তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৩)

0
833

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৩)
#রোকসানা_রাহমান

“নাম?”

সুমধুর তরঙ্গের মতো ছোট্ট প্রশ্নে ইশাদের হুশ এল। সে কোথায় হারিয়েছিল কে জানে? সামনে তাকাতে দেখল খালি চেয়ারটি খালি নেই। সেখানে একজন মহিলা বসে আছেন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। বেশিও হতে পারে! মুখ দেখে বুঝার জো নেই। ফর্সা বর্ণের গোলগাল মুখটিতে চশমা এঁটে আছে। ঠোঁটে কি লিপস্টিক পড়েছে? মুহুর্তেই ইশাদের মনে বাড়ি খেল। সব ছেড়ে তার চোখ ঠোঁটে আটকাল কেন? তবে কি তিহি ঠিক? সে আসলেই নষ্ট পুরুষ? ভাবনা পথেই চোখের সামনে তিহির মুখটি ভেসে উঠেছে। কানের কাছে বাজছে বিতৃষ্ণার ডাকটি,’নষ্ট পুরুষ!’

ইশাদ চমকে উঠে। দ্রুত চোখ রাখে আশেপাশে। তার অতিশয় ব্যাকুলতা ধরতে পারলেন ড.রিদিমা। শান্ত স্বরে বললেন,

“কাউকে খুঁজছেন?”

ইশাদ দ্বিতীয় দফায় চমকাল। ড.রিদিমার দিকে কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে থাকে। চোখ নামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর ঠোঁট নাড়ল,

“না।”
“সত্যি?”

ইশাদ পুনরায় চোখ মেলে তাকায়। বিপরীতে কিছু বলতে পারে না। হঠাৎ করেই নিজের মধ্যে ভার কিছু অনুভব করছে। কেমন যেন অতিরিক্ত কিছু। যা সে আগে কখনো বহন করেনি। ইশাদ চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে। নিজের পকেট চেক করে। নাহ! কিছুতো নেই। তাহলে?

ড. রিদিমার সহজ মুখটি ধীরে ধীরে গম্ভীরের রূপ নিচ্ছে। সাধারণত পেশেন্টদের সাথে যথা সম্ভব আন্তরিক ও সহজ ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। যাতে খুব সহজেই দুজনের মধ্যে এমন আস্থা গড়ে উঠতে পারে যার দরুনে পেশেন্ট কুষ্ঠাবোধ,সংশয়,সংকোচ,জড়তায় আটকে না থাকে। তিনি যথারীতি গম্ভীর ভাব কাটিয়ে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন,

“পানি খাবেন?”

ইশাদ এবারও কোনো জবাব দিল না। ড.রিদিমাও হয় তো জবাবের আশা করেননি। তিনি পানির গ্লাসটি এগিয়ে দিলেন। ইশাদ এক ঝলক পানির দিকে তাকাল। তারপর চেয়ারে বসে গ্লাস তুলে নেয়। ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি খেয়ে খালি গ্লাসটি টেবিলে রাখে। বেখেয়ালিতে হালকা শব্দ হয়। ইশাদ ব্যস্ত গলায় বলে,

“সরি।”

ড. রিদিমা সহজ হাসি উপহার দিলেন। নরম গলায় বললেন,

“নামটা এখনো বলেননি।”

হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় চেয়ার থেকে কিঞ্চিৎ উচু হল ইশাদ। রিদিমার দিকে সামান্য ঝুঁকে ডান হাতটি বাড়িয়ে বলল,

“আমি ইশাদ। ড.ইশাদ শাইখ। আই স্পেশালিষ্ট!”

ড.রিদিমা নির্দ্বিধায় হাত মেলালেন। ঠোঁটে হাসির রেখা দীর্ঘ হল। চোখের মণিতে সন্দেহ ভাসছে। রসিকতার সুরে বললেন,

“স্বয়ং ডক্টর আমার চেম্বারে হাজির। গুরুতর কিছু কি?”

ইশাদ মাথাটা খানিকটা দুলাল। যার মানে হ্যাঁ /না কোনোটাই বুঝা যাচ্ছে না৷ তবুও বুদ্ধির ছক কেটেই ড.রিদিমা পুনরায় বললেন,

“কী সমস্যা?”

