তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৭)

0
889

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৭)
#রোকসানা_রাহমান

দুপুরের কড়া রোদ এখন অনেকটাই নিভে এসেছে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে বিকেলের মিষ্টি আভা,মৃদু বাতাস। পথপ্রান্তে কচিকাঁচাদের দুরন্ত কোলাহল! এই সময়টাতে বাচ্চাদের আনোগোনাই চোখে পড়ে বেশি। ইশাদ হাতে ফোন নিয়ে গেইট পার হতে একটা বাচ্চার সাথে ধাক্কা খেল। ইশাদ জ্ঞানীভাব নিয়ে ছোট্ট ধমক দিল। সতর্ক করে বলল,’আস্তে দৌড়া! এখনি তো ফেলে দিচ্ছিলি।’ দশ কী বারো বছরের ছেলেটা কর্ণপাত করল না। সে নিজের মতো দিব্বি দৌড়িয়ে রাস্তার অন্য পাশে চলে গেল। তার পেছন পেছন শব্দ হাসি নিয়ে আরেকটা বাচ্চা ছুটছে। ইশাদ সেদিকেই কিয়ৎকাল চেয়ে থাকে। অতঃপর ফোনে মনোযোগ রাখে। ইমদাদের নাম্বারে কল ঢুকিয়ে পা সচল করে। গন্তব্য বাড়ির পেছন দিক।

ইমদাদের নাম্বারে কল ঢুকেছে। রিং হচ্ছে পরপর। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। মৃদু রাগ ফুটে উঠে ইশাদের নাকের দু পাশে। কপালে দীর্ঘ ভাজ ফুটে। দ্বিতীয় বারের মতো কল ঢুকাতে নাসা ছিদ্রে ধোয়ার মতো আক্রমণ করে কড়া দুর্গন্ধ! ইশাদ বাম হাতে নাক চেপে ধরে চারপাশে চোখ বুলায়। তিন শতাংশেরও অধিক এই খোলা জায়গাটি ইশাদের দাদা পুত্র সোবহান শাইখকে উপহার দিয়েছিলেন। সাথে ছোট্ট ইচ্ছেও পোষণ করেছিলেন। ছোট্ট স্কুল খোলার। যেখানের প্রধান শিক্ষক হবেন পুত্র সোবহান শাইখ। তবে যৌবনকালে নয়,প্রৌঢ়কালে। সোবহান শাইখ পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। সরকারী শিক্ষক। তিনি চাননি ছেলের স্বপ্ন,লক্ষ্যকে আঘাত করতে। তাই দলিল হাতে দিয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলেন,’যেদিন সরকার তোরে বহিষ্কার করব ঐ দিন আমার শখের স্কুলে মাস্টারি করবি। চাইলে বেতনও দিমু। এক দমকা ঝড়ে সব শেষ! বাবা-ছেলের মান অভিমানে ইচ্ছে চাপা পড়ে। আজও সেই ইচ্ছে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। ইশাদের বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস! পুনরায় শ্বাস টেনে নিতে যেন দুর্গন্ধটা নাক ছুঁয়ে পেটে চলে গেল কড়াভাবে। পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফাঁপা ঢেকুর! মুখে তেতো লালা জমতে চোখে পড়ে মরা ইঁদুরের বিষ্ঠা। ইশাদ খেয়াল করল খোলা জায়গাটিতে যেমন ইট,বালুর ছোঁয়া পায়নি তেমন যত্নশীল দুটো হাতেরও ছোঁয়া পায়নি দীর্ঘদিন। একা মা আর কত দিক সামলাবে? ইশাদের প্রশ্ন ঢাকা পড়ল ফোনের রিংটোনে। ইমদাদ কলব্যাক করেছে। ইশাদ অন্য দিকে সরতে সরতে রিসিভ করল,

“সরি,বন্ধু। টয়লেটে ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারিনি।”

ইশাদ ঝাঁজ নিয়ে বলল,

“কোনকালে রিসিভ করতে পেরেছিস বল তো? আমার কি মনে হয় জানিস? তোর মতো ব্যস্ত মানুষের ফোন ব্যবহার করাই উচিত না। ফেলে দিলেই পারিস। নাহয় আমার কাছে নিয়ে আয় এক আছাড়ে কত খন্ড করতে হয় শিখিয়ে দেব।”

