ধোঁয়ার_নেশা,১৪,১৫

0
824

#ধোঁয়ার_নেশা,১৪,১৫
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৪)

অনিকশা অন্ত্রীশার চেপে ধরা হাতটার দিকে তাকিয়ে আবার অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়েছে। ওর চোখ,মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। আর এতো সকালে উঠে এ বাসায় আসা তাও কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে আসা স্বাভাবিক নয়। কিছুতো একটা হয়েছে। কিন্তু কি? আর কিই বা এমন ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলবে ও? পালককে নিয়ে কিছু বলবে না তো?? পালকের কথা মনে পড়তেই অন্ত্রীশার ভেতরটা ছ্যাত করে উঠেছে। যা থেকে সে দূরে থাকতে চায় তাই কেন বার বার তার কাছে এসে ল্যাপ্টে পড়ে?

অন্ত্রীশা আপুকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো,

“” ছোটবেলা থেকেই তুমি আর আমি একসাথেই বেড়ে উঠেছি। তুমি যে আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতে তা কারো অজানা নয়। তোমার দিনে, রাতের চব্বিশটা ঘন্টায় আমাকে নিয়ে কাটতো। কারোর উপর রাগ থাকলেও আমার কাছে এসে ঝাড়তে,আবার খুব খুশি হলেও আমাকে জড়িয়ে ধরেই দুটো চুমু খেয়ে বলতে,আমার সব খুশির ভাগ আমি তোকে দিতে চাই,অনতি! কিন্তু হঠাৎ করেই তুমি বদলে যেতে লাগলে,আমার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতে। যেখানে তুমি আর আমি সবসময় একি রুমে দুজন দুজনাকে জড়িয়ে ঘুমাতাম সেখানেও তুমি অন্য রুমে থাকার বায়না করা শুরু করে দিলে। শুধু রাত না দিনের বেলাও তোমার রুম বন্ধ! আসতে আসতে তুমি আমাদের থেকে দূরে যেতে লাগলে। কিন্তু এই দূরত্বটা আমাদের কাছে অসহণীয় লাগলেও তোমার মধ্যে ছিলো অনাবিল সুখ। তোমার চালচলন,আচার ব্যবহার সবকিছুতেই পরিবর্তন। নিত্যনতুন জামা কাপড় কেনার বাহানায় শপিংমল,সাজগোজের বাহানায় পার্লার এমন কী রাত করে বাসায় ফেরাও শুরু করলে। এই জিনিসগুলোতে আমরা যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম ঠিক তখনি তুমি অরিদ ভাইয়াকে নিয়ে হাজির! বাড়িতে তুমি বড় মেয়ে ছিলে,আদর ভালোবাসাটাও তেমনি ছিলো। আমাদের কোনো ভাই না থাকার সুবাদে তোমার লুকিয়ে বিয়েটাকেও মেনে নিয়েছিলাম আমরা। এতে যেন আমাদের থেকে তোমার দূরত্ব আরো বেশি বাড়তে লাগলো। ছোটখাটো জিনিস নিয়ে রাগারাগি,ঝগড়া বিবাদ,সারাক্ষণ তিরিক্ষে মেজাজ তোমার।””
“” তুই এগুলো বলার জন্য এখানে এসেছিস,অনতি?””

অন্ত্রীশা অনিকশার আরেকটু কাছে চেপে এসে বললো,

“” নাহ,আপু। কিন্তু আমি যা বলতে চাই তার সাথে এগুলো রিলেটেড! একটু চুপটি করে শুনো আপু!””

অনিকশাকে কিছু বলতে না দিয়েই অন্ত্রীশা আবার বলতে শুরু করে দিয়েছে,

“” অরিদ ভাইয়াকে তুমি নিজে বিয়ে করেছিলে। তার মানে উনি তোমার ভালোবাসার মানুষ ছিলো। কেন করেছিলে এটা আমরা একবারও জানতে চাইনি। আব্বু চায়নি এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক তাই। কিন্তু এক দু মাস যেতে বা যেতেই তুমি অরিদ ভাইয়ার সাথে রাগারাগি করে সবকিছু উল্টোপাল্টে করে দিচ্ছিলে। তোমার বোন হওয়ার সুবাদেও আমি অরিদ ভাইয়ার দলেই কারণ উনি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আর যে সংসারে স্বামী তার বউকে এতো ভালোবাসে সে সংসারে ঝগড়া কিভাবে লাগতে পারে? এমন তো নয় যে তুমি তাকে ভালোবাসো না। যদি ভালো না বাসতে তাহলে তো বিয়েটা তুমি করতে না!””

অন্ত্রীশা কথা বলতে বলতে এক সময় অনিকশার কাঁধে মাথা রেখে হালকা জড়িয়ে নিয়ে আদুরী গলায় বললো,

“” তুমি এতে বছর ধরে যে সত্যটাকে ভেতরে পুষে রেখেছো সেটা আজ মুক্ত করে দাও আপু। যে সত্যটা তোমাকে এভাবে কঠোর থেকেও কঠোরতার রুপে বন্দি করছে সেটাকেও মুক্ত করে দাও। আমি তোমাকে সাহায্য করবো,আপু!””

অন্ত্রীশাকে নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে শক্ত কন্ঠ ধারণ করলো অনিকশা,

“” কী বলতে চাস,তুই? সেটা সোজা করে বল এতো প্যাঁচাচ্ছিস কেন?””

