হিউবট(থ্রিলার) পর্বঃ-০২

0
1365

#হিউবট(থ্রিলার)
পর্বঃ-০২
লিখা- সুহাসিনী

শান আর কাল বিলম্ব না করে অক্সিজেন মাস্কটা ওর মুখে লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না।৷ তার আগেই দিপা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। একরাশ রহস্য রেখেই মেয়েটা মারা গেল। পেটের স্বচ্ছতা আস্তে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে তার। পাশেই ছোট বাচ্চাটি নিষ্পলক চেয়ে আছে দিপার নিথর দেহটির দিকে।
ডাক্তার এন্থনি একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই শেষ। বাইরে তার বয়স্কা মা বসে আছেন। ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি করে যেভাবে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন! তাকে কী জবাব দেবে সে! আতঙ্কগ্রস্থ চোখে সে চেয়ে আছে দিপার দিকে। ডাক্তার এন্থনি এই ওসানার রহস্য আহামরি কিছুই জানেন না। কিন্তু শানের মনে তখন অন্য কিছু চলছে। সে বলল,
– মিস দিপার শরীরে এখন এক্স-রে করতে পারি, স্যার?

এন্থনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। মৃত শরীরে এক্স-রে করে বিশেষ লাভ কী! তাছাড়া পার্মিশনেরও ব্যাপার থাকে। বিস্ময় নিয়েই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
– কেন?
– আপনার জীবনে কখনো এমন বিশেষ ডেলিভারি করেছেন- যেখানে মাত্র ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট মেয়ে থাকে? তাও আবার এত পুষ্ট একটা বাচ্চা। সেসবও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু দিপার পেট দেখেছিলেন না? অমন স্বচ্ছ পেট! ভিতরকার সমস্ত কিছু তার দেখা যাচ্ছিল। আপনি বুঝতে পারছেন স্যার?

এন্থনি মাথা দুলালেন। ক্ষনিক মুহুর্ত কীসব ভেবে তিনি বললেন,
– হয়তো ঠিকই বলেছো। বাচ্চাটাকে বেবি রুমে রাখার ব্যবস্থা করো। আর ওর মাকে এখনই জানানোর দরকার নাই। কাজটা ইললিগ্যাল হবে যদিও। তবে এই রহস্যের শেষ দেখা দরকার আমাদের।

এন্থনির নির্দেশে বাচ্চাটাকে নার্সদের একজন বেবি রুমে রেখে এসেছে। পাশের আরেকটি দরজা দিয়ে শান এবং এন্থনি দিপার মৃত শরীরটাকে এক্স-রে রুমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। তবে শুধুমাত্র এক্স-রে করেই তারা ক্ষান্ত নয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফিও বাদ দিতে পারেনি কেউই।

সব ঠিকঠাকভাবে হবার পর স্ক্রিণের দিকে চেয়ে শান একেবারে হতভম্ব হয়ে যাবার উপক্রম। রিপোর্টেও একই। দিপার শরীরে যকৃত নেই। কয়েকবার করে দেখার পরও ফলাফল সেটাই দেখাচ্ছে। একটা মানুষের শরীরে যকৃত না থাকলে সে বাঁচবেই বা কী করে! কিন্তু ডাক্তার এন্থনি এটাই ভেবে পাচ্ছেন না, দিপার যকৃত না থাকলে এতদিন সে কীভাবে বেঁচে ছিলো। নাকি এর ভিতর ভিন্ন কোনো গল্প লুকিয়ে আছে! ব্যাপারটা তিনি কোনোভাবেই মেলাতে পারছেন না। তবে এই বিষয় নিয়ে তিনি মোটেও পড়ে থাকতে চান না। ডাক্তারদের অনেক কিছুই ভুলতে হয়। ভুলে থাকতে হয়। শত শত মৃত্যু, শত শত শরীর, জীবন। সব মনে রাখতে গেলে আর ডাক্তার হয়ে ওঠা যায় না। দিনশেষে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে হয় তাদের। ঠিক একারণেই ডাক্তাররা বিশেষ করে সার্জনরা অতীতের গল্পগুলো ভুলে থাকবার চেষ্টা করেন।