ইমদাদ দ্রুত কণ্ঠে বলল,

“আমার ফোন ভাঙলে যদি তোর রাগ নামে তাহলে আমি তাই করতে প্রস্তুত। কিন্তু বন্ধু তারজন্য তোর বাড়ি যাওয়া লাগবে কেন? আমার বাড়ির মেঝেও শক্ত আছে। তুই শুধু একবার বলে দেখ,কত টুকরা করি। গুনে গুনে যোগফল জানাব তোকে।”

ইশাদের ভ্রূ কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়। সন্দহের সুর তোলে বলল,

“হঠাৎ আমার বাড়ি আসতে নাকোচ প্রকাশ করছিস। ব্যাপার কি? কাল অবধিও তো বিয়ে খাবি বলে কান ঝালা পালা করে দিচ্ছিলি।”

ইমদাদ শুকনো ঢোক গিলল। স্বাভাবিকস্বরে বলল,

“তোকে নতুন কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছি না। এমনিতেও জোর করে বিয়ে খেতে গিয়ে তো আর ব্যক্তিত্বে অপমান ঢালতে পারি না,তাইনা?”

ইশাদের ভ্রূজোড়া পূর্বের তুলনায় আরো বেশি কুঁচকে গেল। সন্দেহের আঁধার আরো ঘন হয়ে আসলো। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলল,

“তোর ব্যক্তিত্বের অপমানের খাতা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়।”
“কোথায় যাব?”
“আমার বাড়ি।”

ইমদাদ আতকা চিৎকার তুলে বলল,

“না।”
“কি না?”
“আমি তোর বাসায় যাব না।”
“কেন?”

ইশাদের প্রশ্নের উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গে দিল না ইমদাদ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিঃশব্দে নিশ্বাস টানল। অসহায় কণ্ঠে বলল,

“তোর বাড়ি আমার জন্য অভিশাপস্বরূপ! পা পড়তে না পড়তেই অঘটন ঘটে। আমার রঙিন জীবনটা সাদা-কালো হয়ে গেছে।”
“ওটা রঙিন জীবন নয়,দূষিত জীবন। আর কত? এবার সংসার বাঁধ।”
“আচ্ছা,আজ টিনার সাথে দেখা করে আসি তারপর রাতে শুয়ে শুয়ে ভাববো।”

মুহূর্তেই ইশাদের মুখে রক্তিমআভা স্পষ্ট হয়। ক্রুদ্ধ কণ্ঠ ছেড়ে বলল,

“এক ঘন্টার মধ্যে তোকে আমার সামনে দেখতে চাই।”

কথাটা শেষ করেই কলটা কেটে দিল ইশাদ। রাগের ছটা নিশ্বাসে নিশ্বাসে উড়িয়ে দিচ্ছে। ফোন পকেটে পুরল। হঠাৎ মস্তিষ্ক সজাগ হয়। কান খাড়া হয়। নাকে ভারি নিশ্বাস টেনে বলল,

“তিহি,কেন এসেছো?”

পেছন থেকে কোনো সাড়া আসে না। ক্ষীণ পদশব্দ হয়। পা দুটো এগিয়ে এসেছে। ইশাদ অনুভব করতে পারছে। কল্পনাশক্তিতে ধারণাও করেছে,পেছন ঘুরলেই তিহির চোখে চোখ পড়বে। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পারবে। দূরত্বটা এর থেকেও কম হতে পারে। ইশাদ পেছন ঘুরল না। পুনরায় বলল,

“আর একটা রাতের অপেক্ষা! তারপরই মিহি আমার ঘরের ঘরনি হবে। আমার জীবন পাতার এপিঠ-ওপিঠের সর্বত্রই মিহির বিচরণ চলবে। এটা কি তোমার অজানা? সব জেনেশুনেও কেন বার বার আমার কাছে ছুটে আসো?”

এবার তিহির কণ্ঠ পাওয়া গেল। কবিতা আবৃত্তির ন্যায় বলল,

“আর একটা রাতের অপেক্ষা! তারপরই মিহি আপনার ঘরের ঘরনি হবে। আপনার জীবন পাতার এপিঠ-ওপিঠের সর্বত্রই মিহির বিচরণ চলবে। এটা কি আপনার অজানা? সব জেনেশুনেও কেন বার বার আমার ছুটে আসার অপেক্ষায় থাকেন? মনে মনে হাজারও বার আমার উপস্থিতি কামনা করেন?”