অন্ত্রীশা এবার জোর করে তার আপুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

“” তুমি আর আমি আব্বুর আদর্শে বড় হয়েছি,আপু! আমি জানি তুমি কোনো অন্যায় কাজ করতে পারো না। হয়তো তুমি কোনো অন্যায় কাজের মুখোমুখি হয়েছিলে,যেটা তোমাকে তোমার আদর্শ থেকে নড়াতে পারেনি। আর এই অন্যায় কাজটা তুমি করতে পারোনি বলেই আজ তুমি অন্ধকারে ডুবে আছো সাথে আমাদেরকেও ডুবিয়ে রেখেছো!””
“” অনতি,তুই কিন্তু…””
“” পালক আর তোমার মধ্যকার সম্পর্কের কথা জানতে চাই!””

অন্ত্রীশার এই ছোট্টবাক্যটাই যেন অনিকশাকে থমকে দিয়েছে। অনেকটা কাঁচের মতো শক্ত হয়ে গেছে সে। যাকে এখন একটু আঘাত করলেই হাজারটা টুকরো হয়ে ভেংগে পড়বে।

“” পালককে কি তুমি আগে থেকে চিনতে?””

অনিকশা নরম ধাঁচের শক্ত আয়নার মূর্তি হয়ে বললো,

“” পালক এন্ড আই ওয়াজ ইন এ রিলেশনশীপ!””

অনিকশার উত্তরে অন্ত্রীশার যতটা না বিস্মিত হওয়ার কথা ছিলো তার ছিটেফোঁটা ছাপ প্রকাশ পাইনি তার চেহারায়। বরংচ আরো সহজ স্বাভাবিকভাবেই বললো,

“” আমি পুরোটা শুনতে চাই আপু। বিস্তারিতভাবে। যাতে আমার চোখের সামনে তোমাদের লাভ স্টোরিটা ভেসে উঠে।””

অন্ত্রীশার এমন আবদারে থতমত খেয়ে যাচ্ছে অনিকশা। নিজের স্বামীর লাভস্টোরী অন্য মেয়েকে নিয়ে তাও মেয়েটা অন্য কেউ নয় তারই বড় বোন,এইভাবে স্বাভাবিক শান্ত হয়ে কিভাবে শুনতে চায়? ও কি আদৌ হুশে আছে নাকি বেহুশ হয়ে হুশে থাকার অভিনয় করছে??

অনিকশার কাঁধে ঝাকি দিতেই অনিকশার চোখের পলক পড়ছে।

“” আপু বলোনা,প্লিজ। আমি ওয়েট করছি!””
“” সেদিন ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারী,ভেলেন্টাইনস ডে! যেহেতু এটা সরকারী ছুটি না সেহেতু এই দিনে ভার্সিটি বন্ধ থাকার কথা না। তোকে কলেজে নামিয়ে দিয়েই আমি আমার ক্লাসের দিকে এগুচ্ছিলাম। আমার ফাইনাল ইয়ারের লাস্ট এক্সাম ছিলো ওইদিন। এক্সাম শেষে বের হতেই রিতালী আমার চোখ ধরে ফেলে! আমাকে চুপ করিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসের মাঠের ঠিক মাঝখানে দাঁড় করিয়ে আমার চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। আমি রিতালীকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই চোখের ইশারায় বললো নিচের দিকে তাকাতে। আমি নিচে তাকাতেই,,,””
“” পালককে হাটু গেড়ে বসে থাকতে দেখলে তাই না আপু?”‘
“” হুম!””
“” তারপর? কটিনিউ করো!””
“” তারপর আর কী ও প্রপোস করলো আর আমি রাজি হয়ে গেলাম!””

অন্ত্রীশা এতক্ষণ সোফাতে শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে অনিকশার কথা শুনছিলো। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,

“” প্রপোস করলো আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? তুমি কি আগে থেকেই পালককে ভালোবাসতে,আই মিন পছন্দ করতে?””
“” তা জানি না। কিন্তু আমাদের ভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ের ক্রাশ ছিলো ও। আমি এটা সিওর ছিলাম আমার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে সেও আমার মতো একি কাজ করতো!””
“” তুমি আমার আপু হয়ে পালকের কাছে সাধারন হয়ে গেলে? এটলিস্ট নিজের সেল্ফ এটিটিউটটা বজায় রাখার জন্য পরে জানাবে এটাও তো বলতে পারতে। আচ্ছা তারপর কী হলো?””
“” তারপর আর কী,ওর গভীর ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিতে থাকলাম। ডুবতে ডুবতে এতোটাই অতলে চলে যাচ্ছিলাম যে তোদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। অবশ্য আমার দোষটা কিসের বল ও মানুষটাই এমন। যে কাউকে নিজের প্রেমে ফেলে দিতে পারে,যেমনটা তোর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এক চুমুতেই তুই বশ হয়ে গেলি!””

অনিকশা কথার ছলে অন্ত্রীশার গাল টিপে দিতেই অন্ত্রীশা বলে উঠলো,

“” তাহলে তুমি অরিদ ভাইয়াকে কেন বিয়ে করলে? পালক তো এখনও তোমাকে ভালোবাসে। উনি তো তোমাকে ধোকা দেইনি আপু,তুমি কেন দিলে?””

অন্ত্রীশার এই প্রশ্নটাই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে অনিকশা। ওর কাছ থেকে কিছুটা সরে এসে আমতা আমতা করে বললো,

“” ওর সাথে আমার কোনোকিছুতেই মিলছিলো না। যার সাথে একটা বছরও আমি মানিয়ে নিয়ে চলতে পারিনি তার সাথে সারাজীবন কিভাবে থাকতাম?””
“” তাহলে যাকে কখনো ভালোইবাসোনি তার সাথে সারাজীবন থাকার দলিলে কিভাবে সাইন করলে আপু?””

