দেশলাই -১৭,১৮

0
389

দেশলাই -১৭,১৮
জবরুল ইসলাম
১৭ পর্ব

রাতের খাবার শেষে সবাই পারভীন বেগমের (ইলির ফুপুর) রুমে বসে গল্পে মেতে উঠলেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ মিশুক। কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে অত্যন্ত পছন্দ করেন। খানিক পর মিনহাজের বাবা গিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাকীরা চেয়ার আর পালঙ্কে বসে পারভীন বেগমের গল্প শুনছে। সব গল্পই অতীতের দুঃখ-সুখের গল্প। এক সময় এই জগত-সংসারে দাপিয়ে বেড়ানো বিয়োগ হওয়া আপন মানুষগুলোর স্মৃতিচারণের গল্প।

ইলি হঠাৎ মিনহাজকে বলল,
– ‘মনে আছে আপনি আর ঈশী আপু বকুল পুর বেড়াতে গেলে রাফসান ভাই সহ আমরা সকলে চোর-পুলিশ খেলতাম?’

– ‘হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু এখন এগুলো কেউ খেলে না-কি? মাত্র সাত-আট বছর আগেও মানুষ বৃষ্টির দিনে বা মেহমান বাড়িতে এলে লুডু আর চোর-পুলিশ খেলে সময় কাটাতো। এখন মোবাইল, টিভি সবার হাতে হাতে, ঘরে ঘরে তাই কেউ খেলে না।’

রাফসান রসিকতা করে বলল, ‘সবার সবকিছুই মনে আছে খালি মনে নাই সব খেলায় কে রেগুলার জিততো।’

সকলেই ‘হু-হু’ করে হেঁসে উঠলেন।

ইলি মিনহাজের দিকে ফিরে বলল,
– ‘আচ্ছা মিনহাজ ভাই, এক দিনে শ্রীমঙ্গলের কতটা জায়গা ঘুরে দেখা যাবে?’

– ‘কেন তুই এর আগে শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখিসনি?’

– ‘ছোটবেলায় দেখেছি। মাধবপুর লেক আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কথা মনে আছে।’

– ‘আর কোথায় যাবি? একদিনে হামহাম জলপ্রভাত ছাড়া সবই ঘুরতে পারবি।’

– ‘তাহলে হামহাম জলপ্রভাতে কাল চলে যাই।’

– ‘শ্রীমঙ্গলে দর্শনীয় স্থানের কি অভাব? হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা ভালো না৷ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট খাল দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে হয়। পানিতে জোকও অনেক। লাঠি হাতে থাকলে অবশ্য পা পিছলেও পরবি না। আরেকটা রাস্তা আছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। সেদিকে বেশি কষ্ট।

– ‘উফ কি এডভেঞ্চার হবে।’

– ‘যা গিয়ে মর।’

– ‘হুদাই ভয় দেখাইও না তো মিনহাজ ভাই। তুমি কি ভাবছো আমি এগুলোর খবর রাখি না? ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকেও পুরুষ-মহিলারা দেখতে যায়। তারা পারলে আমরা বাড়ির পাশে থেকেও পারবো না কেন?’

– ‘আচ্ছা যা ইচ্ছে হইলে। কিন্তু আমি যেতে পারবো না।’

– ‘তুমি যেতে হবে না। শুধু দোকানে গেলে পরিচিত একটা সিএনজি দশটার আগে পাঠিয়ে দিয়ো।’

– ‘আচ্ছা। তাইলে শোন৷ অন্যরা যদিও মোবাইল-ব্যাগ নিয়েও যায়। পরিচিত সিএনজি হওয়ায় তোমরা সবকিছু রেখে যেতে পারবে। ছবি তুলতে হলেও দু’জনের মধ্যে একজনের মোবাইল নিবি। রাফসান শর্ট প্যান্ট পরে নিস। একটা স্কুল ব্যাগ পেছনে ফেলে নিবি। সেটায় মোবাইল আর জোক ছাড়ানোর জন্য লবণ রাখতে পারবি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ কিন্তু লবণ লাগবে না। জোক এতো ভয় পাই না আমি।’

– ‘ইলি ভয় পাবে।’

– ‘সমস্যা নাই আমি তো আছিই।’

রাত বারোটার দিকে সবাই যার যার রুমে ঘুমোতে চলে গেল। রাফসানকে বারান্দার লাগোয়া রুমটিতে দেয়া হয়েছে। ইলি ঘুমিয়েছে পারভীন বেগমের সঙ্গে।
ভ্রমণের আমেজ আর উত্তেজনায় ইলির ভোর ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল। ইলি দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে পেল লিজার মা ঘরদোর ঝাড়ু দিচ্ছেন। সে পেছনের পুকুরে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বলল,
– ‘ভাবী চলো তোমার দেবরের সঙ্গে দুষ্টামি করবে আমি আড়াল থেকে দেখবো।’

– ‘বুঝিনি, কার সাথে?’

