#নিষিদ্ধ_বরণ,১৫,১৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৫)
নিহিতা তখন গোসল করেছে মাত্র। ভেজা চুল থেকে তোয়ালে খুলে হিজাবটা হাতে নিয়েছিল ওযু করবে বলে। মায়ের গলা পেয়ে সেভাবেই বাইরে ছুটল। বারান্দা ধরে সোজা হেঁটে গেলে লেবু গাছটা পড়ে। নিহিতা বারান্দা পেরোতে পারল না। তার আগেই চোখ দুটো আটকে গেল গেইটের দিকে।
শূভ্র রঙের পাঞ্জাবিখানায় মসৃণ মুখটা বড্ড কোমল, স্নিগ্ধ ও মসৃণ দেখাচ্ছে। দেহ কাঠামো থেকে যেন পবিত্র আলোর স্ফুরণ ঘটছে! ঠোঁটের মুচকি হাসিটা নিহিতার হৃদয়ে ছুরির ফলার মতো বিঁধতেই ধপাস শব্দ হলো! বারান্দা থেকে গড়িয়ে লেবু গাছের তলাতে গিয়ে থামল নিহিতার দেহখানি। ভয়ে, আতঙ্কে, টাল সামলাতে লেবুর একটি ঢাল চেপে ধরেছিল ডান হাতে। কাঁটা ফুটতেই আর্তনাদ করে উঠল!
ব্যথিত কণ্ঠস্বর সর্ব প্রথম পৌঁছাল মনের কানে। মাহদীর কোলে থেকেই চিৎকার করল,
” খালামনি! ”
তারপর তরতর করে নেমে আসল মাটিতে। বাবাকে ফেলে উঠোনের মধ্যখানে ছুটছে। মাহদী ছেলেকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে। ছেলের কাছে দাঁড়াতে নিহিতার গোঙানি শব্দ পায়। ঘাড় ফিরে তাকাতে কিঞ্চিৎ ভয় পায়। নিহিতার কাছে পৌঁছায় ঝড়ের গতিতে! উঠানোর জন্য হাতে ধরতে গিয়েও থেমে যায়। বলল,
” কীভাবে পড়লে? সাবধানে উঠো! ”
নিহিতা মাটিতে হাতের ভর রেখে উঠতে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। চোখ ছেড়ে পানি গড়িয়ে পড়তে বলল,
” পারছি না! ”
ততক্ষণে মন নানিকে ডেকে এনেছে। তিনি মেয়ের হিজাব ঠিক করে দিয়ে চুল ঢাকলেন। পাজামা টেনে গোড়ালি ঢেকে বললেন,
” পড়লি কিভাবে? ”
নিহিতা উত্তর দিল না। হাতে বিঁধে থাকা কাঁটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে উঠল। মাহদী ব্যাপারটা খেয়াল করে হাতের কাঁটা টেনে তুলল দ্রুত। তাড়া দিয়ে বলল,
” ও একা উঠতে পারবে না। আপনি সাহায্য করুন। কাঁটাস্থানে ওষুধ দিতে হবে। ”
কথাটা বলতে বলতে গেটের দিকে তাকাল। এরশাদ রহমান নামাজ শেষে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলছিলেন। মাহদীরাও সাথে ছিল। মন পানি খেতে চাওয়াই শ্বশুরকে রেখে চলে আসতে হয়েছে। এখনও আসছেন না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল সে।
আসমা রহমান সর্ব শক্তিতে মেয়েকে তুলতে সফল হলেন। মায়ের হাতের জোরে নিহিতা সোজা হয়ে দাঁড়ালেও হাঁটতে পারল না। একপা সামনে এগুতে পড়ে যাচ্ছিল মাহদী চট করে ধরে ফেলে। নিহিতা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” মনে হয় পা-টা ভেঙে গেছে! ”
কথাটা মায়ের উদ্দেশ্যে বললেও উত্তর দিল মাহদী,
” আরে না! উপর থেকে পড়েছ তো তাই মচকে গেছে একটু। ”
মাহদীর কথায় খুব একটা আস্থা পেল না নিহিতা। মাহদী নিজেও অনাস্থায় ভুগছে। না দেখে কিভাবে বুঝল মচকে গেছে? সে কি ডাক্তার? মাহদী নিজের বলে ফেলা উক্তিতে লজ্জা পেল। মাঝখান থেকে আসমা রহমান বললেন,
” এখন ঘরে নিব কিভাবে? ”
আসমা রহমানকে ছুটে বাইরে বের হতে দেখে রিন্টুর মা পিছু নিয়েছিল। দূরে থেকে বলল,
” কোলোত নেন। খালাম্মা আপাক কোলোত নেন। ”
আসমা রহমান রেগে গেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,
