#অনান
#পর্ব-৮
পুরো বাড়ি খুজেও যখন নীরাকে পেলো না তখন মোর্শেদের বড্ড ভয় হলো। নীরার আবার কিছু হলো না তো? আজ সারাদিনে একবারও কথা হয়নি নীরার সাথে। ভেবেছিলো অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে জরুরি কাজে আটকে গেলো আর বাড়ি ফেরার কথা মাথা থেকে পুরোপুরি আউট হয়ে গেলো। মোর্শেদ বারকয়েক নীরাকে ডাকলো কিন্তু কোনো সারা পেলো না। মোর্শেদ এবার ঘামতে লাগলো। কি করবে না করবে মাথা কাজ করছে না একদম। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছিলো কাকে ফোন দেবে। পরমুহূর্তেই মনে হলো, আরে নীরাকেই তো ফোন করা হয়নি। নীরাকেই একবার ফোন দিয়ে দেখা যাক। ফোন বাজছে বেডরুমে। মোর্শেদ দৌড়ে গেলো, দেখলো বিছানায় ফোনটা অলস পড়ে আছে। মোর্শেদ মাথা চুলকে একবার ভাবলো, ফোন আছে তারমানে ফোনের মালকিনও বাড়িতেই থাকার কথা। তবে সে আছে কোথায়? কি মনে হতেই মোর্শেদ একবার বারান্দায় উঁকি দিলো। যা ভেবেছিলো তাই, নীরা দু’হাটুর মাঝে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। মোর্শেদের ভ্রু কুঁচকে গেলো, এভাবে বসে আছে কেন মেয়েটা? বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো।
“এই নীরা, কি হয়েছে তোর? এভাবে অন্ধকারে বসে আছিস কেন?”
মোর্শেদের গলা শুনে নীরা চকিতে একবার ঝট করে মোর্শেদের দিকে তাকালো তারপর উঠে এসে মোর্শেদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মোর্শেদ কিছুটা বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রিয় মানুষটা এতো কাছে মোর্শেদের খুশি হওয়ায় কথা। এই দিনটার জন্য কবে থেকে ওয়েট করছে সে। অথচ আজ কেন যেন খুশি হতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলো ওর শার্টটা বুকের কাছে ভিজে যাচ্ছে। তার মানে নীরা কাঁদছে? মোর্শেদ নীরাকে দু’হাতে আগলে ধরতে যেয়ে বুঝলো মেয়েটা কান্নার তোড়ে কাঁপছে ক্রমাগত। মোর্শেদ নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়-
“নীরা, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
“তোরা সবাই ভালো কেবল আমিই খারাপ। আমার ভুলের কারনেই বাবাকে হারালাম। তোকেও সারাজীবন ভুল বুঝে গেলাম। আমি অনেক খারাপ অনেক খারাপ… ”
“কে বলেছে তোকে? আমি বলেছি কিছু? ”
নীরা মাথা নাড়ে-” আমি জানি তোর বলতে হবে কেন? মা তো নিজের মুখেই বললো সেদিন শুনিসনি?”
“ও তো বড়মা রাগের মাথায় বলেছে। কিন্তু সবাই জানে তোর মন কতটা ভালো, সবার জন্য তুই কতটা ভাবিস।”
“উহু, আমি সত্যিই খারাপ। তোর সাথে এতোদিন কতো খারাপ আচরন করেছি অথচ তুই কিছুই বলিসনি আমাকে।”
আলতো করে নীরার মুখটা তুললো মোর্শেদ, চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো-
“পাগলি, কেঁদে কেটে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিস। আর কতো কাঁদবি? আর খামোখাই কাঁদছিসই বা কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
“কারো কিছু বলতে হবে কেন? আমি কি এতোটাই অবুজ যে নিজে নিজে কিছু বুঝবো না? তুই তো নিজেকে সাধু সন্তের কাতারে ফেলে দিচ্ছিস আর আমি ভিলেন হচ্ছি দিনদিন। চুপিচুপি কোথায় কি করে বেড়াস সেসব আমাকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করিস না। তা আমাকে জানাবিই বা কেন? আমি কে তোর? বউ তো মানিস না আমাকে?”
ঝাঁজের সাথে কথাগুলো বলে নীরা। নীরার কথা শুনে মোর্শেদের চক্ষু কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম। বলে কি মেয়ে? একটু আগের ক্রন্দসী নারী থেকে এখন একেবারে রননারী। সে অবাক হয়ে তাকায় নীরার দিকে-
“আমি তোকে বউ মানি না নাকি তুই আমাকে বর মানিস না? তুইতো এই সম্পর্ককেই স্বীকার করতে চাস না, তবে আমি কেন আগ বাড়িয়ে তোর সাথে কথা বলতে যাবো? বল, মানিস আমাকে?”
“আমি মানি বা না মানি তুই তো মানিস? তবে আমাকে কিছু জানাস না কেন?”
নীরা গোঁয়ারের মতন বলে।
“কি বলিনি তোকে?”
