তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,১৬,১৭

0
1103

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,১৬,১৭
রোকসানা রাহমান
পর্ব (১৬)

তিহির টুকে দেওয়া ঠিকানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল ইশাদ। মনে সন্দেহরা বাড়ে বাড়ে প্রশ্ন তুলেছে, ঠিক ঠিকানা দিয়েছে তো? সে প্রশ্নটা জোর করেই এড়িয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা, এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানো অত্যাবশ্যক। তিহিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য এই মুহূর্তে তার বাবা-মার উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক!

ইশাদ মনের সাথে দ্বন্দ্ব নিয়ে তিহির দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাল। তিহির বাবা রশীদ মিয়ার সাথে সাক্ষাৎ হতে চিন্তামুক্ত হলো। মনে মনে রুকমিনি মুখার্জিকে ধন্যবাদও দিল। তিহির দেওয়া ঠিকানা শেরপুরের মধ্যে হওয়ায় তিনি সহজ পথ বলে দিয়েছিলেন।

রশীদ মিয়া শুরুতে ইশাদকে সহজ চোখে দেখেননি। তাকে বাড়ির ভেতরেও ঢুকতে দেয়নি। বাইরের উঠোনে চেয়ারে বসে সবটা শুনছিলেন। শেষটায় নোনা পানিতে মনিদুটো ডুবে যেতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। স্ত্রীকে হাঁক দিয়ে বলেন, মেয়ের জামাইয়ের জন্য রাতের খাবার বাড়তে। ইশাদ সেই আনন্দটুকু উপভোগ করার সময় পেল না। সটাং দাঁড়িয়ে জরুরি গলায় বলল,
” বাবা, তিহি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন বের হলে সকালের মধ্যে পৌঁছে যাব। ”

রশীদ মিয়া দর্প চাহনি ফেললেন ইশাদের দিকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আচমকা জড়িয়ে নিলেন আলতোভাবে। বললেন,
” চলো। ”

তিহির মা তানিয়া বেগমও স্বামীর সাথে পেছনে সিটে বসলেন। রাতের ঘন অন্ধকার ছিদ্র করে ছুটে চলল ইশাদের গাড়ি।

___________

ইশাদ দূর থেকে তিহির আনন্দ দেখল। আবেগে গলে পড়া অশ্রুপাত দেখল। বাচ্চাদের মতো অভিমানে ঠোঁট ভাঙতে দেখল। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অনুশাসন দেখতে দেখতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ এক বছর নয় তিহিপাখি, সাত বছর পর বাবা-মায়ের দেখা পেলে। ‘

” তুই কি সত্যিই চাস না, তিহি তোদের বিয়ের ব্যাপারটা জানুক? ”

হঠাৎ ইমদাদের গলা পেয়ে ইশাদ চমকে যায়। দরজা ছেড়ে একটু সরে এসে বলল,
” চাইব না কেন? অবশ্যই চাই। কিন্তু এখন নয়, পরে। ”
” সেই পরেটা কবে আসবে? ”
” জানি না। ”

ইশাদের বেখেয়ালি উত্তরে ইমদাদ বিরক্ত হলো, রাগ বাড়ল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,
” তাহলে ইনার কী হবে?

ইশাদ সরল চাহনি ফেলল ইমদাদের মুখে। নিরুদ্বেগে বলল,
” ইনা তার বাবার সাথে থাকবে। ”
” বাবা? তাজকেও খুঁজে পেয়েছিস নাকি? ”

ইমদাদের বেফাঁসে বলে ফেলা কথাটায় কটমটে তাকাল ইশাদ। দৃঢ় স্বরে বলল,
” ইনার বাবার নাম ইশাদ। ”

ইমদাদ খানিকটা ভয় পেল। মিনমিনে বলল,
” তুই যেভাবে ওর সব ফিরিয়ে দিচ্ছিস তাই ভাবলাম…”

পরেরটুকু আর বলল না ইমদাদ। ইশাদ তাকে রেখে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল,
” আমি শুধু তিহিকে সুস্থ রাখতে চাচ্ছি, এই মুহূর্তে ব্রেইনে প্রেশার না পড়াই ভালো। ভুলে যাস না ও শুধু আমাকে না পুরো ছয়টা বছর ভুলে গেছে। ”

ইমদাদ আর কিছু বলল না। ইশাদকে অনুসরণ করে রুকমিনি মুখার্জির নিকট চলে গেল। তাকে কয়েকদিন ইনার সাথে থাকার অনুরোধ করতেও শুনল। রুকমিনি মুখার্জি রাজি হলেন। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন,
” তিহিকে এ অবস্থায় একা ছেড়ে দিবে? ”