– ‘রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে। সে তো মিনহাজ ভাইয়ের ছোট।’

– ‘যাও তো আমি পারবো না। ওর সাথে সেরকম কথাবার্তাও হয়নি।’

– ‘তাইলে চলো আমি দুষ্টামি করবো তুমি দেখবে।’

– ‘না না। আমি যেতে পারবো না। তুমিই দুষ্টুমি করো গিয়ে।’

– ‘ধুরো, তুমি কচুর ভাবী। রাফসাইন্নার ভাবী আমি। দেখো কি করি।’

ইলি হনহন করে চলে গেল। পারভীন বেগমের এখান থেকে সামনের রুমের দরজায় শুধু পর্দা টানানো, বারান্দার দিকে দরজা। ইলি চুপিচুপি পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। রাফসান শর্ট প্যান্টের সঙ্গে গেঞ্জি পরে ঘুমিয়েছে। পালঙ্ক একেবারে এই দরজার পাশেই। ইলি পর্দার ফাঁক দিয়ে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে চুলে টান দিয়ে একচোখে দেখে।
রাফসান মাথা তুলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে আবার ঘুমায়৷ ইলি আবার চুলে টান দিতে গিয়েও দিলো না। কাল চুল কেটে শ্যাম্পু করায় কেমন সিল্কি লাগছে। ইচ্ছে করছে চুলে আঙুল ডুবিয়ে নেড়ে দিতে। ইলির অকারণ আর জ্বালাতন করতে ইচ্ছে হলো না। গিয়ে দেখলো লিজা ঘুম থেকে উঠে গেছে। তাকে নিয়ে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে লাগলো। এ বাড়ির পশ্চিমেই বিরাট একটা পাহাড়। চারপাশে হেঁটে দেখে খানিক্ষণ পর ইলি আবার ফিরে এলো। রাফসান এখনও ঘুমোচ্ছে। ইলির কেন যেন ভালো লাগছে না। তবুও ফুপুর পালঙ্কে শুয়ে মোবাইল বের করে টিপাটিপি শুরু করলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে আটটা হয়ে গেছে। আস্তে করে নেমে রাফসানের রুমের পর্দা সরায়। এখনও ঘুমোচ্ছে৷ ইলি ভেতরে গেল। চুল-দাড়ি কাটায় একদিনেই যেন অনেকখানি পাল্টে গেছে মানুষটা। ইলি বালিশে ধাক্কা দিয়ে আস্তে করে ডাকে, ‘রাফসান ভাই উঠো।’

রাফসান চোখ মেলে তাকায়।

– ‘উঠো আটটা বেজে গেছে।’

রাফসান হাই তুলে উঠে বসে বলল, ‘ভোরে তুই আমার চুল ধরে টান দিয়েছিলি কেন?’

ইলি চমকে উঠলো৷ ধরা পড়ে গেল কি-না কে জানে। আমতা-আমতা করে বলল,

– ‘কই না তো।’

– ‘মিথ্যা বলিস না।’

– ‘দিলে দিছি, এখন উঠো।’

নাস্তা করার পর সাড়ে ন’টায় সিএনজি এলো। বাড়িতে ভাত খেয়ে যেতে বললেও তারা খেলো না। পারভীন বেগম টিফিনে খাবার দিতে চাইলেও ইলি নিষেধ করলো। বাইরে খাওয়াও না-কি ভ্রমণের অংশ।
ব্যাগ-প্যাক নিয়ে তারা সিএনজিতে উঠে। কাঁচা-পাকনা দাড়ি-গোঁফ ওয়ালা মধ্যবয়স্ক ড্রাইভার। পাহাড়ি এলাকার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সিএনজি চলছে। বাড়ি থেকে শহর কাছেই। খানিক পরেই তারা শহরে চলে এলো।
ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘পানসি রেস্টুরেন্টের দিকে নেব না-কি? এখানে কি নাস্তা-টাস্তা কিছু করবেন?’

ইলি রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি করবে?’

রাফসান ড্রাইভারকে বলল, ‘মামা হামহাম যেতে কি খাওয়ার কিচ্ছু পাবো না?’