তিহির উত্তর- প্রত্যুত্তরে ইশাদ বিস্ময়ে স্তব্ধ। অজান্তেই পেছন ঘুরে। হতবুদ্ধী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে প্রশ্নেবাঁধা মুখটিতে। তিহি সেই চোখে অল্পক্ষণ নীরব নয়ন রাখে। অতঃপর পূর্বের সূত্র ধরেই বলতে থাকে,

“আমার মতো কি তোমার হৃদয়ও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে না,ইশ? চোখ যন্ত্রণার আগুনে পোড়ে না? মন হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে উঠে না? অকারণে রাতের ঘুম উবে যায় না? ব্যস্ত মুহূর্তেও কল্পনায় কিছু খেলে যায় না? ঠোঁটে হঠাৎ হঠাৎ হাসি উঁকি দিয়ে যায় না?”

ইশাদ কোনো উত্তর দিতে পারে না। অনুভব করতে পারছে তার হৃদয়ের খুব গভীরে কিছু একটা আচড়ে পড়ছে। ভেসে যেতে চাচ্ছে তার নিজ সত্তা।

ইশাদের এই নীরব উপস্থিতি তিহি সহ্য করতে পারছে না। উন্মদাগ্রস্ত হয়। আত্ম সংবরণ গ্রাস করে নিয়েছে যেন। সে ইশাদের দুই বাহু চেপে ধরে। ঝাঁকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,

“কী হলো চুপ করে আছো কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমরা তো একি রোগের রোগী। তাহলে দুজনের এক কামড়ায় থাকতে কী অসুবিধা? কিসের ভয়? কীসের দ্বিধা?”

ইশাদ আলগোছে তিহির হাত দুটো কাঁধ থেকে সরিয়ে দেয়। মন্থর গতিতে মাথা দুদিকে নাড়ে। চোখের দৃষ্টিতে প্রকাশ করতে চায়,এমনটা হয় না। অসম্ভব!

তিহি বুঝতে পারলেও মানতে পারছে না। তার চোখের কোল জলছায়ায় পূর্ণ। কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ইশাদ বলল,

“তিহি,তুমি আবারও ছেলেমানুষি করছো। এগুলো তোমার সাথে একদম মানাচ্ছে না৷ অবুঝের মতো কী সব বলছো? শান্ত হও। চোখ মেলে চারপাশটা দেখো।”

তিহি শান্ত হয়। ইশাদের পাশাপাশি দাড়ায়। দূরের আকাশের দিকে উদাস চোখে তাকায়। আনমনে বলল,

“ভালোবাসা হলো নবশিশুর মতো পরিপুষ্ট! যার মধ্যে জ্ঞানশক্তির লেশমাত্র নেই। শুধুই অনুভূতি,প্রগাঢ় অনুভূতিতে ভরপুর।”

ইশাদ তিহির দিকে তাকায়। নরমস্বরে সুধায়,

“তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

এ পর্যায়ে তিহি নীরব উপস্থিতি পালন করল কিছুক্ষণ। হঠাৎ ইশাদের দিকে তাকায়। গাঢ় দৃষ্টি রাখে অনেক্ষণ। নীরবেই পা বাঁকায় ফিরতে পথে। এক কদম এগুতে ওর কব্জী চেপে ধরে ইশাদ। পূর্বের প্রশ্নটাই দ্বিতীয় বারের মতো করার জন্য উদ্যত হয়। সেই সময় ফোনটা বেজে উঠে। ইশাদ তিহির হাত ধরা অবস্থায় পকেট থেকে ফোন বের করে। কানে ধরতেই শাহিনা শাইখা অতিশয় আপ্লুত কণ্ঠে বললেন,

“উনি আমার জন্য শাড়ি এনেছেন।”
“কে?”
“তোর বাবা।”
“বাবা?”
“হুম।”

ইশাদ না দেখেও বুঝতে পারল তার মায়ের চোখে পানি চিকচিক করছে। আনন্দের পানি!