ইশাদ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ল। চোখের চাহনি ঝাপসা হতে বলল,
” একা কোথায়? বাবা-মা আছেন। তিহির এখন আমাকে নয়, উনাদেরকেই প্রয়োজন। যখন আমাকে প্রয়োজন হবে তখন ঠিক হাজির হয়ে যাব। ততদিন নাহয় দূর থেকেই ভালো রাখার চেষ্টা চালাব। ”

ইশাদের না বলা ব্যথাটুকু রুকমিনি মুখার্জি বুঝে ফেললেন। অপ্রকাশিত কষ্টুটুকু অনুভব করলেন। ঠোঁট কামড়ে ইশাদের কাধে আলতো হাত রেখে দরদভরা গলায় বললেন,
” সব ঠিক হয়ে যাবে। তিহি তোমাকে খুব ভালোবাসে। আমি দেখেছি সেই ভালোবাসার গভীরত্ব। এত সহজে মুছে যেতে পারে না। ”

ইশাদ ক্লান্তভঙ্গিতে মাথা নাড়ল উপরনিচ। রুকমিনির হাতটা কাঁধ সরিয়ে বলল,
” আপনারা থাকুন আমি বাসের টিকেট কেটে আসছি। ”

ইশাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ইমদাদ বলল,
” তোকে যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি। ”

ইশাদের দিক থেকে কোনো জবাবের তোয়াক্কা না করেই ইমদাদ নিচতলায় চলে আসল। রিকশায় উঠে কল দিল শাহিনা শাইখাকে। তিনি ফোন ধরলে বলল,
” ইশাদ এত ছুটাছুটি করছে যে, ওষুধ নেওয়ার সময় পাচ্ছে না। তিহিকে সুস্থ রাখতে গিয়ে নিজে না বিছানায় পড়ে যায়। আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসেন। ”
” আমি কি ওর সাথে পারি? তুই একটু জোর করে খায়িয়ে দিতে পারছিস না? ”

শাহিনা শাইখার প্রশ্নের উত্তরে চুপ হয়ে গেল ইমদাদ। হঠাৎ করেই জোর করার মতো অভিপ্রায় দেখাতে পারছে না। কেমন যেন সংকোচে ভুগছে। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হচ্ছে।

” ইমদাদ? ”

শাহিনা শাইখার ডাকে ইমদাদ উত্তর দিল,
” আমি একটু বেরিয়েছি, আন্টি। আপনি এখন আসছেন তো? ”
” হ্যাঁ, রাস্তায় আছি। ”

__________
হসপিটাল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করতে করতে শাহিনা শাইখা চলে আসলেন। প্রথমেই ছেলেকে টেনে নিলেন এক কোনায়। জোর করে মুখে একটু খাবার দিয়ে বললেন,
” এই বয়সে মায়ের হাতে মার খেতে না চাইলে চুপ করে গিল। ”

ইশাদ বাধ্য হয়ে খাবার খাচ্ছে। সেই ফাঁকে শাহিনা শাইখা প্রশ্ন করলেন,
” তিহি তো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি, এই অবস্থায় বাসে পাঠাচ্ছিস কেন? তোর গাড়িতে করে দিয়ে আসতি। ”

ইশাদ খাবার চিবানো বন্ধ করে বলল,
” সাহস পাচ্ছি না, আম্মু। যদি আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে? ”

শাহিনা শাইখা চাপা নিশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের দিকে মমতাময়ী চাহনি আঁকলেন। কাঁধে হাত দিয়ে আদুরে মর্দন করতে থাকলেন।

____________
বিকেল নামার আগেই সূর্য ডুবে গেছে। হালকা ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। অন্ধকার নামতে এখনও অনেকটা দেরি। তিহি সিটে বসে মায়ের কাঁধে মাথা ফেললে ইশাদ সামনের সিটে এগিয়ে গেল। রশীদ মিয়ার হাতে তিনটা চাদর দিয়ে বলল,
” জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়েন। বাতাস বেশ ঠাণ্ডা! ”

কথাটা বলেই রশীদ মিয়ার সিটের পাশের জানালাটা লাগিয়ে দিল। সেই সঙ্গে তিনি বুঝে গেলেন ইশাদ কোন জানালা লাগানোর কথা বলছে। ইশাদ বিদায় নিয়ে বাস থেকে নেমে যাবে সেই সময় রশীদ মিয়া বললেন,
” সাবধানে থেকো, তিহিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। আমরা দেখেশুনেই রাখব। ”

