দেশলাই -০৮,০৯
জবরুল ইসলাম
৮ম পর্ব
রাফসানের এপাশ-ওপাশ করে রাত চারটা হয়ে গেল। সাদ ফ্যান ছেড়ে কম্বল গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কনকনে শীতেও ফ্যান ছেড়ে ঘুমানো তার অভ্যাস।
কিন্তু রাফসানের চোখ থেকে যেন ঘুম ছুটি নিয়েছে। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে কাল কি হবে? সবকিছু যেন তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সত্যি কি ইন্তিশাকে কাছে পাবে সে? কাল রাত আস্ত একটা নারীর সঙ্গে যা ইচ্ছা করতে পারবে সে? প্রথমে কি করবে? তাছাড়া কারও কাছে ধরা পড়বে না তো? তার ভাবনায় ছেদ করে শহরের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের আজান। নিজেকে খানিক্ষণ বকা দেয়। কীসব উল্টাপাল্টা ভেবে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই কাল পুরো রাত জাগতে হবে। নিজেকে প্রেরণা দিয়ে চোখবুঁজে। ধীরে ধীরে ঘুম আসে। কিন্তু ভোর সাতটায় সাদের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। চা খেতে নিচে যাবে কি-না সে জিজ্ঞেস করে। রাফসান চোখ না খুলেই অসম্মতি জানায়। আবার ঘুম আসে। সেই ঘুম ভাঙে বেলা দশটায়। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে বাথরুমে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চুল কি লম্বা? কাটতে হবে। দাড়িও ছাঁট দিলে মন্দ হয় না।
মুখ-হাত ধুয়ে বাইরে বের হয়। মোড়ের চা’র দোকানে গিয়ে বলল, ‘মামা লিকার চা দেন।’
ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেয়। মনে পড়ে আজ তার বিশেষ একটা দিন। নারী সঙ্গ পাবে। তাও পছন্দের, ভালোবাসার মেয়েটিকে। শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। বিল মিটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে সেলুনের উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। রিকশার টুংটাং শব্দ। গাড়ির সাইরেন। মানুষে গিজগিজ। ব্যস্ত শহর। এক বৃদ্ধা সুরে সুরে দুরুদ পড়ে ভিক্ষা চাইছে। মায়া লাগে তার। আজ বড়ো মায়ার মন। মানিব্যাগ বের করে বিশ টাকা দেয়। সাদ কোত্থেকে এসে দেখে ফেলে।
– ‘আরে মামা, তুইতো বড়লোক। পুরো বিশ টাকা দিয়ে দিলি? চল চা খাওয়া।’
– ‘নারে সেলুনে যাবো।’
– ‘সেলুনে যাবি কেন? চুল-টুল সব তো ঠিকই আছে।’
– ‘তবু একটু কাটবো।’
– ‘আরে মামা, তোর লাইফ তো সুন্দর। টাকাপয়সা বাড়ি থেকে আসছে না-কি? আর তোকে এতো খুশিখুশি লাগছে কেন? বল বল, ঘটনাটা কি?’
