#নিষিদ্ধ_বরণ,১১,১২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১১)
” উনার হাসিটা দেখেছিস? মনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ”
সুমিকে অনুসরণ করে নিহিতাও তাকাল মাহদীর দিকে। নিমিষেই নিহিতার বিস্ময়াভিভূত চোখ জোড়া চুম্বকের মতো আটকে গেল মাহদীর মুচকি হাসি টানা ঠোঁট জোড়ায়। সেই সময় মায়ের কণ্ঠ পেল। নাস্তা খেতে ডাকছেন। নিহিতা চমকে উঠল। শরীর কেঁপে উঠল। চোখের পাতা পড়ল ঘন ঘন। ভ্রান্ত বদনখানি স্বাভাবিক হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। অতঃপর তাড়া দিল সুমিকে,
” চল, ভেতরে চল। ”
সুমি গড়ি-মসি চালে নিহিতার পেছন ধরল। দরজার কাছটাতে এসে থেমে গেল নিহিতা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে না তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল পেছনে। আড় চোখে আরও এক বার স্থির চাহনি আঁকল মাহদীর উপর। দৃষ্টি গাঢ় হতেই কানের কাছে অদৃশ্য স্বরে বেজে উঠল হযরত আলী (রা) কে বলা নবী (স) এর উক্তিখানা, ‘হে আলী, এক নজরের পর দ্বিতীয় নজর দিও না। প্রথম নজর তো ক্ষমাপ্রাপ্ত কিন্তু দ্বিতীয় নজরে ক্ষমা নেই।’ নিহিতার ভেতরটা কেঁপে উঠল! উত্তপ্ত ছ্যাকা পড়ল বুঝি অন্তরে! গলে গেল এত বছরের গড়ে তোলা আত্ম অহমের ভিত! আপনমনে উচ্চারণ করল, ‘ আমার পর্দা ছুটে যাচ্ছে! ‘
__________
নাস্তা খেতে খেতে মায়ের দিকে তাকাল নিহিতা। একটা প্রশ্ন গলার মধ্যেখানে এসে আটকে আছে। না করে শান্তি পাচ্ছে না। খাবার বিস্বাদ লাগছে। এত সময় খাবার নিয়ে বসে থাকার মেয়ে নয় নিহিতা। সুমি অর্ধেক খেয়ে উঠে পড়তে নিহিতা প্রশ্ন করে বসল,
” আম্মু, নায়রা আপুর বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল? ”
আসমা রহমান সুমির ফেলে যাওয়া প্লেট গুছাচ্ছিলেন। চোখে-মুখে অসন্তোষের ছাপ! তন্মধ্যে মেয়ের প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেন? ”
নিহিতা উত্তর দেওয়ার সাহস পেল না। আগ্রহান্বিত চাহনি নামিয়ে ফেলে খাবারে মনোযোগ দিল। মুখে খাবার তুলতে তুলতে মনে পড়ল, নায়রা আপুর বিয়ের খবরটা ফোনে শুনেছিল নিহিতা। তখন সে মাদরাসায় থেকে পড়াশোনা করছে। পড়ালেখার ভারি চাপ! মাসের শেষের এক দিন কী দুই দিনের জন্য বাড়িতে বেড়াতে আসে। আপুর বিয়ের খবর শুনে সে খুব দুঃখ পেয়েছিল। বিস্মিতও হয়েছিল। বিস্ময় নিয়ে জানতে চেয়েছিল বিয়ের ব্যাপারে। মা কিছু না বলেই ফোন কেটে দিয়েছিলেন। এরপর ছুটিতে বাড়ি এসে সামনাসামনি একই প্রশ্ন করেছিল আম্মুকে। সেবারও বলেননি, উল্টো ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘ ছোটদের এসব জানতে নেই। ‘ নিহিতা স্বগতোক্তি করল, ‘ আমি কি এখনও ছোট? ‘
চেয়ার টানার শব্দে পাশে তাকাল নিহিতা। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল,
” শরীর খারাপ লাগছে, আম্মু? ”
আসমা মেয়ের প্রশ্ন বোধ হয় শুনলেন না। নিজ থেকে বলতে শুরু করলেন,