ইশাদ চটজলদি বললেন,
” ছি, ছি, ছি! এভাবে বলছেন কেন? আপনারা ওর বাবা-মা। আমার থেকেও যে ভালো রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ করা অন্যায়। ”

তিহিদের বাস ছেড়ে দিতে ইশাদের হৃদয়টা কেঁপে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তিহিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলছে। আর কখনও দেখা হবে না, কথা হবে না, ভালোবাসা হবে না। কেউ ফোন দিয়ে বলবে না, ‘ আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ‘

” বাসায় যাবি না? ”

মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ইশাদ পাশে তাকাল। ভীত চোখ জোড়ায় জলের ছায়া নামার ভাব ধরতে গিয়েও থেমে গেল। মায়ের পেছনে বাবাকে দেখে কটাক্ষ করে বলল,
” উনি দেখি সুস্থ হয়ে গেছেন। ”

শাহিনা শাইখা ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে স্বামীর দিকে তাকালেন। নিচু গলায় বললেন,
” এভাবে বলছিস কেন? ”

ইশাদ সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। মায়ের হাত ধরে বলল,
” এখন তো আর হাসপাতালে ছুটাছুটি করার দরকার নেই। চলো, বাসায় যাবে। ”

মায়ের হাত ধরে দুকদম হেঁটেই থেমে যেত বাধ্য হলো। পেছনে তাকিয়ে বলল,
” কী হলো, আম্মু? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ”

শাহিনা শাইখা অন্য হাতে চোখ রাখলেন। ইশাদ সেই হাতে তাকালে দেখল, তার বাবা ধরে আছে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলে সোবহান শাইখ বললেন,
” শাহিনা, তোমার সাথে যাবে না। ”

একটু থেমে বললেন,
” তুমিও অন্য কোথাও যাচ্ছ না। তোমরা দুজনে আমার সাথে যাবে। ”

ইশাদ কিছু বলার জন্য তৈরি হলে সোবহান শাইখ চটজলদি বললেন,
” তোমাদের বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমি যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। বলো, আমায় কী করতে হবে? ”

ইশাদ রাগ নিয়ে বলল,
” আপনাকে কিছু করতে হবে না। কারণ, আমরা আপনার সাথে যাচ্ছি না। ”

কথাটা বলেই মায়ের দিকে তাকাল ইশাদ। তাড়া দিয়ে বলল,
” আম্মু, চলো। ”
” আমি জানি, তোমার আম্মুকে মানা করলে এখান থেকে একচুলও নড়াতে পারবে না। কিন্তু আমি মানা করব না। আমি জোর করে নয়, আপোষে ফিরিয়ে নিতে চাই। ”

সোবহান শাইখ ইশাদের কাছ ঘেষে দাঁড়ালেন। অকপটে বললেন,
” তুই বুঝাতে চেয়েছিস, তোর মা ছাড়া শুধু আমার সংসার না, আমিও অচল। আমি বুঝে গেছি। এবার রাগ-অভিমান ভাঙ। কথা দিচ্ছি, তাকে পূর্ণ সম্মান দেওয়া হবে। আর কষ্ট দিস না। তোদের ছাড়া ঐ বাড়িটা বিষাক্ত লাগে। ”

ছেলের থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর মুখে রাখলেন। হাত জোর করে বললেন,
” আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, ক্ষমা করে দেও শাহিনা। ”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৭)

শুক্রবার ছুটির দিন। জুমু’আর নামাজ পড়ে নিল ইমদাদ। পাঞ্জাবি বদলে এক রঙের শার্ট আর জিন্স পরল। হাতাগুলো গুটাচ্ছিল তন্মধ্যে ফোন বাজে। সে কল রিসিভ করে ফোন কাঁধ দিয়ে চেপে ধরে বলল,
” হ্যাঁ, মৃধা। বলো। ”

ওপাশ থেকে উচ্ছল গলা ভেসে এলো,
” ইমু, কখন আসবে? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ”
” আসছি, বাবু। পাঁচ মিনিট সময় দেও? ”

মেয়েটি শব্দ করে হেসে বলল,
” পাঁচ মিনিটই কিন্তু। ”