“এই যে মিরা আপাকে তুই সাহায্য করেছিস। সে বড় বিপদে পড়ে আমাদের ওখানে গেছিলো?”
“এসব তো বলার ব্যাপার নয় যে বলবো। তাছাড়া, বড় আব্বু নেই এসব বলে খামোখাই বাড়িতে সকলকে টেনশন দেওয়ার দরকারটা কি?”
“আমি অন্য কাউকে বলার কথা বলছি না। আমাকে বলার কথা বলছি।”
“তোর নিজের জানার ইচ্ছে থাকলে তুই নিজেই জানতে পারতি। সেই কবে মিরা আপা পালিয়ে গেছিলো সেটাতে তুই আমাকেই দোষী ভেবে বসে আছিস। আমি কেন তোকে কিছু বলতে যাবো? পরে ভাববি আমি তোর কাছে ভালো সাজার জন্য এসব করছি।”
মোর্শেদ অভিমান ভরা কন্ঠে বলে।
“অথচ আমি চেয়েছিলাম মিরা আপা যেন ওই ছ্যাচরার সাথে না পালায়। তাই বড় আব্বুকে এসে বলেছিলাম। বড় আব্বুর রাগ বেশি সে কিছু না ভেবেই মিরা আপাকে পিটুনি দিলো। আর মিরা আপার জেদ আরো গেড়ে বসলো সে পরদিন ভোরেই সুযোগ বুঝে পালালো। এতে আমার কি দোষ সেটা বল?”
নীরা ভারী লজ্জা পেলো মোর্শেদের কথা শুনে। সে মোর্শেদের বুকের ভেতর আরেকটু সেধিয়ে গেলো।
“বাবার মিরা আপাকে এভাবে মারতে দেখে তোকেই দোষী মনেহয়েছিলো। তুই তো জানিস না, মিরা আপার যাওয়ার পর মা রাতে ঘুমাতো না। মাঝে মাঝেই মাকে দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে। আর বাবা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিলো দেখেছিস তো? সেই রাগী মানুষটাকে আর খুঁজে পাইনি কখনো।”
“হুম, দেখেছি বলেই তোর সাথে বিয়েতে আমি আপত্তি করিনি। কারণ তার ভয় ছিলো তুইও মিরা আপার মতো কোনো ভুল না করে ফেলিস। অথচ তোকে নিয়ে বড় আব্বুর অনেক স্বপ্ন ছিলো। বলতো, বুঝলি মশু, আমার এই মেয়েটা অনেক ভালো, ওই একমাত্র এই পরিবারটাকে একটা বাঁধনে বেঁধে রাখতে পারবে। ও সবাইকে মানিয়ে চলতে পারে। সেই তুই কিনা আমার সাথে বিয়ে নিয়ে কতো কিছু করলি। আচ্ছা, বলতো আমি কি এতই খারাপ যে তুই আমার সাথে এমন ব্যবহার করেছিস?”
“জানি না। তুই তো খারাপই। তুই খারাপ না হলে বাবা কেন আমার চাইতে তোকে বেশি ভালোবাসে?”
“ওহহ দেখি ছাড় তো। এভাবে চুপচাপ বসে থেকে খামোখাই আমাকে টেনশন দিয়েছিস। এখন দয়া করে ফ্রেশ হতে দে। আর কিছু খেতে দে।”
মোর্শেদ বিরস বদনে বলে ওঠে। নীরাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে মোর্শেদকে এমন ঠান্ডা গলায় কথা বলতে দেখে নীরা অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো ওর আবার কি হলো?
“ঠিক আছে তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।”
★★★
নীরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মোর্শেদের দিকে। খাবার আইটেম খুব সামান্য খিচুড়ি, ডিম ভাজি আর বেগুন ভাজা। মোর্শেদ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে কিছু বলছে না। নীরারও প্রচন্ড খিদে পেয়েছে অথচ ও চাইছে মোর্শেদ একবার ওকে খেতে বলুক নিজ মুখে।
“খিচুড়ি কেমন লাগছে খেতে?”
“ভালো। তুই না খেয়ে বসে আছিস কেন?”
“এই তো খাচ্ছি। ”
প্লেটে ভাত নিতে নিতে নীরা ভাবছিলো মিরার সাথে দেখা হওয়ার কথা বলবে কিনা। ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললো-
“আজ মিরা আপার সাথে দেখা হলো। সাথে আপার ছেলেও ছিলো।”
“হুমম।”
“তোর সাথে যে মিরা আপার যোগাযোগ আছে সেটা বলিস নিতো?”
“যতটুকু যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন ততটুকু রেখেছি। আমার ব্যক্তিগত কোনো বেনিফিটের জন্য তো যোগাযোগ রাখিনি। এটা আর আলাদা করে বলার কি আছে?”
“বুঝলাম। তুই নাকি তার অনেক উপকার করেছিস?”