” ও কি বাচ্চা? আমি কিভাবে কোলে নেব? না বুঝে কথা বলতে আসবি না। ”
রিন্টুর মাকে শাসিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর অসহায় স্বরে বললেন,
” তোর বাবাও বাসায় নেই। কখন আসবেন কে জানে! এভাবে আর কতক্ষণ থাকবি? ”
রিন্টুর মা আবারও কথা বললেন,
” খালুক লাগবে ক্যান? হামারে দুলাভাই আছে না? উনাক নিবা কন। ”
আসমা রহমান অগ্নি চোখে তাকালেন। কিছু বলতে পারলেন না। মন বাবার পাঞ্জাবি টেনে বলল,
” ও বাবা, খালামনিকে কোলে নেও। ব্যথা পাচ্ছে তো! ”
আসমা রহমান নাতির দিকে তাকালেন, মাহদীও। তারপর শাশুড়ি ও মেয়ে জামাইয়ের চোখাচোখি হলো। মাহদী ম্লান হাসল। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” কোলে নিতে হবে কেন? একপা মচকেছে তো কী হয়েছে? অন্য পা আছে না? ওটা দিয়ে যেতে পারবে। ”
নিহিতার ডানহাতটা নিজের কাঁধে রেখে বলল,
” ছোটবেলায় কুতকুত খেলনি? ”
নিহিতা উত্তর দেওয়ার পূর্বে বলল,
” না খেলে থাকলে আজ খেলবে। এসো আমি সাহায্য করছি। ”
নিহিতা কুতকুত খেলার চেষ্টা করল না। মাহদীর উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। আসমা রহমান ও রিন্টুর মায়ের সহযোগিতায় খাটে শুয়ে পড়ল। মাহদী রুম থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। পড়ার টেবিলের সামনে একটি ফটোফ্রেমের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে যায়। একটা বাচ্চাকে আরেকটা বাচ্চা চুল বেঁধে দিচ্ছে। চিরুনি হাতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” এটা নায়রা? ”
আসমা রহমান মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন মাহদীর দিকে। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” আপনাদের বাসায় ছবির ফ্রেম? অবাক লাগছে খুব! ”
” কেন? ”
” নায়রা আমাকে কখনও ছবি তুলতে দিত না। বাবা নাকি পছন্দ করেন না! ”
” হ্যাঁ। উনি এসব পছন্দ করেন না। ছবি তোলা ভালো নয়। খুব প্রয়োজন হলে তবেই তুলেন। ”
” তাহলে এটি? ”
আসমা রহমান মাহদীর দিকে ঘুরে বসল। বললেন,
” এটা ওর মামা তুলেছিল। বিদেশি মোবাইলের প্রথম ছবি। নিহিতার বাবা জানতেন না। পরে বাঁধিয়ে নিহিতাকে উপহার দিল তখন আর সরাতে পারেননি। কেউ ধরলেই কাঁদত খুব! ”
মাহদী ছোট্ট নায়রার মুখটায় হাতের তালুর নরম স্পর্শ রাখল। চোখ বন্ধ করতে দেখতে পেল নায়রা নিহিতার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ছবিটা আগের জায়গায় রেখে দিল। মাহদী নিহিতার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসল। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
” মা, ঐ ছবিটা আমাকে দেওয়া যায় না? ”
আসমা রহমান চমকে তাকালেন। পর মুহূর্তে মেঘে ঢেকে গেল মুখখানা। সেভাবে নিহিতার দিকে তাকালেন। নিহিতা শোয়া অবস্থায় ছবিটার দিকে তাকাল। পর মুহূর্তে মাহদীর দিকে। লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল,
” দিয়ে দেও, আম্মু। ”
” তোর কষ্ট হবে না? ”
” না। উনি আমার থেকেও বেশি যত্নে রাখবেন। ”
আসমা রহমান ছবিটা মাহদীর হাতে দিতে সে বুকে চেপে ধরল। কৃতজ্ঞ হাসি দিয়ে চলে গেল। নিহিতা তার চলে যাওয়ার পানে চেয়ে স্বগোতক্তি করল, ‘ ওখানটাই তো আমিও আছি। তার বুকের ওমটা কি আমাকেও ছুঁয়ে দিল? ‘