– ‘একেবারে কলাবন গিয়ে পাইবেন। সেখানে আগে বইলা গেলে আসার সময় খেতে পারবেন।

– ‘ইলি তাহলে আমরা এখান থেকে খিচুড়ি নিয়ে চলে যাই। কলাবন গিয়ে আগে খেয়ে নিতে হবে। হাঁটার রাস্তা তো। একেবারে না খেয়ে পারা যাবে না।’

– ‘তাহলে খেয়েই যাই। পার্সেল নিয়ে সেখানে গিয়ে খেলে শরীর ভারী লাগবে।’

– ‘তাহলে চল। মামা আপনিও আসুন খেয়ে নিই।’

– ‘না ভাই, আমি মাত্র খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি।’

রাফসান আর ইলি পানসিতে খাওয়া শেষ করলে সিএনজি কলাবনের দিকে ছুটে। শহর থেকে বের হতেই সুরো রাস্তা। খানিক এগুতেই তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। উঁচু-নীচু পাহাড়ের চা গাছের দিকে তাকালে ইলির কখনও মনে হচ্ছে সমুদ্রের জলের মতো সবুজের ঢেউ। কখনও মনে হচ্ছে উঁচু-নীচু পাহাড়ের গায়ে কেউ সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে ছোট ছোট চা গাছ কিলবিল করে যেন পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা শুরু করেছে।
খানিক এগুতেই আর দূরে তাকাতে হলো না৷ রাস্তার দুই পাশ থেকেই চা বাগানের শুরু। চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি। বাগানের মাঝে মাঝে নাম না জানা আরও অসংখ্য গাছগাছালি৷
দিনের প্রথমভাগের সূর্যের নরম আলোকে গাছগাছালি ভেঙে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলেছে। সূর্যের সোনালি আলোয় চিকচিক করছে সবুজ চা পাতা। চা বাগানগুলো যেন বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তোমরা ঢুকে পড়েছো দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে।
ইলি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। রাফসান পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিয়েছে সে টেরই পায়নি। কিন্তু যখনই সিগারেটে আগুন ধরাতে মাথা নুইয়ে হাত সিগারেটের কাছে তুলেছে। ইলি দেখে ফেলে ক্রোধান্বিত নয়নে দাঁত কটমট করে তাকায়। রাফসান সিগারেট হাতে নিয়ে মুচকি হেঁসে বলল, ‘জল্লাদের মতো তাকাচ্ছিস কেন?’

– ‘তুমি এটা কি করছো।’

– ‘কি আবার। সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছিলাম।’

– ‘দেশলাই আমার কাছে দাও।’

– ‘কেন?’

ইলি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বলছি তাই।’

– ‘তুই বললেই দিয়ে দেবো কেন?’

ইলির মুখটি ম্লান হয়ে গেল। সিএনজির বাইরে চোখ রেখে অস্ফুটে বলল,

– ‘তাও ঠিক। আমি বললেই কেন দেবে।’

– ‘ইলি একটা খাই?’

এদিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আমি না করলেও তুমি শুনবে না। সুতরাং জিজ্ঞেস করার মানে নেই।’

– ‘আচ্ছা এখন একটা ধরাচ্ছি। আজ আর খাব না।’

ইলি কোনো কোথা বললো না। রাফসান সিগারেট ধরিয়ে টানছে। ইলি বাইরের বিস্তৃত সবুজের সমুদ্রে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ইলির কাছে এখন আর উপভোগ্য মনে হচ্ছে না।

রাফসান সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া সিএনজির বাইরে ছেড়ে ফুরফুরে মেজাজে বলল, ‘চা বাগানগুলো দারুণ দেখতে, তাই না ইলি।’

ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান বুঝতে পারে ইলি রেগে আছে। তবুও ড্রাইভারের জন্য এখন আর কথা বলতে গেল না।
খানিক পরেই তারা পৌঁছে গেল কলাবন পাড়ায়। ড্রাইভার একটা বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এখানে খাবার অর্ডার দিয়ে গেলে ওরা রান্না করে রাখবে। আসার পর খাওয়া গোসল করে কাপড় পাল্টে নিতে পারবেন।’

ইলি ভারী মুখে কাপড় আর ওড়না ঠিকঠাক করে হাঁটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
– ‘ইলি কি করবো। খাবার অর্ডার দিয়ে যাই।’

ইলি মলিন মুখেই জবাব দিলো,
– ‘দাও।’