অনিকশা কিছুটা রাগ নিয়ে অন্ত্রীশাকে ধমকে বললো,

“” তোর যা জানার ছিলো বলে দিয়েছি,আমার আর অরিদের মাঝখানে আসবি না। তাহলে কিন্তু আমি…””
“” আপু,আমি আসি!””
“” আসি মানে? মাত্রই তো এলি,এখনি চলে যাবি?””
“”হুম!””

অন্ত্রীশা সোফা থেকে পার্স আর মোবাইলটা নিয়ে দরজার কাছটাতে এগুতেই অনিকশা ডেকে উঠলো,

“” অনতি!””

অন্ত্রীশা উল্টো দিকে মুখ রেখেই বললো,

“” কিছু বলবে আপু?””
“” পালক একটা নিষ্পাপ ছেলে,কোনো কালো ছায়া ওর উপর পড়েনি। একটা বছরে ওর সাথে আমার হাজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো ঘনিষ্ঠতার স্মৃতি নেই। আমরা এমন সিচিউশনেও ছিলাম যেখানে আমাদের মধ্যে অনেককিছুই হতে পারতো কিন্তু ও আমার হাতটা পর্যন্ত ধরেনি। একেবারেই ধরেনি এটা বলবো না,ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে ধরেছিলো যে ছোঁয়ায় কোনো ভালোবাসা বা কামুকতা ছিলো না,ছিলো শুধুই দায়িত্ববোধ!””
“” সত্যি?””
“” হুম! ওর ভেতরের ভালোবাসাটা ছিলো পবিত্রতায় ঘেরায় যেটা আমি ভাংতে পারিনি।””
“” তুমি উনাকে এখনো ভালোবাসো তাই না আপু?””

অনিকশা অন্ত্রীশার কপালে দুটো চুমু খেয়ে বললো,

“” না রে পাগলী,ওর প্রতি আমার কখনোই ভালোবাসা জন্মায়নি। ওর ভালোবাসা আমাকে অবাক করতো। কিন্তু কেন জানি আমার ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করতো না। যদি ইচ্ছেই করতো তাহলে আমি কখনোই অরিদকে বিয়ে করতাম না। আমি তো এটাও জানি আমি যদি এখনো ভালোবাসার দোহায় দিয়ে ওর কাছে ফিরতে চাই ও খুশি মনে আমাকে বরণ করে নিবে। কিন্তু আমি কেন যাবো?””
“” তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছো উনি যে তোমাকে জেলাস করানোর জন্য এতকিছু করতো তুমি একটুও জেলাস হওনি?””
“” একদম না। তুই যে জেলাসের কথা বলছিস সে জেলাস ফিল করিনি। করলে এতদিনে অনেক কিছুই ঘটে যেতো। তবে হ্যাঁ,একটু একটু মন খারাপ হয়েছে। যেমনটা তোর কোনো ফ্রেন্ড অন্য কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করলে তুই আমার কাছে এসে কাঁদতি,তেমনটা। একটা বছর একসাথে চলাফেরা করেছি। হুট করে অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব করে নিলেতো খারােপ লাগবেই তাই না?'”

সকালে রোদের তীব্রতাকে মাথায় না নিলেও এখন নিতে হচ্ছে। যেমনটা চুপচুপা ঘাম নিয়ে অনিকশার বাসায় পৌঁছে ছিলো,অন্ত্রীশা। এখনও সে সেরকমই চুপচুপা ঘাম নিয়েই বাসে বসে আছে। তারাহুড়োয় ছাতা নিয়ে বের হয়নি সে। আজ যে তাকে মাথা ব্যথারা খুব করে চেপে ধরবে খুব বুঝতে পারছে সে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে ডুবে যেতে যেতে আবারও ভাবনায় ডুব দিচ্ছে অন্ত্রীশা!

অনিকশা যে তাকে সবকিছু খুলে বলেনি সেটা সে তখনি বুঝতে পেরেছে। অন্ত্রীশারও কেন জানি ইচ্ছে হয়নি সবটা জানতে। কেন হয়নি? আপু বলতে ইততস্ততায় ভুগতো তাই? নাকি অন্য কারণে??? অন্ত্রীশা চোখ বন্ধ করেই হালকা হেসে উঠে।

আচ্ছা সত্যিই কি পালক আপুর সাথে ঘনিষ্ঠতাই আবদ্ধ হয়নি? যেখানে বাসের পাশের সিটের পাঁচ মিনিটের জন্য একজন অপরিচিত মেয়েকে দেখলেও পুরুষজাতিগুলো কামুকতায় ছটফট করে। নানাভাবে তাকে ছোঁয়ার বাহানা বানায়। কেউ কেউ তো প্রকাশেই! তাহলে সেখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এতোটা কাছাকাছি,এতোটা নিরিবিলি জায়গায় এতোটা সময় একসাথে থাকলে ছেলেদের মনে একটু অন্যকিছু করার ইচ্ছে জাগবে এটাই স্বাভাবিক। বরংচ না জাগাটাই অস্বাভাবিক! তবে কি আপু আমাকে মিথ্যে বলেছে? যদি আমার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকতো তাহলেও কি এই কথাগুলো বলতো?

কন্টাক্টরের ডাকে অন্ত্রীশা চোখ মেলে। বাস থেকে নেমেই রিকসায় উঠে পড়েছে।

বাসায় আসতেই পালকের মুখোমুখি হয়েছে অন্ত্রীশা। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই পালক চোখ সরিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। পালকের গালে এখনও লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। অন্ত্রীশা নিজের ডান নাতটা চোখের সামনে ধরতেই মু্খ থেকে বেরিয়ে এলো,তোর হাতে এতো শক্তি? এভাবে একটা পুরুষের গালকে কলংকিত করে দিলি.??