এবার আর সময় ব্যয় করে না ইশাদ। গম্ভীর কন্ঠে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে,

“কয়েকদিন আগে একটি মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও আপত্তিকর অবস্থায়। কিছু ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টিও সেখান থেকে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি। আরো ঘেটে গিয়েছে। আরো জড়িয়ে পড়েছি। অবস্থা এতোটাই বেগতিক হয়েছে যে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। ভয়াবহ সেই স্বপ্ন। ভয়ঙ্কর রকম লোমহর্ষক অনুভূতি!”

এতটুকু বলেই ইশাদ থেমে গেল। তার কন্ঠে উদাসের ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ড.রিদিমার দিকে থেকেও যেন নেই। হারিয়ে গিয়েছে অন্য কোথাও! ড. রিদিমা ইশাদের হাতের দিকে তাকালেন। কথার ছলে অনেক্ষণ পূর্বেই ডান ও বা হাত একসাথে টেবিলের উপর রেখেছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন ইশাদের হাতের লোমগুলোও ইশাদের অনুভূতির সাথে সায় দিতে মাথা তুলে দাড়িয়েছে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন৷ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু ভাবলেন। অতঃপর সংশয়িত গলায় বললেন,

“খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল না ড.ইশাদ? এই মুহূর্তে আপনি ডক্তর নন। একজন পেশেন্ট। সেই দিক থেকে আপনার সমস্যাটা বিস্তারিতভাবে বলা উচিত। আমার মনে হয় আপনি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন।”

শেষ কথাটা মৃদু হেসে বললেন ড. রিদিমা। ইশাদও ঠোঁটে হাসি এনে সম্মতি জানায়। একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। ভেতরে ভেতরে সবটা গুছিয়ে নিয়ে বিরামহীন শুরু করে।

যথেষ্ট মনোযোগ সহিত সবটা শোনার পর ড. রিদিমার প্রথম প্রশ্ন,

“মেয়েটি সুন্দরী?”

ইশাদ খানিকটা বিব্রত নিয়ে বলল,

“জি।”
“অসম্ভব রকমের সুন্দরী?”

ইশাদের ভ্রূ কুঁচকে যায়। কাঠ গলায় আবারও বলে,

“জি।”

ড.রিদিমা মিষ্টি হাসলেন। চিকন সুরের হাসির শব্দটা ইশাদের কানের গোড়ায় পৌঁছায়। খানিকটা লজ্জা উড়ে এসে পড়ে ইশাদের মুখে। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। তন্মধ্যেই ড. রিদিমা বললেন,

“আপনার মতে আপনি পুনর্জন্ম করেছেন?”
“নিশ্চিত নই৷ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে আছি।”

ড. রিদিমা একটু নড়েচড়ে বসলেন। চোখের চশমাটা খুলে পাশে রাখলেন। টেবিলের উপর হাত রেখে। গম্ভীর স্বরে বললেন,

“মেয়েটির নাম কী বললেন?”
“তিহি।”
“তাহলে প্রথমে তিহির ব্যপারটি পরিষ্কার করি। কি বলেন?”

ইশাদকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিলেন না ড. রিদিমা। নিজ থেকেই বলতে শুরু করলেন,

“আমাদের চলার পথে লক্ষ মানুষের সাথে দেখা হয়। তার মধ্য থেকে হাজার মানুষের সাথে টুকিটাকি কথা হয়। তার মধ্য থেকে একশ মানুষের সাথে সম্পর্ক মোটামোটি পর্যায় চলে যায়। এই যেমন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয় তারপর আবার হঠাৎের পাতায় পড়ে যায়। আর এই একশ মানুষের মধ্যে এক,দুই,চার,পাঁচ,দশজনের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক হয়। এটাকে আত্মার সম্পর্কও বলা যেতে পারে। যার সাথে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে যখন-তখন কথা কাটাকাটি চলতেই থাকে। ঠিক?”

