তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্ব-১
নূর নাহার লিজা
(গল্পটির পটভূমি আজ থেকে ২০ বছর আগে এই প্রাণপ্রিয় ঢাকা শহর। তখন ঢাকা ছিল মোটামুটি শান্তির শহর।ছিলনা ক্যাবল নেটওয়ার্ক এর দৌড়ত্ব, না ছিল মোবাইল ফোনের হিড়িক। টিভিতে একটাই চ্যানেল ছিল- বাংলাদেশ টেলিভিশন। টিভি সেটের উপর লাগানো লম্বা লম্বা এন্টেনা দিয়ে ওই চ্যানেল দেখতে হত। বাড়িগুলো ছিল বেশির ভাগ ৪-৫ তলা।ভাড়াটিয়ারা অত্যন্ত সংকোচের সাথে বাড়িওয়ালাদের বাসায় আসতো ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করার জন্য। বাড়িওয়ালারা আড়চোখে একবার ফোনের দিকে তাকায় একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের জন্য যে অনেক খেলার মাঠ ছিল তাও কিন্তু না। বাড়িগুলোর ছাদ তখন সবার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বাচ্চারা বিকেলবেলা ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে খেলত। বিল্ডিং এর ভাবীদের আড্ডা চলত।এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে হত ভাবের আদান-প্রদান।এখন মাইলের পর মাইল উঁচু উঁচু দালানের ছাদ দেখা যায়, কিন্তু সেখানে মানুষের বিচরন খুব কম। সেই কুঞ্জ ও আর দেখা যায় না, প্রাণনাথরাও আর সেখানে আসেন না।)
মজিদ সাহেব রাবেয়ার রুমে ঢুকে দেখলেন রাবেয়া এক মনে বই পড়ছেন।একসিডেন্ট এর পর থেকে এই নেশা ধরেছে রাবেয়াকে। বই পড়া। অনেক বই পড়ে এখন সে। মজিদ সাহেব পেশায় ডাক্তার।বই পড়ার সময় হয়ে উঠে না। দিনের বেশির ভাগ সময় হসপিটালে থাকতে হয় তাকে। রাবেয়া- রুনি কাউকেই ঠিক মত সময় দিতে পারেন না। তারপর আবার তাদের থাকার ঘর আলাদা। রাবেয়াই আলাদা করেছিল। বলেছিল সারাদিন হসপিটালে কাজ করে এসে আবার রুগির সাথে একসাথে থাকার কোন মানে হয়ই না। তাই আলাদা থাকার ব্যবস্থা।রাবেয়ার দেখাশুনার জন্য একটা মেয়ে রাখা হয়েছে- সপ্না নাম। এখনো আসেনি।
মজিদ সাহেব দরজায় টোকা দিলেন”আসব?”
রাবেয়া মুখ তুলে তাকালেন”এসো।এত ফরমালিটি দেখাচ্ছ যে।”
“না। তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলে কিনা।একবার ভাবলাম পরে আসব। তোমাকে Disturbed করা ঠিক হবে না।”
“তুমি আসলে আমি Disturbed হয়ই বুঝি?এই জানলে আমায়?”
“আমি সেরকম কিছু মীন করিনি আসলে। আচ্ছা এখন বল তোমার শরীর কেমন?”
“আছি কোনমতে। পঙ্গু মানুষের আর থাকা-না থাকা”
“কেন এভাবে চিন্তা কর বলত?তোমায় কখনো অবহেলা করেছি?”
“কয়দিন পর এই ঘরে আসলে তা জানো?”
“হাসপাতাল থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়ো। তাই তখন আর তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না।”
“তুমি আসলে আমি কখনো বিরক্ত হইনা। যাই হোক, তোমার সময় আর নষ্ট করব না। জরুরী কথা বলার জন্য তোমায় ডেকেছি।আমি রুনির বিয়ে ঠিক করেছি।”
“কি?রুনির বিয়ে?”মজিদ সাহেব অবাক হয়ে গেলেন।
“অবাক হচ্ছ কেন?মেয়ের বয়স কত হয়েছে খেয়াল করেছ? সামনের জুনে ২১ শেষ হবে।”
মজিদ সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।সত্যি সময় কত দ্রুত চলে যায়।মনে হচ্ছে এই সেদিন রুনি হল। ডেলিভারি আরও মাসখানেক পরে ছিল। বিকেলবেলা রাবেয়া বসে বসে গল্প করছিল ওর মায়ের সাথে।৫ মাসের সময়ই শাশুড়িকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন মজিদ সাহেব।হঠাৎ পানি ভেঙ্গে যায়। রাবেয়ার মা মনোয়ারা টেলিফোন করতে জানতেন না। রাবেয়াকে অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে ফোন করতে হয়।কিন্তু মজিদ সাহেব তখন ওটিতে ছিলেন।ওটি থেকে বের হয়ে জানতে পারলেন রাবেয়ার কথা।মনোয়ারা উপায় না দেখে পাশের বাড়িতে খবর দেয়। ওরাই রাবেয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। পুরো ঢাকা শহর পানিতে ডুবে যায়। ঢাকা মেডিকেল থেকে মালিবাগ আসতে ৩ ঘণ্টা লেগে যায়। পুরো ১২ ঘণ্টা পেইন থাকে রাবেয়ার। ফজর আযানের কিছু আগে জন্ম হয় রুনির।সেই রুনির ২১ বছর শেষ হবে এই জুনে।
“কি হল? কথা বলছ না কেন?”