সারাদিন একা ঘরে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলো অন্ত্রীশা। তার মধ্যে তো যখন তখন নানা ভাবনায় মাথাটাকে পাগল করে দিচ্ছে। কিছুটা রিলাক্স হওয়ার আশায় পাপড়ির রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে অন্ত্রীশা!

এ বাসায় আসার পর থেকে পাপড়িকে রুম থেকে তেমন একটা বের হতে দেখেনি অন্ত্রীশা। মেয়েটাকে দেখলে মোটেও শান্তশিষ্ট লাগে না। চেহারায় একটা চঞ্চলতার ভাব রয়েছে।

অন্ত্রীশা দরজায় পরপর দুবার নক করতেই পাপড়ি দরজা খুলে দিয়েছে।

“” কিছু বলবে ভাবী?””
“” তোমার রুমে ঢোকা নিষেধ?””
“” না তো,কেন?””
“” এইভাবে আমাকে বাইরে রেখেই সবসময় কথা বলোতো তাই ভাবলাম।””

পাপড়ি রুমের লাইট জ্বালিয়ে অন্ত্রীশাকে ভেতরে এনে বসিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছে। এটা যেন বেশ অস্বাভাবিক মনে হলো অন্ত্রীশার কাছে। এখনো তো তেমন রাত হয়নি যে ও ঘুমাবে তার উপর সামনে ওর পরীক্ষাও। তাহলে লাইট বন্ধ করে কী করছিলো?

পাপড়ি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে অন্ত্রীশার পাশে বসতেই,অন্ত্রীশা বললো,

“” তোমার চোখ,মুখের এই অবস্থা কেন? কাঁদছিলে?””

অন্ত্রীশার এমন হুট করে করা প্রশ্নে বেশ ঘাবড়ে যায় পাপড়ি।

“” কেন কাঁদছিলে,পাপড়ি?””

পাপড়ি অন্ত্রীশার কাছ থেকে উঠে যেতে নিলেই ওকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে অন্ত্রীশা বলে উঠলো,

“” এই বয়সে মেয়েরা দরজা বন্ধ করে কেন কাঁদে সেটা মুখ ফুটে বলতে লাগে না। আমি কি তোমাকে দুটো কথা বলবো? তুমি মন দিয়ে শুনবে?””

পাপড়ি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁবোধক উত্তর দিলেও অন্ত্রীশা কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো। মেয়েটা আরেকটু কেঁদে হালকা হোক তারপর নাহয় বলা যাবে।

পালক অফিস থেকে বেশ রাত করেই ফিরেছে।অন্ত্রীশার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। কিন্তু রুমে ঢুকেই খালি বিছানা পেয়ে সে হতাশ। তারমানে ও ঘুমোয়নি? তাহলে কোথায় গেলো? বারান্দার দিকটাই তাকাতেই চাঁদের আলোই অন্ত্রীশার ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এতোরাতে ওখানে কী করছে? রাতে অমন ছটফট করে সকালে কোথায় বেরিয়েছিলো? ওর মনে চলছেটা কী??

ভাবনাতুর চেহারায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দরজায় হাত পড়তেই একটা চিরকুট দেখতে পেলো পালক। ছোট্ট করে লিখা,

**সরি!!

ইতি
অন্ত্রীশা

যেটা টেপ দিয়ে দরজায় আটকানো। পালকের চিরকুটে চোখ পড়তেই চোখ,মুখ উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে।

পালক ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় বদলে বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছে। অন্ত্রীশার পাশে এসে দাড়িয়েছে সে!

নিজের পাশে পালকের উপস্থিত পেয়ে অন্ত্রীশা রুমের দিকে পা বাড়াতেই ওর হাত আকড়ে ধরেছে পালক,

“” আর কিছুক্ষণ থাকো না,অন্ত্রীশা। তোমার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। শুনবে না আমার গল্প????

চলবে

#ধোঁয়ার_নেশা

#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৫)

অন্ত্রীশা এই মুহুর্তে পালকের কোন কাজটাই সে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। পালকের হাতে নিজের হাত বদ্ধ হওয়াতে, ওর কথাতে নাকি ওর ওই আবদারির চাহনিতে??? চোখের সামনে একের অধিক অপশন থাকলে মানুষ সবসময় ছোট্ট একটা ভাবনায় ডুব দিতে চাই। আর এই ছোট্ট ভাবনাটা একসময় বিশাল আকৃতির রুপে পরিণত হয়,ঠিক তখনি সে কোন অপশন গ্রহণ করবে সেটা গুলিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে তার সবগুলো অপশনই গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে। এখন অন্ত্রীশার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। ইচ্ছে করছে সে পালকের সবকিছুকেই তার একদৃষ্টিতে দেখে নিক।

এই প্রথম পালকের ছোঁয়াতে অন্ত্রীশা ভালোবাসার কিছুটা উপস্থিত পাচ্ছে। তবে সেটা স্বামী হিসেবে বউকে দেওয়া ভালোবাসা নয়,অন্যকিছু।

“” এভাবে থমকে গেলে যে? শুনবে না?””

