তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,১৪,১৫

0
996

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,১৪,১৫
রোকসানা রাহমান
পর্ব (১৪)

যে মানুষটা জীবনের প্রায় সবটা সময় কাটিয়েছেন বাড়ির বাইরে, হঠাৎ সন্তানের মায়ায় অতিথির মতো হাজির হতেন সেই মানুষটাই সন্তানের মায়া হারিয়ে অনেকগুলো দিন বাড়ির বাইরে গেলেন না৷ রুমের চার দেয়ালে বন্দী করে রাখলেন নিজেকে। নাওয়া-খাওয়াই আসল তীব্র অনীহা। রাতগুলো কাটাল অনিদ্রায়, দিনগুলো অবসাদে! বেখেয়ালি উদাসীনতায় তীব্র ব্যথা অনুভূত করল শিরা-উপশিরায় , অচেনা কষ্টও! শুকনো চোখজোড়ায় তীব্র যন্ত্রণা। পাপহীন অনুতাপে যখন লালরঙা হৃদয়টা পুড়ে ছাই হতে লাগল ঠিক তখনই প্রথমবারের মতো হার্ট-অ্যাটার্ক হলো সোবহান শাইখের। টনু কোনো রকমে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই শাহিনা শাইখাকে কল করেছিল।

টনুর অসহায় কণ্ঠস্বরে শাহিনা শাইখার আত্মসম্মান ভেঙে গেল। পাথরের মতো শক্ত হৃদয়টা হলো ঝুরঝুরে। চোখে ভারি অশ্রুপাতে গলে পড়ল রাগ-অভিমান। দিশাহারা হয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। সেখানে পৌঁছে এক পলকের জন্য স্বামীকে দেখেই ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলেন। কথাবার্তা শেষ হতে না হতেই আরেকটা কল। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিলেও দ্বিতীয় ধাক্কাটা সামলাতে পারলেন না। আর্তনাদে ফেটে পড়ে করিডোরের মাঝখানে বসে পড়লেন। হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়লে তাকে জড়িয়ে ধরল ইমদাদ। দ্রুত বলল,
” আমাদের ইশাদের কাছে যেতে হবে, আন্টি। নিজেকে সামলান। ”

শাহিনা শাইখা নাভিশ্বাস তুলে বললেন,
” ও ঠিক আছে তো? ”

ইমদাদ উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না। তিহির মতো জ্ঞান হারিয়ে আইসিইউতে ভর্তি না হলেও জখম হয়েছে মারাত্মকভাবে। নিজের চিকিৎসা বাদ দিয়ে তিহির জন্য ছুটছে। সে অবস্থায় তাকে কল দিয়ে মায়ের কথা বলেছিল। ইমদাদ খুঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে শাহিনা শাইখার নাম্বারে কল দিয়ে জানতে পারে এ হাতপাতালে আছেন তিনি। ইমদাদ তার কাছে না এসে আগে ইশাদের সাথে দেখা করে। জোর করে চিকিৎসাধীনে রেখে তারপর শাহিনা শাইখার নিকট আসছিল। ভেবেছিল, সামনাসামনি বলবে। তন্মধ্যে কেউ একজন কল দিয়ে ইশাদের এক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে দেয়।

ইমদাদের বাহুতে থেকেই একবার স্বামীর কেবিনের কাছে গেলেন শাহিনা শাইখা। তিনি ঘুমাচ্ছেন। এ অবস্থায় ছেলের খারাপ অবস্থার কথা বলার সাহস পেলেন না। টনুকেও কিছু বলতে মানা করে সরে পড়লেন কেবিন থেকে। ইশাদের কাছে পৌঁছালেন চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে।

————
ইশাদের ক্ষতস্থানগুলোতে ড্রেসিং শেষে হাতে ব্যান্ডেজ করছিল ডাক্তার সাহেব। সেসময় মায়ের ডাক শোনে ইশাদ বাচ্চাদের মতো সব ফেলে ছুটে আসে। মাকে জড়িয়ে শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়ে। শাহিনা শাইখা ছেলের দুর্বল শরীরটাতে হাত বুলিয়ে বললেন,
” আমাকে তিহির কাছে নিয়ে চল। ”

ইশাদ তাৎক্ষণিক মাকে নিয়ে আইসিইউর সামনে গেল। তিনি দূর থেকে দেখে চোখের পানি ফেললেন চুপচাপ। ছেলেকে শক্ত রাখতে বললেন,
” চিন্তা করিস না, বাবা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। দেখবি, তিহি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। ”