ইমদাদ আর কিছু বলল না। কল কেটে ফোন ঢিল মেরে রাখল বিছানায়। হাতা গুটানো শেষে আঙুল চালাল চুলে। ঠোঁটের সাহায্যে শিস বাজাতে বাজাতে সুগন্ধী মাখল শরীরে। পকেটে মানিব্যাগ পুরে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসল আয়নার সামনে। নিজেকে আগাগোড়া দেখে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন লাগছে আমাকে? ”

প্রশ্ন করেই ঠোঁট টেনে লাজুক হাসল। পরমুহূর্তেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। গাঢ় দৃষ্টি পড়ল চোখজোড়ায়। সুন্দর মুখটার মধ্যে এই চোখজোড়া অসুন্দর লাগছে কেন? এত মলিন, নিষ্প্রভ, নিস্তেজ! ইমদাদ ঘন ঘন পাতা ফেলল। ছুটে গিয়ে চোখে পানি ছেটাল বেশ কয়েকবার। তারপর পূর্বের ন্যায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” looking so handsome. ”

মৃদু হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজায় তালা মেরে চাবি ঢুকাল পকেটে। ঠোঁটের আগায় গুনগুন সুর নিয়ে সিঁড়ি কাটছে। গেইট থেকে বের হয়ে রিকশা ডাকার জন্য হাত উঁচু করল। সেসময় একটা বাচ্চা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ল তার সামনে, পায়ের কাছে। ইমদাদ রিকশা ডাক দেওয়া থামিয়ে তড়িঘড়িতে ছেলেটিকে তুলে দাঁড় করাল। বয়স পাঁচ কী ছয় হবে। নিষ্পাপ চোখ দুটি ব্যথার জলে টলটল! ঠোঁট উল্টে চিৎকার করে ডাকল,
” মাম্মাহ! ”

ডাকটি বাতাসে বাড়ি খেতে মা দৌড়ে এলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে বকাঝকা শুরু করলেন। পরনের হলুদ রঙের গেঞ্জি খুলে হাতিয়ে দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললেন। ছিলে যাওয়া অংশে ফুঁ দিতে দিতে ইমদাদকে জিজ্ঞেস করল,
” এখানে হাসপাতাল আছে? ”

ইমদাদ এতক্ষণ মাকে দেখছিল বেশ মনোযোগে। একরকম ঘোরেই চলে গিয়েছিল। তার ডাকে ঘোর ভাঙে। প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে বলল,
” জি? ”

মা কান্না জড়ানো গলায় বলল,
” এখানে হাসপাতাল আছে? ”

ইমদাদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” রক্ত বের হচ্ছে। নিশ্চয় খুব ব্যথা করছে আমার বাবাটার! ”

ইমদাদ খেয়াল করল ছেলেটি পড়ে যাওয়ার পর কান্না না করলেও এখন শব্দ করে কাঁদছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” হাসপাতাল একটু দূরে। ফার্মেসী আছে রাস্তার ঐপাশে। কিন্তু এসময় তো খোলা পাবেন না। ”

ইমদাদের কথায় মা এমনভাবে তাকাল যে তার ভীষণ মায়া হলো। বলল,
” তেমন কিছু নয়, আপা। একটু ছিলে গেছে। আমার সাথে আসুন। আমার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক মলম আছে। ”

ইমদাদ বাসার গেইটের দিকে হাঁটা ধরে পেছনে তাকায়। ছেলে কোলে মাকে সন্দেহ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” আমি ডাক্তার। এ বাসার দো’তলায় থাকি। ”

এবার একটু ভরসা করল বোধহয়। ইমদাদের পেছন পেছন রুমে ঢুকল। ইমদাদ ছেলেটির ক্ষতস্থান তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে নিওমাইসিন মলমের প্রলেপ দিয়ে বলল,
” হয়ে গেছে, আপা। ”

বাচ্চাটির মা কৃতজ্ঞতা দেখাতে মৃদু হাসল। ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। ইমদাদ রুমে তালা মেরে তার পেছনে পেছনে ধীরে নামছে। সেসময় দেখল বাচ্চাটির মা তার স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলছে। ছেলের পড়ে যাওয়া ঘটনা বলতে গিয়ে আরেকদফা কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে আবার বলছে, ‘ তুমি তো কাজের চাপে আসতে পার না, তাই আমিই চলে এসেছি। সাথে করে তোমার পছন্দের রান্না নিয়ে এসেছি। তোমার পাঠানো শাড়িও তো পরেছিলাম। কিন্তু কে জানত শাড়ি সামলাতে গিয়ে ছেলেকে সামলাতে পারব না। সব দোষ আমার, তোমার কথা না শুনে এত দূর…”