পালকের কথায় অন্ত্রীশার হুশ ফিরে এসেছে। আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। তবে আগে সে একা দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে জোসনা আলো নিজের মধ্যে মাখতে চেয়েছিলো কিন্তু এখন জোসনার আলো ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা আলো পালককেও ছুঁয়ে দিচ্ছে।

অন্ত্রীশাকে নিজের পাশটাতে এসে দাঁড়াতে দেখে পালক নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। দুজনেই হাজার তারার মাঝে উকি দেওয়া চাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন একটা ভাব যেন কেউ কারো মুখ দেখলে দুজনের নামে মামলা হয়ে যাবে।

“” আতিশ বাদে এই প্রথম আমি কাউকে আমার ভেতরে গুপ্ত হয়ে থাকা কথাগুলো প্রকাশ করছি। কেন করছি জানি না! শুধু জানি মন চাইছে আজ তোমাকে গল্প শুনাতে।

আমি খুব চাপা স্বভাবের মানুষ,হৈহুল্লোড়,আড্ডা,ঘুরাঘুরি কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না। সবকিছুতেই বিরক্ত লাগতো। মনে হতো জীবনের এতো অল্প সময়টাকে এগুলোর মধ্যে ব্যয় করে কী লাভ?? কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও আমার আতিশের সাথে বন্ধুত্ব হয়। শুধু বন্ধুত্ব বললে ভুল হবে,বলতে পারো ওকে আমি খুব পছন্দ করি,ভালোও বাসি। মাঝে মাজে তো মজা করে আতিশকে বলিও ও মেয়ে হলে আমি ওকে বিয়ে করতাম।

আমার জীবনে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পড়ালেখা।মেধা ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পড়ালেখা করতে করতে যখনি বোর হয়ে যেতাম তখনি আতিশের কাছে চলে যেতাম। ওর সাথে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগতো। যদিও বা গল্প করার মতো আমি তেমন কথা পেতাম না তবুও এক কথা দুবার তিনবার বলেও ওর সাথে আড্ডা জমাতে চাইতাম। এতে আতিশ কখনোই বিরক্ত হতো না। ও আরো বেশি উৎসাহী হয়ে আমার কথা শুনতো। কিন্তু হঠাৎ করে একজন নতুন কেউ আগমন ঘটে আমার জীবনে। এমন একজন, যার কাছে এক কথা দু’বার তিনবার নয় হাজার হাজার বার বলেও আমি শান্তি পেতাম না,তৃপ্তি পেতাম না। ইচ্ছে করতো পৃথিবার সবার কথা আমি ওকে শুনাবো। ও হবে আমার কথা শুনার কথাপাখি! আজ আমি তোমাকে আমার এই কথা পাখির গল্পই শুনাবো ,অন্ত্রীশা। আমার পত্রীকন্যার গল্প!””

পত্রীকন্যা নামটা শুনে অজান্তেই পালকের দিকে চোখ পড়েছে অন্ত্রীশার।

পালক হাসি হাসি মুখে বললো,

“” তুমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো,আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে আনছি।”””

পালক তাড়াহুড়ো করে পা বাড়াতেই অন্ত্রীশা পেছন থেকে বললো,

“” আপনি কফি বানাতে পারেন?””

জবাবে পালক মুচকি হেসে বললো,

“” হুম,তোমাকে আজ একটা স্পেশাল কফি খাওয়াবো। একটু ওয়েট!””

পাপড়ি বেরিয়ে যেতেই আতিশ দরজার সিটকিনি লাগিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছিলো। নিশ্বাসের গতি অনেকটাই কমে গিয়ে বুকে ব্যথা সৃষ্টি হচ্ছিলো। ফ্যানের পাওয়ারটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই দরজায় নক হওয়ার শব্দ পায়। পাপড়ি এসেছে ভেবে বেশ রাগ নিয়েই দরজা খুলে সে। মনে মনে এটাও ভেবেছিলো এবার একটা না দুটো না তিনটে চড় মারবে সে। কিন্তু দরজায় একজন মাঝ বয়সী লোককে দেখে সে খুব চমকে গিয়েছিলো।

আতিশ হাতে নিজের চাকরির জয়েনিং লেটারটা নিয়ে বসে আছে। তার চাকরি হয়েছে! এটা ভেবেই তার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ এতো খুশি সে জীবনে আর কখনো হয়নি। আতিশের মনে হচ্ছে এই চাকরির পুরো ক্রেডিটটাই তার পাপড়িকে দেওয়া উচিত। ঘরে লক্ষীর পা পড়তে না পড়তেই সুখবর এসে দরজায় হাজির,ভাবা যায়? এই খবর পাপড়িকে দেওয়ার জন্য সে কতবার ফোন হাতে নিয়েছে হিসেব নেই। কিন্তু ঐদিনের ঘটনার পর ও কি আদৌ তার কল রিসিভ করবে? ভাবতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠছে। যদি না ধরে এই টেনশনেই তার রাতের ঘুম উধাও। সাথে অসুস্থতাও!

এভাবে আর কতক্ষণ সে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকবে? মাথাটা পেছনে কাত করে উপরের দিকে তাকিয়ে,বিসমিল্লাহ বলেই পাপড়ির নাম্বারে ডায়াল করেছে আতিশ। কিন্তু ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কেটে দেওয়াতে আতিশ পুনরায় ডায়াল করে পাপড়ির নাম্বার বন্ধ পেল। আতিশ চোখ দুটো বড় বড় করে,নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,, আরে,এতো দেখছি আমার নাম্বার ব্লাকলিস্টে রেখে দিয়েছে!