মায়ের প্রবোধদানে ইশাদ শান্ত হতে পারল না। অসুস্থ শরীরেই বার বার ছুটোছুটি করল। ইমদাদ রুকমিনি মুখার্জির সাথে কথা বলে এসে ইশাদের কাছে এলো। জোর করে টেনে নিয়ে গেল তার কেবিনে। নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। কথা চালাচ্ছে অনর্গল,
” পাগল হওয়ার মতো কিছু হয়নি, ইশাদ। তোর মতো এত আঘাতও পায়নি। আমি নিজে দেখে এসেছি তিহিকে। ”

ইশাদ ব্যাকুল হয়ে বলল,
” কিছু হয়নি, না? কপাল থেকে রক্ত পড়ছিল! ডানহাতটা ছ্যাচে গেছে একদম! আরে, পুরো ধাক্কাটা ওর উপর দিয়েই তো গেছে। আমি কিছু করতে পারলাম না! ড্রাইভিং সিটে আমি থাকতেও কিছু করতে পারলাম না। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে ট্রাকটাকে দেখছিলাম! ওর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। ”

শেষ কথাগুলো একদম পাগলের মতো আওড়াল ইশাদ। ইমদাদের কাছ থেকে ছুটে পালাবে তার আগেই ইমদাদ ধরে ফেলল। কঠিন স্বরে শাসাল,
” কোথাও যাবি না। চুপ করে বস। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। ”

ইশাদ সেই শাসানি পরোয়া করল না। বসা থেকে আবারও উঠে দাঁড়ালে ইমদাদ সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল। ধরা গলায় অনুরোধ করল,
” তোকে এই অবস্থায় দেখতে পারছি না, ইশাদ। আমার উপর দয়া করে হলেও একটু নিজেকে সামলা। আন্টির কথা ভাব। উনি একা তোদের দুজনকে কী করে সামলাবে? ”

ইশাদ একটু স্থির হলো। ইমদাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে প্রশ্ন করল,
” দুজন বলতে? আর কার কথা বলছিস? ”

ইমদাদ ভেবেছিল বাবার অসুস্থের কথা আজ বলবে না। পরে পরিস্থিতি বুঝে বলবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ইশাদকে স্বাভাবিক করতে হলে বাবার কথাটা বলতেই হবে। সে নিশ্বাস আটকে বলল,
” তোর বাবার হার্টে অ্যাটাক হয়েছে। আন্টি সে খবর শুনেই ওভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল। ”

ইশাদ পলকহীন চেয়ে থাকল ইমদাদের দিকে। তার কেমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করা উচিত সে দ্বিধায় ভুগছে। বিভ্রান্ত চাহনি হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠল। ইমদাদ কিছু বোঝার আগেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল। মায়ের কাছে গিয়ে আচমকা থেমে যায়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
” বাবা কেমন আছে, আম্মু? ”

স্বামীর কথা উঠতে তিনি আবার অস্থির হয়ে পড়লেন। মাত্রাহীন দুশ্চিন্তায় সবকিছু অসহণীয় হয়ে পড়ল। করুণ বদনে কিছু বলার আগেই ইমদাদ বলল,
” উনি ঠিক আছেন। ”

ইশাদ পেছন ঘুরে বিরক্তে বলল,
” তুই একটু চুপ থাকবি? তখন থেকে এক কথায় বলে যাচ্ছিস। তুই কী করে বুঝবি আপন মানুষের একটু খারাপ থাকায় কেমন লাগে! ”

ইমদাদ চোখ নামিয়ে ফেলল। অন্য দিকে তাকিয়ে এক কদম পেছনে সরে গেল। একটা সুক্ষ্ম ব্যথা টের পেয়েও তাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