শাহিনা শাইখা চোখের কোণ মুছলেন। বললেন,

“মিহি মেয়েটা আসলেই অনেক লক্ষী,বুঝলি? তোর বাবাকে তুই,আমি,তোর দাদিও সংসারে বাঁধতে পারলাম না। মিহি ঠিকই পারল। কত অল্প সময়েই বেঁধে নিল! দেখিস ও আমাদের সংসারে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে। সুখের রঙে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবে। আজ রাতটাই বাকি। কালই আমার বউমা হবে। না,বউমা নয়। মেয়ে হবে। আমি ওকে আমার মেয়ের মতো যত্ন করব। আদর করব। ভালোবাসব। জানিসতো,আমার এখন মনে হচ্ছে আমি আসলেই কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি।”

শাহিনা শাইখার শেষ কথাগুলো ইশাদের কানে অস্পষ্ট হয়ে ঢুকছে। তার এক স্থির দৃষ্টি তিহির মুখপানে। হঠাৎ সে তিহির হাতটা ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিহি চোখ তুলে তাকায়। ইশাদ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। অন্য দিকে ঘুরে দাড়ায়। মায়ের মুখে এক চিলতে সুখের হাসি দেখার জন্য সে হৃদয়টাকে ছিঁড়ে বের করে দিতে পারবে। এখন সেই হৃদয়ে কে আছে তা দেখে কী লাভ?

________________________________
“আমি রুমে ঢুকেই দেখি সবুজ পাঞ্জাবির পাশে এই গোলাপি রঙের শাড়ীটা পড়ে আছে। এক সাথে,পাশাপাশি বিছানো। আমি তো প্রথম দফায় আঁতকে উঠেছিলাম। পরে আত্মসংবরণ করে চারপাশে খোঁজ লাগালাম। ভুল করে অন্য কেউ রেখে গেল নাতো? কিন্তু না। এ ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না৷ তখনই খেয়াল করলাম বাসায় তোর আব্বু নেই। তাহলে কি উনি রেখেছেন? শাড়িতে হাত দিতেই এই কাগজটা পেলাম।”

শাহিনা শাইখা চাপা উত্তেজনায় পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন ছেলের কাছে। সঙ্গে কাগজটাও এগিয়ে দিলেন। ইশাদ কাগজে চোখ রাখে। তাতে লেখা,’সম্পর্কের সূচনা হোক এখান থেকেই।’

ইশাদ লেখাটির দিকে গম্ভীরভাবে চেয়ে রইল। তার মধ্যে তীক্ষ্ণ গাম্ভীর্যভাব ফুটে উঠেছে। নিজের মনকেই প্রশ্ন করল,এটা কি বাবার লেখা?

“মানুষটা হঠাৎ এমন পাল্টে যাবে আমি তো ভাবতেই পারিনি। সে যাইহোক,দেখতো খোকা তোর বাবার পছন্দ কেমন? আমাকে মানাচ্ছে তো? এই শাড়িটা পড়ে উনার পাশে দাড়ালে ভালো লাগবে তো?”

শাহিনা শাইখা শাড়ির দুটো ভাঁজ খুলে কাঁধে আঁচলের মতো বিছিয়ে নিয়েছেন। ছেলের দিকে আগ্রহী মনোভাব। ইশাদ কিছু বলার আগেই রেখা ভূইয়ার হঠাৎ আগমন ঘটল। শাহিনা শাইখার কাঁধের শাড়িটা নিজের কাছে নিলেন। নিজের হাতের শাড়িটা উনার কাঁধে ফেলে গদগদ কণ্ঠে বললেন,

“আমার মেয়েটা আসলেই পাগল। হঠাৎ আবদার করে বসল,আপনাদের উপহার দিবে। আমাকে টেনে মার্কেটে নিয়ে গেল। আপনার আর আপনার স্বামীর জন্য একি রঙের পাঞ্জাবি,শাড়ি কিনল। সাথে আমার জন্যও একটা শাড়ি কিনল। অথচ দেওয়ার বেলায় গোলমেল করে দিল। সবুজ পাঞ্জাবির সাথে সবুজ শাড়ি না দিয়ে গোলাপি শাড়ি,মানে আমার শাড়ি দিয়ে গেল। ওর যে কবে বুদ্ধীশুদ্ধী হবে! আপনার পছন্দ হয়েছে তো?”

শাহিনা শাইখা তরল গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন,

“এগুলো তিহি রেখে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ। আপনি দেখেননি?”