রাফসান খাবার অর্ডার দিয়ে এলো। এক ঝাঁক বাচ্চা-কাচ্চারা কাঁচা লাঠি নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিক্রির জন্য। কারণ এখান থেকে দু’টা রাস্তা দিয়েই হামহাম যেতে হয়। একটা উঁচু-নীচু পাহাড় আর টিলা দিয়ে। সেদিকে যেতেও পিচ্ছিল পথে লাঠি প্রয়োজন। অন্যটি হচ্ছে ঝিরি পথ। সেদিকে যেতেও লাঠি লাগবে। তারা দশ টাকায় দু’টা লাঠি এবং তিনশো টাকা দিয়ে একজন গাইড নেয়। কারণ গহীন জঙ্গলের ভেতরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাঁটতে হবে, বনের প্রায় সাড়ে সাত কিলো ভেতরে হামহাম ঝর্ণা।
জঙ্গলের এতটাই ভেতরে যে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের মহিমা লুকিয়ে রেখেছিল এই জলপ্রপাত। দূর্গম পথ আর লোকালয়ের বেশ বাইরে থাকার কারণে এতদিন এই জলপ্রপাতটি কারও চোখে পড়েনি। মাত্র দুই হাজার দশ সালে প্রথমে হামহাম জলপ্রপাত আবিষ্কার হয়।
ঝিরিপথে প্রায় হাঁটু অবধি পানি থাকায় অনেকেই জোকের ভয়ে লবণ বা গুল নিয়ে যায়।
গাইডের পিছু পিছু রাফসান আর ইলি লাঠি হাতে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে। রাফসান উপরের প্যান্ট খুলে গাড়িতে রেখেছে৷ নিচেই শর্ট প্যান্ট ছিল। পেছনে স্কুল ব্যাগ। ইলি চুল খোঁপা করে ওড়না কাঁধ থেকে বুক দিয়ে আড়াআড়িভাবে পেঁচিয়ে বেঁধে নিয়েছে। হাঁটছে ম্লান মুখে।

চলবে…

দেশলাই – ১৮ পর্ব

লাঠি হাতে ম্লান মুখে ইলি হাঁটছে৷ রাফসান ওর কাছাকাছি গিয়ে বলল,
– ‘জুতা পরে নে ইলি। খালা তোর হাঁটার সুবিধার জন্য পুরোনো বেল্টওয়ালা জুতা ব্যাগে ভরে দিয়েছেন।’

ইলির কাছ থেকে কোনো জবাব এলো না।
রাফসান খানিক্ষণ ওর পায়ে পায়ে হেঁটে মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

– ‘গোমড়ামুখে কি ভ্রমণ হয় রে ইলি?’

এবারও কোনো জবাব নেই। প্রতিক্রিয়া নেই। যেন সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। নিজের মতো গাইডের পিছু পিছু হাঁটছে। রাফসানের সঙ্গে তার কোনো পূর্ব পরিচয় নেই। অন্য আট-দশজন পর্যটকের মতো রাফসান কোথাকার ছেলে সে জানে না। জানার দরকারও নেই। এই মুহূর্তে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে গাইডের পিছু পিছু হাঁটা।
কিন্তু রাফসান নাছোড়বান্দা হয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে নানানভাবে ইলির মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। খানিক সামনে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে আবার হাসতে হাসতে বলল, ‘লাঠি হাতে তোকে কি যে ভয়ংকর লাগছে ইলি। দাঁড়া ছবি তুলে দেখাই।’

কিন্তু কে শুনে কার কথা। ইলি নিজস্ব গতিতে মুখ ভার করে হাঁটে। তবুও রাফসান হুটহাট ক্লিক মেরে কয়েকটি ছবি তুলে নেয়। গাইড ‘হেহে’ করে হাসে।
রাফসান ছবিগুলো দেখার আর সময় পেল না।
তারা হেঁটে হেঁটে লোকালয় পেরিয়ে জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকে আর মানুষের বসতবাড়ি নেই। কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা।
গাইড তাদেরকে দু’টি রাস্তা দেখিয়ে বলল, – ‘এই যে দেখেন। এইটা হচ্ছে টিলা পথ আর এইটা ঝিরিপথ। এইবার কন কোনদিকে যাবেন।’

ইলি জবাব দিলো,
-‘ঝিরিপথ দিয়ে যাবো। টিলা পথে ফিরে আসবো।’

– ‘আইচ্ছা তাইলে চলেন।’

হাসানোর জন্য রাফসানের আবার বৃথা চেষ্টা করে বললো, ‘ঝিরিপথে আমরা যুদ্ধ করতে করতে যাবো আর টিলা পথে পালিয়ে আসবো, তাই নারে ইলি?’