মায়ের কাছ থেকে সবটা শোনার পর ইশাদের দুঃচিন্তা সিকি পরিমাণ কমল।

_________
তিহি বিপদমুক্ত হতে তাকে আইসিইউ থেকে বের করে অচেতন অবস্থায় কেবিনে রাখা হলো। তাকে কেবিনে রাখার পর থেকে ইশাদ পাশেই বসে ছিল। কখন সকাল হলো, দুপুর হলো খেয়াল নেই। শাহিনা শাইখা কিছু খাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে ব্যর্থ হলেন। সে অবস্থায় স্বামীকে দেখতে গেলেন। দুপুরের রোদ প্রায় পড়ে এসেছে, এমন সময় তিহির জ্ঞান ফিরল। পিটপিট চোখে তাকাতে দেখল তার হাত ধরে একটা ছেলে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। সে অবাক হলো, ভয় পেল। চট করে নিজের হাত টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে মাথা তুলল। অন্য দিকে চেপে যেতে হতে ইশাদ চোখ মেলল। আদুরে গলায় বলল,
” তিহিপাখি! তোমার ঘুম ভেঙেছে? দাঁড়াও আমি ডাক্তার….”
” কে আপনি? ”

ইশাদ বসা থেকে দাঁড়িয়েছে সবে তখনই তিহি পৃথিবী থমকে দেওয়া প্রশ্নটি করে বসল। ইশাদ অবাক হয়ে দেখল তিহির চোখে ভয়! নিজেকে লুকিয়ে ফেলার এক অদম্য চেষ্টা চলছে। সে অবস্থায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
” আপনি আমাকে ছুঁয়ে ছিলেন কেন? ”

মুহূর্তে তিহির চোখদুটি ছলছল হয়ে উঠল। কক্ষের চারপাশ দেখার জন্য একটু নড়তে হাতে সুচের টান লাগল। সে ব্যথায় আহ! করে উঠতে ইশাদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার থমকে যাওয়া অনুভূতিটুকু সতর্ক হয়ে বলল,
” নড়ো না, ব্যথা পাবে। ”

তিহি ইশাদের কথা শুনল। নড়াচড়া বন্ধ করে অসহায় গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আপনি ডাক্তার? ”

ইশাদ ছোট্ট করে বলল,
” হ্যাঁ। ”

তিহি আগ্রহ নিয়ে পরের প্রশ্নটা করল,
” আমাকে এখানে কে এনেছে? ”

ইশাদ উত্তর দেওয়ার সময় পেল না তার আগেই তিহি বলল,
” তাজ এনেছে? ”

ইশাদ আর উত্তর দিতে পারল না। গলার ভেতরটা কেমন ব্যথা করে উঠল, বুকটা ভার হয়ে আসল। এক পলকে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত হয়ে গেল।

তিহি দরজার দিকে চোখ রেখে ফিসফিসে বলল,
” ও কি জেনে গেছে আমি বেঁচে আছি? ”

ইশাদ যান্ত্রিকের মতো বলল,
” না। ”

উত্তর শুনে আচমকা ইশাদের হাত টেনে ধরল তিহি। অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার একটা কথা রাখবেন? ”

তিহির এই আচরণে ইশাদ চমকাল না। স্বাভাবিকভাবে বলল,
” কী অনুরোধ? ”

তিহি সাথে সাথে বলল,
” তাজকে বলবেন না, আমি বেঁচে আছি। বলবেন না তো?”
” তাজ নেই। ”

তিহি অবাক হয়ে বলল,
” নেই মানে? ও বাইরে দাঁড়িয়ে আমাকে পাহারা দিচ্ছে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” পাহারা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। ”

তিহি একটু থামল। হঠাৎ বলল,
” মরে গেছে? ”

ইশাদ এবার হকচকিয়ে গেল। তাজ বেঁচে আছে নাকি সে জানে না। তাই বলে কি সরাসরি মৃত ঘোষণা করে দিবে? তার বিবেকে বাঁধা দিল। বলল,
” জানি না। ”

তিহির দীপ্তিময় মুখটা দ্যুতি হারিয়ে ফেলল। সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
” জানেন না কেন? ”
” কারণ, এই হাসপাতালে আমি শুধু তোমাকে দেখেছি। আর কাউকে না। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো হারিয়ে গেছে। ”

রুকমিনি মুখার্জি হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করায় তিহি-ইশাদের কথপোকথন এখানে থেমে গেল। তিনি তিহির পুরো শরীরে হাতিয়ে বললেন,
” এসব কিভাবে হলো? ”

তিহি প্রথমে চুপ করে থাকলেও এবার কথা বলল,
” আপনি তাজের মা? ”

রুকমিনি মুখার্জি অশ্রু ফেলা বন্ধ করলেন। একবার ইশাদের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” আমি চিনতে পেরেছি। আপনাদের ছবি দেখেছিলাম। ”
” ছবি! ”