“তাই নাকি? ছেলে কি করে? বাড়ি কোথায়?”
“ছেলে কি করে তার চেয়ে অনেক বেশী ইম্পরট্যান্ট তোমার মেয়ের ছেলেকে খুবই পছন্দ হয়েছে। মেয়ে তোমার খুশিতে একেবারে ডগমগ।” কথা সত্যি। ঘটকের কাছ থেকে Biodata নিয়ে রাবেয়া রুনিকে দেখায়। রুনি একটা একটা করে Biodata দেখছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। এই ছেলের রং কাল, ঐ ছেলে শর্ট- বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা। রাবেয়া খুব ভালো করে জানে রুনি বাদলকে পছন্দ করে।মেয়ে তার অনেক সেয়ানা। অন্য ছেলেদের ভূল ধরতে ব্যস্ত। তাই ঠিক করেছে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে তাড়াতাড়ি।
“সবই ত ঠিক আছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিবে? মাত্র তো সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অনার্সটা অন্তত শেষ করুক।”
“তোমার মেয়ের উপর আমার কোন ভরসা নেই। পরে দেখা যাবে কাকে না কাকে ধরে নিয়ে এসে বলবে মা একে আমার পছন্দ, একে বিয়ে করতে না পারলে আমার জীবন কয়লার মত অন্ধকার হয়ে যাবে। তুমি এসব সহ্য করতে পারো আমি পারব না।”
মজিদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাবেয়া একবার যখন ঠিক করেছে মেয়ের বিয়ে দিবে তো দিয়েই ছাড়বে।
সামনের বিল্ডিং এর বারান্দায় ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছে। রাবেয়া লক্ষ্য করেছে সপ্নার সাথে ছেলেটাকে চোখাচোখি করতে, দুজনে মুচকি মুচকি হাসে ও।
“খালুজান আপনার ফোন।” ময়নার মা দরজার বাইরে থেকে বলল।
“আসছি।রাতে কথা বলব রাবু।গেলাম” মজিদ সাহেব বললেন।
“ইব্রাহিমকে একটু আসতে বোলো। কাজ আছে” রাবেয়ার প্রত্যুতর।
সামনের বারান্দার ছেলেটাকে ডাকতে হবে। বাদলকেও ডাকতে হবে। কাজ আছে।
************
অন্ধকার ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে “তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে”। এভাবে ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে গান শেখে রুনি। গানের প্রতি রুনির প্রচণ্ড আগ্রহ। বাদল গান শুনতে পছন্দ করে না তেমন। তবে রুনির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে বেশ পছন্দ করে। রুনিকে রুনি লায়লা বলে ডাকে।বাদলের শখ বই পড়া। প্রচুর বই পড়তে পারে। শুধু গল্প-উপন্যাস না, অনেক কঠিন কঠিন বই ও পরে।রুনি মাঝে মাঝে হুমায়ন আহমেদ, জাফর ইকবাল এদের বই পড়ে- এর বাইরে যেতে পারে না।কিন্তু বঙ্কিম- শরৎচন্দ্র পড়া হয়না।
দরজায় টোকা পড়লো। টোকার শব্দ থেকে রুনি বলে দিতে পারে কে এসেছে।মিলি এসেছে।
“দরজা খোলা। ঘরে ঢুকে পড়।”
মিলি নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
“কিছু বলবি?”
“আপা, লাইট তা একটু জ্বালাবো?”
মিলির গলা ভেজা। খালামনি বা বাদলদা কেউ মনে হয় বকেছে।কেউ একজন বকা দিলেই মিলি সোজা দোতলায় চলে আশে।রুনি উঠে বসলো “লাইট জালিয়ে ক্যাসেটটা বন্ধ কর।”
মিলি লাইট জ্বালাল। মিলির চোখ ভেজা।
“কি হয়েছে?”
“অঙ্ক পরীক্ষার খাতা দিয়েছে। ৪৫ পেয়েছি। ভাইয়া থাপ্পর দিয়েছে।”
রুনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাদলদা অনেক যত্ন করে অঙ্ক করিয়েছিল মিলিকে। কোথাও কোন গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হচ্ছে। মিলির চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
“ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে আয়।”
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞেস করল “কেন এত কম নম্বর পেলি?”
“অঙ্কের মাঝে মাঝে ছোট ছোট ভুল করে ফেলেছি।”
“কেন? মনোযোগ ছিল না পরীক্ষায়?”
“ভুল হয়ে গেছে।”
“বাদলদা কোথায় রে?”
“ভাইয়া তো ছাদে।”
রুনি জানে বাদলদা এই সময় ছাদে থাকে। তারপর ও মিলির কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া।
“আমি ছাদে যাচ্ছি। তুই কি আরও কিছুক্ষণ রুমে থাকবি?”
“আপা টিভিতে একটা নাটক আছে- অন্ধ শিকারি।”
“মার খেলি তাও নাটক দেখার ভুত মাথা থেকে যায়নি। যা ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখ। Sound কম করে দেখবি। মার শরীর খারাপ। মা ঘুমুচ্ছে।”
“মা তোমায় উপরে যেতে বলেছে। কলই এর ডাল রান্না হয়েচে।কিভাবে যে এই বিদখুটে জিনিস্তা তুমি পছন্দ কর?”
“যেভাবে তদের দুই ভাইবোনকে আমি পছন্দ করি। বিদঘুটে দুই মানুষ। আমি গেলাম। তুই থাক।” এই বলে রুনি ছাদে চলে গেল।
চলবে