তিনি শানকে বিষয়টা এখানেই ক্লোজ করে অন্য কাজে মনোযোগ দিতে বলে বাইরে বের হয়ে এলেন। শান তেমনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে ডাক্তার এন্থনি বাইরে এসে একটু বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেছেন। অন্যান্য ডাক্তার এবং নার্সরা কী জানি বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত। ইমার্জেন্সি মিটিং ডাকা হিয়েছে। সবার দিকে এক পলক চেয়ে ওয়াশরুম থেকে তিনি ফ্রেশ হয়ে নিলেন। তারপর সোজা চলে গেলেন চেয়ারম্যানের রুমে। তার আগেই কয়েকজন ডাক্তার এবং নার্সও এসে হাজির হয়েছেন। শুধুমাত্র শানের কোনো উপস্থিতি পাওয়া গেল না। শানকে নিয়ে কেউ তেমন আগ্রহও অবশ্য এখন দেখাচ্ছে না। সবার চিন্তা এখন অন্য বিষয়ে।

চেয়ারম্যান স্যার একটা সিসিটিভি ফুটেজ ওপেন করলেন সবার উদ্দেশ্যে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা বেবি রুম থেকে বাচ্চা চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টা কারোরই চোখে পড়েনি! পরবর্তীতে তদারকি করতে গিয়ে বাচ্চা খুঁজে পাওয়া না গেলে অবশেষে ডিউটিরত নার্স এবং ওয়ার্ড বয় বিষয়টা এসে জানায়।

চেয়ারম্যান স্যার বললেন,
– এখন আমরা এই বাচ্চাটার অভিভাবক এবং মাকে কী জবাব দেবো? আপনারাই এর সমাধান দিন। এভাবে আমার প্রতিষ্ঠানের বদনাম আমি হতে দিতে পারি না।

ডাক্তার এন্থনিই সবার আগে মুখ খুললেন। নিজের এপ্রোনটা বাম হাতের কনুইয়ের ভাঁজে রেখে বললেন,
-বাচ্চাটার গায়ের রঙ খয়েরি! তবে আপনার দুশ্চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। এই বাচ্চার মা আর বেঁচে নেই। ওর মায়ের নাম দিপা। মেয়েটার শরীরে কোনো যকৃত নেই। আমি রিপোর্ট করার আগেই ইমার্জেন্সি মিটিংয়ে চলে এলাম!

– আর উনার গার্ডিয়ান?

-সেটারও প্রয়োজন নেই। কারণ যিনি বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছেন, উনিই বাচ্চাটির নানি। মিসেস ওসানা।

-উনি কি হাসপাতালের বিল দেন নাই?

রিসিপশনের মেয়ে দুটো নিশ্চিত করলো, ওসানা সমস্ত বিলই দিয়ে গেছেন আগেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এভাবে বাচ্চা নিয়ে উধাও কেন হয়ে গেলেন, সেটাই বোধগম্য নয়। তাছাড়া দিপার মৃত শরীরটাও তো হস্তান্তর করতে হবে। নিজের মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়াটা কেমন মায়ের কাজ!
হাসপাতালের চেয়ারম্যান নির্দেশ দিলেন, লাশটা যত দ্রুত সম্ভব হস্তান্তর করার জন্য।
ডাক্তার এন্থনি শুধু মাথা দুলালেন। একটা শব্দও করলেন না আর।

রাত আটটার সময় মিসেস ওসানার বাসার সামনে এম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো। হাসপাতাল থেকে চল্লিশ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে এই ওসানার ঠিকানা। আশেপাশে বাড়িঘরের তেমন বালাই নেই। কেবলই গাছপালা আর নির্জনতা। যে কয়টি বাড়ি ঘর ওসানার আশেপাশে আছে, সেগুলোও এক কিলোমিটার বা আধা কিলোমিটার দূরে। মূলত এই অঞ্চলের প্রতিটা বাসাই এমন। খুব সম্ভবত কারো সাথেই কারো তেমন যোগাযোগ নেই। ওসানার ঘরের আশেপাশে বিশাল বড় বড় কয়েকটি মেহগনি গাছ। ঝড়ে বোধহয় একটা উপড়ে পড়ে আছে রাস্তার প্রায় সাথেই। ওসানার ঘরটাও বেশ বিলাসবহুল। সুন্দর দোতলা বাসা। কলিংবেল ছাড়া দরজা ভাঙারও উপায় নেই একদমই।