ইলির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কেবল গাইড ভদ্রলোক ‘হেহে’ করে হেঁসে রাফসানকে সঙ্গ দিলেন।
খানিক এগুতেই জঙ্গলের সম্মুখ পথে দৃশ্যমান হলো একটি ছোট্ট খাল। সেখানে শুকনো গাছের একাংশ বিছিয়ে রাখা। ধরে যাবার জন্য কোনো হাতল নেই। গাইড ম্যান ওপারে চলে গেল। রাফসানও মোবাইল ব্যাগে পুরে লাঠি হাতে সাবধানে ওপারে গিয়ে ইলিকে বললো,
‘আয়।’

ইলি আমতা-আমতা করছে। হাতল ছাড়া কীভাবে পার হবে বুঝতে পারছে না। গাইড তাড়া দিয়ে বলল,
– ‘এইটা পার হইতে না পারলে যাইবেন কেমনে? এইটা তো মাত্র শুরু ম্যাডাম।’

রাফসান একটু এগিয়ে তার লাঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– ‘হাত বাড়িয়ে এটা নে। দু’টা লাঠি দিয়ে পার হতে সুবিধা হবে।’

লাঠির দিকে হাত না বাড়িয়ে ইলি সাহস করে গাছে পা দেয়। রাফসান আবার উপরে উঠে গেল। ইলি কাঁপতে কাঁপতে লাঠিতে ভারসাম্য রক্ষা করে উপরে এসে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁচে।
তারা এবার হাঁটতে থাকে নানান ধরনের গাছগাছালির মাঝখান দিয়ে। সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জারুল গাছ। রাফসান পকেট থেকে মোবাইল বের করে গ্যালারিতে গিয়ে ছবি দেখে পেছন থেকে একা একা হাসতে শুরু করে। উদ্দ্যেশ্যে ইলির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু ইলির কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। রাফসান এবার লাইনচ্যুত হয়ে কয়েকটি জারুল গাছের দিকে ঘুরে ইলির সামনে গিয়ে মোবাইল চোখের সামনে ধরে ঠাট্টা করে বললো, ‘দেখ দেখ তোকে কেমন লাগছে।’

ইলি তাকায় না। তাকালে দেখতো সত্যিই কত অদ্ভুত লাগছে। হাঁটার সময় ছবি তুললে যেমন হয়। ইলির এক হাতে লাঠি, এক পা মাটি থেকে উপরে। মাথা আকাশের দিকে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সেও জারুল গাছের দিকে গিয়ে রাফসানের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যায়।
রাফসানের এবার রাগই হলো, অস্ফুটে বলল,
– ‘ধুরো বাল, হুদাই রাইগা আছে।’

মেজাজ খারাপ হলে সিগারেট খাওয়া নিয়ম।
সে টান দিয়ে ব্যাগটা সামনে এনে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট বের করে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরাই। শব্দ শুনেই ইলি পিছু ফিরে তাকায়। তারপর আবার নিজের মতো হাঁটতে থাকে। রাফসান দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট ব্যাগে রেখে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
– ‘তাকানোর কি আছে? এতো বড়ো জঙ্গলে সিগারেট খেলে তো কারও সমস্যা হওয়ার কথা না।’

খানিক এগুতেই দেখা গেল জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে নানান রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে বহুদূরে উড়ে যাচ্ছে। ইলি সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘ওয়াও, কি সুন্দর। মনে হচ্ছে প্রজাতির ডানায় কোনো মানুষ নিজের হাতে রঙ করে দিয়েছে। এতো ঝকঝকে রঙিন। উফ।’
গাইড পেছন ফিরে বলল, ‘আগে আরও বেশি আছিল বুঝলেন, মানুষের চলাচল বাড়ায় সবকিছু কমে যাচ্ছে।’

রাফসান পিছু থেকে থেকে বলল,
– ‘শুনলাম প্রথমে না-কি এসব রাস্তায় বাঘ, সাপও পাওয়া যেতো।’

– ‘হ, এখনও মাঝেমধ্যে পাওন যায়।’

– ‘এখানে এসে কেউ কি কোনোভাবে দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে?’