ইমদাদের নজর গিয়ে পড়ল শাড়িতে। মুহূর্তে মিহির মুখখানা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্না করা ব্যস্ত মেয়েটা মনে আঘাত করে হারিয়ে গেল। ইমদাদ শিউরে উঠল। নিজের গন্তব্য ভুলে গেল। মৃধার কথা ভুলে হাজির হলো ইশাদের বাসায়।

___________
ইশাদের হাতে কয়েক লাইনের একটি চিঠি। সেদিন তিহির বাবা রশিদ মিয়ার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে তিনি চিঠিটি এনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিহি তাজ নামের এক হিন্দু ছেলেকে ভালোবাসে। বাবা মানবে না জেনে বিয়ের আসর ছেড়ে তার সাথে পালিয়ে যায়। ইশাদ সেসময় চিঠিটি খুলে দেখেনি। আজ দেখছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার পড়া শেষ। যত পড়ছে তত দুর্বল হয়ে পড়ছে। আশা হারিয়ে ফেলছে। হতাশ মনে প্রশ্ন রাখছে, ‘ তিহির মনে আমার জায়গা হবে তো? ‘

” ইমদাদ এসেছে। ”

মায়ের গলা পেয়ে ইশাদ চিঠি ভাঁজ করতে করতে পেছনে তাকাল। বুক পকেটে রেখে বলল,
” ইমদাদ! এসময়? ”

শাহিনা শাইখা খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
” মুখটাকে এমন বানিয়েছিস যেন অবাস্তব কিছু ঘটেছে। ”

ইশাদ বসা থেকে দাঁড়াল। মায়ের দিকে এগুতে এগুতে বলল,
” তেমন নয়, আম্মু। আমার বাসায় আসার আগে সবসময় কল দেয়। আজ দেয়নি তাই অবাক হয়েছি। ”

ইশাদ বসার রুমের দিকে হাঁটা ধরলে শাহিনা শাইখা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,
” তোর বাবা খাবার টেবিলে বসে আছে। ইমদাদকে নিয়ে সেখানে চলে যা। ”

ইশাদ দূর থেকে ইমদাদকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে স্থির হয়ে বসে নেই। এক সোফা থেকে উঠে আরেক সোফাতে গিয়ে বসছে। কুশন টেনে একবার কোলে নিচ্ছে তো আবার সোফাতেই সাজিয়ে রাখছে। সেন্ট্রাল টেবিলে রাখা কাগজের ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে মুখে ঢোকাতে ইশাদ ধমকে উঠল,
” তোকে না বলেছি, আমাকে ফোন না দিয়ে বাসায় আসবি না? ”

ইমদাদ ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বোকা চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
” ফোন বাসায় ফেলে আসছি। ”

ইশাদ আর কিছু বলল না। ইমদাদের ভাব-সাব অদ্ভুত লাগছে। ছেঁড়া ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলে ইমদাদ বলল,
” তোর সাথে কথা আছে। ”

ইশাদ শুনতে পেয়েও ইমদাদের কথাটা উপেক্ষা করে বলল,
” এসেছিস ভালো হয়েছে। আমি এখনই তোকে কল দিতাম। ”

ইমদাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুমে ফিরে গেল ইশাদ। মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে ইমদাদের হাতে একটি কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল,
” তোকে একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ঠিকানা লিখে দিয়েছি। পৌঁছে আমাকে ফোন দিবি। ”

ইমদাদ বলতে চাইল, ‘ আমি এখন কোথাও যেতে পারব না। আমি মিহির সাথে দেখা করতে চাই। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? ‘

” এখনই বেরিয়ে পড়। ”

ইশাদের তাড়া দেওয়ায় ইমদাদ নিজের কথাটুকু বলতে পারল না। চুপচাপ বেরিয়ে যেতে নিলে ইশাদ পেছন থেকে বলল,
” তুই তো কিছু বলতে এসেছিলি। বলবি না? ”

ইমদাদ কাগজের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
” পরে বললেও চলবে। তোর থেকে বেশি জরুরি না। ”

_________
ইমদাদ তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার চিঁড়ে বাড়ির ভেতরে উঁকি দিতেই নিশ্বাস আটকে গেল। চোখ বড় বড় করে স্থির চেয়ে থাকল কলপাড়ের মেয়েটির দিকে। বিস্ময়াবিষ্ট থেকেই বলল,
” মিহি! ”