ভাবতেই নিহিতা ভেতরে ভেতরে উষ্ণ অনুভূতি টের পেল।
” তোমরা এখন যাও, আম্মু। আমার নামাজ বাকি আছে। ”
আসমা রহমান রিন্টুর মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে মনের দিকে তাকাল নিহিতা। বলল,
” ছোট আব্বু, তুমি একটু নানির কাছে যাও? আমার নামাজ শেষ হলে ডাকব। ”
” তোমার ব্যথা ভালো হয়ে গেছে, খালামনি? ”
” না। ”
” তাহলে নামাজ পড়বে কিভাবে? ”
নিহিতা মৃদু হাসল। বলল,
” বসে বসে। ”
” বসেও নামাজ পড়া যায়? ”
মনের কণ্ঠ থেকে বিস্ময় গলে পড়ল যেন! চোখেমুখে নিদারুন কৌতূহল।
” হ্যাঁ, যায়। কেউ দাঁড়াতে না পারলে সে বসে নামাজ পড়তে পারে। বসতে না পারলে শুয়েও পড়তে পারবে। আল্লাহ আমাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। ”
এর মধ্যে রিন্টুর মা ওযু করার পানি দিয়ে গেল। নিহিতা আদুরে স্বরে বলল,
” ছোট আব্বু, এবার নানির কাছে যাও। ”
” কিন্তু আমার যে বসে বসে নামাজ পড়া দেখতে ইচ্ছে করছে, খালামনি। একটু থাকি? ”
মনের অনুরোধে নিহিতা হেসে ফেলল। বুকে জড়িয়ে বলল,
” আচ্ছা। থাক। কিন্তু আর কখনও এমন অনুরোধ করবে না। ঠিক আছে? ”
মন দারুন খুশিতে রাজি হয়ে গেল।
________________
বিকেলে চায়ের বদলে কফি দেখে অবাক হলো মাহদী। কফির কাপের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া। তার শুরুতে ইংলিশে লেখা ‘ Thank you ‘ তারপর নিচে বাংলায় লেখা, ‘ আপনি যে চা খান এটা মাকে বলেননি কেন? আপুটাও কী মন ভোলা! আপনাকে নিয়ে এত গল্প করেছে অথচ এই ছোট্ট অভ্যাসের কথা বলেনি। আপুর হয়ে আমি দুঃখিত। এখন থেকে আর চা খেতে হবে না। ‘
মাহদী কাগজটা মুচড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মন বারান্দায় চেয়ার পেতে মোয়া খাচ্ছে। ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
” তুমি খালামনিকে বলেছ আমি কফি খাই? ”
মন খানিকটা ছিটকে উঠল। পরক্ষণে ভেবে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” খালামনি জানতে চেয়েছে তাই। ”
” কী জানতে চেয়েছিল? ”
” সব তো মনে নেই, বাবা। ”
মাহদী শক্ত চাপে কাগজখানা চেপে ধরে বড় বাড়িটার দিকে তাকাল। চুপচাপ রুমে ফিরে এসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
” নানিকে বলে এসো, আমি তার হাতে চা-ই খাব। কফি যেন আর না বানায়। ”
” কফি তো নানি বানায়নি। ”
” তাহলে? ”
” খালামনি বানিয়েছে। ”
মাহদী কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিতে গিয়েও দিল না। ছেলের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা তুমি খাও। শেষ হলে খালামনিকে বলে আসবে, আমি শুধু তোমার আম্মুর হাতের কফি খাই। ”
_____________
পরের দিন সকালে মনকে ঘুমে রেখে শ্বশুরের সাথে বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিল মাহদী। ফিরে আসতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পুরো রুম ঝকঝকে, তকতকে। সব কিছু বেশ পরিপাটিভাবে গুছানো। সাজাতে গিয়ে এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় সরানো হয়েছে। মেঝেটা ভিজে। বোধ হয় মাত্রই ধুয়েমুছে দিয়েছে কেউ। একটা অন্য রকম ঘ্রাণও পাচ্ছে। একটু খোঁজ করতেই উৎস মিলল। বিছানার কাছের ছোট টেবিলটার উপর স্তুপকারে বেলি ফুল রাখা। তা দিয়ে খেলছে মন। পাপড়ি দিয়ে বিছানা মাখামাখি! মাহদী জানতে চাইল,
