তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্ব: ৬
নূর নাহার
বাদলের পাশে থাকলে রুনি একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই সুন্দর মানুষটার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে ধরা দেয় না, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
“নাশতা করেছো?”। বাদল না সুচক মাথা নাড়ল।
“চল রেলগেটে নেমে নাস্তা করি। তারপর যাই।”
“না, দেরী হয়ে যাবে।” বাদলের শরীর ভাল লাগছে না। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। “বাদলদা তুমি সোনারগাঁয়ে আগে গিয়েছ?”
“না, থার্ড ইয়ারে থাকতে একবার ফ্রেন্ডরা মিলে যাবার প্ল্যান করেছিলাম। পরে কেন জানি আর যাওয়া হয়নি।”
“আমার কেন জানি মনে হয় জায়গাটা অনেক সুন্দর হবে।”
বাদল রুনির দিকে তাকিয়ে বলল,“বেশি সুন্দর হলে আমরা ঐখানে থেকে যাব, আর আসব না।ঠিক আছে?”
বাদলের এই ধরনের কথাবার্তার সাথে রুনির পরিচয় আছে। একবার দুজনে বেড়িবাঁধে বেড়াতে গিয়েছিল।দুজনের কেউ সাঁতার জানে না।রুনি বলল “আমার খুব ভয় করছে। আমরা যদি পানিতে ডুবে যাই।”
“তাহলে তো ভালই হবে। বাঁচতে হলে একসাথে বাঁচব, মরলে একসাথে মরব।”
আবার এর উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। রিক্সায় চড়ে বেড়াবার সময় মাঝে মাঝে আবেগের বশবর্তী হয়ে রুনি বাদলের হাত ধরেছে। তখন বাদল বিরক্তির সাথে বলে “ভয় করলে রিক্সার হুট ধরে বস। পড়লে নিজে তো পরবি, আমাকে নিয়ে পড়বি।”
“বাদলদা তুমি আমায় বিয়ের পর চিঠি দিবে?”
“চিঠি লিখব কেন?আর কি লিখব চিঠিতে?”
“তোমার কথা, খালামনির কথা, মিলির কথা।”
“তুই বিদেশ যাবি। তুই চিঠি দিবি। সাথে থাকবে উইকেন্ড – হলিডেতে বেড়াতে যাওয়ার ছবি, স্নো এর সময় স্নোম্যান বানানর ছবি। আমদের জীবনে তো কোন বৈচিত্র্য নেই। সেই গরম, ট্রাফিক, গালাগালি, হাতাহাতি। এগুলো কি আর চিঠিতে লেখা যায়?”
সামনে প্রচণ্ড জ্যাম।আজকে না বেরলেই ভাল হত, বাদল ভাবল।মাথাটা খুব ধরেছে। ইচ্ছে করছে রুনিকে বলতে, “চল বাসায় ফিরে যাই।খুব মাথা ধরেছে। আমাকে তোর কোলে একটু মাথা রাখতে দিবি?গান গেয়ে একটু ঘুম পাড়িয়ে দে না।”
কিন্তু এমনটা করা যাবে না। এটাই হয়তো রুনির সাথে শেষ কোথাও বেড়াতে যাওয়া।এই যাত্রাটা পণ্ড করলে চলবে না।কাল রাতে রুনিকে নিয়ে একটা স্বপ্নওদেখেছে।রুনিকে নিয়ে প্রায়ই বাদল স্বপ্ন দেখে।স্বপ্নে রুনিকে ওর স্ত্রী মনে হয়েছে। কোন এক ছুটির দিন হবে। বাদল বাজার থেকে ছোট মাছ এনেছে। রুনি রাগে গজগজ করতে লাগলো।সারাদিন বাদলের উপর রাগ করে থাকল। রাতেও (স্বপ্নে হুট করে দিন থেকে রাতে চলে যাওয়া যায়)অন্য দিকে মুখ করে শুয়েছিল। বাদল রুনিকে নিজের কাছে টেনে নিল। ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বলল, “মান করে থাকা আজকে কি সাজে? মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে চল চল কুঞ্জ মাঝে।” তারপরই ঘুম ভেঙে যায়। তখন কারেন্ট ছিলনা, তাই রাত কয়টা বাজে জানার উপায় ছিলনা। তবে শেষ রাত্রি হবে বোধ হয় কারন এর কিছুক্ষণ পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হল। নিলুফা ফজর আজানের সময় ঘুম থেকে উঠেন।অবাক করা ব্যাপার হল স্বপ্নে রুনি সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছিল(স্বপ্ন তো সাদাকালো হওয়ার কথা, স্বপ্ন রঙ্গিন হল কেন?) আর বাস্তবের রুনিও আজ সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে।
বাদল সিগারেট ধরাল। রিক্সায় সিগারেট খাওয়া রুনি পছন্দ করে না। কিন্তু আজ আর রুনি বাধা দেবে না। এটাই হয়তো বাদলদার সাথে শেষ কোথাও বেড়াতে যাওয়া। আজ বাদলদার কোন কাজে বাধা দেবে না রুনি।
“তা তুই যে বিয়ে করবি রান্না-বান্না তো কিছু পারিস না। বিয়ের পর স্বামীকে কি রান্না করে খাওয়াবি?”
“বিদেশে রান্না এত কঠিন হয়না। ঐখানে তো শুনেছি স্যান্ডউইচ খেয়ে থাকে।”
“তুই সারা জীবন স্যান্ডউইচ খেয়ে থাকবি?” রুনি উত্তর দিল না।“ যে কয়দিন আছিস মার কাছ থেকে রান্নাটা শিখে নে।”
“উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আর কিছু?”