– ‘হ, কত দূর্ঘটনা হয়। কিছুদিন আগেও একজন পাহাড় ঝর্ণার উপরে গিয়েছিল কেমনে, কোত্থেকে পানি আসে দেখতে। কিন্তু সেখান থেকে ঝর্ণার পানির সাথে নিচে পড়ে মারা যায়।’

– ‘মাই গড।’

খানিক এগুতেই গাইড বলল, ‘এখন বেতের বাগান শুরু হবে আপনেরা মাঝখান দিয়ে হাঁটবেন। না হইলে বেতের কাটায় কাপড় আটকাইব।’

মাথা নেড়ে সায় দেয় রাফসান। একটু পরেই লতানো চিরুনির মতন কাটা ওয়ালা বেতের বাগান দৃশ্যমান হয়। মাঝখান দিয়ে মানুষের তৈরি আঁকাবাকা পথ। ইলি ভার মুখে সাবধানে বেত বাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটে৷ বেত বাগান পেরিয়ে খানিক যেতেই দেখা যায় চারদিকে প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর। সেখানে নানান ধরনের বাঁশ লক্ষণীয়।

রাফসান গাইডকে বলল, ‘এখানে তো একই রকম বাঁশ মনে হচ্ছে না।’

– ‘না এখানে অনেক প্রজাতির বাঁশ আছে
ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি বাঁশ আছে।’

– ‘কি অদ্ভুত অদ্ভুত নাম। তবে দারুণ লাগছে দেখতে।’

আরেকটু সামনে গিয়ে ইলি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আরে এতো গহীন জঙ্গলে এসে কলাগাছ লাগালো কে?’

গাইড হলদে দাঁত বের করে হেঁসে বলল,
– ‘এগুলা বন্য কলাগাছ। কেউ লাগায়নি এমনিতেই হইছে।’

– ‘ওয়াও, এতো সুন্দর, সুশৃংখল সারিবদ্ধভাবে নিজ থেকে হয়ে গেছে?’

– ‘হ।’

রাফসান ইলি মুগ্ধ নয়নে চারদিকে তাকিয়ে হাঁটছে। কীসের একটা কড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক ধরা যাচ্ছে না।

গাইড পেছনে তাকিয়ে বলল,
– ‘এখন একটা ছোট্ট সাঁকো পাইবেন। এইটা প্রথম সাঁকো। এরকম আরও সাতটা সাঁকো পাওন যাইব।’

ইলি ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, ‘আল্লাহ এতো সাঁকো।’

– ‘সমস্যা নেই। ছোট্ট সাঁকো। উপরে হাতলও আছে।’

খানিক সামনে যেতেই সাঁকোটি দেখা গেল। আসলেই সমস্যা নেই। ছোট্ট এবং শক্ত হাতল দেয়া। গাইড যাওয়ার পর ইলিও সাচ্ছন্দ্য ভাবে পার হয়ে চলে গেল। তাদের পেছনে রাফসান।
হাঁটতে থাকে তারা। যেদিকে চোখ যায় নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফুলের গাছ পরম মমতায় কেউ সৃষ্টি করে রেখেছে মানুষকে বিস্মিত করার জন্য। অপরূপ সৌন্দর্য থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। কানে অবিরাম ভেসে আসছে নানান পোকা, পাখি, জন্তু জানোয়ারের ডাক।

আরও খানিক্ষণ হেঁটে যেতেই মাথা ধরে যাচ্ছিল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে।

– ‘কি মামা, এতো ঝিঁঝি পোকার ডাক কোত্থেকে আসছে?’

– ‘একটু সামনে গেলে পাইবেন চারদিকে শালগাছ আর এক টানা শুনবেন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রাজকান্দি ফরেস্টের পুরো রাস্তা মনে করেন এই শব্দ চলতে থাকবে।’

সত্যিই তাই হলো। একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকা। শালবন পেরিয়ে তারা পেল কিছু উঁচু-নীচু টিলা। যতই এগুচ্ছে তারা গহীন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে যেসব স্থানে মানুষের পদচিহ্নও পড়েনি। পুরো জঙ্গল জুড়ে নানান প্রাণীর মিশ্র ডাক। হঠাৎ কিছু তীব্র শব্দ শুনে ইলি কেঁপে উঠে। হাত থেকে লাঠি পড়ে যায়। বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। রাফসানও কান পেতে চারদিকে তাকাচ্ছে। কি ভয়ংকর চিৎকার। জঙ্গল যেন কাঁপিয়ে তুলছে।
ইলি লাঠি হাতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গাইডকে বলল,

– ‘এরকম কি ডাকে?’