রুকমিনি মুখার্জির কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়তে ইশাদ এদিকটায় হেঁটে আসল দ্রুত। তার কাঁধে হালকা ছুঁয়ে বলল,
” বাইরে আসুন, কথা আছে। ”

রুকমিনি মুখার্জি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিহির দিকে তাকিয়ে আড়ষ্টভঙ্গিতে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলে তিহি বলল,
” আপনাদের কারও কাছে ফোন আছে? আমার বাসায় একটু কল দিতাম। ”

ইশাদ নিজের ফোনটা তিহিকে দিলে সে খুশি হলো। ধন্যবাদ দিয়ে ফোনে মনোযোগ দিল। কয়েকটা নাম্বার তুলে ইশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনার নামটাই তো জানা হলো না। দরকার হলে কী বলে ডাকব? ”
” মি. ইশ। ”

তিহি কপাল কুঁচকে সুধাল,
” মি. ইশ নাকি ড. ইশ? ”

ইশাদ ক্লান্ত হেসে অপরিচিত গলায় বলল,
” আপনার যেটা ভালো লাগে। ”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৫)

ইশাদের পিছু পিছু বাইরে এসে দাঁড়ালেন রুকমিনি মুখার্জি। ভেজা চক্ষুদ্বয়ে আতঙ্কের ছাপ! ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলেন,
” তিহির কি স্মৃতি…”
” হ্যাঁ, ওর স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে। ”

তাকে প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়েই উত্তর দিয়ে ফেলল ইশাদ। তার চোখ, মুখ ও কণ্ঠস্বর বড্ড বেশি স্বাভাবিক ঠেকল রুকমিনি মুখার্জির নিকট। সংকোচে বললেন,
” তোমাকে চিনতে পেরেছে তো? ”

ইশাদ একপাশে ঠোঁট টেনে ম্লান হাসল। চোখ নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
” ওর জ্ঞান ফেরার পর প্রথম প্রশ্নই ছিল, আমি কে? ”

রুকমিনি মুখার্জির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। যেন ইশাদ অচিন্তনীয় কিছু বলে ফেলেছে। বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পলকহীন চেয়ে থাকলেন ইশাদের মুখটায়। এখন আর স্বাভাবিক লাগছে না। বড্ড অসহায় লাগছে! তার নীরবতা ভেঙে দিয়ে ইশাদ বলল,
” সেদিনের এক্সিডেন্টের মুহূর্তটুকুতেই আটকে আছে তিহি। এরপর কী হয়েছে তার মনে নেই। ভাবছে, সেই এক্সিডেন্টের জন্যই হসপিটালে এডমিট আছে। ”
” ইনাকে দেখলেও চিনবে না? ”

এতক্ষণে ইনার কথা মনে পড়ল ইশাদের। বাসায় একা একা কী করছে মেয়েটা? কান্নাকাটি করছে না তো? সে তৎক্ষনাৎ বাসায় ফোন দিতে চাইল, সম্ভব হলো না। মনে পড়ল ফোন তিহির কাছে। রুকমিনি মুখার্জি বুঝতে পেরে নিজের ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন। ইশাদ ফোন হাতে নিতে কল আসল। স্ক্রিনে নিজের নাম্বার দেখে চমকে গেল খানিকটা। পর মুহূর্তে ভাবল, তার মোবাইল তিহির কাছে। তারমানে এ নাম্বারে কল দিয়েছে তিহি। কিন্তু তিহি যেসময়ে অবস্থান করছে সেসময়ে রুকমিনি মুখার্জির নাম্বার জানা কথা না। তাহলে কল দিল কিভাবে? তবে কি ওর সবকিছু মনে পড়েছে? ইশাদ চিন্তায় মগ্ন হলে রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” কে কল করেছে দেখি? ”

ইশাদের দেখাতে হলো না। তিনি মাথা এগিয়ে এনে দেখলেন। বললেন,
” এটা তো তোমার নাম্বার! ”

ইশাদ চটপটে ফোনটা রুকমিনি মুখার্জির হাতে দিল। তিহির রুমের দিকে এগুনোর পূর্বে বলল,
” রিসিভ করবেন না। আমি আসছি। ”

একাধারে কল দিয়ে তিহি বিরক্ত হয়ে পড়লে ইশাদের কণ্ঠস্বর পেল,
” কথা হলো? ”

তিহি সামনে তাকাল। অসহায় গলায় বলল,
” না, আম্মু কল ধরছে না। ”
” আম্মু বলতে, আপনার নিজের আম্মু? ”