ড.রিদিমার কথায় ইশাদ মাথা নাড়লে তিনি আবার বললেন,

“এইবার বলুনতো এই লক্ষ লক্ষ মানুষ থেকে দুই/এক জনই কেন কাছের হয়? অন্যরা হয় না কেন?”

ইশাদ কোনো রকম ভাবনাতে গেল না। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল,

“এত মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখার মতো সময়,সুযোগ,ধৈর্য্য কোনোটাই থাকে না।”
“ঠিক। এবার আমার পরের প্রশ্ন হলো,সবাইকে পিছিয়ে ফেলে এই দুই/একজন কী করে সামনে এসে দাড়ায়?”

ইশাদ খানিকটা ভাবল। তারপর বলল,

“বিশেষ কারণ,বিশেষ প্রয়োজন,বিশেষ ব্যক্তিত্ব, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু হতে পারে।”

ড.রিদিমার মুখটি হাস্যোজ্জ্বল। উচ্ছল গলায় বললেন,

“আমরা মনে হয় সমস্যার সমাধান পেয়ে গিয়েছি। তিহি মেয়েটি আপনার জন্য বিশেষ হয়ে উঠেছে। সেটা কি বুঝতে পারছেন নাকি বিশদ আলোচনা করব? তার জন্য আমাকে আপনার নিজের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিতে হবে।”

ইশাদ কিছুক্ষণ নিরব রইল। খানিকবাদে বলল,

“বুঝতে পেরেছি। তারপর বলুন।”
“এক কথায় যদি বলি তাহলে আপনার পুনর্জন্ম এবং স্মৃতিমুছন কোনোটাই ঘটেনি।”
“আপনি এত সিউর হচ্ছেন কী করে?”

ইশাদের প্রশ্নে ড.রিদিমার মুখের সহজ হাসিটা গাঢ় হল। চেহারায় ফুটে উঠেছে সন্তোষের ছাপ। মুখে হাসির ছটা নিয়েই বললেন,

“স্বপ্নের মধ্যে আপনি তিহিকে আঘাত করেছেন?”

ইশাদের দ্রুত উত্তর,

“না।”
“কিন্তু আপনি তো বললেন,তিহি নামের মেয়েটির শরীরে আঘাতের দাগ ছিল। তাহলে আঘাত ছাড়াই দাগ কী করে এসেছে?”

ইশাদ চুপ। প্রশ্নের উত্তরটা তার জানা নেই। ইশাদের নিরবতা ভেঙে ড.রিদিমা বললেন,

“আমার মতে আপনি কোনো স্বপ্নই দেখেননি। আর যদি স্বপ্ন দেখেও থাকেন তাহলে সেখানে আপনারা দুজন বাদেও আরেকজন ছিল। যার উপস্থিতি আপনি অনুভব করতে পারেননি। কারণ আপনি তাকে চেনেন না। ড.ইশাদ আপনি হয়তো এটা জেনে থাকবেন,মস্তিষ্ক কখনোই মুখের রূপ দিতে পারে না। অর্থাৎ আমরা স্বপ্নে যাদের দেখি তাদেরকে আমাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে দেখেছি! সেটা হতে পারে আশেপাশের পরিচিত কিংবা রাস্তায় হুট হাট কাউকে দেখা। যেটা আমরা মনে রাখতে না পারলেও আমাদের সাবসেন্স মাইন্ড সংরক্ষণ করে রাখে। যা পরবর্তীতে স্বপ্নে আসে। এবং ঘুম থেকে উঠার পর ভুলে যায়। সেই তৃতীয় ব্যক্তিকে আপনি চলার পথে আজ অবধি দেখেননি তাই তার উপস্থিতি টের পাননি। তৃতীয় ব্যক্তির ব্যাপারটা আমি জোর দিচ্ছি না। কারণ আমার মনে হচ্ছে আপনি যেটাকে স্বপ্ন বলছেন সেটা আদৌ স্বপ্ন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করছি।”

ইশাদ চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করল। কিছুটা টেবিলের দিকে ঝুঁকে এসে গভীর গলায় বলল,

