্ষমতাশালী লোক আসবেন।অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন এক সপ্তাহ আগে। তাকে অপেক্ষা করালে শুধু পেশাগত জীবনে নয়,ব্যক্তিগত জীবনেও খারাপ প্রভাব পড়তে পারে!
_________________

পাক্কা তিন ঘন্টা সময় লাগল ইশাদের রোগী দেখতে। সিরিয়াল শূন্য হতেই সে বাড়ির পথে ছুটল। অসস্থি হচ্ছে তার। বার বার মস্তিষ্কে তিহির আনাগোনা চলছে। রাতের অমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখার কারণটাও সে বের করতে পারছে না। একজন ডক্টর হয়েও সে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দাড় করাতে পারছে না। শুধু উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা জাগছে মনে। পথে চলতে চলতে ইমদাদের নাম্বারে কল দিল। নাম্বার ওয়েটিং দেখাচ্ছে। ইশাদ মেসেজ লিখল,

জনাব অশ্লীল!

ফোনে ফোনে নোংরামী শেষ হলে,কল দিয়েন। আপনার কল পেলে আমি বাধিত হব।

ইশাদ রিক্সায় উঠতেই তার মনে হল সে একটা ভুল করেছে। শুধু ভুল নয় অনেক বড় অন্যায়। আর এই অন্যায়টা হয়েছে তিহির সাথে। যেটা তিহি নিজেও অনুধাবন করতে পেরেছে। কারণস্বরূপ সে তার উপর অনেক রেগে আছে। এই রাগটা দূর করতে হলে তিহির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু ইশাদ ক্ষমা চায়নি। আর এই জন্যই অবচেতনে তিহি তার মধ্যে সঞ্চরণ করছে। ইশাদ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, খারাপ স্মৃতি ভুলতে হলে ক্ষমা দেওয়া ও পাওয়া অপরিহার্য!

বাসার কলিংবেল বাজাতে দরজা খুলে দিল মিহি। মুখে চমৎকার হাসি নিয়ে বলল,

“আপনি টমেটোর চাটনি খেতে পছন্দ করেন তাই না ইশাদ ভাইয়া? আমি শিখছি।। আন্টি আমাকে শেখাচ্ছেন। আর কী কী পছন্দ করেন?”

ইশাদও কিঞ্চিত হাসি নিয়ে বলল,

“ভাত আর ডাল। তুমি করতে পার?”

মিহি অতিশয় খুশি হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলল,

“এগুলো তো আমি পিচ্ছিকালেই শিখেছি।”
“বাহ! তাহলে তো হলোই আর কিছু শিখতে হবে না।”

মিহি মলিন কন্ঠে বলল,

“তাহলে টমেটোর চাটনি বানানো শিখব না?”

ইশাদ মিহিকে পাশ কেটে ভেতরে ঢুকল। গলার টাইটা ঢিলে করে ছোট্ট করে বলল,

“তোমার ইচ্ছে।”

ইশাদ পায়ে পায়ে নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে হাঁক দিল,

“টনু,জলদি আমার রুমে আয়।”

ইশাদ রুমে ঢুকেই কাগজ আর কলম নিল। খালি কাগজে কী লিখে পূর্ণ করবে ভেবেই পাচ্ছে না। ভাবনা পথে ঢুকতে ঢুকতে নিজেই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম তবুও একটি লাইন বের করতে পারল না৷ ইশাদ বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। রুমময় চলছে পায়চারি! হাতের কাগজটা এতক্ষণে পাখার কাজ করছে। কলমটা দাঁতে চেপে কিছুক্ষণ থমকে দাড়াচ্ছে। কিছু পেয়েছে ভেবে যেই না লিখতে যাবে অমনি তার শব্দভান্ডার শূন্য। ইশাদ বিরক্ত সাথে টনুও। ইশাদ নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত হল। শেষে কাগজে ছোট্ট করে লিখল,’Sorry’

খচখচ করে লেখা শেষ করে টনুর হাতে দিয়ে বলল,

“এটা আয়নাকন্যাকে দিয়ে আয়।”
“আয়নাকন্যা?”