শাহিনা শাইখা উত্তর দিলেন না। সে বিছানায় পড়ে থাকা পাঞ্জাবিতে হাত দিতে গেলে ইশাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবি আড়ালে রেখে মায়ের দুটো হাত চেপে ধরে। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখা ভূঁইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“হ্যাু,আন্টি। খুব সুন্দর হয়েছে। কাল আম্মু এই শাড়িটাই পড়বে।”

রেখা ভূঁইয়া তৃপ্তি হাসি উপহার দিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,

“তাহলে আমিও এটা পড়ব। যাই তিহিকে বলে আসি। ও শুনলে খুব খুশি হবে।”

রেখা ভূঁইয়া রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইশাদ মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“এটা কী করছিলে,আম্মু? উনারা ভালোবেসে উপহার দিয়েছে। ওটা ফেরত দিচ্ছিলে? কষ্ট পেত না?”

শাহিনা শাইখা উত্তর দিতে পারলেন না। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল!

ছেলের বুকে মাথা রেখে অনেক্ষণ চোখের জল ছাড়লেন শাহিনা শাইখা। শরীর,মন হালকা হয়ে আসতে বললেন,

“মিহিকে ডেকে নিয়ে আয়।”

ইশাদ বিপরীতে আর কথা তুলল না। চুপচাপ মায়ের রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিহিকে নিয়ে যখন ফিরল,তখন সোবহান শাইখ বাড়ি ফিরেছেন। রুমের ভেতরেই উপস্থিত আছেন। বিছানার এক কোণে বসে আছেন। পাতলা,নরম কাপড় দিয়ে চশমার গ্লাস পরিষ্কার করছেন।

মিহি ভেতরে ঢুকেই সহজ গলায় বলল,

“আন্টি ডেকেছেন?”

শাহিনা শাইখা মিহিকে হাতে ধরে খাটে বসাল। শাড়ির আঁচলে বাঁধা চাবির ছড়ায় ঝনঝন শব্দ তুলে একটা বিশেষ চাবি খুঁজে নিলেন। আলমারির তালা খুলে ভেতর থেকে লাল বেনারশী বের করলেন। মিহির সামনে এসে বললেন,

“তোমার জন্য নতুন বেনারশী,গয়না সবই কেনা হয়েছে। তবুও আমি যদি এটা তোমাকে দেই,তুমি কি নিবে?”

মিহি সরল মনে বলল,

“কেন নেব না? আমার বাবা বলতো,কেউ উপহার দিলে তার মূল্য,সৌন্দর্য কিংবা প্রয়োজন দেখতে হয় না। বরঞ্চ ভালোবাসা অনুভব করতে হয়।”

মিহির উত্তরে শাহিনা শাইখা খুশি হলেন। তিনি আলমারির গুপ্ত ড্রয়ার থেকে গয়না বের করলেন। ঝাপসা চোখে সবগুলো গয়নাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। এগুলো তার বিয়ের গয়না। বিয়ের সময় তাঁর বাবা তাকে দিয়েছিল। শুধু নিজের মায়ের নয়,শ্বাশুড়ি মায়ের গয়নাও আছে। সে যে বিয়েতে পরেছিল তারপর আর পরা হয়নি। শুধু ছোট্ট ঝুমকো জোড়া আর চেইনটা পরতেন মাঝে মাঝে। যখন সোবহান শাইখ বাড়ি আসতেন তখন। এখনো পরে আছেন!

শাহিনা শাইখা একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। তিনি একটি বারের জন্যও স্ত্রীর দিকে তাকালেন না। তাকালে নিশ্চয় দেখতেন,বুকে কত বড় পাথর চাপা দিচ্ছেন!

শাহিনা শাইখা সবগুলো গয়না মিহির হাতে থাকা বেনারশীর উপর আলতো করে রাখলেন। কানে পরে থাকা ঝুমকোতে হাত দিতে ইশাদ চমকে যায়। মায়ের কাঁধে হাত রাখে। চোখের ইশারায় খুলতে নিষেধ করছে। শাহিনা শাইখা ছেলের নিষেধ শুনলেন না। কানের ঝুমকো এবং চেইনটাও খুলে ফেললেন। মিহির হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

“আজ থেকে এগুলোও তোমার।”

ইশাদ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাড়াল না। ছুটে বাইরে চলে আসে। ধপধপ পা ফেলে ছাদে উঠে যায়। অন্ধকারে ঢাকা এক কোণে পৌঁছেই রেলিংয়ে শক্ত ঘুষি বসায়। সেই সময় পেছনে সোবহান শাইখ এসে দাঁড়ালেন। দুর্বল স্বরে বললেন,

“তোমার মাকে বলে দিও,বিয়ে বাড়িতে এভাবে নাক,কান,গলা খালি করে যেন না ঘুরে!”