আতিশ বিছানার চাদর উল্টিয়ে পাল্টিয়ে একটা সিম খুজে পেয়েছে। ওটা ফোনে ডুকিয়ে কল দিতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করলো পাপড়ি। পাপড়ি হ্যালো বলার আগেই আতিশ চিল্লিয়ে উঠেছে,

“” তুই যে এতো অসভ্য,বেয়াদব মেয়ে আমি তো আগে জানতাম না। পালকের মতো ভালো ছেলের বোন তুই কী করে হলি এটাই তো ভেবে পাচ্ছি না,পাপড়ি!””
“” আপনাকে ভাবতে বলেছে কে?””
“” কেন আমার ভাবার জন্য কি এখন তোর কাছে পারমিশন নিতে হবে? তুই কি ভাবনারানী হয়ে গেছিস? তোর কাছে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে অনুমতি নিয়ে তারপর আমাকে ভাবতে হবে?””
“” কেন কল করেছেন,আতিশ ভাইয়া?””
“” কেন কল করেছি মানে? তোর মতো অসভ্য বেয়াদব মেয়েকে আমি কেন কল দিবো? ফোন হাতে নিয়ে দেখি তোর মিসড কল উঠে রয়েছে। কল ব্যাক করে দেখি নাম্বার ব্লাকলিস্টে। নিজেই মিস কল দিবি আবার নিজেই ব্লাকলিস্টে রাখবি?””
“” আমি আপনাকে কল দেইনি। মিথ্যে বলছেন কেন?””
“” এখন তুই আমাকে মিথ্যেবাদীও বানাতে চাস? আর কী কী বানাতে চাস বল,দেখি তোর ভাবনা কতদূরে গিয়ে
জিরোয়!””
“” আমার ঘুম পাচ্ছে,আতিশ ভাইয়া। আপনার কি জরুরি কিছু বলার আছে?””
“” আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এখন নিজের ঘুম দেখানো হচ্ছে? তুই এতো বেড়ে গেছিস,পাপড়ি?”‘
“” আমি কখন আপনার ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম?””
“” ঐ যে ঘন্টায় ঘন্টায় হাজার হাজার কল দিয়ে ডিস্টার্ভ করিস। খাইতে গেলেও কল,পড়তে বসলেও কল,ঘুমুতে ঘেলেও কল,গোসল করতে গেলেও কল,আমার তো মনে হয় তুই আমার বাসর রাতেও কল দিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করবি। তুই কি ভেবেছিস তোর ছককাটা প্লেন আমি বুঝি না? আমিও প্লেন করবো তোর থেকে বেশি বেশি ঘর কেটে ছক কাটবো। বউকে রুমে ঢুকিয়েই মোবাইল,টেলিফোন,টেলিগ্রাম,দরজা,জানালা,ফ্যান,পাখা,লাইট সব বন্ধ করে দিবো!””
“” ফ্যানও বন্ধ করে দিবেন?””
“” হুম!””
“” আপনার বউ তো গরমে মরে যাবে।””
“” আমার বউ মরবে কেন? ফ্যান অফ করলেই মরে যেতে হবে? আমি আছি কী করতে? আমি ফুঁ দিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে তুলবো।””
“” ফুঁ দিয়ে?””
“” দরকার হলে আরো অনেককিছুই করবো। যেমন ধর,আমি ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট লাগিয়ে আমার নিশ্বাস ওকে দিয়ে দিবো।””

আতিশের বউকে নিয়ে গল্প পাপড়ি আর শুনতে পারছে না। গলাটা বসে যাচ্ছে,

“” আমি রাখছি।””
“” রাখছি মানে? তোকে তো আসল কথাই বলা হলো না,এতো তাড়া কিসের তোর?””
“” কী কথা?””
“” আমি আর তোকে পড়াতে পারবো না। আমার চাকরি হয়ে গেছে। তুই অন্য মাস্টার খুজে নিস,বুঝলি? তোর মাথার যে অবস্থা আমি সহ্য করেছি বলে তো অন্যরাও সহ্য করবে না। তাই বলি কী একটা শক্তশাক্ত মাস্টার খুজে…””
“” ওকে!””

আতিশের কথার মাঝখানেই পাপড়ি কলটা কেটে দিয়েছে।

“” দেখো তো কফিটা কেমন হয়েছে!””

অন্ত্রীশার সামনে কফিটা এগিয়ে ধরে আছে পালক। অন্ত্রীশা হাসি দেওয়ার চেষ্টায় কফিটা নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিলো।

“” খেয়ে দেখবে না কেমন হয়েছে?””

অন্ত্রীশা কফিটা ঠোঁটে ছুৃতেই চোখ চকচক করে উঠেছে। পালকের দিকে ফিরে বললো,

“” ধনেপাতা ফ্লেবার??””
“” হুম,এটা আমাকে পত্রীকন্যা শিখিয়েছে। খাওয়ার যোগ্য হয়েছে তো?এই প্রথম বানিয়েছি!””

অন্ত্রীশা আরেকটা চুমুক দিয়ে বললো,

“” দারুন! আপনারটা কোথায়?””
“” আমি কফি খাই না।””
“” তাহলে কফি বানানো শিখলেন কেন?””
“” তাকে বানিয়ে খাওয়াবো বলে।””