টনুর প্রশ্নে ইশাদ জিভ কাটে। নিজের বেফাঁস কথাটা আড়াল করতে দ্রুত বলল,

“তোর তিহি আপাকে দিয়ে আয়।”
__________________________

রেখা ভূঁইয়া শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে ঝাড়ু হাতে মাকড়শার জাল ঝাড়ছেন। তিহিও চুপচাপ বসে নেই। সে ওড়না বেঁধে ঘর মুচছে।বালতিতে টুকরো কাপড়ের ময়লা পানি ঝরানোর মধ্যেই টনু হাজির। বলল,

“তিহি আপা?”

তিহি হাতের কাপড়টা বালতির পানিতে ছেড়ে দিল। ওড়না খুলে দরজার সামনে গিয়ে বলল,

“টনু ভাই আপনি?”
“এটা দিতে এলাম।”

টনুর হাত থেকে কাগজটা নিল তিহি। সংকোচে ভাজ খোলে। ভেতরে ছোট্ট লেখাটা দেখতেই তার শরীর রি রি করে উঠল। সে ভেতরে ঢুকে। কলম নিয়ে নিচে লেখে,’Not acceptable!’

তিহির বাকা হাতের ইংলিশে লেখা লাইন দেখে ইশাদ হতভম্ব। তবে বিস্ময় ভাবটা ক্ষনিকের মধ্যেই বরাদ্দ রইল। কিছু সময় যেতেই তার মেজার বিগড়ে গেল। তবে মেজাজটা সংযত রেখে লিখল,

‘Why?’

তিহি লিখল,

‘Admit your guilt first’

তিহির দ্বিতীয় উত্তরে ইশাদের রাগ চড়ে বসল। সে ইংলিশ লেখা বাদ দিয়ে বাংলায় লিখল,

‘ত= তিহি
ত=তেলাপোকা। আপনি তেলাপোকা সেজে আমার মাথার ভেতর উৎপাত শুরু করেছেন। সেই উৎপাত বন্ধ করার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।’

তিহি লিখল,

‘ই=ইশাদ
ই=ইদুর। আপনি ইদুর হয়ে শুধু আমাকে নয়,মিহিকেও কামড়াতে চাচ্ছেন। আপনার এই কামড়াকামড়ির শাস্তি এতো সহজে মাফ হবে না। দয়া করে অপেক্ষা করুন। আমি কঠোর শাস্তি নিয়ে হাজির হব!’

ইশাদ বড় বড় দুটো ক্রোধ মাখানো নিশ্বাস ফেলল। কাগজে কলম বসাতে টনু অনুরোধের সুরে বলল,

“আমি আর সিড়ি বাইতে পারুম না ছোটসাব। আমার ভাঙ্গা মাজা আলগা হইয়া যাইতাছে। শেষে দেখবেন, আমার মাথা তিহি আপার রুমে আর পা দুইটা আপনার রুমে পইড়া আছে। আমার শরীর দুই খন্ড হওয়ার আগেই আমারে মুক্তি দেন!

ইশাদ ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। টনুর মুখের করুণ দশা তাকে দমিয়ে দিয়েছে। কাগজ,কলম ফেলে স্নাগারে ঢুকে পড়ল।

তিহি এদিকে ইশাদের পরবর্তী বার্তার অপেক্ষা করতে করতে কাহিল। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“আম্মু,আমি গোসল করে আসি। আমাদের গোসলখানায় কল লাগিয়ে দিছে?”

রেখা ভূইয়া দেয়াল ছেড়ে সিলিংয়ে হাত দিয়েছেন। ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,

“হ্যাঁ। সকালেই লাগিয়ে দিয়েছে।”

তিহি আর সময় নষ্ট করে না। পড়নের জামাকাপড় গুছিয়ে গোসলখানায় ঢুকে পড়ে।
________________________

ইশাদ গোসল সেরে বাইরে বের হতেই কান নষ্ট হওয়ার জোগাড়। বাইরে থেকে কেউ বাজখাঁই গলায় চিৎকার করছেন। ইশাদ কোনো রকমে একটা টি-শার্টে মাথা ঢুকিয়ে বাইরে বের হল। সোজা রান্নাঘরের সামনে চলে গেল। ভেতরে রেখা ভূঁইয়া, শাহিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলছেন,