” সেদিন তোর নানির বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। পথিমধ্যে রিকশা থামালেন পাশের গ্রামের এক ভাবি। বললেন, ‘ তোমার বেটি নাকি একলা একলা বিয়া করছে হ! জামাই নিয়া পুরা গ্রাম ঘুরি বেড়াউছে?’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমার মেয়ে যে এমন কাজ করতে পারে না এটা বিশ্বাস করাতে চাইলাম। উনি বিশ্বাস করলেন না উল্টো আমাকে বিশ্বাস করিয়ে দিলেন আমার মেয়ে এমন কাজ করতে পারে, করেছে। আমার মন অস্থির হয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরেই নায়রার রুমের দরজা আটাকালাম। জানতে চাইলাম ছেলেটি কে? নায়রা প্রথমে কিছু বলল না। মাথা নিচু করে কেঁদে দিল। আমার মায়া হলো। বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। নায়রার পাশে বসতে নায়রা আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে জানাল, ছেলেটির নাম মাহদী। স্টেশনে দেখা হয়েছিল। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার কলেজে একটা ঝামেলা হয়ে যায়। ভুল করে বিয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ে পুরো কলেজে। সেখান থেকে গ্রামে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। আমি ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। এই সমস্যার সমাধান কী হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ভাবলাম, তোর বাবাকে বলে দেখি। নায়রাকে ছেড়ে তোর বাবার খোঁজে বাইরে আসতে দেখলাম উঠোনে কয়েক জন অপরিচিত মানুষ। সাথে সাথে বুঝতে না পারলেও পরে জানতে পেরেছিলাম উনারা মাহদীর মা-বাবা। মাহদীর জন্য নায়রাকে চায়তে এসেছে। ”
” তারপর বিয়ে হয়ে গেল? ”
মাঝখানে মেয়ের প্রশ্ন শুনে চোখ পাকালেন আসমা রহমান। নিহিতা কৌতূহল দমিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আসমা রহমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” না হয়নি। তোর বাবা ভেবেছিল মাহদী হিন্দু। পরে অবশ্য জেনেছিল সে মুসলমান। তবুও রাজি হলেন না। তিনি চেয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ, খোদা ভীরু, ইসলামিক ধারায় জীবনযাপন করা কোনো সাদামাটা ছেলেকে মেয়ের জামাই করতে। সে দিক দিয়ে দেখলে মাহদী একদমই উল্টো। উগ্র স্বভাব, রগচটা, চাল-চলনে অভদ্রভাব। তোর বাবার মুখেই শোনা ধর্মে বিশ্বাস নেই একদম। চোখ বন্ধ করে নাস্তিকদের দলে ফেলে দেওয়া যায়।
তিনি ভেবেছিলেন ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যাবে। কিন্তু না মিটেনি। নায়রাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করল।রাস্তা-ঘাটে নায়রার সাথে এমন অশালিন আচরণ করত যে, দূর থেকে দেখে যে কেউ ভাববে মাহদী নায়রার স্বামী। ভেবেছিলও। সকাল-বিকাল বাড়িতে মানুষজন এসে তোর বাবার কাছে নালিশ করে যেত। তিনি বাধ্য হয়ে নায়রার বাইরে যাওয়া বন্ধ করলেন। এতে মাহদী আরও হিংস্র হয়ে উঠল। যখন তখন বাড়িতে ঢুকে চ্যাঁচামেচি করত, এটাসেটা ভাঙত। নায়রাকে তুলে নিয়ে যাবে এসব বলে শাসাত। নায়রার বাবা ধৈর্য্য হারিয়ে থানাই যাওয়ার তোরজোর করছিলেন। তার যাওয়ার পথ আটকাল নায়রা। হঠাৎ বলে বসল, ‘ আমি উনাকে বিয়ে করতে রাজি। ‘ তোর বাবা সাথে সাথে কিছু বললেন না। আপত্তি করলেন। বাবা-মেয়ের মধ্যে কথার দ্বন্দ্ব চলল অনেক্ষণ। এক পর্যায়ে তোর বাবা জানতে চাইলেন, ‘ তার মধ্যে এমন একটা গুন দেখা যার উপর ভরসা করে তোকে তার হাতে তুলে দেব। ‘ নায়রা বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। মাথা নিচু করে থাকলে তিনি আবার বললেন, ‘ আজ পর্যন্ত যা যা করেছে সবটাই তোর জানা। আমার থেকে বেশি জানা। তাহলে বল কোন বিশ্বাসে এই বিয়েতে রাজি হব? যেখানে আমি অনুমান করতে পারছি তুই সুখে তো দূর ভালোও থাকতে পারবি না। ‘ নায়রা আর চুপ থাকল না মুক্ত গলায় বলে দিল, ‘ বিশ্বাস আসলে কোনো মানুষের উপরে নয়, সৃষ্টিকর্তার উপর রাখা উচিত। কারণ, তিনিই সমগ্র মানব মন ও শরীরের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী। আমি তাঁর উপর বিশ্বাস রেখে এই রাগী, একরোখা, পথভ্রষ্ট মানুষটাকে বিয়ে করতে চাই। বাবা, তুমি কি আমাকে সেই অনুমতি দিবে? ‘