ইশাদ ফুঁসে উঠে বলল,

“তোমার সমস্যা হলে,তুমি গিয়ে বলো। আমাকে বলতে আসবে না।”

ইশাদ রক্তিমমুখে চলে যেতে পা বাড়ায়। সোবহান শাইখ থামিয়ে বললেন,

“দাঁড়াও। তোমার সাথে কথা আছে।”
“আমার নেই।”

ইশাদ অবাধ্য হয়ে চলে যেতে চাইল। সোবহান শাইখ করুণ গলায় বললেন,

“বেশি সময় নেব না। প্লিজ!”

ইশাদ চাইলেও আর যেতে পারল না। দাম্ভিকতায় ভরপুর মানুষটার কণ্ঠে এমন নিস্তেজ অনুরোধে সে থামতে বাধ্য হল। বলল,

“জলদি বলো।”

সোবহান শাইখ মৃদু হাসলেন। যেন চোখের সামনে নিজের প্রতিরূপকে দেখতে পারছেন। তিনি অন্ধকারে ঢাকা দূরের গাছটির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,

“তোমার দাদা মানে আমার বাবা আমার পেশাকে মেনে নিতে পারতেন না। তার এক কথা অন্যের হয়ে কামলা খাটতে দিবেন না। জাত যাবে। প্রয়োজনে আমাকে স্কুল খুলে দিবে। কিন্তু আমি এর বিরোধিতা করি। বাড়ি ছেড়ে সিরাজগঞ্জ পাড়ি দেই। জয়েন করি শিক্ষকতায়। সেই চাকরী সূত্রেই মিহির মা,রুবিনার সাথে আমার পরিচয়। সেখানকার মেয়েরা খুব একটা স্কুলের বারান্দায় পা রাখত না। তারমধ্যে রুবিনাও ছিল। কিন্তু সে পরিবারের খুব আদরের মেয়ে ছিল। তার পড়ালেখার প্রতি আলাদা টান। বাবার কাছে আবদার রাখতে তিনি রাজি হন। কিন্তু স্কুলে যাতায়াতের অনুমতি দেয়নি। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে আমাকে প্রাইভেট মাস্টার হিসেবে নিলেন। রুবিনা অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের ছিল। পুরো এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল ওর মুখ থেকে কথা ফুটাতে! আমাকে অনেক খাটুনি করিয়েছিল। অবশেষে আমি সফল হই। কিন্তু বুঝতে পারিনি। সফলতা পড়ালেখা গন্ডি পেরিয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছে। যখন বুঝতে পারলাম তখন আর ফিরে আসার পথ নেই। ব্যাপারটা একপাক্ষিক হলে হয়তো সম্ভব হতো। কিন্তু না,দুই পাশ থেকে প্রবল জোয়ার বয়ছিল। ঠিক তখনি বাবা তলব পাঠালেন। জরুরী তলব। যেতেই হবে। নাহলে সাংঘাতিক কিছু হতে পারে! আমি ভয়ে বাড়ি ছুটে যায়। বাবার মিথ্যে ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি। সেই ফাঁদে পড়েই তোমার মাকে বিয়ে করা। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করা এমন তো অহরহ ঘটে। সংসারও করে! হয়তো আমিও করতাম। কিন্তু আমার ভেতরে তখন প্রচন্ড জেদ চেপে বসেছিল। শুধু এক কথায় বার বার মনে হচ্ছিল, বাবা কি একটাবার আমার কথা শুনতে পারতো না? একটাবার আমার ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতে পারত না? তারপরে নাহয় সিদ্ধান্ত নিত। আমি রাগে,দুঃখে,আক্ষেপে নিজের কাছেই শপথ করে বসি,বাবার দেওয়া এই জিনিসটা আমি কখনোই গ্রহণ করব না। কখনোই না। সেই সিদ্ধান্ত অটুট রাখতে বাড়ি ছাড়া হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দ্বিতীয় বিয়ে করব। আমি পরিবারের অমতে গিয়েই রুবিনাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। সব কিছু ঠিকঠাকও হয়েছিল। তোমার মায়ের কথা আত্মগোপন রেখেই রুবিনাকে বিয়ে করার জন্য আয়োজন হয়। কিন্তু শেষ অবধি আর পারিনি। হঠাৎ করেই তোমার মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমার কী হয়েছিল জানিনা,রাতের আঁধারে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমি চাইলেও মনকে মানাতে পারতাম না৷ তোমার মায়ের সাথে আমি শত চেষ্টা করেও সময় কাটাতে পারতাম না৷ যন্ত্রণা হতো খুব। না পারছিলাম ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে, না পারছিলাম নিজের করে নিতে। এক দিকে দায়িত্ব,আরেক দিকে ভালোবাসা! দুই দিকের প্রচল স্রোত আমাকে দাঁড়াতে দিচ্ছিলো না। একটাকে ছেড়ে আরেকটাকে আঁকড়ে ধরতেও পারছিলাম না। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই আমার দূরে থাকা।”