” ফুল কোথায় পেলি? ”
মাহদী টেবিলটি দেখিয়ে বলল,
” এখানে। ”
মাহদী বুঝল মন জানে না। তার ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ রেখে গেছে হয়তো। মাহদী আর মাথা ঘামাল না। ঘামে ভেজা শার্ট পালটাতে গিয়ে দেখে তার জামাকাপড় নেই কোথাও। মনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,
” খালামনি নিয়ে গেছে। ”
” কেন? ”
” ধুয়ে দিবে তাই। তুমি নাকি ধোও না। গন্ধ করছিল! ”
মাহদী আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আমি কাপড় ধুই না! আমার কাপড়ে গন্ধ! ”
চলবে
#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৬)
মাহদী শান্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও থাকতে পারছে না। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসছে। নাকের পাটা ফুলছে ঘন ঘন। শ্বাস ছাড়ছে ভারী ভারী। ঘামে ভেজা শার্টটা আরও ভিজে উঠছে। অস্থির হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বারান্দার এপার থেকে ওপারে যেতে মন ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” কাপড় ইস্ত্রী করতে দিয়েছে, বাবা। বিকেলে খালামনি দিয়ে যাবে। ”
মুহূর্তেই মাহদীর মাথা গরম হয়ে গেল। মেজাজ সাত আসমান পার হলো বুঝি! এই নিয়ে চার বার ও ঘরে পাঠাল মনকে। প্রথম বার জানাল, কাপড় পাউডার দিয়ে ভিজিয়েছে। পরের বার বলল, ধুচ্ছে। তারপরের বার রোদে শুকাতে দিয়েছে। আর এখন বলছে ইস্ত্রী করতে দিয়েছে। কেন? সে কি একবারও বলেছে কাপড় ধুয়ে দিতে? আবার ইস্ত্রী করতে? যেখানে শাশুড়িকেই এসব কাজ থেকে দূরে রেখেছিল মাহদী। সেখানে নিহিতার হস্তক্ষেপ একদম পছন্দ হচ্ছে না তার। বরঞ্চ বাড়াবাড়ি ঠেকছে। অসহ্যও!
এদিকে ঢাকায় ফেরত যাওয়ার আগে একবার শিহাবের সাথে দেখা করার কথাও ছিল মাহদীর। দুপুরের নামাজ শেষ করে রওনা দিবে ভেবেছিল। এখন তো মনে হচ্ছে নামাজটাও পড়া হবে না। মাহদী গা থেকে শার্ট খুলতে উদ্যত হলো। আর কতক্ষণ নোনাজলে শরীর ডুবিয়ে রাখবে? শার্টের উপরের দিকে বোতাম খুলতে খুলতে নিচে আসতে থেমে যায় আচমকা। কী ভেবে সরাসরি দৃষ্টি রাখে অদূরে বড় বাড়িটির মূল দরজায়। খুব একটা স্পষ্ট না হলেও তার মনে হলো পর্দা নড়ছে। কেউ যেন ছুটে পালাল! নিমিষেই মুখের ভাব বদলে গেল মাহদীর। কপালের চামড়ায় দীর্ঘ ও গভীর ভাঁজ পড়ে। পাশ দিয়ে মন ছুটে যেতে নিলে হাত ধরে ফেলল। চাপা গলায় বলল,
” রুমে যাও। ”
মন বাবার দিকে তাকাল। চাহনি বলছে, বাবার কথাটি মানতে চাচ্ছে না সে। ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। খালামনির কাছে থাকতে তার খুব ভালো লাগে। কী মিষ্টি করে কথা বলে! কত আদর করে! ছুটাছুটি খেলা খেলে। আবার মায়ের গল্পও বলে। যেগুলো বাবা তাকে বলেনি। খালামনি বলেছে, এই গল্পগুলো শুধুমাত্র সেই জানে। আর কেউ না।
মাহদী চিন্তা জগৎ থেকে ফিরে ছেলেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। নাক দিয়ে বুকে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
” অনেক ছুটেছ। এবার গোসল করতে হবে। ”
মন হাসির চোটে কিছু বলতেই পারল না। বাবা যখন বিছানায় নামিয়ে গেঞ্জি খুলছে তখন বলল,