প্রায় বিশ পঁচিশবার বেল বাজানোর পরেও দরজা খোলা হলো না। এম্বুলেন্সের সাথে ডাক্তার শানও এসেছে। ড্রাইভার একটু অবাক হলেও শান তাকে জানিয়েছে- দিপা মেয়েটা তার পূর্ব পরিচিত। তাই ওর বাড়ির লোকের পাশে তার দাঁড়ানো উচিত। ড্রাইভারও আর সাত পাঁচ না ভেবে তাকে নিয়ে আসতে রাজি হয়ে যায়। সাথে আরও ২ জন আছেন লাশ বহন করার জন্য।

আরও প্রায় পনেরো মিনিট সময় অতিবাহিত হবার পর ওসানা একটা লাল রঙের গাউন পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। যেন কিছুক্ষণ আগে বিশেষ অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি। নিজের মেয়েকে এইভাবে হাসপাতালে ফেলে এসে আনন্দ উৎসব করাটা ড্রাইভার এবং তার সঙ্গীদের কাছে বিচ্ছিরি লাগলেও শানের কাছে খুবই স্বাভাবিক। যেন এটাই হবার ছিলো। ড্রাইভার জানালো,
-আপনি কী জানেন, আপনার মেয়ে মারা গেছে!

– কীসব আজেবাজে কথা বলছেন আপনারা! আমার মেয়ে মারা যাবে কেন!

ওসানা প্রশ্নাতুর ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলো। শানের মনে হচ্ছে, এই মহিলা নির্ঘাত অভিনয় করছে। ড্রাইভার তখন এম্বুলেন্সের দরজা খুলে দিপার লাশ দেখিয়ে বলল,
– এই দেখুন, আপনার মেয়ের লাশ। আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে? উনাদের ডেকে পাঠান। লাশ হস্তান্তর করে আবার হাসপাতালে ফিরতে হবে আমাকে।

ওসানার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কিন্তু কাঁদলেন না। নরম শুরে জবাব দিলেন,
– আমার বাসায় আর কেউ নেই। আমি একাই থাকি। আপনারা লাশ নামিয়ে দিয়ে যান।

ড্রাইভার কিছুটা অবাক হলেও বিশেষ গায়ে নিলো না ব্যাপারটা। লাশবাহী এম্বুলেন্স ড্রাইভারদের বিবেক, শোকাত্মা বলে কিছু রাখে না তারা। এসব রাখতে গেলে লাশ টানা যায় না। লাশ নামিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো। শান ড্রাইভারকে একটু থামতে বলে ওসানার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর বলে,
– আপনার নাতনীকে এভাবে নিয়ে আসার মানে কী?

– ওর নাম ধরে ডাকুন। ওর নাম সনো।

-আপনার মেয়ের জন্য আপনার মায়া নেই? আপনি আছেন তার ছেলেকে নিয়ে।

ওসানা একবার দিপার লাশের দিকে তাকালো। কিন্তু ওর চোখ দিয়ে এক ফোটাও পানি বের হলো না। শানের ভীষণ রাগ হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছে ওর নিজের প্রতিই। এই দিপা মেয়েটার প্রতি তার ভীষণ রকম মায়া জন্মে গেছে। এভাবে তার প্রতি অবিচার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলেই ফেললো,

– আপনি একজন ধূর্ত মহিলা।

– আপনার কথা বলা শেষ হলে যেতে পারেন।

এরকম কড়া জবাবে শান আর প্রতুত্তর করতে পারে না। চুপচাপ এম্বুলেন্সে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। গাড়ির পেছনের গ্লাসের ভিতর দিয়েই শান পিছনে চেয়ে দেখে, দিপার লাশের বাক্সটা টানতে টানতে ওসানা ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের মৃত্যুতেও তার পরনে লাল গাউন। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। দরজার সাথে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দেড় বছর বয়সী আরেকটা বাচ্চা ছেলে। হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে ওসানার দিক। কী ভয়ংকর দৃশ্য সে!

চলবে….

প্রশ্নঃ- দিপার কি ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here