তোর বাবা আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ”
” তারপর বিয়েটা হলো? ”
আসমা বেগম শক্ত চোখে তাকালেন। পর মুহূর্তে মন খারাপের গলায় বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু বিয়ের পর মেয়ের জামাইয়ের মুখদর্শন করেননি। মাহদীও না। দুজন একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি। নায়রা অনেক চেষ্টা করেছিল দুজনের রাগ ভাঙাতে। পারেনি! ”
ছোঁয়াচে রোগের মতো মায়ের মন খারাপটা নিহিতার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। প্লেটের শেষ খাবারটুকু জোর করে শেষ করল।
_______________
কিছু একটা ভাঙার শব্দ পেয়ে রুম থেকে ছুটে এলো নিহিতা। রান্নাঘরের কাছাকাছি পৌঁছাতে মায়ের গলা পেল। কাউকে ধমকাচ্ছেন খুব! নিহিতা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল নতুন কাজের মহিলাটিকে বকছেন। অপরাধ চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে।
কাজের মহিলাটি নিহিতার খুব একটা পরিচিত নাহলেও আসমা রহমানের পরিচিত। বাপের বাড়িতে রিন্টুর মা নামে ডাকে সবাই। ঐ বাড়িতে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। কয়েক দিনের জন্য এ বাড়িতে আনা। মাকে দেখার জন্য যখন তখন ছুটতে হয় আসমা রহমানের। তার অনুপস্থিতিতে রিন্টুর মা এ বাড়িতে থাকবে। হাতে-হাতে এটাসেটা এগিয়ে দিবে।
নিহিতা রিন্টুর মাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল,
” ইচ্ছে করে ফেলেনি তো, আম্মু। ছেড়ে দেও। ”
আসমা রহমানের রাগ আরও বেড়ে গেল। বলল,
” তোকে বলেছি সালিশি করতে? তুই ও কে চিনিস? ইচ্ছে করেই এমন করে। যাতে কিছু করতে না দেয় কেউ। আমার মায়ের কাপ-পিরিচ তো এই ভেঙেছে! ”
নিহিতা চোখের ইশারায় রিন্টুর মাকে চলে যেতে বলল। সে ও আর এক দণ্ড দাঁড়াল না। অনেকটা দৌড়ভঙ্গিতে ছুটে পালাল। নিহিতা মাকে শান্ত করে বলল,
” আজ কী রান্না হচ্ছে, আম্মু? ”
” চচ্চড়ি, মুরগির মাংস আর ভর্তা। ”
” ভর্তা? কী ভর্তা? ”
” মাছের ভর্তা। ”
কথা বলতে বলতে সেদ্ধ করা মাছে হাত দিলেন আসমা রহমান। কাঁটা ফেলায় মনোযোগি হলে নিহিতা কৌতূহল নিয়ে বলল,
” কাঁটা ফেলছ যে? পাটায় বাটলেই তো হবে। ”
আসমা রহমান সামান্য হাসলেন। বললেন,
” কাঁটা থাকলে মাহদী খাবে না। ”
” কেন? ”
” ভয় পায়! কাঁটা দেখলেই নাকি গলা ব্যথা করে। ”
” উনি বলেছে তোমাকে? ”
” না, নায়রার কাছে শুনেছিলাম। ও বেছে দিলে তবে খেত। নাহলে খেত না। ”
” কেন? উনি বাছতে পারেন না? ”
” পারবে না কেন? ”
” তাহলে? ”
” নিজের উপর ভরসা নেই। ”
নিহিতা কিছু বলতে চেয়েছিল, বলল না। অজান্তেই হেসে ফেলল।
” চ্যাঁচাচ্ছিলে কেন? ”
বাবার কণ্ঠ পেয়ে নিহিতা তটস্থ হলো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
এরশাদ রহমান স্ত্রীর নিকটে এসে হতাশা কণ্ঠে বললেন,
” তোমাকে কথা বলা শেখাতে পারলাম না। ”
আসমা রহমান মাছ ফেলে স্বামীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন,
” পারবেও না। ”