– ‘আরে কিচ্ছু না।’
– ‘তাইলে চা খাইয়ে যা। ফকিরকে তো বিশ টাকা দিয়ে দিলি। আর বন্ধু-বান্ধবদের চা খাওয়াতে গেলে তুমি উল্টো ফকিরের ভাব লও। এগুলা তো ভালা না মামা।’
– ‘আমি তো এখনই চা খেয়েছি। নে তুই দশ টাকা নিয়ে একাই খা। আমি যাচ্ছি।’
টাকা দিয়ে রাফসান হাঁটা দিল। পেছন থেকে ডাকছে সাদ। সে কান না দিয়ে অন্য গলিতে ঢুকে পড়ে।
সেলুনে গিয়ে সুন্দর করে চুল কাটে। দাড়ি ছাঁট দেয়। মুখ ওয়াস করায়।
বাসায় ফিরতে সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
শ্যাম্পু ছিঁড়ে মাথায় দিয়ে গুনগুন করে নতুন লেজার নিয়ে বাথরুমে ঢুকে। বগল-টগলের লোম ফেলে গোসলটা সেরে নেয়। তারপর আর দিন যেন যাচ্ছেই না। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে এক সময় তার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। নতুন আন্ডারওয়্যারটি পরে। ব্লু জিন্সের সঙ্গে কালো গেঞ্জি তার উপরে ব্লেজার। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। পারফিউম মারে ভালো করে। বেরিয়ে পরে নীলগঞ্জের উদ্দ্যশ্যে। দুরুদুরু বুকে ফার্মেসিতে যায়। নাম বলতেই তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আলগোছে ব্যাগে ভরে বাসে উঠে।
নীলগঞ্জ বাজারে গিয়ে সে একটি হোটেলে বসে চা খায়। মোবাইল টিপে। কিন্তু কতক্ষণ আর বসবে? বিল মিটিয়ে বাইরে আসে। মানুষ কমতে শুরু করেছে। অলিগলিতে একা হাঁটাহাঁটি করে। রাত সাড়ে বারোটা হয়ে গেছে৷ বাজারে আর থাকা যায় না। পাঁচ মিনিট হেঁটে একটা নদীর পাড়ে যায়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। দূরে একটা লাইটের আলো দেখে পিলে চমকে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো লোকটি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। চ্যাটে টুকটাক কথা চলে ইন্তিশার সঙ্গে। রাত ঘনাতেই মেসেজ এলো, ‘চলে আসো।’
রাফসানের বুক ধুকপুক করে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। নীলগঞ্জে এখন রজনী নিঝুম। কেবল দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক। বন্ধ দোকানের বারান্দায় কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। চারদিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে হাঁটে সে। কথামতো আম গাছের সামনে গিয়ে মেসেজ দেয়, ‘এসেছি।’
খানিক বাদে আলগোছে দরজা খুলে যায়। অন্ধকারে কেবল মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ছায়াটি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে। রাফসান ধীরপদে এগিয়ে যায়। ইন্তিশা তাকে রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বেলে দেয়। রাফসান মৃদু আলোয় ইন্তিশার দিকে তাকায়।
ওর পরনে একটি কালো গেঞ্জি। মাথার চুল খোঁপা করা।
ইন্তিশা লজ্জায় আঁজলা করে নিজের মুখটা ঢেকে নেয়। রাফসান মুচকি হেঁসে কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। ইন্তিশা হাত সরিয়ে চোখে চোখ রাখে। তারপর নিজ হাতে রাফসানের ব্যাগটি পড়ার টেবিলে রেখে ব্লেজার খুলে চেয়ারে রেখে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলে, ‘বোনকে বুদ্ধি করে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
সেও ফিসফিস করে বলল, ‘ভালো করছো। না হয় ভয় ভয় করতো। কিন্তু তুমি লজ্জা পাচ্ছে কেন?’
– ‘বাতি বন্ধ করে দিলে আর লজ্জা করবে না। বন্ধ করি?’