” আজ খালামনির কাছে গোসল করি, বাবা? ”
মাহদী কোনো ভাবনায় না গিয়ে বলল,
” না। ”
” কেন? ”
মাহদী চুপ থেকে বলল,
” তুমি বড় হয়েছ তাই। ”
” বড় হলে খালামনির কাছে গোসল করা যায় না? ”
” না। ”
” কিন্তু খালামনি যে বলল, গোসল করিয়ে দিবে। ”
মাহদী আবারও চুপ হয়ে গেল। সেই সময় কারও পায়ের শব্দ ভেসে এলো। মাহদী বুঝতে বুঝতে পায়ের আওয়াজটি তার নিকটে চলে এসেছে। সে ঘাড় ঘোরাতে চোখ পড়ল একদম নিহিতার মুখে। অন্য সময়ের মতো ওড়নার এক প্রান্ত মুখে চাপা দেওয়া নেই। মাহদী ছিটকে এক কদম পাশে সরে গেল। নিহিতা অপ্রস্তুত হলো। পরক্ষণে মিষ্টি হাসল। হাতের প্যাকেটটা মাহদীর দিকে বাড়িয়ে স্বাভাবির স্বরে বলল,
” গোসল করে এটা পরে নিবেন। ”
প্যাকেটটার দিকে সন্দেহ দৃষ্টি মাহদীর। ভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী এটা? ”
” পাঞ্জাবি। একদম নতুন। আপনার পছন্দ হবে। ”
” কী করে বুঝলে আমার পছন্দ হবে? নিজের পছন্দের উপর এত বিশ্বাস? ”
” আমার পছন্দের উপর নয়। ”
” তাহলে? ”
” আপনার পছন্দের উপর। আমি জানি কালো রঙ আপনার খুব প্রিয়। ”
মাহদী বিস্মিত হলো। চিন্তায় পড়ল। পাঞ্জাবিটা নিবে কী নিবে না দ্বিধায় ভুগছে। দ্বিধান্বিত অবস্থায় দরজার দিকে হেঁটে আসলে নিহিতা বলল,
” রেখে যাচ্ছি, পরে নিয়েন। বিকেলের আগে অন্য কাপড় পাচ্ছেন না। নামাজ পড়বেন তো নাকি? ”
মাহদী থামল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বারান্দায় নেমে আসল। চেয়ারটাতে বসতে ক্লান্ত ভাব ছড়িয়ে পড়ল তনু-মনে। মনকে নিয়ে নিহিতা উঠোনে নামতে মাহদীর টনক পড়ল। আপনমনে প্রশ্ন করল, ‘ তার উপহার গ্রহণ করার জন্যই কি এত কিছু করল? নাহলে ধোয়া কাপড় আবার ধুতে যাবে কেন? তার মধ্যে পরার জন্য একটি কাপড়ও রাখেনি। নিহিতা এত বোকা? ‘
মাহদী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। রুমে ফেরত যেতে নিলে মোয়াজ্জিনের সুমধুর ডাক কর্নগহ্বর দিয়ে মন ও মস্তিষ্ক ছুঁয়ে দিল। সাথে সাথে উঠোনে নেমে আসল। বড় বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে ডাকল,
” মা? ”
আসমা রহমান ভেতরে রান্নাঘরের কাজ করছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের ডাক শুনতে পাননি। খবর নিয়ে গেলেন রিন্টুর মা। হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে দ্রুতপদে ছুটে আসেন। শাশুড়িকে দেখে মাহদী বলল,
” বাবার একটা পাঞ্জাবি দেওয়া যাবে? ”
আসমা রহমান কারণ জানতে চাইলেন না। কাঠের আলমারিতে ভাঁজ করে তুলে রাখা একটা নতুন পাঞ্জাবি এনে দিলেন।
___________
মনকে নিয়ে নামাজে যাওয়ার আগে নিহিতার দেওয়া পাঞ্জাবিটা মনের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা খালামনিকে দিয়ে আসো। নানিকে বলে আসবে, আমরা এক চাচ্চুর বাড়িতে যাচ্ছি। ফিরতে বিকেল হবে। ”
মন আদেশ পেয়েই দৌড়ে চলে গেল। ফিরে এলো মিনিটের মধ্যেই। ছেলেকে নিয়ে গেইট পার হয়ে রাস্তায় পা রাখে মাহদী। ঢিলে হওয়া পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতের ট্রেনেই ঢাকা ফিরবে। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মন খারাপ করা মেয়েটিকে সে আর মন খারাপ করাতে চায় না। মেয়েটিকে যে নায়রা খুব ভালোবাসত!