এরশাদ রহমান ভ্রু বাঁকালেন। স্থির চোখে চেয়ে থাকলেন স্ত্রীর দিকে। কতক্ষণ পর নরম গলায় বললেন,
” মেয়েদের কথা বলতে হয় নরম হয়ে, নীচু স্বরে। যাকে বলছ সে ছাড়া যেন অন্য কেউ শুনতে না পারে। ”
আসমা রহমান মুখ বাঁকালেন। বললেন,
” পারব না। অনেক শিখিয়েছ, আর শেখাতে হবে না। ”
স্ত্রীর অশিষ্ট আচরণে রাগ করার বদলে নীঃশব্দে হেসে ফেললেন এরশাদ রহমান। সেই মুচকি হাসিতে মুগ্ধ দৃষ্টি নিহিতার। বাবার এই হাসিটা খুব পছন্দ তার। মায়ের এই আচরণটাও। বাবা-মায়ের এই মিষ্টি ঝগড়াটুকু সেই প্রায় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। আজও দেখল। তবে অন্য দিনের তুলনায় আজ অন্য রকম লাগছে। কেন? নিহিতার ভাবনা পথেই হঠাৎ মাহদীর হাসিমাখা মুখখানা উঁকি দিয়ে হারিয়ে গেল!
__________
সন্ধ্যার চা বানিয়ে মাহদীর রুমের দিকে যাচ্ছিলেন আসমা রহমান। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল নিহিতা। বলে বসল,
” আমি নিয়ে যাই, আম্মু? ”
আসমা রহমান সন্দেহ চোখে তাকালেন। বললেন,
” তুই নিবি? কেন? ”
নিহিতা কিছুক্ষণ ইতস্ততায় ভুগে বলল,
” তুমি তো রান্না বসিয়েছ। পুড়ে গেলে? ”
আসমা রহমান মেয়ের কথায় গলে গেলেন। নিহিতার হাতে চা দিয়ে বললেন,
” তোকে যেতে হবে না। বারান্দায় রিন্টুর মা আছে। ওর কাছে দিয়ে আয়। ”
নিহিতা চা হাতে বারান্দায় গেল। রিন্টুর মাকে দেখেও যেন দেখল না। উঠোন পেরিয়ে মাহদীর রুমের দরজায় কড়া নাড়ল। মাহদী দরজা খুলে আশ্চর্য হয়ে গেল। আশ্চর্যান্বিত প্রশ্ন করল,
” তুমি? ”
নিহিতা ঘাবড়ে গেল। হাত-পা কাঁপছে। কাপ থেকে চা ছিটকে পড়তে মাহদী চটজলদি চায়ের কাপ নিজের হাতে নিয়ে বলল,
” তুমি ঠিক আছো? ”
নিহিতা উত্তর দিতে পারল না। মাহদীর দিকে তাকাতে পারল না। ফিরে যেতেও পারল না। সেই সময় মন ছুটে এলো। নিহিতার পেট জড়িয়ে বলল,
” খালামনি! ”
নিহিতা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। দরজার একপাশ চেপে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। মনকে অন্য হাতে জড়িয়ে বলল,
” ছোট বাবা! কিছু বলবে? ”
মন নিহিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” বাবা, খালামনিকে বলো ভেতরে আসতে। আমাদের সাথে খেলবে। ”
মাহদী আপত্তি দেখালেও নিহিতা মনকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
” তোমরা বুঝি খেলছিলে? ”
” হ্যাঁ, তুমি খেলবে? ”
” কী খেলছ? ”
মন উত্তর দেওয়ার আগে মাহদী বলল,
” তেমন কিছু নয়। তোমার মনে হয় পড়া আছে। ”
নিহিতা বুঝতে পারল মাহদী তাকে চলে যেতে বলছে। তবুও না বুঝার ভান ধরে মনকে বলল,
” চলো খেলি। ”
নিহিতা মনকে নিয়ে বিছানার কাছে পৌঁছাতে মাহদী বলল,
” তোমরা খেল। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। ”
কথাটা বলেই মাহদী বেরিয়ে পড়ল।
চলবে
[ কিছু কি বুঝলেন? মূল কাহিনি আসছে ধীরে ধীরে। তবে আপনারা যেটা ভাবছেন সেটা নয়।]
#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১২)
বাসর রাতে বউয়ের ঘোমটা না খুলেই প্রশ্ন করল মাহদী,
” বিয়েতে রাজি হলে কেন? ”
নায়রা নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয়। মাহদী আরেকপা এগিয়ে আসল। ঘোমটা তোলার খুব একটা আগ্রহ ধরা পড়ল না। হাত দুটো বুকে বেঁধে এক পায়ে ভর ছেড়ে কাত হয়ে দাঁড়াল। চোখেমুখে শক্ত ভাব। সন্দেহ চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” আমার প্রেমে পড়ে গেছ এমন হতেই পারে না। এই কয় দিন তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি, বিরক্ত করেছি। তবুও এক বারের জন্য নিজ থেকে আমার দিকে তাকাওনি। তাহলে হঠাৎ মন পাল্টে গেল কীভাবে? আমি কারণ জানতে চাই,নায়রা ”