– ‘আচ্ছা।’
বাতি বন্ধ করে ইন্তিশা সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার সয়ে গেলে রাফসানের মাথার পেছনের চুল খামচে ধরে নিজের নাক ঠোঁট ওর সমস্ত মুখে ঘষতে থাকে। ঠোঁট ঢুকে পড়ে অপঠোঁটে। দু’জনের শরীরে শিহরন বয়ে যায়। ইন্তিশা তাকে আস্তে আস্তে ঠেলে বিছানায় ফেলে। রাফসান টেনে কোলে এনে ওর পেটে এক হাত রেখে ঘাড়ে নাক, ঠোঁট ঘষে। পেট থেকে হাত সাপের মতোন বেয়ে বুকে আসে আবার নিচের দিকে যায়৷ উত্তেজনায় ইন্তিশার শ্বাস-প্রশ্বাস বাড়তে থাকে। অসহ্য এক সুখের ব্যথা। ইন্তিশা নিজেকে ছাড়িয়ে রাফসানকে বেডে শুইয়ে গেঞ্জি টেনে খুলে ফেলে। বুকে নাক ঘষে, সমস্ত শরীরে চুমু খায়। রাফসান তাকে বুকে টেনে পাশ ফিরে নিচে ফেলে। ধীরে ধীরে তারা উত্তেজনার চরম পর্যায়ে পৌঁছে কামনা-বাসনায় একটি ঝড়ের দিকে ধাবিত হয়। এক সময় দু’টি দেহের ঝড় উঠে। পুরো রাত থেকে থেকে চলতে থাকে সেই ঝড়। কথামতো রাফসান চারটায় বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে। চারধার কুয়াশায় ঘেরা। কনকনে শীত। ভোর পর্যন্ত সে হেঁটে নীলগঞ্জ ফেলে মহাসড়কে এসে বাসে করে সিলেট আসে। এরপর থেকে একজন আরেকজনের শরীরের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। ঢুকে পড়ে একটা চক্রে। পড়ালেখা, সমজা-সংসার সবকিছু ঐচ্ছিক হয়ে পড়ে। সমস্ত কিছু প্রেমকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে। পুরো রাত ফোনালাপ। সকালে না পারতে ক্লাসে যাওয়া। আবার এসে চ্যাটিং, রাতে ফোনালাপ। সারাক্ষণ একজন আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। কেবল বাথরুমে যেতে হলে, ‘আসছি একটু ওয়েট।’ বলে যাওয়া।
খেতে হলে, ‘খেয়ে আসছি ওয়েট।’
গোসল করতে হলে, ‘এখন গোসল করবো একটু পরে আসছি।’
দু’জন অতি প্রয়োজনীয় কাজ করছে এভাবে জিজ্ঞেস করে। সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বাকী সব। ক’দিন পর পরই নীলগঞ্জ ছুটে যায় রাফসান। পুরো রাত তারা সুখের সমুদ্রে ভাসে।
কিন্তু বছর খানেক বাদেই আচমকা সম্পর্ক প্রাণহীন হয়ে যায়। ঘুড়ির সুতো কাটা পড়ে। ছন্দ পতন হয়।
চলবে…
দেশলাই – ৯ম পর্ব
বছর খানেক পরেই তাদের সম্পর্ক কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ঘুড়ির সুতো কাটা পড়ে। ছন্দ পতন হয়। ইন্তিশা কেমন নীরব হয়ে যায়। ওর মোবাইল থেকে এখন আর মেসেজ বা কল আসে না। রাফসান কল দিলে কেবল ভদ্রতার বাক্যবিনিময় হয়। মেসেজ দিলে ‘হুম, হ্যাঁ’ ধরনের অনাগ্রহের উত্তর। রাফসান আগের মতো নীলগঞ্জে যেয়ে রাত কাটানোর বাহানা খুঁজে। কিন্তু ইন্তিশা সাড়া দেয় না। নানান অজুহাত দাঁড় করিয়ে বাঁধা দেয়। তার ভেতরে ভেতরে তখন রাগ হয়। কঠিন দু’একটা কথা বলে ফেলে। ঝগড়াঝাটি করে দু’জন ফোন রেখে দেয়। কিন্তু ওপাশ থেকে রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় মোবাইল বেজে উঠে না। রাফসান কল বা মেসেজ না দিলে এভাবেই কয়েকদিন চলে যায়। আবার সে নিজ থেকেই কল দেয়। মেসেজ দেয়। খানিকটা স্বাভাবিক হয় সম্পর্ক। জোড়াতালি দিয়ে সম্পর্ক এভাবে জিইয়ে রাখার অঘোষিত একটা দায়িত্ব এসে পড়ে কেবল রাফসানের উপরেই।
তাই বলে ইন্তিশাকে পাওয়ার দাবী কমে যায়নি, বরং বেড়েছে। অন্যদিকে ইন্তিশা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। তাতে ঝগড়াঝাটি, রাগ, মান-অভিমান, অভিযোগ বাড়ে। আরও একটি বছর সম্পর্ক ভাঙা গড়ার খেলার ছলে চলে যায়।
সেদিন রাফসানের ইন্টারের টেস্ট পরীক্ষা শেষ। ততদিনে ইন্তিশা নিজ থেকে খোঁজ-খবর নেয়া পুরোদমে ছেড়ে দিয়েছে। রাফসানও এই কয়দিন পরীক্ষার ব্যস্ততায় সব সময় নিয়ম করে মেসেজ দেয়নি। আজ তিনদিন হলো তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। শেষ মেসেজ এখনও সিন করেনি।
আজ শেষ পরিক্ষা দিয়ে সে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। মেসে ফিরে গোসল আর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় গা হেলিয়ে দেয়৷ মেসেজ সিন করেনি দেখে ডায়রেক্ট কল দেয়। তাকে অবাক করে দিয়ে মোবাইল বন্ধ দেখায়। অকারণ হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও মেসেজ দেয়। না সিন হয় না।
– ‘সাদ, এই সাদ।’
রান্নাঘর থেকে জবাব দেয়, ‘কিরে ডাকছিস ক্যান?’