তিহি কপাল কুঁচকে বলল,
” নিজের আম্মু হবে না তো অন্যের আম্মু হবে? ”

তিহির বিরক্তের কারণ বুঝতে পারল ইশাদ। মৃদু হেসে তার কাছে এসে বলল,
” নেটওয়ার্কে সমস্যা মনে হয়। আমাকে দিন। ”

তিহি সহজমনেই ফোন তুলে দিল ইশাদের হাতে। সে সময় নষ্ট না করে ডায়াল লিস্টে ঢুকল। সবার উপরে রুকমিনি মুখার্জির নাম্বার দেখে যতটা না চমকাল তার থেকেও বেশি চমকাল নিজের নাম্বার দেখে। মনের মধ্যে সন্দেহ জমার আগেই তিহির দিকে ফোন বাড়িয়ে বলল,
” এই নাম্বারেও কল দিয়েছেন দেখি। এটা কার? ”

তিহি নাম্বারে চোখ বুলিয়ে বলল,
” আব্বুর। ”

ইশাদ যারপরনাই বিস্মিত হলো। তিহি এতকিছু খেয়াল করল না। বলল,
” আব্বুর নাম্বারে কল ঢুকছে না। মনে হয় সিম পাল্টেছে। এক বছর ধরে কথা হয়নি। ”

ইশাদ মনে মনে কিছু ভেবে নিয়ে বলল,
” আপনার বাসার ঠিকানা মনে আছে? ”
” কেন? ”
” ফোনে যোগাযোগ সম্ভব না হলে কাউকে দিয়ে আপনার খবর পাঠিয়ে দিব। ”

তিহি প্রথমে সন্দেহ চোখে তাকালেও পরক্ষণে বলল,
” হ্যাঁ, মনে আছে। ”
” বলুন। ”

তিহি বলার জন্য উদ্যত হয়ে থমকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অসহায় গলায় বলল,
” মনে পড়ছে না! ”

ইশাদ ঘাবড়াল না। নার্স ডেকে এক টুকরো কাগজ আর কলমের ব্যবস্থা করল। তিহির হাতে দিয়ে বলল,
” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেকটা সময় অজ্ঞান ছিলেন তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যাবে। আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন। ঠিকানা মনে পড়লে এখানে লিখে রাখবেন। কেমন? ”

তিহির মুখ থেকে অসহায়ত্ব ভাব কেটে গেল। হালকা হেসে মাথা একপাশে কাত করল। বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলে ইশাদ বেরিয়ে আসে। রুকমিনি মুখার্জির কাছে হেঁটে এসে বলল,
” আমাকে ভুলে গেলেও আমার নাম্বারটা এখনও মনে আছে। ”
” মানে? ”

ইশাদ ক্লান্ত হাসল। তিহিকে একা থাকার সময় দিয়ে বলল,
” চলুন, ইনার সাথে দেখা করে আসি। ”

রুকমিনি মুখার্জিকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হওয়ার জন্য করিডোর পার হলো ইশাদ। রিসিপশনের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলে, কোনো দরকার হলে এ নাম্বারে কল দিতে। তারপরেই এগোয় মূল দরজার দিকে। বাইরে বের হতে পারেনি তার আগেই পেছন থেকে ওয়ার্ডবয় ডেকে উঠল। ইশাদ থমকে পেছনে তাকালে সে দ্রুত হেঁটে এসে বলল,
” আপনি কারও মোবাইল নিয়ে এসেছেন, স্যার? ”

ইশাদ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল ওয়ার্ডবয়ের দিকে। সন্দেহি কণ্ঠে জানতে চাইল,
” মোবাইল? ”
” হ্যাঁ, ৩০৩ নম্বর রুমের পেশেন্ট জানাল, ড.ইশ নামের একজন তার মোবাইল নিয়েছে। এখন সেটা তার চাই। ”

ইশাদ ভ্রূ কুঞ্চিত করে মনে করার চেষ্টা করল কিছু। হঠাৎ তিহির কথা মনে পড়ল। সেই সাথে তিহির রুমের নাম্বারটাও। সে চটপটে বলল,
” তিহির কথা বলছ? আচ্ছা, তুমি যাও। আমি মোবাইল নিয়ে আসছি। ”

ওয়ার্ডবয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত পেয়ে অন্যদিকে চলে গেল। ইশাদ রুকমিনি মুখার্জিকে সেখানে দাঁড় করেই তিহির কাছে ছুটে গেল। সে তখন আধশোয়া। ইশাদকে দরজার কাছে দেখেই অস্থির হয়ে বলল,
” মোবাইল দিন। ”

ইশাদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে তিহির হাতের দিকে তাকাল। এমনভাবে হাত পেতে মোবাইল চায়ছে যেন সে তার মোবাইল জোর করে নিয়ে পালিয়েছে!