অন্ত্রীশাকে ছোট্ট হাসি উপহার দিয়ে পালক গল্প শুরু করে দিয়েছে।

“” তখন আমি থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। কিছুদিনের মধ্যেই ইনকোর্স পরীক্ষা। তুমি নিশ্চয় জানো ইনকোর্সের মার্কসটা কতটা ইম্পর্ট্যান্ট? হ্যাঁ,ভালো ছাত্র হওয়ায় হয়তো ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে ফুল নাম্বারটাই দিয়ে দিতো। কিন্তু এমনি এমনি দেওয়া আমার পছন্দ না। তার উপর আমার মনে হতো নিজের মেধাকে অপমান করা হচ্ছে। তাই আমি খুব মনোযোগী হয়েই স্টাডি নিয়ে বিজি। ঠিক তখনি এক অজানা মেয়ের একটা চিঠি পৌঁছুলো আমার কাছে। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি এতোই সিরিয়াস ছিলাম যে মেয়েদের সাথে আমার কন্টাক্ট হয়ে উঠেনি। বলতে পারো আমি চাইনি এসবে জড়াতে। কিন্তু ঐ একটা চিঠি আমাকে পুরো নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না আমি ঐ চিঠিটা কম করে হলেও ১০০ বার পড়েছিলাম। তখনো কিন্তু আমি চিঠির মালিককে জানতাম না। নিজের পড়ালেখা,পরীক্ষা সব ভুলে গিয়ে চিঠির মালিককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ঠিক তখনি তার দ্বিতীয় চিঠি। আর আমার প্রেমে পড়ার দ্বিতীয় ধাপ!””
“” চিঠিতে কি এমন ছিলো যে আপনি প্রেমে পড়ে গেলেন?””
“” আই ডোন্ট নো। ইনফেক্ট সেখানে প্রেম নিয়ে কোনো বক্তব্যও ছিলো না। কোনো প্রেম নিবেদনও ছিলো না। তবুও আমি প্রেমে পড়ে ছিলাম। কেন পড়েছিলাম আমি জানি না। তবে এতো দিনে এটা বুঝেছি,সত্যিকারের প্রেমে পড়ার মধ্যে কোনো কারণ থাকে না। যে প্রেমে পড়াই কারনলণ থাকে সে প্রেম কখনোই সত্যি হতে পারে না। এক কথায় ওটা প্রেম নয়,প্রেমের মুখোশ পড়া অভিনয়!””
“” তারপর?””
“” তারপর আমিও ওকে চিঠি লিখলাম। আমি ওর প্রতি এতোই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে আমি থার্ড ইয়ারে দু সাবজেক্টে ফেল! তুমি ভাবতে পারছো? যে ছেলে পুরো ভার্সিটির মধ্যে টপ ওয়ানে ছিলো সেই ছেলে দু সাবজেক্টে ফেল!””
“” সিরিয়াসলি?””

অন্ত্রীশার প্রশ্নে পালক শব্দ করে হেসে উঠলো,

“” হুম,তোমার মতো সবাই এমন অবাক হয়েছিলো। আমার প্রিনসিপাল অফিস রুমে,আমাকে পুরো দুঘন্টা দাঁড় করিয়ে নিজে পায়চারি করেছেন আর বলেছেন,এটা কী করে হতে পারে পালক? ওহ! মাই গড। উনাকে দেখে আমার অনেক মায়া হয়েছিলো কিন্তু আমি কী করবো বলো,আমি তো তখন পত্রীকন্যার রোগে ভুগছিলাম,যে রোগের ওষুধ একমাত্র আমার পত্রীকন্যাই দিতে পারে। আর সে তার নেক্সট চিঠিতে ওষুধ বানিয়েও ফেলেছিলো। ও জানিয়েছিলো যদি আমি এই ব্যর্থতা কাটিয়ে ফাইনাল ইয়ারে সব থেকে ভালো রেজাল্ট করতে পারি তবেই ও আমাকে দেখা দিবে।

এই এক বছরে আমি ওকে দেখার জন্য আকুল হয়ে পড়েছিলাম,আমার ওকে খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করতো,চোখের সামনে বসিয়ে দেখতে ইচ্ছে করতো,ও যখন চিঠি লিখে তখন ওকে কেমন দেখায়? যখন কথা বলে তখন কেমন দেখায়,যখন হাসে তখন কেমন দেখায়,উফ! সবকিছুতেই একটা ছটফটানিতে ভুগতাম। আর যখন ও বললো,ও আমার সামনে আসবে তখন মনে হয়েছিলো আমি আর পৃথিবীতে নেই,অন্য কোথাও চলে এসেছি যেখানে সুখ আর সুখ। আর এই সুখকে অর্জন করতেই আমি আবার দিনরাত এক করে পড়া শুরু করে দিলাম!
“” চিঠিতেই এ অবস্থা!””
“” হুম, ধুমচে পড়ার মাঝে মাঝেও আমি পত্রীকন্যার পত্রে হারিয়ে যেতাম। তখন ও সপ্তাহে ১ টা করে চিঠি লিখতো। আর এই একটা চিঠিই আমি সাতদিনে নাহলেও ৭০০ বার পড়তাম। প্রিপারেশন বেশ চাংগা করেই হলে বসি। একে পরীক্ষা এগুচ্ছে তো পত্রীকন্যাকে দেখার জন্য আমার হার্টবিটগুলোও গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবেই পরীক্ষা চলাকালীন আমি বেকে বসি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কম করে হলেও তিনমাস পর রেজাল্ট দিবে। আর এতদিন ওয়েট করার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। তাই পত্রীকন্যাকে আমি চিঠি লিখলাম আমার লাস্ট এক্সাম,ভেলেন্টাইনস ডে তে আমার ওকে চাই। কিন্তু!””
“” কিন্তু?””
“” কিন্তু আমার চিঠির কোনো উত্তর আসেনি। আমি আবার ভেংগে পড়ছিলাম। আমি ভাবছিলাম হয়তো ও রেগে গিয়েছে,অভিমান করেছে তাই আর চিঠি লিখেনি। এদিকে আমার লাস্ট এক্সামও চলে আসছিলো। তার উপর ওর রাগ,চিঠি না পাওয়া সবকিছু নিয়ে আমি ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। তখনি মনে হলো ও যদি আমার কাছে আসতে না চায় আমি ওর কাছে যাবো। আমার হৃদয়ের সবটা ভালোবাসা দিয়ে ওর রাগ ভাংগাবো।