“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“সাধারণত আমরা একটি স্বপ্ন ঘুম থেকে উঠার পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পঞ্চাশ শতাংশ ভুলে যায়। পরবর্তী দশ মিনিটে নব্বই শতাংশ। কিন্তু আপনি তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলেছেন। মানে আপনার সবটা মনে আছে। আর এটা তখনি সম্ভব যখন আপনি নিজেই স্বপ্নটি তৈরী করবেন। এটাকে স্বপ্ন নয় কল্পনা বলতে পারি। আপনি ঘুমিয়ে নন,জেগে থেকে পুরোটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। পরবর্তীতে সেটাকে স্বপ্নের রূপে দেখার জন্য ব্রেইনকে আহ্বান করেছেন।”

ইশাদের চোখে বিস্ময়ের মেলস বসছে। মাথার ভেতরটা ফাঁপা মনে হচ্ছে। নতুন করে সবকিছু সাজানোর জন্য আগ্রহ নিয়ে চাইল ড.রিদিমার দিকে। তার প্রশ্নবিদ্ধ চোখ দেখেই ড.রিদিমা আবার যোগ করলেন।

“আপনি মনেপ্রাণে চাচ্ছিলেন তিহির সমস্যার কারণটি জানতে কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। এদিকে আপনি নিজের হারটাও মেনে নিতে পারছিলেন না। ফলে অজান্তেই আপনি কল্পনায় নিজের মতো করে কারণ তৈরী করে ফেলেছেন। যেহেতু তৃতীয় ব্যক্তিটি আপনার অজানা সেহেতু তার জায়গায় স্বয়ং আপনি চলে এসেছেন।

ড. রিদিমা আরো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু ইশাদের মুখের দিকে চোখ পড়ায় আর কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন,

“আমার মনে হয় আপনার কিছু সময়ের প্রয়োজন। আজ এই পর্যন্তই থাক। আপনি সময় নিয়ে সবটা গুছিয়ে ভাবুন। আমার মনে হয় এরপরে আমাকে আর প্রয়োজন হবে না। আর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আবার চলে আসবেন।”

কথাটা শেষ করেই মিষ্টি হাসলেন ড.রিদিমা। ইশাদ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

“কোনো উপদেশ?”

ড. রিদিমাও দাড়ালেন। চশমাটা হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন,

“পরিবার কিংবা ঘনিষ্ঠদের সাথে ভালো সময় কাটান। বিশেষ এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ হলো,আপনার মাথায় যে ব্যামোটা হয়েছে সেটা সারাতে হলে হয় তিহির সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী করুন নাহয় দূরে সরে আসুন। মাঝামাঝিতে থাকাটা আপনার জন্য বিপদজনক!”
“ধন্যবাদ।”

ড.রিদিমার চেম্বার ছাড়তেই ইশাদের ফোন বেজে উঠল। ইমদাদ কল দিয়েছে। এই মুহূর্তে ইমদাদকে তার উঠকো ঝামেলা ঠেকল। তাই কল কেটে ফোন পকেটে রেখে দেয়। গেইট ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। খালি রিকশার জন্য রাস্তায় চোখ রাখতেই ইমদাদকে দেখতে পেল। সে রিকশায় বসে আছে। ইশাদকে হাতের ইশারায় ডাকছে। চোখে,মুখে অসন্তোষ বজায় রেখে রিকশায় উঠে ইশাদ। বসেই ডান ভ্রূটা কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল,

“নাকে কী হয়েছে? আমি তো তোকে মারি নি।”

ইমদাদ গলায় হাত চেপে বলল,

“বিশাল কাহিনি। পরে বলি? এখন গলা ব্যথা!”

________________________________

বাসায় ফিরতে ফিরতে ইশাদ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে উপরে উঠবে না। ভুলক্রমেও না। তিহি নামের মেয়েটিকে সে ভুলে যাবে। বার বার জপতে শুরু করল,তিহি নামের কাউকে চিনি না। তিহি একটি দুঃস্বপ্ন! আর দুঃস্বপ্ন মনে রাখতে নেই। মনে রাখলেই আযরাইল চলে আসবে। আমার রূহটা টেনে ছিড়ে নিবে! কিন্তু আমি এত দ্রুত মরতে চাই না। ঠোঁটের আগায় বিড়বাড়ানি নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফাটায় বসে পড়ল ইশাদ। আজ সারাদিন পরিবারকে সময় দিবে। গল্প করবে,শব্দ করে হাসবে,তর্ক-বিতর্কে জড়াবে,প্রয়োজনে নাচানাচিও করবে। মস্তিষ্কের বিশ্রামের প্রয়োজন। নাহলে উল্টা-পাল্টা সংকেত দিবে!