তিহি অধৈর্য হয়ে বলল,
” কী হলো? মোবাইল দিন। ”

ইশাদ পকেট থেকে ফোন বের করতে তিহি ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে বলল,
” আমার বাসা থেকে কেউ কল করেছিল? ”
” না। ”

ইশাদ খেয়াল করল তিহির মধ্যে চলা অস্থিরতা ভাবটা কেটে গেছে। গভীর কোনো চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছে এমনভাবে নিশ্বাস ফেলছে। ইশাদ ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। দমে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়লে জিজ্ঞেস করে বসল,
” কেউ কল দিলে কী হতো? ”
” আপনিও তাজের মতো আব্বুর কাছে মিথ্যে বলতেন। ”

তিহির মুখে তাজ নামটা আবারও ইশাদের হৃদয়ে ছুরির ফলার মতো বিঁধল। ব্যথা শুরু হওয়ার আগেই বলল,
” তাজ মিথ্যে বলেছিল? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”

তিহি উত্তর দিল না। ইশাদ লক্ষ করল তিহি উদাস হয়ে পড়ছে। ভাবল আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। পরমুহূর্তেই টের পেল, তাজময় রহস্য উদ্ঘাটন না করলে সে শান্তি পাবে না। তাই ধীরে ও শীতল স্বরে সুধাল,
” তিহি, তাজ কেন মিথ্যে বলেছিল? ”

তিহি উদাস মনেই বলল,
” জানি না। ”

তিহির উত্তরে ইশাদ আশাহত হলো। চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে শুনতে পেল তিহি নিচু স্বরে কিছু একটা বলছে। সে এগিয়ে এসে মনোযোগ দিল।