– ‘কতকিছু আছে জঙ্গলে। প্রত্যেকটা পোকা, পশু-পাখিরাই ডেকে যাচ্ছে অনবরত।’

– ‘কিন্তু ওইযে শোনা যাচ্ছে এটা কিসের?’

– ‘উল্লুকের ডাক শোনা যাচ্ছে।’

রাফসান ইলির কাছাকাছি এসে বলল,
– ‘কেমন ভূতের পরিবেশ তাই না? হরর সিনেমার মতো নানান শব্দ।’

ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান গাইডকে বলল, ‘আচ্ছা আর কোনো মানুষ দেখছি না যে?’

– ‘ঝর্ণায় গিয়ে পাইবেন। সামনে পেছনেও মানুষ আছে। কিন্তু গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়ের জন্য একটু দূরের কেউ কাউকে দেখতে পায় না বুঝছেন।’

– ‘হুম বুঝেছি।’

– ‘মাঝে মাঝে দূর থেকে বিপন্ন বনমানুষের ডাকও আসে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ। আরো কতকি আছে। আরে মিয়া বুঝেন না কেন। কলাবন থাইকা আর বাড়িঘর নাই। এক সময় মানুষ রাতে ভরা বর্ষায় শুধু ঝর্ণার পানির আমআম শব্দ শুনতে পাইতো। কারণ অনেক উপর থাইকা পানি পড়ে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারতো না কিসের ডাক। কোথা থেকে আসে। মানুষ আসতোই না এতো গভীরে। এই জঙ্গল গিয়ে লাগছে ভারতের ত্রিপুরা। সেখানের বাসিন্দারা আদিবাসী।’

– ‘ও আচ্ছা।’

এভাবেই তারা অদ্ভুত অদ্ভুত ডাক শুনে। অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝিরি পথের সামনে চলে আসে।

গাইড পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘সাবধানে হাঁটবেন। পড়লে কিন্তু ব্যাথা পাইবেন। পানিও একেক জায়গায় ব্যাপক।’

ইলি হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা হাপিয়ে উঠেছে। ঝিরি পথের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে ওড়নার মাথা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নেয়। তারপর আবার ওড়নাটা শক্ত করে বাঁধে। এতো ক্লান্তিতেও পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথ দেখে, সুমধুর পাখির কলরব এবং দূর থেকে ভেসে আসা উল্লুক, বিপন্ন বন মানুষের ডাক শুনে ভয়ের সঙ্গে ভালো লাগার অনুভূতিতে ভরে যায়।

রাফসান কান পেতে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পাখিরা শিস দিচ্ছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে কিচিরমিচির করছে। কখনও মনে হচ্ছে গান গাচ্ছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে পাখিরা তাদের দিকে গালি ছুড়ে দিচ্ছে। গাইডকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কি মামা, ঝিরিপথে এতো পাখির ডাক কেন?’

– ‘হ, পুরা ঝিরি পথে এরকম শুনা যাবে। কিন্তু এর পর ঝর্ণার পানির শব্দে কিচ্ছু শুনা যাবে না।’

– ‘ও আচ্ছা।’

ধীরে ধীরে তারা সচ্ছ শীতল পানিতে লাঠি হাতে নেমে পড়ে। ঝিরি পাথরের ওপর হাঁটা খুবই কষ্টের মনে হচ্ছে ইলির কাছে। মাঝেমধ্যে কোমর অবধি পানি। কোথাও এতটাই শুকনো যে নিচ দেখা যায় সিমেন্টের ঢালাই করার মতো এবং খুবই পিচ্ছিল। ইলি লাঠিতে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটছে খুব ধীরে ধীরে। গাইড চলে গেছে বহুদূর। রাফসান খানিক দূরে গিয়ে বারংবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। ইলি পেছনে পড়ে যাচ্ছে বারংবার। অসংখ্য পাখির ডাকের মাঝখানে হঠাৎ উল্লুকের ডাকে কাঁপন ধরে যায় তার বুকে। ঝিরিপথের চারপাশে ডুমুর গাছের সঙ্গে বাঁশঝাড় বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও নাম না জানা অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরপুর। প্রতিটি গাছের ডাল দু-দিক থেকে নুইয়ে ঝিরিপথকে কেমন বিচ্ছিন্ন করে ভয়ংকর রুপ দিয়েছে।