বিকেল শেষে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অথচ কার সাথে গল্পটা করবে সেটাই বাছাই করতে পারছে না ইশাদ। যার দিকে তাকাচ্ছে তাকেই দুঃখী দুঃখী লাগছে। সবশেষে সে টনুকে বেছে নিল। টনু সদর দরজার পাশে বসে জুতায় কালি লাগাচ্ছে। ইশাদ হাঁক দিল,

“টনু,এদিকে আয়।”

টনু ছুটে আসে। একহাতে জুতো অন্যহাতে কালি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ইশাদ দ্বিধায় পড়ে গেল। সে কি জুতোয় কালি লাগাচ্ছে নাকি মুখে? তন্মধ্যেই সোবহান শাইখ এলেন। ইশাদের পাশের সোফায় বসতে বসতে বললেন,

“আমার রুমের কলে পানি আসছে না। তুমি কী ছাদে গিয়ে দেখে আসবে কী সমস্যা?”

ইশাদ সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার গলায় উত্তর দিল,

“না। আমি এখন ব্যস্ত।”

সোবহান শাইখ পাশ ঘুরলেন। ছেলের দিকে গাঢ় দৃষ্টি। সে পা উঠিয়ে সোফায় বসে আছে। কোলের উপর কুশন। সেটা নেড়ে-চেড়ে খেলছে। তিনি শক্ত গলায় বললেন,

“কী নিয়ে ব্যস্ত?”
“গল্প। আমি এখন টনুর সাথে গল্প করব।”

ছেলের অভদ্র আচড়ণে সোবহান শাইখ বিস্ময় ও হতাশ হলেন। নিরবে বসার রুম ত্যাগ করলেন।

ইশাদের সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। তার ঠোঁটের বিড়বাড়ানি আরো বেড়ে গেল। তার মাঝেই টনুকে কিছু জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হতে শাহিনা শাইখা ডেকে উঠলেন,

“ইশাদ। বাবা একটু শোন তো।”

ইশাদ কুশনটি ফেলে রান্নাঘরে চলে গেল। মায়ের সামনে দাড়াতে উনি একটি বাটি ধরিয়ে দিলেন ইশাদের হাতে। বললেন,

“এটা উপরের আন্টিকে দিয়ে আয়।”

ইশাদ মায়ের হাতে বাটি ফেরত দিয়ে বলল,

“পারব না।”

শাহিনা শাইখার মুখ হা’হয়ে গেল। ইশাদ রান্নাঘর ছেড়ে চলে আসতে গিয়েও থেমে গেল। অসহায় গলায় বলল,

“আমাকেই দিয়ে আসতে হবে? টনুকে বলো।”
“ও তো জুতো পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজেই অপরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় কিভাবে পাঠাই?”

ইশাদের ইচ্ছে হলো টনুকে বুড়িগঙ্গায় কয়েকবার চুবিয়ে আনতে। যে সামান্য জুতো পরিষ্কার করতে পারে না তার বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরা উচিত। শাহিনা শাইখা ছেলেকে পাশ কাটতে কাটতে বললেন,

“আচ্ছা আমিই দিয়ে আসি।”

রান্নাঘর ছেড়ে সিড়ির দিকে পা পড়তেই ইশাদ দৌড়ে এল। চোখে,মুখে অনিচ্ছা,অপ্রসণ্ন নিয়ে ঢাকনা ফেলা পেয়ালাটি কেড়ে নিল। বিষন্ন স্বরে বলল,

“আমি যাচ্ছি।”