তিহি বলছে,
” আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতে আম্মু বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। পাত্র আগে থেকেই ঠিক করা, গাঁয়ের মাতব্বরের ছেলে। আমি পরীক্ষার দোহাই দিয়ে এতদিন আম্মুকে সামলে রেখেছিলাম। এবার আর পারছিলাম না। এদিকে গ্রামে কোনো কলেজ না থাকায় আব্বুও আমার পড়ালেখায় খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। আবার এত অল্প বয়সে বিয়ে হোক সেটাও চাচ্ছিল না। আমি কেঁদেকেটে অসুস্থ হয়ে পড়লে আব্বু বাধ্য হয়ে আমাকে শহরের কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়। গ্রাম থেকে অতদূর যাওয়া-আসা করতে কষ্ট হবে দেখে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাও করে দেয়। শর্ত একটাই, পড়ার বাহিরে অন্য কিছু করা যাবে না। ইন্টার শেষ হলে খুশিমনে বিয়ের জন্য তৈরি হতে হবে। কোনো ঝামেলা করা যাবে না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। মন দিয়ে পড়তে থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম, আগে তো কলেজ শেষ করি। তারপরে বাকিটা ভাবা যাবে।
হোস্টেলে উঠার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার রুমমেটদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। সকলে আমার সিনিয়র ছিল বলে আমাকে খুব আদর করত। তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি পছন্দ করতাম অনন্যা দিদিকে। হঠাৎ একদিন শুনি দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে। হোস্টেল ছেড়ে দিবে। যাওয়ার আগে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেল। আমাকে তো বার বার বলে গেল অবশ্যই যেন যাই। সেসময় আমি কথা দিতে পারলাম না। কারণ, আব্বুকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম। যদি জানে পড়া রেখে বিয়েতে গিয়েছি, তাও আবার হিন্দু বাড়ির বিয়েতে তাহলে আমাকে খুব বকবেন। কিন্তু এই ভয়টা আমি কাউকে বুঝাতে পারলাম না। রুমমেট সকলে আমাকে জোর করে বিয়েতে নিয়ে গেল। আশ্বাস দিল, এ কথা অন্য কেউ জানবে না। তাছাড়া অনন্যা দিদির বাড়ি অন্য গ্রামে। আব্বু সেখানে কখনই যাবে না। আমি বাধ্য হয়ে তাদের সাথে গেলাম। বিয়েতে কন্যাদানের পর্ব আসতেই বাড়ি থেকে কল আসল। আমার তো ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। ফোন ধরলে যদি উলুর ধ্বনি শুনতে পায়? শাঁখ বাজার শব্দ পায়? আবার না ধরলে যদি সন্দেহ করে? আমি বিয়ে বাড়ির শব্দ থেকে দূরে সরতে গিয়ে একদম রাস্তার কাছে চলি আসি। বাবার নাম্বারে কল দিতে গিয়ে দেখি ফোনে টাকা নেই। এদিকে আশে-পাশে কোনো দোকানও নেই। রিচার্জ করতে হলে বাজারে যেতে হবে। আবার এতদূরে চলে আসায় অন্য আপুদের ফোনও নিতে পারছিলাম না। ঠিক সেসময় চোখ পড়ল রাস্তার অন্য পাশে। অন্ধকারে মোটরসাইকেলে ঠেস দিয়ে একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে। আমি ভাবলাম, তার কাছ থেকে মোবাইল চাইব বাবাকে কল দেওয়ার জন্য। পরক্ষণে মনে পড়ল, আমি তো এ গ্রামে নতুন। কাউকে চিনি না। লোকটা যদি খারাপ হয়? আশপাশটাও নির্জন। বিপদে পড়লে কেউ সাহায্য করতেও আসবে না। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম আব্বুর পরবর্তী কলের জন্য। অনেকটা সময় কাটার পরও যখন আব্বু কল দিল না। তখন আমার চিন্তা হতে লাগল। ভালো-মন্দ ভুলে দৌড়ে গেলাম ঐ ছেলেটার কাছে। ফোন চাইলে, দিল। আমি আব্বুর সাথে কথা বলে ফোন ফিরিয়ে চলে আসব তখনই সে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি তো ভয়ে পেছন ঘুরতেই পারলাম না। তখন সে জিজ্ঞেস করল, ‘ নাম কী তোমার? ‘ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ তিহি। ‘ তারপর সে বলল, ‘ তিহি, আমাকে ধন্যবাদ দিলে না? ‘ আমি হাত-পায়ে কাঁপুনি নিয়ে তার দিকে ঘুরলাম। শ্যামবর্ণের মুখটির দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। সে হাত ছেড়ে দিল। আমি ছুটে পালালাম। ”

এতটুকু বলে তিহি দম নেওয়ার জন্য থামতে ইশাদ জানতে চাইল,
” ঐ ছেলেটি কি তাজ ছিল? ”

তিহি বোধ হয় প্রশ্নটা শুনল না। নিজের মতো বলে চলল,
” তারপর কী হলো বুঝলাম না। পরের দিন আব্বু হোস্টেলে আসল। সকলের সামনে আমাকে খুব বকল, একটা চড়ও মারল। তারপর জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আম্মুকে বলল, ‘ মাতব্বরকে খবর দিতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। ‘ সেদিন বিকেলেই মাতব্বর আমাদের বাড়িতে আসল। আব্বু-আম্মু যখন তার সাথে আলোচনায় বসেছে তখন আমি দরজা আটকিয়ে কান্না করছি। হঠাৎ দেখি আমাদের বাসার পেছন রাস্তাতে সেদিনের সেই ছেলেটি মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লুকিয়ে তার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আমার আব্বু আপনাকে কল দিয়েছিল? ‘ সে বলল, ‘ হ্যাঁ, কল দিয়ে জানতে চাইল আমি কে। ‘ আমি জানতে চাইলে উত্তরে কী বলেছে? সে বলল, ‘ আমি বলেছি, আমি তোমার প্রেমিক। কয়েক মাস ধরে প্রেম করছি। আজ বিয়ে করব। ‘ তারপর আমার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিল। ”
” সিঁদুর! তোমাকে কেন সিঁদুর পরাবে? তুমি তো হিন্দু না। ”

ইশাদের বিস্ময় আর কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিল না তিহি। ইশাদের ফোনটা বালিশের নিচে লুকিয়ে বলল,
” আপনিও যাতে মিথ্যে বলতে না পারেন সেজন্য মোবাইল নিয়ে রাখলাম। আব্বু আমার কাছে না আসা পর্যন্ত দিব না। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here