এবারও নীরব থাকল নায়রা। সামান্য নড়ল না পর্যন্ত! মাহদী আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। আচমকা ঘোমটা সরিয়ে ফেলল। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি ফেলে বলল,
” অনেক চুপ থেকেছ আর নয়। এবার কথা বলতে শিখ। মুখ তোলো। ”
নায়রা কাঁপল বোধ হয়। নিশ্বাস আটকে রাখল। তবুও মুখ তুলল না। মাহদী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। চোখের রক্তিম আভা গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। নাকের পাতা ফুলে উঠতেই নায়রার থুতনি চেপে ধরল। মুখ তুলে বলল,
” বিয়ে যখন করেছ আমার দিকে তাকানোও অভ্যাস করো। এখন তো পরপুরুষ নই। ”
মাহদীর বলে যাওয়া কথার মধ্যেই আরও কয়েক বার কেঁপে উঠল নায়রা। বন্ধ চোখের পাতা ও আশেপাশের অংশে হালকা কুঁচকে যাওয়ার দাগ পড়ল। সেই দাগ ডুবিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। মাহদী ভেজা চোখজোড়াই চোখ রেখে বলল,
” বুঝেছি। প্রশ্নটা তোমার বাবাকেই করতে হবে। চিন্তা করো না, নাম্বারটা এখনও সেইভ আছে। ”
মাহদী নায়রার থুতনি থেকে হাত সরিয়ে নিল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরতে হাত চেপে ধরল নায়রা। অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার বাবাকে আর কষ্ট দিবেন না, প্লিজ! ”
মাহদী সাথে সাথে কিছু বলল না। অন্তর্নিহিত দৃষ্টি রাখল নায়রার মুখে। সহসা বলল,
” তাহলে বিয়ে করার কারণ এটাই? ”
নায়রা মাথা নিচু করে ফেলল। হাত সরিয়ে নিতে গেলে অন্য হাত দিয়ে আটকে নিল মাহদী। বিজয়ী হেসে বলল,
” তার মানে আমার অক্লান্ত পরিশ্রম বিফলে যায়নি! বাবা মেয়ে দুজনই হারল? ”
নায়রার ঝুকে থাকা মুখখানা আরেকটু বুকের দিকে চেপে গেল। মাহদী উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল,
” তুমি কি সারাজীবন এমন মাথা নিচু করেই থাকবে? আমার সাথে কথা বলবে না? আমাকে দেখবে না? ”
নায়রা চুপ থাকলে মাহদী বলল,
” তুমি তো আমাকে ভালোবাস না। তাহলে কি আমরা এক বিছানায় শুব না? ”
নায়রা এবার সস্বভাব থেকে বেরোতে বাধ্য হলো। বিস্মিত চোখে তাকাল মাহদীর উপর। তার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব! করুণ স্বরে বলল,
” আমার কি ভদ্র ছেলেদের মতো অন্য রুমে শোয়া উচিত? নাকি মা-বাবা জেনে যাবে সে ভয়ে সোফায় কিংবা নিচে বিছানা পেতে শুতে হবে? নায়রা, এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমি তো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি! ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় আছি! ”
নায়রার চাহনি বদলাল না। উপরন্তু বিস্ময়ের ছটা চোখ ছেড়ে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝরে পড়া অশ্রুকণা শুকিয়ে চোখের কোল ছেড়েছে। মাহদী ভারী নিশ্বাস ছাড়ল। নায়রার পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে বলল,
” তুমি কিন্তু ভালোবাসতে বেশি সময় নিও না। ভালোবাসা হয়ে গেলে সাথে সাথে জানাবে। আবার লজ্জা দেখাতে গিয়ে বুকে চেপে রেখো না। তুমি তো জানোই আমার ধৈর্য্য খুব কম। একেবারেই নেই! ”