___________
” সকালে গেলে হতো না, বাবা? ”
আসমা রহমানের অনুরোধে মাহদী হালকা হাসল। তার হাত থেকে চামচ নিয়ে তরকারির বাটি থেকে একটু ঝোল তুলে নিল নিজ পাতে। ভাত মেখে মনের মুখে দিতে দিতে বলল,
” চিন্তা করবেন না, মা। রাতে সফর করা অভ্যাস আছে আমার। ”
আসমা রহমান অনুরোধের স্বরটা গাঢ় করতে চাইলে মাহদী দ্রুত বলল,
” আপনার হাতের মোয়া মনের খুব পছন্দ হয়েছে। বানানো আছে কি? তাহলে ওর জন্য…”
” হ্যাঁ, আছে তো। তোমরা খাও, আমি এখনই বোয়ামে ভরে দিচ্ছি। ”
আসমা রহমান তড়িঘড়িতে চলে গেলে মাহদী চৌকস হাসল। বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে। এভাবে অনুরোধ রক্ষা করতে গেলে এ বাড়ি ছাড়া হবে না তার। যদিও সে বুঝতে পারছে মেয়ের অভাবটা তাদের দিয়ে পূরণ করতে চাচ্ছে। তবুও কিছু করার নেই। তাকে যে যেতেই হবে। যত দ্রুত সম্ভব।
খাওয়া পর্ব শেষ করতে আসমা রহমান মোয়া ভর্তি বোয়াম নিয়ে আসলেন। সাথে আরও কিছু শুকনো খাবার ও ফলফলাদি। মাহদী ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সহজমনে সব কিছু গ্রহণ করল। এরশাদ রহমান এলেন তারও কয়েক মিনিট পর। হাতভর্তি শপিং ব্যাগ। বিছানায় রেখে একগাল হেসে বললেন,
” দুই দিন বলেছ বলে যে দুই দিন থাকবে বুঝতে পারিনি। তাহলে এগুলো আরও আগে কিনে আনতাম। এখন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সব ঠিকঠাক…”
শ্বশুর কথা শেষ করার আগেই সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল মাহদী। চাপা গলায় বলল,
” নায়রা নেই কিন্তু তার সাজানো সংসারটা এখনও আছে। একবারটি আসবেন তো? ”
এরশাদ রহমানের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। মন ভারাক্রান্ত হলো। বুকের কোথাও একটা চিনচিন ব্যথা উঠল। মাহদী আরেকটু গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” সে জীবিত থাকতে ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি। এখনও কি পারব না, বাবা। ”
এরশাদ রহমান কাঁপা হাত রাখল মাহদীর পিঠে। ছলছল চোখে বলল,
” আসব। অবশ্যই আসব। খুব শীঘ্রই। ”
মাহদী খুশি হলো। কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। শ্বশুরকে ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস গলায় বলল,
” নায়রা আপনার গায়ের রঙ পায়নি কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি নায়রাকে….”