– ‘তোর মোবাইলটা দে ভাই।’
– ‘আরে বাল এখানে আইসা নে।’
রাফসান তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যায়।
– ‘মোবাইল দিয়ে কি করবি?’
– ‘দরকার আছে দে।’
রাফসন মোবাইল হাতে নিয়ে রুমে আসে। সাদের মোবাইলে নাম্বার তুলে কল দেয়। কিন্তু বিশেষ কাজ হয় না। ইন্তিশার মোবাইল বন্ধ।
আচমকা মোবাইল বন্ধ৷ মেসেজ সিন না হওয়ার কারণ বুঝতে পারে না সে। অস্থির হয়ে যায়। খাটে বসে আঁজলা করে মুখ ঘষতে থাকে। চুল ধরে টানে৷ অস্থিরতার সময় এরকম করা তার অভ্যাস।
হঠাৎ মাথায় এলো সুলতানার কথা।
তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে কল দেয়, ওপাশে রিং হয়ে কেটে আসে। আবার দেয়। না রিসিভ হয় না।
তার বুক ধুকপুক করে। নিজেকে মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বুঝায়। মোবাইল তো বন্ধ হতেই পারে। এখানে অস্থিরতার কি আছে? তবুও তার ভয় কমে না। যেন অবচেতন মন কিছু একটা বুঝে নিয়েছে।
খানিক পর মোবাইলে রিং হয়। চমকে উঠে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকায়। সুলতানা কল দিয়েছে।
– ‘হ্যালো, সুলতানা কেমন আছো?’
– ‘আমি আর কেমন জেনে লাভ আছে? তোমরা দু’জন তো ভুলেই গেছো আমাকে।’
রাফসান আর সেদিকে না গিয়ে মূল কথায় ফিরে যায়,
– ‘আচ্ছা ইন্তিশার কোনো খবর কি জানো? কয়েকদিন থেকে ওর মোবাইল বন্ধ কেন?’
– ‘জানি না তো।’
– ‘আচ্ছা আরেকটা উপকার করবে সুলতানা?’
– ‘কি বলো?’
– ‘ওদের বাড়িতে একবার যাবে? কি সমস্যা জানবে আর পারলে তোমার মোবাইল দিয়ে ফোন দিয়ে কথা বলাবে প্লিজ।’
– ‘একটা কথা বলি?’
– ‘বলো।’
– ‘ইন্তিশা চাইলে আমি এই উপকার করতে পারবো। কিন্তু সে কথা বলতে না চাইলে আমি কিছুই করতে পারবো না৷ তুমি হয়তো জানো না, আমি এই এলাকায় লোকাল না। আমার বাড়ি ময়মনসিংহ। বাবার চাকুরির কারণে এখানে থাকি আমরা। ইন্তিশার সঙ্গে সম্পর্ক আগে অনেক ভালো ছিল। এখন আগের মতো যোগাযোগও হয় না। আচ্ছা তবুও আমি যাবো।’
– ‘ধন্যবাদ সুলতানা। তুমি শুধু খোঁজ-খবর নাও।’
পরেরদিনই ইন্তিশার মোবাইল থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই মিষ্টি কণ্ঠ শুনতে পায়। তার ভেতরকার সমস্ত অলিগলিতে যেন একফালি শীতল হাওয়া ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
– ‘তোমার মোবাইল বন্ধ কেন বলো তো? আর মেসেজ দেই সিন করো না?’