মাহদী মেঝেতে বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতে করতে বলল,
” ধৈর্য্য বাড়ানোর কোনো দোয়া আছে? আমাকে শিখিয়ে দেও তো! ”
নায়রা কিছু বলার পূর্বেই মাহদী নায়রার মুখের কাছে মাথা নিয়ে আসল আকস্মাৎ। অনুরোধ করে বলল,
” শেখাতে হবে না। তুমি মনে মনে পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিয়ে দেও। ”
নায়রা প্রথমে ভয় পেল পর মুহূর্তে হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে কিছু একটা বিড়বিড় করল। অতঃপর মাহদীর মাথার তালু বরাবর ফুঁ দিল কয়েক বার। মাহদী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিলে নায়রা শরীরের গয়না খুলল সাবধানে। শাড়ি পালটে বাতি নিভিয়ে পুনরায় বিছানায় আসল। বালিশে মাথা রেখে ডানপাশে কাত হতে মাহদীর গলা ভেসে এলো,
” ভদ্র ছেলে হওয়া অনেক কষ্টের! ”
নায়রা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। অন্ধকারেও বুঝতে পারল মাহদী বিছানায় উঠছে। তার পাশে শুলো নীঃশব্দে। নায়রা তাৎক্ষণিক ঘাড় সোজা করল। নিশ্বাস আটকে চোখ বন্ধ করে নিতেই মাহদীর হাতের স্পর্শ পড়ল কোমরে! কানের কাছে নিশ্বাসের শব্দ পৌঁছানোর পূর্বে ঠোঁটের নরম ছোঁয়া পড়ল গলদেশে! নায়রার নিশ্চুপতাতে সঙ্গী করে মাহদী বলল,
” নায়রাকে পেয়েছি, নায়রার মনও পাব। তার জন্য দূরে থাকা কেন? আমি এত ভদ্র ছেলে নই। তাহলে তো তোমার সাথে দেখাই হতো না। নায়রা, তোমার দোয়া কাজ করেনি। মন থেকে পড়োনি, তাই না? ”
ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই। নায়রার মাথা বুকে চেপে ধরে শুয়ে আছে মাহদী। চোখ বন্ধই ছিল। হঠাৎ খুলল। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
” তোমার মনে কি একটু ভালোবাসা জমেছে? ”
নায়রা ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রায়। মাহদী জোর করে মুখ তোলায় তা ছুটে গেল। দুর্বল চোখে তাকালে মাহদী আবার বলল,
” জমেছে? ”
নায়রা তখনও বুঝতে পারল না। সেকেন্ড কয়েক পর কিছু বলতে চাইল। তার আগেই মাহদী ওর মুখ ছেড়ে দিল। বুক থেকে সরিয়ে দিল। অন্য বালিশে মাথা রেখে ভার স্বরে বলল,
” একটুখানি ভালোবাসা জমতে এত সময় লাগে? আমার তো লাগেনি! ”
নায়রা তাকে মানানোর জন্য কাঁধে হাত রাখল। নরম স্বরে ডাকল,
” শুনুন না? রাগ করছেন কেন? একটা রাত তো পার হতে দিন! ”
মাহদী ফিরল না। কাঁধ থেকে নায়রার হাত সরিয়ে দিল। রাগ নিয়ে বলল,
” ভালোবাসা জমতে রাত পার হতে হয়? আমার তো হয়নি। কয়েক সেকেন্ডে ভালোবাসা জমে গেছিল। ”
নায়রা আবার হাত রাখলে মাহদী এবারও সরিয়ে দিল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” ঘুমাতে দেও। বিরক্ত করো না। সরো এখান থেকে। ”
নায়রার অভিমান হলো। কষ্ট হলো। চোখে অশ্রু জমল। মাহদীর কাছ থেকে সরে অন্য দিকে মুখ ঘুরে শুয়ে বলল,
” আপনাকে একটুও বুঝতে পারি না। আপনি খুব অদ্ভুত। ”
মাহদীর মন টলল না। রাগ কমল না। পূর্বের গলায় বলল,
” পারবেও না। এখন মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে! ”
নায়রা আর মাহদীর বিবাহ জীবনের প্রথম পাতাটি মনে করতে করতে হাঁটছিল মাহদী। হঠাৎ কেউ একজন তাকে টেনে সরিয়ে আনল রাস্তার কিনারে। সেই সময় একটা লাল রঙের গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে গেল পাশ দিয়ে। জানালা গলিয়ে মাথা বের করে একজন চিৎকার করে বলল,