শাহিনা শাইখা হাসলেন। ছেলের মাথায় সস্নেহের হাত রেখে রান্নাঘরের দিকে পা রাখলেন।

দোতলা সিড়ি শেষে ছাদের সিড়িতে পা ফেলে ইশাদ। এক পা করে উপরে উঠছে আর মনে মনে পণ করছে,তিহির দিকে তাকাবে না। কেউ জোর করে টেনে ধরলেও তাকাবে না! কয়েক ধাপ পার হতেই তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। তিহি উপর থেকে নামছে। ইশাদের মতো সেও থেমে গিয়েছে। দুজনে একি ধাপে দাড়িয়ে আছে। ভিন্ন দিকে মুখ করে। ইশাদ শ্বাসরুদ্ধ সময়টাকে দ্রুত শেষ করতে উপরে উঠে গেল। এক লাফে তিনটে ধাপ পার করে করে।

তিহিদের রুমের সামনে এসেই ইশাদ থ হয়ে রইল। দরজা বাইরে থেকে লাগানো। ভেতরে কেউ নেই নাকি? সে বন্ধ জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরে ঢু মারার চেষ্টা করছে। তার ধারণা,রেখা আন্টি ভেতরেই আছে। এই দস্যি মেয়ে উড়াল পারার জন্য হয়তো বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে!

“চুরি করার মতলব আঁটছেন?”

ইশাদ মৃদু কম্পনে চমকে উঠে। পেছনে ঘুরতে ঘুরতে তিহি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল,

“আপনি কি আগের জন্মে ব্যাঙ ছিলেন?”

ইশাদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। এতদিন পুনর্জন্ম নিয়ে মরেছে। এখন আবার আগের জন্ম নিয়ে মরতে হবে?

“নিশ্চয় কোনো রাজকুমারীর সাথে নোংরামী করেছিলেন। শাস্তিস্বরূপ রাজা আপনাকে ব্যাঙ বানিয়ে দিয়েছিল তাইনা? আগের জন্মের অভ্যাস এখনো মনে রাখতে হবে?”

ইশাদ না চাইতেও প্রশ্ন করে বসল,

“আমি দেখতে ব্যাঙের মতো?”
“সেটা কখন বললাম? বলেছি ব্যাঙের মতো অভ্যাস। ঐযে কিছুক্ষণ আগে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি বায়লেন।”
“আপনি কি আগের জন্মে কাক ছিলেন?”

তিহি কপট রাগ নিয়ে বলল,

“আমি কাক হতে যাব কেন?”
“লাফিয়ে লাফিয়ে চললে যদি ব্যাঙ হয়,অযথা ক্যা ক্যা করে ঝগড়া করলেও কাক হয়। যেটা আপনি শুরু থেকে আমার সাথে করে আসছেন। আগের জন্মেও ঝগড়ুটে ছিলেন? নিশ্চয় আপনাকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করতে কাক বানিয়ে দিয়েছিল তাই না?”

তিহি রাগে গর্জে উঠে। ইশাদের কলার খামচে ধরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজার সিটকিনিতে হাত লাগাতে গেলে ইশাদ সামনে এসে দাড়ায়। হাতের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আম্মু দিয়েছে।”

তিহি গরম চাহনি ফেলে বাটিটা ছিনিয়ে নিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যায়। কিন্তু পারে না। তার আগেই ওর বাম হাতের কব্জী চেপে ধরে ইশাদ। তিহি কপাল কুঁচকে তাকালে ইশাদ নরম গলায় বলল,

“আপনি চাইলে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি।”

তিহি চুপ। তার মুখ থেকে রাগের ধারা ঝরে পড়ছে মাটিতে। মোহতা ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই বলল,

“ছি! আপনার মতো নষ্ট,লম্পট,চরিত্রহীনের সাথে আমি কেন বন্ধু পাতব? যেচে নষ্ট হতে?”