মাঝে মাঝে গোড়ালি সমান পানি দেখা যায়। নিচ সিমেন্টের ঢালাই এর মতো। রাফসান সেরকম একটি জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে ইলির জন্য অপেক্ষা করছে। ইলি তার কাছাকাছি চলে এসেছে হঠাৎ দেখে তার বাম পায়ের আঙুলের চিপায় জোকে ধরেছে। ইলিকে দেখানোর জন্য রাফসান ইচ্ছে করেই বললো, ‘ওমা গো জোক।’
ইলি রাফসানের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মতো লাঠি হাতে পানিতে চপচপ শব্দ তুলে সামনে চলে গেল।

রাফসান মাথা নুইয়ে এক টানে জোক হাতের মুঠোয় নেয়। আঙুল থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। তবুও সাবধানে দৌড়ে ইলির সামনে গিয়ে ভয় দেখানোর জন্য বলে,

– ‘মাথায় দিয়ে দেই। দেই…দেই..দিচ্ছি কিন্তু..দিচ্ছি।

ইলি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ভাবলেশহীনভাবে হাঁটছে। রাফসান এবার চেহারা দেখে বুঝতে পারে এই রাগ ঢং করে ভাঙানোর মতো না। তারও নিমিষেই মন খারাপ হয়ে গেল। পুরো ভ্রমণটাই যেন মাটি৷
ম্লান মুখে সেও হাঁটতে থাকে। ইলি আবারও পেছনে পড়েছে। রাফসান আর দাঁড়ায় না। তার রীতিমতো রাগ হচ্ছে৷

ইলি জোকের জন্য ভয়ে ভয়ে হাঁটছে৷ জোকে ধরলে সর্বনাশ। তাছাড়া আসার আগে বুঝেনি এতোটা ভয় লাগবে৷ এখন মনে হচ্ছে হরর বই কিংবা সিনেমা থেকে কম ভয়ংকর না জায়গাটা। এক বিচ্ছিন্ন জগতে চলে এসেছে মনে হচ্ছে। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত তারা জঙ্গলের পথে হাঁটছে।
আচমকা কাছাকাছি কিছু একটার ডাক শুনে মাথা তুলে তাকাতেই পা পিছলে সামনের দিকে পড়ে পুরোটাই ডুবে গেল ইলি। নিচে পাথরে হাঁটু লেগে ব্যাথা পায়। লাঠি ভেসে যায় পানিতে।

রাফসান শব্দ শুনে পিছু ফিরে তাকিয়ে দৌড়ে আসে।
তার ইন্ডিয়া যাবার অভিজ্ঞতার কাছে এখানকার সবকিছু খুবই তুচ্ছ। রাফাসান আসার আগেই ইলি উঠে গেল। লাঠি এনে হাতে দিতে যাবে তখনই ইলি বলল,
– ‘লাগবে না।’
তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে লাঠি নিয়ে এলো। গাইড দাঁড়িয়ে আছে দূরে। রাফসান ইশারা করলো যেতে। গাইড নিজের মতো আবার হাঁটতে থাকে। ইলি কিনারার কাছাকাছি গিয়ে হাঁটু থেকে রক্ত বেরুচ্ছে কি-না দেখতে যাবে তখনই চোখে পড়ে ডান পায়ের গোড়ালির সোজা উপরে একটা কালো তেলতেলে মোটা জোক দু’দিকে মুখ গেড়ে একদম পায়ে সেঁটে আছে।
ভয়ে চিৎকার করে জোক ছাড়ানোর জন্য ইলি ডান পা পানিতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার উল্টে পড়ে পেছনের দিকে। ব্যাথা পায় কনুইয়ে। রাফসান হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে যেয়ে নিজেও ব্যাগ সহ পড়তে পড়তে লাঠির কারণে আঁটকে যায়। ইলি কোনোভাবে মাথাটা তুলে কাশি দিতে দিতে আবার পড়ে গেল। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে টেনে খাঁড়া করে পিঠের দিকে হাত পেঁচিয়ে ধরে। ইলির নাকে-মুখে পানি ঢুকে যাওয়ায় কাশতে থাকে। কাশি খানিক কমতেই রাফসান বাম হাতে লাঠি সহ ইলিকে বুকের সঙ্গে চেপে রেখে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছে,
– ‘শান্ত হ, কিচ্ছু হবে না। শ্বাস নে ধীরে ধীরে। আমি আছি না। দেখিস জোক কীভাবে ছাড়াই।’

কিন্ত ইলি খানিকটা শাস্ত হবার পর মোচড়ামুচড়ি করে বলল,
– ‘ছাড়ো আমাকে। জোক ছাড়ানো লাগবে না আমার। রক্ত খাক। ছাড়ো।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here