সোবহান শাইখ বিরতি টানলেন। লম্বা নিশ্বাস টেনে ছেলের দিকে তাকালেন। দৃঢ় গলায় বললেন,

“আমি আজও পারিনি,কোনো এক কিনারের মাটি শক্ত করে ধরতে! এখনও ভরা নদীর দুকূলের বিপরীতমুখী স্রোতে ডুবে ডুবে মরছি। মিহির সাথে তোমার বিয়ের কথা কিন্তু আমি বলিনি। আমি শুধু বলেছিলাম,মিহিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। তোমার মা ভয় পেয়েছিল! ভেবেছিল,আমি রুবিনাকে বিয়ে করে ফেলব। আমাকে আটকাতে তোমার সাথে মিহির বিয়ে ঠিক করেছে। তোমার মা কিন্তু অত্যন্ত চালাক ও বুদ্ধমতি!”

শেষ কথাটা বলে সোবহান শাইখ হেসে ফেললেন। সশব্দের হাসি! যেন খুব মজার একটা কথা বলেছেন। হাসতে হাসতে ছেলের দিকে তাকালেন। ইশাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উনার হাসি থেমে গেল। ফিরে আসল পুরোনো সেই গম্ভীরভাব। সহসা ইশাদের কাঁধ চেপে ধরল। ভারি গলায় বলল,

“আমি চাইনা যে ভুল আমার বাবা করেছে,সেই একি ভুল আমি করি। তোমার জীবনটাকে নরক, তিক্ত,অসহণীয় যন্ত্রণা বানাতে চাই না। আমি চাই তুমি সুখে থাকো! তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষটির ঠিকানা আমাকে দিবে? আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। প্রয়োজন পড়লে কালই তার সাথে তোমার বিয়ে হবে।”

ইশাদ ক্ষণকাল বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ আক্রোশে ফেটে পড়ে। গলার স্বর উঁচু করে বলল,

“বলব না। তোমাকে আমি কিছু বলব না। সেই অধিকারটা তুমি অনেক আগেই হারিয়েছো। আমি মিহিকেই বিয়ে করব। আমিও দেখতে চাই ভালোবাসার মানুষের জায়গায় অন্য কাউকে বসালে কতটা কষ্ট হয়। যন্ত্রণার পাথরের ওজনটা কী পরিমাণ ভার হয়। ঠিক কতটা ভার বয়ে মা,বাবা,স্ত্রী,পুত্রকে ফেলে অন্যত্র থাকতে হয়। সাথে তোমাকে এটাও দেখাতে চাই,হয়তো প্রথম ভালোবাসাকে ভুলা যায় না। কিন্তু চাইলেই নতুন ভালোবাসার জন্ম দেওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তা সেই শক্তি আমাদের দিয়েছেন। ভালোবাসা কোনো মাপকাঠিতে মাপা যায় না৷ কোনো বেড়াজালে বন্দী করাও যায় না। তাহলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যেত! সাথে অনুভূতিগুলোর অকালমৃত্যু ঘটত। পরিশেষে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here