মোর্শেদ এবার খাওয়া থামিয়ে নীরার দিকে তাকালো।
“মিরা আপার কথা শুনেই কি তোর মনে আমার জন্য প্রেম জেগেছে? দু’দিন আগেও তো আমাকে তোর সহ্য হতো না আর আজ এতো কথা বলছিস যে?”
“না, ব্যাপারটা সেরকম নয়।”
“তাহলে কি রকম আমাকে একটু বুঝিয়ে বল। তোর নিজের তো আমার প্রতি বিশ্বাস নেই। অন্যের কথা শুনে এখন এসেছিস? ছোটর থেকে একসাথে বড় হয়েছি তবুও আমার প্রতি তোর কোনো ফিলিংস নেই। তাহলে এখন কিসের জোরে এতো কথা বলছিস?”
“আসলে তুই যা ভাবছিস তা নয় মোটেও। তোকে কখনও স্বামী রুপে ভাবিনি। নিজের পরিবারের ভেতর বিয়েটা আমার ভালো লাগে না।”
মোর্শেদ বাঁকা হাসি দিলো-
“তোর আমার বিয়েটা ছোটর থেকেই ঠিক করা ছিলো নীরা। এজন্যই তোকে আমার দু’বছর পরে স্কুলে দেওয়া হয়েছিলো। যেহেতু আমি বড় ছেলে আর আমার সাথে তোর ম্যাচ হয় তাই পরিবারের বড়রা নিজেদের ভেতর আগে থেকেই কথাবার্তা বলে রেখেছিলো। এসব কি তুই জানতিস না?”
“জানতাম কিন্তু মানতে চাইতাম না। আর মিরা আপার ঘটনার পরতো আরো না। আমাদের জীবনের অশান্তির জন্য তোকেই দায়ী মনেহতো।”
“আর এখন কি মানতে পেরেছিস? নেহাৎ আমি বড় আব্বুকে খুব ভালোবাসি তাই তোর সব বাজে ব্যবহার সয়ে গেছি। ও হ্যা, আরো একটা কারন আছে। ছোটর থেকেই তোকে বউ ভেবেছি নিজের তাই মনের অজান্তেই তোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তবে তোর দিক থেকে সারা না পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। দাদীজান না থাকলে হয়তো সম্পর্কটাই ঝুলিয়ে রাখতাম না। বুড়িকে এই বয়সে আর দুঃখ দিতে চাই না। আমাদের নিয়ে বুড়ীর আশা অনেক।”
“কি বলছিস এসব? আমি তো এমনটা কখনও বলিনি?”
নীরা দুঃখী গলায় বললো।
“মুখে না বললেও আচরণে বুঝিয়েছিস তো।”
“পুরনো কথা কেন তুলছিস?”
“ওহহ,তুলবো না? এখন কি একদিনে আমায় ভালোবেসে ফেলেছিস? শোন নীরা, আমি তোর ভালোবাসাটা চাই, তুই মন থেকে যখন আমার জন্য ফিল করবি তখন আমায় বলিস। কিন্তু অন্য কারো কথা শুনে আমাকে ভালো ভেবে আমার প্রতি এট্রাক হওয়া চাই না। বুঝেছিস?”
মোর্শেদ অর্ধেক খাওয়া রেখে উঠে পড়ে।
“কি হলো উঠলি যে? খাবি না?”
“নাহ। থ্যাংকস কষ্ট করে আমার জন্য রান্না করেছিস। ”
মোর্শেদ হাত ধুয়ে নিলো। নীরার কান্না পেয়ে গেলো আচমকা। সে তো মোর্শেদকে ভালোবাসতে চায়, বুঝতে চায় তাই বলে এতো কড়াকথা শোনাবে? সে না হয় না জেনে ভুল করে ফেলেছে। এখন কি সারাজীবন ভুলের খেসারত দিতে হবে? নীরা নিজে থেকেই চোখ মুছলো। নাহ, মোর্শেদ ঠিকই বলেছে। ভুল যেহেতু ওর তাই শুধরে নেওয়ার দায়টাও ওর। সে ঠিকই আবার মোর্শেদের মন জয় করে নেবে। সেই সাথে মায়ের রাগটাও পানি করে দেবে। বাবা নেই তো কি হয়েছে? মিরা আপার কারনে বাবা যতটুকু দুঃখ পেয়েছিলো, অপমানিত হয়েছিলো পরিবার আর সমাজের কাছে তার চাইতে দ্বিগুণ সম্মান আর ভালোবাসা সে বাবাকে ফেরত দেবে। তখন নিশ্চয়ই মা তাকে মাফ করে দেবে? বাবার বিশ্বাস আর ভরসার পরীক্ষায় তার উত্তরে জেতে হবে। সব কিছু ভেবে নিয়ে নীরা মনে মনে ভারী শান্তি অনুভব করে। নিজের ভেতর একটা প্রেরনা পায়। টেবিল গোছাতে গোছাতে নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গান গেয়ে উঠলো, ঠোঁটে তার মৃদু হাসি।
চলবে—–
Farhana_Yesmin।