– ‘আগে বলো তুমি এতো অস্থির কেন রাফসান? সুলতানাকে আমাদের বাড়িতে পাঠানো ঠিক হয়নি। এমনিতেই আব্বু-আম্মু কীভাবে জানি টের পাইছেন সবকিছু। হাত থেকে মোবাইল নিয়ে অফ করে তালা মেরে রেখেছেন। ভার্সিটিতেও যেতে দিচ্ছেন না।’
– ‘বলো কি! এতোকিছু হয়ে গেল কীভাবে? এখন কি করবে?’
– ‘এতোকিছু তো হবেই রাফসান। তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করেছো। আমাদের আরও আগেই লাগাম টেনে রাখা উচিত ছিল। তোমার এতো ঘন ঘন আসা যাওয়ায় কিছু বুঝলেন কি-না কে জানে।’
– ‘আল্লাই জানে। কিন্তু এখন কি করবে? আমাদের যোগাযোগ হবে কীভাবে?’
– ‘তুমি আছো তোমার যোগাযোগ নিয়ে। এদিকে আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে কি-না ভয়ে আছি। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি নিজেই যোগাযোগ করবো, ঠিক আছে? আর সুলতানাকে তুমি পাঠাবে না আমাদের বাড়িতে। ও এলে পরিবারের মানুষ আরও সন্দেহ করবে। এখন রাখছি।’
ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেল। রাফসান মোবাইল পাশে রেখে মুখ ঢেকে খানিক্ষণ বসে রইল। নিজেকে সান্ত্বনা দিলো হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ইন্তিশা তার সঙ্গে নিজ থেকেই যোগাযোগ করবে।
কিন্তু মাস খানেক চলে যায় ইন্তিশার কোনো খোঁজ-খবর নেই৷ ওর নিষেধ থাকার পরও আবার সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনুরোধ করে আবার ইন্তিশাদের বাড়িতে পাঠায়।
ফোনে কথা হয় দু’জনের।
ইন্তিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে পরিবার বিয়ে দিয়ে দেবে। প্লিজ তুমি বিয়ের প্রস্তাব দাও আমার আব্বু-আম্মুর কাছে। আকাশ ভেঙে পড়ে রাফসানের মাথায়। এখনও তো তার বিয়ের বয়সই হয়নি। কীভাবে বিয়ে করবে? তার পরিবারও তো মানবে না। তাছাড়া বেকার ছেলের কাছে ওর বাবা-মা কি দেখে বিয়ে দেবে?
রাফসান আমতা-আমতা করে বলে,
– ‘তোমার মা-বাবাকে বলো সম্পর্ক আছে।’
ওপাশ থেকে ইন্তিশা জানায়,
– ‘হ্যাঁ, আমি বলেছি। ওরা চায় তুমি নিজের অবিভাবক নিয়ে সামনে আসো। বিয়ের প্রস্তাব দাও।’
– ‘প্রস্তাব দিলে কি বিয়ে দেবে?’