মিহি চাপকল থেকে জগে পানি ভরছিল। হঠাৎ পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চকিতে পাশে তাকায়। উঠোনের শেষ মাথায় ইমদাদকে দেখে বিস্মিত হয়। বিস্ময় কাটিয়ে উঠার আগেই ইমদাদ ঝড়ের মতো মিহির সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
” তুমি এখানে কী করছ? ”

মিহি বিরক্ত হলো। পানির জগ তুলে নীরবে হাঁটা শুরু করে। ইমদাদ পেছন আসতে আসতে বলল,
” আমাকে না বলে পালিয়েছ কেন? বলে আসলে কি মানা করতাম? তোমার আমাকে সেরকম মনে হয়েছিল? ”

মিহি হাঁটা থামাল। রাগ চোখে ইমদাদের মুখটিতে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায়। আবার হাঁটা শুরু করলে ইমদাদ বলল,
” এমন অভদ্রের মতো আচরণ করছ কেন? কয়েক দিন আগেও তো আমার সাথে কথা বলার জন্য আগে-পিছে ঘুরতে। ”

এ পর্যায়ে মিহি দাঁড়াল। পেছন ঘুরে বলল,
” অভদ্র আমি না আপনি? একটা মেয়ের রুমে ঢুকে ধমকাচ্ছেন। ”

ইমদাদ চট করে আশেপাশে তাকাল। সত্যি সে একটা রুমের ভেতরে চলে আসছে। বেরিয়ে যাবে ভেবেও বেরুল না। সন্দেহ নিয়ে বলল,
” তোমার রুম মানে? এটা তোমাদের বাসা? কিন্তু ইশাদ তো আমাকে অন্যকারো সাথে…”

পরের কথাটুকু মনে মনে বলল ইমদাদ। চুপচাপ কিছু একটা ভাবতে ভাবতে চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।

” কার সাথে কথা বলছিস, মা? ”

মায়ের ডাক পেয়ে মিহি চেঁচিয়ে বলল,
” চিনি না, মা। গাঁয়ে নতুন আসছে মনে হয়। ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে। ”

মিহির কথা শুনে ইমদাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। এমন ভাব ধরে বলল,
” তুমি আমাকে চিনো না? ”

মিহি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন এসেছেন? ”

ইমদাদ উত্তর দেওয়ার পূর্বেই রুবিনা এসে দাঁড়ালেন দোরগোড়ায়। ধমকের সুরে বললেন,
” অচেনা মানুষকে ঘরে ঢুকিয়েছিস কেন? ”

ইমদাদ পেছনে তাকালে রুবিনার গলার স্বর পাল্টে গেল। লাজুক হেসে বলল,
” তুমি ইমদাদ না? ”

ইমদাদ সালাম দিয়ে বলল,
” জি। কেমন আছেন, মা? ”

রুবিনা ইমদাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মেয়ের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় কাছে ডেকে নিল। ফিসফিসে বলল,
” ও আসবে আগে বলবি না? এখন কী দিয়ে খেতে দিব? ”

মিহি গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে বলল,
” উনি খেয়ে এসেছেন। এখন চলে যাবে। ”
” কী বলছিস এসব? প্রথমবারের মতো এসেছে, কিছু খাবে না? বাইরে দেখেছিস কী হাওয়া? সোয়েটারও আনেনি দেখছি। যাবে কীভাবে? ”

ইমদাদ মা-মেয়ের কথপোকথনে বুঝে গেল মিহির রাগ করে চলে আসার ব্যাপারটা মা জানে না। সুযোগকে কাজে লাগাতে বলল,
” হ্যাঁ, মা। অনেক ঠাণ্ডা। এই দেখুন কেমন কাঁপছি। ”

রুবিনা ইমদাদের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে শব্দ হলে সে দৌড়ে কোথাও গেল। একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এটা মিহির বাবার চাদর। ওম আছে। ”

ইমদাদ চাদর ভালো করে জড়িয়ে আরামভঙ্গি করলে রুবিনা মৃদু হেসে বলল,
” ভেতরে লেপ আছে। তুমি একটু বিশ্রাম নেও। আজকে আর যেতে হবে না। ”

ইমদাদ বাধ্য ছেলের মতো চৌকিতে গিয়ে বসল। লেপ ছড়িয়ে গায়ে টেনে বলল,
” আমি কিন্তু রাতে খাব। ঘুমিয়ে পড়লে ডাক দিবেন। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here