এমন একটা মুহূর্তে এই ধরনের কথা আশা করেনি ইশাদ। আশা ব্যহত হওয়ায় ক্রোধ ফেটে পড়ে তার সর্ব শরীরে। অনু পরমানুতে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। রাগটা একটুও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে না ইশাদ। পুরোটাই ঢেলে দিতে মুষ্ঠিতে থাকা হাতটা মুচড়িয়ে নেয়। তিহির পিঠের সাথে বলপ্রয়োগে চেপে ধরে। তিহিকে ঠেলে দরজার ঠিক পাশেই চেপে ধরে অগ্নিঝরা কন্ঠে বলল,

“কিছু বলছি না দেখে বেশি সাহস হয়ে গিয়েছে? এখনো এক ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছেন। বার বার আমার চরিত্রে আঙুল তুলছেন। কেন করছেন? কী সমস্যা? সেদিনের ঘটনা নিছকই ভুল ছিল। তার জন্য তো আমি সরি বলেছি। তাও মানছেন না। সারাক্ষণ এক টপিক নিয়ে মাথায় আগুন জ্বেলে দিচ্ছেন। অসহ্য একটা! কী চান বলুন তো। কী করলে মুক্তি দিবেন?”

তিহির হাত থেকে বাটি পড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। অস্ফুট স্বরে বলল,

“রাক্ষস,নির্দয়,নিষ্ঠুর ছেলে। আমাকে ব্যথা দিয়ে নিজে মুক্তি চাচ্ছে। আগে তো আমায় মুক্তি দিন।”

তিহির ব্যথাতুর কন্ঠে ইশাদের সব রাগ পানি। তিহির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার এক গাল দেয়ালের সাথে ঘেষা। অন্যগালে চোখের পানিতে ভেজা। ইশাদের মায়া হল। মায়া তো কাটাতে পারলই না। উপরন্তু মোহঘোরে ডুবে গেল। ডুবন্ত মনেই আবারও ভুল করে বসল। তিহিকে অবাক করে দিয়ে ইশাদ আরেকটি চুমু খেল। কানের ঠিক নিচের গলার ভাজে!

তিহি ক্ষণকাল মানবী মূর্তির রূপ ধারণ করল। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছাতেই রেখা ভূঁইয়ার গলা আসল,

“তিহি মা। এত রাতে কোথায় গেলি? রান্নাঘরে? কী ফেলেছিস? কতবার নিষেধ করেছি রান্নাঘরে যাবি না।”

ততক্ষণে ইশাদের সম্বিৎ এসেছে। সে তিহিকে ছেড়ে লাফিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। তিহি তৎক্ষনাৎ মায়ের উদ্দেশ্য বলল,

“কিছু পড়েনি আম্মা। পানি খেতে এসেছি। তুমি থাকো আমি এখনি আসছি।”

তিহি কথা শেষ করেই সিড়ি ঘরের দিকে দৌড় দিল। দ্রুত সিড়ি কেটে সোজা ইশাদদের ডাইনিংয়ে চলে আসে। শাহিনা শাইখা রাতের খাবার সাজাচ্ছেন। সোবহান শাইখও সেখানেই উপস্থিত। তিহি হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে উঠল,

“আন্টি! আন্টি,আপনার ছেলে আমাকে..”

শাহিনা শাইখা তিহির কাছে আসেন। উদ্বিগ্ন নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন? কী হয়েছে? দাড়াও আগে পানি খাও।”

শাহিনা শাইখা দ্রুত গ্লাসে পানি ঢাললেন। তিহির হাতে গ্লাস তুলে দিতে সে এক নিশ্বাসে সবটা পানি খেয়ে নিল। গ্লাস ফেরত দিয়ে আগোর কথা সম্পূর্ণ করার জন্য উদ্যত হতে চোখ পড়ে পাশে। ইশাদ অসহায়ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। তিহির চোখ তার দিকে পড়তেই সে কানে ধরে ফেলে। উঠবসও শুরু হয়ে গিয়েছে। উঠবস করতে করতে কান থেকে হাত সরিয়ে করজোরে তুলে কিছু একটা ইশারা করছে। তিহি কি সে ইশারা বুঝল? তার মধ্যেই মিহি চেঁচিয়ে বলল,

“ইশাদ ভাইয়া,আপনি কান ধরে উঠবস করছেন কেন? স্কুল স্কুল খেলছেন?”

মিহির কন্ঠ পেয়ে আরো দুজোড়া চোখ পড়েছে ইশাদের দিকে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here