– ‘কীভাবে দেবে? তুমি মাত্র ইন্টারে পড়ো।আমি তো সেটা ওদের বলিনি। জানলে আমাকে মেরে ফেলবে সবাই।’
– ‘ইন্টারে তো তুমি জেনেই রিলেশন করছো।’
– ‘আরে বাবা, আমার মা-বাবা তো জানে না। আমি তো এখনও চাই তোমাকে। তুমি বললে আমি এখনই পালিয়ে চলে আসবো? পারবে তুমি আমার দায়িত্ব নিতে? তোমার তো বিয়েরও বয়স হয়নি। এদিকে আমার পরিবার বর খোঁজা শুরু করেছে।’
– ‘তাহলে এখন আমি কি করবো।’
– ‘এখন একটাই পথ আমি বাধ্য মেয়ে হয়ে মা-বাবার কথামতো চলবো। তাতে ওদের আস্থা আসবে আমার উপর। আমি তখন বলবো পড়ালেখা করতে চাই। এখন বিয়ে করবো না। তুমিও আপাতত কোনোভাবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। সুলতানার সঙ্গেও না। আর নীলগঞ্জ ভুলেও আসবে না।’
রাফসান দীর্ঘদিন যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ইন্তিশার বিরহ যন্ত্রণায় তো সে নিরবধি পুড়ছে। নিজেকে অন্যকিছুতে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করতে গিয়ে আরও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। গান শুনলে ইন্তিশার সঙ্গে কাটানো সমস্ত স্মৃতি তাকে তাড়া করে। নাটক-সিনামা দেখলে মনে হয় নায়িকা ইন্তিশাম। এই গল্প তাদের। উপন্যাস পড়তে গেলে বারংবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সিম অপারেটর থেকে মেসেজ এলেই চমকে উঠে ভাবে এই বুঝি মেসেজ দিলো। কিন্তু না, ইন্তিশার মেসেজ আসে না। কল আসে না। তার ইন্টারের পরীক্ষার আগেরদিন সুলতানাকে আবার কল দেয়। সুলতানা জানায় ইন্তিশার সঙ্গে কথা বলে না। তাদের ঝগড়া হয়েছে। আর যেন তাকে কল না দেয়। এই লাইন কেটে দেয়। রাফসান কল দিলে আর কখনও সুলতানা রিসিভ করেনি। পাগলের মতো হয়ে যায় সে। দিনে-দুপুরে ছুটে চলে যায় নীলগঞ্জ। ওদের বাড়ির আশপাশে উঁকিঝুঁকি দেয়। না, ইন্তিশাকে দেখা যায় না কোথাও। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
এরপরই তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। নীলগঞ্জে চাইলেও যেতে পারে না৷ কিন্তু এই অবস্থায় পড়ালেখায় মনযোগ দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাতভর গান শোনা, সিগারেট টানা, আনমনে বইয়ের পাতা ওল্টানো আর পরেরদিন আবার পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না৷ সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে ইন্তিশা। প্রতিটি চিন্তায় কোনো না কোনোভাবে ইন্তিশা। খাওয়া-গোসল কিচ্ছু ভালো লাগে না। ঘুম থেকে উঠলে মনে হয় কি হবে উঠে? নিজের কাছেই যেন নিজেকে পাগল লাগে তার। কারও কাছে মনের সব কথা খুলে বলে ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেউ শুনে না। সবার কাছে হাস্যকর লাগে। এই অবস্থায় এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। পড়ার টেবিলে মন বসছে না। পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না। এটার জন্যও ভেতরে একটা অশান্তি শুরু হয়।
পরীক্ষার মাঝখানে একদিন ছুটি পায় সে। চলে যায় ইন্তিশার ভার্সিটিতে। গেইটের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। ওর বন্ধ ফোনে বারবার দেয়াল ঠেলানোর মতন কল দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে। নীলগঞ্জ বাজারে যায়। ওদের বাড়ির পাশের নদীর পাড়ে হাঁটে। কত ছোট ছোট স্মৃতি উঁকি দেয় মাথায়। কত রাত ইন্তিশার সঙ্গে কাটিয়ে কুয়াশার ভোরে চুপিচুপি এই রাস্তা দিয়েই সে ফিরে যেতো সিলেট। এই বাজার, এই নদীর পাড়েই হাঁটাহাঁটি করে সে ইন্তিশার ‘চলে আসো’ মেসেজের অপেক্ষা করতো।