” পাগল নাকি? রাত-বিরাতে গাড়ির তলে মরতে এসেছে! ”
মাহদী হতভম্ব চোখে গাড়িটির চলে যাওয়া দেখছিল। তখনই এরশাদ রহমান ধমকে উঠলেন,
” কী সমস্যা? এত রাতে এই পথে কী করছ? আমার আসতে আরেকটু দেরি হলে কী হতো বুঝতে পারছ? একদম পিষে দিত! ”
মাহদী তখনও চিন্তাশক্তির বাইরে। বোকা চোখে চেয়ে আছে শ্বশুরের দিকে। তিনি আবার বললেন,
” কী হয়েছে? তোমাকে এমন লাগছে কেন? ”
মাহদীর কী যে হলো! আচমকা জড়িয়ে ধরল একশাদ রহমানকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপনি প্রথম দিনে রাজি হননি কেন, বাবা? তাহলে তো নায়রাকে আরও কয়েকটা দিন বেশি পেতাম! ”
এরশাদ রহমান কিছু বলতে পারলেন না। মাহদীকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন।
_______________
মাহদী বাসায় ফিরল শ্বশুরের সাথেই। তার ধারণা ছিল মনকে নিয়ে নিহিতা নিজেরের ঘরে গিয়েছে। হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। তাই শ্বশুরের সাথে সে ঘরের দিকে এগুচ্ছিল। এক কদম এগুতে তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। নিহিতার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। সে কিছুটা অবাক হলো। খানিকটা সন্দেহ মনেই দক্ষিণ দিকের ঘরটির দিকে এগুলো।
খালামনির মুখে মায়ের গল্প শুনতে শুনতে প্রশ্ন করল,
” আম্মুও তোমার মতো বোরকা পড়ত? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখনই ছেলেদের সামনে আসত না? ”
” না। ”
” তাহলে তুমি আসো কেন? ”
এ পর্যায়ে চটপটে উত্তর দিতে পারল না নিহিতা। পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কখন আসলাম? ”
” এখন। ”
নিহিতা সতর্ক চোখে আশপাশ দেখে বলল,
” এখানে তো কোনো ছেলে নেই। ”
মন নিহিতার হাতের বাঁধন থেকে ছুটে দাঁড়িয়ে বলল,
” এই যে আমি আছি। খালামনি, আমি ছেলে না? ”
নিহিতা অবাক হলো। পরক্ষণে একগাল হাসল। মনকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল,
” তুমি তো আমার ছোট বাবা। ”
” ছোট বাবার সামনে আসা যায়? ”
নিহিতা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। দরজায় ঠকঠকের শব্দ হলো। মন দরজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কে? ”
মাহদী জবাব দিল,
” তোমার বাবা। ”
মন তাৎক্ষণিক চোখ নিয়ে আসল নিহিতার দিকে। নিহিতার ঘাড়ে পড়ে থাকা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে দিল সযত্নে। তারপর বলল,
” এবার আস, বাবা। ”
ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেয়েও ঢুকল না মাহদী। বাইরে থেকে বলল,
” নিহিতা, বাবা এসেছেন। ”
নিহিতা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা নিচু করে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমার আপু কি আপনাকে ভালোবাসতে পেরেছিল? ”
মাহদী ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। নিহিতা আবার বলল,
” আপুকে ভালো রাখতে পেরেছিলেন? সুখী করতে পেরেছিলেন? ”
মাহদী বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিল। অন্ধকারে ডুবে থাকা উঠোনের দিকে চেয়ে থেকে নিজের ছেলেকে ডেকে আনল। আদেশের মতো বলল,
” মন, তোর নানিকে ডেকে নিয়ে আয়। ”
মন নানিকে ডাকতে দৌড় দিলে নিহিতা শঙ্কিত স্বরে বলল,
” আম্মুকে ডাকছেন কেন? আম্মুকে দিয়ে কী হবে? ”
মাহদী কাঠ গলায় বলল,
” অপেক্ষা করো। ”
চলবে