মাহদী কথাটা শেষ করতে পারল না। লজ্জায় চিবুক লাল হলেও সেই প্রথম দিনের মতো বলল,
” আজকালকার ছেলেরা বাবার সাথে মিশে বন্ধুর মতো। মেয়ে পটানো থেকে শুরু করে কোথায়, কিভাবে, কয়টা চুমু খাবে এ সকল পরিকল্পনা করে হাতে মদ ভর্তি গ্লাস নিয়ে। আমি ভালো দেখে বউয়ের কথা বলেছি। তাও আপনার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ”
এরশাদ রহমান আগের চেয়েও বেশি লজ্জা পেলেন। বিব্রত হলেন। অস্বস্তি কাটাতে বললেন,
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ”
তিনি পর্দা ঠেলে বেরিয়ে যেতে মাহদী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে খেয়াল করল দরজার ওপাশে একটি নারী ছায়া। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মনের চুলে আঙুল ডুবাল মাহদী। চুল ঠিকঠাক করে বলল,
” খালামনির থেকে দোয়া নিয়ে আসো। ”
মন খুশিমনে বেরিয়ে গেল। দরজার পাশে খেয়াল না করে উঠোনে নামতে গেলে নিহিতা পেছন থেকে জড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। নিজেদের বারান্দায় পৌঁছে নামিয়ে দেয়। ধার ঘেষে বসে বলল,
” সত্যি চলে যাচ্ছ, ছোট আব্বু? ”
মন উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” মিথ্যামিথ্যি যাওয়া যায়, খালামনি? ”
নিহিতা হালকা হাসল। মনের কান টেনে বলল,
” দুষ্টুমি হচ্ছে? ”
মনও হাসল। নিহিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভার কণ্ঠে বলল,
” তোকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। আরও কয় দিন থেকে যা না। ”
” বাবাকে বলো। বাবা থাকলে আমিও থাকব। ”
” তোর বাবা আমার কথা শুনবে না। ”
” শুনবে। আমার বাবা খুব ভালো। ”
নিহিতা আর কথা প্যাঁচাল না। সরাসরি বলল,
” তুই গিয়ে বল। ”
” কী বলব? ”
” আরও কয়েক দিন থাকতে। ”
” আমি বললে থাকবে? ”
” হ্যাঁ, তুই তো বললি তোর বাবা খুব ভালো। তোর আবদার ফেলতে পারবে না। আর যদি রাজি না হয় কান্নাকাটি করবি। ”
” এমনি এমনি কাঁদব? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিন্তু আমার যে কান্না পাচ্ছে না, খালামনি। ”
” জোর করে কাঁদবি। তোর বাবা তোকে খুব ভালোবাসে। কাঁদতেও হবে না। কাঁদার ভান করলেই রাজি হয়ে যাবে। ”
মন নিহিতার দিকে তাকাল। অসন্তুষ্টের চাহনি! বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি বাবাকে ধোঁকা দিতে পারব না। ”
কথাটা বলে মন হাঁটা ধরে। বাবার কাছে ছুটে যাওয়ার আগে হাত ধরে ফেলে নিহিতা। মন ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে নিহিতা শক্ত করে চেপে ধরে। হঠাৎ কী যে হলো! মনকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে ফেলে দিল। উপর থেকে গড়িয়ে একটা ভাঙা ইটে মনের মাথা বাড়ি খেলে নিহিতা গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল। ভয়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
নিহিতার চিৎকার শুনে মাহদী রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আসমা রহমান পেছনে। এরশাদ রহমান গেটের বাইরে রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলছিলেন। তিনিও দ্রুত কদমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। উঠোনের মাঝামাঝিতে পৌঁছাতে মাহদীর গলা পেল,
” মন? আমার বাবা? চোখ খোল। ”
মন চোখ খুলতে গিয়েও পারল না। কপালের রক্ত গড়িয়ে চোখের পাতা ছুঁতে জ্ঞান হারাল।
আসমা রহমান নাতির কাছে বসে উদ্বিগ্নচিত্তে মেয়ের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” ও পড়ল কিভাবে? ”
নিহিতা দুর্বল গলায় বলল,
” জানি না। ”
মাহদী ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের জন্যে ছুটলে এরশাদ রহমান সঙ্গী হলেন। আসমা রহমান গেট পর্যন্ত এগিয়ে থেমে গেলেন। রিকশাটা দূরে মিলিয়ে গেলে মেয়ের কাছে এসে বললেন,
” মন তো তোর সাথেই ছিল। ”
নিহিতা ভয়ে ভয়ে বলল,
” আমি একটু ভেতরে গেছিলাম। তারপর বাইরে এসে দেখি..”
নিহিতা আর কিছু বলতে পারল না। বারান্দার মেঝেতে ভার ছেড়ে বসে পরনের জামাটা খামচে ধরল। নাভি শ্বাস তুলে নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘ এত বড় মিথ্যে কিভাবে বললি, নিহিতা? ‘
চলবে