এগুলো ভাবতেই ভাবতেই ইন্তিশার বাড়ির রাস্তায় গিয়ে সতর্কভাবে উঁকিঝুঁকি মারে। মাঝে মাঝে ভাবে বাড়িতে চলে যাবে৷ কিন্তু কি এক আশংকায় আর যাওয়া হয় না তার। পাছে ইন্তিশার আরও বিপদ আসে কি-না। পরিবারের মানুষ টের পেলে বেচারি ঝামেলায় পড়বে। মেসে ফিরে যায়।
পরীক্ষা শেষ হয়। তখন চুল-দাড়ি লম্বা হয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখের নিচে কালি পড়েছে। প্রেমিকার বিরহে হৃদয় পোড়ার সঙ্গে ঘন ঘন সিগারেট টেনে ঠোঁট কালো হয়েছে। এই রক্তাভ ঠোঁটের খুব প্রশংসা করতো ইন্তিশা। সেই ঠোঁট আজ তারই বিরহে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই সে বাসে উঠে ছুটে চলে যায় নীলগঞ্জ। এখন সারাক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে সে। কেমন ঘোরের ভেতর দিয়ে দিনকাল কাটে। তার অবচেতন মন হয়তো বুঝে ফেলেছে সব। ইন্তিশা আর তার নেই। হারিয়ে ফেলেছে সে।
অসতর্ক ভাবে সিগারেট টেনে টেনে নীলগঞ্জ বাজার, নদীর পাড়, ইন্তিশাদের বাড়ির রাস্তায় উঁকিঝুঁকি মারে। কোথাও ইন্তিশাকে দেখা যায় না। অথচ কি অদ্ভুত ভাবে তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। ঘপটি মেরে বসে আছে মস্তিষ্কে৷ মিশে আছে সমস্ত চিন্তা-ভাবনা জুড়ে।
রাস্তা থেকে নাম ধরে হাঁক ছাড়ে রাফসান। ওদের রাস্তার পাশে শিমুল গাছে বসা কাকটি হাঁক শুনে কা কা করে উড়ে যায়। ইন্তিশা আসে না। আরও কয়েকটি ডাক দিয়ে রাস্তার কিনারায় বসে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। কয়েকজন লোক এদিকে আসে। তারা বেশ কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছিল। এসে কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
– ‘তোর বাড়ি কই? এদিকে কিছুদিন পর পর ঘুরাঘুরি করিস কেন?’
সে চোখের জল মুছে স্পষ্ট গলায় বলে দেয়,
– ‘এ বাড়ির মেয়েকে আমি ভালোবাসি।’
‘ঠাস’ করে একজন গালে চড় দিয়ে বলল, – ‘শালার পুত মুতের গন্ধ গেছে তোর? সম্পর্ক মারাচ্ছিস এলাকায় এসে। গ্রাম কি ল্যাংটা পাইছিস? কয়েকদিন পর পর এসে ঘুরাঘুরি করিস। এই শালাকে বেঁধে ফেল। আর ওর অবিভাবকের ঠিকানা নিয়ে বল এসে ছুটিয়ে নিতে।’
তাকে ধরে সবাই বাজারের দিকে নিয়ে যায়। মুরব্বি কয়েকজন মাঝখানে পড়ে। জিজ্ঞেস করে কি সমস্যা? রাফসান চোখের পানি মুছতে মুছতে মুরব্বিদের জানায়,
– ‘ওই বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে, তাই আসি।’
মুরব্বি একজন ধমক দিয়ে বলল,
– ‘এই বেটা, এসব কথা মুখে আনতে লজ্জা করে না? বিয়ের আগে কিসের সম্পর্ক? চ্যাংড়া পোলাপান পড়ালেখা করবি৷ তা না করে পিরিতি কইরা বেড়ায়। এইযে এলাকার পোলাপান তোকে ধরলো। এখন যদি পিটায় কি করবি? আর যেন কখনও এলাকায় না দেখি, সোজা বাসে উঠে চলে যা। আর এই বাড়ির মাইয়ার বাপের সঙ্গে আমরা কথা বলবো৷ এলাকার মান-মর্যাদা আর রাখলো না।’
ফিরে আসতে হলো রাফসানের। একটা সময় পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। জানতে পারে তিনটি বিষয়ে সে ফেইল করে ফেলেছে। বদ্ধ উম্মাদ হয়ে যায়। শহরের রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে তেড়ে যায় মারতে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। রুমমেট সাদ রাফসানের বাড়িতে ফোন করে তার মানসিক অবনতির কথা জানায়। তারা এসে নিয়ে যায় তাকে।
চলবে…