“ঐটা রুম না মাকড়শার কারখানা? যেদিকে তাকাই সেদিকেই মাকড়শার ঝুল! ধূলো ময়লার গন্ধে আমার এলার্জি শুরু হয়ে গেছে। নাই চুলা। রান্না করব কবে? তার মধ্যে আবার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিছেন কোন সাহসে? দেখেন তো আমি গরমে ল্যাতাল্যাতা হয়ে গেছি। ঘাম দিয়ে গোসল করানোর জন্যই ভাড়া দিছেন না? পানি বাঁচাবেন? এতো ছোট মন নিয়ে বাড়িওয়ালা সাজছেন? এমন বাড়িওয়ালার মুখে তো..”
“কী সমস্যা? আম্মুর সাথে এমন অভদ্রভাবে কথা বলছেন কেন?”

ইশাদ কঠিন মুখে রেখা ভূঁইয়ার কথা টেনে নিতে শাহিনা বেগম ছুটে এলেন ছেলের কাছে। হাত চেপে ফিসফিস করে বললেন,

“তুই এখানে কী করছিস? ভেতরে যা।”

ইশাদ প্রতিত্তোরে কিছু বলার সুযোগ পেল না। রেখা ভূঁইয়া তেড়ে এসে বললেন,

“ভেতরে যাবে কেন? আগে আমার রুমের বিদ্যুৎ ঠিক করবে তারপর ভেতরে যাবে।”

শাহিনা শাইখা আঁতকে উঠে বললেন,

“আমার ছেলে এগুলো পারে না। আমি ইলেক্ট্রিশিয়ানকে ডেকে পাঠাচ্ছি আপা। রুমটা অনেক দিন বন্ধ পড়ে ছিল তো তাই হয়তো সমস্যা হয়েছে। একটু শান্ত হোন। সরবত খাবেন? লেবুর সরবত বানিয়ে দেই?”

ইশাদকে জোর করে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন শাহিনা শাইখা। খালি গ্লাসে পানি ভরে চিনির কৌটো হাতে নিলেন। ইশাদ মায়ের আচরণে বিরক্ত প্রকাশ করে নিজের রুমের দিকে এগুলো। দোতলার সিড়ির শেষ ধাপ পার হয়ে দাড়িয়ে গেল। ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ছাদে উঠার সম্মুখে। মনে মনে চলছে তুমুল চিন্তার খেলা।
__________________

তিহি গোসল শেষ করে তোয়ালে খুঁজছে। সব কাপড় আছে কিন্তু তোয়ালে নেই। কোথায় গেল? সে কি আনতে ভুলে গেছে? তিহি ভেজা শরীরে দাড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করছে। চিন্তাশক্তি ঝাপসা! গোসলখানার দরজা অল্প ফাঁক করে ডাকল,

“আম্মু? ও আম্ম। তোয়ালে আনতে ভুলো গেছি। দাও তো।”

নিজের কথার প্রেক্ষিতে কোনো সাড়া আসছে না। তিহি আবার ডাকল। এবারও সাড়া নেই। তাহলে কি আম্মু কোথাও গিয়েছে? এখন সে কী করবে? কতক্ষণ ভেজা অবস্থায় থাকবে? তিহি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এক মিনিট,দুই মিনিট,পাঁচ মিনিট। এবার সে ধৈর্যচ্যুত হল। দরজার ফাঁকটা বড় করে বাইরে তাকাল। রুম পুরো ফাঁকা। আম্মুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে তোয়ালে দেখা যাচ্ছে। বিছানার উপর পড়ে আছে। তিহি দ্রুত ভেবে ফেলল,সে নিজেই তোয়ালে নিবে। তাদের রুমে কারো আসা-যাওয়া নেই। আসলে আম্মু আসবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। আর দুই হাত দুরে বিছানা থেকে তোয়ালে নিতে সময়ই বা কতটুকু লাগবে? কেউ দেখবে না। যাবে,নিবে,চলে আসবে!

তিহি ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। দুই কদম ফেলে তিন কদম ফেলার পূর্বে মনে সতর্কতার বাড়ি পড়ল। কী ভেবে দরজায় তাকাতেই মানবমূর্তি ধারণ করল। ইশাদ দাড়িয়ে আছে। দরজার বাইরে নয়,ভেতরে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here