আতিশ আর কাদিরকে নিয়ে লেগে পড়ি পত্রীকন্যার খোঁজে। ও আমাকে এতো চিঠি লিখেছে কিন্তু কোথাও এমন কিছু লিখেনি যে ও কে খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম তখনি আতিশের মাথায় টুপ করে একটা বুদ্ধি চলে আসলো। সেই বুদ্ধির জোরেই জানতে পারলাম আমার পত্রীকন্যা আমার ক্লাসমেট। আরেকটু জোরালোভাবে বুঝার জন্য ভালো করে ঘাটতেই দেখলাম মেয়টারও মিষ্টি রঙটা খুব পছন্দ যেটা আমার পত্রীকন্যারও ছিলো। ব্যস,ভেলেন্টসইনস ডে তে ওকে প্রপোস করে সারপ্রাইজ করে দিলাম। ও এতো বেশিই সারপ্রািজড হয়েছিলো যে আমার উপর যে রাগ করেছিলো ওটাও ভুলে গিয়েছিলো।””

পালক কথার ছলে অন্ত্রীশার দিকে তাকাতেই দেখলো ও পলকহীনভাবে পালকের দিকে তাকিয়ে আছে,

“” তুমি কি আমার কথা শুনছো অন্ত্রীশা?””
“” হুম! তারপর কী হলো? আপনার পত্রীকন্যার রোগ ভালো হয়েছিলো?””

পালকের মুখটা মেঘে ঢেকে গিয়েছে। অন্ত্রীশা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে,আকাশেও মেঘ জমে গেছে।

“” কী হলো বলছেন না যে?””
“” না,ভালো হয়নি। আমি আজও পত্রীকন্যার রোগে ভুগছি। আমার পত্রীকন্যা চিঠিতেই ভালো ছিলো,চিঠির পত্রীকন্যা আমাকে কখনো কষ্ট দেয়নি। কিন্তু যখন ও চিঠি থেকে বাইরে চলে এলো তখনি ওর মধ্যে আমি অন্য কারো অপস্থিতি টের পেতাম। চিঠি পড়তে পড়তে আমার মনের চোখে যে পত্রীকন্যাকে এঁকেছিলাম তার সাথে বাস্তবের কোনো মিল ছিলো না। কিছুদিনের মধ্যেই আমার প্রতি ওর অবহেলা,বেখেয়ালি,অযত্ন তৈরি হতে থাকে। নানাভাবে আমাকে অপমান করতে থাকে। কিন্তু এতো কিছুর পরও ওকে হারানোর কথা আমি ভাবতে পারিনি,ওর মতো হয়ে চলার চেষ্টা করেছি,ওর মতো করে ও কে ভালোবাসার চেষ্টা করছিলাম,তাও আমি ব্যর্থ হয়েছি। খুব ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলে সে। সেদিন আমি কেঁদেছিলাম,অনেক কেঁদেছি,ইচ্ছে করছিলো পৃথিবীর সবকিছু ভেঙ্গেচুড়ে ফেলি। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি,ওর মুখোমুখি হয়ে ছোট্ট একটা প্রশ্নও করতে পারিনি,কেন আমাকে ঠকালো?

কস্ট কখনোই নিজের মধ্যে চেপে রাখতে নেই,তাহলে ছোট্ট কষ্টটাও পাহাড় সমান হয়ে নিজের উপর ভেংগে পড়ে। আর আমি সেটাই করেছিলাম যার ফলে দিনে দিনে আমার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। একটা বদ্ধঘরে নিজের জীবনকে আটকে ফেলেছিলাম,এমন অবস্থায় আব্বু আমাকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলো। সেখানে গিয়ে আমি নতুন কিছু অনুভব করলাম। আমার মনে হতে কাগলো পত্রীকন্যা চলে গিয়েছে বলে আমার কষ্ট হচ্ছিলো না। কষ্ট হচ্ছিলো এইটা ভেবে, পত্রীকন্যা আমাকে কেন চিঠি লিখছে না??

তার কিছুদিন পরই খবর আসে আব্বু রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।

পালকের কন্ঠ চেন্জ হয়ে আসছে ভেবে অন্ত্রীশা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,

“” কফিটা অসাধারণ ছিলো,রেসিপিটা একটু বলবেন,আমিও শিখে নিতাম,ধনেপাতার কফি!””

পালক অন্ত্রীশার দিকে ঘুরে বললো,

“” শিখাতে পারি,যদি তুমি আমার বন্ধু হও। তোমাকে বউয়ের মর্যাদায় হয়তো রাঙাতে পারিনি কিন্তু বন্ধুত্বের অমর্যাদা আমি করবো না। বন্ধু হবে আমার?””

অন্ত্রীশা পালকের কথা উপেক্ষা করে চলে যেতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। পালকের চোখে চোখ রেখে বললো,

“” আপু আপনার পত্রীকন্যা নয়। আপনার সাথে আপুর যা হয়েছে তার জন্য সে লজ্জিত,অনুতপ্ত। অনুতপ্তের আগুনে আপু নিজেকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছে। আপুকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন!””

অন্ত্রীশার কথাই পালকের সবকিছু থমকে গিয়েছে। না সবকিছু থমকে যায়নি,শুধু সে থমকে গেছে,আর বাকি সব তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে,যদি অনিকশা তার পত্রীকন্যা না হয় তাহলে তার পত্রীকন্যা কে?

পালক রাগে ফুসতে ফুসতে অনিকশার নাম্বারে কল দিয়েছে,অপাশ থেকে রিসিভ হতেই পালক চিৎকার করে বললো,

“” আমি তোমাকে এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। রাইট নাউ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here