“তুই বিয়ের পর বাসায় সবসময় শাড়ি পড়ে থাকিস। তোকে শাড়িতে বেশ মানায়।”
“আমি সবসময় শাড়ি পড়ে থাকব।”কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রুনি জিজ্ঞেস করল, “বাদলদা আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমরা কি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?”
“বাড়ি ভাড়া নিয়েছে মা, মা এই ব্যাপারে সিন্ধান্ত নেবেন। আমি না।”
“তুমি কি চাও?”
বাদল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।কাল রাতে মায়ের সাথে বাসা পাল্টানো নিয়ে কথা হল। এত তাড়াতাড়ি তো ওর জানার কথা না।রুনি কি অন্তর্যামী?
সোনারগাঁয়ে গিয়ে দুজনে জাদুঘর ঘুরে ঘুরে দেখল, নৌকায় চড়ল। বাদল রুনিকে একটা লাল রঙের জামদানী শাড়ি কিনে দেয়। বাসায় ফিরে রুনি শাড়ীটা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল।
******************
নিলুফার ইস্কুল শেষে মিটিং ছিল।দুপুরে মিলিকে একা বাসায় ফিরতে হয়েছে।এটা নিয়ে মিলির অবশ্য কোন সমস্যা হয় না, বরং একা বাসায় থাকতে তার ভালই লাগে।নিজেকে খুব স্বাধীন স্বাধীন লাগে।কেউ পেছন থেকে তাগাদা দেবে না তাড়াতাড়ি গোছল কর, পড়তে বয়, টিভি দেখবি না।কয়েকদিন আগে সাতকাহন বইটা পড়া শুরু করেছে। তার বান্ধবী শিলার কাছ থেকে এনেছে। অবশ্য এটা শিলার বই না, ওর বড় ভাইয়ের বই। ভালই লাগছে পড়তে। ভেবেছিল ইস্কুলে বায়োলজি ক্লাসে পড়বে। বায়োলজি ম্যাডামের ক্লাসটা বড্ড বোরিং লাগে। তাই মিলি আর ওর বান্ধবীরা এই সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নেয়। কেউ গল্পের বই পড়ে, কেউ প্র্যাকটিকেলের ছবি আঁকে, কেউ গল্প করে।মিলি ঘরে ঢুকে কাপড় চেঞ্জ না করেই বই নিয়ে বসে পড়ে। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায়না।
নিলুফা বেল এর পর বেল দিয়েই যাচ্ছেন। মিলি দরজা খুলছে না। নিলুফার খুব ভয় লাগছে। মেয়েটার কোন অঘটন ঘটলো না তো। সেদিন বাংলার দিলারা ম্যাডাম বলছিলেন তাদের বাসার সামনের এক বাসায় দিনে দুপুরে কতগুলো বখাটে ঢুকে এক গর্ভবতী মহিলাকে রেপ করে বাসার আলমারি ভেঙে সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। ইব্রাহিমকে ডাকতে যাবেন এমন সময় মিলি দরজা খুলল।মিলিকে সুস্থ অবস্থায় দেখে খুশি হলেও নিলুফা জোরে একটা থাপ্পড় মারলেন মিলিকে।
“কই ছিলি এতক্ষন? আর স্কুলের জামা ছাড়িসনি কেন এখনও?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব টায়ার্ড লাগছিল তাই জামা ছাড়া হয়নি।” কাঁদো কাঁদো স্বরে মিলি বলল।
“খুব ভাল করেছ। উদ্ধার করেছ আমায়। যা এখান থেকে।”
মিলি গোছল সেরে বারান্দায় কাপড় মেলে দেয়ার সময় ছেলেটাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মিলি প্রায়ই ছেলেটাকে তাদের বাসার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে।সামনের বাসায় নতুন ভাড়াটে হিসেবে এসেছে ওরা।
বিকেলের দিকে ছাদে উঠল মিলি। অনেক দূরে আকাশটা মিলে গেছে।মনে হয় পৃথিবীটা ওইখানেই শেষ হয়ে গেছে। আচ্ছা এরপরও কি আর কোন পৃথিবী আছে? দীপাবলিদের চাবাগানটা কি আকাশের ঐপারে? কি ডানপিটে মেয়ে ছিল দীপাবলি কিন্তু বিয়ের পর থেকে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। রুনি আপারও বিয়ে ঠিক হয়েছে। রুনি আপাও সারাক্ষণ মুখ ভার করে আছে। মা-ভাইয়া সবার মন খারাপ। আচ্ছা বিয়ে ঠিক হলে কি সবাই এমন হয়?কই ঝুমুরের বোন নীলা আপার ও তো বিয়ে সামনে। আপা তো খুশি মনে শপিং করে বেড়াচ্ছে। সবার মন খারাপের জন্য মিলি কোন মজা করতে পারছে না। ভেবেছিল বিয়ে উপলক্ষে নতুন জামা কিনবে,রুনির সাথে ঘুরে ঘুরে শপিং করবে। এমনকি তার কয়েকজন বান্ধবীকেও দাওয়াত করবে ঠিক করেছে। এরকম কিছু হচ্ছে না দেখে মন খারাপ লাগছে। সামনের বাসার ছেলেটা তাদের ছাদে উঠেছে। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।মিলি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রাতে মিলি বারান্দায় গেল শুকনো কাপড় নিয়ে আসার জন্য।তখনও ছেলেটাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মিলির বিরক্ত লাগছে। ঘরে ঢোকার সময় বিরক্তি নিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিল।
(চলবে)