আকাশ আমার সঙ্গী
পর্ব : এক
লেখক : মো. ইয়াছিন
বাস থেকে নেমেই একটা অপরিচিত লোকের পাঞ্জাবিতে বমি করে দেয় ঝুমুর।
“করছেন কী! করছেন কী!” বলে দূরে সরে যাওয়ার আগেই যা হবার তা হলে গেল! সাদা পাঞ্জাবি হলুদ বমিতে ছেয়ে গেছে। তার উপর হজম না হওয়া আস্ত আমের আচাড়ও ভাসছে! লোকটা দম খিঁচে নাক সিঁটকিয়ে বলে, “এইটা কী হইলো? কী হইলো এইটা?”
বিস্ময়ে লোকটার চোখদু’টো কমলালেবুর মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে বমি দেখছে না, দেখছে গু কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু! অত্যন্ত কঠিন গলায় সে বলে, “নতুন পাঞ্জাবিটা শ্যাষ! আজকেও বউ আমারে পিডাইবো! এই মাইয়্যা! কী করছেন এইটা! চোউখ নাই আপনের? চোউখে দেখেন না আপনে?”
ঝুমুর জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে লোক অনেক জমে গেছে। ভীড়ের মাঝখান দিয়ে একটা ছিঁচকে চোর ঝুমুরের ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করে নিয়ে গেছে সেটা কেউ খেয়াল করেনি। এমনকি ঝুমুর নিজেও বুঝতে পারেনি। ব্যাগে টাকা কম থাকলেও সোনার আঙটি আছে। আঙটিটা বিয়ের। সেটা চুরি হয়ে গেলে বিপদ। অথচ চোর সেই আঙটি নিয়ে ফুরুৎ হয়ে গেছে!
ভারী লাগেজটা মাটিতে রেখে এক প্যাকেট টিস্যু পেপার বের করে দেয় ঝুমুর। তাই দেখে লোকটা ফায়ারপ্লেসের আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। একটানে পরনের পাঞ্জাবিটা দু’টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে বলে, “টিস্যু দিয়া দরদ দেখাইতাছেন? আমার নতুন পাঞ্জাবি নষ্ট কইরা এখন দরদ দেখাইতাছেন? এই টিস্যু আপনে আপনের মুখে ভরেন। যাতে আর বমি না বাইরোয়।”
গজরাতে গজরাতে লোকটা চলে গেলে ধীরে ধীরে ভীড় কমে আসে। ঝুমুর লাগেজ হাতে তুলে নিয়ে এক পা এগোবার আগেই বুক কেঁপে উঠে তার।
ভ্যানিটি ব্যাগটা কোথায় গেল?
বাঁ হাতেই তো ছিল!
সেই ব্যাগে বিয়ের আঙটি!
বিয়ে হয়েছে মাত্র একমাস। এরই মধ্যে আঙটি হারিয়ে ফেলল সে!
চঞ্চল চোখে চারপাশ খুঁজে নেয় ঝুমুর।
নিশ্চয়ই কেউ ব্যাগটা পেয়ে চম্পট মেরেছে!
তিনদিন বাপের বাড়িতে বেড়ানো শেষ করে স্বামীর সংসারে ফিরছিল ঝুমুর। এইতো সামনে সিএনজি স্টেশন। সিএনজি করে গেলে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। এইটুকু পথ হলেও ওই আঙটি ছাড়া এক পা এগোতে সাহস পেল না ঝুমুর। কারণ যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে সেই মানুষটাকে এখনও ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেনি সে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে।
চারপাশে ঝাঁ করে কুয়াশা নেমেছে। লোকজন ভারী শীতের কাপড় গায়ে দিয়ে চলাফেরা করছে। ঝুমুরের পরনে পাতলা সালোয়ার কামিজ। তবুও গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে তার। চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে। কী হবে এখন? মালেক যদি জানতে পারে, ঝুমুর বিয়ের আঙটি হারিয়ে ফেলেছে তখন!
“আপা, কই যাবেন?”
অল্পবয়স্ক সিএনজি চালকের ডাকে ঘোর কাটে ঝুমুরের। দ্বিধান্বিত স্বরে সে বলে, “সি ব্লক।”
“উঠেন।”
ঝুমুর একহাতে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসে। কিন্তু এখানেও যে আরো একটা বিপদ হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
একটু যাওয়ার পর ঝাঁকানি দিয়ে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। চালক পেছনে তাকিয়ে বলে, “আপা, গাড়িটা ডিস্টার্ব করতেছে। ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট নেওয়া লাগবে। একটু নামবেন?”
ঝুমুর সরল মনে নেমে যায়। লাগেজটা রয়ে যায় গাড়িতেই। সে নেমে পড়তেই সিএনজিটা সাঁই করে ছুটে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই হাওয়া। যাঃ! এবার লাগেজটাও নিয়ে গেল! লাগেজে সব কাপড়চোপড়, কসমেটিকস্, পছন্দের কয়েকটা উপন্যাসের বই। সবগুলো খোয়া গেল!
কুয়াশায় যেমন ঘাসের বুকে জল জমে, ঠিক তেমনি করে অল্প একটু জল জমেছে ঝুমুরের চোখে। ঝাপসা চোখে সে নিষ্ঠুর শহরটাকে দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ তার কপালে কী আছে কে জানে!
চলবে